বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
ছেলেটা আমার কাছাকাছি এসে তার নৌকাটা থামাল, লগিটা পুতে নৌকাটাকে বেঁধে আবার পানিতে ডুবে গেল। আমি যখন প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছি যে ছেলেটা আর ভেসে উঠবে না তখন সে আবার একটা মাছ ধরার খাঁচা নিয়ে ভুল করে ভেসে উঠল। ভেতরে অনেক মাছ কিলবিল করছে। ভালো করে দেখার জন্য আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ছেলেটা পিছন দিকটা খুলে হাত ঢুকিয়ে যখন মাছ বের করছে তখন আমি হঠাৎ করে দেখলাম ভিতরে একটা সাপ কিলবিল করছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “সাপ! সাপ!”
ছেলেটা একটুও ভয় পেল না, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর সাপটাকে খপ করে ধরে বের করে এনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা সাপ না! এটা বাইম মাছ।”
“মাছ? এইটা মাছ?” আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বললাম, “দেখতে একেবারে সাপের মতো।”
মাছটাকে ঝুড়ির ভেতর রাখতে রাখতে বলল, “সাপ আরো লম্বা হয়।”
ছেলেটা কিছু মাছ ঝুড়িতে রাখল, কিছু ছেড়ে দিল তারপর আবার পানিতে ডুবে গেল। এবারে আমি ভয় পেলাম না, আমি বুঝে গেছি এই ছেলে পানিতে অনেক সময় ডুবতে পারে। পানি থেকে বের হয়ে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে ছেলেটা আমার দিকে তাকালো, বলল, “তুমি কোথায় থাকো?”
আমি কোথায় থাকি বললে কী ছেলেটা সেটা চিনবে? তাই সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।”
ছেলেটা গামছাটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, “বলতে চাও না?” অনেক দূর মানে কত দূর? কোপেনহেগেন নাকি নিউইয়র্ক?”
আমি খাবি খেলাম। ছেলেটা আমাকে নিয়ে কী সহজে ঠাট্টা করল। দিল্লি নাকি দুবাই না বলে কোপেনহেগেন আর নিউইয়র্ক বলেছে। কোপেন হেগেনের নাম শুনেছি কিন্তু শহরটা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আমি এতদূর বলি নাই। মিরপুর। ঢাকা।”
“আমি মিরপুর গেছি। চিড়িয়াখানা আছে।”
“ও।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কোথায় থাক?”
ছেলেটা আমার মতো করে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।” তারপর হিহি করে হাসল, বলল, “একটু মজা করলাম। আমি কাছেই থাকি। মনে হয় চিনবা না। তিন বাঁক দূরে।”
“বাক? বাঁক মানে কী?”
“একটা নদী যখন একটু বেঁকে যায় সেইটাকে বলে বাক।”
“তার মানে একটা বাক এক কিলোমিটার হতে পারে আবার একশ কিলোমিটার হতে পারে।”
“পারে। তবে আমাদের নদী বাচ্চা নদী, এর বাঁক ছোট ছোট।”
বাহ! কী সুন্দর নদীটাকে বাচ্চা নদী বলল। কথা শুনেই বোঝা গেল নদীটাকে ছেলেটা আদর করে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি স্কুলে পড়।”
“পড়ি।” সে তার লগি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি?”
“আমিও পড়ি।” তারপর বললাম, “আমার অবশ্য লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না।”
“লেখাপড়া করতে কারো ভালো লাগে না।” ছেলেটা লগি দিয়ে নৌকাটাকে ধাক্কা দিতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
আমি বললাম, “সেভেন। তুমি?”
“এইট।”
আমি আরেকবার খাবি খেলাম। আমার থেকে এক ক্লাস বেশি। একটু আগে আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা বুঝি লেখাপড়াই করে না।
ছেলেটা বলল, “সেভেন এইটে আসল লেখাপড়া শুরু হয় না। আসল লেখাপড়া শুরু হয় নাইন থেকে।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“আমি নাইন টেনের বই দেখেছি। অনেক কিছু আছে। তবে মনে হয় ভুলভাল আছে।”
আমি আবার খাবি খেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ভুলভাল?”
“হ্যাঁ। নিউটনের সূত্রটা দেখছিলাম। লেখা হচ্ছে কোনো জিনিসের উপর বল প্রয়োগ করলে ত্বরণ হয়। এই নৌকাটারে লগি দিয়ে ঠেলা দিলে নৌকা নড়ে। ঠিক আছে। কিন্তু বড় একটা বজরাকে আমি কী লগি দিয়ে ঠেলে নড়াতে পারব? বল প্রয়োগ করলাম, ত্বরণ কই?”
ত্বরণ মানে কী আমি জানি না। তবে ছোট নৌকাকে লগি দিয়ে ঠেলা দিয়ে নাড়ানো যায়, বড় বজরাকে নাড়ানো যাবে না এর মাঝে কোনো ভুল নাই। নিউটন সাহেব যদি এইটাই বলে থাকেন তাহলে যে ভুল বলেছেন এর মাঝে কোনো সন্দেহ নাই। ছেলেটাতো ঠিকই বলছে। মনে হচ্ছে এই ছেলে নিজেও ছোটখাটো নিউটন।
আমি বললাম, “স্কুলের স্যারকে জিজ্ঞেস কর না কেন?”
“তুমি ভাবছ জিজ্ঞেস করি নাই?”
“স্যার কী বলেছে?”
“কিছু বলে নাই। কানের মাঝে একটা পাটকান দিয়েছে।”
পাটকান শব্দটা আগে শুনি নাই কিন্তু ছেলেটার কথার ধরন দেখে বুঝলাম চড় কিংবা ঘুষি জাতীয় কিছু হবে। আমি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর স্যারদের উপর বিতৃষ্ণা জানালাম।
ছেলেটা বলে, “তারপরও যখন জিজ্ঞেস করেছি তখন বাপ মা তুলে গালি দিয়ে বলল, তুই পড়িস ক্লাস এইটে নিউটনের সূত্র দিয়ে কী করবি? ধুয়ে পানি খাবি?”
আমি আবার জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করলাম। ছেলেটা যখন লগি দিয়ে আবার ঠেলা দিয়ে নৌকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হলো, বললাম, “তুমি একটা কাজ করতে পার। আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস” বলেই তাড়াতাড়ি শুদ্ধ করলাম, “মানে সায়েন্টিস্ট। তাকে জিজ্ঞেস করতে পার।”
“তোমার মামা কই?”
“আছে জঙ্গলের মাঝে?”
ছেলেটা অবাক হলো, ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “জঙ্গলে কী করে?”
“গবেষণা করে।”
“জঙ্গলে গবেষণা করে?”
“হ্যাঁ। মামার একটা মাইক্রোবাসের মাঝখানে একটা ল্যাবরেটরি আছে। সেই মাইক্রোবাসে মামা থাকে, ঘুমায়, গবেষণা করে। আমিও থাকি।”
ছেলেটা এইবার যথেষ্ট কৌতূহলী হলো। লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা নদীর তীরে লাগালো, তারপর লগিটা পুতে নৌকাটাকে আটকে নৌকা থেকে নেমে এলো। আমিও নদীর তীর থেকে নিচে নেমে এলাম, দুইজন কাছাকাছি দাঁড়ালাম। সে আমাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল আমিও তাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম।
ছেলেটা বলল, “তার মানে তুমি মনি কাঞ্চনে থাকো না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মনি কাঞ্চন? সেটা আবার কী?”
“এটা রিসোর্ট।”
“রিসোর্ট মানে কী?”
“বড় লোকের হোটেল। এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা!”
“ধুর! এতো টাকা ভাড়া হয় কেমন করে।”
ছেলেটা গম্ভীর মুখে বলল, “হয়। এর থেকে বেশিও হয়।”
জিজ্ঞেস করলাম, “মনি কাঞ্চনটা কোথায়?”
“যদি হেঁটে যাও, দুই-তিন কিলোমিটার। নৌকাতে গেলে এক বাঁক পার হয়ে একটা হাওড়, হাওড়ের পাড়ে মনি কাঞ্চন। খুব কাছে।”
“তুমি কখনো গিয়েছ?”
ছেলেটা হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “তুমি ভাবছ মনি কাঞ্চনে আমারে ঢুকতে দিবে? মনে হয় কাছে গেলেই আমারে গুলি করে দেবে।”
“গুলি করে দিবে?”
“মনে হয়। মনি কাঞ্চনের চারিদিকে দারোয়ানরা মেশিন গান নিয়ে ঘুরে।”
“মেশিন গান? ধুর।”
“বিশ্বাস কর না? তুমি একদিন গিয়ে দেখে আস।”
“আমি তো চিনি না।”
“ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। বেশি কাছে কিন্তু যাওয়া যাবে না। দূর থেকে দেখতে হবে।”
ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তাহলে তোমার মামা আমাকে নিউটনের সূত্র বোঝাতে পারবে? বকা দিবে না তো?”
“না। বকা দিবে না, কিন্তু অন্য ঝামেলা হতে পারে।”
ছেলেটা চিন্তিত মুখে বলল, “অন্য কী ঝামেলা?”
“তুমি জিজ্ঞেস করবে নিউটনের সূত্র। মামা নিউটন শেষ করে গ্যালেলিও, গ্যালেলিও শেষ করে আইনস্টাইন, আইনস্টাইন শেষ করে কাইনস্টাইন, কাইনস্টাইন শেষ করে টাইনস্টাইন সবার সূত্র বুঝিয়ে দেবে। তোমার বারোটা বেজে যাবে। সেইজন্য আমরা কখনো মামাকে সাইন্স নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি না।”
ছেলেটা হি হি করে হাসল, বলল, “কানের উপর পাটকান না দিলেই হলো।”
“না। সেইটা কখনো দিবে না।”
“ঠিক আছে, আজকে বিকাল বেলা আসব।”
“খুঁজে পাবে?”
“জঙ্গলের মাঝে কী আর দশটা মাইক্রোবাসের ল্যাবরেটরি থাকবে? আমি খুঁজে বের করে ফেলব।”
“ঠিক আছে তাহলে।” আমি চলে যেতে যেতে থেমে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এখন কী করবে?”
“আমার আরো দুইটা ঝাঁকা পানির তলা থেকে তুলতে হবে। তারপর বাড়ি যাব।” ছেলেটা হঠাৎ থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী করবে?”
“আমি একটু জায়গাটা ঘুরে দেখব।”
“তুমি সাঁতার জান?”
“জানি।”
“তাহলে তুমি আমার সাথে নৌকায় একটু ঘুরতে পার।”
“সত্যি?” আমি খুশি হয়ে বললাম, “নিবে আমাকে?”
“নিব না কেন? আস।”
আমি ছেলেটার সাথে নৌকায় উঠলাম। নৌকাটা একটু দুলে উঠল, মনে হলো পড়ে যাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়লাম না। ছেলেটা লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে নদীর মাঝে নিয়ে এসে বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে শুরু করল।
আমি বললাম, “আমাকে নৌকা চালানো শিখাবে?”
“এর মাঝে শিখানোর কিছু নাই। চেষ্টা করবে শিখবে।”
“একটু চেষ্টা করি?”
“কর।” বলে সে নৌকার পিছনে বৈঠাটা রেখে সামনে চলে এলো, আমি সাবধানে পিছনে গিয়ে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রথমে সেটা সামনে না গিয়ে ঘুরে যেতে লাগল। আমি বললাম, “কী হলো ঘুরে যায় কেন?”
ছেলেটা বলল, “আমি বলে দিতে পারি, কিন্তু তাতে লাভ হবে না। তোমার নিজের আবিষ্কার করতে হবে।”
কাজেই বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আমি নিজে আবিষ্কার করলাম কেমন করে নৌকা বাইতে হয়। যখন সত্যি সত্যি শিখে ফেললাম তখন এতো আনন্দ হলো সেটা আর কী বলব। তবে বৈঠা বাইতে যে এতো পরিশ্রম সেটা আমি জানতাম না। একটু খানি যেতেই মনে হলো জান বের হয়ে যাচ্ছে।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ...