বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
বংশালের বনলতা (পর্ব - ২)
মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর
৭
মশার কামড়ে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সন্ধে গড়িয়ে
গেছে, ঘর অন্ধকার। মুকুলের মা রাতের খাবার
তৈরির জন্য তখনো আসেনি। বাইরে গিয়ে চা-নাশতা
খেয়ে ঘরে ফিরলাম। আলো জ্বেলে
ক্লজিটের দরজা খুলে টর্চের আলো ফেললাম
ওটার ভেতর। দুপুরে খোলার পর একদিকে
সরিয়ে রেখেছিলাম তক্তাটা। আস্তে আস্তে
ব্রাশ চালিয়ে পরিষ্কার করলাম মূর্তিটা। দুদিকে দুটো
পেঁচার মূর্তির মাঝে সাদা বেলে পাথরের যুবতী
নারীর মূর্তি। সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরটা থেকে
স্বাস্থ্য আর যৌবন যেন ফুটে বেরোচ্ছে।
ঢেউখেলানো চুল, ভ্রু, চোখ, স্তন, ঊরু,
তলপেটের প্রতিটি বাঁক নিখুঁত। দেখে মনে
হলো, মেয়েটি মাঝারি একটি গাছের বাঁকানো গুঁড়ি
দুই পা দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে।
যুবতীর ডান কাঁধের ওপর লেপ্টে আছে
গাছের একটি কাটা ডাল। তকতকে মসৃণ গাছের গুঁড়ি,
সেটাতে না কোনো ডালপালা, না পাতা।
পেঁচাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওগুলোর
পা পাখির পায়ের মতো নয়, তরুণী মেয়েদের
পায়ের মতো। ড্যাম্প পরিবেশের কারণে মূর্তির
গায়ে রাস্টের দাগ পড়ে গেছে। এই দাগ উঠাতে
হলে মূর্তিটাকে স্পিরিট দিয়ে ঘষতে হবে।
ঘরে রাবিং অ্যালকোহল ছিল। রুমালে অ্যালকোহল
লাগিয়ে ঘষে ঘষে দাগ কিছুটা তুলে ফেললাম।
যেটাকে গাছ মনে করেছিলাম, দেখলাম, সেটা
আদৌ কোনো গাছ নয়। যুবতীকে জড়িয়ে ধরে
থাকা একটি মোটা সাপ ওটা। সাপের পুঁতির মতো
চোখগুলোতে নীল রঙের ছোট ছোট
পাথর বসানো। কুলুঙ্গি দুটোর দিকে চেয়ে
দেখলাম, ওগুলোর মাথায় ঘন কালো রঙের
ছোপ। কোনো এক সময় নিয়মিত বাতি জ্বালানো
হতো ওগুলোর ভেতর। অনেকক্ষণ হয় টর্চ
জ্বালিয়ে রেখেছি। কটা আলো বেরোচ্ছে,
ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে ওটার। যেকোনো
মুহূর্তে নিভে যাবে টর্চ। দুটো মোম ধরিয়ে
দুই কুলুঙ্গিতে রাখলাম। মোমের কাঁপা কাঁপা
আলোয় মনে হলো, যুবতীর শরীরের ওপর
মোচড় খাচ্ছে সাপটি। তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে
যায়। জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে আমার
ঘোর কাটল। ক্লজিটের দরজা বন্ধ করে রুমের
দরজা খুলে দেখি, মুকুলের মা দাঁড়িয়ে আছে।
রাতের রান্না শেষ, যাওয়ার আগে আমাকে এক
কাপ চা বানিয়ে দেবে কি না জানতে চায়। তাকে
বিদায় করে কাপড়চোপড় পরে বাইরে বের হলাম।
ভাবলাম, খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।
৮
রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। একে রোববার, তার ওপর
এমনিতেই তখন ঢাকায় লোকজন এখনকার তুলনায়
অনেক কম ছিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম
হোসেনী দালানের (বর্তমান আহসান মঞ্জিল)
সামনে বুড়িগঙ্গার ধারে। প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডের এই
ভাঙাচোরা প্রাসাদটি এক কালে দোর্দণ্ডপ্রতাপে
কাঁপত। ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা এখানে
বসে বাইজি নাচ দেখতেন, ফিস্ট খেতেন আর
বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন এখানে এসে
জুটেছে রাজ্যের ভবঘুরে আর ভিখিরি। সামনে
চলছে মদ, গাঁজা, জুয়া, মাগিবাজি। আশপাশে ওত
পেতে আছে ছিনতাইকারী, হাইজ্যাকার। তখনো
দালানটির আশপাশে অনেকগুলো পুরোনো বাড়ি
দেখা যেত। নবাবের কর্মচারীদের কোয়ার্টার।
এখন ভূমিডাকাতেরা ওগুলো দখল করে
ভেঙেচুরে রুচিহীন সব দালান তুলেছে। এ
কালের লেখক হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন,
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। বাস্তবে
হয়েছেও তা-ই।
হোসেনী দালানের সামনে গেলে প্রায়ই
মনে পড়ত একটা কিংবদন্তির কথা। একসময় কাহিনিটা এই
এলাকায় সবার মুখে মুখে ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ
প্রতিদিন ভোরে বুড়িগঙ্গায় গোসল সেরে
ফজরের নামাজ আদায় করতেন। এ জন্য সুন্দর
একটি ঘাটও বানিয়েছিলেন। নবাব একদিন খুব
ভোরে গোসল করতে এসে দেখলেন, শাড়ি
পরা টকটকে ফরসা এক যুবতী সোনার বদনা হাতে
ঘাটের সিঁড়িতে একাকী বসে আছে। মেয়েটির
গা ভরা সোনার গহনা, খালি পায়ে লাল আলতা দেওয়া।
তখনো ভোরের আলো ঠিকমতো
ফোটেনি। সলিমুল্লাহ মেয়েটিকে মিষ্টি কথায়
ভুলিয়ে আধো অন্ধকারে প্রাসাদে এনে নিচতলার
এক গোপন কুঠুরিতে রেখে দেন। সেখান
থেকে তাকে তিনি কোনো দিন বের হতে
দেননি। নবাব ছাড়া ও ঘরে ঢোকার সাধ্য কারও ছিল
না। সলিমুল্লাহ বিশ্বাস করতেন, যত দিন ওই মেয়েটি
তাঁর প্রাসাদে থাকবে, তত দিন তাঁর ঐশ্বর্যের
কোনো ঘাটতি হবে না। আরও শোনা যায়,
মেয়েটির সোনার বদনাটি হীরা, চুনি, পান্নায় ভর্তি
ছিল। নবাব যুবতীর কাছ থেকে বদনাটি নিয়ে
নেন।
সলিমুল্লাহ মারা যাওয়ার কিছু দিন পর মাঘ মাসের তীব্র
কুয়াশায় ঢাকা এক ভোরে প্রাসাদের দারোয়ান
দেখল, লাল শাড়ি পরা সোনার গহনা গায়ে একটি
মেয়ে গেট পার হয়ে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে
যাচ্ছে। ব্যাপার কী, জানার জন্য দৌড়ে গিয়ে
দেখে সুনসান ঘাট, মেয়েটি উধাও। এর পর
থেকেই পড়তে শুরু করে নবাবদের অবস্থা।
আমার খুব ইচ্ছে, ওই ঘরটি দেখার। নবাবের সাথে
যুবতীর কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, সেটা জানারও
আকাক্সক্ষা আছে। মনে পড়ল, যুবতী মেয়ে
একটা আমার ঘরেও আছে। পার্থক্য এই যে, সে
পাথরের, আর তার গায়ে একটা সুতোও নেই।
নদীর ধারে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরলাম।
খেয়েদেয়ে বিছানায় ফিরে রবীন্দ্রনাথের
‘মনিহারা’ পড়তে পড়তে ঘুম এসে গেল। অদ্ভুত
রহস্যময় এক গল্প, সময় পেলে পড়ে
দেখবেন। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে মনে হলো,
ক্লজিটে যে মূর্তিটা আছে, ওটার একটি নাম
দেওয়া দরকার। কল্পনায় দেখতে পেলাম, যুবতী
মেয়েটির লতানো চুল, তার অপূর্ব বন্য সৌন্দর্য।
ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে ওটার নাম
রাখলাম ‘বনলতা’।
৯
পরদিন সকালে অফিসের কাজ শুরু করলাম এক নিদারুণ
দুঃসংসাদ শুনে। অফিসের এক্সিকিউটিভ অ্যাকাউন্ট্যান্ট
অমল বোসের বাসা বকশিবাজারে। সন্ধের সময়
নিউ মার্কেট কাঁচা বাজার থেকে সদাইপাতি করে
ফেরার সময় পলাশীর মোড়ে ছিনতাইকারীদের
হাতে পড়েছিলেন। ঘড়ি, আংটি, মানিব্যাগ, বাজার সবই
তারা নিয়ে গেছে। তবে ভয়ংকর ব্যাপার যেটি
সেটি হলো, ছিনতাইকারীরা যখন সবকিছু নিয়ে
হাসতে হাসতে সলিমুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে জহুরুল
হক হলের দিকে সরে পড়ছে, তখন অমল বাবু
রাগে ফেটে পড়ে পেছন থেকে একজনকে
জাপটে ধরে চেঁচাতে শুরু করেন। সঙ্গীকে
ছাড়াতে গিয়ে হাইজ্যাকারদেরই একজন তখন ড্যাগার
দিয়ে অমল বাবুর পেটটা আড়াআড়ি চিরে দেয়। বাবু
এখন শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেলের
আইসিইউতে। ছয় মাসের আগে কাজে ফিরে
আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারের আগে কোম্পানির এমডি
আফতাব সাহেব তাঁর চেম্বারে আমাকে ডেকে
পাঠালেন। সেদিন থেকে এক্সিকিউটিভ
অ্যাকাউন্ট্যান্টের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে।
নরমাল অবস্থায় এই পোস্ট পেতে দশ বছর
তো লাগতই, সেই সাথে দরকার হতো
ভাগ্যেরও। বেতন বেড়ে গেল চার গুণ।
কোম্পানির সব ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের খবর
থাকে এক্সিকিউটিভ অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে, এই
কারণে এই পোস্টে যে থাকে তার ক্ষমতাও
অনেক। সকালে কাজ করছিলাম বড় একটা হলঘরে
সার সার টেবিলের একটাতে বসে। অথচ
বিকেলে বসলাম এক্সিকিউটিভ অ্যাকাউন্ট্যান্টের
চেম্বারে। দরজার পাশে টুলের ওপর বসা পিয়ন।
১০
আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরি হেঁটে হেঁটে। রুট
খুব সিম্পল। প্রথমে যাই বিমান অফিসের সামনে,
সেখান থেকে ডিআইটি হয়ে গুলিস্তান সিনেমা হল।
এরপর ফায়ার ব্রিগেড হেড অফিসের পাশ দিয়ে
ঢুকি আলাউদ্দিন রোডে। কিছুটা সামনে
এগোলেই হাতের ডানে পড়ে হাজির বিরিয়ানির
দোকান। মাঝেমধ্যেই ওখান থেকে বিরিয়ানি
খেয়ে বাসায় ফিরি। আজও বাসায় ফিরে কাপড়
ছেড়ে গোসল সেরে খবরের কাগজ গিয়ে
বিছানায় বসলাম। মুকুলের মা এক গ্লাস পানি, টোস্ট
বিস্কুট আর চা রেখে গেছে। কাগজ পড়া শেষ
করে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময়
মনে পড়ল মূর্তিটার কথা। দুটো মোম ধরিয়ে
ক্লজিটে ঢুকলাম। আগের মতোই দেয়ালে
ঝুলে আছে ওটা। কিছু সময় তাকিয়ে থাকলে মনে
হয়, ওটার শরীরের ওপর মোচড় খাচ্ছে সাপটা।
তাকিয়ে আছি তো আছিই। সংবিত ফিরে পেলাম
মুকুলের মায়ের ডাকে। রান্নার লবণ নেই। ক্লজিট
থেকে বেরিয়ে মুকুলের মায়ের হাতে একটা
টাকা দিয়ে লবণ আনতে পাঠালাম। আর ঠিক তখনি
বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হলো।
মনে হলো বললে ঠিক বলা হয় না, আসলে
মনের ভেতর কে যেন কথা বলে উঠল। মনে
হলো কে যেন বলছে : ‘লবণ কেনো,
আরও লবণ কেনো।’
১১
পরদিন সকালে অফিসে গিয়েও মাথার ভেতর ওই
একই কথা ঘুরতে লাগল। ধরা যাক, অনেক লবণ
কিনে রাখলাম, কিন্তু তারপর কী হবে? তবে এ
কথা ঠিক যে, আগে স্থিতিশীল থাকলেও
স্বাধীনতার পর থেকেই কোনো কোনো
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হঠাৎ হঠাৎ
বেড়ে যেত। কিছু লবণ কিনে রাখলে কেমন
হয়? ধরা যাক, একশো মণ। বর্ষাকাল চলছে, অফ
সিজন। কিনে দেখা যেতে পারে, লস হলে আর
কতই হবে? তখন এক সের লবণের দাম ছিল ৬০
পয়সা থেকে ১২ আনা। অফিসের পেটি ক্যাশে
সব সময় পঞ্চাশ হাজার টাকা থাকে। সেখান থেকে
দু’হাজার টাকা উঠিয়ে পাইকার বাজার থেকে একশো
মণ লবণ কিনে অফিসেরই গোডাউনে ফেলে
রাখলাম। সপ্তাহ দুয়েক পর হঠাৎ বাড়তে লাগল দাম।
আপনারা জানেন, সে সময় প্রতি সের লবণ বিশ-
বাইশ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। যার কাছ থেকে
কিনেছিলাম, বিক্রিও করলাম তার কাছেই। কেনা ছিল
দু’হাজারে, বেচলাম আশি হাজারে। সেই সময়
আটাত্তর হাজার টাকা অনেক টাকা।
রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেলাম। এই ঘটনার মাস
খানেক পর ঘটল একই রকম আরেকটি ঘটনা। তবে
মুকুলের মা এইবার লবণের পরিবর্তে উল্লেখ
করল শুকনো মরিচের কথা। গতবারের মতো
তখনো আমি ক্লজিটের ভেতরেই ছিলাম। এখানে
বলে রাখি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বেলে
মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকা আমার প্রধান একটি কাজ
হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই কাজটি না করলে শান্তি পেতাম
না মনে। তবে এবার আর অত চিন্তা করলাম না। এমডি
সাহেবকে রাজি করিয়ে প্রচুর শুকনো মরিচ কিনে
গোডাউন ভরে ফেললাম। তার সাথে আমার ফিফটি-
ফিফটি লাভের চুক্তি হলো। অফিসকে এর মধ্যে
জড়িয়ে ফেলার পেছনেও কারণ ছিল। ভেবে
দেখলাম, এভাবে একা একা যদি টাকা বানাতে থাকি,
তাহলে সহকর্মীদের কোপানলে পড়তে বেশি
সময় লাগবে না। তারা যদি কেউ একবার
রক্ষীবাহিনীর কানে আমি মজুতদার, কালোবাজারি
এ কথা তুলে দেয়, তাহলে আর দেখতে হবে
না। এ কথা সবাই জানে, পাঁচ টাকা সেরের শুকনো
মরিচ তখন বিক্রি হয়েছিল একশো ষাট টাকায়।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now