বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
চা-বাগানের শীতল রহস্য
লেখক : নুর
চা বাগানের সেই রাস্তাটা সবসময়েই আমার কাছে কেমন যেনো অদ্ভুত অদ্ভুত লাগে। দিনের বেলা যতটা শান্ত আর সবুজ, রাতের বেলা ঠিক ততটাই শীতল, ফাঁকা আর অচেনা মনে হয়। সে রাতে আমি শিলচরের দিকে যাচ্ছিলাম। নভেম্বরের শেষ দিক। আকাশে চাঁদ নেই, চারপাশে শুধু গভীর কুয়াশা। বাস থেকে নেমে একটি সরু কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তার দুইপাশে উঁচু উঁচু চা গাছের সারি, গাছের পাতায় রাতের শিশিরের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে। দূরে কোথাও শ্রমিকদের কলোনির আলো দেখা যায়, কিন্তু এখানে শুধু এক গাড় অন্ধকার আর কুয়াশা। বাতাসে এক ধরনের ঠান্ডা গন্ধ, যেন ভেজা মাটি, শুকনো পাতার ধোঁয়া আর পুরনো কাঠের ঘ্রাণ মিশে আছে। পায়ের নিচে নুড়িপাথরের কড়মড় শব্দ, আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক। কিন্তু হঠাৎই বুঝলাম—ঝিঁঝি পোকার ডাকটা কিছুক্ষণ আগে থেকে নেই! চারদিকে নিস্তব্ধ, যেন কেউ শ্বাস বন্ধ করে শুনছে আমি কী করছি। হঠাৎ বাঁদিকের চা গাছের সারির ভেতর থেকে নরম একটা আওয়াজ পেলাম, যেন পাতার ফাঁকে কেউ ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। “কেউ কি আছেন ওখানে!!” ভয় মিশ্রিত কন্ঠে জিগ্যেস করলাম।
কোনো উত্তর নেই। বরং পাতার নড়াচড়া আরও কাছে আসছে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম, কিন্তু অনুভব করলাম আমার পায়ের সঙ্গে পায়ের শব্দ মিশে আরেকটা ভারী, ধীর শব্দও আসছে। যেন কারও পা মাটিতে টেনে টেনে হাঁটার শব্দ। বাগানের মাঝখানে একটা পুরনো কাঠের সেতু আছে। এই সেতুর নিচে শুকনো নালা, বর্ষাকালে এখানে পানি বইত। আমি সেতুর দিকে এগোতেই কুয়াশার ভেতর থেকে ম্লান একটা লণ্ঠনের আলো ভেসে উঠল। কেউ একজন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সাদা ধুতি, মাথায় সাদা পাগড়ি কিন্তু মুখটা পুরোপুরি অন্ধকারে ঢাকা। আমি সাথে সাথে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম। আলোটা যেন আমার দিকে এগিয়ে এলো, কিন্তু মানুষটা নড়ছে না—শুধু আলোটাই এগোচ্ছে। আমার বুক ধড়ফড় করছে। সেতুর নিচ থেকে হঠাৎ শোঁ শোঁ ঠান্ডা বাতাস ভেসে এলো আর তখনই দেখলাম, সেই মানুষেটার পা নেই। লণ্ঠন হাতে ধরা অবয়বটা ধীরে ধীরে সেতুর ওপর ভেসে উঠল, আর তার লণ্ঠনের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য দেখলাম মুখটা যেন পোড়া, কালচে, আর চোখের জায়গায় শুধু ফাঁকা গর্ত। আমি চিৎকার করার আগেই আলোটা নিভে গেল।
সেই পোড়া-মুখো, শূন্য-চোখের অবয়বটা যখন লণ্ঠন হাতে সেতুর মাঝ বরাবর এসে থামল, আমার গা-হাত একসঙ্গে ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন বুকের ভেতরের রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে আসছিল আর গলায় যেন কেউ অদৃশ্য হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। সেতুর নিচ থেকে আবার শোঁ শোঁ হাওয়া উঠল, আর হাওয়ার সঙ্গে কানে ভেসে এলো কর্কশ একটা ফিসফাস—
“তুই… চলে যা..”
কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চোখের সামনে সবকিছু কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল।
লণ্ঠনের সেই ম্লান আলো হঠাৎ তীব্র হয়ে চোখে লাগল, তারপর আবার নিভে গেল।
অন্ধকার… আর অন্ধকার!! শেষবার যা মনে আছে, তা হলো সেই পোড়া মুখটা আমার দিকে ঝুঁকে আসছে, আর তার গন্ধ… যেন পুরনো পোড়া কাঠ আর পচা মাটির মিশ্রণ। তারপর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি একটা মাটির ঘরের ভেতরে শুয়ে আছি। মাথার পাশে কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বলছে। ঘরের কোণে বসে আছেন তিন-চারজন স্থানীয় শ্রমিক।
তাদের চোখে কৌতূহল, ভয় আর অবিশ্বাস একসঙ্গে জমে আছে।
“বাবু, আপুনি ভাগ্যবান… অনেকেই ওই সেতুর ধারে গিয়ে ফেরে নাই,” - বলে এক বৃদ্ধ শ্রমিক, যার গলার স্বর কর্কশ হলেও চোখে ছিল এক ধরনের উদ্বেগ। আরেকজন বলল, “ওইটা বহু পুরনো ঘটনা বাবু… এই বাগানের মালিকের খুন হওয়া, আগুনে পুড়ে মরার কথা… অনেক কাহিনি আছে। কিন্তু রাতের বেলায় কেউ সেতুর ওধারে গেলে…”। সে বাকিটা আর বলল না, শুধু মাথা নিচু করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমার পুরো শরীর তখনো ঠান্ডায় কাঁপছে। বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ যেন কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। আমি বুঝলাম, আমি যেটা দেখেছি, সেটা স্বপ্ন বা মায়া নয়… বরং এই চা-বাগানের এক কালো সত্য। আমি উঠে বসলাম। মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে। আমার পোশাক ভিজে গেছে, যেন গভীর কুয়াশার ভেতর থেকে আমি এইমাত্র বেরিয়ে এসেছি। লণ্ঠনের ম্লান আলোয় আমি দেখতে পেলাম, ঘরের কোণে বসে থাকা শ্রমিকদের চোখ যেন আমার দিকেই। আমি জানতে চাইলাম, “কে… কে ছিলেন উনি? সেতুর নিচে… আর পোড়া মুখ…?” বৃদ্ধ শ্রমিকটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবু, উনি হলেন এই বাগানের মালিক। নাম সুরেশ রায়। বহু বছর আগে, এই চা-বাগান যখন তৈরি হয়, তখন সুরেশবাবু একজন সৎ এবং দয়ালু মানুষ ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভেতরে লোভ আর হিংসা বাসা বাঁধল। শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার শুরু করলেন, তাদের পাওনা টাকা দিতেন না, আর যারা প্রতিবাদ করত, তাদের মারধর করতেন। একটা সময় তার এই অত্যাচার এতটাই চরমে পৌঁছালো যে শ্রমিকরা আর সহ্য করতে পারল না।”
কথাটা শেষ না করে বৃদ্ধ একটু থামল, যেন কোনো স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এরপর সে আবার বলতে শুরু করল, “একদিন রাতে, শ্রমিকরা তাকে এই সেতুর নিচেই আটকে ফেলে। তারা তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সুরেশবাবু বাঁচার জন্য চিৎকার করছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে আসেনি। সেদিন থেকেই শোনা যায়, সুরেশবাবুর অতৃপ্ত আত্মা প্রতি রাতে ওই সেতুতে ফিরে আসে। সে তার পোড়া মুখ আর শূন্য চোখে সেইসব মানুষ খোঁজে, যারা তার এই পরিণতি ঘটিয়েছিল। আর মাঝে মাঝে যে কোনো অপরিচিত মানুষ যারা এই রাত গভীর রাতে এই পথ দিয়ে যায় তাদের সে তার কাছে টেনে নিয়ে যায়।”
বৃদ্ধের কথাগুলো আমার বুকে একটা কাঁটার মতো বিঁধছিল। তার চোখে ভয় আর দুঃখের এক অদ্ভুত মিশ্রণ দেখা যাচ্ছিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাইরে তখনো অন্ধকার। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে। “আমি… আমি চলে যেতে চাই,” কোনোমতে বললাম। শ্রমিকরা আমাকে বাগান থেকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো যেন কেউ আমাকে পেছন থেকে অনুসরণ করছে। আমি বারবার পেছনে ফিরে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। শুধু সেই পচা গন্ধটা, সেই পোড়া কাঠের গন্ধটা এখনো আমার নাকে লেগে আছে। আমি যখন চা বাগান পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে পৌঁছালাম, তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি একটা খালি বাস পেলাম আর তাতে উঠে বসলাম। বাস যখন চলতে শুরু করল, আমি জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, এই দুঃস্বপ্নটা শেষ হলো। কিন্তু হঠাৎই বাসের আয়নায় আমার প্রতিফলন দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। আমার মুখটা কালচে আর ঘোলাটে লাগছিল। আর আমার চোখের জায়গায় যেন শুধু দুটি শূন্য গর্ত…
বাসটা তখনো রাস্তা দিয়ে চলছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার এই চা-বাগান থেকে পালানো সম্ভব না। আমি কেবল একটা গল্পের সাক্ষী হয়ে গেলাম আর সেই গল্পের, যার নাম 'চা-বাগানের শীতল রহস্য'।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now