বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
লেখকঃ মোহাম্মদ শাহজামান শুভ।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই জলিল সাহেবের মুখখানা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, আজ তিনি বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাধারণত অফিস না থাকলে তিনি অলসতার সম্রাট হয়ে পড়েন। বিছানায় গড়াগড়ি, হাতে মোবাইল, কখনো টিভি চালিয়ে সংবাদ শোনা আবার খানিক বাদে রাজনৈতিক আলোচনায় ফুঁসে ওঠা—এই নিয়েই তাঁর ছুটির দিনগুলো কাটে। কিন্তু আজ সকালটা অন্যরকম।
চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে তিনি বললেন—
“শোনো, আজকে ছুটির দিন। আমি ঠিক করেছি এই দিনটা একদম শান্তিতে কাটাবো।”
স্ত্রী ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বিয়ের পঁচিশ বছর পরেও এ মানুষটার কোনো শান্তির দিন আসে নি, আসবেই বা কীভাবে! সংসারের ভেতরে তিন সন্তানের কলরব, বাজারে দৌড়, আত্মীয়-স্বজনের ফোন, বিদ্যুতের লোডশেডিং—এসবের মাঝে শান্তি নামের পাখিটা কোথায় উড়ে যাবে? তবু তিনি হেসে বললেন,
“আচ্ছা, আজ আবার কী প্ল্যান করেছ?”
জলিল সাহেব বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন,
“তিনটা সিনেমার টিকিট কেটে এনেছি!”
স্ত্রী খুশিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন—আহা, মানুষটা মাঝে মাঝে কী মিষ্টি চমক দিতে জানে। হয়তো এতদিনের বকাঝকার ক্ষতিপূরণ করতে চাইছে। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
“তিনটা টিকিট! তুমি, আমি আর বাচ্চারা—সবাই একসাথে সিনেমা দেখতে যাবো?”
জলিল সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,
“না না, তুমি আর বাচ্চারা যাবে। আমি বাসায় থাকব।”
স্ত্রীর চোখ কপালে উঠল।
“মানে? তুমি টিকিট কাটলে, কিন্তু যাবে না?”
“ঠিক তাই।” জলিল সাহেব হেসে বললেন, “আমার শান্তির দিনটা নষ্ট করতে চাই না। ঘরে আমি থাকব, বাইরের ভিড়ভাট্টায় না গিয়ে তোমরা বিনোদন নেবে। তাতে সংসারেও শান্তি থাকবে।”
স্ত্রী এক দমকা হাসি চাপতে গিয়ে গম্ভীর হলেন। বউরা কিন্তু এমন কথা সহজে হজম করে না। তিনি বললেন,
“তাহলে টিকিট কেটে সংসারের শান্তি কিনে এনেছ?”
জলিল সাহেব ঠোঁট উঁচিয়ে বললেন,
“সংসারের শান্তির জন্য এর চেয়ে সস্তা ডিল আর কোথায় পাওয়া যায় বলো তো?”
বাচ্চারা দৌড়ে এসে খবর শুনে খুশিতে লাফালাফি শুরু করল। বড় মেয়ে বলল,
“ওহ্ বাবা, আজকে তাহলে আমরা থ্রি-ডি মুভি দেখতে যাবো? মজা হবে!”
জলিল সাহেব গম্ভীর শিক্ষক সেজে বললেন,
“হ্যাঁ, তোমরা যেও। তবে মনে রেখো, শান্তিপূর্ণভাবে দেখতে হবে। সিনেমাহলে হৈচৈ কোরো না।”
স্ত্রী মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
“শান্তি চাওয়ার জন্য মানুষ টিকিট কেটে পরিবারকে সিনেমা পাঠায়, এ নতুন নিয়ম হলো।”
সকালের নাশতা শেষে সবাই যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন জলিল সাহেব নতুন করে সুখী মানুষের মতো আচরণ করছিলেন। বাজারের তালিকা লিখে দিলেন স্ত্রীর হাতে—“ফিরতি পথে বাজারটা করে নিয়ে আসবে।” আবার বড় ছেলেকে বললেন—“গাড়ির জানালার পাশে বসবে, সিটে দাঁড়িয়ে চেঁচাবে না।”
স্ত্রী খোঁচা মেরে বললেন,
“তুমি সিনেমায় না গিয়ে বাজারের তালিকা দিয়ে শান্তি খুঁজছ, এ তো অদ্ভুত দর্শন।”
জলিল সাহেব শান্তির গুরু হয়ে বললেন,
“শান্তি মানে কী জানো? যেখানে ঝগড়া নেই, হৈচৈ নেই, শুধু প্রশান্তির শব্দ আছে। আমার শান্তির সাউন্ডট্র্যাক হলো—বাড়ির ভেতরে একাকী পাখির ডাক আর ছাদের উপর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাওয়া।”
সবাই সিনেমা হলে চলে গেলে সত্যি সত্যিই বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। জলিল সাহেব খালি ঘরে চেয়ারে বসে হাত-পা মেলে দিলেন। টিভি খুলে দেখলেন ক্রিকেট ম্যাচ, তারপর চ্যানেল ঘুরিয়ে একেবারে রান্নার অনুষ্ঠান পর্যন্ত গেলেন। নিজের মনে হাসলেন—“এই শান্তি কি আমি কোনোদিন পেয়েছি?”
কিছুক্ষণ পরে তিনি গরম চা বানালেন, কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। হঠাৎই মনে হলো, স্ত্রী না থাকলে ঘরটা কেমন ফাঁকা লাগে! ছেলেমেয়েদের কলরব নেই, কারো হৈচৈ নেই, অথচ শান্তির বদলে এক ধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনই ফোন এলো স্ত্রীর।
“শোনো, হলে ঢুকেছি। কিন্তু টিকিট ভুল হলে কেটেছ। এই শোটা ডাবিং হিন্দি মুভি, পুরো হলে হট্টগোল!”
জলিল সাহেব চমকে উঠলেন।
“আরে, আমি তো ভেবেছিলাম বাংলা সিনেমা! তাহলে তো তোমরা শান্তিতে বসে দেখতে পারছ না।”
স্ত্রী হেসে বললেন,
“তোমার শান্তির জন্য আমাদের অশান্তি কিনে দিলে?”
বাচ্চাদের চিৎকার পেছন থেকে শোনা যাচ্ছিল। ছেলে বলছিল,
“বাবা, সিনেমায় মারামারি চলছে! একদম গর্জন!”
ফোন কেটে গিয়ে জলিল সাহেব নিজের মনে হাসলেন।
“এটাই সংসারের ভারসাম্য। একপাশে অশান্তি, অন্যপাশে শান্তি। দুটো মিলে আসল সুখ।”
দুপুর গড়িয়ে গেল। তিনি একা খাওয়া-দাওয়া সেরে সোফায় আধশোয়া হয়ে রইলেন। বাইরে পাখির ডাক, হাওয়া বইছে—কিন্তু মনের ভেতরে যেন কিছু একটা খচখচ করছে।
অবশেষে সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তানরা ফিরে এলো। সবাই হৈচৈ করে ঢুকল ঘরে। ছেলে বলল,
“বাবা, তুমি মিস করেছ! সিনেমায় হিরো এমন ডায়লগ দিল—‘আমি শান্তি চাই না, আমি ন্যায় চাই!’—সারা হল হাততালি দিয়েছে।”
জলিল সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“বাবা, আমি শান্তি চাই, ন্যায় চাই, দুটোই চাই। তবে তার জন্য টিকিট কেটে সংসারের ভারসাম্য রাখতে হয়।”
স্ত্রী বাজারের ব্যাগ নামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“তাহলে শোনো, আগামী শুক্রবার আমিই তিনটা টিকিট কাটব। তুমি আর বাচ্চারা যাবে, আমি বাসায় থেকে শান্তি উপভোগ করব।”
বাচ্চারা হো হো করে হাসল। জলিল সাহেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন,
“আচ্ছা, সংসারে শান্তির নামে এভাবে যদি সিনেমার টিকিট লেনদেন হয়, তাহলে আমাদের সংসার একদিন সিনেমাহলেই পরিণত হবে!”
তারপর সবাই মিলে হাসিতে ফেটে পড়ল। সেই হাসির ভেতরেই সংসারের আসল শান্তি নেমে এলো।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now