বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ক্রুসেড সিরিজ (৭) ষষ্ঠ অংশ

"ইসলামিক" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান মফিজুল (০ পয়েন্ট)

X দূর্গ পতন সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী এবার আরও একটি বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিলেন। একদল দুঃসাহসী সৈন্যকে পুরো বাহিনী থেকে বেছে আলাদা করলেন তিনি। তাদের বললেন, মাদ মুজাহিদ আল্লাহর সৈনিকরা! শাহাদাতের পেয়ালা পান করার জন্য যারা উদগ্রীব আজ তাদের স্বপ্ন পূরণের দিন। আমি তোমাদের পাঠাতে চাই সেই সিংহ দরজায়, যে দরজা আটকে রেখেছে আল্লাহর সৈনিকদের অগ্রযাত্রা। আমি তোমাদের কেল্লার ফটকে আঘাত হানার জন্য নির্বাচন করেছি। সৈনিকদের মধ্যে প্রাণের নতুন প্রবাহ সৃষ্টি হলো। ফটক ভাঙার যন্ত্রপাতি নিয়ে ওরা ঝাপিয়ে পড়লো কেল্লার মূল ফটকে । এই জান কবুল বাহিনীর সৈন্যরা যখন ফটকের দিকে এগিয়ে গেল, ক্রুসেড বাহিনী পাঁচিলের ওপর থেকে তীরের স্রোত বইয়ে দিল। খৃষ্টানদের তীরের আঘাতে প্রাণ বায়ু উড়ে গেল কোন কোন জানবাজের। আহত হলো অনেকে, কিন্তু এইসব জানবাজদের গতি তাতে মোটেই শিথিল হলো না। যারা বেঁচে গেল এবং পারল, ছুটে পাঁচিলের সাথে গিয়ে মিশে গেল ওরা। সুলতান জঙ্গী দূর নিক্ষেপকারী তীরন্দাজ বাহিনী এবং সাধারণ তীরন্দাজ বাহিনীকে ফটকের দিকে কাতারবন্দী করে দাও। আল্লাহর সৈনিকেরা বন্ধুদের কাভার দাও। ফটকের দু’পাশে পাঁচিলের ওপর এমনভাবে তীর বর্ষণ করো, খৃস্টানদের চোখগুলো যেন তীরের বদলে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পায় ।” আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই সৈনিকরা লাগাতার তীর বর্ষণ শুরু করে দিল। দু’পক্ষের সীমাহীন তীর নিক্ষেপের ফলে দেয়ালের গোড়ায় কি হচ্ছে চোখে পড়ছিল না কোন পক্ষের। জানবাজ বাহিনীর আরেকটি দল ফটকের দিকে দৌড়ে গেল। ” জঙ্গী তীরের বর্ষণ আরও তীব্রতর করে তুললেন। পাঁচিলের ওপর থেকে খৃস্টান সেনাদের কানফাটা চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। দূর পাল্লার তীরগুলো যথাসময়ে মোক্ষম আঘাত হেনেছে। অসংখ্য খৃস্টান সৈন্য লুটিয়ে পড়েছে পাঁচিলের ওপর । একটু পরেই খৃস্টানদের দিক থেকে তীর আসা কমে গেল। সিড়ি বেয়ে অনেকেই নেমে গেল ওপাশে। খৃস্টান সেনাপতি ওদের বললেন, জলদি ড্রাম তোল পাঁচিলে। সৈন্যরা কাঠের বোঝা এবং ড্রাম নিয়ে উঠে এল উপরে। ড্রামে ভিজিয়ে যেই ওরা কাঠে আগুন দিল, জ্বলন্ত কাঠের ফাঁক দিয়ে ড্রাম বহনকারী সৈন্যদের মাথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল মুজাহিদদের কাছে সাথে সাথে সেই মাথাগুলোকে তীরের নিশানা বানাল মুজাহিদরা। দু’একটা ড্রাম বাদে বাকি ড্রামগুলো দেয়ালের ওপারেই গড়িয়ে পড়লো আবার। যে দু’একটা আগুনের শিখা ওরা । এপাশে ছুড়ে মেরেছিল, দেখা গেল সে শিখার ওপর নিক্ষেপকারী নিজেও হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সুলতান জঙ্গীর এক সহকারী সালার এতক্ষণ জঙ্গীর আক্রমণের পদ্ধতি দেখছিলেন। তিনি বললেন, ‘সুলতান, আপনি এখানে আক্রমণ অব্যাহত রাখুন, আমি পেছনের ফটকের আক্রমণের অবস্থা দেখে আসি। জঙ্গীর অনুমতি নিয়ে তিনি প্রাণপণে ছুটে গেলেন কেল্লার পিছনের ফটকে। ওখানকার কমাণ্ডারকে সামনের ফটকে সুলতান কিভাবে আক্রমণ পরিচালনা করছে বললেন তিনি। সহকারী সালারের নির্দেশে ওখানকার কমাণ্ডার জঙ্গীর । পদ্ধতিতে পিছনের ফটকে তুমুল আক্রমণ শুরু করে দিল । ওখানে দূর পাল্লার তীরন্দাজ না থাকায় প্রথম দিকে মুজাহিদদের বেশ বেগ পেতে হলো। আক্রমণ তীব্রতর করলে তা জানের ক্ষতি স্বীকার করেই করতে হতো। কিন্তু মুজাহিদরা এ সবের কোন পরোয়া করল না। যতই ক্ষতি হোক, আঘাত ওরা তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলল । তীরন্দাজদের সহায়তা নিয়ে একদল জানবাজ দ্রুত ছুটে গেল ফটক ভাঙতে। প্রধান ফটকে ড্রাম নিয়ে ক্রুসেডারদের উপরে উঠে । আসার আর সুযোগ দিচ্ছিল না মুসলিম তীরন্দাজরা। সুলতান । জঙ্গী এবার মেনজানিক দিয়ে দুর্গের ভেতরে আগুন ও পাথর নিক্ষেপ করার হুকুম দিলেন। সুলতান জঙ্গীর সৈন্যরা কেল্লার উভয় ফটকে বীরত্বের সাথে আক্রমণ করছে দেখে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেও জেহাদী জযবার বান ডাকল । সুলতান তাদেরকে দুটি দলে ভাগ করে দিলেন। এক দল কেল্লার সামনে চলে গেল আরেক দল চলে গেল কেল্লার পিছন দিকে। তারা দুদিকে ছড়িয়ে পড়ে দেয়ালের ওপর এমন তীব্র তীর বর্ষণ শুরু করলো যে, পাঁচিলের ওপর থেকে খৃস্টান সৈন্যরা আবার লাফিয়ে নিচে নেমে গেল। পাঁচিলের ওপর এখন আর কোন ফটক ভাঙার কাজে নিয়োজিত মুজাহিদরা প্রাণপণ শক্তিতে আঘাত হানল ফটকের ওপর। মুজাহিদদের তীব্র আঘাত সইতে না পেরে এক সময় খৃস্টানদের দুর্ভেদ্য দুর্গের ফটক ভেঙে একদিকে হেলে পড়ল। সুলতান জঙ্গীর সৈন্যরা ঢুকে পড়ল কেল্লার ভিতর। এরপর শহরের মধ্যে শুরু হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শহরের খৃস্টান বাসিন্দারা পালানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করল । এই হুড়োহুড়ি ও হই-হাঙ্গামার মধ্যে খৃষ্টান শাসক ও সেনা কমাণ্ডাররা দুর্গের বাইরে পালিয়ে গেল । দিনভর শহরময় এই হাঙ্গামা ও হাতাহাতি লড়াই অব্যাহত রইল। সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে ক্রুসেড সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিয়ে অস্ত্রসমর্পণ করলো। দুর্গে প্রবেশ করে সুলতান জঙ্গী প্রথমেই বেগার ক্যাম্পের বন্দী মুসলমানদের মুক্ত করে দিলেন। পরে লড়াই শেষে সন্ধ্যায় যখন সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলো, সারা শহরে একজন ক্রুসেড নেতা ও কমাণ্ডারকেও খুঁজে পেলেন না। ক্রাক দুর্গের এই রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে ১১৭৩ সালের শেষ দিকে। মুসলমানরা এ সময় বায়তুল মুকাদাসের খুব কাছাকাছি পৌছে যায়। পরাজিত ক্রুসেড জেনারেলরা আবার একত্রিত হলো। পরাজয়ের পর এটাই তাদের প্রথম বৈঠক। যে কোন পরাজয় বা বিজয় লাভের পর এ ধরনের বৈঠকে বসাটা খৃস্টানদের একটা ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের বৈঠকে পরম্পর মত বিনিময় ছাড়াও অবধারিতভাবে থাকে মদ ও মেয়ে। মত বিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে তারা শরাব পান করে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এ বৈঠক। যদি বৈঠক হয় আনন্দের, তবে নারী ছাড়া সে আনন্দের উচ্ছাস পরিপূর্ণ হয় না তাদের। আর যদি বিষাদ ও বেদনায় ভরা মন নিয়ে বৈঠকে বসে ওরা, মদ আর নারী হয় সে বিষাদ বেদনা থেকে মুক্তির হাতিয়ার। এ দুই জিনিস ছাড়া তাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের কথা চিন্তাই করা যায় না। আগে এ ধরনের বৈঠকে বসলে কোন জেনারেল হয়তো বলত, ‘আমাদের মেয়ে গোয়েন্দাদের খবর কি?। মুসলিম এলাকায় ওদের দিয়েই ধ্বংসাত্মক কাজ বাড়াতে হবে। তারা মুসলিম শাসকদের বশীভূত করে আমাদের অনুগত বানাবে আর সে এলাকার মুসলমান মেয়েদেরকে পথে বের করে মুসলমানদেরকে নৈতিকভাবে দেউলিয়া বানিয়ে দেবে।’ ‘এ জন্যই তো সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলে, ক্রুসেডাররা নারীর ইজ্জত নিয়ে ব্যবসা করে আর মুসলিমরা নারীদের রক্ষকের ভুমিকা পালন করে,’ বলত অন্য জেনারেল। জেনারেলরা এসব কথায় খুব হাসতো। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো সুলতান আইয়ুবীকে ঠাট্টা করে বলতো, “এ লোক মহা গোয়ার গোবিন্দ ঠিক, কিন্তু মোটা বুদ্ধির অধিকারী নইলে আমাদের চাল ঠিকই ধরে ফেলতো। আরে আহাম্মক। খৃস্টান যুবকরা ক্রুসেড বাহিনীতে যোগ দিয়ে তোদের অকেজো করার জন্যই তো শরীরের শক্তি ব্যয় করে। কিন্তু তোরা জানিস না, আমাদের মেয়েরা যুবকদের চাইতে আরো সফল যোদ্ধা। যুবকরা শরীরের শক্তি দিয়ে যা পারে না মেয়েরা শরীরের সৌন্দর্য্য দিয়ে অনায়াসেই তা জয় করতে পারে!’ আইয়ুবী এর মোকাবেলা করবে কি, ও তো এখনো জানেই না কত অসংখ্য ছোট বড় কর্মকর্তা, দুর্গাধিপতি ও সেনাপতিকে আমরা সুন্দরী নারী এবং সোনার তোড়া দিয়ে বশীভূত করে রেখেছি। যাদের নিয়ে তিনি এত বড়াই করেন, তাদের অধঃপতনের খবর যদি তিনি জানতেন। জঙ্গী ও আইয়ুবীর ঘরেই আমরা খৃস্টানদের মানস সন্তান তৈরি করবো। এ থেকে তারা ইসলামকে কেমন করে রক্ষা করবে? কিন্তু আজকের বৈঠকে এ সবের কিছুই আলোচনা হলো না। এ বৈঠক হচ্ছিল বায়তুল মুকাদাসের পবিত্র প্রাঙ্গণে । সময়টা ১১৭৩ সালের শেষ দিক। খৃষ্টান জাতির নেতৃস্থানীয় লোকেরা সমবেত হয়েছিল এ বৈঠকে । তাদের মনের ভেতর বিষাদের ভার। সকলেই কেমন গম্ভীর, চিন্তান্বিত। তারা কেউ সুলতান আইয়ুবীকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করলো না। কারো মুখে ভুলেও কোন হাসির ভাব ফুটে উঠল না। এমনকি শরাব ও নারীদের কথাও ভুলে গেল তারা। তাদের এ দুশ্চিন্তার কারণ ছিল ক্রাকের বিপর্যয়। লজ্জার মাথা খেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে বড় বড় খৃস্টান জেনারেলরা। এদের মধ্যে ছিল দুর্গাধিপতি রোনাল্ডোও । তিনি একজন ভাল যোদ্ধা, রণকুশলী ও পারদশী সেনাপতি হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর সাথে তার সৈন্যদের বহুবার যুদ্ধ হয়েছে। এ বৈঠকে আরো ছিলেন সম্রাট রিমাণ্ড। ক্রাক রণাঙ্গণে সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীকে পিছন থেকে আক্রমণ করে নিঃশেষ করার সংকল্প ছিল তার । সে চেষ্টা তিনি করেও ছিলেন। কিন্তু আইয়ুবীর কৌশল ও দুরদর্শিতার কাছে হেরে গিয়ে সংকীর্ণ পাহাড় কুচিতে আটকে পড়েছিলেন তিনি। আইয়ুবীকে নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প ও স্বপ্ন-সাধ হারিয়ে উল্টো নিজেই অবরোধের মধ্যে আটকা পড়ে অসহায় হয়ে গেলেন। রসদপত্র সব ছিনিয়ে নিল আইয়ুবীর দল। চরম খাদ্য সংকটে পড়ে সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত ও নাজেহাল । যুদ্ধের ঘোড়া আর উটগুলো মেরে মেরে খেতে হলো বাঁচার তাগিদে। শেষে অর্ধেক সৈন্য হারিয়ে তিনি কোন রকমে পালিয়ে এসেছেন। . দুর্গের অধিপতি রোনাল্ডো কপালগুণে বেঁচে গেছেন। আইয়ুবীর ফৌজ দুর্গে ঢুকলে শিরস্ত্রাণ, বৰ্ম, পোশাক সব খুলে ফেলে সাধারণ লোকের বেশে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। সেনাপতির সেই সাজপোষাক পাল্টাতে না পারলে আজকের এই সম্মেলনে জীবিত শামিল হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এ বৈঠকে ক্রুসেডদের সেই রণবীর যোদ্ধা সেনাপতিরাও অংশগ্রহণ করেছিল, যাদেরকে তাদের বীরত্বের জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এই সম্মানজনক উপাধি, সম্রাটদের পক্ষ থেকে দেয়া লৌহ বর্ম, সামরিক ব্যাজ ও পোষাক সব কিছুই যেন আজ তাদের উপহাস করছে। এ সম্মেলনে আরো এসেছিলেন ক্রুশের মহান রক্ষক ক্রাক শহরের সম্মানিত পুরোহিত। ছিলেন আবারলফ ও তার ভাই ইমারলফ । প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন মুসলমানদের চিরশত্রু ফিলিপ অগাষ্টাস । সম্মেলনে উপস্থিত এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা গভীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীর অবিসংবাদিত নেতা, গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান হরমন ও তার সংগীদের দিকে। পরিস্থিতির নতুন , কোন অবনতি বা অগ্রগতির খবর থাকলে তা তাদের কাছেই পাওয়া যাবে। সম্মেলন হলে এসে বসেছে সবাই, কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। জমাটবাঁধা নীরবতা অসহনীয় হয়ে উঠলে শেষে প্রথমে মুখ খুললো ফিলিপ অগাস্টাস, সঙ্গে সঙ্গে মাহফিলে যেন প্রাণ ফিরে এলো। তিনি ক্রুশের মহান রক্ষক সম্মানিত পুরোহিতকে সভাপতি হিসাবে সভা শুরু করার অনুরোধ করলেন। সম্মানিত পুরোহিত সভার শুরুতেই বললেন, “আমি ঐসব লোকের সভায় সভাপতিত্ব করতে লজ্জাবোধ করছি, পবিত্র ক্রুশ ছুয়ে শপথ করার পর যারা তাদের সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে। আমি তাদেরকে ধিক্কার জানাচ্ছি, যারা পবিত্র এবং এতবড় ব্যর্থতার পরও সুস্থ শরীরে এই মহান দরবার কক্ষে এসে আসন গ্রহণ করেছে। । আজ আমি যীশুর সামনে খুবই লজ্জিত। আমি যতবার ক্রুশের দিকে তাকাই ততবার আমার দৃষ্টি নিচু হয়ে যায়। তোমরা সবাই কি ক্রুশের ওপর হাত রেখে এই হলফনামা পাঠ করোনি, তোমরা ক্রুশের শক্ৰদের দুনিয়ার বুক থেকে শেষ করে দেবে? যদি এর জন্য প্রাণ দিতে হয় তবুও কেউ পিছপা হবে না? তোমরা কি আরও হলফ করোনি, ইসলামের নাম নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য নিজের জান, মাল অকাতরে কোরবান করবে? প্রয়োজন হলে কোরবান করবে পরিবার পরিজন, সন্তান সন্ততি এবং দেহের শেষ রক্তবিন্দু? এখানে আমার সামনে যারা বসে আছো, তাদের মধ্যে এমন-কে আছো যার শরীরে সামান্যতম জখমের দাগ আছে? বলো, কে আঁছো?” কেউ উঠে দাঁড়াল না, কেউ হাতও তুলল না। সাহস কারো নেই। তোমাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যার গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। এই তোমরা কি সেই তোমরা নও, যারা মুসলমানদের হাতে সুবাক ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলে! সেই তোমরাই এখন আবার ক্রাক শহর মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়ে ছুটে এসেছে এখানে । আমি জয় পরাজয়ের বাস্তবতাকে অস্বীকার করি না। ময়দানে যুদ্ধ করতে গিয়ে দু’একবার পরাজয় বরণ করতে হতেই পারে। দুটি সফলতার পর একটি পরাজয় কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু একের পর এক সর্বক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। আমার এখন মনে হচ্ছে, খৃষ্টানরা ইউরোপে বন্দী হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, সে সময় খুব দূরে নয়, যখন ইউরোপের গীর্জায় গীর্জায় আজানের ধ্বনি মুখরিত হবে।’ ‘এমনটি কখনও হবে না সম্মানিত পিতা , ফিলিপ অগাস্টাস বললেন, “হে মহান ক্রুশের রক্ষক! এমনটি কখনও হবে না। পরাজয়ের কিছু কারণ ছিল। এ বিষয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করেছি, এখন আপনার উপস্থিতিতে আরও চিন্তা-ভাবনা করব এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ নেবো ।” সম্মানিত পিতা আবার বললেন, “যদি এর পরও তোমরা গভীর চিন্তা না করো এবং কঠিন পদক্ষেপ না নাও তবে এই বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হবে। তোমরা কি জানাে না, সুলতান সালাহউদ্দিন বায়তুল মুকাদাস অধিকার করার কসম খেয়ে ময়দানে নেমেছে? তোমরা কি জানো না, মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস, যার জন্য তিনি তার শিশুদেরও কুরবানী দিতে এক পায়ে খাড়া?” “আমরা মুসলমানদের মধ্যে গাদারীর বীজ বপণ করে রেখেছি।” ফিলিপ আগাস্টাস বললেন, “আমরা মুসলমানদের মধ্যে এত গাদ্দার সৃষ্টি করে রেখেছি যে, তারাই গাজী রাস্তায় আটকে সেখানে পুতে রাখবে।” “তবে সে মুসলমান করা যারা তোমাদের হাত থেকে এত মজবুত ও শক্ত দুর্গ ছিনিয়ে নিয়ে গেলো?” তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে স্পষ্ট কষ্ঠে বললেন, “এই সত্য কখনও ভুলে যেয়াে না, মুসলমানরা স্বাধীনচেতা জাতি। মুসলমান যখন গাদারী করতে প্ৰস্তুত হয় তখন তারা আপন ভাইয়ের গলায় ছুরি চালায়। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবােধ ও ঈমানী জযবা জেগে উঠে তখন তারা নিজের জীবন দিয়ে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে । মুসলমান যদি গাদ্দারও হয় তবু তাদেরকে বিশ্বাস করবে না। বেশি দূরে যেতে হবে না; শুধু গত দশ বছরের ঘটনার উপরেই দৃষ্টি রাখো। ইসলামের গাদাররা তোমাদেরকে কতটুকু স্থান দখল করিয়ে দিয়েছে? মিশরে পা রাখার মত কি তোমাদের সাহস আছে? আজ যদি মুসলমানরা ফিলিস্তিনের ওপর বসতে পারে, কাল তোমাদের বুকের ওপর গিয়ে বসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্মরণ রেখো, হে আমার বন্ধুগণ! যদি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গী তোমাদের থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ছিনিয়ে নিতে পারে, তবে তারা তোমাদের কাছ থেকে ইউরোপও ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন। এখানে শুধু ইউরোপ ও ফিলিস্তিন নয়। জমিনের কোন অংশের নয়; আসল সমস্যা ক্রুসেড ও ইসলামের! এই দুটি ধর্মের মতাদর্শের মধ্যেই এই যুদ্ধ। এই দু’য়ের মধ্যে একটি শেষ হতে হবে! তোমরা কি ক্রুসেডদের নিঃশেষ হয়ে যেতে বলে?” ‘না’! ‘পবিত্র পিতা, না!! এমন কখনও হবে না। আমরা আপনাকে এত বেশি নিরাশ হতে দেবো না।” তাহলে সেই কারণ খুঁজে বের করো, যা তোমাদের পিছু হটার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তোমাদের যুদ্ধ সম্পর্কে কোন পরামর্শ দিতে পারবো না। আমি গীর্জার সেবক । আমার গীর্জার কুমারীদের কসম! দশটা কট্টর মুসলমান সামনে নিয়ে এসো, তাদেরকে ক্রুশের পূজারী বানিয়ে দেবাে। আমি বুঝতে পারি না, তোমাদের মধ্যে আছে বড় বড় বীর, নাইট, সামরিক জেনারেল, তােমরা কি চমৎকার ব্যাজ ও সামরিক পোষাক পরো, অথচ অল্প সংখ্যক সাধারণ মুসলমান সেনাদের সাথে কেন মোকাবেলা করতে পারো না? তোমাদের পাঁচশো অশ্বারোহী সৈন্যকে মাত্র একশো পদাতিক মুসলিম সেনা কি করে পরাজিত করে? তারা তা পারে শুধু এই কারণে, মুসলমানরা ধর্মের উন্মাদনা নিয়ে যুদ্ধ করে। যখন তারা তোমাদের সামনে আসে, তখন কসম খেয়ে আসে। হয় সফলতা নয় মৃত্যু, এর বাইরে আর কোন পথের খবর জানা নেই তাদের। আমি শুনেছি, তাদের ছোট ছোট কমাণ্ডো বাহিনী যখন তোমাদের পিছনে আঘাত হানে তখন তোমাদের তীরের আঘাতে তারা জর্জরিত হয়ে যায়, কিন্তু তারা প্রাণের মায়া না করে এমন বিদ্যুৎগতিতে তোমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তোমাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়ে সরে যায়, যা তোমাদের চোখে তাক লাগিয়ে দেয় । একবার চিন্তা কর, মাত্র দশ বারো জনের ছোট্ট একটি দল কেমন করে তোমাদের হাজার সৈন্যের বুহ্য ভেদ করে বেরিয়ে যায়? কোন সাহসে তারা ঢুকে? এটা আর কিছু নয়, শুধুই ধৰ্মীয় উন্মাদনা। তারা মনে করে, আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, আল্লাহর রাসূলের রূহানী শক্তিও সঙ্গে আছে তাদের। এই বীরত্ব প্রদর্শন করে তারা আল্লাহর হুকুমে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কুরআন পাঠ করেছি, করেছে। আর এই জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ করে দিয়েছে কোরআন। এমন কি অন্যান্য ফরজ ইবাদত, যেমন নামাজ, রোজা ও হজ্বের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় জিহাদকে। যতক্ষণ তোমরা তোমাদের মধ্যে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করতে না পারবে ততোক্ষণ তোমরা ইসলামের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।” পবিত্র পিতার আবেগময় সত্য ভাষণে পরাজিত সেনাপতি, রাজন্যবর্গ ও সেনা কমাণ্ডারদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হলো। তিনি এই বলে বিদায় নিলেন, “এখন তোমরা নিজেদের মধ্যে তােমাদের পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলোচনা করো এবং কি করে এই পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করা যায় তা ঠিক করো। বায়তুল মুকাদাসকে জীবন মরণের সমস্যা বানিয়ে নাও। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কোন ফেরেশতা । নয়, সে তোমাদের মতই একজন মানুষ। তার শক্তির উৎস তার ঈমানে বলিষ্ঠতা। তোমরাও তোমাদের কাজে সেই বলিষ্ঠতার প্রকাশ দেখাও।” পাদরী তার কথা শেষ করলেন এবং আপন কর্তব্য নির্ধারণের জন্য তাদেরকে বৈঠকে রেখে তিনি বিদায় নিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর অগাস্টাসের সভাপতিত্বে বৈঠক পূনরায় শুরু হলো এবং আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গৃহীত হলো। এ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এখন থেকে সালাহউদ্দিনের যে কোন হামলার বলিষ্ঠ জওয়াব দেয়া হবে, তবে নিজে থেকে আক্রমণ করা হবে না। আইয়ুবী ও জঙ্গর অগ্রযাত্রায় বাঁধা না দিয়ে তাদের এতটা পথ অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিতে হবে, যেন তারা নিজের সীমানা থেকে অনেক দূর সরে আসে। তাদের দু’জনকে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। এতে তাদের খাদ্যশস্য ও রসদ পৌছানোর পথ দীর্ঘ ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, গ্ৰীস ও ফ্রান্সের বাহিনীকে অতিসত্তর প্রস্তুত করে তাদেরকে সমুদ্র পথে মিশর আক্রমণে পাঠানো হবে। তারা সমুদ্র তীরে সৈন্য অবতরণ করে মিশরের উত্তর-পূর্ব দিকে অভিযান চালাবে। উত্তর-পূর্ব দিকের বিরাণ এলাকাগুলো দখল করে সেখানে তারা সুদৃঢ় ক্যাম্প স্থাপন করবে। ওখান থেকেই মিশরের মূল ভূখণ্ডে প্রকাশ্যে জোরদার আক্রমণ করা সম্ভব হবে। বৈঠকে গোয়েন্দা প্রধান হরমন জানালেন, অধিকৃত অঞ্চলে মুসলমানদের জীবন অতিষ্ট করে তোলা হয়েছে। তারা নিরূপায় হয়ে দলবল বেঁধে হিজরত করছে। এই সব কাফেলা পথের মাঝে লুট হয়ে যাচ্ছে। তাদের সহায় সম্প্রদ ও পশুপাল কেড়ে নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানালেন কাফেলা থেকে মুসলিম মেয়েদের কিডন্যাপ করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এভাবে মুসলমানদের বংশ ধ্বংস করার প্রচেষ্টাও চালু রাখা হয়েছে। বিশেষ করে ছোট ও কিশোরীদের ছিনতাই করে তাদের পূর্ব পরিচয় ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে বেহায়া ও নির্লজ্জতার প্রশিক্ষণ দিয়ে যখন তারা যুবতী হয়ে উঠে তখন জন্য, তাদের চরিত্র ও ঈমান নষ্ট করার জন্য। হরমন এরপর উপস্থিত সবাইকে একটি দুঃসংবাদ দিলেন। বললেন, “সীমান্ত এলাকায় পীর সেজে জনগণকে বিভ্ৰান্ত করার যে জাল বিস্তার করেছিল রবার্ট, সে মিশন ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। যে সব মুসলমানকে সে প্রভাবিত তারাই রবার্টসহ মিশনের অন্যান্য সকলকে হত্যা করেছে।” । উপস্থিত রাজন্যবর্গ বললেন, “কিন্তু সীমান্ত এলাকাসহ সমগ্র মিশরে খৃষ্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার ও ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজ যে কোন মূল্যে চালু রাখা এবং জোরদার করা জরুরী।” হরমন বললেন, ‘আমি আপনাদের সাথে একমত। কিন্তু সমগ্র মিশরে খৃষ্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজ চালাতে অঢেল অর্থ সম্পদের প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে সেখানে অর্থ পাঠানো নিয়ে। রবার্টের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর সালাহউদ্দিন সীমান্তে পাহারা জোরদার করেছে। সীমান্ত পথে এখন অর্থ পাঠানো খুবই বিপদজনক। সাধারনতঃ আমরা অর্থ সম্পদ উটের কাফেলার সাথে পাঠাতাম । প্রহরীদের হাতে ধরা পড়েছে। তারা সমুদয় অর্থ সম্পদ আটক করে, এমনকি উটগুলোও নিয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে মিশরে এখন কাজ চালানোই সমস্যা হয়ে যাবে।” অগাস্টাস বললেন, “এ জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা গ্ৰহণ করবো। প্রয়োজনে মিশর থেকেই তাদের সব ধরনের সাহায্য দেয়া যাবে। দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয়ে আমি চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। মিশরের মাটির নীচে এত অজস্র ধন সম্পদ, মনিমানিক্য, রত্ন ও স্বর্ণ লুকানাে আছে, যা দিয়ে সমস্ত বিশ্ব খরিদ করা যায়।” “কিন্তু সে সব সম্পদ আহরণ করা তো আকাশের তারকা । ছিড়ে আনার মত ব্যাপার!’৷ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন হরমন । “হ্যাঁ, এসব সম্পদ আহরণ করা যথেষ্ট কঠিন হবে ঠিক, কিন্তু আমরা জানি, ফেরাউনের লাশের সঙ্গে এসব সম্পদ পিরামিডে সুরক্ষিত আছে। ইতিহাসে ফিরাউনের বিধান ও নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। কোন ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাঁর সাথে তার সমুদয় ব্যক্তিগত সম্পদ ও ব্যবহার্য দ্রব্য সবই তার সঙ্গে কবরে রেখে দেয়া হত। মৃত ফেরাউনের কবর কয়েক গজের বেশি চওড়া ছিল না, কিন্তু তার জন্য মাটির নীচে একটি মহল তৈরী থাকতো। এবং স্থানটি এমনভাবে বাছাই করতেন, যেন তার মৃত্যুর পর কেউ সেখানে পৌঁছতে না পারে। মৃত্যুর পর তার লাশ এমন গোপনীয়তার সাথে সে কবরে রাখা হতো। যার খবর সেই কবর খোদক ছাড়া আর কেউ জানতো না। লাশ মমি করে দাফন করা শেষ হলে সেই কবর খোদককে হত্যা করা হতো। ফেরাউনরা নিজেকেই খোদা বলে বিশ্বাস করতো এবং মনে করতো মরার পরও তার শান শওকত অবিকল তাই থাকবে। সুতরাং পাহাড় কেটে সেই পাহাড়ের তলদেশে কামরা। আর সে কামরাগুলো ভরে তোলা হতো হীরা জহরত দিয়ে। এমনকি ঘোড়াসহ অশ্ব চালিত গাড়ী এবং মাল্লাসহ কিস্তি রাখা থাকতো তাতে । তাঁর খেদমতের জন্য সেখানে দাস দাসী এবং বিবিও রাখা হতো। এমনি করে একটি লাশের সাথে অপরিমেয় ধন সম্পদও দাফন হয়ে যেতো। দাফনের পর এমনভাবে কবরের মুখ ঢেকে দেয়া হতো যাতে কবরের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া না যায়। ফেরাউনের লাশকে মশলা ও আরক মিশিয়ে জমাটবদ্ধ করা হতো। একে বলা হয় মমি। হাজার হাজার বছর ধরে এ মমি অবিকল আগের মতই আছে। যার কিছু নমুনা লণ্ডনের যাদুঘরেও সংরক্ষিত আছে। ফেরাউনের যুগ শেষ হওয়ার পর মিশরে যে লোকই শাসন কর্তৃত্বে এসেছে সেই ফেরাউনের লাশ অনুসন্ধান তার একটি রিপোর্ট আছে আমার কাছে। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করছি আমি। মিশর তার ইতিহাসে বহু রাজা-বাদশাহ দেখেছে। প্রত্যেক বাদশাহই ফেরাউনের কবর অনুসন্ধান করেছে। যে যা পেয়েছে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি পেয়েছে ইংরেজ সরকার। কারণ ইংরেজরা বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের প্রভাব কাজে লাগিয়েছে সবচে বেশি। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ইংরেজরা যে পরিমাণ কবর আবিস্কার করতে পেরেছে। অন্য কেউ তা পারেনি। তবুও লোকে বলে, মিশরের মাটি এখনো ফেরাউনের সম্পদে পরিপূর্ণ। ব্যক্তিগত পর্যায়েও কেউ কেউ ফেরাউনের লাশ অনুসন্ধানে বের হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে কবরও খুঁজে পায়। কিন্তু কবরে নামার পর ওরা কোথায় গায়েব হয়ে গেছে সে হদিস আর পাওয়া যায়নি । অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। একবার একদল লোক একটা কবর খুঁজে পেয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। একটু পর তারা ভুড়মুড় করে ছুটে বেরিয়ে আসে। লোকগুলোর চোখ ভয়ে বিস্ফারিত ছিল। কি দেখে তারা ভয় পেয়েছে জানার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। লোকগুলো বোবা হয়ে গিয়েছিল, কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। এ জন্য অনেকে বিশ্বাস করে, ফেরাউন খোদা নয় বটে। কিন্তু মরার পরেও তার এমন শক্তি রয়েছে, যে জন্য তার লাশের কাছে সাধারণ মানুষ যেতে পারে না। লোকেরা আরো রাজত্বের অবসান ঘটে। ফলে অনেকেই ফেরাউনদের অশুভ শক্তি মনে করে । সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন মিশরের ক্ষমতায়। সে জানি মিশরের মাটির নীচে এখনো ধনরত্বের বিশাল খনি আছে । শুধু আমি নই, সকল খৃস্টান শাসকরাই এ খবর রাখে। এ জন্য সকলেই মিশরের সে খনির দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করা সহজ নয়। এ জন্য সবাই চিন্তা করছে, মিশরবাসীদের দিয়েই সে গুপ্তধন অনুসন্ধান করার। আমি আরো খবর পেয়েছি, মিশর সরকারের পুরাতন কাগজপত্রে এমন সব লেখা ও নকশা আছে যার মধ্যে ফেরাউনদের কবর সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে। এই কাগজগুলো উদ্ধার করতে পারলে গুপ্তধনের ভাণ্ডার আবিষ্কার করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। আমরা মিশরে বিচক্ষণ গোয়েন্দা পাঠিয়েছিলাম। শুধু এটুকু জানার জন্য যে, এ কাগজপত্রগুলো কোথায় আছে এবং কেমন করে তা উদ্ধার করা যায়। কিন্তু যার তত্ত্বাবধানে এগুলো আছে তাকে এখনো বাগে আনা যায়নি।” গোয়েন্দা প্রধান হরমন বললেন, “যখন সুলতান আইয়ুবী সুবাক ও ক্রাকের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন তখন আমিও একবার চেষ্টা করেছিলাম। মিশরে তখন আমাদের গোয়েন্দারা ভালই সুবিধা করে নিয়েছিল। এ ব্যাপারেও তারা কিছুটা সফলতা লাভ করেছিল। সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীর উর্ধতন অফিসার আহমদ দরবেশকে তারা মুঠোর মধ্যে নিতে পেরেছিল। আহমদ দরবেশ সুদানী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কখনো গাদ্দারীর কোন অভিযোগ উঠেনি। তিনি সুলতান আইয়ুবীর খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন এবং সুলতান আইয়ুবীর অধীনে যুদ্ধ করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। আমি যে রিপাের্ট পেয়েছি তাতে জানা যায়, মেরিনা নামে এক খৃস্টান মেয়ের ফাঁদে পড়ে আহমদ দরবেশ। এই মেয়ে তাকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তাকে মিশর ও সুদানের মাঝে একটি অঞ্চলের স্বাধীন সুলতান বানানোর লোভ দেখায় মেরিনা। ইতিমধ্যে নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক দখল করায় এবং সুলতান । আইয়ুবী মিশরে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল অভিযান শুরু করায় তিনি এখন চুপ মেরে আছেন। অবশ্য এর মধ্যে মেরিনার সাথে তার কয়েক দফা মিলন ঘটেছে। এমন গোপনীয়তার সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন, কেউ এখনো জানতে পারেনি, তিনি আমাদের সাথে গোপন আতাত করেছেন। আহমদ দরবেশ এতই প্রভাব বিস্তারকারী অফিসার যে, পুরাতন নথিপত্রের ফাইল পর্যন্ত পৌছতে পারেন তিনি। সেখান থেকে তিনি যেসব কাগজপত্র চুরি করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তাতে দেখা যায় কিছু কাগজের ওপর উদ্ভট ধরনের রেখা ও নকশা আঁকা। এগুলো আসলে কোন কাগজ নয়, কাপড় ও চামড়ার মাঝামাঝি জাতীয় জিনিস। কাগজ বিশেষজ্ঞরা বলেছে, এর নাম নাকি মেমফিস। এ মেমফিসের ওপর যে লেখা ও নকশা তা খুবই দুর্বোধ্য। ফেরাউনের সময়কার দুর্লভ ও আশ্চর্য কাগজ এই মেমফিসের লেখা ও রেখা পড়া বা বুঝা বড়ই মুশকিলের ব্যাপার। সবাইকে তা দেখানােও বিপদজনক। যাই হােক, আমার বিশেষজ্ঞরা যতটুকু তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছে তাতে দেখা যায়, কায়রো থেকে প্রায় আঠারো মাইল দূরে একটি দুৰ্গম পাহাড়ী অঞ্চল আছে। এই অঞ্চলটি এতই দুৰ্গম ও ভয়াবহ যে, লোকে ওই অঞ্চলকে মৃত্যু উপত্যকা বলে। মানুষ তো দূরের কথা, ওখানে কোন হিংস্র পশুও যেতে পারে না। সেই মৃত্যু উপত্যকার কোন এক জায়গায় একজন ফেরাউনের কবর আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই এ তথ্য কতটুকু সত্য ও নির্ভুল। রেখাগুলোর মধ্যে হাতে আঁকা কয়েকটি ছবিও আছে। গল্পের কিছু অংশ ঐ ছবিগুলিতে লুকানাে আছে বলে মনে হয়। আহমদ দরবেশ ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন । এই ফেরাউনের নাম দ্বিতীয় রিম্যান্স। এই অভিযানে তার কিছু বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী ও বিশ্বস্ত লোকের দরকার হলো। আমরা কবরের অনুসন্ধান ও খোদাই কাজের জন্য কায়রোতে অবস্থানরত আমাদের কিছু সচেতন ও পরিশ্রমী গোয়েন্দাকে তার সাথে দিলাম। এদের নেতা হিসাবে দিলাম। ইটালীর ভ্ৰমণ বিশারদ ও পর্বত আরোহী মার্কলিকে। আহমদ দরবেশ এই লোকদের নিয়ে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। দু’জনকে নিজের বাড়ীতে চাকর রাখলেন। যাতে যে কোন সময় অন্যদের শামিল হওয়ার খবর দিতে পারেন। ছদ্মবেশ ধারণের প্রাকটিস শুরু করলেন, যেন যাওয়ার আগে ছদ্মবেশ ধরলে কায়রোর কেউ তাকে চিনতে না পারে। আহমদ দরবেশের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হলো, তিনি যে ধনরত্ব পাবেন তা নিজের প্রয়োজনে আর সুলতান সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করবেন। সহকারী হিসেবে যারা যাবেন তাদের নামমাত্র মজুরী প্রদান করবেন । সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার পিছনে তিনি যে অর্থ ব্যয় করবেন তার বিনিময়ে যখন মিশর খৃস্টান্দের হাতে আসবে তখন তাকে একটি স্বাধীন দেশের শাসক বানিয়ে দেয়া হবে। যার কিছু অংশ নেয়া হবে মিশর থেকে, কিছু অংশ থাকবে সুদানের। তাকে এ কথাও বলা হয়েছে, সেই অনুসন্ধানের সময় যদি সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের ওপর আক্রমণ চালায় তবে আহমদ দরবেশ তার বাহিনীকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন। আহমদ দরবেশ খুশিতে বিভোর হয়ে একদিন তার কাছে চাকরের ছদ্মবেশে আমাদের যে দু’জন গোয়েন্দা ছিল তাদেরকে নকশা দিয়ে ফেরাউনের কবরের অনুসন্ধানে এক, মিশন পাঠিয়ে দিল। গোয়েন্দা মারফত আমাকে সংবাদ পাঠাল, ‘অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়ে গেছে।” হরমন বললেন, আহমদ দরবেশ যদি সফল হতে পারে এবং এ কবর আবিষ্কার হয়ে যায়। তবে তার থেকে যে ধনরত্ন পাওয়া যাবে তা দিয়েই মিশরের ধ্বংসের মূল কাজটা শুরু করা যাবে ।” বৈঠক শেষ হলো। সুলতান আইয়ুবী জানতেও পারলেন না, তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের আরেক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। #চলবে কি? gj


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩১৮ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now