বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
ডুবো পাহাড়
চ্যাপ্টার- ৪
বাকি অংশ
‘বিক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা তারা করেছে, ওদের পরিকল্পনা, আব্বাকে দিল্লীর গভর্নর বানানো। তারপর লোক সভায় নিয়ে আসা। এভাবে শীর্ষ নেতাদের অনেককে তারা পার্লামেন্টে নিয়ে আসবে এবং দেশব্যাপী তাদের পরিচিত করাবে।’ বলল সুষমা রাও।
‘মহাসংঘ সম্পর্কে ওরা কি বলেছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘শিবাজীর স্বপ্নের সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ওদের লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক দলের অধিকাংশই তাদের ‘মহাসংঘ’-এর সদস্য। এমনকি কম্যুনিষ্ট পার্টির উপর তলার প্রায় সব নেতাই তাদের সদস্য। তারা তাদের ‘মহাসংঘ’কে ‘ডুবো হিমালয়’ বলে ডাকে। বলে যে, যেদিন হিমালয় জাগবে, সেদিন শুধু তারাই থাকবে আর কেউ থাকবে না।’ থামল সুষমা রাও।
‘আমরা অনেকেই ‘মহাসংঘ’কে ‘ডুবো পাহাড়’ বলে থাকি। বাইরের এই ধারণা এবং ওদের কথার মধ্যে আশ্চর্য মিল দেখছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি ‘মহাসংঘ’কে জানতেন?’
‘খুব সামান্য। আন্দামানে ওদের কিছু নেতার সাথে দেখা হয়েছে, নাম জেনেছি, যাদের সাথে আমার মোকাবিলা হয়েছে।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তুমি হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহ সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছ। উনিও সম্ভবত এদের কোন গোপন বন্দীখানায় বন্দী আছেন।’
‘উনি হোটেল সাহারার মালিক হাজী সাহেব না?’
‘হ্যাঁ, সুষমা। তুমি কি কিছু শুনেছ তার সম্পর্কে?’
‘কিছু শুনেছি ভাইয়া। গতকাল বড় কেউ একজন এসেছিল আমার কক্ষে আমাকে বুঝাবার জন্যে। সে সময় তার মোবাইলে একটা কল এসেছিল। সে কলে কথা বলার সময় এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, ‘যতদিন না আহমদ মুসা ধরা পড়ছে, ততদিন হোটেল সাহারার মালিক হাজী সাহেবকে ছাড়া বা মারা কিছুই করা যাবে না। সে আমাদের একজন বড় টোপ। তাকে উদ্ধার করার জন্যে আহমদ মুসা আসবেই।’ বলল সুষমা রাও।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ সুষমা। তুমি অত্যন্ত বড় একটা সুখবর শুনিয়েছ। তিনি বেঁচে আছেন, এই খবর আমার জন্যে, তাঁর পরিবারের জন্য আকাশ ছোঁয়া আনন্দের সংবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ, সংবাদটা যে আমি দিতে পারলাম।’
‘আগের কথায় ফিরে আসি সুষমা রাও। বাড়ি যাওয়া প্রশ্নে ভেবে-চিন্তে কথা বল। এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।’
‘দুঃখিত ভাইয়া, আমার পিতার কাছে বংশীয় মর্যাদা ও রাজনৈতিক প্রয়োজনের চেয়ে বড় কিছু নেই। সুস্মিতা বালাজী আপা ও আমার ঘটনা তারই কিঞ্চিত প্রমাণ। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত দিন ভাইয়া, আমার কি করা উচিত।’
‘তুমি কি সুরূপা সিংহাল ও সাজনা সিংহালকে চেন?’
হাসল সুষমা রাও। বলল, ‘কি বলছেন ভাইয়া, ওরা আমার বোন, খালাতো বোন। সুরূপা সিংহাল এখানে থাকে। কিন্তু সাজনা সিংহাল তো মহারাষ্ট্রে থাকে। আপনি চিনলেন কি করে?’
‘সাজনা সিংহাল পোর্ট ব্লেয়ারে বেড়াতে এসেছে। সুরূপার ওখানে আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি এত কিছু জানলেন কি করে? সুস্মিতা আপা বলেছে?’ সুষমা রাও বলল।
আহমদ মুসা তার গ্রীনভ্যালি থেকে পোর্ট ভ্যালিতে আসা, সুরূপাদের সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে সব কথা সুষমা রাওকে সংক্ষেপে বলল।
আহমদ মুসা থামলে মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে বলল, ‘থ্যাংক গড, তিনি আপনাকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। আমাদের মত মজলুমদের জন্যেই জালেমের বিরুদ্ধে আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করেন।’
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘সুরূপার বাড়ি আমার নিজের বাড়ি। ওখানকার চেয়ে ভালো থাকার জায়গা আমার আর নেই। আর আমার সবচেয়ে লাভ আপনি ওখানে থাকবেন।’
‘এবার আমরা উঠতে পারি, চল।’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আহমদ মুসা।
সুষমা রাও আহমদ মুসার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াল।
দুজন আবার হাঁটতে লাগল রাস্তায় উঠার জন্যে।
নাস্তার টেবিলে বসে ছিল সুরূপা সিংহাল, সাজনা সিংহাল ও সুষমা রাও।
সুরূপার স্বামী অরূপ রতন সিংহাল নাস্তার টেবিলে বসতে বসতে সুরূপা সিংহালকে জিজ্ঞেস করল, ‘আহমদ মুসা ভাই সাহেব কোথায়?’
‘তুমি ব্যস্ত ছিলে তোমার কম্পিউটার নিয়ে, আর উনি ভোরের নামায সেরেই নিচে নেমে গিয়েছিলেন সমুদ্র তীরে। এই এসে গোসলে ঢুকেছেন। তুমি করেছ যন্ত্র চর্চা, উনি করেছেন মাঠ চর্চা, আর আমরা করেছি গৃহ চর্চা। গৃহ চর্চা তো কোন কাজ নয়, তাই একটু আগেই আসতে পেরেছি নাস্তার টেবিলে।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘দেখ। আমার কিছু দোষ হতেই পারে। ভাই সাহেবকে দোষ দিও না। মাঠের পরিস্থিতি কোন সময়ই তাঁর হাতে থাকে না। অতএব তাঁর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মানতেই হবে।’ অরূপ রতন সিংহাল বলল।
‘এই কিছুক্ষণ আগে সুস্মিতা আপা টেলিফোন করেছিলেন। বললেন, ‘ভাই সাহেব সব কাজ কাঁটায় কাঁটায় করেন, শুধু নিজেরটা ছাড়া।’ বলেছেন, ‘তাঁর নিজের ক্ষেত্রে তাঁকে কোন ছাড় যেন না দেই।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘কিন্তু সেভাবে যদি তিনি নিজের কথা ভাবতেন, তাহলে আন্দামান তাঁকে দেখতে পেত না, আমরাও দেখতে পেতাম না। তিনি মদীনায় বসে স্ত্রী, ছেলে নিয়ে সংসার করতেন।’ অরূপ রতন সিংহাল বলল।
‘দুলাভাই ঠিকই বলেছে......।’ সুষমা রাও তার কথা শেষ করতে পারলো না। আহমদ মুসাকে নাস্তার টেবিলে আসতে দেখে থেমে গেল সুষমা রাও।
টেবিলের হেডচেয়ারের দুপাশে বসেছে সুরূপা ও অরূপ সিংহাল। সুরূপার পাশের চেয়ারটাতে বসেছে সাজনা সিংহাল, তারপর সুষমা রাও।
আহমদ মুসা দ্রুত এসে অরূপ সিংহালের পাশের আরেকটি চেয়ারে বসল।
‘ভাই সাহেব, আবার আপনি এ চেয়ারে বসলেন।’ তারপর হেডচেয়ারটির দিকে ইঙ্গিত করে অরূপ সিংহাল বলল, ‘ওটা আপনার, দয়া করে ওখানে বসুন।’
‘আপনাদের অনেক অনুরোধ রক্ষা করেছি। আর নয়। ঐ অবস্থানটা ফ্যামিলির হেডব্যক্তির জন্যে। এটাই নিয়ম। ভাই সাহেব, আপনি ওখানে বসুন। অথবা ওটা খালিই থাকুক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফ্যামিলির সবার সম্মানিত ব্যক্তিই ওখানে বসেন। আসল ব্যাপার হল যারা টেবিলে বসবেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিতজনই ঐ চেয়ারে বসবেন, এটাই কথা। আমরা যারা টেবিলে আছি, তাদের মধ্যে ঐ চেয়ার আপনার প্রাপ্য। আমরা নয়, সবাই এ কথাই বলবে।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না। আমি মেহমান। ও জায়গা ফ্যামিলি প্রধানের বা ফ্যামিলির অন্য কারও, তাই কথাটা বলছিলাম।’
বলে আহমদ মুসা উঠে গিয়ে চেয়ারটিতে বসল।
হাসল অরূপ রতন সিংহাল। বলল, ‘আমরা আপনাকে মেহমান নয়, পরিবারের একজন বলে মনে করি ভাই সাহেব।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে আহমদ মুসা একটু গম্ভীর হল। বলল, ‘দুঃখিত যে নাস্তার সময়ের একটু পরে আমরা নাস্তা করছি। বেরিয়েছিলাম প্রতিদিনের মত সাগর তীরে একটু দৌড়াদৌড়ি করেই চলে আসব। কিন্তু বেরিয়েই রিকশা যাত্রী দুজন লোকের মধ্যকার আলোচনার একটা অংশ শুনে তাদের পিছু নিতে হয়েছিল। দেরিটা সেই কারণেই।’
‘এমন কি গুরুত্বপূর্ণ কথা যে তাদের পিছু নিতে হল, সেটা কি বলা যায় স্যার?’ সাজনা সিংহাল বলল।
‘ওদের কথোপকথনের মধ্যে ‘হাজী আবদুল্লাহ’ নাম শুনতে পেয়েছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি। ধন্যবাদ।’ বলল সাজনা সিংহাল।
‘পিছু নেয়ার রেজাল্ট কি হল, সেটা কি বলা যায় ভাই সাহেব?’ বলল অরূপ সিংহাল।
‘অবশ্যই। পিছু নিয়ে ওদের সব কথা শুনেছি। তার মধ্যে আমার জন্যে কথাটা ছিল হাজী আবদুল্লাহকে যেখানে রেখেছে, তারা সেখানকার পাহারাদার। সেখানেই তারা যাচ্ছিল। আমি ওদের সাথে শেষ পর্যন্ত গিয়ে বাড়িটা দেখে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে হাজী সাহেবকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সে জায়গাটা দেখে এসেছেন। থ্যাংকস গড।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
‘হ্যাঁ, যা বুঝেছি, যা শুনেছি, তা যদি সত্য হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে স্যার, আজ রাতেই আপনার দ্বিতীয় অভিযান।’ বলল সাজনা সিংহাল। নাস্তার মধ্যেই কথা চলছিল।
সাজনার কথার জবাবে কিছু না বলে হাসল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, আপনি হাসছেন। আমি যেখানে বন্দী ছিলাম সে বন্দীখানায় আপনার ঢোকার আগের ঘটনা মনে হলে এখনও আমার গা কাঁপে। আমার কক্ষের পাঁচ প্রহরী আপনার গুলীতে মরল। ওরাও তো আপনার আগেই আপনাকে গুলী করেছিল, সে গুলী যদি আপনার লাগত! আপনার সেসব কথা মনে পড়ে না?’ বলল সুষমা রাও।
‘ওসব দুঃখের কথা মনে না পড়াই ভালো সুষমা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওটা তো শংকা, আতংক ও বীভৎসতার কথা, দুঃখ কোনটা?’ প্রশ্ন সুষমা রাওয়ের।
‘এখানে দুঃখটা হল পাঁচটা মেয়ের মৃত্যু মানে পাঁচটা পরিবারে দুঃখের পাহাড় নেমে আসা।’ আহমদ মুসা বলল।
টেবিলের সবাই আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসার ভারী কণ্ঠ তারা লক্ষ্য করল।
সঙ্গে সঙ্গে কেউ কথা বলল না। একটু পর অরূপ রতন সিংহাল বলল, ‘ভাই সাহেব, আপনার মন খুবই সংবেদনশীল। মানুষ, জীব নির্বিশেষে সকলের প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখি। তাহলে আপনিই আবার কেমন করে কারও প্রতি গুলী চালাতে পারেন, যেমন ঐ পাঁচটি মেয়েকে মারলেন।’
আহমদ মুসার মুখে বিষণœতার একটা ছায়া নেমেছে। বলল, ‘আমার সামনে স্থির লক্ষ্য ছিল সুষমাকে উদ্ধার করা। এই পথে যে বাধাই আসুক তাকে সরিয়ে ফেলা। আমি আগে সুযোগ পেয়ে প্রুুষ পুলিশদের সংজ্ঞাহীন করে পথ পরিষ্কার করেছি। কিন্তু মেয়েগুলোর ক্ষেত্রে সে সুযোগ পাইনি। ওরাই আগে গুলী করেছে। ওদের না মারলে ওদের পরের গুলীতেই আমাকে মরতে হতো। আমি সুষমাকেও উদ্ধার করতে পারতাম না।’
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। গোলাপ তুলতে গেলে কাঁটার ঘা সইতে হয়, পরীক্ষায় ভালো করতে হলে ভালো পড়ার কষ্ট, উপার্জন করতে হলে কাজ করার কষ্ট স্বীকার করতেই হয়। সুষমার মুক্তির মূল্য দেয়া তাদের জন্যে অবধারিত ছিল।’
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার নাস্তা খাওয়া শেষ।
আহমদ মুসা তার ঘরের দিকে যাবার উদ্যোগ নিতেই সুরূপা সিংহাল হঠাৎ দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব, জরুরি খবর আছে। আপনি ড্রইং-এ একটু বসুন। আমরাও আসছি।’
ঔৎসুক্য, কৌতুহল আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল। ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘সুখবরের শিরোনাম বলতে পারেন বোন।’
‘হ্যাঁ পারি।’ বলে একটু স্বর নামিয়ে সুরূপা বলল, দিল্লী থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আপনাকে টেলিফোন করেছিলেন। আপনি না থাকায়, আপনার মোবাইলে আমিই এ্যাটেন্ড করেছিলাম।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা গিয়ে ড্রইং রুমে বসল।
সবাই এল ড্রইংরুমে।
‘আবারও আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি যে আপনি টেলিফোনটি ধরেছিলেন। গত রাতে অনেক সময় ধরে তাকে টেলিফোনে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। পাইনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অনেক রাতে গতকাল উনি ফেরেন। এসেই আপনার মেসেজ পান। অত রাতে টেলিফোন না করে সকালে টেলিফোন করেন। উনি ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আপনার কলের অপেক্ষা করবেন। এরপর ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্তু উনি ফ্রি থাকবেন।’
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়িতে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট, বেজেছে। আহমদ মুসা বলল, ‘বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না। এখনই টেলিফোনটা সেরে নেই।’
কথা শেষ করেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নাম্বারে টেলিফোন করল।
রিংটোন তিনবার বেজে উঠতেই ওপার থেকে একটা ভারী গলা বলে উঠল, ‘গুড মর্নিং বিভেন বার্গম্যান। কেমন আছেন?’
‘গুড মর্নিং রবার্ট পাওয়েল। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন?’
রবার্ট পাওয়েল নয়াদিল্লীস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত। আহমদ মুসার কথার উত্তরে সে বলল, ‘ভালো মি. বার্গম্যান। আমি আপনাকে খুঁজে হয়রান। আন্দামানে গিয়েও পাইনি। এদিকে বার বার আমাকে তাকিদ দিচ্ছে আপনাকে লোকেট করার। আন্দামানের খবরে উনি উদ্বিগ্ন।’
‘স্যরি। আন্দামানে যখন আপনি এসেছিলেন, তখন আমি পোর্ট ব্লেয়ার থেকে অনেক দূরে আহত হয়ে পড়েছিলাম। আপনি এখানে আসার খবর আমি ওখান থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আপনার টেলিফোন নাম্বার তখন দিতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট আন্দামানের কোন খবরে উদ্বিগ্ন?’
‘মি. প্রেসিডেন্ট আমাকে আন্দামানের খবর নিয়মিত মনিটর করে পাঠাতে বলেছেন। আমি সেটা পাঠিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি সেখানে রহস্যজনক নিহতের হার বেড়ে গেছে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের প্রায় একশ ভাগই সিআইএ-এর তথ্যমতে ভারতের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘মহাসংঘে’র লোক। সিআইএ এ তথ্য দিয়েছে যে, মহাসংঘের বিপরীতে ‘বিভেন বার্গম্যান’ নামে একজন লোক কাজ করছে। এর বেশি সিআইএ আর কোন তথ্য দিতে পারেনি। মি. প্রেসিডেন্ট সেখানকার প্রকৃত অবস্থা কি জানতে চান আপনার কাছ থেকে। কোন সাহায্য আপনার দরকার কিনা জানতে চেয়েছেন।’
‘ধন্যবাদ মি. এ্যামবেসডর। আপনি আন্দামানের খোঁজ রাখছেন এজন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। পরিস্থিতি এখনো আরও জটিলই রয়েছে। বিশেষ করে মুসলমানদের বিশেষ কম্যুনিটির লোক যে পরিকল্পিতভাবে নিহত হচ্ছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারী সংগঠনের লোকরাই এখন নিহত হচ্ছে। তবে সমস্যার জটিলতা তাতে কমেনি। প্রধানত যাকে উদ্ধার করতে আমার আন্দামানে আসা, তাকে উদ্ধার করা যায়নি। তার উপর কিডন্যাপ হয়েছেন হাজী আবদুল আলী আবদুল্লাহ। আপনি সেটা জানেন। ‘মহাসংঘ’ সংগঠনটি ‘ডুবো পাহাড়ে’র মতই বিপজ্জনক। খোদ আন্দামানের গভর্নর এর সাথে জড়িত দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এবং সরকারের রাজনৈতিক মহলে ‘মহাসংঘে’র শিকড় মজবুতভাবে বিস্তৃত। আর এরা কতটা বেপরোয়া তা বুঝা যায়, স্বয়ং গভর্নর তার নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করার ঘটনা থেকে। এই..........।’
আহমদ মুসার কথা আর অগ্রসর হতে পারলো না। এ্যামবেসেডর আহমদ মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘তুমি নিশ্চিত যে, গভর্নর বিবি মাধব এ কাজ করেছিলেন? সিআইএ সূত্রও আমাকে এটাই জানিয়েছে।’
‘ইয়েস মি. এ্যামবেসেডর, গভর্নর বিবি মাধবের মেয়ে সুষমা রাও-ও এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি তো নিশ্চিত অবশ্যই।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার শেষ বাক্যটার রেশ মেলাবার আগেই এ্যামবেসেডর দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কিন্তু বিবি মাধব নিজের মেয়েকে কেন কিডন্যাপ করবেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সিআইএ দিতে পারেনি।’
‘মি. এ্যামবেসেডর, যে কারণে বিবি মাধব বা মহাসংঘ শাহ আলমগীরের মা-বোনকে কিডন্যাপ করেছিল, সেই একই কারণে সুষমা রাওকে তারা কিডন্যাপ করেন। আহমদ শাহ আলমগীরের মা-বোন হাতছাড়া হয়ে যাবার পর সুষমা রাওকে কিডন্যাপ করা হয়। সুষমা রাওকে আহমদ শাহ আলমগীরের সামনে হাজির করে তারা সুষমার উপর সব রকমের নির্যাতন চালিয়ে আহমদ শাহ আলমগীরকে মুখ খুলতে বাধ্য করতে চেয়েছিল। ওদের.......।’
আবারও আহমদ মুসাকে তার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট পাওয়েল বলল, ‘বিবি মাধবও এত জঘন্য?’
‘মি. এ্যামবেসেডর, বিবি মাধব জঘন্য নয়, জঘন্য হল ‘মহাসংঘ’। এই ‘মহাসংঘ’ই মানুষকে অমানুষ বানাচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছ মি. বার্গম্যান। তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গুজরাটে যা করেছিল, সেই কাজই নিরবে আরও নিখুঁতভাবে, আরও সামগ্রিকভাবে করার কাজ তারা শুরু করেছে আন্দামান থেকে। একে আগে বাড়তে দেয়া যায় না। ভারত সরকারও নিশ্চয়ই একে আগে বাড়তে দেবে না। কিন্তু একটা কথা বলতো, ‘আহমদ শাহ আলমগীরের কাছ থেকে কি কথা বের করতে চায়?’
‘কি একটা বাক্স নাকি আহমদ শাহ আলমগীর কোথায় রেখেছে তা জানতে ও পেতে চায়। বাক্সে কি একটা দলিল ও আরও কিছু আছে। এর বেশি কিছু আমরা জানতে পারিনি এ্যামবেসেডর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আহমদ শাহ আলশগীরের কাছে থাকা কাগজপত্র ওদের কাছে এত মূল্যবান হবে কেন? আহমদ শাহ আলমগীর কি গোপন কোন গোষ্ঠীর সাথে ছিল, যাদের কোন কাগজপত্র তার কাছে গচ্ছিত আছে?’ এ্যামবেসেডর বলল।
‘এমন কথা কেউ বলে না। এমন কোন সংগঠন আন্দামানে নেই।’
একটু থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মি. এ্যামবেসেডর, আন্দামানে বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনারা কি করতে পারেন বলুন?’
‘আমরা অবশ্যই অনেক কিছুই করতে পারি। সবচেয়ে বড় যে কাজ করতে পারি সেটা হল ভারত সরকারকে গোটা বিষয় জানিয়ে তার কাছ থেকে প্রতিকার দাবী করা।’ বলল এ্যামবেসেডর রবার্ট পাওয়েল।
‘কি বলবেন আপনি?’
‘বলব ‘মহাসংঘে’র কথা। বলব আন্দামানে তাদের নির্মূল অভিযান, আহমদ শাহ আলমগীর ও হাজী আবদুল্লাহকে বন্দী করে রাখার কথা ইত্যাদি।’
কথা শেষ করেই এ্যামবেসেডর আবার দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘সুষমা রাও কি কোন ষ্টেটমেন্ট দিতে পারে?’
‘কাজে আসবে কি? আমি সুষমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখব। আমি মনে করি আপনি ভারত সরকারকে রাজি করাতে পারেন এবং ভারত সরকার সিবিআই-এর ভালো ইউনিটকে আন্দামানে পাঠাতে পারেন, তাহলে তারা হাজী আবদুল্লাহ ও আহমদ শাহ আলমগীরকে উদ্ধার করে হাতে-কলমে সব প্রমাণ করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার পারার কথা বলছ কেন? স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে তোমার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর শোন, আমার সব চুল সাদা হয়েছে। তুমি অনেক ছোট বলেই তোমাকে ‘তুমি’ বলেছি, কিছু মনে করো না। তাহলে কথার এখানেই শেষ বাই।’ বলল এ্যামবেসেডর রবার্ট পাওয়েল।
‘ধন্যবাদ মি. এ্যামবেসেডর। মি. প্রেসিডেন্টকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন। বাই।’ বলে মোবাইল অফ করে ফিরে এল সোফার দিকে। ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।
পিন পতন নিস্তব্ধতার মধ্যে সুরূপা সিংহাল, সাজনা সিংহাল, অরূপ রতন সিংহাল ও সুষমা রাও আহমদ মুসার কথা শুনছিল। আহমদ মুসা যখন মোবাইল নিয়ে সরে যায়নি তখন কথা শোনা যেতে পারে বলে সবাই মনে করেছে।
আহমদ মুসা সোফায় বসতেই সাজনা সিংহাল বলল, ‘স্যার, টেলিফোনে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ কয়েকবার এসেছে। শেষে আপনি প্রেসিডেন্টকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। কোন প্রেসিডেন্ট? ভারতের?’
‘না সাজনা, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথা আমরা বলেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
সাজনা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সুষমা রাও বলে উঠল, ‘আমাকে কি জিজ্ঞাসা করে দেখার কথা এ্যামবেসেডরকে বললেন ভাইয়া?’
‘তোমার ঘটনা সম্পর্কে তিনি তোমার কাছ থেকে একটা ষ্টেটমেন্ট চান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন? তিনি কি করবেন?’ বলল সুষমা রাও।
‘তিনি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট আন্দামানের ব্যাপারে ভারত সরকারকে বলবেন। তোমার ষ্টেটমেন্ট একটা দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই, আমি ষ্টেটমেন্ট দেব ভাইয়া।’
‘ঠিক আছে। তৈরি করে রাখ। তার বিশেষ টেলিফোনে আমি পাঠিয়ে দেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফ্যাক্সেও তো পাঠাতে পারেন।’ বলল সুষমা রাও।
‘না ফ্যাক্স, ই-মেইল, সাধারণ টেলিফোন কিছুই ব্যবহার করা যাবে না। অন্যেরা ধরে ফেলবে। ওটা মার্কিনীদের নিজস্ব চ্যানেলে পাঠাতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনি যে সব কাজের কথা বললেন, সেসব কাজে কি তিনি ভারত সরকারকে বলে সাহায্য করাতে পারবেন?’ বলল সুষমা রাও।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বলাই যথেষ্ট। তার উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে যদি একটা ইঙ্গিতও করেন, তাহলে দেখবে ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা এজেন্সী কিভাবে আন্দামানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চা এখন আর আমি খাচ্ছি না। এখনই একটু বেরুতে হবে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল সাজনা সিংহালের দিকে। বলল, ‘দেখ, আমার পাগড়ী কোথায়?’
‘শিখ সাজার পাগড়ী তো? নিয়ে আসছি স্যার। ইস্ত্রি হয়ে আছে।’ বলেই দৌড় দিল সাজনা সিংহাল।
মুহূর্ত কয়েক পরেই সাজনা ইস্ত্রি করা পাগড়ী নিয়ে হাজির হল।
‘ধন্যবাদ, সাজনা।’
বলে পাগড়ী হাতে নিয়ে আহমদ মুসা তার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
আহমদ চলে গেলে সাজনা সিংহাল অরূপ রতন সিংহালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দুলাভাই, স্যারকে মার্কিন সরকার এত গুরুত্ব দেন কেন?’
‘দেবারই কথা সাজনা। বলা হয় আহমদ মুসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক ষড়যন্ত্রের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে শান্তি, স্বচ্ছতা ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডার ফাদারসদের স্বপ্ন ছিল। তাই নতুন করে পুরাতনের স্বকীয় অবস্থানে ফিরে যাওয়া আমেরিকার বর্তমান নায়করা আহমদ মুসার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া স্বাভাবিক।’
‘খুব বড় বিষয়। আমি জানতাম না দুলাভাই, এত বড় পরিচয় তার! কিন্তু এই তুলনায় তাকে উপযুক্ত গুরুত্ব আমরা দিচ্ছি না।’ সাজনা বলল।
‘তাহলে এ বাড়িতে আর তাকে পাবে না। যতই ঝুঁকি থাক, সোজা গিয়ে হোটেলে উঠবেন।’ বলল সুরূপা সিংহাল।
সাজনার মুখ ম্লান হল। বলল, ‘তাহলে থাক বাবা বড় বড় ফর্মালিটি। উনি থাকছেন, সেটাই ভালো।’
বলে উঠে দাঁড়াল সাজনা সিংহাল। একটু পরে বলল, ‘চল সুষমা নিচে বাগানে যাই।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now