বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
পথের পাঁচালী (২১)
"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান TARiN (০ পয়েন্ট)
X
ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর পর চার-পাঁচ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। মাঘ মাসের শেষ, শীত বেশ আছে। দুই পাশে ঝোপে-ঝাপে-ঘেরা সরু মাটির পথ বাহিয়া নিশ্চিন্দিপুরের কয়েকজন লোক সরস্বতীপূজার বৈকালে গ্রামের বাহিরের মাঠে নীলকণ্ঠ পাখি দেখিতে যাইতেছিল।
দলের একজন বলিল, ওহে হরি, ভূষণে গোয়ালার দরুন কলাবাগানটা তোমরা কি ফের জমা দিয়েচো নাকি?
যাহাকে উদ্দেশ করিয়া বলা হইল তাহাকে দেখিলে দশ বৎসর পূর্বের সে হরিহর রায় বলিয়া মনে হয় না। এখন সে মধ্যবয়সি, পুরাদস্তুর সংসারী, ছেলেমেয়ের বাপ হরিহর খাজনা সাধিয়া গ্রামে গ্রামে ঘোরে, পৈতৃক আমলের শিষ্যসেবকের ঘরগুলি সন্ধান করিয়া বসিয়া গুরুগিরি চালায়, হাট্রোঠে জমির ঘরামির সঙ্গে ঝিঙে-পটলের দর-দস্তুর করিয়া ঘোরে, তাহার সঙ্গে আগেকার সে অবাধাগতি, মুক্তপ্রাণ, ভবঘুরে যুবক হরিহরের কোন মিল নাই। ক্ৰমে ক্রমে পশ্চিমের সে-জীবন অনেক দূরের হইয়া গিয়াছে—সেই চুনার দুর্গের চওড়া প্রাচীরে বসিয়া বসিয়া দূর পাহাড়ের সূর্যস্ত দেখা, কেদারের পথে তেজপাতার বনে রাত-কাটানো, শাহ কাশেম সুলেমানীর দরগার বাগান হইতে টক কমললেবু ছিড়িয়া খাওয়া, গলিত রৌপ্যধারার মতো স্বচ্ছ, উজ্জ্বল হিমশীতল স্বৰ্গনদী অলকানন্দা, দশাশ্বমেধ ঘাটের জলের ধারের রানা–একটু একটু মনে পড়ে, যেন অনেকদিন আগেকার দেখা স্বপ্ন।
হরিহর সায়সূচক কিছু বলিতে গিয়া পিছন ফিরিয়া বলিল, ছেলেটা আবার কোথায় গেল? ও খোকা, খোকা-আ-আ-—
পথের বাঁকের আড়াল হইতে একটি ছয় সাত বছরের ফুটফুটে সুন্দর, ছিপছিপে চেহারার ছেলে ছুটিয়া আসিয়া দলের নাগাল ধরিল। হরিহর বলিল—আবার পিছিয়ে পড়লে এরই মধ্যে? নাও এগিয়ে চল–
ছেলেটা বলিল–বনের মধ্যে কি গেল বাবা? বড় বড় কান?
হরিহর প্রশ্নের দিকে কোন মনোযোগ না দিয়া নবীন পালিতের সঙ্গে মৎস্যশিকারের পরামর্শ তাঁটিতে লাগিল।
হরিহরের ছেলে পুনরায় আগ্রহের সুরে বলিল–কি দৌড়ে গেল বাবা বনের মধ্যে? বড় বড় কান?
হরিহর বলিল–কি জানি বাবা, তোমার কথার উত্তর দিতে আমি আর পারিনে। সেই বেরিয়ে অবধি শুরু করেচো এটা কি, ওটা কি-কি গেল বনের মধ্যে তা কি আমি দেখেচি? নাও এগিয়ে চলো দিকি!
বালক বাবার কথায় আগে আগে চলিল।
নবীন পালিত বলিল, বরং এক কাজ করো। হরি, মাছ যদি ধরতে হয়, তবে বঁয়াশার বিলে একদিন চলে যাওয়া যাক-পুব-পাড়ার নেপাল পাড়ই বাচ দিচ্ছে, রোজ দেড়মন দু’মিন এইরকম পড়চে-পাঁচ-সেরের নিচে মাছ নেই!! শুনলাম, একদিন শেষরাত্তিরে নাকি বিলের একেবারে মধ্যিখানে অর্থই জলে সৗ সা করে ঠিক যেন বকনা বাছুরের ডাক–বুঝলে?
সকলে একসঙ্গে আগাইয়া আসিয়া নবীন পালিতের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
–অনেক—কেলে পুরোনো বিল, গহিন জল, দেখেছো তো মধ্যিখানে জল যেন কালো শিউগোলা, পদ্মগাছের জঙ্গল, কেউ বলে রাঘব বোয়াল, কেউ বলে যক্ষি–যতক্ষণ ফরাসা না হলো ততক্ষণ তো মশাই নৌকোর ওপর সকলে বসে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো–
বেশ জমিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ হরিহরের ছেলেটি মহা-উৎসাহে পাশের এক উলুখড়ের ঝোপের দিকে আঙুল তুলিয়া চিৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া গেল।–ওই যাচ্ছে বাবা, দ্যাখো বাবা, ওই গেল বাবা, বড় বড় কান, ওই–
তাহার বাবা পিছন হইতে ডাক দিয়া বলিল,–উঁহু উঁহু উঁহু–কাঁটা কাঁটা কাঁটা-পরে তাড়াতাড়ি আসিয়া খপ করিয়া ছেলের হাতখানি ধরিয়া বলিল,–আঃ বড্ড বিরক্ত কল্লে দেখচি তুমি, একশ’ বার বারণ কিচ্চি তা তুমি কিছুতেই শুনবে না, ওই জন্যেই তো আনতে চাচ্ছিলাম না।
বালক উৎসাহে ও আগ্রহে উজ্জ্বল মুখ উঁচু করিয়া বাবার দিকে তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল–কি বাবা?
হরিহরি বলিল–কি তা কি আমি দেখেচি! শুওর-টুওর হবে।–নাও চলো, ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটো–
–শুওর না বাবা, ছোট্ট যে! পরে সে নিচু হইয়া দৃষ্ট বস্তুর মাটি হইতে উচ্চতা দেখাইতে গেল।
–চল চল––হ্যাঁ–আমি বুঝতে পেরেচি, আর দেখাতে হবে না-চল দিকি!…
নবীন পালিত বলিল–ও হলো খরগোশ, খোকা খরগোশ। এখানে খড়ের ঝোপে। খরগোশ থাকে, তাই।
বালক বর্ণপরিচয়ে ‘খ’-এ খরগোশের ছবি দেখিয়াছে, কিন্তু তাহা যে জীবন্ত অবস্থায় এ রকম লাফাইয়া পালায় বা তাহা আবার সাধারণ চক্ষুতে দেখিতে পাওয়া যায়, এ কথা সে কখনও ভাবে নাই।
খরগোশ!–জীবন্ত–একেবারে তোমার সামনে লাফাইয়া পালায়–ছবি না, কাচের পুতুল না–একেবারে কানখাড়া সত্যিকারের খরগোশ! এইরকম ভাটগাছ। বৈঁচিগাছের ঝোপে।–জল-মাটির তৈরি নশ্বর পৃথিবীতে এ ঘটনা কি করিয়া সম্ভব হইল, বালক তাহা কোনমতেই ভাবিয়া ঠাহর করিতে পারিতেছিল না।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ...