বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
কার্পেটের কারচুপি
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সেকেন্ড স্টেন ]
কোন বছর তা বলব না। এমনকী সেযুগটারও কোনো নামকরণ করব না। শরৎকালে এক মঙ্গলবারের সকালে বেকার স্ট্রিটে আমাদের দীনহীন ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবির্ভূত হলেন ইউরোপবিখ্যাত দুজন পুরুষ। একজন তপঃকৃশ চেহারা, উন্নত নাক, ইগল পাখির মতো চোখ এবং সব মিলিয়ে ক্ষমতাবান পুরুষের মতো প্রভুত্বময় মূর্তি। দু-দু-বার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন যিনি, ইনি সেই স্বনামধন্য লর্ড বেলিনগারআর একজনের বর্ণ মলিন, মুখের গঠন নিখুঁত, সুষ্ঠু, সুন্দর, পরিপাটি চেহারা। টেনেটুনে তাকে মধ্যবয়সিও বলা যায় না। দেহ এবং মনের স্বভাব-দত্ত সর্ববিধ গুণসম্পন্ন এই পুরুষটিই রাইট অনারেবল ট্রেলাওনি হোপ—যিনি ইউরোপ সংক্রান্ত দপ্তরের সেক্রেটারি এবং দেশের উদীয়মান রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁর স্থান সবার আগে। কাগজপত্র ছড়ানো সেট্টির ওপর পাশাপাশি বসলেন দুজনে। ওঁদের শ্রান্ত শুকনো আর উদবেগে-আঁকা মুখ দেখে অতি সহজেই বোঝা যায় যে, রীতিমতো জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে দুজনকে সশরীরে আসতে হয়েছে আমাদের আস্তানায়। নীল-নীল শির-বার করা পাতলা হাতে ছাতার হাতির দাঁতের বাঁটটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন প্রধানমন্ত্রীমশায়। আর বিষাদ-মাখা তপঃকৃশ কঠোর মুখে ক্রমান্বয়ে তাকাচ্ছিলেন আমার আর হোমসের পানে। নার্ভাস হয়ে নিজের গোঁফ ধরে টানাটানি করছিলেন ইউরোপীয়ান সেক্রেটারি আর চঞ্চল আঙুলে নাড়াচাড়া করছিলেন ঘড়ির চেনের সিলমোহরগুলো।
মি. হোমস, আজ সকালে আটটার সময় চুরিটা আবিষ্কার করার সঙ্গেসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীমশায়কে খবর দিই আমি। তারই প্রস্তাবমতো দুজনে এসেছি আপনার কাছে।
পুলিশকে জানিয়েছেন?
না, মশায়। চট করে জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনভাবে বললেন যেন তার কথাই চূড়ান্ত, তারপর আর কিছু বলার নেই। কথা বলার এই দুটি বিশেষ ভঙ্গিমার জন্যে সুনাম আছে তাঁর। আমরা জানাইনি এবং জানাননাও সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। পুলিশকে জানানো মানেই, দু-দিন বাদে জনসাধারণকে জানানো। ঠিক এই জিনিসটাই আমরা এড়িয়ে যেতে চাই।
কিন্তু কেন, স্যার?
কেননা যে-দলিল সম্পর্কে আমরা এসেছি, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনই বিরাট তার গুরুত্ব যে, একবার যদি প্রকাশ পায়, তাহলে অতি সহজে চরমতম মুহূর্তের মধ্যে গিয়ে পড়বে সারা ইউরোপে এবং আরও জটিল হয়ে উঠবে তার বর্তমান পরিস্থিতি। আমি আবার বলছি, এ-বিপর্যয়ের সম্ভাবনা খুবই বেশি। বেশি কী, এ-ব্যাপারের ওপর শাস্তি অথবা যুদ্ধ নির্ভর করছে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। রীতিমতো গোপনতার সাথে এ-দলিল উদ্ধারের চেষ্টা না-করলে, কোনোদিনই তা উদ্ধার করা যাবে না। কেননা এ-জিনিস যারা নিয়েছে, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্যই হল এর বিষয়বস্তু সর্বসাধারণে প্রকাশ করে দেওয়া।
বুঝলাম। মি. ট্রেলাওনি হোপ, কীরকম পরিস্থিতির মধ্যে ও-দলিলটি অদৃশ্য হয়েছে, তা যদি হুবহু বলেন তো বাস্তবিকই উপকার হয় আমার।
অল্প কয়েকটি কথা দিয়েই তা বলা যায়, মি. হোমস। চিঠিটা—দলিলটা আসলে এক বিদেশি রাজার একটা চিঠি পেয়েছিলাম ছ-দিন আগে। চিঠিটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে কোনোদিনই আমার আয়রন সেফে তা রেখে যাওয়া নিরাপদ মনে করিনি। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময়ে সঙ্গে করে এনেছি হোয়াইট হল টেরেসে আমার বাড়িতে। চিঠিপত্র, দলিল, দস্তাবেজ বয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা ডেসপ্যাঁচ বাক্স আছে আমার শোবার ঘরে। এই ডেসপ্যাঁচবাক্সেই চাবি দিয়ে রেখে দিতাম চিঠিটাকে। গতরাত্রে এই বাক্সতেই ছিল চিঠিটা। এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। ডিনারের পোশাক পরার সময়ে বাক্সটা খুলেছিলাম, চিঠিটাকেও ভেতরে দেখেছিলাম। আজ সকালে দেখি তা উধাও হয়েছে। আমার ড্রেসিং টেবিল আয়নার পাশেই সারারাত ছিল ডেসপ্যাঁচবাক্সটা। আমার ঘুম পাতলা, আমার স্ত্রীর-ও তাই। আমরা দুজনেই শপথ করে বলতে রাজি আছি, সারারাত ঘরের মধ্যে তৃতীয় কোনো প্রাণী ঢোকেনি। তা সত্ত্বেও আবার আমি বলছি, চিঠিটা উধাও হয়েছে বাক্সের ভেতর থেকে।
ডিনার খেয়েছিলেন কখন?
সাড়ে সাতটায়।
শুতে গিয়েছিলেন কখন?
থিয়েটারে গেছিলেন আমার স্ত্রী। তার অপেক্ষায় বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। সাড়ে এগারোটায় আমরা শুতে গেছিলাম।
তাহলে পুরো চার ঘণ্টা অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে ছিল ডেসপ্যাঁচ-বাক্সটা?
সকালে বাড়ির পরিচারিকা, আর সারাদিনে আমার খিদমতগার অথবা আমার স্ত্রীর পরিচারিকা ছাড়া আর কাউকে আমার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না। এরা প্রত্যেকেই খুব বিশ্বাসী এবং বেশ কিছুদিন ধরে রয়েছে আমাদের কাছে। তা ছাড়া, ওদের মধ্যে কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয় যে, দপ্তরের সাধারণ কাগজপত্র ছাড়া আরও বেশি মূল্যবান দলিল থাকতে পারে আমার ডেসপ্যাঁচবাক্সে।
চিঠিটার অস্তিত্ব কে কে জেনেছিল?
বাড়ির মধ্যে কেউ নয়।
আপনার স্ত্রী নিশ্চয় জেনেছেন?
না মশায়। আজ সকালে কাগজটা খোয়া যাওয়ার আগে পর্যন্ত স্ত্রীকে কিছুই বলিনি আমি।
ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
বললেন, জনসাধারণের কাজে তোমার কর্তব্যবোধ যে কতখানি প্রখর, অনেকদিন ধরেই আমি তা জানি, হোপ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পারিবারিক বন্ধন যতই নিবিড় আর মধুর হোক না কেন, সব কিছুর ওপরে স্থান দেওয়া উচিত এ-জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্যসম্পর্কিত যাবতীয় ঘটনা।
বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন জানালেন ইউরোপীয় সেক্রেটারি।
বললেন, আমার ন্যায্য পাওনাটুকুই শুধু আমায় দেবেন, স্যার। মি. হোমস, আজ সকালের আগে এ-ব্যাপার সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি আমার স্ত্রীর কাছে।
উনি অনুমান করতে পেরেছিলেন কি?
না, মি. হোমস। উনি তো পারেনইনি,আর কারো পক্ষেও সম্ভব ছিল না অনুমান করার।
এর আগে আপনার কোনো দলিল খোয়া গেছিল?
না মশায়।
এ-চিঠির অস্তিত্ব সম্বন্ধে আর কে কে খবর রাখেন সারা ইংলন্ডে?
ক্যাবিনেটের প্রত্যেক মেম্বাররা জানেন। গতকালই এ-খবর দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। ক্যাবিনেট-মিটিংয়ে যাঁরা যোগদান করেন, তাদের প্রত্যেককেই গুহ্যতত্ত্ব গোপন রাখার আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার করতে হয়। এ-অঙ্গীকারের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীমশায়ের দেওয়া গুরুগম্ভীর হুঁশিয়ারিতে। হায় রে! তখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি নিজেই খুইয়ে বসব এ-জিনিস! প্রবল নিরাশায় দুমড়ে-মুচড়ে বিকৃত হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। দু-হাতে চুল ধরে টানতে লাগলেন উনি। মুহূর্তের জন্য এক ঝলকে দেখে নিলাম আমরা আসল মানুষটিকে—উদগ্র আবেগ, আতীব্র আর আতীক্ষ্ণ অনুভুতি দিয়ে ঘেরা একটি স্বাভাবিক মানুষকে। পরের মুহূর্তেই ফিরে এল তার আভিজাত্য-আঁকা মুখোশ আর ধীরগম্ভীর স্বর। ক্যাবিনেটের মেম্বাররা ছাড়া এ-সম্বন্ধে জানেন দপ্তরের দুজন, কি খুব সম্ভব তিনজন অফিসার। ইংলন্ডে আর কেউই জানে না, মি. হোমস। এ-বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনি।
কিন্তু সাগরের ওপারে?
আমার বিশ্বাস, এ-চিঠি যিনি লিখেছিলেন, তিনি ছাড়া আর কেউই এটা দেখেননি। আমার দৃঢ় ধারণা, মিনিস্টারদের মানে, অফিসের কাউকেই এ-কাজের ভার তিনি দেননি।
অল্পক্ষণের জন্য কথাগুলো মনে মনে তোলপাড় করে নিল হোমস।
তারপর বললে, এবার, স্যার, আরও বিশদভাবে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। এ-দলিলটি কীসের এবং এর অন্তর্ধানে পরিণামই-বা এত গুরুতর হবে কেন, তা আমার জানা দরকার।
চকিতে দৃষ্টি বিনিময় করলেন দুই রাজনীতিবিদ। তারপর, ঝকড়া ভুরু কুঁচকে কুটি করলেন প্রধানমন্ত্রী।
মি. হোমস, লেফাফাটা লম্বা আর পাতলা। ম্যাড়মেড়ে নীল রং, গুঁড়িমারা একটা সিংহের ছাপ আছে লাল গালার সিলমোহরের ওপর। ঠিকানাটা লেখা হয়েছে গোটা গোটা, বলিষ্ঠ অক্ষরে—
হোমস বাধা দিয়ে বললে, এসব খুঁটিনাটি যতই চিত্তাকর্ষক আর প্রয়োজনীয় হোক না কেন, সব কিছুরই একদম গোড়ায় পৌঁছোতে চায় আমার তদন্তধারা। চিঠিটা কীসের?
সেটা একটা রাষ্ট্রিক গুহ্যতত্ত্ব এবং অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ! এ-প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দিতে পারব না এবং এ-তথ্যের প্রয়োজন আছে বলেও মনে হচ্ছে না আমার। যেসব ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় আপনার এত সুনাম, তার সাহায্যে আমার বর্ণনামতো লেফাফা এবং তার মধ্যেকার কাগজপত্র যদি উদ্ধার করে আনতে পারেন, তাহলেই জানবেন, আপনার স্বদেশের একটা যথার্থ উপকার আপনি করলেন। আমাদের ক্ষমতায় যা কুলোয়, একটি পুরস্কারও অর্জন করবেন আপনি।
মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল শার্লক হোমস।
বললে, এদেশের সবচেয়ে কর্মব্যস্ত পুরুষদের মধ্যে আপনারা দুজনেও আছেন। আর, দীনহীন হলেও বহুজনেই দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি জানাচ্ছি, এ-ব্যাপারে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারব না। এ-সাক্ষাৎকার আর টেনে নিয়ে গেলেও শুধু সময় নষ্টই সার হবে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী। কোটরে বসা দুই চোখে দপ করে জ্বলে উঠল চকিত ভয়ংকর দীপ্তি। এ-চোখের সামনে কতবার কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেছে গোটা ক্যাবিনেটটা। এসব আমি বরদাস্ত করি না বলেই, প্রবল চেষ্টায় সামলে নিলেন তাঁর ক্রোধ। আবার বসে পড়লেন সেটির ওপর। মিনিটখানেক কি তারও বেশি হবে চুপচাপ বসে রইলাম সবাই। তারপর দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন বৃদ্ধ রাজনীতিবিদ, আপনার শর্তই মেনে নেওয়া উচিত, মি. হোমস। নিঃসন্দেহে খাঁটি কথাই বলেছেন আপনি। আমাদের পরিপূর্ণ বিশ্বাসের আওতায় আপনাকে
-আনা পর্যন্ত আপনার পক্ষে তৎপর হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত নয়।
আমি আপনার সাথে একমত, স্যার, বললেন কনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ।
আপনার এবং আপনার সহকর্মী, ড. ওয়াটসনের সততার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করে সবই আমি বলব। আপনাদের স্বদেশপ্রেমের ওপর আস্থা রাখছি আমি। এ-ব্যাপার একবার প্রকাশ পেলে যে চরমতম দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসবে এদেশের শিরে, তার চেয়ে বেশি আর কিছু আমি কল্পনাতেও আনতে পারছি না।
নিশ্চিন্ত মনে আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন আপনি।
চিঠিটা এসেছে একজন বিদেশি রাজার কাছ থেকে। সম্প্রতি এদেশের উপনিবেশ সংক্রান্ত কয়েকটি পরিস্থিতিতে বেশ খানিকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন উনি। চিঠিটা লেখা হয়েছে। তাড়াতাড়ি এবং সম্পূর্ণভাবে তার নিজের দায়িত্বে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এ-ব্যাপার সম্পর্কে তার মিনিস্টাররাও কিছু জানেন না। চিঠিটা কিন্তু লেখা হয়েছে এমন ভঙ্গিমায়, বিশেষ করে এর কয়েকটি কথা এমনই আক্রমণাত্মক যে এ-চিঠি একবার কাগজে ছাপা হয়ে গেলেই অত্যন্ত বিপজ্জনক মনোভাবের সৃষ্টি হবে এদেশে। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই আমার। ফলাফলটা এমনই গেজে উঠবে যে, কোনোরকম দ্বিধা না-করেই বলছি, এ-চিঠি প্রকাশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে আমাদের দেশ।
একটুকরো কাগজে একটা নাম লিখে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিলে হোমস।
এজ্যাক্টলি? ইনিই বটে। এবং এইটাই সেই চিঠি যার পরিণাম হয়তো কোটি কোটি মুদ্রার ব্যয় আর লক্ষ লক্ষ জীবনের হানি। এই চিঠিটাই হারিয়েছি।
চিঠি যিনি পাঠিয়েছিলেন, তাঁকে জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, জানিয়েছি। গোপন হরফে লেখা একটি সংকেত-টেলিগ্রাম চলে গেছে তার কাছে।
উনি হয়তো চান চিঠিটা ছাপা হোক।
না মশায়, না। কাজটা যে মাথা গরম হয়ে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় অত্যন্ত অবিবেচকের মতো করে ফেলেছেন, তা যে এর মধ্যেই উনি বুঝতে পেরেছেন, তা বিশ্বাস করার মতো জোরালো কারণ আমাদের আছে। এ-চিঠি প্রকাশ পেলে আমরা যে-চোট পাব, তার চাইতেও প্রচণ্ড আঘাত গিয়ে পড়বে ওঁর নিজের দেশের ওপর।
তাই যদি হয়, তাহলে বলুন তো এ-চিঠি সর্বসমক্ষে প্রকাশ পাক, এ-রকম আগ্রহ কার থাকতে পারে? এ-জিনিস লোপাট করা বা ছাপানোর অভিসন্ধিই যদি কারো মনে জেগে থাকে, তবে তার মূল কারণটাই-বা কী?
মি. হোমস, তাহলেই তো আমাকে বেজায় উঁচুদরের আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক্তিয়ারে এনে ফেললেন। ইউরোপীয় পরিস্থিতি যদি একটু বিবেচনা করে দেখেন, তাহলেই কিন্তু মোটিভ অনুমান করতে মোটেই বেগ পেতে হবে না আপনাকে। সারা ইউরোপটা এখন একটা সশস্ত্র শিবিরে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে দুই জাতির একটা জোট আছে—সামরিক শক্তির মোটামুটি সমতা রক্ষা করছে এরাই। পাল্লা ধরে বসে রয়েছে গ্রেট ব্রিটেনে। এই দুই রাষ্ট্রের একটির সঙ্গে যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয় গ্রেট ব্রিটেন, তাহলেই জোটের অপর রাষ্ট্রটির পরম প্রাধান্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তারা যুদ্ধে যোগদান করলেই-বা কী, না-করলেই-বা কী। বুঝেছেন তো?
জলের মতো। তাহলে এই রাজ্যের শত্রুরাই চাইছে চিঠিটা সংগ্রহ করে ছাপিয়ে দিতে—যাতে করে তাদের দেশ আর আমাদের দেশের মধ্যে ফাটল ধরে। এই তো?
ইউরোপের যেকোনো বড়ো চ্যান্সেলারিতে অর্থাৎ এমব্যাসি-সংলগ্ন অফিসে পাঠিয়ে দিলেই হল। এই মুহূর্তে চিঠিটা খুব সম্ভব এইরকম কোনো চ্যান্সেলারির দিকে ধেয়ে চলেছে তিরবেগে—মানে যতটা বেগে স্টিমের জাহাজ তাকে নিয়ে যেতে পারে।
মি. ট্রেলাওনি হোপের মাথা ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপর। সজোরে গুঙিয়ে উঠলেন উনি। আলতো করে সান্ত্বনার ছলে তার কাঁধের ওপর হাত রাখলেন প্রধানমন্ত্রী।
মাই ডিয়ার, এ তোমার নিছক দুর্ভাগ্য। এজন্যে কেউই অপরাধী করতে পারে না তোমাকে। এমন কোনো সাবধানতা বাকি ছিল না যা তুমি অবহেলা করেছ। মি. হোমস, সব তথ্যই তো পেলেন। এবার বলুন তো, আমাদের করণীয় কী?
বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়তে লাগল হোমস।
বলল, স্যার, আপনি তাহলে মনে করেন, এ-চিঠির পুনরুত্থান না হলে যুদ্ধ হবেই?
আমার মনে হয়, সে-সম্ভাবনা খুবই বেশি।
তাহলে, স্যার, যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুত হোন।
কথাটা খুবই শক্ত, মি. হোমস।
ঘটনাগুলো ভেবে দেখুন, স্যার। চিঠিটা যে রাত সাড়ে এগারোটার পর নেওয়া হয়নি তা সহজেই অনুমেয় এই কারণে যে, এইমাত্র শুনলাম মি. হোপ আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই সেই সময় থেকে চুরি ধরা পড়ার সময় পর্যন্ত ঘরের মধ্যেই ছিলেন। তাহলে এ-জিনিস উধাও হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায় সাড়ে সাতটা থেকে এগারোটার মধ্যে, খুব সম্ভব সাড়ে সাতটার পরেই কোনো সময়ে। এ-কথা বললাম এই কারণে যে, চিঠিটা যে-ই নিক না কেন, সে নিশ্চয় জানত ডেসপ্যাঁচ বাক্সেই আছে দলিলটা। কাজে কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা হস্তগত করে ফেলাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। আচ্ছা স্যার, এ-রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল যদি ওই সময়ে উধাও হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বলুন তো এখন তা কোথায় থাকতে পারে? চিঠিটা কাছে রেখে দেওয়ার কোনো কারণ নেই কারোরই। এ-জিনিস যারা চায়, তাদের কাছেই চটপট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে দলিলটা। এখন বলুন তো এদের পিছু নেওয়ার বা পিছু নিয়ে তাদের পেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ কি আমাদের আছে? না, নেই। চিঠি চলে গেছে আমাদের নাগালের বাইরে।
সেট্টি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী।
মি. হোমস যা বললেন, তা খুবই যৌক্তিক। বেশ বুঝতেই পারছি, বাস্তবিকই এ-ব্যাপার আমাদের হাতের বাইরে।
নিছক তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই, দলিলটা সরিয়েছে পরিচারিকা অথবা খিদমতগার—
দুজনেরই বয়স হয়েছে এবং বহুভাবে যাচাই হয়ে গেছে তাদের সততা।
আপনার মুখেই শুনলাম, আপনার ঘরটা তিনতলায়। বাইরে থেকে সে-ঘরে ঢোকার কোনো পথ নেই এবং ভেতর থেকেও অলক্ষিতভাবে কারোর পক্ষে উঠে আসা সম্ভব নয়। তাহলে, নিশ্চয়ই বাড়ির কেউ নিয়েছে চিঠিটা। চোর মহাপ্রভু চিঠিটা নিয়ে যাবে কার কাছে? আন্তর্জাতিক গুপ্তচর আর সিক্রেট এজেন্টদের একজনের কাছে। এদের সংখ্যা বেশি নয় এবং তাদের প্রত্যেকের নামের সাথে পরিচয় আছে আমার। এ-পেশার মাথা বলতে আছে তিনজন। আমার তদন্ত শুরু হবে এদেরকে দিয়েই। প্রত্যেকের ঘাঁটিতে গিয়ে আমায় দেখতে হবে তারা হাজির আছে কি না। একজন যদি নিপাত্তা হয়—বিশেষ করে কাল রাত থেকে যদি সে উধাও হয়ে গিয়ে থাকে—তাহলেই দলিলটা যে কোনদিকে গেছে, সে-সম্বন্ধে কিছু হদিশ পাওয়া যাবে।
ইউরোপীয় সেক্রেটারি শুধোলেন, কিন্তু সে নিপাত্তাই-বা হবে কেন? চিঠিটা নিয়ে লন্ডনের কোনো এমব্যাসিতে পৌঁছে দিলেই কাজ শেষ হয় তার। অবশ্য এমনটা হতেও পারে, নাও হতে পারে।
আমার তা মনে হয় না। এ ধরনের এজেন্টরা স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং এমব্যাসির সঙ্গে এদের সম্পর্ক প্রায় ক্ষেত্রেই বিশেষ মোলায়েম হয় না।
ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানালেন প্রধানমন্ত্রী।
আমার তাই বিশ্বাস, আপনি ঠিক বলেছেন, মি. হোমস। এ-রকম একটা মূল্যবান দলিল সে নিজের হাতেই পৌঁছে দেবে হেড কোয়ার্টারে। আপনার কাজের গতি-পদ্ধতি খুব চমৎকার বলেই মনে হচ্ছে আমার। হোপ, ইতিমধ্যে এই একটা দুর্ভাগ্যের জন্যে আমাদের অন্যান্য কর্তব্যকর্মে অবহেলা করা সাজে না। সারাদিনে নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আপনাকে খবর দেব। আর আপনিও আপনার তদন্তের ফলাফল জানাবেন নিশ্চয়।
বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন জানিয়ে গম্ভীরমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দুই রাজনীতিবিদ।
এহেন যশস্বী সাক্ষাৎকারীরা বিদায় হলে পর, নীরবে পাইপটা ধরিয়ে নিলে হোমস। তারপর অতলস্পর্শী চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। সকালের কাগজটা খুলে একটা চাঞ্চল্যকর খুনের সংবাদে ড়ুবে গিয়েছিলাম আমি। খুনটা হয়েছে গতরাতে লন্ডন শহরেই। ঠিক এমনি সময়ে বিস্ময়চকিত দারুণ চিৎকার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল আমার বন্ধুটি। তারপর পাইপটা নামিয়ে রাখল ম্যান্টেলপিসের ওপর।
বললে, ঠিক, এ-রহস্যের মুখে পৌঁছোনোর এর চাইতে আর ভালো পথ নেই। পরিস্থিতি বেপরোয়া হলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এমনকী কখনো যদি জানতে পারি এদের মধ্যে কোন মূর্তিমান এ-জিনিসটাকে চক্ষুদান করেছেন, তাহলেও এমনও হতে পারে যে এখনও চিঠিটা বেহাত হয়নি। একটা কথা কি জানো, এ ধরনের লোকদের কাছে অর্থই হচ্ছে পরমার্থ আর ব্রিটিশ কোষাগার তো আমার পেছনেই রইল। এ-চিঠি যদি বাজারে পৌঁছায়, কিনে নিতে পিছপা হব না আমি—তাতে যদি ইনকাম ট্যাক্সে আর একটি পেনি বৃদ্ধি পায়, পরোয়া করি না। যতদূর মনে হয় আমার, লোকটা হয়তো মওকা বুঝে দাঁও মারবার আশায় এখনও চিঠিটা রেখে দিয়েছে নিজের জিম্মায়। ওদিকে কপাল ঠুকে দেখার আগে দেখে নিতে চায় এদিক থেকে কীরকম দরটা আসে। এ ধরনের বিরাট খেলা খেলতে পারে শুধ তিনজন।ওবারস্টাইন, লা রোথিয়েরা, আর এড়ুয়ারডো লুকাস। এদের প্রত্যেকের সাথে দেখা করব আমি।
আমি সকালের কাগজের পাতায় চোখ রাখলাম।
গোডোলফিন স্ট্রিটের এড়ুয়ারডো লুকাস তো?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে না।
কেন হবে না?
গতরাতে সে খুন হয়েছে তার বাড়িতে।
বিগত বহু অ্যাডভেঞ্চারে আমাকে বহুভাবে তাক লাগিয়েছে আমার বন্ধুটি। কাজেই, যখন উপলব্ধি করলাম এক্ষেত্রে তাকেও আমি বিলকুল তাজ্জব বানিয়ে দিতে পেরেছি, তখন বাস্তবিকই পরম সন্তোষ লাভ করলাম আমি। বিস্ফারিত চোখে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ও, তারপর কাগজটা ছিনিয়ে নিলে আমার হাত থেকে! হোমস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর পর থেকে যে প্যারাগ্রাফটা তন্ময় হয়ে পড়ছিলাম, তা নীচে দিলাম :
ওয়েস্টমিনিস্টারের হত্যা
গতরাত্রে ১৬ নং গোড়োলফিন স্ট্রিটে একটি রহস্যজনক অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে। হাউস অফ পার্লামেন্টের সুবিশাল টাওয়ারগুলির ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে নদী এবং মাঠের মধ্যবর্তী স্থানে অষ্টাদশ শতাব্দীর সারি সারি কতকগুলি সেকেলে নির্জন বাড়ি আছে। ১৬নম্বর বাড়িটি ইহাদেরই অন্যতম। ক্ষুদ্র কিন্তু রুচিসুন্দর এই আয়তনটিতে মি. এড়ুয়ারডো লুকাস কয়েক বছর ধরিয়া বাস করিতেছিলেন। সমাজের বিভিন্ন মহলে তিনি দুই কারণে সমধিক পরিচিত। প্রথমত তাঁহার মনোহর ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয়ত এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শৌখিন গায়ক হিসাবেও তাহার বিলক্ষণ সুনাম আছে। মি. লুকাস দারপরিগ্রহ করেন নাই। ঘরকন্নার কাজ দেখাশুনা করার জন্য বর্ষীয়সী মিসেস প্রিন্সল এবং খিদমতগার মিঠুনকে লইয়াই তাহার সংসার। মিসেস প্রিন্সল সকাল সকাল ঘুমাইতে যায় এবং তাহার শয়নকক্ষ বাড়ির সর্বোচ্চ তলায়। হ্যামারস্মিথে এক বন্ধুর সহিত দেখা করিবার জন্যে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ির বাহিরে গিয়াছিল খিদমতগার। এই সময়ে কী ঘটিয়াছে, তাহা এখনও প্রকাশ পায় নাই। কিন্তু রাত সওয়া বারোটা নাগাদ পুলিশ কনস্টেবল ব্যারেট গোডেলফিন স্ট্রিট দিয়া যাইতে লক্ষ করে যে ১৬ নম্বর বাড়ির দরজাটি দু-হাত করিয়া খোলা। টোকা মারিয়াও সে কোনো উত্তর পায় না। সামনের ঘরে আলোর আভাস পাইয়া সে প্যাসেজ বরাবর আগাইয়া যায় এবং আবার টোকা মারে, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ আসে না। তখন সে দরজা ঠেলিয়া ঢুকিয়া পড়ে। ঘরে সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড হইয়া পড়িয়া ছিল। যাবতীয় আসবাবপত্র টানিয়া একধারে জড়ো করা হইয়াছিল এবং একটি চেয়ারের একটি পায়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া পড়িয়া ছিলেন বাড়ির হতভাগ্য ভাড়াটিয়া। তাহার বক্ষে ছুরিকাঘাত করা হইয়াছিল এবং প্রাণবায়ু নিশ্চয় সঙ্গেসঙ্গেই বাহির হইয়া গিয়াছিল। যে ছুরিকা দিয়া অপরাধ সংঘটিত হয়, তাহা একটি বেঁকানো ভারতীয় ভোজালি। নির্জিত শত্রুর দেশ হইতে সংগৃহীত প্রাচ্য অস্ত্রশস্ত্রাদি টাঙানো ছিল একটি দেওয়ালে। ভোজালিটি এইস্থান হইতে টানিয়া নামানো হয়। হত্যার মোটিভ চুরি বলিয়া মনে হইতেছে না। কেননা ঘরের মূল্যবান সামগ্রীসমূহের একটিও সরানোর প্রচেষ্টা করা হয় নাই। মি. এড়ুয়ারডো লুকাস এত সুপরিচিত এবং সর্বজনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁহার এই নিষ্ঠুর এবং রহস্যাবৃত পরিণতি তাঁহার সুদূরপ্রসারী বন্ধুমহলে সগভীর সহানুভূতি এবং বেদনাময় আগ্রহের সঞ্চার করিবে।
ওয়াটসন, এ-সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয় শুনি? দীর্ঘ বিরতির পর শুধোল হোমস।
একটি আশ্চর্য কাকতালীয়।
কাকতালীয়! এ-নাটকে যে তিনজন সম্ভাব্য অভিনেতার নাম বলেছি, এ-লোকটা তাদেরই একজন। যে সময়ে এ-নাটক অভিনীত হয়েছে বলে আমরা জানি, ঠিক সেই সময়ের মধ্যেই শোচনীয়ভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছে সে। কাকতালীয় না-হওয়ার সম্ভাবনাই দেখছি বিস্তর। কোনো সংখ্যা দিয়েও এসবের প্রকাশ চলে না। না, মাই ডিয়ার ওয়াটসন, এ দুটো ঘটনার মধ্যেই যোগসূত্র আছে—আছেই। এবং সে-যোগসূত্র কী তা আমাদেরই বার করতে হবে।
কিন্তু এখন তো সরকারি পুলিশ সবই জেনে ফেলেছে?
মোটেই নয়। গোডোলফিন স্ট্রিটে যেটুকুই দেখেছে, ওরা শুধুই সেইটুকু জানে। হোয়াইট হল টেরেস সম্বন্ধে ওরা কিছুই জানে না বা জানবে না। আমরাই শুধু দুটি ঘটনাই জানি এবং আমরাই পারি এই দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করতে। তবে একটা জবরদস্ত পয়েন্ট আছে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই শুধু এই পয়েন্টের জোরেই আমার সন্দেহ এসে পড়ত লুকাসের ওপর। ওয়েস্টমিনিস্টারের গোডোলফিন স্ট্রিট থেকে হোয়াইট হল টেরেস মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। আর যে ক-জন সিক্রেট এজেন্টের নাম করলাম, ওরা থাকে ওয়েস্ট এন্ডের এক প্রান্তে। কাজেই ইউরোপীয়ান সেক্রেটারির গেরস্থালির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা বা সেখান থেকে কোনো বার্তা গ্রহণ করা অন্যান্যের চেয়ে লুকাসের পক্ষেই সহজতর। জিনিসটা খুবই সামান্য কিন্তু যেখানে সমস্ত ঘটনাকে চেপেচুপে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মেয়াদে আনা হচ্ছে, সেখানে এর প্রয়োজনীয়তা থাকলেও থাকতে পারে। আরে! আরে! আবার কী এল?
রেকাবিতে এক ভদ্রমহিলার কার্ড নিয়ে ঘরে ঢুকল মিসেস হাডসন। এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভুরু তুলল হোমস। তারপর, কার্ডটা তুলে দিলে আমার হাতে।
বললে, লেডি হিলডা ট্রেলাওনি হোপকে দয়া করে ওপরে আসতে বলল।
এক মুহূর্ত পরেই আমাদের দীন হীন ঘরে প্রবেশ করলেন লন্ডনের সবচেয়ে লাবণ্যময়ী রমণী। সকাল বেলাই এই সামান্য প্রকোষ্ঠ একবার ধন্য হয়েছিল দুই রাজনীতিবিদের আগমনে এবং তা আর একবার সম্মানিত হল লেডি হোপের আবির্ভাবে। ডিউক অফ বেলমিনস্টারের কনিষ্ঠতম কন্যার রূপের খ্যাতি আমি প্রায় শুনতাম। কিন্তু বর্ণনা শুনে বা রঙিন ফটোগ্রাফ দেখে অনেক কল্পনা করেও তার এহেন সুগঠিত চারু করোটির অপরূপ বর্ণসমারোহ আর নিখুঁত মনোহর, নয়ন-সুন্দর কান্তির জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না আমি। কিন্তু তা সত্ত্বেও শরতের সেই সকালে তার সৌন্দর্যই কিন্তু সবার আগে আমাদের মনে গভীর ছাপ এঁকে দেয়নি। গাল দুটি কমনীয় বটে, কিন্তু আবেগের ছোঁয়া লেগে তা ফ্যাকাশে। চোখ দুটি প্রদীপ্ত বটে, কিন্তু সে-দীপ্তি জ্বরের উত্তাপজনিত। অনুভূতি-সচেতন মুখটি দৃঢ়সম্বন্ধ এবং চাপা অধরাষ্ঠে আত্মসংযমের প্রয়াস। মুহূর্তের মধ্যে খোলা দরজার ফ্রেমে আমাদের রূপসি সৌন্দর্য দর্শনপ্রার্থী যখন এসে দাঁড়ালেন চিত্রার্পিতের মতো, তখন সৌন্দর্য নয়—আতঙ্কই সবার আগে থির থির করে কেঁপে উঠল তার দুই চোখে।
আমার স্বামী কি এখানে ছিলেন মি. হোমস?
হ্যাঁ, ম্যাডাম, এখানে ছিলেন তিনি।
মি. হোমস, আপনাকে মিনতি করছি, আমি যে এখানে এসেছি, তা তাঁকে বলবেন না। ভাবলেশহীন নিস্পৃহ মুখে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানাল হোমস। তারপর হাতের সংকেতে লেডিকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলে।
বললে, ইয়োর লেডিশিপ, আমাকে বড়ো সংকটে ফেললেন। আমার অনুরোধ, আগে বসুন, তারপর বলুন কী অভিপ্রায়। কিন্তু আগেই জানিয়ে রাখছি, কোনোরকম শর্তবিহীন প্রতিশ্রুতি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।
দ্রুত পদক্ষেপে আড়াআড়িভাবে ঘর পেরিয়ে জানলার দিকে পিঠ করে বসে পড়লেন লেডি হোপ। রানির মতোই হাবভাব-চেহারা তাঁর—তন্বী, দীর্ঘাঙ্গী, অভিজাত এবং রেখায় রেখায় বরবর্ণিনী।
মি. হোমস, কথা বলতে বলতে সাদা দস্তানাপরা হাতের মুঠি বন্ধ করতে এবং খুলতে লাগলেন ঘন ঘন, অকপটে আপনাকে সব খুলে বলব আমি। বলব এই আশায় যে হয়তো সব শোনার পর আপনিও প্রাণখোলা হবেন আমার কাছে। শুধু একটি বিষয় ছাড়া আমি এবং আমার স্বামী পরস্পরের কাছে কোনো প্রসঙ্গই গোপন করি না। সমস্ত ব্যাপারে আমার ওপর ওঁর পরিপূর্ণ আস্থা আছে—শুধু একটি ছাড়া। এবং তা রাজনীতি। এ-ব্যাপারে যেন গালামোহর করা তাঁর ঠোঁট। কিছুই বলেন না আমাকে। কিন্তু আমি জানি, গতরাত্রে অত্যন্ত শোচনীয় একটা কাণ্ড ঘটে গেছে আমাদের বাড়িতে। আমি জানি, একটা কাগজ অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা রাজনীতি সম্পর্কিত, সুতরাং আমার স্বামী পুরোপুরিভাবে আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারছেন না। অথচ এ-ঘটনার সব কিছু বিস্তারিতভাবে আমাকে জানতেই হবে। এবং জানাটা একান্তই দরকার—একান্তই দরকার, আবার বলছি আমি। এই রাজনীতিবিদরা ছাড়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সত্য ঘটনাটা জানেন। সেইজন্যেই আমার অনুরোধ, আমার মিনতি মি. হোমস, দয়া করে বলুন, ঠিকঠিক বলুন কী হয়েছে এবং এর পরিণাম কী। সমস্ত খুলে বলুন, মি. হোমস। মক্কেলের স্বার্থের কথা চিন্তা করে নির্বাক হয়ে থাকবেন না। কেননা, তাঁর স্বার্থ রক্ষা পাবে যদি আমাকে আপনারা সব কথা বলেন এবং আমার ওপর আস্থা রাখেন। যে-কাগজটা চুরি গেছে সেটা কী?
ম্যাডাম, যা জিজ্ঞাসা করছেন, তা সত্যিই অসম্ভব।
গুঙিয়ে উঠে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন লেডি।
জিনিসটা বুঝতে চেষ্টা করুন, ম্যাডাম। আপনার স্বামী যদি এ-ব্যাপারে আপনাকে অন্ধকারে রাখাই সংগত মনে করে থাকেন, তখন, সদ্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে যেসব তথ্যগুলি আমি জেনেছি এবং যা উনি আপনার কাছে গোপন রেখেছেন, তা কি আপনাকে আমার বলা উচিত? এ-কথা জিজ্ঞেস করাটাও অন্যায়। আপনার উচিত তাঁকেই জিজ্ঞেস করা, আর কাউকে নয়।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে। শেষ উপায় হিসেবে আপনার কাছে আমি এসেছি। মি. হোমস, নিশ্চিত কিছু না বলেও একটি পয়েন্ট সম্পর্কে আপনি যদি আমায় আলোকিত করেন তো বড়ো উপকার হয়।
পয়েন্টটা কী, ম্যাডাম?
এ-ঘটনার ফলে আমার স্বামীর রাজনৈতিক কর্মজীবন কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
ম্যাডাম, এ-ব্যাপারে একটা সুরাহা না হলে ফলাফল খুবই খারাপ হতে পারে।
আ! এমনভাবে চকিতে নিশ্বাস টানলেন লেডি যেন আরও দৃঢ়মূল হল তার সন্দেহের রাশি। আর একটা প্রশ্ন, মি. হোমস! এ-বিপর্যয়ের প্রথম শক পেয়েই আমার স্বামী তার চোখ-মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুলেছিলেন যা থেকে আমি বুঝেছিলাম, এ-দলিল খোয়া যাওয়ার ফলে ভয়ানক রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে জনগণের মধ্যে।
উনি যদি তা বলে থাকেন তাহলে নিশ্চয় তা উড়িয়ে দিতে পারি না।
প্রতিক্রিয়াগুলো কী প্রকৃতির বলুন তো?
উঁহু, ম্যাডাম, আবার আপনি এমন কথা জিজ্ঞেস করছেন যার উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাহলে আপনার সময় নষ্ট করব না। আরও একটু খোলাখুলিভাবে কথা বলতে চাইলেন , সেজন্যে আপনাকে আমি দোষ দিই না, মি. হোমস। আপনিও যে আমার সম্বন্ধে একটা খারাপ ধারণা নিশ্চয় পোষণ করবেন না–সে-বিশ্বাস আমার রইল। আমার স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমি চাই তার উদবেগ উত্তেজনার কিছুটা অংশ নিজের মনে নিতে। আর একবার অনুরোধ জানিয়ে যাই, আমি যে এখানে এসেছিলাম, তা দয়া করে ওঁকে বলবেন না। দরজার কাছ থেকে আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন উনি। শেষবারের মতো দেখলাম তাঁর সুন্দর কিন্তু উদ্ভান্ত মুখ, চমকিত চোখ আর চাপা অধরোষ্ঠ। তারপরই অদৃশ্য হলেন উনি।
স্কার্টের বিলীয়মান খস খস শব্দের পরিসমাপ্তি ঘটল দরজা বন্ধ করার শব্দে। হাসিমুখে হোমস তখন বললে, ওহে, ওয়াটসন, মেয়েদের বিভাগটা তো তোমার। সুন্দরী মহিলাটি কী খেলায় মেতেছেন বলো তো? ওঁর আসল অভিপ্রায়টা কী?
ভদ্রমহিলার বক্তব্যই তো জলের মতো পরিষ্কার এবং ওঁর উদবেগও খুবই স্বাভাবিক।
হুম। ওঁর চেহারাটা একবার ভেবে দেখ, ওয়াটসন। আরও ভাবো ওঁর হাবভাব, অবরুদ্ধ উত্তেজনা, অশান্ত প্রকৃতি এবং নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করার ধরন। মনে রেখো, উনি যে-সম্প্রদায়ের মানুষ, সেখানে কেউ লঘু কারণে আবেগ প্রকাশ করে না।
বাস্তবিকই, বেজায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন ভদ্রমহিলা।
আরও মনে রেখো, কীরকম অদ্ভুত ঐকান্তিকতার সঙ্গে উনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন যে, তাঁর স্বামীর সম্যক স্বার্থরক্ষার জন্যেই সব জানা উচিত। ও-কথা বলার অর্থ? আরও একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ করেছ, ওয়াটসন। আলোর দিকে পেছন ফিরে কেমন কৌশলে বসে পড়লেন, তা তো দেখলে। আমরা যে তার মুখের ভাব দেখে মন বুঝে ফেলি, তা উনি চান না।
হ্যাঁ, ঘরের একটা চেয়ারই বেছে নিয়েছিলেন উনি।
জানোই তো, মেয়েদের মোটিভ সবই অবোধ্য। মার্গারেটের সেই স্ত্রীলোকটার কথা তোমার মনে থাকতে পারে। তাকেও ঠিক এই কারণে সন্দেহ করেছিলাম আমি। নাকের ওপর কোনো পাউডার ছিল না। আর এই সন্দেহই কিনা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল নির্ভুল সমাধান। এ-রকম চোরাবালির ওপর কী করে তোমার সিদ্ধান্তের প্রাসাদ তৈরি করবে বল তো? ওদের অতি তুচ্ছ কার্যকলাপ নিয়েই মোটা মোটা গ্ৰন্থখণ্ড রচনা করা যায় অথবা ওদের অতি অসাধারণ আচরণের কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে পাওয়া যায় হয়তো একটা চুলের কাটা বা চুল কেঁচকানোর প্রসাধনসামগ্রী। গুড মর্নিং, ওয়াটসন।
বেরোচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ। যাব গোডোলফিন স্ট্রিটে। পুলিশ অফিসের দোস্তদের সঙ্গে সকালটা কাটাব ওইখানেই। আমাদের সমস্যার সমাধান আছে এড়ুয়ারডো লুকাসের মৃত্যুরহস্যের সাথে—যদিও স্বীকার করছি, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে-বিষয়ে কিছুই আন্দাজ করে উঠতে পারছি না আমি। ইঙ্গিত, ইশারা কিছুই আমি পাইনি এ-সম্পর্কে। ঘটনা ঘটার আগেই থিয়োরি তৈরি করাটা বিরাট ভুল। ভায়া ওয়াটসন, একটু সামলে থেকো। নতুন কেউ দেখা করতে এলে কথা বোলো আমার হয়ে। যদি সম্ভব হয় তো লাঞ্চের আগেই দেখা হবে তোমার সাথে।
সেদিন, তার পরের দিন এবং তারও পরের দিন বিশেষ একটা মুডে রইল হোমস। ওর বন্ধুবান্ধবেরা এ সময়ে ওকে বলে স্বল্পভাষী, আর সবাই বলে বিষণ্ণ। এ ক-দিন ও ঝড়ের মতো এল, ঝড়ের মতো গেল, ধূমপান করলে অবিরাম, মাঝে মাঝে বেহালা নামিয়ে টুকটাক দু-একটা গান বাজাল, কখনো-বা ড়ুবে রইল দিবাস্বপ্নে, স্যান্ডউইচ গিললে যখন-তখন অসময়ে, এবং আমার ছাড়া ছাড়া প্রশ্নগুলোর উত্তর যা দিলে তা না-দেওয়ারই শামিল। বেশ বুঝলাম, তদন্ত সম্পর্কে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছে না ও। নিজের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কেসটা সম্বন্ধে কিছুই বলত না ও তদন্তের খুঁটিনাটি এবং নিহত ব্যক্তির খিদমতগার জন মিঠুনও গ্রেপ্তার এবং পরে খালাস পাওয়ার খবর জানলাম আমি কাগজ পড়ে। করোনারের জুরিরা জানালে যে খুনটা নিশ্চয় উদ্দেশ্যমূলক এবং সুপরিকল্পিত হত্যা। কিন্তু খুনি অথবা খুনিরা আগের মতোই রইল অজ্ঞাত। মোটিভ কী, সে-রকম আচও কেউ দিতে পারলে না। বহু মূল্যবান সামগ্রীতে ঘর বোঝাই থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিসও সরেনি। নিহত ব্যক্তির কাগজপত্রও কেউ নাড়াচাড়া করেনি। কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর দেখা গেল, ভদ্রলোক ছিলেন একধারে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর উৎসাহী এবং উৎসুক ছাত্র, অবিশ্রান্ত গল্পবাজ, অসাধারণ ভাষাবিদ, এবং ক্লান্তিহীন পত্রলেখক। অনেকগুলো দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার ড্রয়ারবোঝাই দলিলপত্র থেকে চাঞ্চল্যকর কোনো তথ্যই আবিষ্কার করা গেল না। স্ত্রীলোকেদের সাথে আলাপের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাছবিচাররহিত। ব্যক্তিনির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশতেন, কিন্তু ওপরে ওপরে, মাখামাখি ছিল না কারোর সাথেই। এ-রকম মেয়েদের মধ্যে তার পরিচিতের সংখ্যা প্রচুর, কিন্তু বান্ধবী ছিল মাত্র কয়েকজন, আর এমন একজনও ছিল না যাকে তিনি ভালোবাসতেন। স্বভাবচরিত্র পরিমিত এবং নিয়মিত। তার আচরণে কেউ রুষ্ট হতেন না। আগাগোড়া একটা বিরাট রহস্য তাঁর মৃত্যু এবং এ-রহস্য সম্ভবত শেষ পর্যন্ত অনুঘাটিতই থেকে যাবে।
সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তার অনুকল্প হিসাবে মরিয়া হয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল খিদমতগার জন মিঠুনকে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই টেনে নিয়ে যাওয়া গেল না। সেই রাতেই হ্যামারস্মিথে বন্ধুদের সাথে দেখা করেছিল সে। কোনো ফাঁক নেই তার অ্যালিবিতে। একটা পয়েন্ট অবশ্য সত্যি। যে সময়ে বাড়িমুখো রওনা হয়েছিল সে, খুনটা ধরা পড়ার আগেই ওয়েস্টমিনস্টারে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল তার। কিন্তু দেরি হওয়ার যে কারণ সে দর্শালে তা খুবই সম্ভব। সেরাতে খানিকটা পথ হেঁটে এসেছিল সে এবং তা আশ্চর্য নয় এই কারণে যে বড়ো সুন্দর ছিল সেই বিশেষ রাতটি। কাজেই, বারোটার সময়ে বাড়িতে পৌঁছায় সে। পেঁৗছেই ওই অপ্রত্যাশিত শোচনীয় কাণ্ড দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে। মনিবের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভালো। মৃত ব্যক্তির কয়েকটি জিনিস বিশেষ করে ক্ষুর রাখবার একটা ছোট্ট কেস খিদমতগারের বাক্সে পাওয়া গেছিল। কিন্তু জন মিঠুন জানলেন যে জিনিসগুলো তার মনিবের দেওয়া বকশিশ। মিসেস প্রিঙ্গলও তা সমর্থন করলে। বছর তিনেক হল লুকাসের কাজে বহাল আছে মিঠুন। একটা জিনিস কিন্তু লক্ষণীয়। ইউরোপ সফরের সময়ে লুকাস মিঠুনকে সঙ্গে নিতেন না। মাঝে মাঝে মাস তিনেকের জন্যে প্যারিসে থাকতেন উনি। সে সময়ে মিটুন থাকত গোছোলফিন স্ট্রিটের বাড়ির তত্ত্বাবধোনে। খুনের রাতে মিসেস প্রিঙ্গলও কিছু শুনতে পায়নি। তার মনিবের সাথে কেউ যদি দেখা করতে এসে থাকে তো তিনি নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
কাজে কাজেই তিনটে দিন কেটে গেল, কিন্তু রহস্য-তিমিরের একটা অংশেরও সমাধান করা গেল না। অন্তত কাগজে আমি তাই পড়লাম! হোমস এর থেকে বেশি খবর যদিও রাখত, তা আর কাউকে জানায়নি। ওর মুখেই শুনেছিলাম, এ-কেসে লেসট্রেড তাকে দলে টেনেছে। সে যে প্রত্যেকটা নতুন পরিস্থিতির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে রয়েছে, তা জানতাম। চতুর্থ দিন প্যারিস থেকে একটা সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোনোর পর মনে হল এ বিরাট প্রশ্নের সব কিছুরই সমাধান হয়ে গেল।
প্যারিসের পুলিশ সদ্য একটা আবিষ্কার করিয়াছে (লিখেছে ডেলি টেলিগ্রাফ)। ফলে, যে অবগুণ্ঠন মি. এড়ুয়ারডো লুকাসের শোচনীয় অদৃষ্টকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা উখিত হইল। গত সোমবার রাত্রে ওয়েস্টমিনস্টারের গোডোলফিন স্ট্রিটে আক্রান্ত হইয়া মি. এড়ুয়ারডো লুকাস মৃত্যুমুখে পতিত হন। আমাদের পাঠকবর্গের স্মরণে থাকিতে পারে যে, নিহত ভদ্রলোককে ছুরিকাহত অবস্থায় তাঁহার ঘরেই পাওয়া গিয়াছিল। কয়েকটি কারণে তাঁহার খিদমতগারকে সন্দেহ করা হইয়াছিল বটে, কিন্তু একটি অ্যালিবির জন্য সে-কেস ভাঙিয়া যায়। ম্যাডামজেল হেনরি ফোরনেয়ি নামে পরিচিত এক ভদ্রমহিলা রু অস্টারলিতে একটি ছোট্ট ভিলা লইয়া বাস করিতেন। গতকাল তাহার চাকরবাকরেরা কর্তৃপক্ষকে খবর দেয় যে তিনি নাকি উন্মাদ হইয়া গিয়াছেন। পরীক্ষার পর দেখা যায় যে, বাস্তবিকই তিনি বিপজ্জনক এবং স্থায়ী প্রকৃতির একটা বাতিকে আক্রান্ত। তদন্তের ফলে পুলিশ আবিষ্কার করিয়াছে যে, লন্ডন পরিভ্রমণ সমাপনান্তে গত মঙ্গলবার স্বগৃহে ফিরিয়া আসেন ম্যাডামজেল এবং প্রমাণ যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহাতে দেখা যাইতেছে, ওয়েস্টমিনস্টারের অপরাধের সঙ্গে তাঁহার সংযোগ আছে। ফটোগ্রাফ মিলাইয়া দেখবার পর সিদ্ধান্তমূলকভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, মসিয়ে হেনরি ফোরনেয়ি এবং এড়ুওয়ারডো লুকাস এক এবং অদ্বিতীয় ব্যক্তি এবং নিহত ব্যক্তি কোনো কারণে লন্ডন এবং প্যারিসে দ্বৈত জীবনযাপন করিয়া আসিয়াছেন। ম্যাডামজেল ফোরনেয়ি বর্ণসংকর। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাহার জন্ম এবং তাহার ধমনীতে ইউরোপীয় ও নিগ্রো উভয় রক্তই প্রবাহিত। অল্পতেই নিরতিশয় উত্তেজিত হইয়া ওঠা তাহার স্বভাব এবং অতীতে ঈর্ষার প্রকোপে কয়েকবার তাহার চিত্তবিকার ঘটিতেও দেখা গিয়াছে। অনুমান, উত্তেজনা বা ঈর্ষাবশতই তিনি এ ভয়ানক খুনটা করিয়া ফেলিয়াছেন যাহার ফলে লন্ডনে এই প্রকার সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। সোমবার রাত্রে তাহার গতিবিধির কোনো হদিশ এখনও পাওয়া যায় না বটে, তবে পুলিশের সন্দেহ, তাহার বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়া যায় এমন একজন স্ত্রীলোক মঙ্গলবার সকালে শেরিং ক্রস স্টেশনে তাহার উদ্ভান্ত চেহারা এবং মারমুখো অঙ্গভঙ্গির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতএব খুনটা স্বভাবতই উন্মত্ত থাকাকালীনই হইয়াছে অথবা খুনের অব্যবহিত প্রতিক্রিয়ায় এই অসুখী মহিলার চেতনা লোপ পায় এবং তিনি পাগল হইয়া যান। বর্তমানে অতীতের কোনো সুসংবদ্ধ বর্ণনা দিতে তিনি অপারগ এবং চিকিৎসকেরাও তাহার চেতনার পুনরুদ্ধারের কোনো আশা রাখিতেছেন না। প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, একজন স্ত্রীলোককে তিনি ম্যাডামজেল ফোরনেয়িও হইতে পারেন, সোমবার রাত্রে কয়েক ঘণ্টার জন্যে গোডোলফিন স্ট্রিটের একটি বাড়িকে লক্ষ করিতে দেখা গিয়াছে।
এ-সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়, হোমস? খবরটা আমিই জোরে জোরে পড়ে শোনালাম ওকে। শুনতে শুনতে প্রাতরাশ খাওয়া শেষ করল বন্ধুবর।
মাই ডিয়ার ওয়াটসন, টেবিল ছেড়ে উঠে ঘরের এ-মোড় থেকে ও-মোড় পর্যন্ত পায়চারি করতে করতে বলল ও, বুঝতে পারছি নিদারুণ ভোগান্তি চলেছে তোমার কৌতূহলের টুটি টিপে বসে থাকার জন্যে। কিন্তু গত তিন দিনে যদি তোমায় কিছু না-বলে থাকি তো বুঝতে হবে বলার মতো কিছুই ছিল না। এমনকী এখনও প্যারিস থেকে আসা এই রিপোর্টও আমায় বিশেষ সাহায্য করতে পারছে না।
লোকটার মৃত্যুই যদি প্রশ্ন হয়, তাহলে এই রিপোের্টই তো চূড়ান্ত, তাই নয় কি?
ভদ্রলোকের মৃত্যুটা তো একটা নিছক ঘটনা—আমাদের আসল কাজের তুলনায় তুচ্ছ একটা উপসংহার। আমাদের মুখ্যকর্তব্য হল দলিলটার হদিশ খুঁজে বার করা আর একটা ইউরোপীয় বিপর্যয়কে নিরোধ করা। গত তিনদিনে একটিমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ঘটেছে, এবং তা হচ্ছে কিছুই ঘটেনি। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় গভর্নমেন্টের কাছ থেকে রিপোর্ট পাচ্ছি আমি এবং ইউরোপের কোথাও কোনোরকম অশান্তির সূচনা দেখা যায়নি, এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এখন, এ-চিঠিটা যদি দেশছাড়া হত না, কখনোই তা হয়নি, হতে পারে না কিন্তু যদি দেশছাড়া না-ই হয়ে থাকে, তবে এখন তা কোথায়? কার কাছে? কেনই-বা একে চেপে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নটাই তো হাতুড়ির মতো দমাদম পড়ছে আমার মগজে। চিঠিটা যে-রাতে অদৃশ্য হল, ঠিক সেই রাতেই লুকাসও ওপারের পথে যাত্রা করলেন–একি বাস্তবিকই নিছক কাকতলীয়? চিঠিটা কি আদৌ পেঁৗছেছিল ওঁর কাছে? তাই যদি হয় তো তার কাগজপত্রের মাঝে মাঝে চিঠির সন্ধান মিলছে না কেন? ওঁর বিকৃত-মস্তিষ্ক স্ত্রী কি যাওয়ার সময়ে চিঠিটাও সঙ্গে নিয়ে গেছেন? তাই যদি, তাহলে তা কি তার প্যারিসের বাড়িতে আছে? ফরাসি পুলিশের সন্দেহ জাগ্রত না-করে কীভাবে আমি এখন এর সন্ধান করি বল তো? মাই ডিয়ার ওয়াটসন, এ-কেসটা এমনই যে এখানে আইন আমাদের কাছে যতখানি বিপজ্জনক, ঠিক ততখানি বিপজ্জনক ক্রিমিনালরা। প্রত্যেকটি লোকের হাত রয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে, তা সত্ত্বেও স্বার্থের ঝুঁকি কিন্তু অতি বিপুল। এ-রহস্যের সাফল্যময়। পরিসমাপ্তিতে যদি পৌঁছোতে পারি, তাহলে আমার গৌরবময় কর্মজীবনের মুকুটমণি হয়ে থাকবে এ-ঘটনা। এই তো দেখছি রণাঙ্গন থেকে এসে পৌঁছেছে আমার সর্বশেষ রিপোর্ট! নোটটা হাতে পেয়েই দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলে ও। হুররে! লেসট্রেড কৌতূহলোদ্দীপক কিছুর খোঁজ পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে! ওয়াটসন, টুপিটা মাথায় দিয়ে নাও। চলো, বেড়াতে বেড়াতে ওয়েস্টমিনস্টারের দিকে যাই দুজনে।
অকুস্থলে সেই আমার প্রথম আগমন। যে-শতাব্দীতে এ-বাড়ির জন্ম–হুবহু তারই মতো আকৃতি। উঁচু মলিন, আর সংকীর্ণ খুপরিতে বহুধা বিভক্ত আয়তন। ফিটফাট, কেতাদুরস্ত আর নিরেট। সামনের জানলা থেকে লেসট্রেডের বুলডগ-আকৃতিকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। বিশালবপু একজন কনস্টেবল দরজাটা খুলে ধরতেই সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন লেসট্রেড। যে-ঘরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল, খুনটা হয়েছে সেখানেই। তখন কিন্তু কার্পেটের ওপর একটা কুৎসিত এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়া দাগ ছাড়া খুনের আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল না ঘরের মধ্যে। কার্পেটটা ছোটো আর চৌকোনা, পুরু কাপড়ে আবৃত এবং ঘরের ঠিক মাঝখানে পাতা। চারপাশে ঘিরে ছিল চওড়া কিন্তু ভারি সুন্দর সেকেলে কায়দায় খুব চকচক পালিশ করা চৌকো ব্লকের কাঠের মেঝে। আগুনের চুল্লির ওপরে ঝুলছিল বিজিত শত্রুদের অতি চমৎকার অস্ত্রের সারি। এই অস্ত্রেরই একটাকে কাজে লাগানো হয়েছে সেই শোচনীয় রাতে। জানলার সামনে একটা বহুমূল্য জমকালো লেখবার টেবিল। ঘরের প্রতিটি তুচ্ছ বস্তু, ছবি, মেঝের আবরণ, দরজা জানলার পর্দা–সব কিছুর মধ্যে একটা সুখাবহ বিলাসপ্রবণ রুচির নিদর্শন।
প্যারিসের খবরটা দেখেছেন, শুধোলেন লেসট্রেড।
মাথা নেড়ে সায় দিল হোমস।
মনে হচ্ছে, আমাদের ফরাসি বন্ধুরা এবার আসল জায়গায় হাত দিতে পেরেছে। ওরা যা বলেছে, নিঃসন্দেহে ঘটেছেও তাই। দরজায় টোকা দিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। আমার অনুমান, আচমকা এসে চমকে দিয়েছিলেন লুকাসকে। কেননা, জলনিরোধক নিচ্ছিদ্র প্রকোষ্ঠে জীবনধারণ করতেন উনি। দরজা খুলে ভদ্রমহিলাকে ভেতরে আনলেন লুকাস–বাইরে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলেন না। কীভাবে লুকাসের ডেরা খুঁজে বার করেছেন, তা বললেন ভদ্রমহিলা। ভৎর্সনা করলেন। এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে এসে পড়লেন অচিরে। তারপরই ছোটোখাটো ওই ভোজালির ঘায়ে যবনিকা পড়ল লুকাসের জীবনে। এত কাণ্ড কিন্তু এক মুহূর্তে হয়নি। কেননা, জানেন তো চেয়ারগুলো গিয়ে জড়ো হয়েছিল দূরে ওইখানে। আর, একটা চেয়ার বাগিয়ে ধরেছিলেন এমনভাবে যেন ওই দিয়ে ভদ্রমহিলাকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন উনি। প্রমাণাদি সবই পেলাম এবং তা এমনই জলের মতো পরিষ্কার যে মনে হচ্ছে আমরা যেন নিজের চোখেই দেখছি সে-দৃশ্য।
ভুরু তুললে হোমস।
আর তবুও কিনা আমায় ডেকে পাঠালে তুমি?
আ, হ্যাঁ, সেটা আর একটা বিষয়। নিছক একটা নগণ্য ব্যাপার, কিন্তু এই সবেতেই তো আপনার আগ্রহ জেগে ওঠে। অদ্ভুত। নেহাতই খামখেয়াল। মূল ঘটনার সঙ্গে এ-প্রসঙ্গে কোনো সংযোগ নেই–থাকতে পারে না অন্তত ওপর দেখে যা মনে হচ্ছে।
জিনিসটা কী শুনি?
আপনারা জানেন তো এ ধরনের অপরাধের পর যেখানকার জিনিস সেইখানেই রেখে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা বেজায় সতর্ক হয়ে থাকি। দিনরাত একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মোতায়েন ছিল এখানে। আজ সকালে মি. লুকাসকে কবর দেওয়ার পর খতম হল তদন্ত পর্ব–এই ঘর সম্পর্কিত তদন্ত। তারপর আমরা ভাবলাম একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক জিনিসপত্র। এই কার্পেটটা দেখছেন তো, মেঝের সঙ্গে এটা আঁটা নেই–শুধু পেতে রাখা হয়েছে। কার্পেটটা তোলার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। তুলতে গিয়ে দেখলাম—
হ্যাঁ? তুলতে গিয়ে দেখলেন—
উদবেগে টানটান হয়ে ওঠে হোমসের মুখ।
যা দেখলাম তা আপনি এক-শো বছরেও অনুমান করে উঠতে পারবেন না। কার্পেটের ওপর এই দাগটা দেখছেন তো? বেশ খানিকটা রক্ত ভেতরেও নিশ্চয় শুষে নিয়েছে–নেয়নি কি?
নিঃসন্দেহে নিয়েছে।
বেশ, বেশ, শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে সাদা কাঠের ওপর এই দাগটার সঙ্গে মিলে যাওয়ার মতো অনুরূপ দাগটি কিন্তু নেই।
দাগ নেই। কিন্তু তা থাকতেই হবে—
ঠিক। আপনিও তাই বলছেন। কিন্তু আসলে দেখা যাচ্ছে যে দাগটা নেই।
কার্পেটের কোণটা তুলে নিয়ে উলটে ফেলে লেসট্রেড দেখাল, বাস্তবিকই সে যা বললে তা সত্যি।
কিন্তু গালিচার তলার দিকে দাগটা যতখানি, ওপরে ততখানি! কাঠের ওপর নিশ্চয় পড়েছে রক্তের চিহ্ন।
সুবিখ্যাত বিশেষজ্ঞকে হতবুদ্ধি বানিয়ে দেওয়ার উল্লাসে মুখ টিপে নিঃশব্দে হেসে উঠল লেসট্রেড।
এবার আপনাকে দেখাচ্ছি এর ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় দাগ একটা আছে, কিন্তু তা প্রথমটার সঙ্গে মিলছে না। নিজেই দেখুন।বলতে বলতে কার্পেটের আর একটা অংশ উলটে ফেললে ও। আর সত্যি সত্যিই দেখলাম বেশ খানিকটা টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়েছে পুরানো কায়দায় মেঝের। চৌকোণে সাদা জমির ওপর। কী মনে হয় আপনার মি. হোমস?
আরে, এ তো ভারি সোজা। দুটো দাগই ওপর ওপর ছিল, কিন্তু কার্পেটটা ঘুরিয়ে দেওয়া
হয়েছে পরে। চৌকোনা কার্পেট, মোটেই বেগ পেতে হয়নি।
মি. হোমস, কার্পেটটা যে ঘোরানো হয়েছে, এ-কথা বলার জন্য আপনাকে সরকারি পুলিশের প্রয়োজন নেই। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কার্পেটটা এদিক দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেই মিলে যাচ্ছে দাগ দুটো। একটার ওপরেই এসে পড়ছে আর একটা। কিন্তু আমি জানতে চাইছি, কার্পেটটা ঘুরিয়েছে কে এবং কেনই-বা ঘুরিয়েছে?
হোমসের শক্ত মুখ দেখে বুঝলাম অবরুদ্ধ উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ও।
বললে, লেসট্রেড, প্যাসেজের ওই কনস্টেবলটি কি সর্বক্ষণ এখানে পাহারা দিয়েছিল?
নিশ্চয়।
আমার উপদেশ নাও। খুব সাবধানে পরীক্ষা করো ওকে। আমাদের সামনে কোরো না। আমরা বরং এখানে অপেক্ষা করছি। পেছনকার ঘরে নিয়ে যাও ওকে। একলা থাকলে অনায়াসেই ওর কাছ থেকে একটা স্বীকারোক্তি আদায় করে নিতে পারবে তুমি। ওকে জিজ্ঞেস করো, কোন সাহসে বাইরের লোককে ভেতরে ঢুকিয়ে একলা রেখে গেছিল সে এ ঘরের মধ্যে। এ-কাজ করেছিল কি না, তা জিজ্ঞেস কোরো না। ধরে নাও সে করেছে। ওকে বলো, এখানে যে কেউ ছিল তা তুমি জান। চাপ দাও। বলো, আগাগোড়া সব স্বীকার করলেই এ-যাত্রা ক্ষমা পেতে পারে সে। যা বললাম, অবিকল তাই করো।
সর্বনাশ! ও যদি এ-খবর জানে তো ওর পেট থেকে এখুনি আমি তা টেনেহিঁচড়ে বার করে নিচ্ছি। চিৎকার করে উঠে হলের ভেতরে ছিটকে এগিয়ে যায় লেসট্রেড। কয়েক মুহূর্ত পরেই ওর গমগমে কণ্ঠের তর্জনগর্জন শোনা যায় পেছনের ঘরে!
এবার, ওয়াটসন, এবার! চিৎকার করে ওঠে হোমস–বিকারগ্রস্ত ব্যাকুলতা রণরণিয়ে ওঠে ওর স্বরে। নিরুদ্যম, নির্বিকার আচরণের ছদ্ম মুখোশ পরা মানুষটির সমস্ত দানবিক শক্তি তেজ যেন নিমেষে ফেটে পড়ে উৎপিঞ্জর-উৎসাহ প্রকম্পিত সাময়িক কিন্তু উদ্দাম উদ্দীপনের মধ্যে। একটানে মেঝে থেকে কার্পেটটা তুলে ফেলে পলকের মধ্যে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে চৌকোনা কাঠের ব্লকের প্রতিটা জোড় আঁকড়ে আঁকড়ে পরখ করতে লাগল ও। একটা ব্লকের কিনারায় নখ বসে গেল হোমসের এবং সঙ্গেসঙ্গে তা ঘুরে গেল পাশের দিকে। বাক্সের ডালার মতো পেছনের কবজায় ঘুরে গেল কাঠের ব্লকটা। নীচে বেরিয়ে পড়ল একটা ছোট্ট অন্ধকারময় গহ্বর। ক্ষিপ্তের মতো সাগ্রহে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলে হোমস। পরক্ষণেই রাগে হতাশায় দাঁত-মুখ খিচিয়ে এক তিক্ত গর্জন ছেড়ে হাত টেনে নিল সে। গহুর শূন্য।
তাড়াতাড়ি, ওয়াটসন, তাড়াতাড়ি! যেমন ছিল তেমনি রেখে দাও! কাঠের ডালা ফিরে এল যথাস্থানে। কার্পেটটা সোজা করে রাখা হয়েছে, এমনি সময়ে প্যাসেজে লেসট্রেডের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে এসে দেখলে অসলভাবে ম্যান্টলপিসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হোমস। যেন চিন্তায় ইস্তফা দিয়ে মূর্তিমান সহিষ্ণুতার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অদম্য হাইগুলো চাপবার চেষ্টা করছে সে।
আপনাকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত, মি. হোমস। বেশ দেখতে পাচ্ছি সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন আপনি। যাক, সব স্বীকার করেছে ও। এদিকে এসো, ম্যাকফারসন। তোমার এই অত্যন্ত অক্ষমাহঁ আচরণের ইতিবৃত্ত শুনিয়ে যাও এই ভদ্রলোকদের।
সুট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল বিশাল বপু কনস্টেবলটি। চোখ-মুখ বেজায় লাল হয়ে উঠেছিল তার। হাবভাব দেখে বেশ অনুতপ্ত মনে হল তাকে।
কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার ছিল না, স্যার, সত্যিই ছিল না। যুবতী মেয়েটি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিলেন এ-দরজায় বাড়ি ভুল করেছিলেন–উনি তাই বললেন কথাবার্তা কইলাম কিছুক্ষণ। সারাদিন এখানে ডিউটিতে মোতায়েন থাকলে বড়ো একলা একলা লাগে।
বেশ, তারপর কী হল শুনি?
খুনটা কোথায় হয়েছে, তা তিনি দেখতে চাইলেন। বললেন, কাগজে নাকি এ-সম্বন্ধে খবর পড়েছেন। দেখলে খুব সম্রান্ত ঘরের মেয়ে বলে মনে হয় তাঁকে, অল্প বয়স, কথাবার্তাও চমৎকার বলেন। তাই, স্যার, ভাবলাম ওঁকে একবারটি উঁকি মারতে দিলে এমন কী আর ক্ষতি হবে। কার্পেটের ওপর ওই চিহ্নটা দেখেই ধপ করে উনি পড়ে গেলেন মেঝের ওপর। এমনভাবে পড়ে রইলেন যে দেখে মনে হল বুঝি-বা মারাই গেলেন। পেছনে দৌড়ে গিয়ে খানিকটা জল নিয়ে এলাম, কিন্তু জ্ঞান ফেরাতে পারলাম না। তখন দৌড়ে গেলাম আইভি প্ল্যান্ট-এ কিছু ব্র্যান্ডি আনতে। ফিরে এসে দেখি মেয়েটি আর নেই। নিশ্চয় জ্ঞান ফিরে পেয়ে খুব লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে আর মুখ দেখাতে সাহস করেননি।
কার্পেটটা নড়ল কেমন করে?
স্যার, ফিরে এসে কার্পেটটাকে বাস্তবিকই একটু কুঁচকে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু শুনলেন তো, মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন কার্পেটের ওপর। পালিশ করা মেঝের ওপর পাতা কার্পেটটাকে মেঝের সঙ্গে আটকে রাখারও কোনো বন্দোবস্ত নেই। আমিই পরে তা সিধে করে দিই।
ভারিক্কি চালে লেসট্রেড বললে, কনস্টেবল ম্যাকফারসন, আজকে এই শিক্ষাই পেলে যে, আমার চোখে ধুলো দিতে তুমি পারবে না। ভেবেছিলে তোমার কর্তব্যের গাফিলতি কোনোদিনই ধরা পড়বে না। কিন্তু কার্পেটটার দিকে এক লহমা তাকিয়েই আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছিল যে এ-ঘরে একজনকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। তোমার কপাল ভালো যে কিছুই খোয়া যায়নি। তা হলে এতক্ষণে কোয়্যার স্ট্রিটে চালান হয়ে যেতে। এই সামান্য ব্যাপারের জন্য মিছিমিছি আপনাকে কষ্ট দিলাম। আমি দুঃখিত, মি. হোমস। ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় দাগের সঙ্গে প্রথম দাগের না মিল হওয়ার পয়েন্ট শুনলে নিশ্চয়ই আগ্রহ বোধ করবেন আপনি।
আরে পয়েন্টটা তো দারুণ ইন্টারেস্টিং বটেই। কনস্টেবল, এই ভদ্রমহিলাটি কি এ-ঘরে শুধু একবারই এসেছিলেন?
হ্যাঁ স্যার, মাত্র একবার।
কে তিনি?
নাম জানি না, স্যার। টাইপরাইটিং সংক্রান্ত একটা বিজ্ঞাপন পড়ে খোঁজ নিতে বেরিয়েছিলেন। এসে পড়েন ভুল ঠিকানায়। ভারি মিষ্টি, আর ভদ্র মেয়ে স্যার।
ছিপছিপে লম্বা? সুন্দরী?
হ্যাঁ, স্যার। মিষ্টি চেহারার অল্পবয়সি যুবতী। সুন্দরী বলতে পারেন। কেউ কেউ হয়তো বলবে বেজায় সুন্দরী। ও, অফিসার, একবারটি আমায় উঁকি মারতে দিন, বললেন মেয়েটি। এমন মিষ্টিভাবে জেদাজেদি করতে লাগলেন যে আমি ভাবলাম দরজা দিয়ে একবার ওঁকে মাথা গলাতে দিলে কোনো ক্ষতিই হবে না।
কীরকম পোশাক পরেছিলেন তিনি?
সাদাসিদে, স্যার, পা পর্যন্ত লম্বা একটা আলখাল্লা।
কোন সময়ে?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল তখন। ব্র্যান্ডি নিয়ে ফিরে আসার পর দেখলাম ওরা ল্যাম্পগুলো জ্বালাচ্ছে।
বেশ বেশ, বললে হোমস। এসো ওয়াটসন, আমার তো মনে হয় অন্যত্র এর চাইতেও দরকারি কাজ আমাদের আছে।
লেসট্রেডকে সামনের ঘরে রেখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। অনুতপ্ত কনস্টেবলটি এসে দরজা খুলে দিলে। সিঁড়ির ধাপের ওপর বোঁ করে ঘুরে গেল হোমস। হাতের মধ্যে কী-একটা জিনিস নিয়ে তুলে ধরলে ম্যাকফারসনের সামনে। নিবিষ্ট চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল কনস্টেবল ম্যাকফারসন।
তারপরই চেঁচিয়ে উঠল, জয় ভগবান, স্যার। বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তার মুখে। ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখল হোমস। হাতের জিনিসটা রেখে দিল বুক পকেটে! তারপর যখন রাস্তায় নেমে এলাম, শুরু হল তার অট্টহাস্য। বললে, চমৎকার! বন্ধু ওয়াটসন, শেষ দৃশ্যের ড্রপসিন এবার উঠেছে। শুনে তুমি আশ্বস্ত হবে যে যুদ্ধ আর হবে না, রাইট অনারেবল ট্রেলাওনি হোপের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও মসীলিপ্ত হবে না, অবিবেচক নৃপতি মহোদয়কে তার অবিবেচনার কোনো শাস্তি পেতে হবে না, প্রধানমন্ত্রীমহাশয়কে ইউরোপীয় জটিলতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, এবং আমরা যদি সামান্য বুদ্ধি খরচ করে সমস্ত ব্যপারটাকে সুকৌশলে পরিচালনা করতে পারি, তাহলে কারোরই আর একটা পেনিও লোকসান হবে না–নতুবা জানই তো কী বিশ্রী দুর্ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে।
সমস্যার সমাধান করেছ তাহলে! চেঁচিয়ে উঠি আমি।
একেবারে নয় ওয়াটসন। এখনও কতকগুলো পয়েন্ট রয়েছে যা আগের মতোই তিমিরাবৃত। কিন্তু এত বেশি জেনে ফেলেছি, যে, এখন যদি বাকিটুকু না জানতে পারি তো দোষ হবে আমাদের নিজেদেরই। এখন আমরা সিধে যাব হোয়াইট হল টেরেসে। এ-ব্যাপারে চূড়ান্ত পরিণতির সৃষ্টি হবে সেখানেই।
ইউরোপীয়ান সেক্রেটারির বাসভবনে পৌঁছে হোমস যাঁর খোঁজ করল তিনি লেডি হিলডা ট্রেলাওনি হোপ। পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল মর্নিংরুমে।
মি. হোমস। ঘৃণা মেশানো রোষে অরুণ হয়ে ওঠে লেডির মুখ, এ কিন্তু আপনার অত্যন্ত অন্যায় এবং অনুদার আচরণ। আমাদের অভিপ্রায় আপনার সামনেই প্রকাশ করতে এসেছি আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার গোপনে রাখবেন শুধু এই কারণে যে আমার স্বামী যেন মনে না-করেন যে আমি তার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি। আর তবুও কিনা এখানে এসে আপনি আমায় সবার সন্দেহভাজন করে তুলেছেন এবং দেখাচ্ছেন যে, আপনার আমার মধ্যে আছে ব্যবসায়িক সম্পর্ক।
ম্যাডাম দুর্ভাগ্যক্রমে এ ছাড়া আর কোনো সম্ভাব্য বিকল্প পথ আমার ছিল না। নিদারুণ গুরুত্বপূর্ণ এই দলিলটা পুনরুদ্ধারের কাজে বহাল করা হয়েছে আমাকে। সুতরাং ম্যাডাম, বলতে বাধ্য হলাম, দয়া করে দলিলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিন।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন লেডি–নিমেষের মধ্যে উধাও হল তার সুন্দর মুখের সমস্ত রং। প্রদীপ্ত হয়ে উঠল তার দুই চোখ–এমনভাবে টলমল করে উঠলেন যে আমি ভাবলাম এবার বুঝি জ্ঞান হারাবেন তিনি। তারপরেই প্রবল প্রচেষ্টায় আঘাতের বিপর্যয় থেকে নিজেকে সামলে নিলেন। আতীব্র বিস্ময় আর ঘৃণা মেশানো ক্রোধ মুখের প্রতিটি রেখা বিতাড়িত করলে আর সব ভাবকে।
আপনি–আপনি আমায় অপমান করলেন, মি. হোমস!
ধীরে, ধীরে, ম্যাডাম, এসবে কোনো লাভ হবে না। চিঠিটা বার করে দিন।
ঘণ্টার দিকে ছিটকে গেলেন লেডি।
বাটলার এসে আপনাদের বাইরের পথ দেখিয়ে দেবে।
ঘণ্টা বাজাবেন না, লেডি হিলড়া। যদি বাজান তো একটা কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্যে আমার যাবতীয় আন্তরিক প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। চিঠিটা দিয়ে দিন–তাহলেই সব কিছু দেখবেন ঠিক হয়ে গেছে। আমার হাতে হাত মিলিয়ে চলুন, সব বন্দোবস্ত আমি করে দেব।কিন্তু আমার বিরুদ্ধে গেলেই আপনার স্বরূপ প্রকাশ করে দিতে দ্বিধা করব না আমি।
অপরূপ উদ্ধত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলেন লেডি হিলডা। রানির মতোই দর্পিত চেহারা তার। নিস্পলক দুই চোখ দিয়ে হোমসকে গেঁথে ফেলে যেন ওর অন্তরাত্মাসুদ্ধ পড়ে নিলেন উনি। ঘণ্টার দড়িতে হাত রেখেছিলেন বটে, দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজানো থেকে নিবৃত্ত করে নিলেন নিজেকে।
বললেন, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন আপনি। এখানে আসা, অরপর কুটি করে একজন স্ত্রীলোককে ভড়কে দেওয়ার চেষ্টা করাটা খুব পুরুষোচিত কাজ নয়, মি. হোমস। আপনি কিছু জানেন বলছেন। কী জানেন আপনি?
দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, ম্যাডাম। পড়ে গেলে নিজেই চোট পাবেন। আপনি না-বসা পর্যন্ত আমি কথা বলব না! ধন্যবাদ।
আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি, মি. হোমস।
এক মিনিটই যথেষ্ট, লেডি হিলডা। আমি জানি আপনি এড়ুয়ারডো লুকাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, দলিলটা তাকে দিয়েছিলেন, অতি দক্ষতার সঙ্গে গতরাতে সেই ঘরেই আবার গেছিলেন এবং সুকৌশলে চিঠিটাকে বার করে এনেছেন কার্পেটের তলায় লুকোনো জায়গা থেকে।
ছাই ছাই মুখে বিস্ফারিত চোখে হোমসের পানে তাকিয়ে ছিলেন লেডি হিলডা।
কথা বলার আগে বার দুয়েক ঢোক গিললেন।
তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি উন্মাদ, মি. হোমস–আপনি উন্মাদ!
পকেট থেকে ছোট্ট এক টুকরো কার্ডবোর্ড বার করল হোমস। জিনিসটা ফটোগ্রাফ থেকে কেটে নেওয়া একটি স্ত্রীলোকের মুখের ছবি।
বললে, ভেবেছিলাম কাজে লাগতে পারে, তাই সবসময়ে সঙ্গে সঙ্গে রেখেছিলাম এই ছবিটি। পুলিশম্যান ছবি দেখে চিনতে পেরেছে।
যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল লেডি হিলডার মাথা এলিয়ে পড়ল চেয়ারের পেছনে।
স্বীকার করুন, লেডি হিলডা। চিঠিটা আপনার কাছেই আছে। ব্যাপারটাকে এখনও সামলে নেওয়া যায়। আপনাকে ঝামেলায় জড়ানোর কোনো অভিপ্রায় নেই। হারানো চিঠিটা আপনার স্বামীর কাছে পৌঁছে দিলেই শেষ হয় আমার কর্তব্য। আমার উপদেশ নিন–সরলভাবে সব খুলে বলুন আমাকে। এ ছাড়া রেহাই পাওয়ার আর কোনো পথ আপনার নেই।
প্রশংসনীয় তার সাহস। এত কাণ্ডের পরেও হার মানবার পাত্রী নন।
আবার আপনাকে বলছি, মি. হোমস, উদ্ভট কতকগুলো কল্পনার জাল বুনে চলেছেন আপনি!
আপনার জন্যে আমি দুঃখিত, লেডি হিলডা। আমার যথাসাধ্য করলাম আপনার জন্যে। সবই দেখছি বৃথা।
ঘণ্টা বাজিয়ে দিল ও। ঘরে ঢুকল বাটলার।
মি. ট্রেলাওনি হোপ বাড়িতে আছেন?
পৌনে একটার সময় উনি বাড়িতে পৌঁছোবেন, স্যার।
ঘড়ির দিকে তাকাল হোমস।
বললে, আরও মিনিট পনেরো। বেশ, আমি অপেক্ষা করব।
বাটলার বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে-না-করতেই লেডি হিলডা জানু পেতে বসে পড়লেন হোমসের পায়ের কাছে। দুই হাত সামনে প্রসারিত করে সুন্দর মুখটি তুলে ধরলেন ওপর পানে। দরদর অশ্রুধারে সিক্ত সে-মুখ।
মি. হোমস, আমাকে এযাত্রা ছেড়ে দিন! আমাকে বাঁচান! অনুরোধ উপরোধ কাকুতি মিনতির উদ্দামতার যেন সাময়িক চিত্তবিকার ঘটে ওঁর।
ঈশ্বরের দোহাই ওঁর কাছে এ-কথা বলবেন না! ওঁকে যে আমি বড়ো ভালোবাসি। ওঁর জীবনে এইটুকু ছায়াও আমি ফেলতে চাই না। আমি তো জানি, সে-আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ওঁর মহান অন্তর।
লেডি হিলডাকে ধরে তুলল হোমস। বললে, ধন্যবাদ, ম্যাডাম। আপনি যে এই শেষ মুহূর্তেও আপনার বিচারবুদ্ধি ফিরে পেয়েছেন, এজন্যে ধন্যবাদ! আর একটা সেকেন্ডও নষ্ট করা যায় না। চিঠিটা কোথায়?
তিরবেগে একটা লেখবার টেবিলের কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে ডেস্কটা খুলে ফেললেন লেডি হিলডা। ভেতর থেকে বার করে আনলেন নীল রঙের একটা দীর্ঘ লেফাফা।
এই সেই চিঠি, মি. হোমস। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, ভেতরে কী আছে, তা আমি কোনোদিনই খুলে দেখিনি!
কী করে ফেরত দিই খামটা? বিড় বিড় করতে থাকে হোমস। তাড়াতাড়ি, যা হয় একটা উপায় ভেবে বার করতেই হবে আমাদের! ডেসপ্যাঁচ-বাক্সটা কোথায়?
এখনও ওঁর শোবার ঘরে।
ওঃ, কী সৌভাগ্য! তাড়াতাড়ি, ম্যাডাম, বাক্সটা নিয়ে আসুন এখানে।
মুহূর্ত পরেই লালরঙের একটা চ্যাটালো বাক্স হাতে ফিরে এলেন লেডি হিলডা।
এর আগে কী করে খুলেছিলেন বাক্সটা? নকল চাবি আপনার কাছে আছে? হ্যাঁ, নিশ্চয় আছে। খুলুন।
বুকের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চাবি বের করলেন লেডি হিলড়া। ওপরদিকে ছিটকে গিয়ে খুলে গেল বাক্সের তালা! কাগজপত্রে ঠাসা ভেতরটা। নীল লেফাফাটা একদম ভেতরে ঠেসে দিলে হোমস। অন্যান্য দলিলের পাতার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে রেখে দিলে বাক্সের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। বন্ধ হয়ে গেল বাক্স, চাবি ঘুরল এবং ফিরে গেল তা শোবার ঘরে।
হোমস বললে, এইবার আমরা তৈরি। এখনও দশ মিনিট হাতে আছে। আপনাকে আড়াল করতে গিয়ে অনেক দূরে গড়িয়েছি, লেডি হিলডা। তার প্রতিদানে আপনি শুধু এই সময়টুকুর মধ্যে বলুন, অকপটে বলুন, এই অসাধারণ ব্যাপারের আসল অর্থটা কী?
মি. হোমস, সবই বলব আপনাকে, চিৎকার করে বললেন লেডি। ওঃ, মি. হোমস, ওঁকে এক মুহূর্তের জন্যও দুঃখ দেওয়ার আগে যেন আমার ডান হাতটা আমি কেটে ফেলি। সারা লন্ডনে আপনি এমন একজন মেয়েকে খুঁজে পাবেন না যে তার স্বামীকে আমার মতো এতখানি ভালোবাসে। তার, তবু আমি যা করছি–যা করতে আমি বাধ্য হয়েছি তা যদি শুনতে পান তো জীবনে আর আমায় ক্ষমা করে উঠতে পারবেন না উনি। ওঁর মানসম্মান এতই সুমহান, সুউচ্চ যে কোনোরকম পদস্খলন ভুলত্রুটিকে উনি বিস্মৃত হতে পারেন না বা ক্ষমার চোখে দেখতে পারেন না। আমাকে সাহায্য করুন মি. হোমস। আমার সুখই তার সুখ। অথচ একী মহাসংকটের মাঝে এসে পড়ল আমাদের দুজনের জীবন।
তাড়াতাড়ি, ম্যাডাম, সময় কমে আসছে!
মি. হোমস, সব কিছুর মূলে আছে আমার লেখা একটি চিঠি, আগে অবিবেচকের মতো, মহামূখের মতো লেখা একটা চিঠি, আবেগবিহুল, প্রেমাদ্ভুত এক বালিকার লেখা একটা চিঠি। কারো ক্ষতিও করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি জানি, উনি এ-চিঠিতে গুরু অপরাধ বলেই গণ্য করতেন। এ-চিঠি উনি পড়লে আমার ওপর ওঁর অটুট আস্থা চিরকালের মতো ধ্বংস হয়ে যেত। এ-চিঠি লেখার পর অনেক বছর কেটে গেছে। ভেবেছিলাম, সমস্ত ব্যাপারটা ভুলে গেছে সবাই। আর, তারপরেই এই লুকাস লোকটার কাছে শুনলাম যে চিঠিটা তার হাতে এসে পৌঁছেছে এবং শিগগিরই আমার স্বামীর সামনে সে তা হাজির করবে। আমি অনুনয় করে দয়া ভিক্ষা করলাম ওর। সে বলল, চিঠিটা সে আমায় ফিরিয়ে দিতে পারে একটি শর্তে। আমার স্বামীর ডেসপ্যাঁচ-বাক্স থেকে বিশেষ একটা দলিল এনে দিতে হবে তার হাতে। অফিসে ওর কয়েকজন গুপ্তচর আছে। তারাই এসে ওকে দলিলটার অস্তিত্ব জানিয়েছিল। আমাকে আশ্বাস দিলে যে এর ফলে আমার স্বামীর কোনো ক্ষতিই হবে না। আমার স্থানে নিজেকে কল্পনা করুন, মি. হোমস। এ-অবস্থায় কী করা উচিত আমার?
স্বামীকে বিশ্বাস করে অকপটে সব খুলে বলা।
আমি তা পারিনি, মি. হোমস, আমি তা পারিনি! একদিকে নিশ্চিন্ত ধ্বংস। অপরদিকে, স্বামীর কাগজপত্র অপহরণ করা ভয়ংকর কাজ মনে করলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে এর ফলাফল আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। তার চেয়ে বরং স্নেহ, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এর পরিণাম কী, তা জলের মতো স্বচ্ছ মনে হয়েছিল আমার কাছে। আমি তাই করলাম, মি. হোমস। চাবিটার একটা ছাপ নিলাম আমি। এই লুকাস লোকটা একটা নকল চাবি আনিয়ে দিলে আমায়। ডেসপ্যাঁচ-বাক্স খুলে কাগজটা নিয়ে পৌঁছে দিয়ে এলাম গোডোলফিন স্ট্রিটে।
সেখানে কী ঘটল, ম্যাডাম?
পূর্ব ব্যবস্থামতো দরজায় টোকা দিলাম আমি। দরজা খুলে দিলে লুকাস। এর পিছু পিছু এসে পৌঁছোলাম তার ঘরে। হল ঘরের দরজা দু-হাট করে রেখে এলাম এই কারণে যে লোকটার সঙ্গে একলা থাকতে ভয় ভয় করছিল আমার। ভেতরে ঢোকার সময়ে মনে আছে একজন স্ত্রীলোককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমাদের কাজ শেষ হল অচিরে। আমার চিঠিটা ও টেবিলের ওপর রেখেছিল। আমি দলিলটা তুলে দিলাম ওর হাতে। চিঠিটা আমাকে দিয়ে দিল ও। ঠিক এই মুহূর্তে, দরজার কাছে কীসের শব্দ শুনলাম। প্যাসেজে সিঁড়ির ধাপ ছিল। লুকাস চট করে কার্পেটটা তুলে ফেলে একটা চোরা গর্তের মধ্যে দলিলটা ঠেলে গুঁজে দিয়ে আবার কার্পেটটা পেতে দিল সমান করে।
এরপরে যা ঘটল তা যেন এক টুকরো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। পলকের মধ্যে যেন স্বপ্নের ঘোরে দেখলাম একটা মলিন, উন্মত্ত মুখ। কানে শুনলাম ফরাসি ভাষায় একজন স্ত্রীলোকের চিলের মতো তারস্বরে চিৎকার, প্রতীক্ষা আমার বিফলে যায়নি। শেষ পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত পেয়েছি তোমায় ওই মেয়েটার সাথে! শুরু হল বর্বরের মতো দারুণ ধস্তাধস্তি। লুকাসের হাতে দেখলাম একটা চেয়ার। আর, স্ত্রীলোকটার হাতে ঝলসে উঠল একটা ছোরা। তিরবেগে আমি বেরিয়ে পড়লাম এই দৃশ্য ছেড়ে এক দৌড়ে এসে পড়লাম বাইরে, রাস্তায় পড়েও দৌড় থামালাম না। খণ্ডযুদ্ধের বীভৎস ফলাফল জানতে পারলাম পরের দিন সকালে কাগজ পড়ে। চিঠিটা ফিরে পেয়ে সেরাতটা কিন্তু বড়ো সুখে কাটালাম আমি। তখন অবশ্য বুঝিনি ভবিষ্যতের গর্ভে লুকোনো এর বিষময় পরিণতি।
পরের দিন সকালে বুঝলাম এক উৎপাত নিরোধ করতে গিয়ে আর এক উৎপাতের সৃষ্টি করেছি আমি। দলিল খোয়া যাওয়ায় আমার স্বামীর আতীব্র মানসিক যাতনা তিরের মতো গিয়ে আমার বুকে বিঁধল। তখনই আর কালবিলম্ব না-করে ভাবলাম তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলি আমার কীর্তি। কিন্তু অতি কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। কেননা তা করা মানেই তো অতীতের অন্যায় স্বীকার করা। সেইদিনই সকালে আপনার কাছে গেলাম এই উৎকট অপরাধের পুরো গুরুত্বটা জানতে। যে-মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম আমার কাজের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া, সেই মুহূর্ত থেকে শুধু একটি চিন্তাই পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল আমার মনের কোণে এবং সে-চিন্তা হল যেমন করেই হোক আমার স্বামীর দলিলটাকে ফিরিয়ে আনা। এমনও হতে পারে যে, লুকাস দলিলটাকে যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল, এখনও তা সেইখানেই আছে। ভয়ংকর ওই স্ত্রীলোকটা ঘরে ঢোকার আগেই কাগজটা ও লুকিয়ে ফেলেছিল এবং সে না এসে পড়লে আমি বোধ হয় জানতেই পারতাম না তার গোপন স্থানের হদিশ। কী করে যাওয়া যায় তার ঘরে? দু-দিন চোখে চোখে রাখলাম জায়গাটাকে। কিন্তু একবারও দরজাটাকে খোলা অবস্থায় দেখলাম না। গতরাতে শেষ চেষ্টা করলাম। কী করেছিলাম এবং কীভাবে আমি কার্যোদ্ধার করি তা তো আপনি আগেই জেনেছেন। কাগজটা নিয়ে এলাম বাড়িতে। অপরাধ স্বীকার না-করে স্বামীর কাছে এ-দলিল ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো পথ না-পেয়ে ভাবলাম নষ্ট করে ফেলব কাগজটাকে। হেভেনস ওঁর পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি সিঁড়ির ওপর।
হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন উত্তেজিত ইউরোপীয় সেক্রেটারি।
খবর আছে, মি. হোমস, কোনো খবর আছে? চেঁচিয়ে ওঠেন উনি।
কিছু আশা আছে।
আ, জয় ভগবান! প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে তার মুখ। প্রধানমন্ত্রীমশায় আমার সাথে লাঞ্চ খাবেন। আপনার আশার অংশ কি তিনিও নিতে পারেন? ইস্পাতকঠিন নার্ভ থাকা সত্ত্বেও আমি জানি এই ভয়ংকর ঘটনার পর থেকে ঘুম উড়ে গেছে ওঁর চোখের পাতা থেকে। জেকবস, প্রধানমন্ত্রী মহাশয়কে ওপরে আসতে বলবে কি? হিলডা ডিয়ার, এটা একটা রাজনীতি সংক্রান্ত ব্যাপার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাইনিং রুমে তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হবেখন।
প্রধানমন্ত্রীর অচঞ্চল হাবভাবে সংযমের প্রকাশ দেখলাম। কিন্তু তবুও তার চোখের দীপ্তি আর অস্থিসার হাতের মৃদু কম্পন থেকে বুঝলাম তরুণ সহকর্মীর উত্তেজনার কবল থেকে তিনিও নিস্তার পাননি।
শুনলাম রিপোর্ট দেওয়ার মতো খবর এনেছেন, মি. হোমস?
বন্ধুবরও উত্তর দিলে, এখনও কিন্তু তা পুরোপুরিই নাবাচক। যেখানে যেখানে এ-দলিলের হদিশ পাওয়া সম্ভব, সব জায়গাতে খবর নিয়েছি আমি। কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা যে নেই, এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু তা তো যথেষ্ট নয়, মি. হোমস। এ-রকম একটা আগ্নেয়গিরির ওপর আমরা তো চিরকাল বসে থাকতে পারি না। নিশ্চিত কিছু আমাদের পেতেই হবে।
আশা আছে, তা পাব। সেই কারণেই এখানে আমি এসেছি। এ-ব্যাপার নিয়ে আমি যতই ভাবছি, ততই একটা বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়ে যাচ্ছে আমার মনে! বিশ্বাসটা এই চিঠিটা কস্মিনকালেও এ-বাড়ির বাইরে যায়নি।
মি. হোমস!
যদি যেত, তাহলে তা এতক্ষণে জনসাধারণের সামনেই উপস্থাপিত হত!
কিন্তু এ-বাড়ির মধ্যেই রেখে দেওয়ার জন্যে কেই-বা সরাতে যাবে বলুন? আর, কেনই-বা নেবে সে?
আমি বিশ্বাস করি না যে চিঠিটা কেউ নিয়েছে।
তাহলে ডেসপ্যাঁচবাক্স থেকে চিঠিটা উধাও হল কেমন করে শুনি?
আমি বিশ্বাস করি না যে চিঠিটা আদৌ ডেসপ্যাঁচ-বাক্সের বাইরে গেছে।
মি, হোমস, বড়ো অসময়ে এসব রঙ্গ-পরিহাস শুরু করেছেন। আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে চিঠিটা বাক্স থেকে উধাও হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালের পর থেকে বাক্সটা আর পরীক্ষা করেছিলেন?
না। তার আর দরকার ছিল না।
আমার অনুমান, আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে চিঠিটা।
অসম্ভব। আমি বলছি, অসম্ভব।
কিন্তু আমি তো পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হতে পারছি না, বিশ্বাসও করে উঠতে পারছি না। এ-রকম ব্যাপার ঘটতে তো এর আগেও আমি দেখেছি। ধরে নিচ্ছি, নিশ্চয় আরও কাগজপত্র ছিল বাক্সের মধ্যে। সেইসবের মধ্যেই মিশে থাকতে পারে দলিলটা।
দলিলটা ছিল সবার ওপরে।
কেউ হয়তো নেড়েছিল বাক্সটাকে। তাতেই স্থানভ্রষ্ট হয়েছে।
না, না। আমি সব কিছু বার করে দেখেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, হোপ, অনায়াসেই তো সমাধান করা যায় এ-সমস্যার। ডেসপ্যাঁচবাক্সটা এখানে আনাও দিকি।
ঘণ্টা বাজালেন সেক্রেটারি।
জেকবস, আমার ডেসপ্যাঁচবাক্সটা নামিয়ে আনে। সময়ের হাস্যকর অপচয় ছাড়া আর কোনো লাভই হবে না। এই করলেই যদি সন্তুষ্ট হন তো, তবে তাই হোক। ধন্যবাদ, জেকবস, এখানে রাখো। চাবিটা সবসময়ে আমার ঘড়ির চেনে লাগানো থাকে। এই দেখুন এই কাগজগুলো। লর্ড মেররোর চিঠি, স্যার চার্লস হার্ডির রিপোর্ট, বেলগ্রেড থেকে সংক্ষিপ্ত বিবরণী, রাশিয়ান-জার্মান ফসলকর সংক্রান্ত টীকাটিপ্পনী, মাদ্রিদ-এর চিঠি, লর্ড ফ্লাওয়ার্সের চিরকুট গুড হেভেনস! এটা কী? লর্ড বেলিনগার! লর্ড বেলিনগার!
ওঁর হাত থেকে নীল লেফাফাটা ছিনিয়ে নিলেন প্রধানমন্ত্রী।
হ্যাঁ, এইটাই–চিঠিটাও আছে। হোপ, আমার অভিনন্দন নাও!
ধন্যবাদ! ওঃ, একী গুরুভার পাথর নেমে গেল আমার বুক থেকে। কিন্তু এ যে অকল্পনীয় অসম্ভব। মি. হোমস, আপনি ভেলকি জানেন, আপনি ঐন্দ্রজালিক। কী করে জানলেন আপনি যে চিঠি এখানেই রয়েছে?
কেননা, আমি জানতাম এ-চিঠি আর কোথাও নেই।
আমার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। ক্ষিপ্তের মতো দরজার কাছে ছুটে গেলেন সেক্রেটারি। আমার স্ত্রী কোথায়? ওকে বলে আসি, সব ঠিক হয়ে গেছে। হিলডা। হিলডা। সিঁড়ির ওপর থেকে ভেসে এল ওঁর কণ্ঠস্বর।
চকচকে চোখে মিট মিট করে হোমসের পানে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।
বললেন, এবার বলুন তো, মশায়। এ ব্যাপারে চোখের দেখার চেয়ে অদেখা জিনিসই আছে বেশি। চিঠিটা কী করে ফিরে এল বাক্সের মধ্যে?
আশ্চর্য ওই দুটি চোখের তীক্ষ্ণ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টির সামনে থেকে মুচকি হেসে সরে গেল হোমস। আমাদেরও তো কিছু কিছু কূটনৈতিক মন্ত্রগুপ্তি আছে। বলে, টুপিটা তুলে নিয়ে ও এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
———-
টীকা
কার্পেটের কারচুপি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সেকেন্ড স্টেন স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৯০৪ সংখ্যায় এবং কলিয়ার্স উইকলির ২৮ জানুয়ারি ১৯০৫ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গল্পটির পাণ্ডুলিপি হ্যাভারফোর্ড কলেজের সংগ্রহে রক্ষিত আছে।
লর্ড বেলিনগার : হোমস এবং ওয়াটসনের জীবদ্দশায় মাত্র তিনজন মানুষ দু-বার করে বা তার বেশি ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তারা হলেন বেঞ্জামিন ডিসরেইলি (১৮৬৮ এবং ১৮৭৪-১৮৮০), উইলিয়ম গ্ল্যাডস্টোন (১৮৬৮-১৮৭৪, ১৮৮০-১৮৮৫, ১৮৮৬ এবং ১৮৯২-১৮৯৪) এবং রবার্ট সলসবেরি (১৮৮৫-১৮৮৬, ১৮৮৬-১৮৯২ এবং ১৮৯৫-১৯০২)। ওয়াটসন বর্ণিত তপকৃশ চেহারা, উন্নত নাক, ইগল পাখির মতো চোখ প্রভৃতি বিবরণ থেকে বেশির ভাগ গবেষক লর্ড বেলিংগারকে মনে করেন রবার্ট সলসবেরির প্রতিরূপ।
ইনিই বটে : হোমস-গবেষকদের মতে ইনি হলেন কাইজার দ্বিতীয় উইললেম (১৮৫৯-১৯৪১) জার্মানির সম্রাট এবং ১৮৮৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রশিয়ার রাজা পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় উইলিয়ম নামেও।
মূল কারণটাই-বা কী : এই চিঠি নিয়ে কে যে কী করতে পারেন, তা শার্লক হোমস বুঝতে না-পেরে এহেন প্রশ্ন করবেন–এ-কথা ভাবাই যায় না।
ওবারস্টাইন, লা রোথিয়েরা : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যানস গল্পে এই দুটি চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রথমজনের ভূমিকা গল্পে বেশ উল্লেখযোগ্য।
ওরা থাকে ওয়েস্ট এস্তের এক প্রান্তে : ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যানস গল্পে ওবাস্টাইনের বাড়ি কেনসিংটনে এবং লা রোথিয়েরার বাসস্থান নটিংহিলে বলে জানা যায়।
স্থায়ী প্রকৃতির একটা বাতিকে আক্রান্ত : বাতিকটা যে স্থায়ী প্রকৃতির তা কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বেশ তাড়াতাড়ি জেনে ফেলেছেন।
অফিসে ওর কয়েকজন গুপ্তচর আছে : তাদের সন্ধান করার ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? মনে হয় ঘটনার সামঞ্জস্য রাখতে প্লটে জোড়াতালি লাগানোর জন্য হঠাৎ করে এই গুপ্তচরদের সৃষ্টি করলেন লেখক।
ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো পথ না-পেয়ে : ডেসপ্যাঁচ বক্সের নকল চাবি ছিল হিলডার কাছে। বাক্সটাও শোবার ঘরে রাখা ছিল। বিস্তর সময় পেয়েও তিনি রেখে দিতে পারলেন না চিঠিটা? এতই বোকা লেডি হিলডা?
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
Ridiyah Ridhi
Golpobuzz ২ বছর পুর্বেTARiN
Golpobuzz ২ বছর পুর্বেRidiyah Ridhi
Golpobuzz ২ বছর পুর্বে