বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

কান্তার মরু – ০৫

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X সম্ভাব্য পরিকল্পনা আঁটতে তিনটে দিন লেগে গেল রানার। জেনকে সঙ্গে নিয়ে ছকটা এঁকেছে ও। ইতোমধ্যে মাথার জখমটা সেরে এসেছে প্রায়। আরেকবার একই জায়গায় বাড়ি না খেলে ওটা আর ভোগাবে না। গ্রেপ্তারকারীরা দিনে তিনবার করে আসছে, নিশ্চিত হয়েছে ওরা। একবার উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার বাকেট পাল্টে দিচ্ছে এবং আরেকবার জগভর্তি পানি আনছে। ছটার আগ দিয়ে ডিনার সার্ভ করে, তারপর বাকি সময়টুকু আর বিরক্ত করে না ওদের। ওয়ায়্যার ডোরের কব্জাগুলো সম্পর্কে রানা বিশেষ ভাবে আগ্রহী। তিন বল্টু দিয়ে দৃঢ়ভাবে ধাতুদণ্ডে আঁটা ও দুটো, এবং আরও তিনটি বল্টু ধাতব দরজাটায় আটকে রেখেছে ওগুলোকে। বল্টুগুলোকে ঢিল করতে লিভারেজ ব্যবহার করা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে রানার। ‘তোমার সঙঊু-ড্রাইভারটা লাগবে, জেন,’ বলল রানা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল জেন। দুটো ঢেউয়ের মাঝে পড়ে টালমাটাল এমুহূর্তে শেপ মাইয়ার। ‘কি করবে ওটা দিয়ে?’ ‘বিসিআইতে একটা মেসেজ পাঠাতে চাই, তারপর আবার এখানে এসে আটকা পড়ব তোমার সাথে। আমরা কোথায় আছি জানলে, ঢাকা বুঝবে কি করা উচিত, বা ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষকে কতটা জানানো দরকার।’ একপাশে আবার কাত হয়ে গেল জাহাজ। ‘এমন রাতে বেরোয় কেউ!’ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল জেন। ‘এটাই তো সুযোগ। সাপ্লাই নিতে লকারে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। আমরা কোন শব্দ-টব্দ করলেও শুনতে পাবে না।’ ‘স্রোতে যদি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়?’ ‘ভাসালে আমাদের নয়, আমাকে ভাসাবে। এখন বলো দেখি, এই এরিয়ার হ্যাচ কোনদিকে খোলে। আমাকে তো অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ?’ ‘আমরা মেইন ডেকের চার ডেক নিচে আছি,’ জানাল জেন। ‘বো-র কাছে, ডেক যেখানে তৈরি হয়েছে, ওখানে একটা হ্যাচ আছে। বড়সড় এক হ্যাচ আর মই নেমেছে দ্বিতীয় ধাপে। নিচের তিন লেভেলে, স্কাট্‌লের পাশে লম্বালম্বি মই রয়েছে।’ ‘মেইন ডেকের হ্যাচটা কি ব্রিজের দিকে মুখ করে খোলে?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘তারমানে ধরা পড়ার চান্স আরও বাড়ছে।’ ক্যামেরাটা খুলতে লাগল জেন। রীলের মাঝখান থেকে বেরোল পিচ্চি এক সঙঊুড্রাইভার। কাজেই, রানাকে একপাটি জুতো খুলে, কব্জার পিন মুক্ত করতে হীল ব্যবহার করতে হলো। উন্মাদের মত দুলে উঠল জাহাজটা, এতখানি দুলুনি সইতে হচ্ছে ওরা একদম সামনের দিকে রয়েছে বলে। পিনগুলো আলগা হয়ে গেলে, দরজাটাকে যথাস্থানে ধরে রাখল জেন এবং রানা ওগুলোকে তুলে দিল ওপরদিকে। এবার বের করে নিয়ে পিনগুলোকে রেখে দিল ব্ল্যাঙ্কেটের ওপর, এবং দু’জনে মিলে বাইরের দিকে ঠেলা দিতে লাগল তারের জালটাকে। জোর ঘষা খেয়ে ঘর-ঘর শব্দ তুলল কব্জা, তারপর বিচ্ছিনড়ব হয়ে গেল। আলগোছে দরজাটা এক মানুষ বেরনোর মত ফাঁক করল রানা। দু’মুহূর্ত পরে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে জেনের সঙ্গে আলাপটা সেরে নিল ও। নটা বাজেনি এখনও। ঠিক হলো এগারোটার আগেই রেডিও শ্যাকে পৌঁছবে রানা। জেন তথ্য জোগাল, মেরী এন্ডারসন এসময় ওটা বন্ধ করে ক্যাপ্টেনের কেবিনে যায়। রানা মনেপ্রাণে কামনা করছে ওসময় শিথিল থাকবে পাহারা, ডিউটির অর্ধেক সময় পার করে ক্লান্ত হয়ে পড়বে লুকআউটরা। স্কাট্‌ল তিনটে পেছনে বন্ধ করল রানা, খোলা হয়েছে ওগুলো বিশেষ নজর না দিলে বোঝার উপায় নেই। প্রয়োজনের সময়, হুইলে হালকা এক মোচড় দিলেই রানা খুলে ফেলতে পারবে। সেকেন্ড ডেকের চারধারে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা, কিন্তু কোন ফাউল-ওয়েদার গিয়ার খুঁজে পেল না। কাজেই হ্যাচের মধ্যখানের স্কাট্‌ল বেয়ে উঠে পড়ল ও-মেইন ডেকে গিয়ে মিশেছে এটা-এবং বোসান্‌স্‌ লকার তল−াশী করে দেখল। কোন এক নাবিক পুরানো এক মোটা কাপড়ের ডাংগ্যারী আর একটা ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট ফেলে গেছে একটা বিনে। প্যান্ট ও জুতো খসিয়ে আঁটো ডাংগ্যারী আর জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল রানা। শেপ মাইয়ার এ মুহূর্তে হেলেদুলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটছে। জাহাজের বো যখনই দেবে যাচ্ছে ঢেউয়ের নিচে ফো’ক্যাসলে আছড়ে পড়ছে পানি। স্টোরেজ এরিয়ায় আরও অনুসন্ধান চালিয়ে বড় এক টুকরো ক্যানভাস ও একটা অয়েলস্কিন হ্যাট খুঁজে পেল রানা। আরও দু’টুকরো ক্যানভাস আবিষ্কার করল ও। তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বড় ক্যানভাসটা হ্যাচের পাশে ডেকে রাখবে ঠিক করল। ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট খুলে ফেলল ও, শার্ট খুলে, ট্রাউজার ও জুতোর সঙ্গে রেখে, জ্যাকেটটা পরে নিল আবার। বাতি নিভিয়ে দিল রানা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, হ্যাচের প্রতিটি শিক খোলার প্রকাণ্ড লিভারটার ওপর হাত রাখল ও, অপেক্ষা করল জাহাজের বো যতক্ষণ না দেবে গিয়ে ফের উঠতে শুরু করল। তারপর হ্যাচ খুলল, ওটা গলে বেরিয়ে, ভেজা ডেকের ওপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল। ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারের উদ্দেশে দৌড়াচ্ছে ও। পতন ঘটল আবার জাহাজের বো-র। পেছনে উঁচু পানির দেয়াল অনুভব করল রানা। সুপারস্ট্রাকচারের গায়ে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে, কোমর সমান উচ্চতার সেফটি রেইল খপ করে থাবা মেরে ধরতে চাইল। জোরাল আঘাত হানল ওর গায়ে ঢেউটা। ধাম করে ধাতব বাড়ি খেতেই হুশ করে বুক থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল রানার। ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে পানি, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ফেলতে চাইছে কালিগোলা রুদ্ররূপী আটলান্টিকে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল ও রেলিং, বুক ভরে নিল বাতাসে, দস্তুরমত লড়াই চালাচ্ছে ঝিম্‌ঝিম্‌ অনুভূতিটার সঙ্গে। মস্তিষ্কের নির্দেশে সাড়া দিতে চাইছে না পেশি। পানির স্তর গোড়ালির কাছে নেমে এলে, পোর্টসাইডের দিকে ঘুরে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করল রানা। রেইল ধরে রেখে সুপারস্ট্রাকচারের গা ঘেঁষে রইল ও। ব্রিজটা তিন ডেক ওপরে, এবং অফিসার কিংবা লুকআউট কারোরই থাকার কথা নয় এখন ওখানে। হেলমসম্যানের সঙ্গে গাদাগাদি করে পাইলটহাউজে থাকবে ওরা। রানাকে ডেক ধরে ছুটতে যদি দেখে না থাকে, তবে এখন আর দেখবেও না। পোর্টসাইডের এক মইয়ের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে তেড়ে এল পরের ঢেউটা। দু’হাতে এক রাং জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল রানা। পানির ভাসিয়ে নেয়ার শক্তি আগেরবারের চাইতে এবারে কম হলেও, জাহাজের পাশ ঘেঁষে রয়েছে বলে রানার সাগরে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। ও সুপারস্ট্রাকচারের বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই ডেকের ওপর দিয়ে ধেয়ে এল তিন নম্বর স্রোতটা। অল্প একটুখানি পানি কেবল ভেজাতে পারল ওর গোড়ালি। সুপারস্ট্রাকচারের আফটার ওয়ালে হেলান দিয়ে দম ফিরে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল রানা। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি রয়েছে ওরা। ফলে, পানি অতখানি ঠাণ্ডা নয় যে পায়ের পাতা অসাড় করে দেবে। সাগরের বিরুদ্ধে প্র ম বাউটে জিতে গেছে রানা। কিন্তু আরও বিপজ্জনক দ্বিতীয় দফা লড়াই এখনও বাকি রয়ে গেছে-বোসানস লকারে ফিরতি যাত্রা। তার আগে, রেডিওশ্যাকে ঢুকে, মেরী এন্ডারসনকে কাবু করে, মেসেজ পাঠাতে হবে। দুই সুপারস্ট্রাকচারের মাঝখানের মেইন ডেকটা পরীক্ষা করল রানা। বেশিরভাগ জায়গাই ডুবে আছে অন্ধকারে, যদিও পোর্টহোলগুলো থেকে চুইয়ে আফটার সুপারস্ট্রাকচারে এসে পড়েছে ছোপ ছোপ আলো। জাহাজের মাঝখানটার দিকে সরে এল রানা এবং চট করে খুলেই লাগিয়ে দিল হ্যাচটা। টিপে টিপে পা ফেলে এবার এগিয়ে চলল ও এবং রেডিও শ্যাকের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতল। কিছুই শোনা গেল না। রেডিও অপারেটর কোন ব্যান্ড যদি মনিটর করেও থাকে, হয় ব্রিজে বাজছে সেটা আর নয়তো এয়ারফোন ব্যবহার করছে। ভেতরে উঁকি দিল রানা। একাকী মেয়েটি। দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা, ভাবখানা এমন যেন শ্যাকে আসার যথার্থ কারণ আছে ওর। বাঁয়ে কন্ট্রোল প্যানেল সামনে নিয়ে বসে আছে মেরী। কিছু টের পেয়ে মুখ তুলে তাকানোর আগেই ডান হাতের মাঝারি ওজনের এক কোপ পড়ল ওর ঘাড়ের ওপর। মুহূর্তে জ্ঞান হারাল মেয়েটি। তাড়াতাড়ি ওর পড়ন্ত দেহটা ধরে ফেলে, সামনের কী থেকে তুলে নিল। জোরাল গোলমাল হয় হোক, সার্কিট সংযুক্ত নয় ব্রিজে কিংবা ক্যাপ্টেনের কেবিনে। এখানে কিছু ঘটলে এখনই জানবে না ওরা। সাবধানে মেয়েটাকে চেয়ারের সামনে মেঝেতে শুইয়ে দিল রানা। আশা করল জ্ঞান ফিরে পাবার পর কি ঘটেছে স্পষ্ট মনে করতে পারবে না মেয়েটা; মনে করবে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে ঘাড়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সাবধানে দরজা ভেজিয়ে ছিটকিনি মেরে দিল রানা। মেরীর পালস চেক করে নিশ্চিন্ত হলো, চলছে। অতিকায় ট্র্যান্সমিটারটা স্টারবোর্ড বাল্কহেডের গায়ে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওটার দিকে চেয়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল রানার। ও যা ভেবেছিল তার চাইতে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী জিনিসটা। ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে, চাবি তুলে নিয়ে ট্রান্সমিটারের সামনে সরাসরি জুড়ে দিল। কন্ট্রোল বোর্ড কিভাবে কাজ করে অতশত ভাবার সময় নেই। রানা আশা করছে ডায়ালগুলো ওটার তুলনামূলকভাবে নিখুঁত। বিসিআইয়ের ফ্রিকোয়েন্সিতে ডায়াল সেট করল রানা। জাহাজ কোথায় আছে জানে না রানা, তবে বিসিআই হেডকোয়ার্টারের রেঞ্জের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে ও। যে-ই ডিউটিতে থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই কাজ ফেলে ঘুমাচ্ছে না। সাদামাঠা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাল রানা। কামনা করছে, যে-ই কপি করবে রাহাত খানের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেবে ওটা। ‘এম আর নাইন ধরা পড়েছে। মিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমেরিকার টনক নড়ায় এজেন্ট পাঠিয়েছে। এম আর নাইন কাজ করছে তার সঙ্গে। চলেছে নির্ধারিত গন্তব্যে। -এম আর নাইন।’ দু’বার পাঠাল ওটা রানা। তারপর কন্ট্রোলবোর্ডে চাবি রেখে, ট্র্যান্সমিটারে আগের ফ্রিকোয়েন্সি রিসেট করল। সন্তর্পণে এবার চলে এল দরজার কাছে। প্যাসেজওয়ে থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল এসময়: ‘রেডিও শ্যাক বন্ধ কেন?’ ‘বুড়োর কেবিনে আজ আগেভাগেই চলে গেছে হয়তো।’ ‘কেন, একমাস পূরণের আগেই নিজের ডোজ শেষ করে ফেলেছে?’ ‘বুড়োরটা বুড়ো ওকে দিয়ে দেবে কষ্ট হলেও; বাজি ধরতে পারো।’ ‘তুমি বা আমি হলেও দিতাম। বিনিময়ে যা পেতাম সেটাও কম না!’ সশব্দ হাসি। মেইন ডেকের ওপরে যাওয়ার হ্যাচটা বন্ধ হলো দড়াম করে। লোক দুটো ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আফটার সুপারস্ট্রাকচারে ওদের পৌঁছতে কমপক্ষে দু’মিনিট লেগে যাবে। হঠাৎ একটা চিন্তা ঘাই মারল রানার মগজে। কিসের ডোজ? তাহলে কি কোনরকমের ড্রাগ দিয়ে লোকগুলোকে নিজের পক্ষে রেখেছে মালদিনি? ডানাকিলদের বেলায় সেটা সত্যি হতেও পারে, কিন্তু নিও ফ্যাসিস্টদেরও বারোটা বাজাচ্ছে লোকটা? ম্যাকলিন? দেখে তো মনে হয় না। নাকি সে ব্যতিμম? ভিনড়ব খাতে চিন্তাস্রোত ঘুরিয়ে দিল রানা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওকে ধরিয়ে দেবে না তো? কিন্তু যুক্তিটা অসার ঠেকল নিজের কাছেই। শেপ মাইয়ারের মত জাহাজে এত সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকতে পারে না। আলগোছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, হ্যাচের উদ্দেশে তড়িঘড়ি পা চালাল রানা। বিনা বাধায় মেইন ডেকে বেরিয়ে এল। পেছন দিক দিয়ে ঘুরে, পথ করে নিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের পাশে চলে এল রানা। এমনভাবে সময় মেপে দৌড়টা দিল, যাতে বো ডিঙিয়ে পানি আসার আগেই মইয়ের নাগাল পায়। টায়ে টায়ে পরীক্ষাটায় পাশ করল। দ্বিতীয় দফা চেষ্টায় সুপারস্ট্রাকচারের সামনের অংশে পৌঁছতে পারল ও। এবং ঢেউয়ের আঘাতে আবারও ছিটকে গিয়ে পড়ল জাহাজের ধাতব দেহে। হ্যান্ডরেইল আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হলো। সামনে যে এগোবে, শরীরে জোর পাচ্ছে না রানা। কতক্ষণ লড়াই চালাতে পারে একটা মানুষ ফুঁসে ওঠা মহাসাগরের বিরুদ্ধে? আরও দুটো জলোচ্ছ্বাস আসতে দিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের বাড়ি হজম করল রানা। এতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্রী আবহাওয়া সহায়তা করেছে ওকে। কিন্তু এখন, এক ছুটে হ্যাচের কাছে পৌঁছতে না পারলে, ভেসে যেতে হবে জাহাজ থেকে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। কার্গো বুম ঘেঁষে ছোটার চেষ্টা করবে ও। আবছা কালো এক আকৃতির রূপে ওটা ধরা দিচ্ছে চোখে। একবারের চেষ্টায় হ্যাচের কাছে যেতে না পারলেও, বুম আঁকড়ে ধরে সাগরের ঝাপ্টা কাটাতে পারবে আশা করছে রানা। পানির ঢল এল আবারও, আগেরগুলোর মত উঁচু কিংবা জোরদার নয় যদিও। বো উঠে যেতে এবং পানি কমে যেতে শুরু করতেই ছপ ছপ করে সামনে এগোল রানা, কাত হয়ে পড়া পিচ্ছিল ডেকে পতন সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটু থেকে নেমে গোড়ালির সমান এখন পানি; ধুপধাপ পা ফেলে যত দ্রুত সম্ভব ছুটছে রানা। কার্গো বুম অতিμম করল। সাঁত করে আচমকা নাক দাবাল জাহাজ-এতই ত্বরিত গতিতে যে দিগ্বিদিক্‌জ্ঞানশূন্য রানা যথাসময়ে থমকে দাঁড়িয়ে বুম ধরতে ব্যর্থ হলো। বো ঘিরে গল গল, ছপাৎ ছপাৎ নানারকম শব্দ করে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে পানি। মুখ তুলে চাইতে, মাথার ওপরে সাদা ফেনার মুকুট লক্ষ করল রানা। নিচু যে স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে এগোচ্ছিল ঢাকা পড়ে গেছে সেটা। সামনে ঝাঁপ দিল মাসুদ রানা অন্ধের মত, হ্যাচ কিংবা মেটাল লেজ, কোন একটার নিচে আড়াল নিতে হবে। কামনা করছে সময়ের হেরফের করে প্রিয় মাথাটা ছাতু হতে দেবে না। টনকে টন পানি আছড়ে পড়ছে নিচে টের পাচ্ছে। শরীর এ মুহূর্তে প্রায় আনুভূমিক ওর, খোলার ও বন্ধ করার লিভারটা বাগে পেতে হাতড়াচ্ছে দুহাত। দেহের নিুাংশে আঘাত হানল পানি, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে; ডেকের দিকে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নিতে চাইছে সুপারস্ট্রাকচারের কাছে-ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে জাহাজ থেকে। শেষ মুহূর্তে লিভারের নাগাল পেল রানার আঙুল। বাঁ হাতটা পিছলে গেলেও ডান হাত ওটাকে ছাড়ল না, কব্জি মুচড়ে গিয়ে অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুমূল পর্যন্ত। কাঁধের পেশি ছিঁড়ে যায় কিনা ভয় পেল রানা। আঁটো ড্যাংগারির বাঁধনটা খুলে গেল কোমরের কাছ থেকে। ড্যাংগারিটা টেনে খানিক নামিয়ে দিয়েছে প্রবল স্রোত। ওভারহ্যাঙের নিচে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে পানি, রানার চোখে-মুখে লবণ ছিটিয়ে শ্বাস কেড়ে নিতে চাইছে। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত মাথার জখমটা এসময় দাপাতে আরম্ভ করল। শেপ মাইয়ার এক্ষুণি ঢেউয়ের নিচ থেকে নাক না তুলতে পারলে, ফো’ক্যাসলে ভাসমান ওই আলগা যন্ত্রপাতিগুলোর মত একই দশা হবে রানার। অবিশ্বাস্য ধীর গতিতে, মনে হলো ওর, জাহাজটার বো শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল। গাল চাটা ছেড়ে শরীরের কাছ থেকে হড়হড় করে সরে গেল পানি। গোড়ালির কাছে তালগোল পাকিয়ে গেছে ভেজা ড্যাংগারি, কাজেই হ্যাচ লিভারে হাতের চাপ দিয়ে ওপরে টেনে তুলল নিজেকে রানা। মরিয়ার মত লাথি মেরে চুপচুপে জিনিসটা দেহ থেকে খসাল ও। ছপাৎ করে ডেকের ওপর পড়ে ভেসে চলে গেল ওটা বানের পানিতে। জাহাজটা এ মুহূর্তে তরতর করে উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে, ঢেউয়ের চূড়ায় ক্ষণিকের জন্যে চড়ে আরেকটা বিশাল ঢেউ ভেদ করার জন্যে ঝাঁপ দিল। লিভার তোলার চেষ্টা করল রানা অনর্থক। ভুলটা বুঝতে পারল ও। শেষ ঢেউটা সামলানোর সময় রানার দেহের চাপ খেয়ে শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে ফাঁকগুলো। ওয়াটারটাইট বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে এত অটুট দৃঢ়তার দরকার পড়ে না। লিভার কেন নড়ে না এর ওপর বিশেষজ্ঞ হলেই বা লাভ কি? পরবর্তী ঢেউটা তো রানার জ্ঞান-গরিমার জন্যে ছাড় দেবে না। আরেকটা প্রবল আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে ওর? শেপ মাইয়ারের বো-র দ্রুত অবনতি ঘটছে। দেহ সাপের মত গুটিয়ে বাঁ কাঁধ দিয়ে আঘাত করল রানা লিভারে। খুলে ওপরদিকে উঠে গেল ওটা। টান মেরে হ্যাচ খুলল রানা। কিনারা আঁকড়ে ধরে, কাত হয়ে শরীর গলিয়ে দিল, বাঁ হাত বোসান্‌স্‌ লকারের ভেতরকার লিভার খুঁজছে। সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে, ধাতব লিভারটা হাতে পেয়ে গেল। দুম করে পেছনে লেগে গেল হ্যাচ। রানা গর্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে মাথার ওপরে ডেকে, আছড়ে পড়ল পানি। হ্যাচের মাঝখানের খুব কাছে রয়েছে ওর হাত। পেছনে সরে এসে, কসরৎ করে শরীর মোচড়াল রানা, লিভারের ওপর সজোরে পড়ল ডান হাত। কিনারা গলে চুইয়ে ঢুকল পানি, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল ফাঁক। ইস্পাতের হ্যাচে বাড়ি খেল ওর মাথা। আগুন ধরে গেল যেন খুলির ভেতর, গুঙিয়ে উঠল রানা। মাথার ভেতর ঝলসে উঠল একাধিক উজ্জ্বল বাতি। হাঁটু ভেঙে স্টীল ডেকে পেতে রাখা ক্যানভাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ও। দুলে উঠল গোটা দুনিয়া-জাহাজের গতির সঙ্গে তাল রেখে নাকি নতুন আঘাতটার কারণে, জানে না রানা। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মাথা। সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলেছে শেপ মাইয়ার।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫৫৯ জন


এ জাতীয় গল্প

→ কান্তার মরু – ০৪
→ কান্তার মরু – ০৩
→ কান্তার মরু – ০২
→ *মাসুদ রানা সিরিজ* কান্তার মরু – ০১

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now