বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
ব্ল্যাক ঈগলের সন্ত্রাস
চ্যাপ্টার- ৪
৪
শাহ বাড়ির ছাদে হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নিয়েছে। হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আহমদ মুসা প্রস্তুত।
হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দাদীমা এখন তাহলে যেতে হয়। হেলিকপ্টার ষ্টার্ট নিয়েছে।’
দাদীমা, যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ সবাই উঠে দাঁড়াল। দাদী বলল, ‘কি বলব ভাই, অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক এক অভিযানে যাত্রা করছ। শুধু আল্লাহকে বলব, তিনি তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করুন, তোমাকে সফল করুন, তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। তোমার মতো হাজারো আহমদ মুসাকে সৃষ্টি করুন। তাহলে দুনিয়ায় আমাদের মতো মজলুমদের আর কোন সমস্যা থাকবে না।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল দাদী।
দু’চোখ ছলছলিয়ে উঠেছে যয়নব যোবায়দা ও ফরহাদ ফরিদ উদ্দিনের। যয়নব যোবায়দা বলল, ‘যদি জানতাম আপনাকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলব, তাহলে ঐভাবে চিঠি পাঠাতাম না, আপনাকে ডাকতাম না। কারও সুখের জন্যে, কারও মুক্তি বা নিরাপত্তার জন্য আরেকজনের এত কষ্ট হতে পারে না।’ যয়নব যোবায়দারও কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দুনিয়ায় সব দাদী, সব মা, সব বোনেরা এমনটি হয়। আমি ভাগ্যবান দাদী। এমন স্নেহ দেবার দাদী, বোন, ভাই আমার দুনিয়া জোড়া। আপনাদের এই অশ্রু আমার জন্যে আশীর্বাদ।’ বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা ছাদে ওঠার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
সবাই তার পেছনে হাঁটতে শুরু করল। যেতে যেতে যয়নব যোবায়দা বলল। ‘ভাই সাহেব, আমি কি ভাবী সাহেবার সাথে কথা বলতে পারি?’
‘অবশ্যই যয়নব যোবায়দা। আমি কিছুক্ষণ আগে জোসেফাইনের সাথে কথা বলেছি। তোমার কথা সে জানে।’
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’ বলল যয়নব যোবায়দা।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাদী ও যয়নব যোবায়দা দাঁড়াল। আবার এক দফা সালাম বিনিময় হলো।
ফরহাদ ও আহমদ মুসা উঠে গেল ছাদে।
সর্বশেষে ফরহাদ ফরিদ উদ্দিন বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ফরহাদের পিঠ চাপড়ে ‘সাবধানে থেকো, সতর্ক থেকো’ বলে হেলিকপ্টার উঠে গেল।
হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ছুটল পশ্চিম দিকে।
হেলিকপ্টার আহমদ মুসাকে নামিয়ে দেবে সোয়াশ’ কিলোমিটার পশ্চিমে ‘হাটাই’ শহরে।
আহমদ মুসার গতিবিধি যাতে শত্রুপক্ষের কাছে গোপন থাকে, এজন্যেই এই হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা।
হাটাই থেকে একটা প্রাইভেট জীপে অতপর আহমদ মুসাকে অগ্রসর হতে হবে পাত্তানী মালয় রোড ধরে দক্ষিণে। এই রোড পাত্তানীর শেষ শহর সিডাও পর্যন্ত গেছে। সিডাও থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মালয়েশিয়া সীমান্ত। মালয়েশিয়া পার হয়ে তাকে পৌছুতে হবে সীমান্ত থেকে ৪০ কি.মি. ভেতরে পাত্তানী-মালয় সড়কের শেষ প্রান্ত ‘সুংচাই পেতানী’ শহরে। এই শহর থেকে দুর্গম এলাকার মধ্যে একটা পথ-চিহ্ন ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে মালয়েশিয়া সীমান্তে আবার তাকে ফিরে আসতে হবে। মালয়েশিয়া অতিক্রম করে তাকে পাত্তানীর দুর্গম শহর বেতাংগে পৌছুতে হবে এখানে তাকে অনেকগুলো কাজ সেরে ১০০ কিঃ মিঃ উত্তরে গোপনে ‘কাতান টেপাংগো’ পৌছার চেষ্টা করতে হবে। এ যেন দরজায় প্রবেশ না করে দরজার সামনে থেকে গোটা ঘরের চারপাশ ঘুরে এসে দরজায় প্রবেশ করা। পাত্তানী শহর থেকে ‘কাতান টেপাংগো’ সত্তর আশি কিলোমিটারের বেশি নয়। এই ‘কাতান টেপাংগো’ আসতেই তাকে ৭০০ কিলোমিটার ঘুরতে হবে, তাও ভিন দেশের মধ্যে দিয়ে। চিন্তা ভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আহমদ মুসা। থাই গোয়েন্দা বিভাগও আহমদ মুসার সাথে একমত হয়েছে। পাত্তানী শহর থেকে কাতান টেপাংগো যাবার দুটি পথের বিবেচনা করে দেখা হয়েছে। জল পথে গেলে কাতান হ্রদ বা জলাভূমি পর্যন্ত পৌছার খবর পেয়ে যাবে ব্ল্যাক ঈগল। অন্যদিকে কাঁচা একটা পথ পাত্তানী থেকে কাতান টেপাংগো’র পাশ পর্যন্ত গেছে। কিন্তু এ পথ সম্পূর্ণটা বলতে গেলে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দখলে। এ পথে পা দিলেই সে খবর কাতান টেপাংগো পৌছে যাবে। কিন্তু ব্ল্যাক ঈগলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাতান টেপাংগো পৌছুতে হবে যাতে বড় ধরনের রক্তপাত এড়ানো যায় এবং বাঁচানো যায় জাবের জহীর উদ্দিনকে। এ অবস্থাতেই হাটাই সুংগাই রোড ধরে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে সুংগাই থেকে পাত্তানীর সীমান্ত শহর বেতাংগে গিয়ে সেখান থেকে পেছন দিক দিয়ে ‘কাতান টেপাংগো’ প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা ও রুট নির্বাচন আহমদ মুসার এবং আহমদ মুসাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বেতাংগ থেকে ‘কাতান টেপাংগো’র রাস্তা অজ্ঞাত, অনিশ্চিত ও দুর্গম। মালয়েশিয়ার সুংগাই থেকে আসা কাঁচা রাস্তা বেতাংগ হয়ে কাতান পর্বত শ্রেণীর অনেক নিচে জংগলের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে, পরে পূর্ব দিকে ফিরে পাত্তানী শহর পর্যন্ত গেছে। এ রাস্তা দিয়ে কাতান টেপাংগো যাওয়া যায় না। কাতান টেপাংগো যাওয়ার অজ্ঞাত পথ কাতান পাহাড়ের উপর দিয়ে। জনশ্রুতি অনুসারে কাতান পাহাড়ের এই পথ থেকে এক সুড়ংগ পথে কাতান টেপাংগো যাওয়া যায়। কাতান পাহাড়ের এক সময়ের এই রাস্তা অব্যাহত ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই রাস্তার সন্ধান দিতে পারে শুধু পাহাড়ের সন্তান বলে কথিত ‘কোহেতান (কাতান) কবির’ বংশের কোন লোক। এরা এখনও পাহাড়ের বাস করে, পাহাড়ে পাহাড়েই ঘুরে বেড়ায়। বেতাংগ শহরের উত্তরাংশের একটি পাহাড়ে ওদের একটা ষ্টেশন আছে। এখানে ওদের কেউ না কেউ থাকে। আহমদ মুসাকে এই ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। ‘কোহেতান কবির’দের কারও সাহায্য নিতে হবে সামনে এগুবার জন্যে। এদিকে আহমদ মুসার এই অভিযান একেবারেই অনিশ্চিত যাত্রা। বেতাংগ পর্যন্ত পৌছে তাকে একেবারেই ভাগ্য, মানে আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করতে হবে।
এই চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌছে গেল হাটাই শহরে।
ছোট্ট হেলিকপ্টারটি তাকে পুলিশ অফিসের একটি মাঠে নামিয়ে দিল।
এখান থেকেই একলা যাত্রা আহমদ মুসার। নির্দেশিকা অনুসারে এখান থেকে একটা বাহন যোগাড় করে তাকে হাটাই সেন্ট্রাল রোডের ৯ নম্বর সরকারি গাড়ির পুলে যেতে হবে।
আহমদ মুসা মাঠ থেকে বেরিয়ে অটোরিক্সা যোগাড় করে ছুটল সেন্ট্রাল রোডের দিকে।
সেন্ট্রাল পুলে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে নাম্বার ওয়ান পার্কিং লোকেশানে একটি ল্যান্ড ক্রুজার জীপ দাঁড়িয়ে আছে। চাবী ঝুলছে গাড়ির কী হোলে।
আহমদ মুসা দরজা খুলে গাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই পকেট থেকে লাইটার বের করে বটমের একটি ক্ষুদ্র সাদা সুইটে চাপ দিল। সংগে সংগেই টপে একটা নীল আলো জ্বলে উঠল। নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা যে অন্তত ২৫ বর্গফুট এলাকার মধ্যে কোন বিস্ফোরক নেই।
আহমদ মুসা লাইটারটি পকেটে রেখে দিল।
লাইটারটি অনেক কাজের। এটি একই সংগে লাইটার, ডিটেক্টর, ক্যামেরা, লেসারগান এবং রেডিও রিসিভার ট্রান্সমিটার।
লাইটারটা তাকে গিফট করেন থাই সহকারী গোয়েন্দা প্রধান পুরসাত প্রজাদিপক।
চাবি ঘুরিয়ে ড্যাশ বোর্ডে কেবিন খুলল আহমদ মুসা। তার নতুন পাসপোর্ট এখানেই থাকার কথা। পাসপোর্ট পেয়ে গেল আহমদ মুসা।
থাইল্যান্ডের এই পাসপোর্টে আহমদ মুসার নাম আহমদ মুসাই লেখা হয়েছে। পাসপোর্টে মালয়েশিয়ার ভিসা লাগানো রয়েছে।
পাসপোর্ট পকেটে পুরে গাড়ি ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
গাড়ি নেমে এল রাস্তায়।
হাটাই-সুংগাই রোড ধরে মালয়েশিয়া বর্ডারের দিকে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার জীপ।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। সকাল ১০টা।
আহমদ মুসার লক্ষ্য এই হাইওয়ের শেষ প্রান্ত সুংগাই পেতানী। আহমদ মুসা তিনটার মধ্যে সেখানে পৌছুতে চায়। মাঝখানে থাই-মালয়েশিয়া বর্ডারে এবং যোহরের নামাযের জন্যে তাকে থামতে হবে।
হাটাই শহর থেকে বেরুনোর পর হাইওয়ে ধরে তার গাড়ি তীব্র গতিতে চলতে শুরু করল। শীঘ্রই গতির কাটা ১০০ কিলোমিটার অতিক্রম করল।
বেতাংগ শহরের উত্তরাংশের সোগা কাতান পাহাড় খুঁজে পেয়েছে আহমদ মুসা। কিন্তু ‘কোহেতান কবীর’ পরিবার নামের কোন পরিবার খুঁজে পায়নি।
পাহাড়টি খুব ছোট নয়। ঝোপ, জংগল, ফল বাগান, সবজি বাগান, বাজার, প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদির বাইরে কয়েকশত পরিবারের বাস এই পাহাড়ে।
আহমদ মুসা গোটা পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছে। একে ওকে কোহেতান কবির পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারেনি।
ভাষা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় লোকরা অপভ্রংশ মালয়ী ও অপভ্রংশ আরবী মেশানো ভাষায় কথা বলে। লিখিত ভাষা ও কথ্য ভাষার মধ্যে এত পার্থক্য যে কোন কোন ক্ষেত্রে কথ্য শব্দ একেবারে নতুন রূপ নিয়েছে।
বেতাংগে পৌছার পরদিন ছিল শুক্রবার।
আহমদ মুসা সোগা কাতান পাহাড়ে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা রোড সাইড রেষ্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে একজন যুবকের সাথে আলাপ করছিল। আহমদ মুসা কথার এক ফাঁকে তাকে ‘কোহেতান কবির’ পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করে। সে জানায় যে, এ ধরনের কোন পরিবারের নাম সে শুনেনি। সে আরও জানায়, এখানে আসল নাম অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। ডাক নামই আসল নাম হয়ে যায়। তারা যে পাহাড়ী পরিবার একথা আহমদ মুসাকে জানায়। সে বলে, এখানে সব পরিবারের শেকড় পাহাড়ে। কিন্তু পাহাড়কে তারা এখন ভুলেছে। অবশ্য দুএকটি পরিবার আছে, যাদের কাছে পাহাড়ই এখনও তাদের আবাস।
এ সময় আজানের শব্দ ভেসে আসে।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকায়। বেলা ১২টা।
‘মসজিদ এখান থেকে কত দূর?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করে যুবককে।
‘এই পাহাড়েরই অল্প কিছু উত্তরে। কেন মসজিদে যাবেন? আজ জুমআর দিন এজন্য?’ বলে যুবকটি।
‘আমি মুসলমান কেমন করে জানলে?’ জিজ্ঞেস করে আহমদ মুসা।
‘কপালে সিজদার দাগ ছাড়াও চেহারা দেখেই আমি বুঝেছি। মুসলমানদের চেহারায় একটা পবিত্র লাবণ্য থাকে। আপনার চেহারায় তা আরও বেশি। চিনব না কেন?’ যুবকটি বলে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমিও কি যাবে মসজিদে?’
‘অবশ্যই যাব। না গেলে আগামী শুক্রবারে জবাবদিহী করতে হবে।’ বলে যুবক।
‘জুমআয় না গেলে জবাবদিহী করতে হয়? কার কাছে?’ জিজ্ঞেস করে আহমদ মুসা।
‘কেন মসজিদে একজন করে সরদার থাকেন। তিনি বংশের সরদারের চেয়েও শক্তিশালী।’ বলে যুবক।
‘তার কাজ কি?’ বলে আহমদ মুসা।
‘এলাকার মানুষদের সাপ্তাহিক দানে গড়ে ওঠা তহবিলের তিনি পরিচালক। সামাজিক বিচার-ফায়সালা করেন। এবং মানুষকে ইসলামী অনুশাসনের উপর থাকার ব্যাপারে তাকিদ করেন।’ যুবকটি বলে।
‘তহবিল দিয়ে কি কাজ হয়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তহবিলের কাজ তিনটি। মসজিদের সাথে একটা মক্তব আছে, সেটা চালানো। এলাকার দরিদ্র লোকদের স্বাবলম্বী হওয়ার কাজে সাহায্য করা এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সাহায্য দেয়া।’ যুবকটি বলে।
‘বাঃ সুন্দর ব্যবস্থা।’ বলে আহমদ মুসা। একথা শুনে আনন্দে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
যুবকটি উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘চলুন বিদেশী ভাই, আজান শোনা গেলেও জায়গাটা খুব কাছে নয়, যেতে কিন্তু সময় লাগবে। পাহাড়ে ওঠা-নামা ও অনেক বাঁক ঘুরে যেতে হবে।
বেশ বড় মসজিদটি। আহমদ মুসা দেখল, মেয়েরাও মসজিদে উপস্থিত। মসজিদের ডান দিকে বসেছে ছেলেরা, বাম দিকে মেয়েরা। মাঝখানে ৪ ফুটের মতো উঁচু পার্টিশন, কাপড়ের। খুশি হলো আহমদ মুসা। বহু মুসলিম দেশেও যা দেখা যায় না, তা এই জংগলের জনপদে এসে দেখতে পেল সে।
মসজিদে ঢুকে সুন্নাত নামায শেষ করে বসেই একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। পাশেই বসেছিল সাথে আসা যুবকটি। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ‘বিদেশী ভাইয়া, ইমাম সাহেব অসুস্থ। তিনি হাসপাতালে। সহকারী মৌলভীসাহেব নামায পড়াবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন, আসার পথে দূর্ঘটনায় পড়ে তিনিও হাসপাতালে। এখন খুতবা পড়ার লোক নেই। এখন যোহর পড়বে কিনা, সেই আলোচনা চলছে।’
শুনেই আহমদ মুসা বলে, ‘যোহর পড়ার দরকার নেই। খোতবা পড়ার কেউ না থাকলে আমি পড়াতে পারি।’
শুনে যুবকটি দারুণ খুশি হয়ে ওঠে। সে দ্রুত উঠে সরদারের কাছে চলে যায় এবং তাকে বিষয়টা বলে।
সরদার স্বয়ং যুবকটির সাথে আহমদ মুসার কাছে আসে।
সরদার ৭০ উর্ধ্ব সম্পূর্ণ সফেদ কেশধারী হলেও তার স্বাস্থ্য অটুট। সে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলে, ‘আমরা খুব খুমি হবো বাবা তুমি জুমআ পড়িয়ে দিলে। এই মসজিদের একশ’ বছরের ইতিহাসে আজকের মতো ঘটনা ঘটেনি।’
আহমদ মুসা সবিনয়ে বলে, ‘আপনাদের অনুমতি হলে আমি পড়িয়ে দেব।’
খুশি হয়ে সরদার উঠে দাঁড়ায় এবং তার জায়গায় ফিরে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। একজন মেহমান এসেছেন। তিনি জুমআর নামায পড়াবেন। নামাযের সময় হয়ে গেছে। আমি তাঁকে মিম্বরে আসার অনুরোধ করছি।’
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে মিম্বরে বসে।
মুয়াজ্জিন খোতবার বই আহমদ মুসার হাতে দিয়ে আযান দিতে চলে যায়। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ায় খোতবা দেবার জন্যে।
হাতের খোতবার বই দেয়ালের তাকে রেখে খোতবা শুরু করে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার আরবী উচ্চারণ অত্যন্ত মিষ্টি এবং তেলাওয়াত মর্মস্পর্শী।
আহমদ মুসা হামদ, সানা ও তেলাওয়াতের পর মালয়, আরবী ও ইংরেজী মেশানো ভাষায় তার খোতবায় দুটি বিষয় তুলে ধরে। এক. জান্নাতের পথ কঠিন কেন এবং জাহান্নামের পথ সহজ কেন। দুই. দুনিয়াতে মুসলমানরা আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পদানত হওয়ার মূল কারণ কি। প্রথম বিষয়ের উপর আহমদ মুসা একটা হাদীস বর্ণনা করে বলে, অনন্ত সুখের জান্নাত দুঃখ, বেদনা, ত্যাগ, কোরবানীর সাগর দিয়ে ঘেরা, অন্যদিকে অনন্ত দুঃখ ভোগের জাহান্নাম ভোগ-লিপ্সার আকর্ষণ দিয়ে সাজানো। জান্নাতের চারদিকের দুঃখ, ত্যাগ-কোরবানীর সাগর পাড়ি দিতে ধৈর্য প্রয়োজন, লোভ সম্বরণ প্রয়োজন। অনেকেই এটা পারে না বলে তাদের জন্যে জান্নাতের পথ কঠিন হয়ে যায়। আর জাহান্নামের চারদিকে সাজানো ভোগ-লিপ্সার আকর্ষণ অধিকাংশ মানুষই উপেক্ষা করতে পারে না। এরাই গিয়ে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে যেমন পতঙ্গ প্রদীপের আগুনে গিয়ে আত্মগুতি দেয়। ইতিহাস থেকে নানা উপমা ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আহমদ মুসা তার আলোচনাকে প্রাণস্পর্শী করে তোলে। দ্বিতীয় বিষয়ের আলোচনায় আহমদ মুসা বলে, ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধের দায়িত্ব ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিত্যাগ করে মুসলমানরা যখন অন্যায়, অসত্য, জুলুম, নির্যাতনের সাথে গলাগলি করে দুনিয়ার সমৃদ্ধি সন্ধান করে, তখন নৈতিক বা আদর্শিক শক্তির বিলয় ঘটে। আদর্শিক শক্তির অনুপস্থিতি মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির পতন ত্বরান্বিত করে। এভাবেই ন্যায়েল শক্তি যখন আমরা হারালাম, তখন অন্যায়ের শক্তি এসে আমাদের গ্রাস করল।
আহমদ মুসার এই খোতবা এতই দরদ মাখা ছিল যে মুসলিস্নদের অধিকাংশই অশ্রুসিক্ত হয়।
নামায শেষ হলে প্রথমেই সরদার এসে আহমদ মুসার সাথে কোলাকুলি করে এবং দাওয়াত দেয় আহমদ মুসাকে তার বাসায়। উল্লেখযোগ্য সবাই এসে আহমদ মুসার সাথে সালাম বিনিময় করে। কেউ কেউ দূর থেকে তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চলে যায়। আহমদ মুসা চাইছিল কোহেতান কবির পরিবারের কথা সরদারকে কিংবা কাউকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সেরকম সুযোগ সে পায় না। অবশেষে সে ভাবে, ইতিমধ্যে কিছু না হলে দাওয়াত খেতে গিয়ে সে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।
তৃতীয় দিনের বিকেল।
আহমদ মুসা হাঁটছিল প্রশস্ত একটা উপত্যকার পথ ধরে।
দু’পাশেই ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া উঁচু টিলা জাতীয় পাহাড়। খুব উঁচু নয় কিন্তু প্রশস্ত। এটাই সোগা কাতান পাহাড়। আহমদ মুসা ঘুরে ফিরে এখানেই ছুটে আসে।
আজও এসেছে সেভাবেই। আহমদ মুসা ধীরে ধীরে হাঁটছিল।
হঠাৎ সূর্যের আলো উবে গেল।
আহমদ মুসা তাকাল আকাশের দিকে।
দেখল টস টসে পানি ভরা মেঘ। এ মেঘ যে কতটা বিপজ্জনক, তিন দিনে টের পেয়েছে আহমদ মুসা। এ মেঘ মাথার উপর আসা মানে বালতি থেকে পানি ঢালার বেগে বৃষ্টি এসে ছেঁকে ধরা।
আহমদ মুসা পাহাড়ের আশ্রয়ে উঠার জন্যে দৌড় দিল।
অনেক খানি উঠে গেল পাহাড়ে।
পাহাড় শীর্ষের শুরুতেই বড় টিলার শীর্ষে একটা সুন্দর বাড়ি। পাহাড় শীর্ষের টিলাগুলোর মধ্যে এই টিলাই সবচেয়ে বড় এবং বাড়িটাও বড় সবার চেয়ে।
ঘুরাঘুরির সময় কয়েকবার দেখেছে সে এ বাড়িটা।
বড় বড় ফোটায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে এল।
আহমদ মুসা যখন দৌড়ে বাড়িটার বারান্দায় উঠল, তখন আধাভেজা হয়ে গেছে সে।
বারান্দাটা আসলে বাড়ির গেটের সামনের ষ্টান্ডিং স্পেস।
বারান্দায় উঠে মুখ তুলতেই বড় দরজার মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা।
দরজার পাশেই একটা কাঠের প্লেট দেয়ালের সাথে সেঁটে রাখা আছে। এটা একটা নেমপ্লেট। তাতে মালয়ী ভাষায় লেখা ‘কবিলা আল কাতান’।
নেমপ্লেটটি পড়ে আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে আনল দরজার উপর।
ঠিক এই সময়ই দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল।
খোলা দরজায় দাঁড়ানো এক তরুণী। পরনে পাজামা। গায়ে কামিজের উপর ওড়না। মাথায় মালয়েশীয় পরদার রুমাল। ফর্সা ও বুদ্ধিদীপ্ত মালয়ী চেহারা।
দরজা খুলেই সালাম দিয়েছে তরুণীটি।
তার চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা লজ্জা,কিছুটা আনন্দ।
সালাম দিয়েই তরুণীটি বলল,‘ভেতরে আসুন স্যার। ভিজে গেছেন। বৃষ্টির ঝাপটা বারান্দায়ও আসছে। আরও ভিজে যাবেন।’ পরিষ্কার ইংরেজি ভাষা মেয়েটির কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল।
মেয়েটি একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল।
ঘরটা প্রায় ফাঁকাই।
ঘরে ঢুকেই ডান দিকে দেয়ালের পাশে জুতো রাখার র্যাক। সামনের দেয়ালের পাশে একটা আলনা দেখতে পেল। চারদিকের দেয়ালে সাঁটা কয়েকটা হ্যাংগার। ঘরের মাঝখানে কাঠের টেবিল। তার চারপাশে চেয়ার। বার্নিস করা সুন্দর চেয়ার টেবিল।
ঘরটা যে ট্রানজিট বুঝল আহমদ মুসা। জুতো ও বাড়তি কাপড় এখানে ছাড়া হয়। ভেতরে প্রবেশের আগে অনেক সময় আগন্তুককে এখানে ওয়েটও করতে হয়।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকল মেয়েটি দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘরের বাম পাশে একটা দরজার দিকে ইংগিত করে বলল, ‘স্যার ওদিকে ড্রইং, চলুন।’
মেয়েটির চোখে-মুখে একটা অন্তরঙ্গ ভাব। চেনা-জানার একটা ছাপ সেখানে।
বিস্মিত আহমদ মুসা বলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চেনেন। কিন্তু আমি আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।’
আহমদ মুসা জুতো খুলে র্যাকে রাখতে রাখতে বলল।
মেয়েটি কোন জবাব না দিয়ে বলল, ‘স্যার আপনি জ্যাকেটটাও খুলতে পারেন। ওটা বেশি ভিজে গেছে।’
সত্যি ভিজা জ্যাকেটে অস্বস্তি লাগছিল আহমদ মুসার। খুশি হয়ে আহমদ মুসা জ্যাকেট খুলে দেয়ালেল হ্যাংগারে ঝুলাল।
মেয়েটি ‘আসুন স্যার’ বলে তখন হাঁটতে শুরু করেছে।
মেয়েটির পেছনে পেছনে আহমদ মুসা ড্রইং রুমে প্রবেশ করল।
বিশাল ড্রইং রুম।
লাল কার্পেটের উপর লাল সোফাসেট সাজানো।
ড্রইং রুমের আরেক অংশে কার্পেটের উপর পুরু ফরাশ এবং সোফসেট পাতা।
‘স্যার আমাদের পাহাড়ি কায়দার ফরাশ এবং ইংরাজী কায়দার সোফাসেট দুই-ই আছে। স্যার সোফাসেট আমার পছন্দ, আপনারও নিশ্চয় তাই। বসুন স্যার।’ একটা সোফা দেখিয়ে বলল মেয়েটি।
মেয়েটির কথা বলায় কোন আড়ষ্টতা নেই। কণ্ঠ সংযত, ভদ্র। চেহারায় পাহাড়ি লজ্জার পুরু ছাপ, কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট, খোলামেলা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসল।
‘স্যার গতকাল আপনাকে আমি মসজিদে দেখেছি। জুমআর খোতবা দিয়েছিলেন, নামায পড়িয়েছিলেন। ইসলামকে আপনি উত্তর আধুনিক ভাষায় তুলে ধরেছেন স্যার। এমন খোতবা শুনিনি কখনও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘স্যার একটু বসুন। আমি দাদুকে ডাকি।’
বলে দৌড় দিল মেয়েটি।
আহমদ মুসা আরেকবার তাকাল ড্রইং রুমের চারদিকে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সাজানো ঘর। সামনের দেয়ালে একটা দীর্ঘ পাহাড় শ্রেণীর দৃশ্য। কাতান পাহাড়ই হবে এটা, ভাবল আহমদ মুসা। অন্যপাশের দেয়ালে একটি নগরীর সুন্দর দৃশ্য। নিশ্চয় এটা বেতাংগ নগরী।
ঘরে ঢুকল সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধ।
তার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এ যে মসজিদের সেই সরদার, যে তাকে দাওয়াত করেছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তার হা হয়েছিল সালাম দেয়ার জন্যে। কিন্তু সরদারের মুখে সালাম উচ্চারিত হয়েছে।
সরদার এসে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে। বলল, ‘খুব খুশি হয়েছি এভাবে তোমাকে আমার বাসায় পেয়ে।’
থামল মুহূর্তের জন্যে। আবার বলে উঠল,‘অনেক সম্মানী, অনেক জ্ঞানী, অনেক বড় কেউ তুমি, কিন্তু আমার নাতির মতো। তোমার মতোই আমার এক নাতি কি এক পাহাড়-বিদ্যায় পাশ করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। অতএব সেদিন তোমাকে ‘তুমি’ বলেছি, আজও বলছি।’
‘অবশ্যই জনাব। আমি খুশি হবো’। আহমদ মুসা বলল।
সরদার আহমদ মুসাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
বসেই বলল সরদার, ‘আমি জামাল উদ্দিন আল কাতানী। কবিলা আল-কাতানের আমি বর্তমান সরদার। পাহাড়েই আমাদের বাড়ি। শুক্রবারসহ সপ্তাহের দু’একদিন আমি এ বাড়িতে থাকি।’
থামল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘আমি আহমদ মুসা। গত পরশু পাত্তানী থেকে আমি এখানে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা। মনে মনে ভাবল গোপন করে আর লাভ নেই। ব্ল্যাক ঈগল তার পরিচয় জেনে গেছে। আর যারা আহমদ মুসাকে জানে না, তাদের কাছে আসল-নকলের কোন পার্থক্য নেই।
‘কিন্তু তুমি তো থাইল্যান্ডের নও। তোমার আরবী, ইংরেজি, মালয় উচ্চারণ থেকে বুঝেছি তুমি আশে-পাশের কোন দেশেরও নও। তাহলে তোমার বাড়ি কোথায়?’ জিজ্ঞাসা সরদারের।
সেই মেয়েটি চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কথা শেষ করেই সরদার বলল, ‘দাও বোন চা দাও।’
মেয়েটি পাশের একটি টি-টেবিলে চায়ের ট্রে রেখে দুই কাপে চা ভরে একটি সরদার, অন্যটি আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল।
সরদার মেয়েটির দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এ আমার নাতনী আলিয়া কাতানী। তোমার সাথে তো আগেই দেখা হয়েছে। ও কুয়ালামপুরের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ‘ভাষাতত্ব’ বিষয়ে পড়ে। মসজিদে তোমার বক্তৃতা শুনে ও দারুণ অভিভূত হয়েছে। ও বলছে, ইসলামের উপর বক্তৃতা সে কুয়ালামপুরে প্রায়ই শোনে। কিন্তু এমন বক্তৃতা নাকি সে..........।’
‘থাম দাদু। সাক্ষাতে এত প্রশংসা করতে মানা আছে।’ সরদারের কথার মাঝখানেই বলে উঠল আয়েশা আলিয়া কাতানী। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তৃতয়ি একটা কাপে চা ঢেলে নিয়ে দাদুর ওপাশের এক সোফায় গিয়ে সে বসল।
‘আয়েশা ঠিক বলেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি খুশি। ও বড় পন্ডিত হবে।’
বলেই সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী দৃষ্টি ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ভাই, আমি তোমাকে দাওয়াত করে রেখেছি মাত্র। কিন্তু বৃষ্টি তোমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। নিশ্চয় তুমি চিনে বাড়িতে ওঠনি!’
‘জ্বি না। তবে এই বাড়ি আগে দেখেছি। গত কয়েকদিন ধরে এই পাহাড়ে আমি ঘুরছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই পাহাড়ে? কেন?’ জিজ্ঞাসা জামাল উদ্দিন কাতানীর।
সংগে সংগে উত্তর দিল না আহমদ মুসা।
চোখ তুলে তাকাল একবার বৃদ্ধ জামাল উদ্দিন কাতানীর দিকে। তার মনে হলো, তার অনুসন্ধান সম্পর্কে বলার উপযুক্ত জায়গা এটা হতে পারে।
মুহূর্তকালের এই ভাবনার পর আহমদ মুসা বলল, ‘আমি একটা পরিবারকে খুঁজছি জনাব।’
‘একটা পরিবার? কোন পরিবার?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন। তার চোখে-মুখে কৌতুহল।
আয়েশা আলিয়া কাতানীও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
‘কাতান পাহাড়ের একটা পরিবার। শহরের এই পাহাড়েও তাদের একটা ঠিকানা আছে। পরিবারের নাম কোহেতান কবীর।’
নাম শোনার সংগে সংগে চমকে উঠল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানি। ভ্রু কুচকালো আয়েশা আলিয়া কাতানীরও।
‘কেন খুঁজছো ঐ পরিবারকে? পরিচয় আছে ওদের সাথে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন কাতানী। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘না পরিচয় নেই। ওদের নাম জানি এবং কিছু জানি ওদের সম্পর্কে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি পাত্তানী শহর থেকে এসেছ বললে। কার কাছ থেকে শুনেছ ওদের সম্পর্কে?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন।
‘কিছু শুনেছি পাত্তানীর শাহ পরিবারের কাছ থেকে, কিছু শুনেছি থাই গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শাহ পরিবারকে তুমি চেন? কাকে চেন?’ সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে সন্দেহের ছায়া। তার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ।
‘শাহজাদী যয়নব যোবায়দাকে চিনি। তার দাদীমাকেও জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওদের সম্পর্কে আর কি জান?’ বলল সরদার জামাল উদ্দিন দ্রুতকণ্ঠে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে অস্পষ্ট একটা হাসি ফুটে উঠেছে। সে নিশ্চিত যে, এই কাতানী পরিবার ‘শাহ পরিবার’কে চেনে। তাহলে এরা কি ‘কোহেতান কবির’ পরিবারকেও চিনতে পারে? বলল আহমদ মুসা, ‘শাহজাদী যয়নব যোবায়দার ভাই জাবের বাংগসা জহীর উদ্দিন থাই সরকারের হাতে বন্দী ছিল। ব্ল্যাক ঈগল তাকে ছিনিয়ে এনেছে থাই সরকারের কাছ থেকে। এখন সে ব্ল্যাক ঈগলের হাতে বন্দী। শুধু বন্দী নয়, তার জীবন বিপন্ন। ব্ল্যাক ঈগলের লোকজনকে যদি থাই সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছেড়ে না দেয় তাহলে জহীরকে ব্ল্যাক ঈগলরা হত্যা করবে।’
থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়, উত্তেজনা ও সন্দেহের ঝড় বইছে সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে-মুখে। আয়েশা আলিয়া কাতানীও যেন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ।
সরদার জামাল উদ্দিনের বিস্ময় হলো, আহমদ মুসা এসব কি বলছে! অবশ্য সরদার জামাল উদ্দিনরাও থাই টিভি ও পত্র-পত্রিকা থেকে জেনেছে ব্ল্যাক ঈগল ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে তাদের লোককে না ছাড়লে তারা জাবের জহীর উদ্দিনকে হত্যা করবে। এটা তো থাই প্রপাগান্ডা বলেই সরদার জামাল উদ্দিনরা জানে। কিন্তু আহমদ মুসাও ঠিক থাই সরকারের মতোই কথা বলছে। সে থাই গোয়েন্দা কিংবা থাই এজেন্ট? কিন্তু এত ভালো লোক এই পথে কিভাবে যায়!
সতর্ক হলো সরদার জামাল উদ্দিন। বলল, ‘ব্ল্যাক ঈগলকে তোমরা কোত্থেকে পেলে? জাবের জহীর উদ্দিনকে তো মুক্ত করেছে ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ (এমপিএম) এবং জাহের জহীর উদ্দিন এখন এমপিএম-এর সাথে থেকে থাই নীপিড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’
‘না জনাব। জাহের জহীর উদ্দিন ব্ল্যাক ঈগলের হাতে বন্দী আছে। আর এমপিএম এখন সশস্ত্র বা হিংসাত্মক আন্দোলনে নেই। তাদের নাম ভাক্সিয়ে ব্ল্যাক ঈগল ষড়যন্ত্রমূলখ কাজে রত আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ব্ল্যাক ঈগল কে?’ সরদার জামাল উদ্দিনের প্রশ্ন।
‘আন্তর্জাতিক একটি ষড়যন্ত্রকারী সংস্থা। থাইল্যান্ডে এদের কাজ হলো নিজেরা থাই পুলিশ, থাই আর্মির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে তার দায় মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া। সে কারণে থাই পুলিশরা মুসলমানদের উপর নীপিড়ন শুরু করে, আর মুসলমানরা থাই সরকারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। এভাবে থাই মুসলমানদের তারা ধ্বংস করতে চায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার কথা যে ঠিক এবং এরা ব্ল্যাক ঈগল তার প্রমাণ কি?’ সরদার জামাল উদ্দিন বলল। তার গলায় অসন্তুষ্টির সুর।
আহমদ মুসা তাকাল সরদার জামাল উদ্দিনের দিকে। বলল, ‘আপনার কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা অসন্তুষ্টি দেখতে পাচ্ছি। আপনি যে প্রশ্ন করছেন তার জবাব দেব। কিন্তু আপনি যদি সত্য জানার জন্যে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে শুধু বলব।’
গম্ভীর হয়ে উঠল সরদার জামাল উদ্দিন। বলল, ‘তুমি আমার জানা ও বিশ্বাসের বিপরীত কথা বলছ। তবে মনে রেখ, আমার ধর্ম এবং সত্য আমার কাছে সব চেয়ে বড়।’
‘ধন্যবাদ জনাব’ বলে কথা শুরু করল আহমদ মুসা, ‘প্রমাণের কথা যেহেতু বলেছেন, আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। আমি থাইল্যান্ডে আসার গত কয়েক সপ্তাহে যা ঘটেছে সব কথাই এর মধ্যে আসবে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে আমি ওদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলব। এক. ওরা পকেট মেশিনগানসহ এ ধরনের যে অস্ত্র ব্যবহার করে, তাতে খোদাই করা সাংকেতিক অক্ষর ও নাম্বার হিব্রু ভাষায় লেখা। তার মানে এ অস্ত্রগুলো ইসরাইলে তৈরি, দুই. ‘মুজাহেদীন পাত্তানী মুভমেন্ট’ (এমপিএম) নামের কভারে ‘ব্ল্যাক ঈগল’এর যারা বাইরে থেকে এসে থাইল্যান্ডে কাজ করছে, তাদের অধিকাংশই আরব বংশোদ্ভুত, আরবী ভাষায় ফ্লুয়েন্ট কথা বলতে পারে এবং নামও আরবীয় তাদের, কিন্তু তারা মুসলমান নয়, এবং তিন. তারা তাদের চিঠিপত্রে, বিভিন্ন ডকুমেন্টে এবং তাদের জামা ও জ্যাকেটের কলার ব্যান্ডের ভেতরের অংশে পরিচয়মূলক যে মনোগ্রাম ব্যবহার করে সে মনোগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্ল্যাক ঈগল। ব্ল্যাক ঈগল বসে আছে মুসলমানদের প্রতীক অর্ধচন্দ্রের বুকের উপর। আর ঈগলের মাথার উপর রয়েছে ইসরাইলের ৬ কোণা তারকা।’ থামল আহমদ মুসা।
সরদার জামাল উদ্দিনের চোখে-মুখে প্রবল বিস্ময়। সে একবার চাইল আয়েশা আলিয়া কাতানীর দিকে। একটু চিন্তা করল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
ভেতরে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘আহমদ মুসা তুমি একটু বস। আর আয়েশা বোন তুমি একটু আমার সাথে এস।’
আয়েশা আলিয়া কাতানীও উঠে দাদুর সাথে ভেতরে গেল।
দু’জনের মুখই গম্ভীর।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now