বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
শ্রাদ্ধ
সিরাজউদ্দিন আহমেদ
দোকানের নাম ‘শিব্রাম চক্কোত্তির বইয়ের দোকান’। দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রথমদিন শিব্রামবাবু ফিক করে হেসে ফেললেন। ভাবলেন, সাইনবোর্ড দেখে ক্রেতা তাঁর দোকানে ঢুকবে প্রফুল্লচিত্তে হাসিমুখে। কিন্তু তাঁর দোকানের নাম পড়ে তিনি ছাড়া আর কেউ কোনোদিন হাসলো না। বরং বিরক্ত হয়ে একজন জিজ্ঞেস করলো, এ কেমন নাম মশাই? আপনি কি শিব্রাম চক্রবর্তী?
– আজ্ঞে।
– আপনি অন্যান্য দোকানের নাম লক্ষ করেন না? দোকানের একটি সুন্দর নাম দিতে হবে। ধরুন নাম দিলেন ‘জ্ঞান ভাণ্ডার’। নিচে লিখবেন – প্রোঃ শিবরাম চক্রবর্তী। প্রোঃ মানে প্রোপ্রাইটর। তা না করে নিজের নাম প্রচারের জন্য নিজেই সাইনবোর্ড দখল করে নিলেন। লোকজন হাসাহাসি করবে।
শিব্রাম উৎসাহিত হয়ে বললেন, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমিও চাই লোকজন হাসাহাসি করুক। বাঙালি হাসতে শিখুক। হাসির বই পড়ুক।
লোকটি ক্রুদ্ধ চোখে শিব্রামের দিকে তাকালেন, আমার সঙ্গে মশকরা হচ্ছে! জানেন আমি কে? পুলিশের লোক। সাবধান! শিব্রাম সঙ্গে সঙ্গে লোকটিকে হাস্য-জ্ঞান দেওয়া থেকে বিরত হলেন। পুলিশের নাম শুনলে শিব্রাম ভয় পান। এমন লম্বা-চওড়া জলজ্যান্ত জোয়ান একজন পুলিশ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শিব্রাম সাবধান হলেন। কিন্তু দোকানের সাইনবোর্ড পাল্টালেন না। ভাবলেন, গাছ লাগালে ফল পেতে কিছুটা ধৈর্য ধারণ করতে হয়, হাসিখুশি ক্রেতা পেতে তাঁরও কিছুটা সময় লাগবে।
সেই কোনকালের কথা, শিব্রাম তখন যুবক ছিলেন। সময় মন্দ কাটেনি। হাসিখুশি ক্রেতা পেয়েছেন। হাসির গল্প লিখে লোক যেমন হাসিয়েছেন, তেমনি হাসাহাসির পাত্রও হয়েছেন। নামডাক ছড়িয়েছে যত, নামিদামি পত্র-পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে তত। রেডিও-টিভি, যেখানে হাসির দরকার, হাসির বন্যায় ভাসবে, দর্শক শ্রোতা সবাই শরণাপন্ন হন শিব্রামবাবুর। পূজাসংখ্যায় শিব্রাম চক্রবর্তীর লেখা ছাড়া সংখ্যা জমে না। হেসে ওঠে পূজার আনন্দ। যেসব পত্রিকায় শিব্রাম নেই মানে সম্পাদক লেখককে ধরতে পারেননি, তাঁদের হাত পিছলে বেরিয়ে গেছেন, তাঁদের মুখে হাসি নেই। রামগড়ুরের ছানার মতো মুখ গোমরা করে পূজার আনন্দ-ঝলকানি দেখেন আর গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
এখন দোকানের ধুলো ঝাড়েন আর মাছি তাড়ান। খদ্দেরের দেখা নেই। কী দিনকাল পড়লো! হাসতে চাইলে জোকস পড়ে। মজা চাইলে অ্যাডাল্ট জোকস পড়ে। এক বইয়ে দশ হাজার জোকস। মূল্য বিশ টাকা মাত্র। মিনিটে চারটা জোকস পড়া যায়। সরাসরি অ্যাকশন। সাহিত্যের প্যাঁচাল শোনার সময় কই? তাছাড়া স্মার্টফোনে টাচ্ করলে শিব্রাম চাও কি শেক্সপিয়র চাও, সঙ্গে সঙ্গে হাজির। কষ্ট করে পড়তেও হবে না। মধুর কণ্ঠে কী সুন্দর পাঠ করে চলেছেন পাঠক। বই পড়া পৃষ্ঠা উল্টানোর ঝামেলা নেই, টাকা খরচের বালাই নেই। ঠান্ডা গরম অ্যাডভেঞ্চার, স্বর্গ মর্ত ধর্ম যা শুনতে চাও কানে হেডফোন গুঁজে নাও। শুয়ে বসে হেঁটে যেমন ইচ্ছে আরামে শোনা যায়। লোকে আর আগের মতো বই কেনে না। গতকাল বিক্রি হয়েছে তেরোটি বই। আজ বিক্রি হয়েছে তিনটি বই। ক্রেতার দেখা নেই। তীর্থের কাকের মতো বসে আছেন। মাঝে মাঝে ধুলো ঝাড়ছেন।
পাশের রেস্টুরেন্টে ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে। শিব্রামবাবু তার গন্ধ পেলেন। আহারে ইলিশ, কতকাল দেখা-সাক্ষাৎ নেই! কবে শেষ দেখা হয়েছে তাও মনে নেই। তিনি দুচোখ বন্ধ করে পরম আনন্দে বারেবারে বড় বড় শ্বাস টেনে ইলিশ ভাজার সুবাস গ্রহণ করে পাতিভুঁড়িতে হাত বুলাতে লাগলেন। ঘ্রাণে অর্ধভোজন আর কী। শিব্রাম বাবুর ক্ষেত্রে হলো উল্টো প্রতিক্রিয়া। অর্ধভোজন না হয়ে তাঁর ক্ষিধে হঠাৎ বেড়ে গেল। পকেট হাতড়ে যা পেলেন তা দিয়ে ইলিশ-ভাজা লাঞ্চ সারা যায় না। ইলিশের হাত থেকে বাঁচতে দোকান বন্ধ করে দ্রুত হাঁটা দিলেন। ইলিশ থেকে দূরে অন্য কোথাও, তাঁর নিত্য মেনুর লাঞ্চ সারতে।
শিব্রামবাবুর তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। বাঁচবেনই বা কদিন! ভালোমন্দ প্রিয় খাবার দেখলে ভালোবাসা আটকে রাখতে পারেন না। নারী নয় সম্পদ নয় খ্যাতি নয়, শুধু দুটি টান ফেরাতে পারেননি। প্রথমত, লেখালেখির প্রেমে আত্মমগ্ন হতে, দ্বিতীয়ত, খাদ্যরসে হাবুডুবু খেতে ভালোবাসেন। কলকাতার যত বিখ্যাত খাবার সবার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। প্রেম যেমন শত বাধা না পেরুলে পূর্ণতা পায় না, তেমনি কতশত কাঁটাতার পেরিয়ে রসনার তৃপ্তি পূর্ণ করেছেন। বন্ধুবান্ধবদের আপত্তি, ডাক্তারের নিষেধ, শরীরে সইবে কী সইবে না সে-বিবেচনা না করে প্রিয় খাদ্যভুবনে ডুবে গেছেন। আবার ডাক্তারের কাছে ছুটেছেন।
নতুন বই প্রকাশিত হলে যেমন খুশি হতেন, তেমনি নিমন্ত্রণ পেলে তাঁর মুখে মধুর হাসি ফুটে উঠতো। তখন থেকে ভাবতে শুরু করতেন মেনু কী হতে পারে। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, জন্মদিন, জামাইষষ্ঠী – ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন মেনু। শিব্রামবাবু মেনু দেখে অনুষ্ঠানের তাৎপর্য বিবেচনা করেন। তাঁর মতে বিয়ের অনুষ্ঠানই সেরা। কী ঝলমলে বর্ণিল আলো, পোশাকের বাহার, শিশু-কিশোরীদের আনন্দ, হইচই-রইরই মাতোয়ারা কাণ্ড। বিয়ের দিনে নারীরা স্বর্গের অপ্সরী হয়ে ওঠে। এসব ছাপিয়ে জেগে ওঠে নানা খাদ্যের নানা সুবাস। শিব্রামবাবুর খাদ্য-ইন্দ্রিয় এতই তীক্ষ্ন যে আধা কিলোমিটার দূর থেকে খাদ্যের সুবাস টের পান। সুবাস বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারেন বিয়েবাড়ির মেন্যু কী।
কোনো নিমন্ত্রণ শিব্রামবাবু মিস করেন না। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি তাঁর নিত্যদিনের পোশাক। নিমন্ত্রণ উপলক্ষে ধুতি-পাঞ্জাবির ওপর কালো রঙের জহরকোট চাপাবেন। শীতকাল হলে জহরকোটের ওপর ভাঁজ করা একটি শাল রাখবেন। অনুষ্ঠান যা-ই হোক, বিয়ে অন্নপ্রাশন কিংবা শ্রাদ্ধ, সব নিমন্ত্রণে একই উপহার। চারটি শিব্রাম রঙিন কাগজের মোড়কে কাঁধের ঝোলাব্যাগে ভরে ট্যাক্সি চড়ে বিয়েবাড়ি হাজির হবেন।
বাঙালির জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বণ। কোনো কোনো মাসে তিরিশ দিনেই বারো পার্বণ চলে আসে। আহারে জীবন, কত যে আনন্দ! শুধু একটা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ তিনি কোনো কালে পেলেন না। কেউ তাঁকে ডাকলো না জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে। ডাকবে কী করে? শিব্রাম বাবু আজ অবধি একজন শ্বশুর জোগাড় করতে পারেননি। জামাইষষ্ঠীর দিনটি এলে শিব্রাম বাবুর মন খারাপ হয়ে যায়। মুখ কালো করে বসে থাকেন। ঘরে ঘরে চলছে কত আনন্দ, রঙ্গ-রসিকতা, জামাই আদর, ভূরিভোজ। জামাই আজ মহারাজ। চিরকাল তিনি প্রজা হয়ে থাকলেন। একদিনের জন্য মহারাজ হতে পারলেন না। জামাইষষ্ঠীর স্বাদ তাঁর জীবনে অধরা রয়ে গেল।
এক জামাইষষ্ঠীর সময় শিব্রাম বাবু নিজেকেই নিজে নিমন্ত্রণ করলেন। সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, এই গরমে পাঞ্জাবির ওপর জহরকোট চাপিয়ে, চন্দনের সুবাস জামায় দেহে ছিটিয়ে নতুন কেনা শৌখিন ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। নিত্যদিনের শিব্রাম বাবুকে আজ অচেনা লাগছে। নতুন ধুতি পাঞ্জাবি ছড়ি কেনার সময় টাক ঢাকার জন্য গায়ক মান্নাদের মতো একটি টুপি কেনার ইচ্ছে হয়েছিল। নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ গঙ্গার ধারে ছড়ি হাতে নানা ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়ালেন। কিছুক্ষণ চার্লি চ্যাপলিন স্টাইল চেষ্টা করলেন। একবার হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। অপ্রস্তুত হয়ে চারিদিকে তাকালেন। না, কেউ দেখেনি। আনন্দে শব্দ করে হেসে উঠলেন। ছড়িটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। ছড়ি ঘুরিয়ে শিব্রাম বাবু পথ চলছেন আর ভাবছেন, ছড়ির উপকারিতা নিয়ে তিনি একটি রঙ্গগল্প লিখবেন। এ-সময় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘূর্ণায়ন ছড়ি থেকে আত্মরক্ষার্থে সভয়ে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। রাগতস্বরে বললেন, বুড়ো মানুষের এ কি ছেলেখেলা! অন্ধ নাকি, চোখে দেখেন না?
শিব্রাম মৃদু হেসে বললেন, নমস্কার দাদু। শুভ জামাইষষ্ঠী।
লোকটি রেগে বলল, আমি দাদু? আর তুমি খোকা? সাদা চুলের টাকু। ভীমরতি ধরেছে, বুড়ো বয়সে জামাই সেজেছে। ছড়ি হাতে খোশমেজাজে শিব্রাম অভিজাত শ্রেণির এসি রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেন। দোতলার রাস্তামুখী টেবিল বেছে নিলেন। খাওয়ার আনন্দের সঙ্গে রাস্তার দৃশ্য উপভোগ করবেন। মেনু হাতে ওয়েটার এসে দাঁড়ালো। তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেনুর কোথাও জামাইষষ্ঠীর খাদ্যতালিকা দেখলেন না।
ওয়েটার জিজ্ঞেস করলো, কী খাবেন স্যার?
শিব্রাম হতাশ হয়ে বললেন, এত বড় রেস্টুরেন্টে এলাম, জামাইষষ্ঠীর খাবার খেতে। মেনুতে নেই!
ওয়েটার বলল, ওসব এখানে পাবেন না।
শিব্রামবাবু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পাওয়া যাবে?
ওয়েটার মৃদু হেসে বলল, শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি ছাড়া এ ডিশ কোথাও তৈরি হয় না।
শিব্রামবাবু হতাশ, ইহজীবনে জামাইষষ্ঠীর স্বাদ গ্রহণ তাঁর ভাগ্যে নেই।
ওয়েটার নরম গলায় বলল, স্যার, অনুমতি দিলে একটা পরামর্শ দিতে পারি।
– বলো।
– মাটন কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি, পায়েস ফার্স্ট কোর্স। আমাদের লাউঞ্জে বসে সেকেন্ড কোর্স
পেপসি-কোক-বিয়ার-ওয়াইন যে-কোনো ড্রিংস উপভোগ করতে পারেন। তাতে জামাইষষ্ঠীর একটা আমেজ পাবেন।
শিব্রামবাবু উঠে দাঁড়ালেন, কাচ্চি খেতে হলে আমজাদিয়া যাবো। কাচ্চির সেরা দোকান।
ভাত, ডিমের তরকারি, ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করতে করতে শিব্রাম বাবুর জামাইষষ্ঠীর সেই ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। যে-গরম পড়েছে দোকানে, ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ট্রামে করে চলে গেলেন গড়ের মাঠে। গাছের ছায়ায় ঘাসে বসে পড়লেন। বাতাস বইছে, শিব্রামবাবুর আঁখি ঢুলুঢুলু। কাঁধের ঝোলা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
অপরাহ্ণ গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই করছে। অফিস ছুটি হয়েছে! মানুষের ভিড় বাড়ছে। কারো ধাক্কা খেয়ে শিব্রামবাবু হকচকিয়ে উঠে বসলেন। তাঁর ঘোর কাটেনি। বুঝতে পারছেন না কোথায় আছেন।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
– আজ্ঞে স্বপ্ন দেখছিলাম।
– কী স্বপ্ন?
– আমার শ্রাদ্ধ খাচ্ছি। নিজের শ্রাদ্ধ খাওয়া কী কম ভাগ্যির কথা! পেটে হাত বুলিয়ে শিব্রাম দুঃখী গলায় বললেন, খাওয়াটা শেষ করতে পারলাম না। আপনি ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন।
লোকটি কথা না বাড়িয়ে দশ টাকার একটি নোট ঘাসে ছুড়ে দিয়ে চলে গেল। শিব্রামবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, দশ টাকার নোটটির সঙ্গে এক টাকার চারটি নোট পড়ে আছে। টাকাগুলি কুড়িয়ে পকেটে ভরে ভাবলেন, মজা তো! তারপর বাড়ি ফেরার ট্রাম ধরতে ছুটলেন।
ট্রাম থেকে নেমে বাসায় ফিরতে পথে পড়ে বটতলার মোড়। বটতলার গোড়াটা প্রশস্ত গাঁথুনির বাঁধানো। লোকজন বসে গল্পগুজব করে, আড্ডা দিতে পারে। এই বটতলা ঘিরে যেমন আছে রাধাকৃষ্ণ টি স্টল, তেমনি বক্সিবাবুর জেনারেল স্টোর, ভূতনাথের মুদিখানা, ড্রাগ হাউজ ফার্মেসি, পোদ্দারের সেলুন এবং আরো কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান গড়ে উঠেছে। শিব্রামবাবু এবং তাঁরই বয়সী প্রতিবেশী দীর্ঘকাল একই সঙ্গে বসবাস করছেন, ঘরে ফেরার পথে বটতলায় রাধাকৃষ্ণ টি স্টলে কিছুটা সময় সুখদুঃখের কথা বলে চা পান করে ঘরে ফিরে যান।
শিব্রামের আগেই নিখিল অনীশ কালীপদ উপস্থিত হয়েছে। শিব্রামকে দেখে নিখিল জিজ্ঞেস করলো, আজ এত দেরি করলে যে, দোকানে খুব ভিড় ছিল বুঝি? আজকের বিক্রি ভালোই হয়েছে কী বলো?
– তা হয়েছে।
কালীপদ বললো, আজ তোমার দান।
– মনে আছে। ঘরে ফিরে আগুন জ্বালাতে ইচ্ছে করে না। দুটো চাপা কলা দুটো টোস্ট বিস্কিট আমার রাতের আহার। তোমরা চায়ের সঙ্গে একটা করে টোস্ট নেবে নাকি?
অনীশ বলল, আজ তোমার বিক্রি যখন ভালো হয়েছে টোস্ট চলতেই পারে। বটতলায় এই যে আমরা আড্ডা দিই, চা খাই, সুখদুঃখ ভাগাভাগি করি এতে এনার্জি পাই, মনোবল বাড়ে। বাড়ি ঢোকার সাহস পাই।
শিব্রাম জিজ্ঞেস করলো, নিজের বাড়ি ঢুকবে তার জন্য সাহস লাগবে কেন?
কালীপদ বলল, সে তুমি বুঝবে না ভায়া। হাত-পা ঝাড়া স্বাধীন মানুষ তুমি। সামনে-পেছনে কোনো টানাটানি নেই। যখন যা ইচ্ছে তা করতে পারো। প্রতিদিন আমাদের মতো গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় না।
শিব্রাম হকচকিয়ে যান, প্রতিদিন গৃহযুদ্ধ! কী নিয়ে?
– আমার মেয়ে কালো, সে-দায় আমার। আমি ফর্সা হলে মেয়ে ফর্সা হতো। বিয়ে নিয়ে এত টেনশন হতো না। মেয়ে আইবুড়ো হতো না। খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাচ্ছি। মাসে এক হাজার করে বছরে জমছে বারো হাজার। গত বছর যে-ছেলের পণ ছিল এক লাখ টাকা, এ-বছর সেই ছেলের পণের দাবি দাঁড়িয়েছে এক লাখ বিশ হাজার টাকা। মেলাতে পারি না। ছেলেটার ফর্সা হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না, সে মায়ের ফর্সা রং পেয়েছে।
নিখিল বলল, কালীপদের সমস্যা আমার হয়নি। আমার দুই মেয়েরই শরীরের চামড়া ফর্সা। মেয়েরাও চালাক-চতুর। নিজেদের বর নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে। কলকাতায় যখন ছিল পূজায় জামাইষষ্ঠীতে কিছু জ্বালা-যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। এখন দুই মেয়ে কলকাতার বাইরে। আমরা বুড়োবুড়ি হাত-পা ঝাড়া, শিব্রামের মতো। মহাআনন্দে নিখিল শব্দ করে হেসে উঠলো।
অনীশ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমার অবস্থা তো জানোই। ছেলে দূরে সরে গেছে। খোঁজখবর রাখতে চায় না। মেয়েটা কোন দূরদেশে পড়ে আছে। ফোনে বছরে চার-পাঁচবার মা-মেয়ের কথা হয়। সবই দুঃখের গল্প। এবার মেয়ে আবদার করেছে, পাঁচ বছর ধরে জামাইকে জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ করি না। ফোনে বা চিঠিতে নিমন্ত্রণ দিলে হবে না। তোমরা আমার এখানে বেড়াতে এসো। কটা দিন বেড়ালে। তারপর জামাইয়ের মান ভাঙিয়ে মেয়ে জামাই নাতি নিয়ে কলকাতায় ফিরে মহাধুমধামে জামাইষষ্ঠী পালন করলে। কতকাল তোমাদের দেখি না। তোমাদের বেড়ানো হলো। তোমাদের জামাইয়ের মানভঞ্জনও হলো।
শিব্রাম বলল, এ তো ভালো কথা।
অনীশ বলল, এ তোমার গল্প লেখা না, এক বলপেনের খরচে হয়ে যাবে। এতকাল গেল কখনো বেড়াতে যেতে বললো না, এখন ভালোবাসা উথলে উঠেছে। হিসাবটা চিন্তা করো – হাওড়া টু ব্যাঙ্গালোর আমরা যাবো, সপরিবারে মেয়ের পরিবারকে নিয়ে আসবো। হয়তো ওদের ফিরতি ট্রেনের টিকিটটাও কিনে দিতে হবে। তারপর জামাইষষ্ঠীর খরচ। হিসাব করে দেখেছি সব মিলে পঁচিশ-তিরিশ হাজারের ধাক্কা। আমরা বাঁচতে এবং ওদের বাঁচাতে শোল মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে এলাম।
– কী ভাবে?
– তোমার বউদি মেয়েকে পত্র দিলো। তোমার বাবা ৩০ বছর ধরিয়া জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ পান না। তোমার মামা-মামিরা আবদার করিয়া লিখিয়াছে, আপনি আমাদের বড় জামাইবাবু। পিতা-মাতার পর আপনি আমাদের গুরুজন। আমাদের বাড়ির প্রথম জামাই। বাবা-মা নাই তো কী হইয়াছে, আপনার তিন শ্যালক ও শ্যালক-স্ত্রী আগামী জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ জানাইতেছি। মহাধুমধামের সহিত আপনার জামাইষষ্ঠীর অনুষ্ঠান পালিত হইবে। আপনি পত্র দ্বারা কনফার্ম করিবেন।
আমরা পত্র দ্বারা তোর মামাকে নিমন্ত্রণ গ্রহণ কনফার্ম করিয়াছি। জামাইকে তোর বাবার মতো ধৈর্যশীল হইতে হইবে। তোরাও তোর মামার বাড়ি চলিয়া আয়। সকলের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ হইবে। তোর বাবার সহিত জামাই বাবাজিরও জামাইষষ্ঠী হইয়া যাইবে।
কালীপদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মাইরি, কী ভাগ্য তোর! এই বুড়ো বয়সেও জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন পাস।
– নেমন্তন্ন না কাঁচকলা। আমার শ্বশুর ছিল হাড়কেপ্পন। শালারা হয়েছে আরো বড় কেপ্পন। চিঠি লিখে মেয়ে-জামাইয়ের প্যাঁচ থেকে পিছলে বেরিয়ে এলাম। পাঁচ হাজার টাকায় তোর বৌদিকে নিয়ে পুরী জগন্নাথ মন্দির দর্শন করে এলাম। বিশ হাজার টাকা লাভ হলো।
শিব্রাম বলল, গণেশ হালদারকে তোদের মনে আছে?
– কোন গণেশ?
– গোবর গণেশ। সরস্বতীর অভিশাপ আর লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ছিল সেই গণেশ। আমার সহপাঠী। বড় বাজারে
ওদের হোলসেলের ব্যবসা ছিল। পূজায় পরতো সোনার বোতাম লাগানো পাঞ্জাবি। সৌখিন গণেশ।
– বাঙ্গাল গণেশ। খুব গালগল্প করতো, পূর্ববঙ্গে ওদের জমিদারি ছিল, সেই গণেশ তো?
– হ্যাঁ। আমরা ওর বাবার শ্রাদ্ধ খেতে গিয়েছিলাম মনে আছে?
কালীপদ বলল, মনে আছে মানে, যে রাজকীয় আয়োজন আর খাবারের সেই স্বাদ ভুলবার নয়। আজো ভুলিনি। স্মরণীয় হয়ে আছে।
শিব্রাম বললেন, আমি তো আর গণেশের মতো পারবো না, স্বল্প আযোজন। মেনু হবে দারুণ, তোদের পছন্দের। তোদের, আরো বন্ধুবান্ধব যাঁরা আছে সকলকে আমার শ্রাদ্ধ খাওয়াতে চাই।
– তিন কুলে তোর কেউ নেই। ছেলেমেয়েরাই আজকাল বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধ করে না। শাস্ত্রমতে ন্যাড়া হয় না, শ্রাদ্ধ খাওয়ার আয়োজন করে না। ঠাকুরের হাতে হাজারখানেক গুঁজে দিয়ে নমঃনমঃ করে আনুষ্ঠানিকতা কোনোমতে শেষ করে কেটে পড়ে। তোর শ্রাদ্ধ করবে কে?
শিব্রাম বলল, আজ দুপুরে ঘুম এলো। স্বপ্নে দেখলাম, আমার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। তোদের সকলের সঙ্গে আমিও আমার শ্রাদ্ধ খাচ্ছি। সকলে ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে আশীর্বাদ করছে। খাবারের প্রশংসা করছে। সেই থেকে আইডিয়াটা এসেছে। মরার আগে শ্রাদ্ধটা করে যাই। নিজের শ্রাদ্ধ খেয়ে যাই। তোরা কী বলিস?
বন্ধুরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কালীপদ বলল, এমন ঘটনা অদ্যাবধি ঘটেনি। আমরাও শুনিনি। শাস্ত্র কী বলে?
শিব্রাম বললেন, শাস্ত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না। ঘুমিয়ে আছে থাক না ঘুমিয়ে। ওকে জাগালে নানা কেলেংকারি। আমি
মরণ-পূর্ব আমার শ্রাদ্ধ করবো। তোমাদের সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খাবো। আমার লেখক-কবি বন্ধুরাও থাকবে। খুব মজা হবে।
শিব্রাম তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতে চলেছেন ভেবে আনন্দিত। বন্ধুদের মধ্যে নীরব বিষণ্নতা নেমে এলো। অনীশ বলল, তোর শ্রাদ্ধ আমাদের খেতে হবে? এমন কথা তুই বলতে পারলি?
বন্ধুদের অনুপ্রাণিত করতে শিব্রাম উৎসাহ নিয়ে বলল, তোদের সঙ্গে আমিও থাকছি, একত্রে খাচ্ছি। ভেবে দেখ দৃশ্যটি কত মধুর! আমি মরে গেলে আমার শ্রাদ্ধ তোদের খাওয়াবে কে? তার চেয়ে এটা ভালো না, শ্রাদ্ধ উপলক্ষে সব বন্ধুকে কাছে পেলাম? নিজের শ্রাদ্ধ নিজে খেয়ে গেলাম! পাতিভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে, যেন ভেসে আসছে শ্রাদ্ধ ভোজের সুবাস, বাতাসে ঘ্রাণ টেনে আবেশে চোখ বন্ধ করে শিব্রাম বলল, আহা, কতকাল শ্রাদ্ধ খাই না।
খুবই দুঃখজনক যে শিব্রামবাবুর ইচ্ছে পূরণ হয়নি। শ্রাদ্ধ আয়োজনের পূর্বে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলো। খবর পেয়ে ছুটে এলেন প্রতিবেশী বন্ধু লেখক কবি সাংবাদিক, শিব্রাম বাবুর আজীবন সঙ্গী-সাথি। যাঁদের সঙ্গে কেটেছে সারাবেলা সারা জীবন।
শিব্রামবাবু হাসপাতালের বেডে ব্রেকফাস্ট করছেন। তাঁকে ঘিরে আছে তাঁর নিত্যদিনের মানুষগুলো। বিষণ্ন নীরব স্তব্ধ। খাওয়ার প্লেট নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, সকলে দেখছি রামগড়ুরের ছানা, হাসতে তাদের মানা, হাসতে যদি না পারিস আমার কাছে আসিস কেন?
শীর্ষেন্দু এগিয়ে গিয়ে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, দাদা, এখন কেমন আছেন?
শিব্রামবাবু মৃদু হেসে ব্রেকফাস্টের প্লেট উঁচিয়ে দেখালো, সেখানে আছে কলা, ডিম, দু-পিস পাউরুটি। বলল, এরকম। চিরকাল যেমন ছিলাম। আমার শ্রাদ্ধ আমি একা খাচ্ছি। তোদের সবার সঙ্গে মিলে হইচই করে জম্পেস খাবারটা হলো না।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now