বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন
বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

২২.অদৃশ্য আতঙ্ক (৫)

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান আরাফাত হোসেন (০ পয়েন্ট)

X জেনেভা লেকের পশ্চিম তীরে সুন্দর শহর মোরজে। পটে আঁকা ছবির মত সুন্দর শহরটি। শহরটির পশ্চিমে মাউন্ট টেন্ডর। পর্বতটির সবুজ উপত্যকায় জেনেভা লেকের আদিগন্ত স্ফটিক জলরাশিকে সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোরজে। মাউন্ট টেন্ডর থেকে তাকালে মনে হয় সবুজ এক বাগান ভাসছে লেক জেনেভার স্বচ্ছ বুকে। আবার লেক জেনেভার দিগন্ত থেকে শহরটিকে মনে হয় যেন সুন্দর একটা সবুজ তিলক ঘুমিয়ে আছে মাউন্ট টেন্ডর-এর কোলে। শহরটির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লেকের ধার ঘেঁষে সুন্দর একটি বাড়ি। বাড়িটি তৈরী হয়েছে লেকের বুক চিরে গড়ে ওঠা একটা মিনি উপদ্বীপের উত্তরে। বাড়ির তিন দিকেই হ্রদের স্ফটিক পানির নিরন্তর নৃত্য। তীর বরাবর দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগানের একটা সবুজ মেলা। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত সুন্দর বাড়িটি। মনে হয় যেন একটা রাজহংস সবুজ মালা পড়ে হ্রদের পানিতে ভাসছে। বাড়িটি সুইজারল্যান্ডের সাবেক কুটনীতিত মিঃ কেলভিনের। এখন তার বয়স সত্তর। দশ বছর আগে রিটায়ার করার পর তিনি এখানেই বসবাস করছেন। বাড়িটার দু’তলার ড্রইংরুম। গল্প হচ্ছিল তিনজনের মধ্যে। একজন মহিলা, জিনা ডোনান্ট। তিনি একজন কূটনীতিকের স্ত্রী এবং মিঃ কেলভিনের একমাত্র সন্তান। সয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। আরেকজন বালিকা, জিনা জোসেফাইন। জিনা ডোনান্টের একমাত্র মেয়ে। আর তৃতীয়জন তাতিয়ানা। রাশিয়ান মেয়ে। পিটার দি গ্রেট পরিবারের সন্তান সে। মিঃ কেলভিন দীর্ঘদিন মস্কো ছিলেন কুটনীতিক হিসেবে। তার মেয়ে জিনা ডোনান্টের স্বামীও তরুন কুটনীতিক তখন সেখানে। সেই সময় পিটার পরিবারের সাথে কেলভিন পরিবারের গভীর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তাতিয়ানা সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে এসে উঠেছে কেলভিনদের বাড়িতে। কেলভিন পরিবার আগেই তাকে জানিয়েছিল, সে যতদিন সুইজারল্যান্ড থাকবে ততদিন সে তাদের মেহমান হবে। কথা বলছিল জিনা ডোনান্ট, ‘সত্যিই সিসি মাছির ব্যাপারটা দারুন আতংকের সৃষ্টি করেছে। ৬টি মর্মান্তিক মৃত্যুর রহস্য ভেদ এখনও হয়নি। এই জন্যেই তোমাকে এ সময় আসতে না করেছিলাম।’ ‘আপনারা বাস করতে পারছেন, আর আমি ক’দিন থাকতে পারবো না কেন?’ বলল তাতিয়ানা। ‘আমরা বাড়িতে আছি। যাই ঘটুক, আমরা বাড়ি ছাড়তে পারি না, দেশ ছাড়তে পারি না।’ বলল ডোনান্ট। আমার যুক্তিটা এ রকমই। মৃত্যু ভয় এড়িয়ে চলতে চাইলে গাড়ি-প্লেন কিছুতেই চড়া যাবে না। অপরাধী সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঘরের বাইরে বেরুনোও তাহলে বন্ধ করতে হবে।’ ‘ঠিকই বলেছ। তবে আমরা এই বয়সে যে ঝুঁকি নিতে পারি, তোমাদের তা নেয়া ঠিক নয়। ‘প্রকৃত’ জীবনটাই তোমার সামনে পড়ে আছে।’ বলে হাসল জিনা ডোনান্ট। গম্ভীর হয়ে উঠল তাতিয়ানার মুখ। বলল, ‘প্রকৃত জীবন কখন আসবে তার কি নির্দিষ্ট সময় আছে?’ ‘অবশ্যই আছে। তুমিও সেটা দেখবে। সে সময় তোমার আসছে।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল জিনা ডোনান্ট। একটা ম্লান হাসি তাতিয়ানার ঠোঁটে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। ও হাসিটা কান্নার চেয়েও বেদনার। বলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি একেবারে নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু সবার জীবনেই কি সে সময় আসে?’ ‘তা আসে না। অনেকে তো সে সময় পর্যন্ত বাঁচেও না। কিন্তু তুমি এভাবে হতাশার সুরে কথা বলছ কেন?’ বলল জিনা ডোনান্ট। তাতিয়ানা একটু হাসল। বলল, ‘এইতো আপনি বললেন সবার জীবনে আসে না। তাহলে বিষয়টা সবার জন্যে নিশ্চিত নয়। যা নিশ্চিত নয়, তার মধ্যেই তো একটা হতাশার ভাব থাকে। জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হেসে উঠে বলল, ‘তুমি ছোট বেলা থেকেই কথার রাজা, তুমি ঠকবে কেন কথায়! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’ ‘করুন।’ ‘আমি সে সময় দেখেছি, কিছুটা একাকিত্বকে তুমি যেন ভালবাসো। তোমার কোন বয় ফ্রেন্ড সে সময় আমি দেখিনি। নিশ্চয় তুমি এ অসামাজিকতা এখন ছেড়েছ?’ ‘কোন বয় আমার ফ্রেন্ড হতে চাইলেই না এই অসামাজিকতা আমি ছাড়তে পারি।’ হেসে বলল তাতিয়ানা। ‘বাজে কথা বলছ তুমি।’ গম্ভীর হলো তাতিয়ানা। বলল, ‘বাজে কথা বলছি না আপা।’ তাতিয়ানার কন্ঠস্বর ভারি। তাতিয়ানার গম্ভীর মুখ আর ভারি কন্ঠ নজর এড়াল না জিনা ডোনান্টের। বিস্মিত হলো সে। অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল তাতিয়ানার দিকে। তার মনে হলো তাতিয়ানার গম্ভীর মুখের আড়ালে অনেক অশ্রু লুকিয়ে আছে। তাহলে কোন দুঃখ আছে নাকি তাতিয়ানার জীবনে? জিনা ডোনান্ট উঠে গিয়ে তাতিয়ানার পাশে বসল। বলল, ‘তাতিয়ানা আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছ। কিছু ঘটেনি তো?’ তাতিয়ানা হাসতে চেষ্টা করে বলল, ‘ভাববেন না আপা। খারাপ ঘটনার দু’টো পক্ষ থাকে। কিন্তু আমার কোন অন্য পক্ষ নেই।’ জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার মুখ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমার এসব দার্শনিক কথার মানে কি?’ জিনা ডোনান্ট যখন কথা বলছিল, সে সময়েই টেলিফোন এল। জিনা ডোনান্টের মেয়ে জিনা জোসেফাইন টেলিফোন ধরেছিল। জিনা ডোনান্ট থামতেই তার মেয়ে জিনা জোসেফাইন তাকে বলল, ‘আম্মা, নানার টেলিফোন ক্লিনিক থেকে।’ জিনা ডোনান্ট গিয়ে টেলিফোন ধরল। জিনা ডোনান্ট টেলিফোন ধরে ফিরে এসে বসতেই তাতিয়ানা বলল উদ্বিগ্ন কন্ঠে, ‘আংকল ক্লিনিকে কেন? কি হয়েছে সেখানে?’ ‘একজন আহত লোককে আব্বা তার ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন।’ ‘এ্যাকসিডেন্ট?’ ‘না। আব্বা ফেরার সময় শহরের বাইরে হাইওয়েতে লোকটিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পেয়েছে। কে বা কারা তাকে নির্দয়ভাবে মেরেছে।’ ‘আংকল কি বললেন?’ ‘বললেন, লোকটির জ্ঞান ফিরলেই আব্বা বাসায় ফিরবেন।’ ‘আংকল কিন্তু আরও বেশী সংবেদনশীল হয়েছেন।’ ‘ঠিক বলেছ। তার উপর লোকটি আবার বিদেশী তো।’ ‘কোন ট‌্যুরিস্ট?’ ‘বোধ হয় না। আব্বা বললেন, ট‌্যুরিস্টদের যেমন অবস্থায় পাওয়া যায়, সে তেমন নয়। তার সাথে কিছুই নেই। তার পাশে একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেছে, তাতে অল্প কিছু সুইস মুদ্রা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।’ কথা শেষ করেই জিনা ডোনান্ট উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘তোমরা এস। আমি দেখি টেবিলে খাবার দিতে বলি। আব্বাও এখনি এসে পড়বেন।’ জিনা ডোনান্ট চলে গেল। পরদিন সকাল। জিনা জোসেফাইন তার পড়ার ঘরে বসে পড়ছে। তাতিয়ানা আয়াকে নিয়ে বেবিয়েছে লেকের ধারে ঘুরতে। ড্রইং রুমে বসে গল্প করছে জিনা ডোনান্ট এবং তার আব্বা মিঃ কেলভিন। কথা হচ্ছিল আগের রাতের ঘটনাটা নিয়েই। ‘ঘটনাটা কোন ছিনতাই, না কোন ব্যক্তিগত শত্রুতার ব্যাপার?’ বলল জিনা ডোনান্ট। ‘কোন একটা তো নিশ্চয় হবে। তবে চেহারায় ছেলেটাকে আমার ভাল মনে হয়েছে। আমি বিস্মিত হয়েছি, জ্ঞান ফেরার পর ওর মধ্যে সামান্য চাঞ্চল্যও আমি দেখিনি। আমি, নার্স এবং ডাক্তার তখন তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। সে চোখ খুলে শান্ত চোখে আমাদের দিকে চাইল। যেন বাড়িতে সে ঘুম থেকে উঠল। তার মুখ থেকে প্রথম যে শব্দ বেরুল, সেটা ছিল আমাদের প্রতি তার ‘ধন্যবাদ।’ তারপর ডাক্তার যখন আমার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি তাকে ক্লিনিকে নিয়ে গেছি, আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি কৃতজ্ঞ এক্সিলেন্সি।’ কোন দাঙ্গাবাজ বা সাধারণ চরিত্রের লোকের এমন নিশ্চিন্ত, শান্ত ও ভদ্র আচরণ হতে পারে না।’ টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন ধরল মি কেলভিণ উঠে গিয়ে। ক্লিনিক থেকে টেলিফোন। কথা সেরে ফিরে আসতে আসতে বলল, ‘ক্লিনিকে যেত হয়।’ ‘কেন লোকটির খারাপ কিছু হয়েছে?’ বলল জিনা ডোনাল্ট। ‘না খারাপ কিছু নয়। আহত ছেলেটা চলে যেতে চায়। অথচ বলেছে এ সময় তার সামান্য হাটাও নিরাপদ নয়।’ ‘আপনি কি করতে চাচ্ছেন আব্বা?’ ‘ক্লিনিকে যাওয়া উচিত ভাবছি। তুমিও যেতে পার আমার সাথে।’ ‘ঠিক আছে আব্বা,চল ঘুরে আসি’ হাসপাতালে পৌঁছে তারা সোজা কেবিনে চলে গেল। কেবিনে প্রবেশ করল মিঃ কেলভিন প্রথমে। তার পেছনে পেছনে জিনা ডোনাল্ট। আহত লোকটির উপর চোখ পড়তেই জিনা ডোনান্ট ভূত দেখার মত চমকে উঠল। আহত লোকটি আহমদ মুসা। যাকে মিসেস জিনা ডোনান্ট আব্দুল্লাহ বলে জানে। মিঃ কেলভিন সেদিন আহমদ মুসাকে সংগাহীন অবস্থায় হাইওয়ে থেকে তুলে ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল। পায়ের শব্দে চোখ খুলেছিল আহমদ মুসা। তারও চোখ পড়েছিল জিনা ডোনান্টের উপর। ‘আপনি?’ বিস্ময়ের এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল জিনা ডোনান্টের কন্ঠে। জিনা ডোনান্টের কথায় বিস্মিত হয়ে মিঃ কেলভিন তাকাল একবার জিনা ডোনান্টের দিকে, আর একবার আহমদ মুসার দিকে। তারপ্র বলল, ‘জিনা মা, তুমি একে চেন?’ ‘জি আব্বা,প্লেন হাইজ্যাক চেষ্টার কাহিনী তুমি পড়েছ, আমিও তোমাকে বলেছি। ইনিই হাইজ্যাকারদের একজনকে হত্যা, আরেকজনকে কাবু করে প্লেন রক্ষা করেছিলেন।’ ‘হ্যা। এ সেই ইয়ংম্যান?’ বলে মিঃ কেলভিন আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে তার ডান হাত তুলে নিয়ে চেপে ধরে বলল,’ ব্রাভো, ইয়ংম্যান। কংগ্রাচুলেশন। আমার মেয়ে জিনার কাছে, আমার নাতনী জোসেফাইনের কাছে তোমার কথা, সেদিনের বিস্তারিত ঘটনা শুনেছি।তোমাকে ধন্যবাদ।’ জিনা ডোনান্টও এগিয়ে এল। বলল,’ কিন্তু সেদিন বিমানবন্দরে নেমে আপনি কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। জানেন, ইয়ারলাইন্স কতৃপক্ষ এবং আন্তর্জতিক বিমান পরিবহন সমিতি আপনাকে অনেক খুঁজেছে। আপনার জন্য একটা বড় পুরষ্কার বরাদ্দ করেছে। আপনি নিয়েছেন সে পুরষ্কার ? আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল,’ না, পুরষ্কার আমি নেইনি।‘ ‘পত্রিকায় পড়েননি?’ ‘পড়েছি।’ ‘তাহলে?’ ‘সেদিনই পুরষ্কার আমি পেয়ে গেছি। মানুষের আশীর্বাদই আমার পুরষ্কার’ ‘তা বটে। কিন্তু তুমি এক বিস্ময়কর ছেলে তো। আজকের জমানায় এমন করে কেউ ভাবে?’ বলে এক্ টু থেমেই মিঃ কেলভিন আবার বলল,’ থাক, এসব কথা পরে হবে। এখন বল, তুমি ক্লিনিক ছাড়তে চাচ্ছ কেন?উঠে দাঁড়াবার মত সামর্থ তোমার হয়নি।ডাক্তার বলেছে।‘ ‘একটু কষ্ট হবে। কিন্তু আমার যাওয়া প্রয়োজন।জরুরী কাজ আছে।’ ‘কষ্ট হবে মানে? দারুন ক্ষতি হতে পারে। যতই জরুরী কাজ থাক, তার চেয়ে জীবন বড়। এখানে তোমার কে আছে?’ ‘ক’জন বন্ধু আছে জেনেভায়।‘ ‘তাদের ওখানে উঠেছ?’ ‘না, এক ট্যুরিষ্ট কটেজে উঠেছি।‘ ‘সেখানে কেউ আছে?’ ‘না, সেখানে আমি একাই থাকি।’ ‘তাহলে আর চিন্তা কি।এমন তো নয় যে বাড়িতে কোন সমস্যা আছে। সুস্হ হও তারপর যাবে।’ ‘আব্বা,তুমি ডাক্তারকে বলে রিলিজ নাও।একে বাসায় নিয়ে যাব। বাসায় ভাল থাকবে। প্রতিদিন ডাক্তার যাবে দেখে আসবে।দরকার হলে নার্স আমরা ডেকে নেব।’ মিঃ কেলভিন উজ্জল চোখে তাকাল মেয়ের দিকে।বলল, ‘ধন্যবাদ মা। একথাটা আমার মনে আসেনি। সেটাই ভাল হবে।আমি ডাক্তারকে বলছি।’ বলে যেতে উদ্যত হলো মিঃ কেলভিন। ‘আমার একটু কথা আছে জনাব।’ হাত তুলে মিঃ কেলভিনকে বাধা দিয়ে বলল আহমদ মুসা। ‘বল।’ বলে দাঁড়াল মিঃ কেলভিন। ‘আমি ক্লিনিকেই থাকতে চাই।’ ‘কেন? আমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাও না এ জন্যে?’ ‘একথা সত্য নয়। আমার অবস্থায় আপনিও কি একথা বলতেন না?’ ‘শুনেছি তোমার কথা।’ হেসে কথাটুকু বলে মিঃ কেলভিন তাকাল জিনা ডোনাল্টের দিকে। বলল, ‘মা জিনা তুমি গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটটা ঠিক করে নাও। আমি ডাক্তারকে বলে সব ঠিক করছি।’ সংগে সংগেই জিনা ডোনান্ট বেরিয়ে গেল। মিঃ কেলভিনও। বেলা দশটা। তাতিয়ানা বাইরে থেকে ফিরে দু’তলায় উঠার জন্যে সিঁড়িতে পা রেখেছিল। জিনা জোসেফাইন দৌড়ে এসে তাতিয়ানার একটা হাত চেপে ধরে বলল,’ কি মজা আন্টি সেই লোক এসেছে।’ ‘কোন লোক?’ জোসেফাইনের পিঠে একটা চাট্রি মেরে চোখ উলটে বলল তাতিয়ানা। ‘কেন গল্প করেছিলাম না, প্লেনে একজন লোক হাইজ্যাকারদের মেরে শেষ করে প্লেনটাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল। সেই লোক।’ ‘সেই লোক? তাকে কোথায় পাওয়া গেল?’ ‘সেই-ই ত আহত লোক, নানু যাকে কাল ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল।’ ‘তাকে বাসায় আনা হয়েছে?’ ‘হ্যাঁ। আম্মা, নানু কিছুক্ষন আগে তাকে নিয়ে এসেছেন’ ‘কেন?’ ‘খুব ভাল লোক তিনি’ কথা বলতে বলতে তাতিয়ানা এবং জোসেফাইন দু’তলায় ড্রইংরুমে এসে প্রবেশ করল। ড্রইংরুমে বসেছিল জিনা ডোনান্ট, জোসেফাইনের মা। সে জোসেফাইনের শেষ কথাটা শুনতে পেয়েছিল। বলল,’কার কথা বলছ জোসেফাইন?’ ‘আংকলের কথা বলছি আম্মা। খুব ভাল না?’ ‘অবশ্যই ভাল মা। ভাল না হলে পরের জন্য কেউ জীবনের ঝুকি নিতে যায়?’ ‘কিন্তু আন্টি, সে লোকটির এ দশা হলো কেন?’ বলল তাতিয়ানা। ‘সেই আলোচনাই এতক্ষণ করে এলাম। বেশি কথা বলে না তো, মেপে মেপে কথা বলে। এতটুকু বলল, যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারা তার ব্যক্তিগত শত্রু নয়। একজন ক্রিমিনালকে সে তাড়া করতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।’ ‘লোকটির নাম কি?’ ‘আব্দুল্লাহ’ ‘আব্দুল্লাহ?মানে মুসলমান?’ ‘হ্যাঁ’ ‘আংকল বলছিলেন বিদেশী। কোন দেশী?’ ‘এশিয়ান। চেহারায় মনে হয় তুর্কি’ ‘শুনলাম উনি চলে যেতে চান, বাসায় আনলেন যে!’ ‘সেদিন প্লেনে সে জোসেফাইনের পাশে বসেছিল। আমি জোসেফাইনের অন্যপাশে ছিলাম।সিটে বসার পর থেকেই তার সুন্দর আর সপ্রতিভ ব্যবহার আমার ভাল লেগেছিল। জোসেফাইনের সাথে কথা বলা দেখে মনে হয়েছে সে যেন আমাদের একান্ত কেউ। তার পর দেখলাম তার ভদ্র ও ন্ম্রতার মধ্যে সিংহের শক্তি ও সাহস ও আছে।অদ্ভূত কৌশলে একাই সে হাইজ্যাকারদের কবল থেকে প্লেনের কয়েক’শ মানুষকে রক্ষা করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, জেনেভা এয়ারপোর্টে নেমে অলক্ষ্যে সে সরে যায়। প্রশংসা ও পুরষ্কার কিছুই সে নেয়নি।এমন একজন লোক দারুন বিপদে পড়েছে। তাকে কি ক্লিনিকে ফেলে রাখা যায়? ডাক্তার ও নার্স প্রতিদিন একবার করে আসবে।’ ‘কোথায় রেখেছেন?’ ‘দু’তলায় উঠা-নামা করতে কষ্ট হবে চিন্তা করে একতলায় মেহমান খানায় রেখেছি’ । ‘ঠিকই হয়েছে। লনে হাঁটতে পারবে।’ কিন্তু তাতিয়ানা মনে মনে বলল,’ খুব ভাল হয়েছে ওকে দু’তলায় না তুলে। একজন অপরিচিতের এইভাবে এখানে থাকার কথায় তাতিয়ানা অস্বস্তি বোধ করছিল।’ ‘তুমি যাবে তাকে দেখতে?’ ‘না। পরে।’ মুখে একথা বললেও মনে মনে সে বলল,’ সে কেন দেখতে যাবে তাকে?’ ‘ও, ভুলে গেছি। তুমি দেখতে যাবে কেন? তুমি ত এমনিতেই অসামাজিক। তাঁর মধ্যে এখনতো আবার ছেলেদের সঙ্গকে আগুনের মত ভয় করে। আচ্ছা বলি, এভাবেই তোমার দিন চলবে?’ ‘কেন ভালইতো চলছে আন্টি।’ ‘ভালই চলছে? তাহলে অমন বাউন্ডেলে হয়েছো কেন? এদেশ থেকে সে দেশে শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? বলেছিলাম, তোমাকে সুইজারল্যান্ড থেকে যেতে দিবনা।’ ‘এমন শাসনের কণ্ঠ ভালই লাগছে আন্টি।’ বলতে বলতে তাতিয়ানার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সেখানে পাতলা বেদনার একটা আস্তরন। কথা শেষ করেই তাতিয়ানা ছুট দিল তাঁর ঘরের দিকে। সেদিনই বিকেল। জিনা ডোনান্ট সেদিনের আনা বাজার ফ্রিজের শেল্পে সাজিয়ে রাখছিল। পাশেই দাঁড়ানো তাতিয়ানাকে বলল, ‘যাও তো এক গ্লাস গরম পানি মেহমানের টেবিলে রেখে চায়ের ট্রলিটা নিয়ে এস। না আপত্তি আছে যেতে?’ ‘না আপা যাচ্ছি।’ বলে তাতিয়ানা এক গ্লাস গরম পানি একটা পিরিচের উপর রেখে আরেকটা পিরিচে ঢেকে দু’হাত দিয়ে ধরে নিয়ে চলল অসুস্থ আবদুল্লাহ নামের আহমদ মুসার ঘরের দিকে। ঘরের দরজা খোলা ছিল। দরজায় টাঙানো হয়েছিল পর্দা। পর্দার ফাঁক গলিয়ে ঘরে প্রবেশ করল তাতিয়ানা। দরজা সোজাই ভেতরে ঘরের ওপ্রান্তে পাতা ছিল আহমদ মুসার খাট। মাথা ছিল দরজার বিপরীত দিকে। চিৎ হয়ে শুয়েছিল সে। চোখ দু’টি বোজা। ভেতরে ঢুকতেই তাতিয়ানার চোখ গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মুখের উপর। চোখ পড়তেই প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল তাতিয়ানা। পরক্ষনেই দেহ-মন অবশকারী এক প্রবাহ খেলে গেল তাঁর গোটা শরীরে। তাঁর হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেল। দু’টি পিরিচ গ্লাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে বিরাট শব্দ করল। শব্দে আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। দেখতে পেল তাতিয়ানাকে। বিস্ময়ের ধাক্কা তাঁর চিন্তাকেও মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলল। ওদিকে শব্দ শুনেই রান্না ঘর থেকে ছুটে এলো জিনা ডোনান্ট। এসে দেখল টলে পড়ে যাচ্ছে তাতিয়ানা। মেহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাতিয়ানার দিকে। তাঁর চখে-মুখে বিস্ময়। জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে ধরে ফেলল। ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে বসাল সে। তাতিয়ানা সংজ্ঞা হারিয়েছে। আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছিল। ‘মিঃ আবদুল্লাহ আপনি উঠবেন না। পাশের ঘরে নিয়ে যাচ্ছি একে আমি।’ জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল পাশের ঘরে এবং তাঁর সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় লেগে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে এলো দু’জন আয়া। ততক্ষনে চোখ মেলেছিল তাতিয়ানা। ‘তোমরা একে এর ঘরে শুইয়ে দাও আমি আসছি।’ তাতিয়ানাকে নিয়ে উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে চলল দু’জন আয়া। তাতিয়ানা একবার চোখ মেলেই চোখ বুজেছে। জিনা ডোনান্ট আহমদ মুসার ঘরে প্রবেশ করল। গ্লাস ও পিরিচের ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে আবর্জনার বাক্সে ফেলে ফিরে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আপনি তাতিয়ানাকে চিনেন?’ ‘অবশ্যই চিনি। তাতিয়ানা এখানে কেন?’ ‘আপনার প্রশ্নের জবাব দেব। কিন্তু আমার উত্তর পাওয়া শেষ হয়নি। কিভাবে তাকে চিনেন?’ ‘তাতিয়ানা তাঁর আব্বার সাথে ছিল মধ্য এশিয়ায়।’ বলে আহমদ মুসা সংক্ষেপে তাতিয়ানার কিছু ভুমিকার কথা জানিয়ে বলল, ‘তাতিয়ানাকে চিনব না মানে, সে অবিস্মরণীয়। কিন্তু সে কি অসুস্থ?’ জিনা ডোনান্ট কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার কাছে তাতিয়ানার কাহিনি শুনে। আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘সে রকম কিছু নয়। তবু আমি দেখি। ওঁর জ্ঞান ফিরেছে।’ বলে জিনা ডোনান্ট তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল আহমদ মুসার ঘর থেকে। তাতিয়ানা শুয়েছিল চোখ বুজে। জিনা ডোনান্ট ধীরে ধীরে তাঁর পাশে এসে বসে তাঁর কপালে হাত রাখল। ম্লান হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানার ঠোঁটে। তাতিয়ানা তার একটা হাত তুলে তাঁর কপালে রাখা জিনা ডোনান্টের হাতের উপর রেখে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই তুমি প্রশ্ন করবে, ‘ওঁর দরজায় গিয়ে হঠাৎ কি হল আমার? হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল কেন?’ ‘না তাতিয়ানা, এ প্রশ্ন আমি করব না। আমার বিশ্বাস ভালো কিংবা মন্দ প্রচণ্ড এক মানসিক উত্তেজনায় তুমি সংজ্ঞা হারিয়েছ। এ মানসিক উত্তেজনা কেন?’ ‘হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়েছিল?’ ‘ঘটনার আগ পর্যন্ত তোমার অবস্থার খবর জানি, মাথা ঘুরাবার মত কোন রোগই তোমার নেই। চেনা লোক দেখেই কি?’ তাতিয়ানা চোখ খুলল। হেসে বলল, ‘আপনি ওঁর সাথে কথা বলেছেন দেখছি।’ ‘বলেছি। জেনেছি, তোমরা একে অপরকে চেন। এক সাথে তোমরা কিছু কাজও করেছ।’ ‘আর কি বললেন উনি?’ ‘বলেছেন, তাতিয়ানাকে শুধু চিনি তাই নয়, তাতিয়ানা অবিস্মরণীয়।’ ‘অবিস্মরণীয় অর্থ কি আপা?’ ‘যার কোন বিস্মরন নেই।’ ‘আর স্মরন অর্থ কি?’ ‘মনে রাখা। এসব অর্থ দিয়ে তোমার কি হবে?’ ‘মনে রাখা বা ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রটা কি বলত?’ ‘যে দুরে থাকে তাকে মানুষ স্মরন রাখে বা ভুলে যায়।’ ম্লান হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানার ঠোঁটে। মনে মনে সে বলল, তাতিয়ানা তাঁর কাছের নয়, মাত্র মনে রাখার মত দুরের কেউ। বুকের গভীরে অসহ্য এক যন্ত্রণা জেগে উঠল তাতিয়ানার। কোন কথা বলল না তাতিয়ানা। তাতিয়ানার ম্লান হাসি এবং তাঁর মুখে যন্ত্রণার সুক্ষ প্রকাশ দৃষ্টি এড়াল না জিনা ডোনান্টের। তাতিয়ানার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে জিনা ডোনান্ট বলল, ‘একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব?’ ‘অবশ্যই। শান্ত কণ্ঠে বলল তাতিয়ানা। ‘বহুদিন পর পরিচিত কাউকে দেখলে আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু তুমি সংজ্ঞা হারিয়েছ এবং দেখতে পারছি তুমি মুষড়ে পড়েছ। কেন?’ তাতিয়ানা হাসল। উঠে বসল। জড়িয়ে ধরল জিনা ডোনান্টকে। বলল, ‘এসব কিছুনা আপা। অনেকদিন পর ওকে দেখে হঠাৎ যেন কি হয়ে গিয়েছিল।’ ‘ও এমন কে যে, ‘পিটার দি গ্রেট’দের কন্যা এতটা অভিভুত হয়ে পড়েছিল’! তাতিয়ানা তাঁর ডান হাতের তর্জনীটা জিনা ডোনান্টের ঠোঁটে চেপে ধরে বলল, ‘ও কথা বলনা আপা, ও কত বড় তা কল্পনারও বাইরে।’ ‘উনি অসাধারণ সাহসী, কুশলী এবং অত্যন্ত সু-আচরনের সুন্দর মানুষ। কিন্তু তুমি কি বলছ?’ তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এ প্রসঙ্গ থাক আপা। চল উঠি।’ ‘তাতিয়ানা তুমি আমাকে কি মনে করেছ? আমি কি শিশু, আমাকে যা তা দিয়ে বুঝ দিবে? আমাকে বলতে না চাইলে বলো না। আমি শুনার উপযুক্ত না হলে শুনব না। আমাকে বোকা সাজাবার প্রয়োজন নেই।’ বলে জিনা ডোনান্ট অভিমানে মুখ ভার করে চলে যাবার জন্যে উঠে দাড়াতে চাইল। তাতিয়ানা তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আপা তোমাকে না বলার কিছু আছে? কিন্তু…? ‘কিন্তু কি?’ ‘ব্যাপারটা খুব সাংঘাতিক ধরনের। বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি।’ ‘কেন বলা ঠিক হবে না?’ ‘ওঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে।’ ‘ওঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন? কে সে?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল জিনা ডোনান্ট। ‘বলছি। কিন্তু একটা অনুরোধ আপা।’ ‘কি?’ ‘ওঁর পরিচয় এমনকি আংকেলকেও বলবেনা।’ বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে জিনা ডোনান্ট তাকাল তাতিয়ানার দিকে। বলল, ‘তুমি এমন অনুরোধ করছ কেন? আমি আর আব্বা কি ভিন্ন? তুমি আব্বাকে চেননা?’ ‘আমি জানি। তবু অনুরোধ, ওঁর আপত্তি না থাকলে পরে বলবে আপা।’ ‘ঠিক আছে তাতিয়ানা তাই হবে।’ তাতিয়ানা আহমদ মুসার পরিচয় দল জিনা ডোনান্টকে। নাম শুনেই জিনা ডোনান্টের মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। জিনা ডোনান্ট কূটনীতিকের কন্যা এবং কূটনীতিকের স্ত্রী। খুব ভালো করেই সে জানে আহমদ মুসাকে। তাতিয়ানা আহমদ মুসার পরিচয় দিয়ে কথা শেষ করলেও অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না জিনা ডোনান্ট। ‘তাতিয়ানা, আমার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না যে, আহমদ মুসা আমাদের বাড়িতে, আমাদের মেহমান?’ একটু থামল জিনা ডোনান্ট। তারপর আবার শুরু করল, ‘তাঁর নিরাপত্তার কথা তুমি ঠিকই বলেছ। নিশ্চয়ই কোন বড় ঘটনা ঘটেছে সুইজারল্যান্ডে। আহমদ মুসা ছোট-খাটো ঘটনায় কোথাও যান না। তাঁর আহত হবার ঘটনা নিশ্চয় কোন বড় ঘটনার অংশ।’ ‘ঠিকই বলেছ আপা। আমিও তাই মনে করি।’ ‘তুমি কি মনে কর এখানে সে নিরাপদ। ক্লিনিক থেকে তাঁর শত্রুরা এ ঠিকানা জেনে নিতে পারে।’ ‘নিরাপদ না হলে উনি আসতেন না, ক্লিনিকে থাকতেন। সবদিক না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত তিনি নেন না। তবু তুনি ক্লিনিকে সাবধান করে দাও, তোমাদের ঠিকানা তাঁরা কাউকে যেন না দেয়।’ ‘ঠিক আছে। কিন্তু তিনি নিচের তলায় থাকবেন, এটা খারাপ লাগছে। যাই হোক তিনি সন্মানের পাত্র।’ ‘কিন্তু আংকেল কি বলবেন?’ ‘আব্বারই প্রস্তাব ছিল তাকে দু’তলায় রাখা। আমি জোর দেয়ায় একতলায় রাখা হয়েছে। এখন দেখা-শুনার অসুবিধা হচ্ছে বলে ওকে দু’তলায় নেয়া যায়।’ ‘হ্যাঁ এটা হতে পারে আপা।’ সেদিনই রাত দশটা। গ্লাসে দুধ ঢালতে ঢালতে জিনা ডোনান্ট পাশে দাঁড়ানো তাতিয়ানাকে বলল, ‘দুধ কি আহমদ মুসাকে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে, না তুমি যাবে?’ ‘না। আমি যাব।’ তাতিয়ানার ঠোঁটে সলজ্জ এক টুকরো হাসি। ‘আবার ফেলে দিবে নাতো?’ হাসল। কথা বলল না তাতিয়ানা। জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না। তোমাকে এমন সংকুচিত, এমন ভেঙ্গে পড়া তো কোন সময় দেখিনি।’ হাসিতে উচ্ছসিত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘দাও দুধ।’ বলে দুধের গ্লাস নিয়ে তাতিয়ানা চলল আহমদ মুসার কক্ষের দিকে। আহমদ মুসাকে বিকেলেই দু’তলায় আনা হয়েছে। দু’তলার দক্ষিন-পুব দিকের একটা সুন্দর রুম তাকে দেয়া হয়েছে। জানালার ভারি পর্দাটা সরালে শুয়ে থেকেই লেকের আদিগন্ত বুকে চোখ বুলানো যায়। জ্যোৎস্না প্লাবিত হ্রদের বুকের উপর চোখ মেলে শুয়ে ছিল আহমদ মুসা। দুধের গ্লাস নিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল তাতিয়ানা। চেষ্টা করেও তাঁর বুকের তোলপাড়টা বাঁধা দিয়ে রাখতে পারল না তাতিয়ানা। আহমদ মুসার কাছে এলেই এমন হচ্ছে। তাঁর অবস্থা ডোনান্ট আপারও নজর এড়ায়নি। অথচ সে চেষ্টা করছে তাঁর মনটাকে শত শক্তি দিয়ে বেধে রাখতে। তাতিয়ানা জানে, আহমদ মুসা পর্বতের মত এক অনড় পাথর। তাঁর বুকের উপর দিয়ে অশ্রুর প্রস্রবন গড়াতে পারে। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করা যাবে না। আহমদ মুসা তাঁর বিছানায় শুয়ে তাকিয়েছিল লেকের শান্ত রুপালী বুকের দিকে। তাতিয়ানা দুধের গ্লাস নিয়ে আহমদ মুসার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ভাবল একবার, ‘দুধ টেবিলে রেখে দেবে কিনা। কিন্তু আবার ভাবল, নিজের দুর্বলতা ঢাকতে সে এই অসৌজন্য দেখাতে পারেনা। ‘দুধ এনেছি।’ অনেক প্রস্তুতি নিয়ে বলল তাতিয়ানা। একটু এগিয়ে এসে তাতিয়ানার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিতে নিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘থ্যাংকস তাতিয়ানা।’ বলে আহমদ মুসা গ্লাস টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল। তাতিয়ানা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘না টেবিলে রাখা নয়। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এখনি খেয়ে নিন।’ ‘ঠিক আছে। খেতে যখন হবে, খেয়ে নেয়াই ভালো।’ আহমদ মুসা দুধ খেয়ে গ্লাস টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল। তাতিয়ানা গ্লাস নিয়ে নিল আহমদ মুসার হাত থেকে। বলল, ‘ঠিক এগারোটায় ঔষধ খাবার সময় আসব।’ বলে চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাড়াতে গেল তাতিয়ানা। ‘যেওনা তাতিয়ানা। গ্লাস টেবিলে রেখে চেয়ারটায় একটু বস।’ থমকে গিয়ে তাতিয়ানা বলল, ‘আচ্ছা।’ গ্লাস টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে না বসে আহমদ মুসার বিছানার এক প্রান্তে জরো-সরো হয়ে মুখ নিচু করে বসল। ‘কেমন আছো তাতিয়ানা? তুমি কি অসুস্থ?’ বলল আহমদ মুসা। চকিতে একবার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কেন একথা বলছেন?’ ‘তখন হঠাৎ তুমি সংজ্ঞা হারালে। তাছাড়া তোমার কেমন যেন মনমরা ভাব দেখছি। তুমি তো এমন নও।’ হৃদয়ের সেই যন্ত্রণা অনুভব করল তাতিয়ানা। একটা করুন হাসি ফুটে উঠতে চাইল ঠোঁটে। একটা কথা ভেতর থেকে বুক ফুড়ে বের হতে চাইল, ‘মন তো অনেক আগে মারা গেছে। সেই সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময়। ভেতরটাকে কঠোর শাসন করে বলল, ‘আমি দুঃখিত। আপনাকে কোনদিন দেখব ভাবিনি, তাই হঠাৎ কি যেন হয়ে গিয়েছিল। আমাকে মাফ করবেন। আপনি এখন আমার সামনে, তবুও আমার যেন স্বপ্নই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক ঘুমের মত ঘুম ভাঙলেই যেন দেখব সব মিথ্যা।’ কাঁপল যেন তাতিয়ানার কণ্ঠ। একটু থামল। দম নিল একটা। তারপর বলল, ‘আপনি কেমন ছিলেন? এখানে কি ঘটেছে, আপনার এমন হল কেন?’ ‘বলব। কিন্তু তাঁর আগে বল, ‘তুমি কোথায় কি করছ?’ ম্লান হাসল তাতিয়ানা। বলল, ‘আমার একাউন্টে আব্বার কিছু টাকা আছে। আব্বার একাউন্টের টাকাও আমি নমিনি হিসাবে পেয়েছি। তাই নিয়ে শুধু ঘুরছি।’ বেদনার একটা খোঁচা লাগল আহমদ মুসার মনে। আহমদ মুসার জন্যেই সে তাঁর আব্বাকে হারিয়েছে, বলতে গেলে স্বজন স্বদেশকে যে পরিত্যাগ করেছে। সর্বহারা হৃদয়কে নিয়ে তাঁর ঘোরা ছাড়া আর উপায় কি! কোন কথা যোগাল না আহমদ মুসার মুখে। তাতিয়ানার শূন্য দৃষ্টি কি চায়, কিসের সন্ধান করছে আহমদ মুসা জানে। এখানেই নিজেকে অসহায় বোধ করে আহমদ মুসা। তাতিয়ানাই কথা বলল আবার। বলল, ‘এবার আপনার কথা বলুন। আপনি কেমন ছিলেন?’ ‘এই সময়ে আমি ফ্রান্স, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র কঙ্গো ঘুরেছি। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছি এখানে।’ ‘সব জায়গায় বোধ হয় একই কাজ করেছেন’? ‘কি কাজ?’ ‘লড়াই।’ ‘আমার পেশাই তো ওটা।’ ‘হলো না। পেশা নয় মিশন।’ ‘পেশা নয় বলছ কেন?’ হেসে বলল আহমদ মুসা। ‘পেশার সাথে বিনিময়ের সম্পর্ক আছে, মিশন মানুষের স্বার্থে নিবেদিত। আপনি যা করছেন, তা কোন কিছুর বিনিময়ে নয়।’ ‘ঠিক হলোনা। আমিও বিনিময়ে কাজ করছি।’ ‘কেমন?’ ‘আমি ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ মানে আল্লাহ্‌র জন্যে কাজ করছি। কিন্তু এর বিনিময় আছে। আল্লাহ্‌ বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ ‘যেমন?’ ‘বেহেশত লাভ।’ ‘ও এই বিনিময়ের কথা বলছেন’ হাঁসতে লাগল তাতিয়ানা। ‘একে কেমন মনে করছ তুমি?’ ‘এটা বিনিময় হলো? বিনিময় তো হাতে হাতে পেতে হয়। ওটা তো পরকালের কথা।’ ‘পরকালের পাওয়াই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। সে পাওয়াটা অক্ষয়। ঐ পাওয়ার প্রতিই আমার লোভ। সুতরাং বলতে পার, বিনিময় ছাড়া আমি কাজ করছি না।’ ‘যাক এই প্রসংগ। সুইজারল্যান্ডে আপনার কথা বলুন।’ ‘মাফ করবেন। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’ তাতিয়ানার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দরজার পর্দা একটু ফাঁক করে বলল জিনা ডোনান্ট। ‘অবশ্যই, আসুন।’ ঘরে ঢুকল জিনা ডোনান্ট। বলল, দুঃখিত।‘মঁথে’ থেকে তাতিয়ানার টেলিফোন। কথা বলবেন নাতাশা।’ নাতাশা একজন সুইস কূটনীতিকের রাশিয়ান স্ত্রী। সে কূটনীতিকও দীর্ঘদিন ছিলেন মস্কোতে। বিয়েও করেন রাশিয়ায়। নাতাশার পরিবারও পূর্ব থেকেই তাতিয়ানার পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিল। বিয়েও হয় তাঁদের মধ্যতায়। নাতাশার কথা শুনেই তাতিয়ানা উঠে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘অনুমতি দিন।’ ‘অবশ্যই।’ তাতিয়ানা চলতে শুরু করে বলল, ‘প্রশ্ন কিন্তু সবই থাকল।’ তাতিয়ানা বেরিয়ে গেলে জিনা ডোনান্ট এগিয়ে এসে টেবিল থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার বেশিক্ষন বসে না থাকা ভাল।’ ‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল। জিনা ডোনান্ট চারদিক চেয়ে বলল, সব ঠিক আছে। রাত এগারোটায় ওষুধ খেতে হবে।’ বলে জিনা ডোনান্ট চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। ‘ম্যাডাম, আমার একটা অনুরোধ, ডাক্তারকে বলে কাল যাতে যেতে পারি, সে ব্যবস্থা দয়া করে করুন।’ জিনা ডোনান্ট হাসল। বলল, ‘জানি আপনার কাজ আপনার জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জীবন না থাকলে কাজ থাকে না।’ আহমদ মুসা একটু বিস্মিত হলেন জিনা ডোনান্টের কথার ধরনে। বলল, ‘আর কিছু জেনেছেন?’ ‘প্লেনেই আমি বুজেছিলাম। আপনি সাধারন কেউ নন। পরে প্রশংসা ও পুরস্কার এড়িয়ে যখন আপনি গায়েব হলেন, তখন আবারও মনে হয়ে ছিল আপনি অসাধারণ একজন। কিন্তু আপনি অসাধারনের মধ্যেও যে অনন্য একজন, তা তাতিয়ানার কাছে শোনার পড়েই বুঝলাম। আপনাকে খোশ আমদেদ। আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটাকে ‘ঐতিহাসিক’ করার সুযোগ দেয়ার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’ ‘আহমদ মুসার এ ফেভার পাবার কারন? তাতিয়ানার সৌজন্যে?’ ‘আহমদ মুসা ফেভার পাবে না কেন?’ ‘সে মুলত মুসলিম জাতির জন্যে কাজ করছে।’ ‘মজলুমের পরিচয় মজলুম। যে কোন জাতিই মজলুম হয়ে দাড়াতে পারে, যেমন এখন মুসলমানরা। জাতির নাম তাঁদের যাই হোক তাঁরা মজলুম। এই মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো।’ আহমদ মুসা ধীরে ধীরে উঠে বসল। বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। পক্ষপাতহীন ও মানবতার পক্ষে এমন রায় পশ্চিমে আমি খুব কম শুনেছি।’ ‘ওয়েলকাম। আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে।’ ‘বলুন।’ ‘আজ নয়। অনেক রাত হয়েছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।’ বলে জিনা ডোনান্ট ‘আসি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দুই দিন পর। আহমদ মুসা বসেছিল তাঁর বিছানায়। তাতিয়ানা বসে ছিল বিছানার এক প্রান্তে। তাঁর চোখ-মুখ ভারি। জিনা ডোনান্ট ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘গাড়ি রেডি। কিন্তু আবার বলছি, কমপক্ষে আরও দু’টো দিন আপনার রেস্ট নেয়া প্রয়োজন।’ ‘আপনাদের আমি সব বলেছি। যে কোন সময় ‘জীবন-হানি’ ঘটতে পারে ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী অথবা ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি’র কথা ভাবুন।’ ‘দেখুন আপনারা যে বিষয়টাকে গোপন রাখছেন তা ঠিক হচ্ছে না। জাতি-বিদ্বেষ বশত দুটি সংবাদ মাধ্যমকে ধ্বংস করার করার যে প্রচেষ্টা চলছে তা বিশ্ববাসীর জানার অধিকার আছে।’ ‘সেটা অবশ্যই জানবে। তবে এখন বললে সেটা প্রমান করা যাবেনা। ওদের হাতে-নাতে ধরিয়ে দিতে হবে। আগে প্রচার করলে সেটা পারা যাবে না।’ ‘মানছি যুক্তি। এমন অসম লড়াই কি চলে? সেদিন কি হতো যদি একটা গাড়ি ঐ সময়ে না আসতো।’ ‘আল্লাহ-এই ভাবেই অসহায়কে সাহায্য করেন।’ ‘দুঃখিত। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি আহমদ মুসা। অসাধারণ বিবেচনায় আপনি পথ চলেন।’ ‘দুঃখিত। এটা আমার অহংকার নয়। এটা আমার সাধারন বিবেচনা।’ ‘ধন্যবাদ।’ হেসে বলল জিনা ডোনান্ট। একটু থেমেই আবার বলল, আপনি তাহলে আসুন। আমি ওদিকটা দেখছি।’ বলে জিনা ডোনান্ট বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। তাতিয়ানাও উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে ওষুধের প্যাকেট এবং ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আহমদ মুসার ব্যাগে ভরে দিয়ে বলল, ‘ব্যবস্থাপত্র দেখে ওষুধ খাবেন। ওষুধের কোর্স শেষ হলে কোন ক্লিনিকে আবার যেতে হবে আপনাকে।’ ‘ধন্যবাদ।’ ‘ওষুধের কথা, ব্যবস্থাপত্রের কথা, ডাক্তারের কাছে যাবার কথা মনে থাকবে কিনা?’ ‘কোনটারই গ্যারান্টি নেই।’ ‘তাহলে আমি জেনেভায় যাব।’ ‘জেনেভায় যাবে? ওষুধ আমার ব্যবস্থাপত্রের তদারকি করার জন্যে?’ ‘ভয় নেই। আমি ওখানে আংকেলের বাসায় থাকব। আপনার সমস্যা সৃষ্টি করবো না।’ ‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা। তুমি চিন্তা করো না। যেভাবেই হোক আমার নিজের প্রতি প্রয়োজনীয় নজর আমি রাখি।’ ‘সুতরাং কেউ যেন নাক গলাতে না যায় এই তো? এটা এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসন। এটা চলতে পারে না।’ গলা কাপছিল তাতিয়ানার। আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল। তাতিয়ানার মনের অবস্থা তাঁর কাছে পরিস্কার। কিন্তু কি বলবে সে তাকে। অতীতের মতই সে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চায়। বলল, ‘ভেবনা তাতিয়ানা, সেখানে আমি নির্বাসনে নেই। সেখানে অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্যে।’ ‘খুশি হলাম। তবে আপনিও জানেন, বন্ধু-বান্ধবরা ওষুধ খাইয়ে দেবার জন্যে দায়িত্বশীল নয়।’ ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর তাতিয়ানার। আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। ম্লান হেসে টেবিলে রাখা তাঁর ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল। তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘গাড়ি পর্যন্ত যদি ব্যাগটা বহন করে নিয়ে যাই, তাহলে এটা বড় রকমের কোন নাক গলানো হবেনা নিশ্চয়?’ বলে তাতিয়ানা ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘চলুন।’ গাড়ি বারান্দায় গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসা এবং তাতিয়ানা। গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল জিনা ডোনান্ট। একটু দুরে খেলা করছিল জিনা জোসেফাইন। আহমদ মুসাকে গাড়ির কাছে দেখে ছুটে এল। আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আংকল আবার কবে আসবেন?’ ‘আচ্ছা মা-মনি ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে?’ তাঁর মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে বলল আহমদ মুসা। ‘না, আপনি আসবেন কিনা বলুন। আপনার সেই গল্প বলা শেষ হয়নি।’ ‘ঠিক আছে। গল্প তো অসমাপ্ত থাকতে পারেনা। আসতেই হবে তাহলে।’ ‘আমি কিন্তু রোজ টেলিফোন করব।’ ‘টেলিফোন নাম্বার কোথায় পাবে?’ ‘কেন, আন্টির কাছে দেখেছি।’ ‘বেশ করো। তবে আমাকে না পেলে গাল দিওনা যেন।’ ‘কেন থাকবেন না ঐ টেলিফোনে?’ ‘আমার তো নানা কাজ নানা জায়গায় থাকি।’ ‘তাহলে ‘সানডে’ তে করব।’ ‘আচ্ছা করো।’ তাতিয়ানা আহমদ মুসার ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিয়ে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বলল, ‘আসুন।’ আহমদ মুসা জিনা জোসেফাইনের কপালে একটা চুমু খেয়ে জিনা ডোনান্টের দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে আসি। আপনাদের আতিথ্য ও আন্তরিকতার কথা কোন দিনই ভুলতে পারব না।’ ‘ধন্যবাদ। আমরা কতটুকু কি করেছি জানি না। কিন্তু আমরা ধন্য বোধ করেছি আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে। আব্বা টেলিফোন করেছিলেন। তিনি ফিরতে না পেরে দুঃখ করেছেন। তিনি জেনেভায় আপনার সাথে কথা বলবেন।’ ‘আমি খুব খুশি হবো। তাকে আমার শ্রদ্ধা দেবেন।’ বলে আহমদ মুসা গুডবাই জানিয়ে গাড়ির দরজার দিকে এগুলো। তাতিয়ানা দু’হাত দিয়ে দরজা খুলে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা জানে মুখ তোলার শক্তি তাঁর নেই। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। তাতিয়ানাকে সে কি বলবে? আহমদ মুসা তাকে এড়িয়ে চলছে, কোন প্রশ্রয় দিচ্ছে না, বিষয়টা তাতিয়ানাকে বেশী আহত করছে। ডোনার কথা তাকে বলা দরকার। কিন্তু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। কিন্তু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। পিতৃ-মাতৃহীনা, আত্মীয়-স্বজন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন- বলা যায় সর্বহারা এই মেয়েটিকে এত বড় আঘাত সে কেমন করে দেবে! তাই ইচ্ছে করেও আহমদ মুসা মুখ খুলতে পারেনি। নতমুখী তাতিয়ানাকে বলার মত কোন কথা আহমদ মুসার মুখেও যোগাল না। শুধু ‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। তাতিয়ানা গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে জানালায় মুখ এনে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ বলে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘মনে রাখবেন আপনি সুস্থ হননি। কাজ শুরুর আগে আপনার দু’তিন দিন বিশ্রাম প্রয়োজন।’ কন্ঠস্বর গম্ভীর তাতিয়ানার। ‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা।’ বলল আহমদ মুসাও গম্ভীর কন্ঠে। তাতিয়ানা সরে দাঁড়াল জানাল থেকে। স্টার্ট নিল আহমদ মুসার গাড়ি। চলতে শুরু করল। গাড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকল তাতিয়ানা। তারপর সে জিনা জোসেফাইনের হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে গেল দু’তলায়। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে জিনা জোসেফাইন বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ আন্টি, সেই হলুদ পাখিটা আবার এসেছে। আমি যাই।’ বলে জিনা জোসেফাইন সিঁড়ি দিয়ে আবার ছুটে নিচে নেমে গেল বাগানের দিকে। তাতিয়ানা অন্য সময় হলে জোসেফাইনের সাথেই ছুটতো বাগানের দিকে। কিন্তু এখন জোসেফাইনের কথা তার কানে গিয়েও যেন গেল না। তাতিয়ানা তার ঘরে গিয়ে তার বিছানায় এলিয়ে পড়ল। বালিশ মুখ গুঁজল সে। তার মনে হলো, অকুল সমূদ্রে বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া অবলম্বনকে কে যেন নিষ্ঠুর ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। হৃদয়ের সমস্ত চাওয়া দিয়ে যাকে সে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল, সে নির্দয়ভাবে দূরে সরে গেল। কান্নার প্রবল এক সাইক্লোন এসে দুমড়ে-মুচড়ে দিল তার বুক। সে সাইক্লোনে উদ্দীপ্ত সাগরের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল তার দু’চোখে। কাঁদছিল তাতিয়ানা। কান্নার ধাক্কায় ফুলে ফুলে উঠছিল তার দেহ। জিনা ডোনান্ট ঘরে ঢুকে এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলো। ক’দিন ধরে যে সন্দেহ সে করছিল, তা সত্য তাহলে! কিন্তু এই ধরনের কান্না কেন? সামান্য বিচ্ছেদে তাতিয়ানার মত মেয়ের জন্যে এ ধরনের কান্না স্বাভাবিক নয়। জিনা ডোনান্ট ধীরে ধীরে এসে তাতিয়ানার মাথায় হাত রাখল। তাতিয়ানা মাথা তুলল। জিনা ডোনান্টকে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে কান্না রোধের চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে বুকে টেনে নিল। বলল, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম, দেখছি তাই সত্য হলো। কিন্তু কাঁদছ কেন? জেনেভা তো আধ ঘন্টার ড্রাইভও নয়। ইচ্ছা করলেই তো গিয়ে দেখে আসতে পারবে!’ কোন উত্তর দিল না তাতিয়ানা। জিনা ডোনান্টের কথায় কান্না তার আরও বাড়ল। জিনা ডোনান্ট বুঝতে পারলো না কি বলে তাকে সান্তনা দেবে। শুধু স্নেহের হাত বুলাতে লাগল তার মাথায়। তাতিয়ানা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। রুমাল দিয়ে চোখ – মুখ মুছে বলল, ‘স্যরি আপা। তোমাকেও কষ্ট দিলাম।’ ‘ওসব সৌজন্য রাখ। তোমাদের কি ঘটেছে বলত? তুমি ইচ্ছা করলে জেনেভায় যেতে পারতে।’ তাতিয়ানা কোন কথা বলল না। শুধু তার চোখ দু’টি থেকে আবার দু’টি অশ্রুর ধারা নেমে এল। জিনা ডোনান্ট তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘ব্যাপার কি বলত? কিছু ঘটেছে?’ ‘কিছুই ঘটেনি।’ বলল তাতিয়ানা চোখ না তুলেই। ‘তাহলে এই কান্না কেন?’ ‘এটা আমার একটা অন্যায় আপা।’ ‘ভ্রু কুঞ্চিত হলো জিনা ডোনান্টের। ক্ষোভ ফুঠে উঠল চোখে-মুখে। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে ডাকল, ‘তাতিয়ানা!’ ‘জ্বি আপা।’ ‘তুমি আমাকে বোকা ঠাওরাতে চাচ্ছ?’ ‘স্যরি। না আপা।’ ‘তাহলে বল কি ঘটনা?’ ‘সত্যিই আপা কোন ঘটনা ঘটেনি।’ ‘কিছু বলেছেন তিনি?’ ‘কাউকে কাঁদাবার মত তিনি কি কিছু বলতে পারেন?’ ‘ঠিক আছে। কিন্তু কিছু ঘটেনি, কিছু উনি বলেনি, তাহলে কি ঘটেছে তোমার?’ তাতিয়ানা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল। ‘বল, তাতিয়ানা।’ ‘কি বলব আপা। আমারই দোষ। আমি সোনা হরিণ ধরতে চাচ্ছি।’ ভ্রু কুঞ্চিত হলো আবার, জিনা ডোনান্টের। হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল তাতিয়ানার ভবঘুরে জীবনের দৃশ্য। মনে পড়ল জীবন সম্পর্কে তাতিয়ানার হতাশার কথা। সংগে সংগে চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল জিনা ডোনান্টের। বলল, ‘তার মানে উনি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন?’ তাতিয়ানা একটু সময় নিল জবাব দিতে। ধীরে ধীরে বলল, ‘প্রত্যাখ্যান করলে অন্তত বুঝতাম উনি আমাকে বুঝেছেন।’ ভাঙা গলা তাতিয়ানার। ‘তোমাকে উনি বোঝেননি। মানে উনি কি জানেন না তুমি তাঁকে ভালবাস?’ ‘তাও তামি জানি না।’ ‘বল কি? তার তরফ থেকে কিছুই জানতে পারনি?’ ‘না আপা। বরফের মত ঠান্ডা উনি। ওর হৃদয় যেন পাথর। কোন আকাঙ্খা, কোন আকুতিই যেন সেখানে কোন স্পন্দন তোলে না।’ তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না জিনা ডোনান্ট। উদ্বেগ ও বেদনার একটা ছায়া নেমেছে তার চোখে-মুখে। সে নীরবে বুকে জড়িয়ে ধরল তাতিয়ানাকে। বলল, ‘তুই দেখছি সর্বনাশ করে বসে আছিস। এমন একা একা কান্না তোর কে দেখবে! কেন তাঁকে বলিসনি পরিষ্কার করে সব কথা?’ ‘ও যদি প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে কষ্ট পায় সেই ভয়ে।’ ‘উল্টোটাও তো হতে পারে! ও অনেক বড়। সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতার মানুষ। তুই ভূল করেছিস তাকে বুঝতে।’ ‘আমি জানি না, জানি না।’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল তাতিয়ানা। জিনা ডোনান্ট তার একটা হাত তাতিয়ানার মাথায় বুলিয়ে তাতিয়ানার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমি কি ওঁকে বলব?’ তাতিয়ানা সংগে সংগেই মাথা নেড়ে জানাল, ‘না।’ ‘তাহলে তুমি জেনেভায় ওর কাছে যাও।’ তাতিয়ানা আবার ঐ ভাবেই মাথা নেড়ে বলল, ‘না! ও এক সাংঘাতিক কাজে এখন মনোযোগ দিয়েছেন। এখন নয়।’ ‘তাহলে তুমি এর মধ্যে গিয়ে ‘মঁথে’ নাতাশার ওখান থেকে ঘুরে এস। আলপস-এর বরফের রাজ্যে গেলে ভিন্ন এক স্বাদ পাবে।’ ঘরে ঢুকল এ সময় জিনা জোসেফাইন। তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। জিনা ডোনান্টাও।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২০৯৬৫ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now