বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
লেখবকর নাম-মাজহারুল মোর্শেদ
অবরুদ্ধ জীবনের গল্প -১৭
চারিদিকে অন্ধকার, এতটাই অন্ধকার যে চোখ খোলা আর না খোলার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তবুও চোখ দু’টো খোলা থাকলে মাথার স্নায়ু গুলো দ্রুত কাজ করে। রাত কতটা হয়েছে তা অনুমান করার কোন উপায় নেই। অন্ধকারের এ ভয়ংকর রূপ সে জীবনে আর কোন দিন দেখে নাই। মৃত্যুর মত ভয়ংকর অন্ধকার যেন পৃথিবীর সবকিছুকে গ্রাস করে ব্লাকহোলের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই তার মনে হচ্ছে সে যেন অন্ধধকারে ভেসে ভেসে অনন্ত কালের জন্য কোন অন্ধকারের অতল গহব্বরে ঢুকে যাচ্ছে, যেখানে কোন দিন আলোর সন্ধান মিলবে না। পাশের জঙ্গলে কয়েকটা শিয়াল হুক্কা-হুয়া করে একসাথে ডেকে ওঠে, অমনি বাড়ির কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে গোটা পাড়া মাথায় তোলে। শিয়াল-কুকুরের মিলিত খোলাহলে পাড়ার সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার সাথে আবিয়ারও চৈতন্য ফিরে আসে। কিন্তু তার কোন কিছু মনে নেই, সে কোথায় আছে বুঝে উঠারও উপায় নেই। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে কোন দিকে শিয়াল ডাকছে সেটা অনুমান করার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ এখন সে টেরপেল শিয়ালের ডাক আসছে পূর্বদিক থেকে। কিন্তু তাদের বাড়ির পূর্বেিক কোন ঝাড়-জঙ্গল নেই তাই সে নিশ্চিত হল এটা তাদের বাড়ি নয়। ডান পাশ থেকে পুরুষালি গায়ের গন্ধ তার নাকের ভিতরের সুপ্ত অনুভুতি গুলোকে জাগিয়ে তুলছে, তাইসে চোখ বন্ধ করে কোন কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। এমন সময় তার পাশে নাক ডাকার শব্দ পায়, এবার সত্যি সত্যি ভয়ে তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে ঘরের ভেতর আলো আসার জন্য অধীর চিত্তে অপেক্ষা করতে থাকে, এমন সময় আধামন ওজনের একটা ভৌতিক হাত এসে তার বুকের উপর পড়ে। সে প্রাণপণে হাতটাকে তার বুকের উপর থেকে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই সে হাত সরাতে পাচ্ছে না। এটা স্বপ্ন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবিয়া নিজের হাতে একটা চিমটি কাটে। এবার সে বুঝতে পারে এটা কোন স্বপ্ন নয়, তাই নিজেকে বাঁচার জন্য অপর পাশে ঘুরে শোয়।
কিছুক্ষ পর ভোরের আলো ফুটে উঠলে আবিয়া দেখে তার পাশে বৃদ্ধ গোছের একজনমানুষ নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার নাক থেকে স্যালো মেশিনের মত ঘটঘট করে শব্দ বের হচ্ছে। এতক্ষণে মনে পড়ল, রাতে মা তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটা টকটকে লালশাড়ি পরিয়ে দিয়ে ইশারা করেছিল কোন কথা না বলতে। বাহিরে কত গুলো লোকের গলার আওয়াজ তার কানে আসে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, তিনকুড়ি মহাজন তার লোকজন নিয়ে এসেছে তাকে বিয়ে করতে। একবার তার মনে হয়েছিল যে, সে পালিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় পালাবে? কতো দূরেই বা যেতে পারবে সে? তিনকুড়ির লোকজন তাকে ঠিকই ধরে নিয়ে আসবে। মাঝখানে তাকে না পেলে তিনকুড়ি তার মা বাবাকে মেরে ফেলবে। মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে কিন্তু সেই কান্নার কোন শব্দ ছিলো না, অনেকটা শব্দহীন, নীরব কান্না। কান্নার মাঝেও নিষেধাজ্ঞা আছে। মা শুধু একটা কথাই তাকে বলে যে, ‘তোর কপালে এ রকম হবে, সেটা মুই আগোত জানির পাইলে আতুর ঘরেই তোর গলা টিপি মারি ফেলানু হয়’। মায়ের মুখে এ কথা শুনার পর আবিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আর কোন কিছুই সে বলতে পারে না। পরনে তার কোন শাড়ি নেই, সেই লাল শাড়ি গেল কোথায়? মনে মনে ভীষণ লজ্জাও পেল সে, ভাগ্যিস মা সালোয়ার কামিজের উপরই শাড়িটা কোন রকমে পেঁচিয়ে দিয়েছিল।
বিছানায় শুয়ে যতোদুর হাতে পাওয়া যায় সে শাড়িটাকে খুঁজতে লাগলো অবশেষে পায়ের কাছে সেটা খুঁজে পাওয়া গেলো। চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে শাড়িটা পড়ে নিলো। খোঁপার কাঁটাটি বালিশের নিচ থেকে আনতে যেয়ে মনের কৌতুহল বশত সে মানুষটার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে, পাহাড়ের মত উঁচু আড়াই মন ওজনের একটা ভুড়িওয়ালা মানুষ। হায় আল্লাহ! এই ভুড়িওয়ালা বুড়ো লোকটা সারারাত তার পাশে শুয়েছিল! একথা ভাবতে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠে। দু’চোখ দিয়ে অঝরে ঝরে পড়তে লাগলো অশ্রু। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে- হায় আল্লাহ! তোমার এত্তোবড় পৃথিবীতে আমার জন্য কোথাও একটু খানি জায়গা খুঁজে পেলে না? এত্তো নিষ্ঠুর, এত্তো কৃপণ তুমি? জন্মের পর থেকেই দিনের পর দিন অনাহারে, অর্ধাহারে, কতরাত না খেয়ে কেটে গেছে। সাবানের অভাবে গোসল হয় নাই, তেলের অভাবে মাথার চুল ধোয়া হয় নাই, কাপড়ের অভাবে কোত্থাও বেড়ানো হয় নাই, জীবনের সব সখ আল্লাদ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। কই, কোন দিন তো তোমার কাছে কিচ্ছু চাই নি? শুধু একটি মঙ্গলময় আনন্দঘণ দিন চেয়েছিলাম। তুমি আমার এইটুকু প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলে না? কেন? তুমি না অনন্ত অসীম প্রেমময়, দয়ার সাগর? আমার জন্য কি তোমার এতো টুকু দয়া হলো না? দরিদ্রতার রোষানলে জীবনের সুখ-শান্তি, ঐশ্বযর্, বৈভব সবি তো চুলোয় গেছে। একটা ভালো ঘরে বরে বিয়ে হলে হয়ত সে দুঃখ-কষ্ট অনেকটা কমে যেতো, কিন্তু তুমি সেটিও হতে দিলে না। আমাকে কাঁদিয়ে তুমি কি সুখ পাও ? অবলা নারীর চোখের জলের এতো কাঙ্গাল তুমি? আমি কি এমন অপরাধ করেছিলাম তোমার কাছে? যার শাস্তি তুমি আমাকে এভাবে দিলে?
আবিয়ার কান্নার শব্দে তিনকুড়ি খাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রচণ্ড রাগে, ক্ষোপে অগ্নিশর্মা হয়ে বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে আবিয়ার মাথার চুল ধরে এটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়, তারপর লাথির উপর লাথি মেরে মেঝের এপাশ থেকে ওপাশে নিয়ে যায়। আবিয়া কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে তিনকুড়ি খাঁর কোমর ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে তিনকুড়ি টলতে টলটে বিছানায় পড়ে যায়। আবিয়া প্রচণ্ড ঘৃণায়, ধিক্কারে তার মুখে যতোগুল থুথু জমেছিল সবগুলোই তিনকুড়ির মুখে ছিটিয়ে দেয়। এই অপমানে তিনকুড়ি আবারও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। পাশ থেকে একটা বাঁশের কঞ্চি এনে আবিয়াকে আবার মারতে শুরু করে। মারের চোটে আবিয়া চিৎকার করে বলতে থাকে-মাগো, ও-মা, কে কোথায় আছ- আমাকে বাঁচাও, ও বাবা আমাকে বাঁচাও, আমাকে মেরে ফেলল, আমাকে মেরে ফেললো। আবিয়া জীবন বাঁচাতে এক লাফে ঘর থেকে বের হয়ে আঙ্গিনায় এসে বেহুশ হয়ে পড়ে যায়। আবিয়ার আঙ্গুর ফলের মত টস-টসে ফর্সা শরীরে রক্ত জমে অস্ত যাওয়া সূর্যের মত রক্তলাল হয়ে উঠে। আশে-পাশের বাড়ির সব মানুষ আঙ্গিনায় এসে জড়ো হয়। তিনকুড়ি খাঁ রাগ সামলাতে না পেরে বামহাতে লুঙ্গির খুলে যাওয়া গিঠটা শক্ত করে ধরে, ডানহাতে বাঁশের কঞ্চি নিয়ে আবার আবিয়াকে মারতে যায়। সবাই তাকে ধরা ধরি করে থামিয়ে দেয়। তিনকুড়ি খাঁ পরনের লুঙ্গিটার নিচের অংশ তুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে-‘মাগীর বাচ্চা মাগি, সারারাত অজ্ঞান হয়া পড়ি থাকিল আর সকালে উঠি ওর বাপ-মাও মরা কান্দন শুরু করি দেইল। ফকিরের ছওয়ার এতো দেমাক। ওয় জানে না, বিশ হাজার টাকা দিবার না পায়া ওর বাপ মোর সাথে বিয়া দিচে।
তিনকুড়ি খাঁর বড়ো বোউ রহিমা তাড়াতাড়ি এক বালতিতে পানি এনে আবিয়ার মাথায় ঢালতে শুরু করে, কিন্তু কিছুতেই তার জ্ঞান ফিরছিল না, মরা মানুষের মতো দু’পাটি দাঁত একখানে লেগে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে কোন ভাবে খুলছে না। কে যেন এক চামুচ লবন এনে তার মুখে ঢেলে দিলো। রহিমা চামুচের হাতল দিয়ে আবিয়ার দাঁতের পাটি আলগা করার চেষ্টা করছে। কেউ এসে তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে। এভাবে অনেক্ষণ চেষ্টার পর আবিয়ার জ্ঞান ফেরে, সে চোখ মেলে দেখে আশে পাশে অনেক মানুষ কিন্তু কাউকেও সে চেনে না। মধ্য বয়সের একজন মহিলা আনেকটা তার মায়ের মত, তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে।
আবিয়া যখন বেহুস হয়ে মাটিতে পড়েছিল সবাই তাকে দেখে আর বলা বলি করে- আহা! এতো সুন্দর একটা হুর পরীর মতো ছওয়া তার কপালোত কি না এই লুচ্চা বুড়া পাঠা, সুদখোর পশুটা আসি জুটিল। হায় আল্লাহ! তোর কি কোন বিচার আচার নাই? আরে পশু! এমন হুর পরীর মত একটা ছওয়া যে তোর ভাগ্যে জুটিছে সেটাই তোর চৌদ্দ গোষ্ঠির কপাল।
পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা মহিলা আবিয়াকে দেখে বলে- হায় আল্লাহ! এমন করি কি কাঁও বোউকে মারে? মানসিতো চোর-ডাকাতকেও এমন করি মাওে না। আল্লাহ তুই এর বিচার করিস। ওই সুদখোর মরা যেন মানসির হাতোত মাইর খ্যায়া মরে, রাস্তায় ঘাটে পড়ি মরে। তার লাস যেন কুকুর-শিয়ালে ছিঁড়ি ছিঁড়ি খায়।
দেলজান বুড়ি এ জগতে তার কেউ নেই, এবাড়ি ওবাড়ি ভিক্ষা করে যা পায় তা দিয়েই কোন রকমে বেঁচে থাকে। যে একমুঠো চাল বেশী দেয় সেই জগতের ভালো, আর যে দেয়না তার চেয়ে খারাপ এ জগতে আর কেউ নেই। গোটা গ্রামে তার দুর্নাম করে বেড়ায়। দেলজান বুড়ি- আবিয়ার ফুলের মতো দেহটা মাটিতে বেহুস হয়ে পড়ে থাকেতে দেখে তার কাছে যায়। চারিদিকে ঘুরে ঘরে তার আবছা আবছা চোখে ভালো করে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে-“ওরে মোর আল্লাহ! এইটা যে হামার আব্দুলের বেটি! বড় রাস্তার ওপারে নদীর পারোত ওমার বাড়ি। আব্দুলটা কি ভাল্ মানসি আর তার বেটির কপালোত এইটা কি হইল। তায় কতো কষ্ট করি নিজে না খ্যায়া ছওয়াগুলাক বড়ো করিল, লেখা পড়া শিখাইল। জীবনে কোন দিন কোন ছওয়ার গায়োত একটা ফুলের টোকাও দেয় নাই আর সেই ছওয়া আজি মানসির হাতোত মাইর খ্যায়া মরে। হায় আল্লাহ! তুইকি কানা? তুই চোখে দেখিস না।
দেলজান বুড়ির আহাজারির শব্দে আবিয়ার জ্ঞান ফিরে আসে, সে উঠে বসার জন্য চেষ্টা করে কিন্ত রহিমা তাকে ধরে রাখে।
দেলজান বুড়ি আবিয়ার মুখের কাছে যেয়ে বলে-ও বোইন, তুই কি মোক চিনিবার পাইছিস?”
হ্যাঁঃ দাদি, তোমাক মুই চেন। দাদি তোমা এ কথাগুলা বাড়ি য্যায়া কাকো কন না। তাহলে আব্বা-আম্মা খুব কষ্ট পাবে। কান্দি মরি যাবে।
যে পশুটা তোক গরু-ছাগলের মতো ধরি মারিল আর তুই তাকে বাঁচের জন্য এমন নাগাইছিস বোইন?”
না দাদি, যায় মোক মারচে তার বিচার আল্লায় করিবে। ওই বুড়া মোর গায়ে যতোটা আঘাত করছে সেটা আরও দ্বিগুন হয়া একদিন তার গায়োত পড়িবে।
হ্যাঁ বোইন তুই ঠিক কতাই কইছিস, তোর মা যদি শুনে যে, তোক মারি অজ্ঞান করি ফেলাইছে, তাহলে তোর মা-বাপ কান্দি মরিবে। মুই তামান জানো। ক্যানে যে আল্লাহ তোর কপালোত এতো দুঃখ নেখিল। আচ্ছা বোইন মুই এ্যালা যাঁও, কাইল একবার আসি তোক দেখি যাইম।
আচ্ছা দাদি যাও।
আমাদের সমাজে প্রত্যাহ আবিয়ার মতো হাজারও নারী নির্যাতিত হচ্ছে ঘরে-বাইরে, রাস্তা-ঘাটে। গৃহে পুরুষ কর্তৃক নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে নারী ভাবে বাপের বাড়িতে চলে গেলে স্বস্তি মিলবে। কিন্তু হায়! ভয়াবহ নিপীড়ন, লাঞ্ছনা পেরিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে স্বামীর ঘরেই তাকে ফিরে আসতে হয় আবারও। কারণ তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নির্যাতন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, নিপিড়নের ক্ষেত্র সবখানেই। কোথাও স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই, আদর ভালোবাসাতো নেই-ই।
কতো নারীই যে বুক সমান হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, অবহেলা, আক্ষেপ নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করে, সে হিসেবটা শুধু ভুক্তভোগীই জানে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অবহেলা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, পারষ্পারিক অবিশ্বাস, চাওয়া পাওয়ায় অমিল ইত্যাদি কারণও সংসারে অশান্তি আনে। জীবন যদি হয় নারী, তাহলে আলোর মুখ দেখা সত্যিই আরও কঠিন হয়ে যায়। কারণ এই সমাজে ভ্রুণ যখন লিঙ্গতে রূপান্তরিত হয় তখনই নারীর ভাগ্য অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায়।
জীবনের বাঁকে বাঁকে বহুমাত্রিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত নারীদের সাধ আর সাধ্য অধরাই থেকে যায়। নির্মম বাস্তবতার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে স্বকীয়তাই ভুলতে বসে নারী। জীবন যুদ্ধে পাড়ি দিতে যেয়ে নারী পদে পদে হোঁচট খায়, আবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। তবে তা ওই চেষ্টা মাত্রই। যে সমাজ তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে থাকা বানরের মতো নারীকে পেছনে টানতে থাকে, সেখানে নারী জীবন অপাংক্তেয়ই। অথচ প্রতিটা মানুষের জীবন তার নিজের। নারীর অধিকার আর মর্যাদা অন্য কোথাও শেকলে বাঁধা। সেই বাঁধনের দৃঢ়তা বা শিথিলতার উপর নির্ভর করে তার মান মর্যাদা, আকাঙ্ক্ষা, সম্ভ্রম প্রায় সবকিছুই। যেন বাড়ির উঠোনে লাগানো সূর্যমুখী ফুল। সূর্যের ন্যায় পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা সময় অবসন্ন মনে ঝরে যায়। নারী যেন ঠিক সেই ফুলের প্রতিচ্ছবি। কন্যা জায়া জননীর প্রতিচ্ছায়া দিয়ে যতোই মহিমান্বিত করা হোক না কেন, পশ্চাৎপদ প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এ সমাজে নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাকে পদে পদে শৃঙ্খল পড়ানো হয়, পেরোতে হয় নানামুখী অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা। ধর্মীয় কাঠামোর মোড়কে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়।
তিনকুড়ির বড়ো বোউ রহিমা আবিয়াকে তার নিজের ঘরে নিয়ে যায়। আবিয়ার নিস্পাপ মুখখানা দেখে তার মাতৃসুলভ মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। ব্যথা কমানোর জন্য সে শাড়ির আঁচল পোটলা করে মুখের ভাব দিয়ে মারের আঘাত গুলোতে আলতো করে সেক দেয়। কিন্তু তাতে কি আর ব্যথা সারে? কিছুক্ষণ পর আবিয়ার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসে। রহিমা ছোট ভাই মোহনকে খবর দিয়ে পাঠায় ডাক্তার আনার জন্য। মোহন ছোট বেলা থেকেই রহিমার কাছে থাকে। পড়াশোনার ফাঁকে সে তার ভগ্নিপতি তিনকুড়ি মহাজনকে ব্যবসায়ের কাজে সাহায্য সহযোগিতা করে। সে বুবুর অসুস্থতার কথা শোনা মাত্র আর এক মুহুর্ত দেরি না করে প্রফুল্ল ডাক্তারকে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
ডাহাগ্রাম-অঙ্গারপোতার ডাক্তার মানেই প্রফুল্ল ডাক্তার। কবে কোথায় তিনি ডাক্তারি পড়েছেন সে কথা কেউ জানে না। তবে চিকিৎসায় তার হাত খুবই পাকা। ভারতের কুচলিবাড়িতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ধাপড়ার হাটেও একজন পল্লী চিকিৎসক হিসেবে বেশ নাম ডাক আছে তার। চেম্বারে রোগী গিজগিজ করে। জমের কাছে চলে যাওয়া রোগীকেও না কি তিনি অনেকবার টেনে হিঁচড়ে ফিরে এনেছেন এমন কথাও গ্রামবাসীর মুখে মুখে শোনা যায়। যাহোক-ডাক্তার সাহেব রোগীকে খুব মনোযোগের সাথেই দেখলেন তারপর নিজের ব্যাগ হতে কিছু ঔষধ বের করে কোন ঔষধের পর কোনটা খেতে হবে মোহনকে তা বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রহিমা মোহনকে আবিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আবিয়ার পাশে বসে মোহন কোন ঔষধ কখন খেতে হবে সেটা বুঝিয়ে দেয়।
আবিয়া একদৃষ্টে মোহনের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে- কি সুন্দর চেহারা, কি মধুর ব্যবহার। হায় আল্লাহ! এ পৃথিবীতে কত ভালো মানুষ আছে আর তারই কপালে জুটিয়ে দিলে কি না একটা নরপশু।
আবিয়া শুয়ে হাতটা বাড়ায় পানির গøাস নেয়ার জন্য কিন্তু শরীরে তার এতটাই ব্যথা যে শরীরটাকে একটু নড়াচড়াও করতে পাচ্ছে না। মোহন চেয়ার থেকে এক লাফে উঠে গিয়ে বলে- আরে বুবু, আমিত এখানেই আছি? আমাকে বললে হতো না? আপনাকে এতো কষ্ট করে উঠতে হবে কেন?
মোহন পানির গøাসসহ ঔষধ গুলো আবিয়ার হাতে দেয়, ঔষধ খেতে খেতে আবিয়া বলে-মোহন ভাই যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি।
জী, বুবু বলেন? মনে করার কি আছে।
আপনার দুলাভাই কোথায়?
উনি আড়তে বসে আছেন, ওনাকে রেখে আমি ডাক্তরের কাছে যাই।
ডাক্তার সাহেব আসার ব্যাপারে তিনি কি কিছু জানেন?
না বুবু, জানেন না। তবে আসার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তুই কোথায় যাস। আমি বলেছিলাম একটু ঘুরে আসি।
আপনার দুলাভাইকে কোন কিছু বলার দরকার নাই, কেমন? আর আমি যে অসুস্থ সেটাও তাকে জানানোর কোন প্রয়োজন নাই। ঠিক আছে ভাই?
ওরে বাপরে! এতোটা অভিমান?
ভাই কিছু বললেন?
না বুবু তেমন কিছু না, তবে উনি জানলে কি ডাক্তার আনতে মানা করতেন বলে আপনার মনে হয়?
না মোহন ভাই, ঠিক তা না। তবে আমি চাই না উনি জানুক।
ও আচ্ছা ঠিক আছে বুবু, আপনি না চাইলে আমি তাকে বলব না। আমি এখন আসি বুবু?
মোহন ভাই? আর একটা কথা জানার ছিল। প্রথম পরিচয়ে আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?
না বুবু, বলেন কি জানতে চান?
আপনি কি আজ সকালে বাড়িতে ছিলেন?
কখন সেটা বুবু?
বাড়িতে গণ্ডগোলের সময়।
এবার মোহন একটু হেসে ফেলে- না বুবু ছিলাম না, সকালে লেবারেরা কাজে আসবে বলে আমিও খুব তাড়াতাড়ি আড়তে চলে গিয়েছিলাম।
আবিয়া মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। এরকম একটা যুবক ছেলে আঙ্গিনায় তাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হতো।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now