চোখের বালি (৩৮) "উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান আরাফাত হোসেন (০ পয়েন্ট)
X
বিনোদিনী যখন যাত্রিশূন্য
মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বাতায়ন
হইতে চষামাঠ ও ছায়াবেষ্টিত এক-
একখানি গ্রাম দেখিতে পাইল, তখন
তাহার মনে স্নিগ্ধনিভৃত পল্লীর
জীবনযাত্রা জাগিয়া উঠিল। সেই
তরুছায়াবেষ্টনের মধ্যে তাহার
স্বরচিত কল্পনানীড়ে নিজের প্রিয়
বইগুলি লইয়া কিছুকাল নগরবাসের
সমস্ত ক্ষোভ, দাহ ও ক্ষতেবেদনা
হইতে সে শান্তিলাভ করিতে
পারিবে, এই কথা তাহার মনে হইতে
লাগিল। গ্রীষেমর শস্যশূন্য
দিগন্তপ্রসারিত ধূসর মাঠের মধ্যে
সূর্যাস্তদৃশ্য দেখিয়া বিনোদিনী
ভাবিতে লাগিল, আর যেন কিছুর
দরকার নাই–মন যেন এইরূপ
সুবর্ণরজ্ঞিত স্তব্ধ-বিস্তীর্ণ
শান্তির মধ্যে সমস্ত ভুলিয়া দুই চক্ষু
মুদ্রিত করিতে চায়, তরঙ্গবিক্ষুব্ধ
সুখদুঃখ-সাগর হইতে জীবনতরীটি
তীরে ভিড়াইয়া নিঃশব্দ সন্ধ্যায়
একটি নিষ্কম্প বটবৃক্ষের তলায়
বাঁধিয়া রাখিতে চায়, আর কিছুতেই
কোনো প্রয়োজন নাই। গাড়ি
চলিতে চলিতে এক-এক জায়গায়
আম্রকুঞ্জ হইতে মুকুলের গন্ধ
আসিতেই পল্লীর স্নিগ্ধশান্তি
তাহাকে নিবিড়ভাবে আবিষ্ট
করিয়া তুলিল। মনে মনে সে কহিল,
“বেশ হইয়াছে, ভালোই হইয়াছে,
নিজেকে লইয়া আর টানাছেঁড়া
করিতে পারি না–এবারে সমস্ত
ভুলিব, ঘুমাইব–পাড়াগাঁয়ের মেয়ে
হইয়া ঘরের ও পল্লীর কাজে-কর্মে
সন্তোষের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে
জীবন কাটাইয়া দিব।
তৃষিত বক্ষে এই শান্তির আশা বহন
করিয়া বিনোদিনী আপনার
কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু
হায়, শান্তি কোথায়। কেবল শূন্যতা
এবং দারিদ্র্য। চারি দিকেই সমস্ত
জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, অনাদৃত, মলিন।
বহুদিনের রুদ্ধ স্যাঁৎসেঁতে ঘরের
বাষ্পে তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ
হইয়া আসিল। ঘরে অল্পস্বল্প যে-
সমস্ত আসবাবপত্র ছিল, তাহা
কীটের দংশনে, ইঁদুরের উৎপাতে ও
ধুলার আক্রমণে ছারখার হইয়া
আসিয়াছে। সন্ধ্যার সময়
বিনোদিনী ঘরে গিয়া পৌঁছিল–ঘর
নিরানন্দ অন্ধকার। কোনোমতে
সরষের তেলে প্রদীপ জ্বালাইতেই
তাহার ধোঁয়ায় ও ক্ষীণ আলোতে
ঘরের দীনতা আরো পরিস্ফুট হইল।
আগে যাহা তাহাকে পীড়ন করিত
না, এখন তাহা অসহ্য বোধ হইতে
লাগিল–তাহার সমস্ত বিদ্রোহী
অন্তঃকরণ সবলে বলিয়া উঠিল,
“এখানে তো এক মুহূর্তও কাটিবে
না।” কুলুঙ্গিতে পূর্বেকার দুই-একটা
ধুলায়-আচ্ছন্ন বই ও মাসিক পত্র
পড়িয়া আছে, কিন্তু তাহা ছুঁইতে
ইচ্ছা হইল না। বাহিরের
বায়ুসম্পর্কশূন্য আমবাগানে ঝিল্লি
ও মশার গুঞ্জনস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত
হইতে লাগিল।
বিনোদিনীর যে বৃদ্ধা
অভিভাবিকা ছিলেন, তিনি ঘরে
তালা লাগাইয়া মেয়েকে দেখিতে
সুদূরে জামাইবাড়িতে গিয়াছেন।
বিনোদিনী প্রতিবেশিনীদের
বাড়িতে গেল। তাহারা তাহাকে
দেখিয়া যেন চকিত হইয়া উঠিল। ও
মা, বিনোদিনীর দিব্য রং সাফ
হইয়া উঠিয়াছে, কাপড়চোপড়
ফিটফাট, যেন মেমসাহেবের মতো।
তাহারা পরস্পরে কী যেন ইশারায়
কহিয়া বিনোদিনীর প্রতি লক্ষ
করিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল।
যেন কী একটা জনরব শোনা
গিয়াছিল, তাহার সহিত লক্ষণ
মিলিল।
বিনোদিনী তাহার পল্লী হইতে
সর্বতোভাবে বহু দূরে গিয়া
পড়িয়াছে, তাহা পদে-পদে অনুভব
করিতে লাগিল। স্বগৃহে তাহার
নির্বাসন। কোথাও তাহার এক
মুহূর্তের আরামের স্থান নাই।
ডাকঘরের বুড়ো পেয়াদা
বিনোদিনীর আবাল্যপরিচিত।
পরদিন বিনোদিনী যখন পুষ্করিণীর
ঘাটে স্নান করিতে উদ্যত হইয়াছে,
এমন সময় চিঠির ব্যাগ লইয়া
পেয়াদাকে পথ দিয়া যাইতে
দেখিয়া বিনোদিনী আর
আত্মসংবরণ করিতে পারিল না।
গামছা ফেলিয়া তাড়াতাড়ি
উঠিয়া গিয়া তাহাকে ডাকিয়া
কহিল, “পাঁচুদাদা, আমার চিঠি
আছে?”
বুড়া কহিল, “না।”
বিনোদিনী ব্যগ্র হইয়া কহিল,
“থাকিতেও পারে। একবার দেখি।”
বলিয়া পাড়ার অল্প খান-পাঁচ-ছয়
চিঠি লইয়া উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া
দেখিল, কোনোটাই তাহার নহে।
বিমর্ষমুখে যখন ঘাটে ফিরিয়া
আসিল, তখন তাহার কোনো সখী
সকৌতুক কটাক্ষে কহিল, “কী লো
বিন্দি, চিঠির জন্যে এত ব্যস্ত
কেন।”
আর-একজন প্রগল্ভা কহিল, “ভালো
ভালো, ডাকের চিঠি আসে এত
ভাগ্য কয়জনের। আমাদের তো
স্বামী, দেবর, ভাই বিদেশে কাজ
করে কিন্তু ডাকের পেয়াদার দয়া
হয় না।”
এইরূপে কথায় কথায় পরিহাস স্ফুটতর
ও কটাক্ষ তীক্ষ্ণতর হইয়া উঠিতে
লাগিল। বিনোদিনী বিহারীকে
অনুনয় করিয়া আসিয়াছিল, প্রত্যহ
যদি নিতান্ত না ঘটে, তবে অন্তত
সপ্তাহে দুইবার তাহাকে কিছু নাহয়
তো দুই ছত্রও যেন চিঠি লেখে।
আজই বিহারীর চিঠি পাইবার
সম্ভাবনা অত্যন্ত বিরল, কিন্তু
আকাঙ্ক্ষা এত অধিক হইয়া উঠিল
যে, দূর সম্ভাবনার আশাও
বিনোদিনী ছাড়িতে পারিল না।
তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন
কতকাল কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছে।
মহেন্দ্রের সহিত জড়িত করিয়া
বিনোদিনীর নামে নিন্দা গ্রামের
ঘরে ঘরে কিরূপব্যাপ্ত হইয়া
পড়িয়াছে, শত্রু-মিত্রের কৃপায়
বিনোদিনীর কাছে তাহা অগোচর
রহিল না। শান্তি কোথায়।
গ্রামবাসী সকলের কাছ হইতে
বিনোদিনী নিজেকে নির্লিপ্ত
করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। পল্লীর
লোকেরা তাহাতে আরো রাগ
করিল। পাতকিনীকে কাছে লইয়া
ঘৃণা ও পীড়ন করিবার বিলাসসুখ
হইতে তাহারা বঞ্চিত হইতে চায়
না।
ক্ষুদ্র পল্লীর মধ্যে নিজেকে সকলের
কাছ হইতে গোপন রাখিবার চেষ্টা
বৃথা। এখানে আহত হৃদয়টিকে
কোণের অন্ধকারে লইয়া নির্জনে
শুশ্রূষা করিবার অবকাশ নাই–
যেখান-সেখান হইতে সকলের তীক্ষ্ণ
কৌতুহলদৃষ্টি আসিয়া ক্ষতস্থানে
পতিত হয়। বিনোদিনীর
অন্তঃপ্রকৃতি চুপড়ির ভিতরকার
সজীব মাছের মতো যতই আছড়াইতে
লাগিল, ততই চারি দিকের
সংকীর্ণতার মধ্যে নিজেকে
বারংবার আহত করিতে লাগিল।
এখানে স্বাধীনভাবে পরিপূর্ণরূপে
বেদনাভোগ করিবারও স্থান নাই।
দ্বিতীয় দিনে চিঠি পাইবার সময়
উত্তীর্ণ হইতেই বিনোদিনী ঘরে
দরজা বন্ধ করিয়া লিখিতে বসিল-
“ঠাকুরপো, ভয় করিয়ো না, আমি
তোমাকে প্রেমের চিঠি লিখিতে
বসি নাই। তুমি আমার বিচারক,
আমি তোমাকে প্রণাম করি। আমি
যে পাপ করিয়াছি, তুমি তাহার
কঠিন দণ্ড দিয়াছ; তোমার
আদেশমাত্র সে দণ্ড আমি মাথায়
করিয়া বহন করিয়াছি। দুঃখ এই,
দণ্ডটি যে কত কঠিন, তাহা তুমি
দেখিতে পাইলে না। যদি দেখিতে,
যদি জানিতে পাইতে, তাহা হইলে
তোমার মনে যে-দয়া হইত তাহা
হইতেও বঞ্চিত হইলাম। তোমাকে
স্মরণ করিয়া, মনে মনে তোমার
দুইখানি পায়ের কাছে মাথা
রাখিয়া, আমি ইহাও সহ্য করিব।
কিন্তু প্রভু, জেলখানার কয়েদি কি
আহারও পায় না। শৌখিন আহার
নহে–যতটুকু না হইলে তাহার প্রাণ
বাঁচে না, সেটুকুও তো বরাদ্দ আছে।
তোমার দুই ছত্র চিঠি আমার এই
নির্বাসনের আহার–তাহা যদি না
পাই, তবে আমার কেবল
নির্বাসনদণ্ড নহে, প্রাণদণ্ড।
আমাকে এত অধিক পরীক্ষা করিয়ো
না, দণ্ডদাতা। আমার পাপমনে
অহংকারের সীমা ছিল না–
কাহারো কাছে আমাকে এমন
করিয়া মাথা নোয়াইতে হইবে, ইহা
আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।
তোমার জয় হইয়াছে, প্রভু; আমি
বিদ্রোহ করিব না। কিন্তু আমাকে
দয়া করো–আমাকে বাঁচিতে দাও।
এই অরণ্যবাসের সম্বল আমাকে অল্প-
একটু করিয়া দিয়ো। তাহা হইলে
তোমার শাসন হইতে আমাকে কেহই
কিছুতেই টলাইতে পারিবে না।
এইটুকু দুঃখের কথাই জানাইলাম। আর
যে-সব কথা মনেআছে, বলিবার জন্য
বুক ফাটিয়া যাইতেছে, তাহা
তোমাকে জানাইব না প্রতিজ্ঞা
করিয়াছি–সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা
করিলাম।
তোমার বিনোদ-বোঠান।”
বিনোদিনী চিঠি ডাকে দিল–
পাড়ার লোকে ছি ছি করিতে
লাগিল। ঘরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া
থাকে, চিঠি লেখে, চিঠি পাইবার
জন্য পেয়াদাকে গিয়া আক্রমণ
করে–কলিকাতায় দুদিন থাকিলেই
লজ্জাধর্ম খোয়াইয়া কি এমনই
মাটি হইতে হয়।
পরদিনেও চিঠি পাইল না।
বিনোদিনী সমস্ত দিন স্তব্ধ হইয়া
রহিল, তাহার মুখ কঠিন হইয়া উঠিল।
অন্তরে বহিরে চারি দিকের আঘাত
ও অপমানের মন্থনে তাহার হৃদয়ের
অন্ধকার তলদেশ হইতে নিষ্ঠুর
সংহারশক্তি মূর্তিপরিগ্রহ করিয়া
বাহির হইয়া আসিতে চাহিল। সেই
নিদারুণ নিষ্ঠুরতার আবির্ভাব
বিনোদিনী সভয়ে উপলব্ধি করিয়া
ঘরে দ্বার দিল।
তাহার কাছে বিহারীর কিছুই ছিল
না, ছবি না, একছত্র চিঠি না, কিছুই
না। সে শূন্যের মধ্যে কিছু যেন
একটা খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল।
সে বিহারীর একটা-কিছু চিহ্নকে
বক্ষে জড়াইয়া ধরিয়া শুষ্ক চক্ষে
জল আনিতে চায়। অশ্রুজলে অন্তরের
সমস্ত কঠিনতাকে গলাইয়া
বিদ্রোহবহ্নিকে নির্বাপিত
করিয়া বিহারীর কঠোর আদেশকে
হৃদয়ের কোমলতম প্রেমের
সিংহাসনে বসাইয়া রাখিতে চায়।
কিন্তু অনাবৃষ্টির মধ্যাহ্ন-আকাশের
মতো তাহার হৃদয় কেবল জ্বলিতেই
লাগিল, দিগ্দিগন্তে কোথাও সে
এক ফোঁটাও অশ্রুর লক্ষণ দেখিতে
পাইল না।
বিনোদিনী শুনিয়াছিল, একাগ্রমনে
ধ্যান করিতে করিতে যাহাকে
ডাকা যায়,সে না আসিয়া থাকিতে
পারে না। তাই জোড়হাত করিয়া
চোখ বুজিয়া সে বিহারীকে
ডাকিতে লাগিল,”আমার জীবন শূন্য,
আমার হৃদয় শূন্য, আমার চতুর্দিক
শূন্য–এই শূন্যতার মাঝখানে একবার
তুমি এসো, এক মুহূর্তের জন্য এসো,
তোমাকে আসিতেই হইবে, আমি
কিছুতেই তোমাকে ছাড়িব না।”
এই কথা প্রাণপণ বলে বলিতে
বলিতে বিনোদিনী যেন যথার্থ বল
পাইল। মনে হইল, যেন এই প্রেমের
বল, এই আহ্বানের বল, বৃথা হইবে না।
কেবল স্মরণ-মাত্র করিয়া, দুরাশার
গোড়ায় হৃদয়ের রক্ত সেচন করিয়া
হৃদয় কেবল অবসন্ন হইয়া পড়ে। কিন্তু
এইরূপ একমনে ধ্যান করিয়া প্রাণপণ
শক্তিতে কামনা করিতে থাকিলে
নিজেকে যেন সহায়বান মনে হয়।
মনে হয়, যেন প্রবল ইচ্ছা জগতের
আর-সমস্ত ছাড়িয়া কেবল
বাজ্ঞিতকে আকর্ষণ করিতে
থাকাতে প্রতিমূহূর্তে ক্রমে ক্রমে
ধীরে ধীরে সে নিকটবর্তী
হইতেছে।
বিহারীর ধ্যানে যখন সন্ধ্যার
দীপশূন্য অন্ধকার ঘর নিবিড়ভাবে
পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে–যখন
সমাজসেংসার, গ্রাম-পল্লী, সমস্ত
বিশ্বভুবন প্রলয়ে বিলীন হইয়া
গিয়াছে–তখন বিনোদিনী হঠাৎ
দ্বারে আঘাত শুনিয়া ভূমিতল হইতে
দ্রুতবেগে দাঁড়াইয়া উঠিল, অসংশয়
বিশ্বাসে ছুটিয়া দ্বার খুলিয়া
কহিল, “প্রভু, আসিয়াছ?” তাহার দৃঢ়
প্রত্যয় হইল, এই মুহূর্তে জগতের আর
কেহই তাহার দ্বারে আসিতে পারে
না।
মহেন্দ্র কহিল, “আসিয়াছি,
বিনোদ।”
বিনোদিনী অপরিসীম বিরাগ ও
প্রচণ্ড ধিক্কারের সহিত বলিয়া
উঠিল, “যাও যাও, যাও এখান হইতে।
এখনই যাও।”
মহেন্দ্র অকস্মাৎ স্তম্ভিত হইয়া
গেল।
“হ্যাঁলা বিন্দি, তোর দিদিশাশুড়ি
যদি কাল”–এই কথা বলিতে বলিতে
কোনো প্রৌঢ়া প্রতিবেশিনী
বিনোদিনীর দ্বারের কাছে
আসিয়া “ও মা” বলিয়া মস্ত ঘোমটা
টানিয়া সবেগে পলায়ন করিল।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now