বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
বংশালের বনলতা (পর্ব - ১)
মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর
১
আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটি
ঘটেছিল ১৯৭৪ সালের শ্রাবণ মাসের এক গুমোট
দুপুরে। রাষ্ট্রপতি নিক্সন ‘পি এল ৪৮০’ চুক্তির
অধীনে আমেরিকা থেকে পাঠানো এক জাহাজ
গম চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছানোর আগেই
ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন ফ্লোরিডার মায়ামি
পোর্টে। সারা দেশে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ,
তার ওপর বন্যা। খেতে না পেয়ে আর ডায়রিয়া-
ম্যালেরিয়ায় দেশজুড়ে লোক মরছে কাতারে
কাতারে। কমলাপুর, গুলিস্তান, সদরঘাটের আশে-
পাশে দিনে-রাতে লাশের পর লাশ পড়ছে।
বেওয়ারিশ মড়া দাফন করতে করতে আঞ্জুমান
মফিদুল ইসলামের দম বেরিয়ে যাওয়ার দশা। মুখে
রংচঙ মেখে লাল-সবুজ ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে
মফস্বল থেকে আসা উঠতি মেয়েরা খদ্দেরের
আশায় বকের ধৈর্য নিয়ে রাত-দিন দাঁড়িয়ে থাকে
ওসমানী উদ্যান আর রেসকোর্স ময়দানে।
র্যাবের বাবা রক্ষীবাহিনী সারা দেশে নকশাল,
সর্বহারা, ডাকাতদের উকুন বাছা করে বাছছে।
দেশের এই যখন অবস্থা, আমি তখন মতিঝিলে
‘আইসিসি ট্রেডিং এজেন্সি’তে জুনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্
টের চাকরি করি। থাকি বংশালের কাছাকাছি আলাউদ্দিন
রোডের আর্মেনীয় ধাঁচে তৈরি দেড়শো
বছরের পুরোনো এক বাড়িতে। জগন্নাথ
কলেজে বিকম পড়ার সময় থেকেই আছি ওখানে।
চাকরি পাওয়ার পর নতুন ভালো বাসায় উঠতে পারতাম,
কিন্তু আমি তা করিনি। বাড়িটার মোটা মোটা নোনাধরা
দেয়াল, লোহার বিমবর্গা দেওয়া উঁচু ছাদ, জাফরিকাটা
রেলিংঘেরা লম্বা বারান্দা আর ছায়া ছায়া ঠান্ডা ঘরগুলো
আমাকে কেমন একটা মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল।
বংশালেরই এক ওয়ার্ড কমিশনার তখন ওই বাড়ির মালিক।
এই বাড়িতেই শ্রাবণ মাসের এক রোববার (তখন
সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রোববার) বেলা একটার
দিকে ঘটনাটা ঘটল।
২
কিছুদিন থেকেই তেলাপোকার জ্বালায় তিতিবিরক্ত
হয়ে পড়েছিলাম। এই প্রাণীটিকে আমি ঘৃণা করি।
দেখতে পেলেই পিষে ফেলি পায়ের তলায়।
যদিও এ কাজে সফল খুব কমই হই। রাতে শুয়ে
পড়লে এগুলো মুখের ওপর হেঁটে বেড়ায়।
নাকেমুখে লেগে যায় এদের শরীরের টকটক
দুর্গন্ধ। সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুলেও ঘিনঘিন করে গা।
ফিনিস পাউডার, অ্যারোসল স্প্রে কোনোটাতেই
কোনো কাজ হয়নি। তেলাপোকার গায়ে স্প্রে
করলেই তবেই ওটা মরে। সমস্যা হলো,
তেলাপোকার ভূতের স্বভাব। বের হয় শুধু
রাতের বেলা, অন্ধকারে। দেখতে পেলে
তবেই না স্প্রে করার প্রশ্ন ওঠে। এবার নিয়ে
এসেছি ‘লক্ষণ রেখা’ নামের একধরনের চক।
মেঝেতে ইচ্ছেমতো আঁকিবুঁকি কাটলেই আমার
কাজ শেষ। বাকিটা করবে চকের দাগ।
দুপুর একটার দিকে গোসলের আগে মুকুলের
মাকে সাথে নিয়ে ঘরে চকের দাগ দেওয়া শুরু
করলাম। এখানে বলে রাখি, মুকুলের মা আমার
রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর সাফ, কাপড় কাচা
সবই করে। পান খাওয়া লাল ঠোঁট, পেটা শরীর
আর ঝামা কালো গায়ের রঙে ছায়া ছায়া অন্ধকারে
তাকে দেখলে মনে হয়, মা কালীর জীবন্ত
মূর্তি। মুকুলের মাকে আমি দুই ঈদে কাপড় দিই,
ভালো রান্না হলে তার কিছুটা দিই এবং চাল, ডাল,
তেল, নুনের কোনো হিসাব কখনো নিই না।
সে বলতে গেলে পুরোপুরি স্বাধীনভাবেই
সংসার চালাচ্ছে। তার সাথে আমার কথা খুব কমই হয়।
এ জন্যই হয়তো আমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড জানার
ব্যাপারে তার আগ্রহ অসীম। তাকে ঘরের একটি
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছি। আমি অফিসে গেলে সে
ঘর পরিষ্কার, বিছানা ঠিকঠাক এসব কাজ করে।
৩
ঘরে আসবাব সামান্যই। দেয়ালের স্কাটিংয়ের নিচ
বরাবর দাগ দিয়েছি। দুদিকের দেয়ালে খড়খড়ি
লাগানো জানালাগুলো লম্বায় প্রায় দরজার সমান। বাকি
দেয়াল দুটোর একটির ঠিক মাঝখানে ক্লজিটের
মতো একটি ফাঁকা জায়গা। আগে কাপড়চোপড়,
জুতো-মোজা, হোল্ডঅল এসব ওখানে রাখা
হলেও বহুদিন হলো ফাঁকা পড়ে আছে।
ক্লজিটের দরজা খুলে দেখি, ভেতরটা বেশ
স্যাঁতসেঁতে আর ধুলো-ঝুলকালিতে একাকার।
আড়াআড়ি সেট করা একটি মোটা কাঠের লাঠিতে
মাকড়সার জালে ঢাকা তিনটে আদ্যিকালের হ্যাঙার
ঝুলছে। সম্ভবত মুকুলের মা ওটা পরিষ্কার করার কথা
কোনো দিন ভেবেও দেখেনি।
তেলাপোকার আদর্শ ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসেবে
তুলনাহীন এর পরিবেশ। ভেবে দেখলাম,
পোকাগুলোকে ঝাড়ে-বংশে শেষ করতে
হলে ক্লজিটটা পরিষ্কার করা খুবই জরুরি। মুকুলের
মাকে পানির বালতি, ঝাঁটা, ন্যাকড়া এসব আনতে বলে
ক্লজিটের দরজাটা খুলে দিলাম। ভেতরটা দিনের
আলোতেও অন্ধকার। কিছু একটা আলোর
ব্যবস্থা না করলে পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তিন
বছর ধরে এখানে আছি, অথচ ভেতরটা ভালো
করে একবারও দেখা হয়নি ভেবে অবাকই হচ্ছি।
কেননা, আমি হচ্ছি সেই দলের, যারা ‘যেখানে
দেখিবে ছাই’-এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে
জীবন কাটায়। মুকুলের মা ঝাঁটা, বালতি, ত্যানা এসব
নিয়ে উপস্থিত হলো। তাকে পরিষ্কার করার কাজে
লাগিয়ে আমি গেলাম বাসার সামনে নারায়ণের
দোকান থেকে টর্চ লাইট কিনতে। পুরোনো
ঢাকার এই এক সুবিধা। বাসা, বাজার, হোটেল,
রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, গোরস্থান সব এক জায়গায়।
৪
তিন ব্যাটারির এভারেডি টর্চ কিনে চা খেয়ে ফিরে
এসে দেখি, মুকুলের মা ঝেড়ে-মুছে ক্লজিটটা
তকতকে করে ফেলেছে। ওটার ভেতর আর
বাইরের মেঝে ভেজা ভেজা। না শুকানো
পর্যন্ত চকের দাগ দেওয়া সম্ভব নয়। মুকুলের
মাকে বিদায় করে ক্লজিটে টর্চের আলো
ফেললাম। ভেতরটা বেশ চওড়া, অনায়াসে একজন
মানুষ ঢুকতে পারবে। সামনের ধূসর দেয়ালে
পড়ে ঝিকিয়ে উঠল আলো। বালি-সিমেন্টের
প্লাস্টার করা সাধারণ দেয়ালে আলোর প্রতিফলন
তো এমন তীব্র হওয়ার কথা নয়। বিষয় কী?
পরীক্ষা করে দেখলাম, প্লাস্টারের বদলে
ওখানে মার্বেল স্ল্যাব বসানো। ক্লজিটের ডান
দিকের দেয়ালও মার্বেল মোড়া। বাঁ দিকে
আলো ফেললাম; কিন্তু কই, আলোর প্রতিফলন
অন্য দুই দেয়ালের মতো তো তেমন
জোরালো হলো না। দেয়ালের রংটাও কেমন
যেন মরা মরা মনে হলো। কাছে গিয়ে ভালো
করে দেখলাম দেয়ালটা, নখ দিয়ে একটা আঁচড়ও
দিলাম। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। ওখানকার আসল দেয়াল
একটা কাঠের তক্তা দিয়ে আড়াল করা। বহু
পুরোনো তক্তা, আঙুলের গাঁটের টোকা দিয়ে
বুঝলাম, বেশ পুরু। মনে হলো, এই আলগা তক্তার
ওপাশেও কিছুটা ফাঁকা জায়গা আছে। ওই বাড়তি অংশটাই
তক্তা দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। লোহার ছেনি,
হাতুড়ি কিংবা একটা শাবল পেলে চাঁড় মেরে খোলা
যেত। থপথপ শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।
মুকুলের মা রান্না শেষ করেছে, এখন চলে
যাবে। আমি যেন খেয়ে নেই, এ কথাটা বলতে
এসেছে। বলে কী, ভাত খাব! উত্তেজনায়
আমার পেট গুড়গুড় করছে তখন।
৫
বংশাল মোড়ে ‘বিউটি ভলকানাইজিং’ গাড়ি আর
মোটরসাইকেলের পাংচার টায়ার সারে। ছেনি-হাতুড়ি
ওদের কাছ থেকে চেয়ে আনলাম। ছেনি
মেরে দেয়াল থেকে আলগা করলাম তক্তাটা।
যে জায়গায় তক্তা ছিল, সেখান থেকে ভেতর
দিকে আরও ফুট চারেক এগিয়েছে ক্লজিটটা।
স্যাঁতসেঁতে ধুলোভরা মেঝের ওপর চামচিকে-
বাদুড়ের কঙ্কাল। হালকা আঁধারে ধবধব করছে
এগুলোর সাদা দাঁত। ভক করে কটু একটা গন্ধ নাকে
এসে লাগল, ঝিমঝিম করে উঠল মাথার ভেতরটা। কাত
হয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। দেয়াল ধরে কোনো
রকমে খাড়া রাখলাম নিজেকে। ক্লজিট থেকে
বেরিয়ে টর্চটা নিয়ে আবার ফিরে গেলাম
ওখানে। আলো ফেলে দেখলাম, সামনে-
পেছনে একই রঙের মার্বেলের দেয়াল। শুধু
শেষ মাথায় যে দেয়াল, সেইটে কুচকুচে
কালো সাধারণ পাথর দিয়ে মোড়া। এরই মাঝখানে
লম্বা-চওড়ায় ফুট দুয়েকের মতো কুলুঙ্গি-টাইপ
গভীর একটা গর্ত। সেই কুলুঙ্গির ভেতর সাদা
রঙের দেড় ফুট লম্বা একটি মূর্তি। ওপরে পুরু
ধুলো জমে থাকায় ভালো করে দেখা যাচ্ছে না
মূর্তিটা। বড় কুলুঙ্গিটার দুপাশে আরও দুটো ছোট
ছোট কুলুঙ্গি দেখতে পেলাম। খুব সম্ভব
মোমবাতি কিংবা কুপি জ্বালিয়ে রাখার জন্য তৈরি
ওগুলো।
৬
ফিরে এসে খাটের ওপর বসলাম। ক্লান্ত মনে
হচ্ছে নিজেকে খুব। একে উত্তেজনা তার ওপর
সকাল থেকে খাওয়া নেই, বমিবমি লাগছে। গোসল
করে খেতে হবে কিছু। ছেনি-হাতুড়িও ফিরিয়ে
দেওয়া দরকার। ভেবেছিলাম, কী না কী
পেয়ে যাব। পেলাম তিনটে ফাঁকা কুলুঙ্গি আর
ধুলোভর্তি একটি দেড় ফুট লম্বা মূর্তি। এসব মূর্তি
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গৃহ-দেবতার হয়। গৃহের
ঐশ্বর্য ধরে রাখাই এসব দেবতার কাজ, অন্তত যারা
এগুলো রাখে, তারা তাই-ই বিশ্বাস করে।
বেচলেও যে খুব বেশি টাকা পাওয়া যাবে, এমন
নয়। ছাঁচে ঢেলে বানানো পোড়া মাটির তৈরি
এগুলো, টেরাকোটা নামেই বেশি পরিচিত।
মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, কান্তজীর মন্দির থেকে শুরু
করে বাজারের মন্দিরগুলো পর্যন্ত এসব
টেরাকোটায় বোঝাই। তবে ধন্দে যেটা
ফেলেছে সেটা হলো, একে এত গোপন
রাখা হয়েছে কেন? আশপাশের দেয়ালে
মার্বেল স্ল্যাবই বা কেন লাগানো? নাহ্,
ভালোভাবে দেখতে হবে মূর্তিটা। একটা মাঝারি
সাইজের রং করা ব্রাশ হলে পরিষ্কার করা যেত ওটা।
মোছামুছি করতে গেলে ভেঙেটেঙে
যেতে পারে। ড্যাম্পের ভেতর বহুদিন পড়ে
থাকলে পোড়ামাটিও ভুসভুসে হয়ে ওঠে। ব্রাশ
কিনতে হলে যেতে হবে হার্ডওয়ারের
দোকানে। মনে মনে ভাবলাম, ভালো ঝামেলা
হলো দেখছি, সারা দিন দোকানে দোকানেই
কাটাব নাকি! ছেনি-হাতুড়ি ফেরত দিয়ে হার্ডওয়ারের
দোকান থেকে মাঝারি সাইজের রং করা ব্রাশ কিনে
এনে গোসল করে খেয়েদেয়ে বিছানায় যখন
গা এলিয়ে দিলাম, শরীরে তখন পাশ ফিরে শোয়ার
মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now