বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
আই লাভ ইউ, ম্যান
১
মাসুল্ডানা
আই লাভ ইউ, ম্যান-১
কাজী আনোয়ার হোসেন
এক
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।
হেড অফিস-মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা।
শনিবার।
শেষ ফাইলটা দেখা শেষ করে রিস্টওয়াচে চোখ বুলাল মাসুল্ডানা। দুটো বাজতে এক মিনিট বাকি। নিজের অজান্তেই ল্ডজার
দিকে তাকাল একবার। কুঁচকে উঠল ভুরু জোড়া। সোহানার
আজ হয়েছে কি? ভাবছে ও। কোন প্রোগ্রাম থাকলে আধঘন্টা
আগে এসে ঘাড়ে চেপে বসে থাকে, কাজে মন বসাতে দেয় না,
কিন্তু আজ সময় পেরিয়ে যেতে চলেছে, অথচ আসার নাম নেই-
ব্যাপারটা কি? নাকি ভুলেই গেছে...অসম্ভব! অনেক মান-অভিমান
ইত্যাদি নারীসুলভ কৌশল খাটিয়ে লাঞ্চের প্রতিশ্র“তি আদায়
করেছে ওর কাছ থেকে সোহানা, ভুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
চেয়ার ছেড়ে একটা হাই তুলল রানা, আড়মোড়া ভাঙল,
তারপর আবার তাকাল ল্ডজার দিকে। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল
ওর চেহারায়, একটা বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস ধরিয়ে পা ঝুলিয়ে
বসল টেবিলের কিনারায়। আজ একশো একটা জরুরী কাজ
সারতে হবে ওকে। একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একজন
অ্যাডভোকেট এবং একজন আর্কিটেক্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আছে ওর। ঢাকা এবং লায়নস ক্লাব, দু’জায়গায় মীটিং। এছাড়াও
অন্তত দুটো পার্টিতে হাজিরা না দিলেই নয়। এতসবের মধেল্টাধ্য হয়ে রাজি হয়েছে ও সোহানাকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে। অথচ!
চোখের সামনে আবার হাত তুলল ও। আঁতকে উঠে টেবিল থেকে
নেমে পড়ল। সর্বনাশ! দুটো পাঁচ! সোহানা আজ ডোবাবে। কিন্তু
হল কি ওর? ভাবতে ভাবতে নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ল
সে, মুখ তুলে তাকাল টাইপ-রতা সেক্রেটারি, মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে
পাশের কামরা পেরিয়ে চলে এল রানা করিডরে। দ্রুত এগোচ্ছে।
পর্দা ঝুলছে সোহানার কামরায়। খুক করে একটু কেশে
ভিতরে ঢুকল রানা। ঢুকেই থমকে গেল। নিজের চেয়ারে বসে
আছে সোহানা, কামরায় আর কেউ নেই। টেবিলের উপর মাথা
ঠেকে আছে তার, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে ঢাকা পড়ে গেছে মুখ।
পায়ের শব্দেও নড়ল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটা হাত
রাখল রানা তার কাঁধে।
‘কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল? সোহানা, কি
হয়েছে?’
‘কিছু না,’ টেবিল থেকে মাথা না তুলেই বলল সোহানা।
‘কিছু না তো এভাবে বসে আছ কেন? শরীর খারাপ?’
‘না।’
‘তবে?’
ঝট করে হঠাৎ মুখ তুলল সোহানা। অভিমান, ক্ষোভ আর
দুঃখের ছায়া দেখল তার মুখে রানা। ‘জানো,’ প্রচণ্ড অভিযোগের
সুরে বলল সে, ‘আমি নাকি একেবারে জঘন্য ভাবে ব্যর্থ হয়েছি
আমার দায়িত্ব পালনে। আমি যেসব ভুল করেছি সেগুলো নাকি
লজ্জাজনক, নতুন এজেন্টরাও নাকি এ ধরনের ভুল করে না।’
‘তার মানে? এসব কি বলছ তুমি?’ কিছুই বুঝতে পারছে না
রানা।
‘আরও শুনবে?’ কার উপর যেন ফুঁসে উঠল সোহানা। ‘আমি
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩
নাকি বিয়ে আর ঘর-সংসার বাঁধার কথাই সবসময় ভাবি, তাই
কাজে মন বসাতে পারি না...তারপর-থাক। সে-সব কথা শুনে
তোমার ল্ডকার নেই। বিশ্বাস কর, ডেকে পাঠিয়ে ঝাড়া দু’টি
ঘন্টা শুধু বকেছে আমাকে...’
‘বকেছে? কে বকেছে?’
‘ওই বুড়ো।’
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠল
রানা।
‘তুমি হাসছ?’ আহত বিস্ময়ে চেহারা কালো হয়ে গেল
সোহানার।
‘একটু বকুনি খেয়েছ, তাতেই এই?’ বলল রানা।
‘একটু নয়, ঝাড়া দু’ঘন্টা,’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সোহানা,
‘তোমাকে এসব কথা বলে লাভ নেই। জীবনে কখনও এই
পরিস্থিতিতে পড়নি তো। আমার মত যদি কখনও বকুনি খেতে,
তবে বুঝতে কেমন লাগে...’
‘বুড়ো শুধু বকাঝকা করেছেন তোমাকে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু
মারধর করেননি। নাকি তাও করেছেন?’
শিরস্ফাড়া খাড়া হয়ে গেল সোহানার। রেগে কাঁই হয়ে
গেছে। ‘তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছ?’
‘কিংবা,’ হাসছে রানা। ‘কোন শাস্তি দেননি তো?’
একটা হাত লম্বা করে ল্ডজার দিকে আঙুল দেখাল সোহানা।
‘তুমি এখন যেতে পার, রানা।’
‘লাঞ্চ কি তবে...’
‘সরি, আজ আমার মুড নেই।’
দ্রুত রিস্টওয়াচ দেখে নিয়ে ভাবল রানা, সোহানা মত
পাল্টাবার আগেই কেটে পড়া উচিত। ওর অভিমান ভাঙাবার
আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে। ‘ঠিক আছে, চললাম তাহলে,’
বলে ঘুরে স্ফাড়াল রানা, এগোল ল্ডজার দিকে।
৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
‘সত্যি চলে যাচ্ছ?’ প্রায় কাঁদ-কাঁদ গলায় পিছন থেকে বলল
সোহানা।
এই সেরেচে, ভাবতে ভাবতে থামল রানা, ঘুরে স্ফাড়াল।
বলল, ‘তো কি করব? তুমিই তো বললে...’
ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল সোহানার চেহারা। ‘ঠাট্টা নয়,
রানা। এই অপমানের একটা প্রতিশোধ নিতে চাই আমি।’
চোখ কপালে উঠে গেল রানার। ‘অপমান? প্রতিশোধ?’
‘হ্যাঁ,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল সোহানা। টান দিয়ে টেবিলের ড্রয়ার
খুলে একটা এনভেলাপ বের করল সে। ‘আমি রিজাইন èে।
ধমক খেয়ে চাকরি করা আমার পোষাবে না। রিজাইন লেটার
টাইপ করে রেখেছি...’
‘মাই গড!’ দ্রুত টেবিলের কাছে ফিরে এল রানা। ‘তুমি
পাগল হয়েছ, সোহানা? আমাকে যা বলার বলেছ, আর কাউকে
বোলো না-শুনলে সবাই হেসে খুন হয়ে যাবে।’
‘বকুনি আমি খেয়েছি, অপমান আমাকে করা হয়েছে...’
‘বকুনি খায়নি কে?’ সোহানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা,
‘এই অফিসে এমন কেউ আছে যে বলতে পারবে চীফের ধমক
আর বকাঝকা খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে চুপিচুপি কাঁদেনি?
তোমাকে অনশুকম চোখে দেখেন, তাই কখনও বকাঝকা
করেননি চীফ, কিন্তু...’
‘তুমি ঠিক জান সবাইকেই এভাবে বকেন?’
‘যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখতে পার। বোকা, চীফের ধমক
না খেলে কেউ আমরা মানুষ হতে পারতাম ভেবেছ? শুধু বকেন
না, কঠোর শাস্তিও দেন তিনি।’
‘শাস্তি?’
‘আমার কথাই ধর না,’ বলল রানা। ‘চাকরিতে ঢোকার প্রথম
দিকের কথা। সাংঘাতিক একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। ব্যস,
আর যায় কোথায়, এমন শাস্তি দিলেন যে তা মাথা পেতে নেয়ার
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫
চেয়ে আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া ভাল। অন্তত তখন তাই মনে
হয়েছিল। একেবারে দ্বীপান্তর!’
‘হোয়াট!’ চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল সোহানার। ‘বল
কি! দ্বীপান্তর?’ সোহানার চোখে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি।
রিস্টওয়াচ দেখে আঁতকে উঠল রানা, ‘সর্বনাশ!’
‘কি অপরাধে দ্বীপান্তর, বলছ না কেন?’
‘সময় নেই, আরেক দিন বলব,’ বলল রানা। ‘আমি এখন...’
হাতের এনভেলাপটা দেখিয়ে জানতে চাইল সোহানা, ‘এটা
তাহলে কি করব? তুমি বলছ সবাইকেই উনি এভাবে...’
‘এক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলে দাও ওটা,’ বলল রানা। ‘কেউ দেখে
ফেলবার আগেই। তোমার সাথে কাল ডিনার খাবার কথা থাকল।
জরুরী কাজ আছে, চললাম।’
‘ইস্,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে স্ফাড়াল সোহানা। ‘চললাম বললেই
হল! লাঞ্চ চুলোয় যাক, তোমার দ্বীপান্তরের কথাটা শুনতেই হবে
আজ আমাকে। মেয়েল্ডে কৌতূহল কেমন জিনিস, জানো না?’
রানার হাত ধরল ও। ‘বাইরে যাবার ল্ডকার নেই, পিয়নকে দিয়ে
লাঞ্চ আনিয়ে নিচ্ছি-তুমি বস।’
ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠল রানার চেহারা। ‘লোকজনকে কথা
দিয়েছি, যেতেই হবে আমাকে-বিশ্বাস কর, কথা দিচ্ছি, আরেক
দিন সময় করে...’
‘উঁহুঁ,’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে সোহানা। ‘আজই শুনব
আমি।’
স্রেফ আপাতত মুক্তি পাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত রাজি হল রানা,
বলল, ‘ঠিক আছে, আজই। তবে এখন নয়।’
‘কখন?’
‘রাতে।’
‘কোথায়?’ জানতে চাইল সোহানা।
‘তোমার বাড়িতে,’ বলল রানা। ‘কাজ সেরে রাত দশটায় যাব
৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আমি।’
‘ঠিক?’
‘ঠিক।’
‘বেশ,’ বলল সোহানা। তারপর রানার হাত ধরে ল্ডজার
দিকে ওকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘তাই বলে লাঞ্চটা
ফাঁকি দেবে, সেটি হচ্ছে না!’
প্রতিবাদ করতে গিয়েও লাভ নেই জেনে চুপ করে গেল
রানা। ভাবছে, এখন না হয় লাঞ্চ খাইয়ে বিদায় করা যাবে, কিন্তু
রাতে? গল্প শোনার ভূত একবার ঘাড়ে চাপলে ভোর না হওয়া
পর্যন্ত নামানো যাবে না। অসম্ভব! সারারাত জেগে অতীত
রোমন্থন করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? হঠাৎ মাথায়
সহজতম বুদ্ধিটা এল। কথা দিয়েছে ঠিক, কিন্তু কথা না রাখলেই
তো ঝামেলা চুকে যায়।
তাই করবে ও। আজ রাতে সোহানার বাড়িতে যাবে না।
রাত দশটা পর্যন্ত খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটল রানার। তিনটে
পার্টির একটাতেও যাওয়া হয়নি, শরীর সাংঘাতিক ক্লান্ত, এখন
আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে,
নাকে মুখে দুটো গুঁজেই বিছানা নেবে, কাল রবিবার, বেলা
বারোটা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমাবে ও।
রান্নাবান্না করে রেখে আজ বিকেলে দেশে গেছে রাঙার মা।
বাড়ি খালি। গ্যারেজে গাড়ি রেখে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এল ও,
বারান্দায় উঠে স্ফাড়াল ল্ডজার সামনে। কী-হোলে চাবি ঢুকিয়ে
তালা খোলার সময় সোহানার কথা ভেবে আপন মনে একটু হাসল
ও। পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে সে ওর জন্যে। আরও কিছুক্ষণ
দেখবে, তারপর ফোন করবে ওকে। কিন্তু ফোন ধরবে না ও।
সাড়া না পেয়ে ভাববে, বাড়িতে নেই ও। সাংঘাতিক খেপে যাবে,
সন্দেহ নেই। শ্রাগ করল রানা, কিছু করার নেই ওর।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭
ল্ডজা খুলে বেডরূমে ঢুকল রানা। অন্ধকারে হাতড়ে বোতাম
টিপে আলো জ্বালল। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। ফর্সা দুটো পা দেখা
যাচ্ছে বিছানায়। মুখের দিকে তাকাতেই রক্তশূন্য হয়ে গেল ওর
চেহারা-যেন ভূত দেখছে!
‘তুমি!’
চিৎ হয়ে রানার বিছানায় শুয়ে আছে সোহানা। হাসছে।
বলল, ‘জানতাম ফাঁকি èোর চেষ্টা করবে। অপেক্ষা করে ঠকতে
মন চাইল না, তাই এখানে চলে এসেছি,’ বিছানার উপর উঠে
বসল সে। ‘হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিংরূমে এস, তোমার সাথে খাব
বলে আমিও খেয়ে আসিনি।’ বিছানা থেকে নেমে ল্ডজার দিকে
এগোচ্ছে সোহানা। ‘কার পাল−ায় পড়েছ সে-খবর রাখো না! কথা
দিয়ে গল্প শোনাবে না-চালাকি!’ রানার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে
রাজনন্দিনীর মত গর্বিত ভঙ্গিতে চলে গেল সে।
খেতে বসে আন্তরিকতার সাথে, মৃদু কণ্ঠে বিনয়াবনত ভঙ্গিতে
শুরু করল রানা, ‘দেখ, সোহানা, সেটা আমার কাঁচা বয়সের কথা,
শাস্তিটা ছিল দ্বীপান্তর, প্রায় চারটে বছর কি যন্ত্রণা ভোগ করেছি-
সেসব আমি স্মরণ করতে চাই না। যা চাও তাই èে, কিন্তু সে-
গল্প দয়া করে তুমি শুনতে চেয়ো না। বলার মত তেমন কিছুই
ঘটেনি সেখানে। তাছাড়া, আজ আমি ক্লান্ত, ঘুমাতে না
পারলে...প−ীজ...’
চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে সোহানার। রানার আবেদন
যেন তার কানেই ঢোকেনি। সবিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে,
‘দ্বীপান্তর! মেজর জেনারেল রাহাত খান শাস্তি দিয়ে তোমাকে
দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছিলেন?’ চটাস করে টেবিলের উপর চাপড়
মারল সে, ‘এ গল্প আমার শুনতেই হবে।’
‘সোহানা...’ করুণ চেহারা স্ফাড়িয়েছে রানার।
সবজান্তার ভঙ্গিতে, অতি উৎসাহের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল
সোহানা, ‘চাকরিতে ঢোকার প্রথম দিকে প্রায় চারটে বছরের কোন
৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
রেকর্ড নেই তোমার ফাইলে-এখন বুঝতে পারছি, ওই সময়টা
দ্বীপান্তর ভোগ করেছিলে তুমি। মাই গড! অ্যাদ্দিন এ খবর তুমি
চেপে রাখলে কিভাবে? এর জন্যে তো আরও কঠিন শাস্তি পাওনা
হয় তোমার-আমার তরফ থেকে। নাও, শুরু করো...’
‘দূর ছাই!’ চরম বিরক্তির সাথে বলল রানা। ‘কথা বুঝতে
চাও না কেন? এতবার করে বলছি সে-সময় উলে−খযোগ্য কিছুই
ঘটেনি...’
‘কিছুই ঘটেনি?’ তীক্ষè হল সোহানার দৃষ্টি। ‘চারটে বছর
একটা দ্বীপে তুমি কাটালে, অথচ কিছুই ঘটল না-একথা আমাকে
বিশ্বাস করতে বল?’
সোহানার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে কেমন যেন অপ্রতিভ বোধ
করল রানা। ওকে ইতস্তত করতে দেখে সোহানা উত্তেজিত হয়ে
উঠল, ‘খবরদার, মিথ্যে কথা বলে আমাকে এড়াতে পারবে না।
তোমার চেহারা বলছে কিছু না কিছু ঘটেছিল-এখনও অস্বীকার
করবে?’
হেসে ফেলল রানা।
‘উত্তর দাও, ঘটেনি কিছু?’
চাপের মুখে পড়ে সত্যি কথাটাই বলতে হল রানাকে। ‘ছোট্ট
একটা ঘটনা ঘটেছিল-কিন্তু আমার অফিশিয়াল দায়িত্বের সাথে
তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। চারটে বছরের এই সামান্য ঘটনাটাই শুধু আজও মনে আছে আমার-মনে পড়লেই প্রতিটা
খুঁটিনাটি পরিষ্কার জ্বলজ্বল করে ওঠে, বাকি সব ঝাপসা, ভুলে
গেছি।’
‘জ্বলজ্বল করে ওঠে?’ ব্যগ্র কৌতূহলে খাওয়ার কথা ভুলে হাত
গুটিয়ে বসে আছে সোহানা। ‘তাহলে নিশ্চয়ই সেটা সাংঘাতিক
কোন ঘটনা? রানা, প−ীজ, আর আমাকে কষ্ট দিয়ো না-খাওয়া হল
তোমার? উঠে পড়, আমি কড়া কফি তৈরি করে আনছি, শুয়ে
শুয়ে শুনব তোমার দ্বীপান্তরের কাহিনী।’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৯
‘কিন্তু...’
‘এই শালা, কানে তোমার কথা যায় না?’ ঝট করে উঠে
স্ফাড়াল সোহানা চেয়ার ছেড়ে। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হাত রাখল
দু’কোমরে। ‘অ্যায়সা এক বক্সিং মারব...’
একসাথে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল দু’জনেই। কিন্তু দ্রুত
মুখের চেহারা গম্ভীর করে ফেলল রানা। ঘাড় থেকে ভূত নামানো
যাবে না, বুঝতে পেরেছে ও। রাতটা জেগেই কাটাতে হবে। কিন্তু
এর বিনিময়ে কিছু আদায় করে নেবার একটা সুযোগ সে-ই বা
ছাড়বে কেন!
‘সোহানা,’ বলল ও। ‘আমার একটা শর্ত আছে।’
‘তোমার যে কোন শর্ত...’ রানাকে লোভাতুর দৃষ্টিতে ওর
দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘোর ভাঙল সোহানার, শর্তটা কি তা
বুঝে নিল এক নিমেষে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মুখটা। ‘তবে
রে...’ টেবিল ঘুরে তেড়ে গেল সোহানা। ‘পাজি, শয়তান,
সুযোগ-সন্ধানী, ব−্যাকমেইলার...’ রানার বুকের উপর গিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, তারপর কানে কানে নিচু গলায় বলল,
‘তোমার শর্তটা কি তা আমি শুনতে চাই না। তবে যাই হোক
পূরণ করব। কিন্তু গল্প শোনার পর।’
বেডরূমের আলো অফ করে দিয়ে অন্ধকারে মুখোমুখি বসে আছে
ওরা। পাশেই জানালা, গ্রিল ছুঁয়ে একফালি ¤−ান চাঁল্ডে আলো
ঢুকে পড়েছে কামরার ভিতর। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে রানা
বাগানের দিকে। ফুরফুরে বাতাস লাগছে মুখে, চুলগুলো
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। মনটা কেমন উদাস লাগছে
ওর।
‘খুব কি করুণ কাহিনী, রানা?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল
সোহানা। ‘তবে না হয় থাক। কষ্ট পাবে মনে করলে না হয়...’
বাগান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল রানা। আবছা অন্ধকারে
১০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
সোহানার মুখের দিকে তাকিয়ে ¤−ান একটু হাসল ও। বলল,
‘আবার সব নতুন করে মনে পড়ে গেছে, সোহানা, এখন যদি কাউকে বলতে না পারি, দম ফেটে মরে যাব আমি-রাতের পর
রাত ঘুমাতে পারব না। না, এখন আর বাধা দিয়ো না। বলতে
দাও আমাকে...কিন্তু, কোথা থেকে শুরু করব, বল তো?’
চুপ করে ভাবছে রানা। সোহানাও ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা
করছে।
তারপর একসময় সোহানাই নিস্তব্ধতা ভাঙল। ‘একটানা চার
বছরের শাস্তি, একেবারে দ্বীপান্তর-কি এমন অপরাধ করেছিলে
তুমি যার জন্যে এতবড় শাস্তি পেতে হল তোমাকে?’
‘শাস্তি বটে, কিন্তু অনেক পরে জেনেছি, সেটা ছিল আমার
জনেঞ্জাশীর্বাদ,’ বলল রানা। ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হচ্ছিল
আমাকে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সরকারের, শুধু
কার্যকরী করা বাকি ছিল। মেজর জেনারেল রাহাত খান ব্যাপারটা
টের পেয়ে তড়িঘড়ি নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে আমাকে
পাঠিয়ে দিলেন দ্বীপান্তরে, সেন্ট মেরী দ্বীপে-আসলে প্রাণে বাঁচিয়ে
দিলেন তিনি আমাকে।’
‘ফায়ারিং স্কোয়াড!’ গলাটা কেঁপে গেল সোহানার। ‘কেন?
কি করেছিলে তুমি?’
নড়েচড়ে বসল রানা। একটা সিগারেট ধরাল। বলল,
‘তাড়াতাড়ি আসল কাহিনীটা শুরু করতে চাই, তাই সংক্ষেপে
তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি আমি, কেমন? যেখানে বুঝবে না
সেখানে প্রশ্ন করে পরিষ্কার হয়ে নেবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলল সোহানা। ‘প্রথম প্রশ্ন-ফায়ারিং স্কোয়াড
কেন? রেকর্ডে তো নেই এসব কথা?’
‘সেটা ছিল আমার ট্রেনিং পিরিয়ড,’ শুরু করল রানা।
‘সেজন্যেই এ সময়ের ঘটনাগুলো আমার রেকর্ড ফাইলে নেই।’
‘কোথায় ট্রেনিং নিচ্ছিলে?’
আই লাভ ইউ, ম্যান
১১
‘লণ্ডনে। কোর্সের শেষ পর্যায়ে আকস্মিকভাবে আমি কিছু
মূলল্টান তথ্য পেয়ে যাই। সিডনি শেরিডান নামে একজন
মিলিওনিয়ার পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রচুর টাকা খাচ্ছিল,
বিনিময়ে পাকিস্তান তার কাছ থেকে নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছিল। পি. সি. আই. অত্যন্ত খাতির করত লোকটাকে। হঠাৎ
আমি টের পেয়ে যাই এই সিডনি শেরিডান ডাব্ল এজেন্টের
ভূমিকা পালন করছে। সে ভারতের কাছ থেকেও প্রচুর টাকা
খেয়ে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য পাচার করছে। ব্যাপারটা
জানতে পেরে আমার ইমিডিয়েট বসল্ডেকে বললাম, কিন্তু কেউ
আমাকে পাত্তা দিল না। আমার হাতে কোন তথ্য প্রমাণ ছিল না,
তাই দমে গেল মনটা। এই সময় আরেকটা ঘটনা ঘটে। এক
লর্ডের ছেলে, হেসটিংস আমাকে ডায়মণ্ড স্মাগলারল্ডে একটা
গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
গুরুদয়াল সিং, একজন ভারতীয় ডায়মণ্ড স্মাগলার-সবাইকে
আমার এই পরিচয় দেয় হেসটিংস। ওরা বিশ্বাস করেছিল।
ওখানে আবার আবিষ্কার করলাম সিডনি শেরিডানকে। ডায়মণ্ড
স্মাগলারল্ডে রিঙ-লিডার সে। খোঁজ নিয়ে জানলাম বন্ধু সেজে
যে লোকটা পাকিস্তানের চরম ক্ষতি করছে এই শেরিডান সেই
শেরিডানই। প্রথমে আমার পরিচয় জানতে পারেনি ও, ভারতীয়
মনে করে খুব খাতির করত আমাকে। না চাইতেই অত্যন্ত
মূলল্টান সব তথ্য পেতাম আমি ওর কাছ থেকে। এবং সে-সব
তথ্য পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অ্যাকটিভ এজেন্টল্ডেকে
আমি গোপনে জানিয়ে দিতাম। এভাবেই চলছিল। কিন্তু আমি
সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না বলে
কাউকে কিছু না জানিয়ে গোটা রিঙটাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা
করে বসলাম। এক ঢিলে দুটো পাখি মারার ইচ্ছে ছিল আমার।
সিডনি শেরিডানের মুখোশ উন্মোচনটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। তখন
বয়স অল্প, বুঝিনি যে অফিশিয়াল অনুমতি না নিয়ে এ ধরনের
১২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
পদক্ষেপ নেয়া ঘোরতর অন্যায়। যাই হোক, সমস্ত তথঞ্জামি
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড, লণ্ডন পুলিস এবং ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে
জানিয়ে দিই। একই দিনে আরেকটা দুঃসাহসের পরিচয় দিই
আমি, এবং প্রফেশন্যাল লাইফের প্রথম ভুলটা করি। হেসটিংসও
একজন স্মাগলার ছিল, তাকে বিশ্বাস করা উচিত হয়নি আমার।
দু’জনে ফাঁদ পেতে সিডনি শেরিডানের একটা ব্রিফকেস ভর্তি
দু’লক্ষ পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং দামের ডায়মণ্ড ছিনতাই করি
আমরা। শেরিডানকে হাতেনাতে ধরার ইচ্ছে ছিল আমার, ফাঁদ্মা
সেজন্যেই পাতা হয়েছিল, কিন্তু গায়ে আঁচড়টি কাটার সুযোগ না
দিয়ে ফসকে গেল সে এবং টের পেল, আমি তার আসল পরিচয়
জেনে ফেলেছি। যাই হোক, হেসটিংসকে ওর বাড়িতে পৌঁছে
দিয়ে দু’ঘন্টা পর হোটেলে ফিরে এলাম আমি...’
‘কামরায় ঢুকে দেখ হেসটিংস তোমার জনেঞ্জপেক্ষা
করছে?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘হাতে পিস্তল। স্রেফ আত্মরক্ষার জন্যেই
যা কিছু করলাম আমি, কিন্তু লোকটা যে সাততলার ব্যালকনি
থেকে একেবারে নিচে পড়ে যাবে তা ভাবতেই পারিনি।’
‘হোটেল থেকে পালিয়ে কোথায় গেলে তুমি?’
‘ছদ্ম পরিচয় নিয়ে অন্য হোটেলে,’ বলল রানা। ‘পরদিন
সমস্ত খবরের কাগজে বড় বড় হেডিংয়ে খবরটা বের হল।
একজন বাদে স্মাগলার চূড়ামণিরা ধরা পড়েছে সবাই।
পলাতকের নাম গুরুদয়াল সিং। লর্ড-পুত্র হেসটিংসকে খুন করার
অভিযোগও আনা হল আমার বিরুদ্ধে। সাংবাদিকরা ব্রিটিশ
সিক্রেট সার্ভিসের একজন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে আভাস দিল
গুরুদয়াল সিং এবং তার সহকর্মীল্ডেকে একটি দেশের স্পাই
বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আমি বুঝলাম শেরিডানই এসব তথ্য সরবরাহ করছে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে।’
ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল সোহানা, ‘সিডনি শেরিডানের
আই লাভ ইউ, ম্যান
১৩
বিরুদ্ধে কোন বল্টস্থা নাওনি তুমি?’
‘ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি আমি,’
বলল রানা। ‘লোকটা সাংঘাতিক চতুর, কোন অপরাধের প্রমাণ
রাখত না। এর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কেও বিচিত্র সব কাহিনী শুনতাম,
একটাও অবিশ্বাস করিনি। সিডনি শেরিডানকে ভয় করে না
ব্রিটিশ আণ্ডার গ্রাউণ্ডে এমন কেউ ছিল না তখন। আমি নিজেও
লোকটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।’
‘তারপর?’
‘কত বড় ভুল করেছি, বুঝলাম পরদিন,’ বলল রানা। ‘আমি
তখন ব্রিটিশ পুলিসকে ফাঁকি èোর জনেঞ্জাতঙ্কিত ইঁদুরের মত
ছুটোছুটি করছি। এই সময় পি. সি. আই-এর একটা মেসেজ
পেলাম। মেসেজে ক্ষতির পূর্ণ বিবরণ জানলাম আমি। গোটা
ইউরোপ-জোড়া ইন্টেলিজেন্স নেটওঅর্ক আমাল্ডে খতম হয়ে
গেছে। আমার সূত্র ধরে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সমস্ত
এজেন্ট, অপারেটর এবং কর্মকর্তাল্ডে পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেছে।
চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ইংল্যাণ্ড, জার্মানী, ফ্রান্স আর সুইডেন ত্যাগ
করতে বলা হয়েছে তাল্ডেকে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে
নিজের চেষ্টায় ইমিডিয়েটলি ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়ায়
যেতে হবে। ওখানে গেলে পরবর্তী আদেশ পাব আমি।’
‘ব্রিফকেসটা ছিল তোমার কাছে...’
‘দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং দামের ডায়মণ্ড ছিল
ওতে,’ বলল রানা। ‘ওগুলো নিয়ে ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করা সম্ভব নয়,
আবার ফেলে রেখে যেতেও মন চায়নি। তখন অবৈধ ডায়মণ্ডের
সবচেয়ে বড় ক্রেতা বলতে সিডনি শেরিডানকেই বোঝাত। এত
টাকা দামের ডায়মণ্ড একমাত্র তার পক্ষেই কেনা সম্ভব।’
‘কিন্তু সে তো তখন তোমার প্রাণের দুশমন,’ বলল সোহানা।
‘নিশ্চয়ই তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওনি?’
‘সাহস করে তাই গিয়েছিলাম,’ বলল রানা। ‘ব্রিটিশ
১৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
ওভারসীজ ব্যাঙ্কের একজন কর্মকর্তার গোপন চেম্বারে সিডনি
শেরিডানের জনেঞ্জপেক্ষা করছিলাম আমি। এল সে, এবং
আমাকে দেখে আপাদমস্তক চমকে উঠল। দেরি না করে কাজের
কথা পাড়লাম আমি। চলতি বাজার ল্ড হিসেবে ডায়মণ্ডের মোট
যা দাম হয় তার চেয়ে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিং কম দেবে সে
আমাকে। ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক পাবেন দশ পার্সেন্ট কমিশন। এই
মুহূর্তে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে আমার অ্যাকাউন্টে মোট পাওনার
একটা চেক লিখে জমা দিতে হবে তাকে। ভুরু কুঁচকে বেশ
কিছুক্ষণ ভাবল শেরিডান। বল্টসায়ী লোক, প্রস্তাবটা মেনে নিল
অবশেষে। কিন্তু সবজান্তা ঢংয়ের হাসি ঠোঁটে নিয়ে আমার কানে
কানে বলল, “মনে রেখ, আমার ডায়মণ্ড আমি কিনে নিলাম। এই
ব্যাঙ্কার ভদ্রলোকের সম্মানে আজ তোমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমি। কিন্তু ভবিষ্যতে খুব সাবধানে থেকো, গুরুদয়াল।
তোমাকে আমি আবার খুঁজে বের করব।” মৃদু হেসে বিদায়
নিলাম আমি। আমার গ্যারান্টি ছিল ওই ব্যাঙ্কার ভদ্রলোক। কথা
দিয়েছিল শেরিডানকে অন্তত একটি ঘন্টা তার চেম্বারে গল্প-
গুজবের মধেঞ্জাটকে রাখবে সে।’
‘এবং ইংল্যাণ্ড ত্যাগ করার জনেদ্দই একটি ঘন্টা তোমার
পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘জাল পাসপোর্ট তৈরিই ছিল, শুধু চেহারা
বদল করে নিতে যা একটু দেরি হল। তারপর লণ্ডন থেকে জুরিখ
হয়ে প্যারিসের ওরলি এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে প্যান অ্যামে চড়ে
সোজা সিডনি চলে এলাম। এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করলেন
স্বয়ং যমদূত-মেজর জেনারেল রাহাত খান।’
‘ওহ্, গড!’
‘হোটেলে পৌঁছুবার আগে পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি চীফ,’
বলল রানা। ‘কিন্তু গাড়িতে দু’বার অসুস্থ বোধ করলাম আমি,
প্রতিবার মনে হল আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। হোটেল কামরার
আই লাভ ইউ, ম্যান
১৫
ল্ডজা নিজের হাতে বন্ধ করে পকেটে হাত ভরলেন চীফ, অমনি
ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। কিন্তু গুলি-টুলি করলেন না। তবে যা
বললেন, তখন মনে হচ্ছিল এর চেয়ে মরে যাওয়াও হাজার গুণে
ভাল। আমার দেয়া রিপোর্টটা নিঃশব্দে পড়া শেষ করলেন তিনি।
তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, শেরিডান ডাব্ল এজেন্ট, তুমি
প্রমাণ করতে পারবে? জান, পাকিস্তানের কত বড় উপকারী বন্ধু
সে? আমি বললাম, না, স্যার। বন্ধু নয়, শত্র“-আরও কিছুদিন
সময় পেলে আমি প্রমাণ করতে পারব। চীফ বললেন, আমি
বিশ্বাস করলাম তোমার কথা-কিন্তু আর কে বিশ্বাস করবে?
আমার ইজ্জতটা শেষ করে দিয়েছ, বোকা ছেলে! সরকারকে
আমার জবাবদিহি করতে হয়, একথা জান না? একশোবার করে
বলে দিয়েছি যেহেতু বাঙালী, প্রতিটা কাজে দ্বিগুণ সাবধান হবে,
ভাবনা চিন্তা করে পা ফেলবে-গর্দভ! এখন তোমাকে বাঁচাব
কিভাবে বলে দাও!’
‘ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা বললেন না?’
‘না। সম্ভবত ভয় পাব বলে কথাটা প্রকাশ করেননি।
অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জানতে
চাইলেন, টাকাটা কি করেছ? বললাম, আছে। বললেন, কি করতে
হবে কালকে জানতে পারবে। বলেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন
কামরা থেকে।’
‘তারপর?’
‘পরদিন বিস্তারিত সব জানানো হল আমাকে। আফ্রিকার পূর্ব
উপকূলের কাছাকাছি ভারত মহাসাগরে ছোটখাট একটা দ্বীপ, নাম
সেন্ট মেরী, সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্যে পোস্টিং দেয়া হয়েছে
আমাকে। সুয়েজ তখন বন্ধ, তাই সারা দুনিয়ার তেলবাহী জাহাজ
ওই সমুদ্র পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে। সব দেশের এসপিওনাজ
নেটওঅর্ক তৎপর ওখানে। তাছাড়া, এলাকাটা আন্তর্জাতিক
স্মাগলারল্ডে স্বর্গ বিশেষ। আমার কাজ হবে সমস্ত এসপিওনাজ
১৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
নেটওঅর্কের মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করা এবং আরও নানান সূত্রে
পাওয়া ইনফরমেশন হাই ফ্রিকোয়েন্সির অয়্যারলেসের মাধ্যমে
কায়রোর পি. সি. আই-এর ব্রাঞ্চ অফিসে পাঠানো। প্রতিষ্ঠানের
সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার ব্যাপারে কঠোর ভাবে নিষেধ
করে দেয়া হল আমাকে। মনটা একেবারে দমে গেল আমার।’
‘কেন?’
‘ভারত মহাসাগরের এই এলাকায় শুধুমাত্র অযোগঞ্জপারেটরল্ডেকে পাঠানো হত,’ বলল রানা। ‘আসলে তেমন
কোন কাজ ছিল না ওখানে-শুধু সময় কাটানো। যাই হোক,
এরপর এল নির্দেশের বিশè্যাখ্যা। একশো পঁচিশ হাজার পাউণ্ড
স্টার্লিং দিয়ে একটা বোট কিনতে বলা হল আমাকে। সেন্ট মেরী
দ্বীপে আমার পরিচয় হবে, আমি পাকিস্তানী বাইশ পরিবারের
কোন এক পরিবারের এক অভিমানী ছেলে, মা-বাবার সাথে রাগ
করে একটা বোট নিয়ে সেন্ট মেরী দ্বীপে এসে পড়েছি, এবং
দ্বীপটা আমার ভাল লেগে গেছে। তাই স্থায়ী ভাবে থাকার জন্যে সেন্ট মেরীর নাগরিকত্ব পাবার জনেঞ্জাবেদন জানিয়েছি।’
‘এবং ঠিক তাই করলে তুমি?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘তাই করলাম। কিন্তু সত্যি সত্যি প্রথম
দর্শনেই ভাল লেগে গেল খুদে দেশটা আমার। দ্বীপটা খ্রিস্টান
প্রধান, তবে অল্প কিছু বহিরাগত হিন্দু এবং মেইন ল্যাণ্ড থেকে
আসা মুসলমানও আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা সবাই নিগ্রো-গায়ের
রঙ কালো, মাথায় কোঁকড়া চুল খুলি আঁকড়ে বসে আছে, কিন্তু
চোখগুলো ধবধবে সাদা। দ্বীপবাসীরা সবাই সরল প্রাণ।
ভালবেসে ফেললাম। বিনিময়ে পেলাম ওল্ডেও অকুণ্ঠ
আতিথেয়তা এবং আন্তরিক প্রীতি। আমাকে ওল্ডে ভাল লাগার
কারণও ছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল কোটিপতির একমাত্র
সন্তান আমি, অথচ জীবিকা অর্জনের জন্যে উদয়াস্ত অমানুষিক
পরিশ্রম করি। ওল্ডে চোখে আমি ছিলাম ভিনদেশী এক রাজপুত্র
আই লাভ ইউ, ম্যান
১৭
যে সাধারণ প্রজাল্ডে সাথে বসবাস করার জন্যে, তাল্ডে দুঃখ-
কষ্টের ভাগীদার হওয়ার জনেশুাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে নেমে
এসেছে পর্ণ কুটিরে।’
‘দ্বীপটা কেমন, রানা?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল
সোহানা।
‘স্বর্গ,’ এক কথায় জবাব দিল রানা। ‘বোটে একগাদা ফুয়েল
ড্রাম তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে রওনা দিই আমি। এই
দু’হাজার মাইল পাড়ি èোর সময় প্রেম হয় আমার সাথে
জলকুমারীর...’
‘জলকুমারী?’
‘তোমার সতীন,’ মৃদু হেসে বলল রানা। ‘ভয় পেয়ো না,
বেঁচে নেই সে। গল্পটা আমার বোট এই জলকুমারীকে নিয়েই।
আর...’ হঠাৎ খাদে নেমে এল রানার কণ্ঠ¯ল্ফ, ‘...আর দ্বীপে পা
দিয়েই কুড়িয়ে পেলাম দুটো সোনার টুকরো-রডরিক আর
ল্যাম্পনি। আমার গল্প ওল্ডেকে নিয়েও।’ একটু থেমে আবার
শুরু করল রানা, ‘দ্বীপে উঠেই কিনলাম পঁচিশ একর ছায়া সুনিবিড়
শান্তি, সেখানে নিজের হাতে তৈরি করেছি চারটে কামরা, চওড়া
একটা বারান্দা, বাগান আর লতা-ঝোপের বাউণ্ডারি ওয়াল। আম
গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িটা থেকে সাদা সৈকত দেখতে পাওয়া যায়।
শোনা যায় সাগরের উদাত্ত আহ¡ান।’
‘অপূর্ব-রানা, ওই দ্বীপে আমার যেতে ইচ্ছে করছে,’ ফিসফিস
করে বলল সোহানা। ‘তারপর?’
‘তিন বছর কেটে গেল ওখানে,’ বলল রানা। ‘এর মধ্যে তেমন কিছুই ঘটেনি। ইতিমধ্যে শুধু দ্বীপের একজন হয়ে উঠেছি
আমি। সবাই ধরে নিয়েছে, এই দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যাব না
আমি। নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করার ছয় বছর পর স্থায়ী
নাগরিকত্ব পাবার কথা। সবাই জানে, তখনই আমি নাগরিকত্ব
পেয়ে গেছি, তিন বছর পর শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকু সম্পন্ন হবে।’
১৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
‘তারপর?’
‘সাঁতার কাটি, বোটটাকে ভাড়া খাটাই, মদ খাই, গান করি-
তারপর এল মাছের মওসুম। সোহানা, গল্প শুরু হল। কিন্তু আজ
এই পর্যন্তই থাক, কেমন? রাত তো অনেক হল। গৌরচন্দ্রিকা
শেষ, আবার অন্য একদিন শুরু করা যাবে মূল কাহিনী, কি বল?’
‘আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব।’ কাঁদ-কাঁদ কণ্ঠ¯ল্ফটা রানার কানে
অকৃত্রিম বলেই মনে হল।
হাসল রানা। ‘ঠিক আছে, তবে শোন। কিন্তু তার আগে...’
‘আবার কি?’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে জানতে চাইল সোহানা।
‘গরম কফি হলে জমত, কি বল?’
‘এক্ষুনি, স্যার।’ চেয়ার ছেড়ে দমকা বাতাসের মত আঁচল
উড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সোহানা।
দুই
সেবারের মওসুমে অনেক দেরি করে এল মাছ। বোট এবং ক্রুল্ডে
গাধার খাটনি খাটাচ্ছি, প্রতিদিন উত্তর দিকে বহু বহু দূর চলে
যাচ্ছি, নিশুতি রাতে ফিরে আসছি গ্র্যাণ্ড-হারবারে-খালি হাতে।
দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা কেটে যাচ্ছে-কিন্তু কই, কোথায়
মারলিন! তারপর হঠাৎ একদিন, নভেম্বরের রোদ ঝিলমিল সাগরে
ঝিক করে হেসে উঠল আমাল্ডে ভাগ্য। মোজাম্বিক স্রোতের স্বচ্ছ
নীল-বেগুনি ঢেউয়ের সফেন মাথা থেকে বড়সড় একটাকে নামতে
দেখলাম আমি।
ইতিমধ্যে একটা মাছের জন্যে মরিয়া জেদ চেপে গেছে
আমার। ক্রুসহ বোটটাকে চার্টার করেছে টাকার কুমীর টনি
রুমার, নিউ ইয়র্কের একটা বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিক। লোকটা
আমার বাঁধা খদ্দের। গত তিন বছর ধরে প্রতি মওসুমে ছয় হাজার
মাইল পাড়ি দিয়ে বড় মারলিনের আশায় তীর্থ করতে আসছে সে
আই লাভ ইউ, ম্যান
১৯
সেন্ট মেরী দ্বীপে। বেঁটে, লালমুখো বানরের মত চেহারা, কিন্তু
সদালাপী-লক্ষ্মী খদ্দের হিসেবে তাকে পছন্দ করি আমি। আর
প্রাণচঞ্চল তরুণ বোট মালিক মাসুল্ডানার উপর ভরসা করার
একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে রুমারের। চেহারা যাই হোক, মনে
অসীম ধৈর্য আর গায়ে শক্তি আছে রুমারের, বড় মাছ নিয়ে
খেলতে হলে যা একান্ত ল্ডকার।
পানির উপর দুই হাতের চেয়েও বড় গোটা ফিন দেখে ছ্যাঁৎ
করে উঠল আমার বুক। ডগার দিকটা চওড়া এবং বাঁকানো
দেখেই বুঝে নিলাম ওটা মারলিন-শার্ক বা পরপয়জ নয়। আমার
সাথে একই সময়ে মাছটাকে দেখতে পেয়েছে জিলেট ল্যাম্পনি,
ফোরডেকে স্ফাড়িয়ে মাস্তুলের দড়িষ্ণা ধরে ঝুলে পড়ল সে,
উত্তেজনায় চেঁচাচ্ছে। পাকানো দড়ির মত চুলের গোছাগুলো রোদ পোড়া মুখের দু’দিকে দোল খাচ্ছে তার।
স্যাঁৎ করে তীরবেগে ঢেউয়ের মাথায় চড়ছে মাছটা, গতি
মন্থর হয়ে এলে মুহূর্তের জন্যে ঢেউয়ের দোলায় দোল খাচ্ছে।
তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে পানি, ব্যাঙের মত লাগছে দেখতে
অনেকটা-কালো, ভারী, বিশাল। সাবলীল ভঙ্গিতে বাঁক নিচ্ছে
মাছটা, সেটার অনুকরণে বাতাস লাগা পতাকার মত ঢেউ জাগছে
পিঠের পাখনায়। ঢেউয়ের মাথা থেকে পিছলে নামছে সে পরবর্তী
ঢেউয়ের মাঝখানে, হুড়মুড় করে ছুটে এসে ঢেকে দিচ্ছে পানি
তার ঝলমলে চওড়া পিঠ।
ঘাড় ফিরিয়ে ককপিটের দিকে তাকালাম। এরই মধেন্ধনি
রুমারকে ফাইটিং চেয়ারে বসতে সাহায্য করছে ফিলিপ রডরিক।
বেল্ট দিয়ে চেয়ারের সাথে রুমারকে আটকে সিধে হয়ে স্ফাড়াল
সে, মনে হল বোটে একটা হিমালয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যেন।
প্রকাণ্ডদেহী বুনো ভাল−ুকের সাথে রডরিকের পার্থক্য শুধু এটুকু যে
বুক ছাড়া তার শরীরে কোথাও তেমন লোম নেই। গায়ের রঙ শুধু
কালো বললে রঙের উজ্জ্বলতাকে অপমান করা হয়। কালো
২০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
মার্বেল পাথরের মত আশ্চর্য একটা স্বচ্ছ গভীরতা এবং দ্যুতি
আছে সেখানে। মস্ত থাবায় ঢাকা পড়ে গেল তার প্রকাণ্ড মুখটা,
সশব্দে চপ করে একটা চুমো খেল সে, তারপর হাতটা ছুঁড়ল
আমাকে লক্ষ্য করে। প্রতীক্ষার অবসানে, নগদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায়
উত্তেজনার ঢেউ লাগছে তার শরীরেও। কিন্তু আমাল্ডে তিনজনের
মধ্যে সবচেয়ে নৈরাশল্টাদী লোক সে-ই, আশা নিরাশার দ্বন্দে¡
দুলছে তার বুক। বলল, ‘বড় সতর্ক, সাত ঘাটের পানি খাওয়া
মাছ।’
নিঃশব্দে হাসছি আমি, ‘ওর কথায় কান দিয়ো না টনি,’
বললাম, ‘একটু সবুর কর, দেখ কিভাবে বাধিয়ে দিই মাছটা।’
‘এক হাজার ডলার বাজি,’ ঢোক গিলে চাপা গলায় বলল টনি
রুমার। এ বাজি জিতে নয় হেরে আনন্দ পেতে চায় সে।
উত্তেজনায় চকচক করছে তার চোখ দুটো।
এক মুহূর্ত ইতস্তত করলাম। হাজার ডলার বাজি হারার
সামর্থঞ্জামার নেই। কিন্তু পরমুহূর্তে বুক টান করে জোর গলায়
জানিয়ে দিলাম, ‘রইল তাই।’ তারপর মন দিলাম মাছের দিকে।
ঠিক ধরেছে রডরিক, এসব মাছের ব্যাপারে অভিজ্ঞতার দিক
থেকে গোটা ভারত মহাসাগরে রডরিকের জুড়ি নেই। প্রকাণ্ড
মাছটা সতর্ক, সাবধান হয়ে আছে।
যত কায়দা-কৌশল জানা আছে, এক এক করে সবগুলো
খাটিয়ে পাঁচবার টোপ সাধলাম মাছটাকে। প্রতিবার বাঁক নিয়ে
সরে গেল সে। নাক ঘুরিয়ে যতবার তার ঠোঁটের সামনে দিয়ে
যেতে চাইল জলকুমারী, প্রতিবার ডুব দিয়ে ফাঁকি দিল সে।
‘রডরিক, আইস-বক্সে তাজা একটা ডলফিন টোপ আছে,’
মরিয়া হয়ে বললাম আমি। ‘বের করে আনো ওটা।’
মাছটাকে এবার ডলফিন সাধলাম। টোপটা অনেক খেটে
নিজে তৈরি করেছি আমি, স্বাভাবিক সাবলীল ভঙ্গিতে সাঁতরে
বেড়াচ্ছে পানির নিচে সেটা। টোপ গ্রহণ করার মুহূর্তটা চিনতে
আই লাভ ইউ, ম্যান
২১
পারলাম। মারলিনের বিশাল দুই কাঁধ নিুমুখী হয়ে যাচ্ছে দেখে
তীক্ষè হল আমার দৃষ্টি। পরমুহূর্তে গড়ান দিয়ে বাঁক নেবার সময়
এক ঝলক আলোর মত দেখতে পেলাম পেটটা-পানির নিচে
একটা আয়না যেন ঝিক করে উঠল।
‘ধাওয়া করছে!’ তীক্ষè কণ্ঠে চিৎকার ছাড়ল ল্যাম্পনি। ডেক
থেকে পা খসে পড়ল তার, দড়ি ধরে দোল খাচ্ছে সে বানরের
মত।
সকাল দশটার দিকে খেলাবার জনেশু“মারকে ছিপটা দিলাম
আমি। তার আগে টানাহেঁচড়া করে বেশ অনেকটা কাছে নিয়ে
এলাম সেটাকে। পানিতে বেশি লাইন থাকলে অতিরিক্ত চাপ পড়ে
রড ধরা লোকটার ওপর। স্ফাতে স্ফাত চেপে ফাইবার গ−াসের ভারী
রড ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়াটাই একমাত্র কাজ নয় আমার-
টোপ গিলেই উন্মত্তের মত মুখ ঝাপটা দিয়ে বড়শি ছাড়াতে চেষ্টা
করছে মাছটা, না পেরে আতঙ্কিত হয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটেছে,
লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছে পানির উপর দিয়ে, ঝপাৎ করে পড়ছে
আবার-সমস্ত মনোযোগ একত্রিত করে বোট চালাচ্ছি আমি,
অনুসরণ করে যাচ্ছি মাছটাকে।
দুপুরের খানিকটা পর অবশেষে পরাস্ত করল রুমার
মাছটাকে। পানির উপর আসতে বাধ্য হয়েছে মাছটা, বিশাল
একটা বৃত্ত রচনা করে প্রথমবার চক্কর মারা শেষ করেছে এই
মাত্র। এখন শুধু প্রতি চক্করে খানিকটা করে কাছে টেনে নিয়ে
আসবে তাকে রুমার।
‘হেই, বস্!’ আমার মনোযোগ ভেঙে দিয়ে হঠাৎ ডাকল
ল্যাম্পনি। ‘একজন অতিথি এসেছেন!’
‘ব্যাপারটা কি, ল্যাম্পনি?’
‘উজান ঠেলে আসছেন বড় সাহেব,’ হাত তুলে দেখাল
ল্যাম্পনি। ‘মারলিনের মুখ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে, গন্ধ পেয়েছেন
তিনি।’
২২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
ল্যাম্পনির হাত অনুসরণ করে তাকাতেই হাঙ্গরটাকে দেখতে
পেলাম। সোজা, একরোখা গতিতে পানি কেটে এগিয়ে আসছে
একটা ভোঁতা ফিন। শুধু রক্তের গন্ধে নয়, পানির তোলপাড়েও
আকৃষ্ট হয়েছে সে। প্রকাণ্ড একটা হ্যামারহেড হাঙ্গর এটা, দেখেই
বুঝলাম। ‘ব্রিজে এস তুমি জলদি, ল্যাম্পনি!’ হাঁক ছাড়লাম
আমি।
‘দেখ, রানা,’ ল্ডল্ড করে ঘামছে টনি রুমার, দু’হাত দিয়ে
চেপে ধরে আছে সে রডটা, মাথা কাত করে কাঁধের কাপড়ে
জুলফি আর কান ঘষে নিয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘শালা খচ্চরটা
যজ্ঝিামার মাছে একটা স্ফাতও বসাতে পারে, হাজার ডলারের
কথা ভুলে যেতে হবে তোমাকে।’
ল্যাম্পনিকে হুইল দিয়ে তিন লাফে ছুটে মেইন কেবিনে গিয়ে
ঢুকলাম আমি। ঝপ করে হাঁটু গেড়ে বসেই দড়ির গিঁট খুলে
ইঞ্জিন হ্যাচটা সরিয়ে দিলাম, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে গহ¡রের
ভিতর, ডেকিংয়ের নিচে হাত গলিয়ে ইনার টিউবের গোপন
সিলিংয়ে ঝোলানো এফ-এন কারবাইনের স্টকটা মুঠো করে
ধরলাম।
ডেকে বেরিয়ে আসার আগেই রাইফেলের লোডিং চেক করা
হয়ে গেছে আমার, বুড়ো আঙুলের ঠেলা দিয়ে সিলেক্টরের কাঁটা
অটোমেটিক ফায়ারের ঘরে নিয়ে গেলাম।
‘ল্যাম্পনি,’ দ্রুত কণ্ঠে বললাম, ‘বড় সাহেবের পাশে নিয়ে চল
বোট।’
জলকুমারীর বো-তে স্ফাড়িয়ে রেলিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়েছি
আমি, বাগিয়ে ধরে আছি কারবাইনটা। কোর্স বদলে সোজা
হাঙ্গরটার দিকে এগোচ্ছে বোট, দ্রুত কমে আসছে দূরত্ব-এখন
আর কোন সন্দেহ নেই আমার, হ্যামারহেডই। ডগা থেকে লেজ
পর্যন্ত বারো ফুট লম্বা, স্বচ্ছ পানির নিচে গায়ের রঙ তামাটে
ব্রোঞ্জ। মাথার আকৃতি বদলে সমতল হয়ে গেছে যেখানটা, দুই
আই লাভ ইউ, ম্যান
২৩
অক্ষিগোলকের মাঝখানে, সতর্কতার সাথে লক্ষ্য স্থির করেই ছোট্ট
করে ট্রিগারে একবার চাপ দিলাম আমি। গর্জে উঠল এফ-এন,
অস্ত্রটা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা খালি পিতলের
কেস, এবং সাগরের পানি দ্রুত ছলকে উঠল বার কয়েক।
গোটা শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে হাঙ্গরটার। মাথার চামড়া ফুটো
করে ভিতরে ঢুকে গেছে বুলেটগুলো, ধবধবে সাদা খুলির হাড়
চুরমার করে দিয়ে ছোট্ট মগজটুকু উড়িয়ে দিয়েছে। উল্টে গিয়ে
ডুবে যাচ্ছে সে।
‘থ্যাঙ্কস, রানা,’ ভেজা টকটকে লাল মুখটা শার্টের আস্তিনে
মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল রুমার।
‘সেবা পরম ধর্ম,’ মুচকি হেসে ল্যাম্পনির কাছ থেকে হুইল
নেবার জন্যে চলে গেলাম আমি।
খুব ভোগাল মাছটাকে রুমার, যতভাবে সম্ভব শাস্তি দিয়ে
লাইন গুটিয়ে ধীরে ধীরে টেনে আনল বোটের কাছে। ছড়ানো
লেজটা পানির উপর নিস্তেজভাবে বাড়ি খাচ্ছে। দীর্ঘ ঠোঁট জোড়া
দ্রুত ফাঁক আর বন্ধ হচ্ছে। চকচকে চোখটা পাকা আপেলের
মত। দীর্ঘ শরীরে হাজারখানেক উজ্জ্বল রূপালী, সোনালী আর
রয়্যাল পারপল রঙের চোখ ধাঁধানো টানা লম্বা দাগ।
স্টেনলেস স্টীলের লম্বা রড হাতে অপেক্ষা করছে রডরিক,
রডের শেষ মাথায় তিন কাঁটার হুকটা রোদ লেগে ঝিলিক মারছে।
দস্তানা পরা হাত দিয়ে হুকহীন আরেকটা রড ধরেছি আমি, ধীরে
ধীরে টেনে আনছি মারলিনকে রডরিকের দিকে। ‘ঠিক জায়গা মত
বেঁধানো চাই,’ বললাম ওকে।
তাচ্ছিলেশু সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল রডরিক, ভাবটা যেন,
ছেলেমানুষের কথা এভাবেই উড়িয়ে দিতে হয়।
‘ঢেউটার জনেঞ্জপেক্ষা কর,’ ঠাট্টা করে উপদেশের সুরে
সাবধান করছি ওকে। অন্য সময় হলে বোটটা দুলে উঠত
রডরিকের অট্টহাসিতে। কিন্তু মারলিন তার সমস্ত মনোযোগ
২৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
কেড়ে নিয়েছে এখন। আমার অহেতুক উপদেশ কানে ঢুকতে
ঠোঁটের কোণ একটু বাঁকা হল শুধু।
ঢেউটা উঁচু করে ধরল মাছটাকে। পানি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে
পড়ল দু’দিকের ছড়ানো পাখনার মাঝখানে পারল্ডে মত চকচকে
চওড়া বুক। ‘এইবার!’ রুদ্ধশ্বাসে বললাম আমি।
‘হেঁইয়ো!’ হুঙ্কার ছেড়ে তিন কাঁটাওয়ালা হুকটা থ্যাচ করে
মারলিনের বুকে গেঁথে দিল রডরিক। উজ্জ্বল ক্রিমসন রঙের রক্ত
ছুটল ফোয়ারার মত। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে পানির উপর
মাছটা, সাদা ফেনার একটা পাহাড় সৃষ্টি হচ্ছে তার চারপাশে,
কয়েকশো গ্যালন লোনা পানি ছিটকে আসছে লেজের ঝাপটায়,
ভিজিয়ে দিচ্ছে ওল্ডে সবাইকে।
ক্রেনের ডেরিক থেকে নামিয়ে অ্যাডমিরালটি জেটিতে ঝুলিয়ে
দিলাম মাছটাকে। হারবার মাস্টার বেনসন সার্টিফিকেট সই করার
সময় মাছের ওজন লিখল আটশো সতেরো পাউণ্ড। চোদ্দ ফুট ছয়
ইঞ্চি লম্বা।
ওদিকে ভক্তরা উল−াসে মেতে উঠেছে, একদল কালো মাণিক
ওরা, ছয় থেকে তেরো চোদ্দ বছর বয়স। কেউ খালি গায়ে,
কারও শার্টের বোতাম ছেঁড়া, রাস্তাগুলো ধরে খালি পায়ে
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে তারা সবাই। চেঁচাতে চেঁচাতে ফুলে উঠেছে
সবার গলার রগ। ‘জেটিতে রানা ভাই পাহাড় ঝুলিয়েছে! জেটিতে
রানা ভাই...।’
দ্বীপবাসীল্ডে জন্যে এর চেয়ে মোক্ষম অজুহাত আর হতে
পারে না। কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে উৎসুক কৌতূহলে দলে
দলে ছুটে আসছে সবাই। দেখতে দেখতে উৎসবমুখর হয়ে উঠল
ব›ল্ড এলাকা।
কথাটা গভর্নমেন্ট হাউজ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুল। অবিরাম হর্ন
বাজিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে আসছে প্রেসিডেনশিয়াল ল্যাণ্ড-
আই লাভ ইউ, ম্যান
২৫
রোভার, বনেটের একধারে পতপত করে উড়ছে রাষ্ট্রীয় পতাকা।
ভিড় দু’ভাগ করে ছুটে এসে জেটির কাছে থামল গাড়িটা। প্রায়
ছিটকে নেমে এলেন মহৎ হৃদয় ব্যক্তিটি। জন্মসূত্রে দ্বীপের
বাসিন্দা যারা তাল্ডে মধ্যে স্বাধীনতার আগে একমাত্র শিক্ষিত
এবং আইনবিদ ছিলেন গডফ্রে পিডল। তাঁর শিক্ষা জীবন কেটেছে
লণ্ডনে।
‘মিস্টার রানা...ও মাই গড!’ মাছটাকে চাক্ষুষ করে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘কি সাংঘাতিক! কি ভয়ঙ্কর! এই নমুনা
দেখে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসবে ট্যুরিস্টরা, আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে
আমাল্ডে ট্যুরিস্ট বল্টসা!’ এগিয়ে এসে সহাসেঞ্জামার হাতটা
ধরে ঝাঁকি দিলেন তিনি, হাতখানেক নিচে থেকে মুখ তুলে
তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। মিনার বসানো কালো টুপি
পরা সত্ত্বেও আমার বগল পর্যন্ত কোনরকমে পৌঁচেছেন তিনি।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মি. প্রেসিডেন্ট, স্যার,’ মৃদু হেসে বললাম। কালো
গায়ের রঙ ঢাকার জন্যেই কিনা কে জানে সব সময় কালো উলেন
সুন্ধ, কালো চামড়ার জুতো, কালো মোজা এবং কালো চামড়ার
রিস্টওয়াচ পরে থাকেন তিনি। তাঁর শরীরে দুটো মাত্র জিনিস
সাদা, তবে এ দুটোর ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত পছ›েল্ড কোন
অবকাশ নেই বলেই আজও সেগুলো যা ছিল তাই আছে। মাথার
সাদা চুল কলপ লাগিয়ে কালো করে নিয়েছেন, কিন্তু হিটলারী
গোঁফ আর ঝকঝকে স্ফাতগুলো ধবধবে সাদা।
প্রেসিডেন্ট গডফ্রে পিডলের শুধু মুখভঙ্গি লক্ষ করলে তাঁকে
ভুল বোঝার অবকাশ সব সময় থেকে যায়। এই যেমন এখন।
আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি, চোখমুখ বিকৃত
করে চেঁচাচ্ছেন, হাত পা ছুঁড়ে নাচানাচি করছেন চারপাশে-যেন
মারধর শুরু করবেন তিনি এখুনি। কিন্তু তাঁকে বুঝতে হলে তার
বক্তব্য শুনতে হবে। তিনি উত্তেজনায় লাফাচ্ছেন আর বলছেন,
‘মিস্টার রানা, তুমি আমাল্ডে গর্ব। তোমাকে আমি অভিনন্দন
২৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
জানাই। দ্বীপবাসীল্ডে পক্ষ থেকে তোমাকে আমি তাল্ডে
কৃতজ্ঞতা জানাই, এবং...’ শেষের এই কথাটা সুযোগ পেলেই
পুনরাবৃত্তি করেন তিনি, ‘...এবং সেন্ট মেরী দ্বীপের একজন সাচ্চা
নাগরিক হিসেবে তোমাকে পেতে যাচ্ছি বলে আমরা গর্বিত।’
কেন যেন আমাকে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে-সেই প্রথম দিন
থেকেই। জাতীয় উৎসবে বা কোন অতিথির আগমনে যখনই
গভর্নমেন্ট হাউজে কোন রাজকীয় খানাপিনার আয়োজন হয়,
আমাকে নিমন্ত্রণ করতে কখনও তাঁর ভুল হয় না।
লম্বা লম্বা পা ফেলে ছবি তোলার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে এল
ঢ্যাঙা গোখলে রামাদীন। মান্ধাতা আমলের ক্যামেরাটা তে-পায়ার
উপর বসিয়ে কালো কাপড়ের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। বিশাল
শিকারের পাশে স্ফাড়ালাম আমরা। মাঝখানে টনি রুমার, হাতে
রড নিয়ে। তাকে ঘিরে বাকি সবাই স্ফাড়াল। আমার পাশে
স্ফাড়িয়েছে রডরিক, আরেক পাশে ল্যাম্পনি। ল্যাম্পনিকে প্রায়
ঠেলা মেরে সরিয়ে দিয়ে আমার পাশে চলে এলেন প্রেসিডেন্ট
গডফ্রে পিডল। স্ফাত বের করে তাঁর সাথে হাসছে সবাই। কিন্তু
রডরিক তার বিশাল দুই কাঁধের উপর বসানো প্রকাণ্ড মুখটাকে
কৃত্রিম আতঙ্কে বিকৃত করে তুলেছে, চোখ দুটো বিস্ফারিত-
তাকিয়ে আছে লেন্সের দিকে। চার্টার পার্টিল্ডে মুগ্ধ করার জন্যে এ ছবি আগামী মওসুমে অবদান রাখবে সন্দেহ নেই। দর্শনীয়
চেহারার ক্রু, বিশাল শিকার, খোদ প্রেসিডেন্ট এবং চার্টার পার্টিকে
নিয়ে তরুণ স্কিপারকে ফটোতে দেখে শিকার বিলাসী সৌখিন
পার্টিরা প্রলুব্ধ হবে। অন্তত স্কিপারের ক্যাপের নিচে এবং বোতাম
খোলা শার্টের ভিতর থেকে বাঁকা হয়ে বেরিয়ে আসা চুল আর উঁচু
হয়ে থাকা পেশী, তার সাথে গর্বিত হাসিটুকু-একবার দেখলে
ভুলতে পারবে না কেউ। এইসব ভাবছি তখন আমি।
পাইনঅ্যাপেল এক্সপোর্ট শেডের কোল্ডস্টোরেজে মাছটাকে
আপাতত রাখার বল্টস্থা হল। পরবর্তী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
আই লাভ ইউ, ম্যান
২৭
শিপমেন্টে লণ্ডনের রোল্যাণ্ড ওয়ার্ডে পাঠানো হবে এটাকে।
ল্যাম্পনি আর রডরিককে জলকুমারীর ডেক পরিষ্কার করার কাজে
লাগিয়ে দিয়ে রুমারকে নিয়ে রওনা দিলাম আমি। কাজটা শেষ
করে হারবারের শেষ মাথার কাছে শেল বেসিনে নিয়ে গিয়ে
জলকুমারীতে তেল ভরবে ওরা, তারপর ব›ল্ড থেকে খানিক দূরে
নোঙর ফেলবে।
আমার পুরানো রঙচটা ফোর্ড পিকআপে রুমারকে নিয়ে
উঠলাম। স্টার্ট দিতে যাব, এমন সময় দেখি মাটি কাঁপিয়ে কালো
একটা ঝড় ছুটে আসছে আমাল্ডে দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে
গাড়ির পাশে এসে থামল রডরিক। প্রকাণ্ড মাথাটা জানালা দিয়ে
ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিচু গলায় বলল সে,
‘বোনাসের কথাটা ভুলে গেছি, রানা! আমি বলতে চাই,
মানে...তুমি তো জানোই...’
‘জানি,’ বললাম। ‘বেগম রডরিককে বোনাসের কথাটা
জানানো চলবে না, এই তো? এর জন্যে ছুটে না আসলেও চলত
তোমার।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ প্রতিবারের মত উত্তর দিল রডরিক। ‘না জানালে
ভাল হয়, এই আর কি!’ যমের মত ভয় করে সে স্ত্রীকে।
‘ঠিক আছে বাবা, এখন তুমি যাও, কাজ করগে।’
পরদিন সকালে টনি রুমারকে পে−নে তুলে দিয়ে এলাম।
মালভূমি থেকে নামার সময় সারাটা রাস্তায় গলা ছেড়ে গান
গাইছি, ফোর্ড পিকআপের বিচিত্র হর্ন বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি
দ্বীপবাসী মেয়েল্ডে। পাইন অ্যাপেলের মাঠে কাজ করছে তারা।
পরিচিত পিপ্ পিপ্ পিপ্, পিপ্-পিপ্ পিপ্ কানে যেতেই সিধে হয়ে
তাকাচ্ছে সবাই, চওড়া স্ট্র হ্যাটের কার্নিসের নিচে হাসিতে
উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে চেহারাগুলো, হাত নাড়ছে তারা।
রামাদীন’স ট্র্যাভেল এজেন্সিতে এসে রুমারের আমেরিকান
এক্সপ্রেস ট্র্যাভেলার্স চেকটা ভাঙালাম। বরাবরের মত এবারও
২৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
বিনিময়ের হার নিয়ে ল্ডকষাকষি করতে হল রামাদীনের সাথে।
ঢ্যাঙা রামাদীনের শরীরের কোথাও মাংসের কোন খবর নেই,
তালগাছের মত ছয় ফুট লম্বা সে। উদ্যোগী পুরুষ, সম্ভাব্য সব
বল্টসার সাথে জড়িত রাখে নিজেকে। লোকটা ভারতীয়, বল্টসা
করতে এসে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে দ্বীপে। যখন ঢুকলাম দেখি
চামড়ার ব্যাগ হাতে রোগী দেখতে যাবার তোড়জোড় করছে সে।
ক্যামেরাম্যান এখন কবিরাজের ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।
গত তিন বছর ধরে রামাদীনই সমস্ত চার্টার পার্টি জোগাড়
করে দিচ্ছে আমাকে। প্রতিবারের মত ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে
দশ পার্সেন্ট কেটে নিল সে। দ্বীপের একমাত্র ইনশিওরেন্স
এজেন্সির মালিকও সে, এই সুযোগে জলকুমারীর বীমা বাবèাৎসরিক প্রিমিয়ামের টাকাটাও কেটে নিতে ভুল করল না। মোট
তিনবার গুণে বাকি টাকা ফেরত দিল আমাকে। স্টীল রিমের
চশমা পরা লোকটাকে নিরীহ, ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে
না বলে মনে হলেও বই-পুস্তকে যত রকম ছলচাতুরীর কথা লেখা
আছে তার সবগুলো জানা আছে তার, অতিরিক্ত আরও দু’একটার
কথা জানে সে যেগুলো এখনও লেখা হয়নি কোথাও। তাই
সতর্কতার সাথে নিজেও একবার গুনলাম টাকাগুলো।
চোখেমুখে পিতৃসুলভ সস্নেহ ভাব ফুটিয়ে তাকিয়ে আছে
আমার দিকে রামাদীন। আমি টাকা গোনা শেষ করতেই মৃদু
উপদেশের সুরে স্মরণ করিয়ে দিল সে, ‘কাল আরেকটা চার্টার
পার্টি আসছে, মনে আছে তো, মিস্টার?’
‘আছে,’ বললাম আমি। ‘চিন্তা করবেন না, আমার ক্রুরা
সবাই সুস্থ থাকবে।’
‘এরই মধ্যে লর্ড নেলসনে পৌঁছে গেছে ওরা,’ একটু গম্ভীর
হল রামাদীন, আমার ভাল-মন্দ সম্পর্কে কত যেন মাথাব্যথা তার!
‘ল্যাম্পনি এরই মধ্যে পৌনে এক ডজন মেয়েকে ডেকে নিয়ে
গেছে...’ দ্বীপের কোথায় কখন কি ঘটছে তার নিখুঁত খবর রাখে
আই লাভ ইউ, ম্যান
২৯
রামাদীন।
‘তাতে হয়েছে কি?’ বললাম আমি। ‘একটু মদ খেলে বা
মেয়েল্ডে নিয়ে একটু আড্ডা মারলে কাল সকালের মধ্যেই মারা
যাবে না ওরা।’
কথা বাড়াবার আর সাহস হল না রামাদীনের, নিজের ভুল
বুঝতে পেরেছে সে। জিলেট ল্যাম্পনি আর ফিলিপ রডরিক, এই
দু’জন সম্পর্কে কোনরকম বিরূপ মন্তব্য সহ্য করতে পারি না
আমি। দ্বীপে এমন বেশ কিছু লোকজন পাওয়া যাবে যারা ওল্ডে
বিরুদ্ধে আমার মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার
হাতেই উত্তম-মধ্যম খেয়ে দু’চারদিন করে হাসপাতালে কাটিয়ে
এসেছে। এসব অজানা থাকার কথা নয় রামাদীনের।
ড্রেক স্ট্রীট পেরিয়ে এডওয়ার্ড স্টোরে এলাম। দোকানের
পিছনের গলিতে লাইন দিয়ে হৈ-চৈ করছে পঁচিশ-ত্রিশটা কালো
মাণিক, শুনতে পেলাম। আমাকে অভিনন্দন জানানর জন্যে মা
এডি তার তিন মেয়ে এবং তাল্ডে এক ডজন বান্ধবীল্ডে নিয়ে
অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে বৃদ্ধা নিজে বেরিয়ে এল
কাউন্টারের এপারে। মাথার পিছনে হাত দিয়ে টেনে নিল নিজের
বিশাল দুই স্তনের মাঝখানে। কোমল মাংসে নাক ডুবে গেল
আমার, দম আটকে এল। তারপর ছেড়ে দিয়ে বুড়ি সহাস্যে জানাল, ‘মেয়েল্ডে হাত ধরে তোর মাছ দেখতে গিয়েছিলাম।’
হাত ধরে ল্ডজার কাছ থেকে কাউন্টারের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে
একটা টুলে বসিয়ে দিল আমাকে। ‘শেলী, বাছাকে ঠাণ্ডা এক
ক্যান বিয়ার দাও জলদি।’
‘ইয়েস, মিসাস!’ কর্মচারী মেয়েটা লাফ দিয়ে ছুটল।
মানিব্যাগ থেকে টাকার বাণ্ডিল বের করলাম আমি। এক ঝাঁক
মুরগীর বাচ্চার মত কিচির মিচির করে উঠল মেয়েরা। চোখ
বিস্ফারিত করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মা এডি।
‘দু’হাতে টাকা কামাও, বাবা। দিনে দিনে উন্নতি কর তুমি...’
৩০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আশীর্বাদ করছে বুড়ি।
দোকানের পিছনের গলি থেকে টুঁ-শব্দটি আসছে না এখন
আর। কালো মাণিকের দল কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছে আমার
উপস্থিতি।
‘কত পাওনা হয়েছে, মিসাস এড?’ জুন থেকে নভে¤ল্ফ, এই
ছয় মাস মাছ পাওয়া যায় না, ফলে এক পয়সা রোজগার করি না
আমি-এই বিপল্ডে সময়টা যখন যা ল্ডকার হয় সব বাকিতে
দিয়ে সাহায্য করে আমাকে মা এডি।
হিসাবের খাতাটা টেনে নিয়ে যোগফলটা শুধু দেখলাম, তার
নিচে ত্রিশ জোড়া রাবারের জুতো, সুতি কাপড়ের শার্ট ও হাফ
প্যান্ট এবং ত্রিশ প্যাকেট চকলেটের দাম লিখে মোট পাওনা যা
স্ফাড়াল তার চেয়ে কিছু বেশি টাকা জমা রাখলাম।
বিয়ারের ক্যান হাতে শেলফের দিকে তাকিয়ে জিনিসপত্র
বাছাই করছি, মই বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে মেয়েরা সেগুলো
পেড়ে আনার জন্যে। মিনি স্কার্ট পরা নিগ্রো মেয়েল্ডে পা আর
মাংসল ঊরু বারবার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে...থুড়ি!
দ্বীপের তৈরি সরু একটা চুরুট ধরিয়ে মা এডির কাছ থেকে
বিদায় নিলাম। বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম অদম্য খুশি
আর আন›েজ্ঝাবার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে কালো মাণিকের
দল। সোজা শেল কোম্পানি বেসিনে এসে ম্যানেজারের সাথে
দেখা করলাম। বিশাল সব সিলভার ফুয়েল স্টোরেজ ট্যাঙ্কের
মাঝখানে তার অফিস।
‘মি. রানা,’ আমাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে স্ফাড়াল
ম্যানেজার। ‘বসুন। সকাল থেকে অপেক্ষা করছি আপনার
জন্যে। আপনার বিলের ব্যাপারে হেড অফিস এমন কান্নাকাটি
শুরু করেছে...’
‘এবার ওল্ডেকে হাসতে বলুন,’ জলকুমারীর ফুয়েল বাবদ সব পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বললাম। কিন্তু জলকুমারী সু›ল্ডী নারীর
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩১
মতই, বড় বেশি খরচ ওর পেছনে-শেল কোম্পানি থেকে বেরিয়ে
এসে পিকআপে ওঠার সময় পকেটটা অনেক হালকা মনে হল
আমার।
লর্ড নেলসনের বিয়ার গার্ডেনে অপেক্ষা করছে ওরা। ব্রিটিশ
রয়্যাল নেভির ক্রু এবং অফিসারল্ডে জন্যেই বিশেষ করে চালু
করা হয়েছিল এই বার অ্যাণ্ড রেস্তোরাঁ। তখন এখানে স্থানীয়
দ্বীপবাসীল্ডে প্রবেশাধিকার ছিল না। দ্বীপটা স্বাধীন হওয়ার পর
বদলে গেছে সবকিছু। কিন্তু দুশো বছরের ঐতিহল্টজায় রেখে
আজও ব্রিটিশ ফ্লীটের একটা স্টেশন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করছে সেন্ট মেরী। রয়্যাল নেভি তাল্ডে স্টেশন প্রত্যাহার
করেনি বলে দ্বীপবাসীরা গর্বিত। গ্র্যাণ্ড হারবারে প্রতিদিনই
দু’একটা যুদ্ধ জাহাজ, রসèাহী জাহাজ এবং ফুয়েল ট্যাঙ্কার
নোঙর ফেলছে। সেই সাথে আনাগোনা করছে নানান দেশের
বাণিজ্যিক জাহাজ, গভীর মসুদ্রে চলছে চোরাকারবারীল্ডে
মহোৎসব। এবং এসপিওনাজের জটিল নেটওঅর্ক।
হারবারের উপরে হেডল্যাণ্ডে কংক্রিটের তৈরি হিলটনের চেয়ে
লর্ড নেলসনে আড্ডা মেরে অনেক বেশি আনন্দ পাই আমি। ছায়া
সুশীতল বাগানে বসে যতই হুলে−াড় কর, গান ধর, মদ খাও-কেউ
তাকিয়েও দেখে না। অবশশুাত যখন গভীর হয়, অন্ধকারে গা
ঢাকা দিয়ে হিলটনে প্রায়ই যেতে হয় আমাকে।
বাগানের পাঁচিল ঘেঁষে একটা বেঞ্চিতে গা ঠেকিয়ে বসে আছে
বেগমকে নিয়ে রডরিক। দু’জনেই আজ তাল্ডে বিয়ের পুরানো
পোশাক পরে এসেছে। শুধু এই পোশাক যখন পরে ওরা তখনই
দু’জনকে আলাদা ভাবে সহজে চিনতে পারা যায়। রডরিকের থ্রি-
পীস স্যুটের একটা বোতাম নেই, বাকিগুলোর কিনারা ভেঙে
গেছে। তার মাথার ডীপ-সী ক্যাপটা শুকনো রক্ত আর স্বচ্ছ
লবণের গুঁড়োয় নোংরা হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। বেগম
রডরিকের পরনে আজানুলম্বিত ভারী কালো, উলের পোশাক,
৩২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
কালের ছোঁয়ায় রঙ সবুজ হয়ে এসেছে, পায়ে গোড়ালি ঢাকা
বোতাম আঁটা চামড়ার ভারী জুতো। এই পোশাক ছাড়া চেহারা,
ওজন, শারীরিক কাঠামো এবং রঙ কোথাও দু’জনের মধ্যে তেমন
কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে সব সময় ক্লিন শেভ হয়ে
থাকে রডরিক, কিন্তু বেগমের নাকের নিচে গোঁফের পাতলা
রেখাটা কারও চোখে না পড়ে উপায় নেই।
‘হ্যালো, মিসাস রডরিক, কেমন আছ?’ বললাম আমি।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার রানা,’ সংক্ষেপে বলল বেগম রডরিক।
ছেলেমানুষকে লাই দিলে মাথায় চড়ে বসবে, তাছাড়া আমি
যেহেতু একাধারে তার স্বামীর বস্ এবং বন্ধু, তাই খুব কম কথা
বলে সে আমার সাথে। তার একমাত্র দুশ্চিন্তা স্বামীর পাওনা
টাকাটা আমার কাছ থেকে উদ্ধার করে কিভাবে কোথায় লুকিয়ে
রাখবে। এ ব্যাপারে তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতা দিই
আমি। জানি, বউ যদি একটু ঢিল দেয় সব টাকা মদ খেয়ে
ওড়াবে রডরিক।
‘বল, কি আনাব তোমার জন্যে,’ জানতে চাইলাম।
‘সামান্য একটু অরেঞ্জ জিন হলেই চলবে, মিস্টার রানা।’
চুপ করে বসে আছে রডরিক, স্থির উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে
আছে তার পেশী। আমার হাত থেকে টাকা নিয়ে গুনছে বেগম,
নিঃশব্দে নড়ছে তার পুরু ঠোঁট জোড়া। আমার সাথে চোখাচোখি
হতে ঢোক গিলল রডরিক, আবেদনের দৃষ্টি ফুটে উঠল তার
চোখে। আজ আবার সবিস্ময়ে ভাবলাম, বউ এত সতর্ক হওয়া
সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে কিভাবে রডরিক তাকে বোনাসের
টাকাটা ফাঁকি দিচ্ছে। ব্যাপারটা বেগমের তরফ থেকে ইচ্ছাকৃত
প্রশ্রয় নয় তো!
গোঁফ ভিজিয়ে গ−াসে শেষ চুমুক দিল বেগম রডরিক, বহু কষ্টে
বিশাল শরীরটা নিয়ে উঠে স্ফাড়াল, বলল, ‘এবার তাহলে আমি
আসি, মিস্টার রানা। আবার দেখা হবে।’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩৩
বাগান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে থপ থপ পায়ের শব্দ তুলে বেগম
রডরিক, বয়-বেয়ারারা সসম্ভ্রমে সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে
তাকে। অন্য কোন কারণে নয়, তার প্রকাণ্ড শরীরটাই সম্মান
কেড়ে নেয় মানুষের। বেগম অদৃশ্য হয়ে যেতেই টেবিলের তলা
দিয়ে বোনাসের টাকাটা রডরিককে দিলাম আমি। খুশিতে ঝকমক
করে উঠল দৈতেশু দু’চোখ। দু’জন একসাথে চললাম প্রাইভেট
বারের দিকে।
দু’পাশে দু’জন এবং কোলের উপর একটি মেয়েকে নিয়ে
বসে আছে জিলেট ল্যাম্পনি। নাভির কাছে বেল্ট পর্যন্ত খোলা
টকটকে লাল সিল্কের শার্ট পরে আছে সে, বুকের চকচকে পেশী
দেখা যাচ্ছে তার। টাইট ফিটিং প্যান্টটা কামড়ে ধরে আছে
শরীরের চামড়া, তার যে পুরুষাঙ্গ আছে সে-ব্যাপারে কারও কোন
সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। পায়ের বুট জোড়া সদ্য পালিশ করা,
আয়নার মত ঝকঝক করছে। উদার হস্তে নারকেল তেল ঢেলেছে
মাথায়, তারপর ব্যাকব্রাশ করেছে। পাঁচ ব্যাটারির টর্চের মত
উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে গোটা কামরা উদ্ভাসিত করে রেখেছে সে।
আমি তাকে তার পাওনা মিটিয়ে দিতেই প্রত্যেক মেয়ের ব−াউজের
সামনের দিকে একটা করে ব্যাঙ্ক নোট পিন দিয়ে আটকে দিল
সে।
‘হেই, লিজা,’ ব্যস্ততার সাথে বলল সে, ‘কানী, দেখতে
পাচ্ছিস না, শালা মনিব এসে হাজির হয়েছে! যাও ছুকরী, বসের
কোলে গিয়ে আস্তানা গাড়ো, ওকে খুশি করো। কিন্তু সাবধান!
বস্ শালা এখনও একটা ভার্জিন, বুঝে-সমঝে নাড়াচাড়া করবি
ওকে, বুঝলি!’ হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ করে হাসতে শুরু করল সে,
তারপর ফিরল রডরিকের দিকে। ‘অ্যাই শালা, রডরিক, তোর
এই ফিক ফিক হাসি থামালি তুই!’
হাসছিল তো না-ই, ভুরু আরও কুঁচকে গিয়ে চারপাশের ফুলে
ওঠা মাংসে চোখ দুটো প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল রডরিকের।
৩৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
মুখের মাংস ভাঁজ খেয়ে চেহারাটা এক নিমেষে ঠিক বুলডগের মত
কদাকার এবং বীভৎস হয়ে উঠল।
‘উফ! ভয়ে মরে যাই!’ তাচ্ছিলেশু সাথে মুখ ভেঙচাল ওকে
ল্যাম্পনি। ‘ওই বুলডগ সেজেই থাক্, আমার গায়ে হাত তুলবি
সে-সাহস তোর কোনদিনই হবে না। রানা যতক্ষণ...’
‘মাসুদ যখন না থাকে?’ কর্কশ গলায় দ্রুত জানতে চাইল
রডরিক।
জোঁকের মুখে লবণ পড়ল যেন, নিমেষে শান্ত হয়ে
আত্মসমর্পণ করল ল্যাম্পনি। ‘হ্যাঁ, তখনকার কথা আলাদা।’
‘এখন তাহলে আয় মদ খেয়ে হুলে−াড় করি?’
‘উত্তম প্রস্তাব,’ গম্ভীর ভাবে বলল ল্যাম্পনি। এই প্রথম
সরাসরি তাকাল আমার দিকে। আন্তরিক সমীহের সাথে জানতে
চাইল, ‘তুমি কি বলো, শালা বস্?’
ভুরু কুঁচকে চিন্তানি¦ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘মদ? হ্যাঁ, তা তো
খেতেই হবে। মদ খেতে না পারলে আজ আমি মরেই যাব।’
ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বারম্যাান। কাউন্টারে ট্রে
সাজানো হয়ে গেছে অনেক আগেই। তার কাছ থেকে ইঙ্গিত
পেয়ে বেয়ারা ছুটোছুটি করে পরিবেশন শুরু করল।
বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেদার চালিয়ে গেলাম আমরা।
কেউ কারও চেয়ে কম খাইনি, কিন্তু তিনজনের প্রতিক্রিয়া
হয়েছে তিন রকম। টেবিলের উপর উঠে পদ্মাসনে বসে গেছে
ল্যাম্পনি, সামনে মল্ডে গ−াস, তার পাশে ফেলে রেখেছে ক্ষুরের
মত ধারালো বেইট নাইফটা, মাথা নিচু করে বিড় বিড় করে
প্রলাপ বকছে। খানিক পর পরই বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুরির ধার
পরীক্ষা করছে সে, তারপর ঝট করে মুখ তুলে আক্রমণাত্মক,
হিংস্র ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে কামরার চারদিকে। দেখছে, কেউ তার
দিকে কোন নজর দিচ্ছে কি না।
আমার পাশের একটা চেয়ারে বসে আছে রডরিক। চুপচাপ
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩৫
হাসছে সে। ঝকঝকে সাদা স্ফাত আর গোলাপী রঙের মাড়ি দেখা
যাচ্ছে তার।
সরু চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছি আমি, ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে
লক্ষ করছি দু’জনকে।
‘মাসুদ,’ মুখটা আমার মুখের কাছে সরিয়ে এনে চোখে চোখ
রাখল রডরিক। ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো নিমেষে স্বাভাবিক হয়ে এল
তার। নেশার চিহ্নমাত্র নেই এখন তার দৃষ্টিতে। ব্যাকুল ভাবে কি
যেন খুঁজছে সে আমার চোখে। দশ সের ওজনের পেশীবহুল
একটা হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। ‘ইউ আর এ গুড
বয়, মাসুদ। একটা কথা বলব বলব করে কক্ষনো কোনও দিন
তোমাকে বলা হয়নি।’ একটু থেমে নিজেকে গুছিয়ে নিল
রডরিক। অদ্ভুত একটা মুগ্ধ দৃষ্টি ফুটে উঠেছে তার চোখে।
প্রত্যেক বেতনের দিন এই কথাটা বলে সে আমাকে। ‘মাসুদ,
আই লাভ ইউ, ম্যান। আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসি
আমি তোমাকে!’
শুকনো রক্ত আর লবণের গুঁড়ো মাখা নোংরা ক্যাপটা তুলে
রডরিকের খয়েরী রঙের কামানো মাথার গম্বুজে ছোট্ট একটা চাঁটি
দিলাম আমি। বরাবর যা বলে থাকি তাই বললাম, ‘আমিও।’
মুখটা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পাঁচ সেকেণ্ড ধরে ভাল করে
নিরীক্ষণ করল আমাকে রডরিক, সতিল্টলছি কিনা বোঝার চেষ্টা
করছে যেন। ধীরে ধীরে দুই কানে গিয়ে ঠেকল হাসি। অর্থাৎ,
বিশ্বাস করে ও আমাকে।
আরও দুই পেগের অর্ডার দিলাম, এই সময় বারে ঢুকল
গোখলে রামাদীন। সরাসরি এগিয়ে এসে আমাল্ডে টেবিলে বসল
সে। স্টীল রিমের চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে ফ্রেমের উপর
দিয়ে আমার দিকে তাকাল। হাসলাম। বলল, ‘মিস্টার রানা,
লণ্ডন থেকে এইমাত্র জরুরী একটা টেলিগ্রাম পেয়েছি আমি।
আপনার চার্টার বাতিল হয়ে গেছে।’
৩৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
ধীরে ধীরে হাসিটা মুছে গেল আমার মুখ থেকে। দুশ্চিন্তায়
ছেয়ে গেল মনটা। গোটা মওসুমে একটামাত্র পার্টি পেয়ে সন্তুষ্ট
থাকতে হবে নাকি? পকেটে বড় জোর আর তিনশো ডলার আছে,
সারাটা বছর চলব কিভাবে? এই এলাকার দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে
দিয়ে মেজর জেনারেল পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন খরচের টাকা
সব আমাকেই জোগাড় করে নিতে হবে। ক্যামোফ্লেজের
নিরাপত্তার জন্যেই প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনরকম ব্যক্তিগত
আদানপ্রদান বা যোগাযোগ করা চলবে না। হাই ফ্রিকোয়েন্সি
ওয়্যারলেস সেটটা বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে শুধুমাত্র অফিশিয়াল
ইনফরমেশন পাঠানর কাজে বল্টহার করা যাবে।
‘যেভাবে হোক নতুন একটা পার্টি ধরুন,’ বললাম আমি।
ছুরিটা তুলে নিয়ে ঘ্যাঁচ করে টেবিলের উপর গাঁথল সেটা
ল্যাম্পনি। কেউ তার দিকে কোন খেয়াল দিল না। আবার সে
হিংস্র ভঙ্গিতে কামরার চারদিকে তাকাচ্ছে।
‘হে, হে-,’ সবিনয়ে হাসল রামাদীন। তারপর বলল, ‘আমার
তরফ থেকে চেষ্টার ত্র“টি হবে না। কিন্তু বোঝেনই তো, মওসুম
প্রায় শেষ হতে চলেছে কিনা...’
‘যাল্ডেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাল্ডে টেলিগ্রাম করুন,’
বললাম ওকে।
কালক্ষেপ না করে দ্রুত জানতে চাইল রামাদীন, ‘টেলিগ্রামের
টাকাটা কে দেবে?’
চোখ গরম করে রামাদীনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে
চেয়ারের পিঠের সাথে সেঁটে গেল হাড়সর্বস্ব লোকটা। ‘ঠিক
আছে,’ বললাম, ‘আমিই èে।’
হে-হে করে হেসে দ্রুত কেটে পড়ল রামাদীন।
‘মন খারাপ কোরো না,’ চোখ মটকে বলল রডরিক। ‘স্টিল
আই লাভ ইউ, ম্যান।’
পিছু হটে ধপ করে আমার পাশের চেয়ারে পড়ল ল্যাম্পনি।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩৭
ব্যাপারটা লক্ষ করে ব্যস্ত হাতে টেবিল থেকে বোতল আর
গ−াসগুলো একপাশে সরিয়ে নিল রডরিক। ‘ধনল্টাদ,’ ঢুলু ঢুলু
চোখে রডরিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল ল্যাম্পনি, তারপর
টেবিলে মাথা নামিয়ে চোখ বুজল সে, এবং সাথে সাথে ঘুমিয়ে
পড়ল। চারদিক থেকে শকুনির মত এগিয়ে আসছে মেয়েরা, তাই
দেখে ল্যাম্পনির পকেট থেকে বেতনের টাকাটা বের করে নিয়ে
নিজের কাছে রেখে দিলাম আমি।
আরেক প্রস্থ মল্ডে অর্ডার দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় একটা গান
ধরল রডরিক। পিঠ, কোমর, কাঁধ, মাথা-সুরের সাথে বিচিত্র
বাঁকাচোরা ভঙ্গিতে আন্দোলিত হচ্ছে। এদিকে গালে হাত দিয়ে
চিন্তা করছি আমি।
পার্টি পাওয়া না গেলে আবার বোট নিয়ে নাইট ডিউটিতে
যেতে হবে আমাকে। প্রথম দিকে চোরাচালানের এই ঝুঁকিবহুল
পথে ইনফরমেশন জোগাড়ের আশায় যেতে হত। উদ্দেশ্য গোপন
রাখার জন্যে তালে তাল মিলিয়ে কিছু বল্টসাও করতে হত
আমাকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কাজ হাসিলের পদ্ধতি পানির
মত সহজ করে নিয়েছিলাম আমি। এখন আর নিশুতি রাতে নাইট
ডিউটিতে গিয়ে ইনফরমেশন সংগ্রহ করতে হয় না, এই দ্বীপে
বসেই কোথায় কি ঘটছে না ঘটছে সব জানতে পাবার নিখুঁত
বল্টস্থা করে নিয়েছি। এতে অবশ্য কিছু খরচ হয়, কিন্তু নির্ভেজাল
এবং গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
পার্টি পাওয়া না গেলে তাই যাব, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিয়ে
মনটাকে শান্ত করলাম। মাসুল্ডানা নাইট ডিউটিতে যেতে চায়,
কথাটা তাহলে প্রচার করে দিতে হবে আগ্রহী লোকল্ডে মধ্যে।
আরও একটা চুরুট ধরিয়ে রডরিকের সাথে গান ধরলাম।
কিন্তু একটু পর সন্দেহ হল দু’জনে একই গান গাইছি কিনা।
প্রতিটি বিরতিতে রডরিকের আগেই পৌঁছে যাচ্ছি আমি।
সম্ভবত দ্বৈত-সঙ্গীতের মধুর আকর্ষণেই বারে এসে ঢুকল স্বয়ং
৩৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আইন। সেন্ট মেরীতে আইন বলতে বোঝায় একজন ইন্সপেক্টর
এবং চারজন ট্রুপার। দ্বীপের প্রয়োজনের তুলনায় বাহিনীটাকে
বড়ই বলতে হবে। গত তিন বছর বউ-পিটুনির কদাচ দু’একটা
ঘটনা ছাড়া আর কোন অপরাধ আজ পর্যন্ত ঘটেনি।
ইন্সপেক্টর পিটার টালি একজন ব্রিটিশ, আরও পাঁচ বছরের
চুক্তিতে দ্বীপের পুলিস বাহিনী-প্রধানের চাকরিতে রয়ে গেছে।
আগামী বছর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে তার। দ্বীপের নাগরিক
সাব-ইন্সপেক্টরকে সবাই ইন্সপেক্টর হিসেবে চায়, তাই পিটার
টালির চুক্তির মেয়াèাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সেটা বুঝতে
পেরেই সম্ভবত গোলমাল আর অপরাধের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় সে
ডালকুত্তার মত, এবং কোথাও তেমন কিছু ঘটতে দেখলে কড়া
শাসনের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করে, যাতে সে চলে যাবার পরও
দ্বীপবাসীরা সহজে তাকে ভুলে যেতে না পারে।
ইন্সপেক্টর পিটার টালির মুখটা লাল, ঠোঁটের উপর কালো
রঙের চিকন গোঁফ, পরনে গাঢ় সবুজ রঙের ইউনিফর্ম।
সিলভারের ব্যাজ লাগানো ক্যাপের কার্নিসটা অস্বাভাবিক চওড়া।
তার হাতের আঠারো ইঞ্চি লম্বা ছড়িটার হাতল পালিশ করা চামড়া
দিয়ে মোড়া। ইউনিফর্মের গায়ে বুকের দু’দিকে, দশটা করে
পদক এবং মেডেল ঝুলছে। এগুলো সে পেয়েছে প্রেসিডেন্টের
তরফ থেকে, দ্বীপে কোন অপরাধ সংঘটিত হয়নি এই রিপোর্ট
লিখে।
‘মি. রানা,’ টেবিলের পাশে স্ফাড়িয়ে অপর হাতের তালুতে
ছড়ির হালকা বাড়ি মারছে ইন্সপেক্টর টালি। ‘আমি চাই না, আজ
রাতে দ্বীপে কোন গণ্ডগোলের সৃষ্টি হোক।’
‘মি. রানা, স্যার...’ কিভাবে আমাকে সম্বোধন করতে হবে
বলে দিলাম আমি। লোকটাকে দু’চোখে দেখতে পারি না। প্রতিটি
জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ঘুষ খায় সে। সুযোগ পেলে
আমার কাছ থেকেও খেতে ছাড়ে না।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৩৯
মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল ইন্সপেক্টরের। কিন্তু রাগ চেপে
রেখে আবৃত্তি করল সে, ‘মি. রানা, স্যার।’
‘ইন্সপেক্টর, এখানে আমরা কেউ মারামারি করছি না, ঠিক?’
‘হ্যাঁ...তা করছেন না।’
‘প্রকাশ্যে মধুর কণ্ঠে গান গাওয়া অপরাধ নয়, ঠিক?’ আবার
জানতে চাইলাম আমি।
‘হ্যাঁ...কিন্তু...’
দুম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিলাম টেবিলের উপর। ‘তাহলে
এখনও আপনি এখানে স্ফাড়িয়ে আছেন কেন? যান, কেটে
পড়ুন...’
আমার দেখাদেখি রডরিকও টেবিলের উপর ঘুসি তুলছে
দেখে তার হাত ধরে ফেললাম বাধা দিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললাম, ‘এটা
কারও মাথা নয়, বোকা। ভেঙে লাভ কি?’
একটা গোলমাল পাকাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি আমরা,
বুঝতে পেরে সাবধান হয়ে গেল ইন্সপেক্টর টালি। কাঙাল যেভাবে
তার ছেঁড়া কম্বল আঁকড়ে ধরে সেভাবে নিজের সম্মানটুকু আঁকড়ে
ধরে পিছিয়ে গেল সে, বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখবেন,
আপনার ওপর নজর রাখছি আজ থেকে।’ বলে ঘুরে স্ফাড়াল সে,
হন হন করে বেরিয়ে গেল বার থেকে।
খানিক পর ল্ডজায় আবার গোখলে রামাদীনকে দেখে
আরেক প্রস্থ পানীয়ের অর্ডার দিল রডরিক।
‘মিস্টার রানা, আপনার জন্যে একটা পার্টি পেয়েছি আমি।’
‘মিস্টার রামাদীন,’ বলল রডরিক, ‘আমরা তোমাকে
ভালবাসি।’
কিন্তু নাইট ডিউটিতে যাবার আর ল্ডকার হবে না বুঝতে
পেরে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল আমার। নাইট ডিউটিতে
বিপল্ডে ঝুঁকি আছে পুরোমাত্রায়, সেটুকু উপভোগ করে মজা
পাই। ‘কখন আসছে ওরা?’
৪০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
‘এসে গেছে। অফিসে ফিরে দেখি আমার জনেঞ্জপেক্ষা
করছে ওরা,’ বলল রামাদীন। ‘একটা পার্টির পূর্ব নির্ধারিত চুক্তি
বাতিল হয়ে গেছে এ-খবর জানে ওরা। আপনার নামটাও ওল্ডে
অজানা নয়। টেলিগ্রাফের সাথে ওরা বোধহয় একই পে−নে
এসেছে।’
অজ্ঞাত কারণে একটা পার্টি পিছিয়ে গেল, তার বদলে অন্য একটা পার্টি ঠিক সময়ে সরাসরি এসে হাজির, এর মধ্যে চিন্তার
খোরাক রয়েছে-কিন্তু অন্যমনস্ক ছিলাম বলে এ নিয়ে কিছুই
ভাবলাম না তখন।
‘হিলটনে উঠেছে ওরা,’ বলল রামাদীন।
‘ওল্ডেকে তুলে আনতে হবে?’
‘না। কাল সকাল দশটায় অ্যাডমিরালটিতে আপনার সাথে
দেখা করবে ওরা।’
তিন
ফ্লাইং ব্রিজে স্ফাড়িয়ে রেলিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়েছি। চোখে গাঢ়
রঙের পোলারয়েড গ−াস, জেটির উপর দিয়ে দৃষ্টি চলে গেছে ড্রেক
স্ট্রীটের দিকে। অবিরাম ছল-ছল-ছলাৎ বাজছে কানে, শন্ শন্
করছে বাতাস। মাঝরাত পর্যন্ত মদ খেয়েছি, নেশার ঘোরটা
পুরোপুরি কাটেনি এখনও।
ফোরডেকে স্ফাড়িয়ে হাত চালিয়ে কাজ করছে ওরা, একই
সাথে চলছে তুমুল ঝগড়া। দড়ির জট ছাড়িয়ে গুছিয়ে রাখছে
রডরিক, ল্ডল্ড করে ঘামছে সে-ঘাম তো নয়, যেন নির্ভেজাল
অ্যালকোহল বেরিয়ে আসছে তার লোমকূপ থেকে। আর একহারা
চেহারার ল্যাম্পনি রড ধরে হাঁটার সময় টলছে।
‘বস্ শালা দ্বীপে আসতেই না তোর কপাল খুলল,’ রডরিককে
আই লাভ ইউ, ম্যান
৪১
বলছে ল্যাম্পনি। ‘তার আগে তুই কি করতিস সবার জানা আছে।
মদ খেয়ে গরুর লাদার মত যেখানে-সেখানে পড়ে থাকতিস
বছরের মধ্যে নয় মাস। তোর চোদ্দপুরুষের ভাগ্য যে বস্ শালা
ক্রু হিসেবে তোকে চাকরি দিল, তা নাহলে আজও তুই...’
একটা হোয়েল বোট ছিল রডরিকের, আজ সেটা কোন
কাজেই লাগে না, মওসুমের সময় ওই হোয়েল বোট নিয়ে মাছ
শিকার করত সে। গোটা ভারত মহাসাগরে ওর মত দক্ষ শিকারী
আর একজনও আছে কিনা সন্দেহ। দুই মাসে যা মাছ ধরত, সারা
বছরের খোরাকি আর মল্ডে দাম উঠতে চাইত না, ধারে ডুবে
থাকত সে বাকি দশটা মাস। ল্যাম্পনি বাজে কথা বলছে না,
চব্বিশ ঘন্টা মদ খেয়ে টং হয়ে থাকত সে। শিকারী হিসাবে ওর
নাম শুনেই ওকে আমি চাকরি দিই জলকুমারীতে। সেই থেকে
রয়ে গেছে আমার সাথে।
‘আর তুই?’ হুঙ্কার ছেড়ে বলল রডরিক। ‘ছোকরাল্ডে হাতে
মার খেয়ে তো মরেই যাচ্ছিলি! ঠিক সেই সময় মাসুদ যত্থিল্ডে
ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ত, কাক শকুনের খাবার হয়ে যেতিস।
তোরও চোদ্দপুরুষের ভাগ্য যে মাসুদ তোর মত একজন
বখাটেকে চাকরি দিয়েছিল, তা নাহলে রঙবাজি করতে গিয়ে
অ্যাদ্দিন কবে মার খেয়ে মরে যেতিস।’
সাংঘাতিক ডানপিটে ছিল ল্যাম্পনি। রোগাপটকা হলে কি
হবে, বেজায় সাহস ছিল ওর। হুমকি দিয়ে সবার কাছ থেকে চাঁদা
তুলত। ছোকরা মেয়ে পটাতে ওস্তাদ, মেয়েরা ওকে ভালও
বাসে। বোধহয় ডানপিটে বলেই। আমি দ্বীপে আসার আগে কোন
কাজ করত না সে, দ্বীপবাসিনী মেয়েল্ডে নিয়ে ফুর্তি আর পকেট
খরচের জন্যে চোখ রাঙিয়ে চাঁদা তোলা ছাড়া। চাকরির প্রস্তাব
পেয়ে স্পষ্টভাবে আমাকে বলেছিল, ‘তুমি শালা কোথাকার বোকা
মাল হে? জীবনে একটা কুটো পর্যন্ত নাড়িনি, কাজ কাকে বলে
তাই জানি না-এমন লোককে চাকরি দিতে চাও কোন্ আক্কেলে?’
৪২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
কিন্তু কাজ শিখে নিতে তিন মাসের বেশি সময় লাগেনি
ল্যাম্পনির। এখন ও দক্ষ একজন ক্রু, যে-কোন বোট মালিক
ওকে লুফে নেবে। আগের চেয়ে অনেক বদলেছে ও, কিন্তু শালা
সম্বোধনটা ছাড়তে পারেনি। আমার প্রতি আন্তরিকতারই একটা
বহিঃপ্রকাশ এটা, আমি যে কিছু মনে করি না এতে-সেটা আবার
ঠিক বুঝতে পারে ও।
‘এবার তোমরা থামো,’ বললাম ওল্ডেকে। দেখতে পাচ্ছি,
ড্রেক স্ট্রীট কাঁপিয়ে দ্বীপের একমাত্র ট্যাক্সিটা ছুটে আসছে
এদিকে।
রাস্তার শেষ মাথায় এসে থামল ট্যাক্সি। আমার পার্টি নামছে।
দু’জন লোক। ভুরু কুঁচকে ভাবলাম, দু’জন কেন? তিনজনের
কথা বলেছিল রামাদীন।
কংক্রিটের চওড়া বাঁধের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে আসছে
ওরা। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে সিধে হয়ে
স্ফাড়ালাম আমি। তলপেটের ভিতরে মৃদু একটা শিরশিরে ভাব
অনুভব করছি। নেশার ভাবটা দ্রুত কেটে যাচ্ছে। একজন প্রায়
আমার মতই লম্বা, প্রফেশনাল অ্যাথলেটের মত সহজ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। মাথাটা খালি, ব্যাকব্রাশ করা ছাই রঙা
চুলের মাঝখানে গোল চাকতির মত অকালে টাক পড়েছে, ¤−ান
গোলাপী রঙের খুলি দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। ওজনে আমার চেয়ে
কিছু বেশি হবে, তবে কোমর এবং নিতম্ব সরু। আশ্চর্য একটা
হুঁশিয়ার ভাব রয়েছে লোকটার মধ্যে। দেখলেই চেনা যায় এই
জাতের লোকল্ডে। শক্তি আর ভয় দেখে এবং দেখিয়ে বেঁচে
থাকার ট্রেনিং রয়েছে এর। লোকটা আইনের পক্ষে না বিপক্ষে
সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা, যে কোন ভদ্রলোকের জন্যে সে
একটা সাংঘাতিক দুঃসংবাদ। সেন্ট মেরীর সুশান্ত পানিতে এই
জাতের হিংস্র ব্যারাকুডা আশা করিনি আমি। দ্রুত অন্য লোকটার
দিকে তাকালাম। এ-ও একই জাতের, তবে এর ধার কমে গেছে,
আই লাভ ইউ, ম্যান
৪৩
চর্বি আর মাংস জমে ভোঁতা হয়ে গেছে কিনারাগুলো, কিন্তু
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম-আরও একটা দুঃসংবাদ।
বয়স্ক লোকটাই লিডার, বুঝতে পারছি। লম্বা লোকটা সম্মান
দেখিয়ে এক পা পিছিয়ে আছে তার চেয়ে। চলি−শ ছুঁই ছুঁই করছে
বয়স, বেল্ট দিয়ে কষে বেঁধে ভুঁড়িটাকে দাবিয়ে রাখার বল্টস্থা
করেছে। পরনে দামি সুন্ধ। অনুমান করলাম গোল্ড রিঙে বসানো
ডায়মণ্ডটা দুই ক্যারেটের কম হবে না। রিস্টওয়াচটাও সোনার।
জেটি ধরে এগিয়ে এসে ঠিক আমার নিচে স্ফাড়াল লোকটা।
মুখ তুলে দেখল। কিন্তু হাসল না। ‘মাসুল্ডানা?’ কর্তৃত্বের সুরে
জানতে চাইল সে।
লোকটার চুলের রেখার কাছে প−াসটিক সার্জারীর ক্ষতটা
চিনতে পারছি আমি। তার মানে এটা তার চুরি করা চেহারা,
আসল চেহারাটা লুকিয়ে ফেলেছে। তথন্ধা মনে রাখলাম। এবং
মুহূর্তে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝলাম, এক পার্টি পিছিয়ে গেল,
সাথে সাথে আরেকটা পার্টি এগিয়ে এল-এটা কাকতালীয় ঘটনা
নয়। মগজ এবং পেশীর এই জোড়া মাণিককে কেউ পাঠিয়েছে,
উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন। এল্ডে ফোন এবং তারপরই একটা
সাক্ষাৎ পেলে যে-কোন সাধারণ শিকারীর মারলিন শিকার করার
সাধ সারা জীবনের জন্যে মিটে যাবারই কথা। ঘটেছেও হয়ত
ঠিক তাই। ‘মি. ব−্যাঙ্ক?’ বললাম আমি। ‘উঠে আসুন।’
পরিষ্কার বুঝতে পারছি আর যাই হোক, মাছ ধরতে আসেনি
এরা। এল্ডে সাথে স্পোর্টসের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।
লম্বা লোকটা লাফ দিল, বেড়ালের মত নিঃশব্দে নামল
ডেকের উপর। কোটের প্রান্ত বাতাসে ঝাপটা খেল তার,
ট্রাউজারের ফুলে থাকা পকেটটা দেখে ফেললাম, বুঝলাম খালি
পকেটে আসেনি এরা। আমাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে
একদিকের নাক টানল সে, তারপর এগিয়ে আমার ক্রুল্ডে সামনে
স্ফাড়াল। চিবুক তুলে মাথাটা একপাশ থেকে আরেক পাশে নিয়ে
৪৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
যেতে যেতে দ্রুত চোখ বুলাল ওল্ডে উপর।
ঠোঁট মুড়ে হেসে ক্যাপের কার্নিস ছুঁয়ে বলল ল্যাম্পনি,
‘ওয়েলকাম, স্যার।’ আর বিড়বিড় করে রডরিক যা বলল তা
আন্তরিক অভ্যর্থনা হলেও শোনাল ভয়ঙ্কর অভিশাপের মত।
নীরব তাচ্ছিলেশু সাথে ক্রুল্ডে দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল
লোকটা। এগিয়ে গিয়ে ডেকে নামতে সাহায্য করল বসকে,
তারপর কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সোজা গিয়ে ঢুকল
মেইন সেলুনে। একটু পর তাকে অনুসরণ করে ব−্যাঙ্কও ঢুকল
সেখানে। ঠিক তার পিছনেই রয়েছি আমি।
জলকুমারীর বিলাসবহুল মেইন সেলুনে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস
ছাড়ল ব−্যাঙ্ক। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে জোরে শ্বাস টানল সে,
এয়ারকণ্ডিশনের শীতলতায় ভরে নিল বুক। গদিমোড়া আরাম
কেদারায় গা ছেড়ে দিয়ে বডিগার্ডের পরিচয় জানাল আমাকে,
‘মাইক প্যানথার।’
ঘাড় ফেরাল না প্যানথার, ওল্ডে দিকে পিছন ফিরে
পোর্টগুলো চেক করছে, ল্ডজা খুলছে, অহেতুক এটা-সেটা
নাড়াচাড়া করছে-তার হাত দুটো অত্যন্ত অস্থির, এটাই যেন প্রমাণ
করতে চাইছে সে।
‘তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মি. প্যানথার,’
সুবোধ বালকের মাধুর্য ফুটে উঠল আমার নিঃশব্দ হাসিতে। কিন্তু
আমার দিকে এবারও তাকাল না প্যানথার, শুধু বাতাসে হাত
ঝাপটা দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল একবার। কোন গুরুত্বই
দিচ্ছে না সে আমাকে।
‘ড্রিঙ্ক, জেন্টলমেন?’ কেবিনেটের ল্ডজা খুলে জানতে
চাইলাম।
একটা করে কোক নিল ওরা। আমি নিলাম জিন। তারপর
গৎ বাঁধা সুরে শুরু করলাম, ‘এইটুকু বলতে পারি, আমার কাছে
এসে আপনারা ভুল করেননি। এই তো মাত্র গতকালই আমি
আই লাভ ইউ, ম্যান
৪৫
প্রকাণ্ড একটা মারলিন ঝুলিয়েছি জেটিতে। বড় মাছের সমস্ত
লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, দারুণ স্পোর্টস হবে...’
দশ সেকেণ্ড একদৃষ্টিতে লক্ষ করল আমাকে প্যানথার,
তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আমার সামনে স্ফাড়াল। ‘এর
আগে কোথায় দেখেছি তোমাকে?’
‘মানে?’
দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল প্যানথার, ‘মনে হচ্ছে, তোমাকে
আমি চিনি।’
‘অসম্ভব কি?’ কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। ‘তবে সভ্য জগৎকে
আমি অনেকদিন হল ডিভোর্স করেছি।’
হাসল না প্যানথার। আমার সামনের চেয়ারে ধীরে ধীরে
বসল সে। দু’জনের মাঝখানে টেবিলের উপর হাত দুটো উপুড়
করে রেখে ছড়িয়ে দিল আঙুলগুলো। সেই থেকে একই দৃষ্টিতে
দেখছে আমাকে। এ বড় কঠিন পাত্র, বুঝতে পারছি আমি।
‘আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে,’ সরল হেসে বললাম।
‘আমরা যদি মোজাম্বিক স্রোতে মাছ ধরতে চাই, সকাল ছ’টার
আগে হারবার ত্যাগ করতে হবে। কাল ভোরে...’
‘আগে এই তালিকাটা মিলিয়ে দেখ, রানা,’ আমাকে থামিয়ে
দিয়ে বলল ব−্যাঙ্ক, ‘তারপর বলো কি কি নেই তোমার কাছে।’
ব−্যাঙ্কের হাত থেকে এক শীট ফুলস্ক্যাপ কাগজ নিলাম আমি।
বল পয়েন্ট দিয়ে লেখা তালিকার উপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখি
সবগুলো স্কুবা গিয়ার এবং স্যালভেজ ইকুইপমেন্ট। পানির নিচে
থেকে কিছু উদ্ধার করতে চায় এরা, বুঝতে অসুবিধে হল না।
‘আপনারা তাহলে মাছ ধরার ব্যাপারে আগ্রহী নন?’ কৃত্রিম
বিস্ময়ের সাথে বললাম আমি। ‘সৌখিন স্যালভেজ...’
‘হুঁম। শখ করে এক-আধটু তল−াশি চালাতে এসেছি, তার
বেশি কিছু না।’
‘কিছু এসে যায় না,’ কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। ‘টাকার বিনিময়ে
৪৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
যা করতে বলবেন করব আমরা।’
‘তালিকার সব জিনিস তোমার আছে?’
‘প্রায় সব আছে। কিন্তু এয়ার ব্যাগ আর অতো দড়ি নেই।’
‘জোগাড় করো,’ আদেশ করল ব−্যাঙ্ক।
মাথা কাত করে রাজি হলাম আমি, জানতে চাইলাম, ‘কখন
রওনা হতে চান?’
‘কাল সকালে, আমাল্ডে সাথে আরেকজন থাকবে।’
‘পাঁচশো ডলার রোজ, রামাদীন নিশ্চয়ই বলেছে আপনাকে?
ইকুইপমেন্টের জনেঞ্জালাদা ভাড়া।’
মাথা ঝাঁকিয়ে ব−্যাঙ্ক বোঝাতে চাইল এসব তার জানা আছে।
সে উঠে স্ফাড়াতে যাচ্ছে দেখে বাধা দিলাম তাকে।
‘টাকার একটু চেহারা দেখলে খুশি হতাম,’ মৃদু গলায় বললাম
আমি।
স্থির হয়ে গেল ব−্যাঙ্ক। যেন লজ্জা পেয়েছি, এই ভঙ্গিতে
বললাম তাকে ‘মওসুমটা তেমন সুবিধে হয়নি, তাই হাত খালি।
অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে, ফুয়েল ট্যাঙ্কগুলো ভরতে
হবে...’
নিঃশব্দে মানিব্যাগ বের করল ব−্যাঙ্ক। পাঁচ পাউণ্ডের ষাটটা
নোট গুনে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বলল, ‘তোমার ক্রুরা
আমাল্ডে সাথে যাচ্ছে না, রানা। বোট চালাতে আমরা তিনজন
সাহায্য করব তোমাকে।’
চমকে উঠলাম। এটা আশা করিনি আমি। ‘কিন্তু সাথে না
নিলেও পারিশ্রমিক দিতে হবে ওল্ডেকে।’
এইবার কথা বলল মাইক প্যানথার। আমার দিকে ঝুঁকে এল
সে, বলল, ‘বসের কথা তোমার কানে গেছে, রানা। বজ্জাত
নিগ্রোগুলোকে কাল সকালে এই বোটে যেন দেখতে না পাই।’
পাঁচ পাউণ্ড নোটের বাণ্ডিলটা সাবধানে ভাঁজ করে বুক পকেটে
রেখে বোতাম লাগিয়ে দিলাম আমি, তারপর মুখ তুলে তাকালাম
আই লাভ ইউ, ম্যান
৪৭
ওর দিকে। এই প্রথম তার ঠাণ্ডা, স্থির চোখে একটা ভাব দেখতে
পাচ্ছি-পরিষ্কার প্রশংসার ভাব। নিজে সে সম্পূর্ণ তৈরি, এবং
বুঝতে পেরেছে ওর বেয়াড়া আচরণের পাল্টা জবাব èোর জনেঞ্জামিও তৈরি হয়ে গেছি। আমাকে এক হাত দেখিয়ে দিতে চাইছে
ও, যোগ্য প্রতিদ্বন্দ¡ীর নাক-মুখ থেঁতলে দিয়ে সুখ পেতে চাইছে।
টেবিলের উপর এখনও ফেলে রেখেছে হাত দুটো, তালু দুটো
নিচের দিকে, আঙুলগুলো ছড়ানো। অনায়াসে ওর সবক’টা আঙুল
এখুনি আমি মাঝখান থেকে মটমট করে ভেঙে দিতে পারি, সতর্ক
হবার কোন সুযোগই পাবে না ও। বোটের মতই প্রাণাধিক প্রিয়
আমার ক্রুরা। শুধু কর্মচারী নয়, ওল্ডেকে আমি বন্ধুর মর্যাদা
দিই। কেউ ওল্ডেকে অপমান করে আজ পর্যন্ত রেহাই পায়নি
আমার হাত থেকে। কিন্তু প্যানথারকে রেহাই দিলাম। ইচ্ছে
করলেই আমি পঙ্গু করে দিতে পারি ওকে বুঝতে পেরে মনটা
আমার খুশি হয়ে উঠল।
‘অ্যাই ছোকরা, আমি কি বললাম কানে গেছে?’ হিস হিস
করে উঠল প্যানথার।
ওকে শায়েস্তা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে, তার আগে
ওল্ডে উদ্দেশন্ধা জানতে হবে আমাকে, এই ভেবে মুখে টাঙিয়ে
নিলাম কাপুরুষের আপোসমূলক হাসি। ‘জ্বে আজ্ঞে, স্যার।
আপনাল্ডে টাকায় নাচব আমি।’
নিজের চেয়ারে হেলান দিল প্যানথার। খুশি হয়নি সে।
নিরাশার ছায়া দেখলাম ওর চেহারায়। ও একটা শক্তি, এবং
নিজেকে খাটানতেই ওর যত আনন্দ।
নিঃশব্দে আমাল্ডেকে লক্ষ করছে ব−্যাঙ্ক। কোন ভাব নেই তার
চেহারায়। এই মুহূর্তে কেউ খুন হয়ে গেলেও যেন ভাবের কোন
পরিবর্তন ঘটবে না সেখানে। আপাতত সংঘর্ষ বাধেনি দেখে
একটু নড়ে উঠল সে, তারপর আবার সেই নরম গলায় বলল,
‘তাহলে সেই কথাই রইল। সব সরঞ্জাম নিয়ে কাল আটটায়
৪৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
অপেক্ষা করবে তুমি আমাল্ডে জন্যে।’
চলে গেল ওরা। বসে বসে জিনটুকু শেষ করলাম আমি। এই
চার্টার পার্টি সম্পর্কে মেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। রডরিক এবং
ল্যাম্পনিকে না হয় এর মধ্যে না-ই জড়ালাম, ভাবতে ভাবতে
মেইন সেলুন থেকে বেরিয়ে এলাম।
‘কোন একটা গোপন উদ্দেশঞ্জাছে ওল্ডে,’ বললাম
ওল্ডেকে, ‘তোমাল্ডেকে বোটে নিতে চাইছে না।’
‘যা ভাল বোঝো করো,’ কাজ থেকে মুখ না তুলে বলল
রডরিক।
রিচার্জিংয়ের জন্যে ইঞ্জিনরূমে গিয়ে অ্যাকুয়াল্যাণ্ড বটলগুলো
এয়ার কমপ্রেশারে বসালাম আমি। জলকুমারীকে জেটিতে রেখে
নেমে এলাম সবাই। আমার তৈরি এয়ার ব্যাগের ড্রয়িং নিয়ে ওরা
চলে গেল ল্যাম্পনির বাপের ওয়র্কশপে। আর আমি গেলাম মা
এডির দোকানে।
চারটের দিকে এয়ার ব্যাগগুলো ডেলিভারি নিয়ে ককপিট
সিটের নিচে মেইন লকারে রেখে দিলাম। এরপর একটি ঘন্টা
ধরে স্কুবার ডিম্যাণ্ড ভাল্ভ এবং অন্যান্য ডাইভিং সরঞ্জাম পরীক্ষা
করলাম। সূর্যাস্তের সময় আমি একাই জলকুমারীকে নিয়ে গিয়ে
নোঙর করলাম, এবং বৈঠা চালিয়ে তীরে ফিরে আসার জন্যে ডিঙি
নৌকায় চড়তে যাবার ঠিক আগে একটা ভাল বুদ্ধি এল আমার
মাথায়। কেবিনে ফিরে এসে ইঞ্জিনরূম হ্যাচটা সরালাম আমি,
লুকানো জায়গা থেকে এফ-এন কারবাইনটা বের করে ব্রীচে
একটা কার্ট্রিজ ঢোকালাম। সিলিংয়ে আবার রেখে èোর আগে
রাইফেলটাকে অটোমেটিক ফায়ারে সেট করে সেফটি ক্যাচ অন
করে রাখলাম।
সন্ধ্যা নামতে একটু দেরি আছে এখনও। আমার পুরানো
কাস্ট নেট (ঝাঁকি জাল) টা নিয়ে খাঁড়ির উপর দিয়ে সন্তর্পণে
এগোচ্ছি মেইন রীফের দিকে। রঙিন ঘূর্ণিটা দূর থেকেই চোখে
আই লাভ ইউ, ম্যান
৪৯
পড়ল। দ্রুত চক্কর মেরে নেমে যাচ্ছে পানি, শেষ মুহূর্তের রোদ গর্তের গায়ে উজ্জ্বল তামাটে এবং আগুনের রঙ ফুটিয়ে তুলেছে।
কাঁধ এবং হাত ঝাঁকিয়ে জালটাকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিলাম উপর
দিকে। প্যারাসুটের মত ফুলে গেল সেটা, বড় একটা বৃত্ত হয়ে
পড়ল ঝাঁক বাঁধা মুলিটের উপর। লাইন টেনে জাল গুটিয়ে নিয়ে
দেখলাম এক হাত লম্বা পাঁচটা রূপালী মাছ কর্কশ ভিজে ভাঁজের
ভিতর তড়পাচ্ছে।
দুটো মাছ গ্রিল করে আস্তানার বারান্দায় বসে খেলাম।
পাহাড়ী ঝর্নার ট্রাউট -এর চেয়ে অনেক বেশি স্বাদ এগুলোর।
খাওয়া শেষ করে গ−াস ভর্তি হুইস্কি হাতে নিয়ে বসে থাকলাম
নিশ্চুপ অন্ধকারে।
সাধারণত এই রকম অন্ধকারে দ্বীপটা আমাকে আশ্চর্য এক
শান্তির কোমল ভাঁজে জড়িয়ে ফেলে, মনে হয় আমি যেন বুঝতে
পারি বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়। তবে এ রাতটা সেরকম
নয়। এই লোকগুলো যেন সাথে করে বিষ নিয়ে এসেছে দ্বীপে।
মেজাজ বিগড়ে আছে আমার। তবু রাগের নিচে, যখন আমি
নিজের সাথে কারচুপি করছি না, পরিষ্কার অনুভব করছি একটা
রোমাঞ্চকর উত্তেজনা, একটা উপভোগ্য গা ছমছমে ভাব। আবার
ঝুঁকি নেয়ার স্বাদ পাবার আশায় উন্মুখ হয়ে উঠেছি আমি। এখনও
জানি না কিসের বাজি লড়তে হবে আমাকে, তবে অনুমান করতে
পারছি সেটা দারুণ মজার কিছু, দারুণ ভয়ঙ্কর কিছু না হয়েই যায়
না। অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ আজ আবার আমি কঠিন পাত্রল্ডে
মুখোমুখি স্ফাড়িয়েছি।
নিভৃত, নির্জন অন্ধকারে নিজের সাথে একান্তে সময় কাটিয়ে
আমি যখন উঠলাম, চাঁল্ডে আলো মাখা ঢেউগুলো তখন সৈকতের
অনেক উপর পর্যন্ত উঠে আসতে শুরু করেছে। পাখা ঝাপটে উড়ে
গেল মাথার উপর দিয়ে জ্যোৎস্নায় নেশাগ্রস্ত একটা পাখি। ঘরে
যেতে মন চাইছে না, অনেকটা জোর করে নিয়ে গেলাম নিজেকে
৫০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
এবং বিছানায় শুয়ে অপাপবিদ্ধ শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়লাম
অঘোরে।
চার
কথার হেরফের হলো না, পরদিন সকালে কাঁটায় কাঁটায় আটটায়
এসে পৌঁছুল ওরা।
ইতিমধ্যে দুটো ইঞ্জিনই চালু করে দিয়েছি জলকুমারীর।
জেটির মাথার কাছে ট্যাক্সি থেকে নেমে হেঁটে এগিয়ে আসছে
ওরা, ফ্লাইং ব্রিজে স্ফাড়িয়ে দেখছি ওল্ডেকে। সমস্ত মনোযোগ
আমার দলের তৃতীয় লোকটার উপর। প্রথম দর্শনেই বুঝলাম,
এর জগতই আলাদা, ঘুঘু জোড়ার সাথে একেবারেই বেমানান।
ছেলেটা রোগা, লম্বা, মুখে প্রফুল− হাসি। সাদা চামড়া রোদে পুড়ে
তামাটে হয়ে গেছে, স্ফাতগুলো ঝকঝক করছে। সাদা শার্ট আর
সাদা প্যান্ট পরেছে সে। সাঁতারুর চওড়া কাঁধ, দেখেই চেনা
যাচ্ছে। হাত এবং পা জোড়া শক্তিশালী। ডাইভিং সরঞ্জাম কে
বল্টহার করবে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।
ছেলেটার বয়স আঠারো উনিশের বেশি নয়। এক দিকের
কাঁধে মস্ত একটা সবুজ ক্যানভাসের ব্যাগ ঝুলছে। বোঝা যাচ্ছে
খুব ভারী ওটা, কিন্তু অনায়াসে বয়ে আনছে সে। আর কি এক
খুশিতে হরদম কথা বলে যাচ্ছে। তার সঙ্গীল্ডে কদাচ ঠোঁট নড়া
দেখে বুঝতে পারছি হুঁ-হাঁ করে সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছে ওরা।
ছেলেটাকে দু’পাশ থেকে একজোড়া সেন্ট্রির মত পাহারা দিয়ে
নিয়ে আসছে যেন।
কাছাকাছি এসে মুখ তুলে তাকাল ছেলেটা, ওর চোখেমুখে
তারুণেশু প্রাণ- চাঞ্চল্য ছাড়াও রোমাঞ্চের তৃষ্ণা এবং সরলতার
ছাপ দেখতে পেলাম। ‘হাই,’ আমার উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে হাসছে
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫১
সে।
‘গ্রিটিংস,’ উত্তর দিয়ে হাসলাম আমিও। কিন্তু মনে মনে
ভাবছি হিংস্র নেকড়ের পালে এই হরিণের বাচ্চা এল কিভাবে?
আমার নির্দেশনায় নোঙর টেনে তুলল ওরা। কাজটা করতে
গিয়ে ওরা প্রমাণ করল এই ধরনের বোটের সাথে ছেলেটা ছাড়া
বাকি দু’জন পরিচিত নয়।
ব›ল্ড ত্যাগ করার পর ছেলেটাকে নিয়ে ফ্লাইং ব্রিজে উঠে এল
ব−্যাঙ্ক। ‘এর নাম নিরো,’ বলল সে।
সাগ্রহে বাড়িয়ে দেয়া নিরোর হাতটা ধরলাম আমি। শুকনো
এবং শক্ত লাগল ওর হাত। ‘এটা একটা ডারলিং বোট, স্কিপার,’
বলল সে, খুশিতে চিকচিক করছে চোখ দুটো। ‘কত লম্বা,
চুয়ালি−শ, নাকি পঁয়তালি−শ ফুট?’
‘পঁয়তালি−শ,’ ওর প্রতি আরও একটু খুশি হয়ে বললাম আমি।
‘নিরো তোমাকে অর্ডার করবে,’ ব−্যাঙ্ক জানাল আমাকে, ‘তুমি
ওর অর্ডার মেনে চলবে।’
‘চমৎকার,’ বললাম তাকে, তারপর নিরোর দিকে তাকালাম।
লাল হয়ে উঠল নিরোর চেহারা। ‘না, অর্ডার নয়, মি. রানা-
কোথায় যাব আমরা আমি শুধু তাই জানাব আপনাকে।’
‘বেশ। ঠিক সেখানেই নিয়ে যাব তোমাল্ডেকে আমি।’
‘দ্বীপটা ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে বাঁক নেবেন আপনি।’
আমি কিছু বলার আগেই ব−্যাঙ্ক জানাল, ‘উপকূল বরাবর
আফ্রিকান মেইন ল্যাণ্ড ঘেঁষে যেতে চাই আমরা।’
‘চান ভাল কথা,’ ব−্যাঙ্কের দিকে ফিরে বললাম, ‘কিন্তু ওদিকে
ওরা অনাহূত আগন্তুক দেখলে খেপে ওঠে, এ-কথা কেউ বলেনি
আপনাকে?’
‘তীরের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে থাকব আমরা।’
এক মুহূর্ত ইতস্তত করলাম আমি। ভাবলাম, জেটিতে ফিরে
গিয়ে এল্ডেকে নামিয়ে èে নাকি? ‘কোথায় যেতে চান,
৫২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
নদীমুখের উত্তরে না দক্ষিণে?’
‘উত্তরে,’ বলল নিরো।
উত্তরে হলে ভাল, ওদিকে কোস্টাল অ্যাকটিভিটি কম। একটা
মাত্র ক্রাশ বোট আছে জিনবালায়, কিন্তু সেটার ইঞ্জিন হপ্তায় বড়
জোর দু’একদিন ভাল থাকে এবং তীর বারাবর স্থায়ীভাবে তৈরি
বিষাক্ত পাম-রস খেয়ে ক্রুরা প্রায় সবাই উন্মাদ হয়ে থাকে। ক্রু
এবং ইঞ্জিন দুটোই যখন সুস্থ থাকে, ওল্ডে গতি ওঠে বড় জোর
ফিফটিন নট, আর আমার জলকুমারী আমি চাইলেই বাইশ নট
স্পীডে ছুটতে পারে।
কিন্তু নদীর দক্ষিণ এলাকায় হেলিকপ্টার নিয়ে পাহারা দেয়
কোস্টাল গার্ডরা, এবং নিজেল্ডে সমুদ্রসীমার ব্যাপারে সাংঘাতিক
স্পর্শকাতর ওরা।
আমার জনেঞ্জারেকটা সুবিধে হল, জলকুমারীকে নিয়ে আমি
উপকূল বরাবর পানিতে ডুবে এবং জেগে থাকা পাথরের
গোলকধাঁধার মাঝখান দিয়ে অন্ধকার ঝড়ো রাতেও অনায়াসে
যেতে পারব। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ক্রাশ বোটের কমাণ্ডার
এ ধরনের বীরত্ব দেখানর মধ্যে নেই। রোদ ঝলমলে প্রশান্ত
দিনেও জিনবালা বে-তে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে সে।
‘ঠিক আছে,’ ব−্যাঙ্ককে জানালাম আমি, ‘কিন্তু আপনি যা
চাইছেন তার জন্যে দৈনিক আড়াইশো ডলার বেশি দিতে হবে-
ডেঞ্জার মানি।’
‘সে ভয় আমিও করেছি-দেয়া যাবে, কি আর করা,’ নির্বিকার
চিত্তে বলল ব−্যাঙ্ক। বুঝলাম পানির মত টাকা খরচ করতে আপত্তি
নেই এই লোকের।
জলকুমারীকে ঘুরিয়ে অয়স্টার পয়েন্টে আলোর কাছাকাছি
নিয়ে এলাম। রোদ ঝলমলে স্নিগ্ধ আজকের সকালটা, পরিষ্কার
আকাশে স্থির হয়ে স্ফাড়িয়ে থাকা মেঘ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঝাঁক
বাঁধা দ্বীপগুলোর অবস্থান, চোখ ধাঁধানো কোমল সাদা পাহাড়
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫৩
সারি সারি মাথা তুলে আছে। সমুদ্রের উপর দিয়ে বয়ে আসা ট্রেড
উইণ্ডের স্বাভাবিক গতি আফ্রিকা মহাদেশে ধাক্কা খেয়ে ব্যাহত
হচ্ছে। ইনশোর চ্যানেলে এখানে আমরা ফিরে আসা সেই
বাতাসের ধাক্কা খাচ্ছি। এলোমেলো ভাবে দমকা বাতাস ছোবল
মারছে ¤−ান সবুজ পানিতে, উপরটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সাদা
ফেনায় ভরিয়ে তুলছে যতদূর দৃষ্টি যায়। খুব খুশি জলকুমারী,
লাফ মারার এবং পানির উপর তলা পর্যন্ত তুলে বাতাস কেটে
ছোটার একটা অজুহাত পেয়ে গেছে সে।
‘নির্দিষ্ট কিছু খুঁজছেন আপনারা, নাকি এমনি খুঁজছেন?’ কথার
পিঠে কথা বলার সুরে সহজভাবে জানতে চাইলাম। উৎসাহের
সাথে আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নিরো, বুঝলাম সবকথা
বলতে চাইছে সে।
উত্তেজিতভাবে মুখ খুলতে যাচ্ছে সে, এই সময় দ্রুত কথা
বলে তাকে থামিয়ে দিল ব−্যাঙ্ক। ‘এমনি খুঁজছি,’ ধমকের সুর
বেজে উঠল তার কণ্ঠস্বরে, সাথে সাথে খোলা মুখ বন্ধ হয়ে গেল
নিরোর।
‘এদিকের পানি আমার চেনা। প্রতিটি দ্বীপ, প্রতিটি রীফ
চিনি। আমি হয়ত আপনাল্ডে প্রচুর সময় বাঁচিয়ে দিতে পারি-তার
সাথে বেশ কিছু টাকাও।’
‘তুমি খুব ভাল ছেলে,’ সম্ভবত ঠিক উল্টোটা বোঝাতে চাইল
ব−্যাঙ্ক, অন্তত তার কর্কশ, রূঢ় কণ্ঠ¯ল্ফ শুনে তাই মনে হল।
‘ধনল্টাদ। আমরা নিজেরাই ম্যানেজ করতে পারব।’
‘তাহলে তো কথাই নেই,’ শ্রাগ করলাম আমি।
নিরোর উদ্দেশ্যে দ্রুত মাথা ঝাঁকাল ব−্যাঙ্ক, তারপর আধপাক
ঘুরে হেঁটে গেল ককপিটের শেষ প্রান্তে। নিরো তাকে অনুসরণ
করল। স্টার্ন রেইলের পাশে স্ফাড়িয়ে নিরোকে উদ্দেশ্য করে নিচু
শান্ত গলায়, কিন্তু জরুরী ভঙ্গিতে ঝাড়া দুই মিনিট কথা বলল
সে। নিরোর চেহারা থেকে উজ্জ্বলতা খসে পড়তে দেখলাম
৫৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আমি। আবার যখন ফ্লাইং ব্রিজে ফিরে এল সে, তার চেহারায়
রাগের ভাব দেখে একটু অবাকই লাগল আমার। বুঝলাম,
ছেলেটা একেবারে পুতুল নয়।
পরিষ্কার বোঝা গেল, মাথা, অর্থাৎ ব−্যাঙ্কের নির্দেশেই কেবিন
থেকে বেরিয়ে এসে ব্রিজের দিকে মুখ করে ফাইটিং চেয়ারে বসল
পেশী অর্থাৎ প্যানথার। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করা
একটা পা হাতলে তুলে দিয়ে বসে আছে সে, অথচ ভঙ্গিতে ফুটে
রয়েছে বিশ্রামরত নেকড়ের আক্রমণাত্মক ভাব। ওর চোখে চোখ
রেখে হাসলাম আমি, কিন্তু এক চুল নড়তে দেখলাম না ওর
চোখের পাতা। মুখেও কোন রেখা ফুটল না। অকস্মাৎ কেন যেন
মনে হল, মৃতুশু সমস্ত লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে ওর মধ্যে।
দ্বীপপুঞ্জের ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ হালকা সবুজ পানি কেটে
এগোচ্ছে জলকুমারী, পানির নিচে কিম্ভূতকিমাকার দৈত্য-দানবের
মত ডুব দিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে পাথরের পাঁচিল। প্রবাল
দ্বীপগুলো সাদা বালিতে ঢাকা, রোদ লেগে তুষারের মত চিক চিক
করছে। তার মাঝখানে গায়ে গা ঠেকিয়ে স্ফাড়িয়ে আছে গাছপালা,
সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে পামগুলো, বাতাসের ঝাপটা খেয়ে মাথা
দোলাচ্ছে।
দিনভর ব্যস্তভাবে একনাগাড়ে এগিয়ে চলল জলকুমারী, এর
মধেঞ্জভিযানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আভাস পাবার চেষ্টা করেছি
আমি। ব−্যাঙ্কের কথা শোনার পর থেকে নিরো এখনও গম্ভীর এবং
চুপচাপ। তার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে একটা বড়সড় স্কেল
অ্যাডমিরাল্টি চার্ট। সেটায় আমাল্ডে পজিশন কোথায় তাকে
দেখালাম, সে আমাকে কয়েকবার কোর্স বদল করতে বলল।
চার্টে বিশেষ কোন চিহ্ন না থাকলেও সেটার উপর বারকয়েক
নজর ফেলার সুযোগ পেয়ে বুঝে নিলাম রোভুমা রিভারের অসংখ্য মুখের পনেরো থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে এবং তীর থেকে ষোলো
মাইল পর্যন্ত দূরের এলাকা সম্পর্কে আমরা আগ্রহী। এই এলাকায়
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫৫
কয়েক একর থেকে শুরু করে কয়েক মাইল লম্বা আনুমানিক
তিনশো দ্বীপ আছে। বিশাল খড়ের গাদা থেকে ওরা একটা জং
ধরা ছোট্ট পিন খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে বলে মনে হল আমার।
ব্রিজে স্ফাড়িয়ে প্রিয়তমা জলকুমারীর হৃৎকম্পন উপভোগ
করছি আর সামুদ্রিক জীব ও পাখিল্ডে রকমসকম লক্ষ করছি,
বেশ ভালই কাটছে সময়টা। ফাইটিং চেয়ারে বসা প্যানথারের
মাথার পাতলা চুলের ভিতর টাকটা লালচে গোলাপী নিওন বাতির
মত জ্বলজ্বল করছে। এই এলাকার সূর্য সম্পর্কে ওকে সাবধান
করে èোর কথা মনে হল, কিন্তু চেপে গেলাম ব্যাপারটা।
পরদিন সারা গায়ে ঘামাচি ফুটল ওর, সারাটা দিন কষ্ট পেল
চুলকানিতে। মুখটা সমুদ্রগামী জাহাজের পোর্ট লাইটের মত
জ্বলছে।
দ্বিতীয় দিনের দুপুর নাগাদ একঘেয়েমিতে পেল আমাকে।
সঙ্গী হিসেবে নিরো একেবারেই অপরিণত, তাছাড়া আগের সেই
সহজ স্বচ্ছন্দ ভাব এখনও সে পুরোপুরি ফিরে পায়নি।
গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে এত বেশি সচেতন সে যে কফি
খাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করবে কি করবে না সিদ্ধান্ত নিতে ত্রিশ
থেকে ষাট সেকেণ্ড সময় নিচ্ছে।
ডিনারের জন্যে মাছ ল্ডকার আমার, তাই একটু সতর্ক হয়ে
লক্ষ রাখছি সমুদ্রের দিকে, এমন সময় সামনে একদল কিংফিশ
দেখলাম, সার্ডিনের বিশাল একটা ঝাঁকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
তাড়াতাড়ি হুইলটা নিরোকে দিয়ে বললাম, ‘সোজা করে ধরে
রাখো শুধু।’
ককপিটে নেমে এলাম আমি। তীক্ষè চোখে লক্ষ্য করছে
আমাকে প্যানথার। কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখি আমার ক্যাবিনেট
খুলে নিজের খুশি মত জিন আর টনিক বের করে এন্তার খেয়ে
চলেছে ব−্যাঙ্ক। এই দুই দিন কেবিন থেকে তার না বেরুবার কারণ
বোঝা গেল। দিনে সাড়ে সাতশো ডলার দিচ্ছে, সুতরাং কিছু
৫৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
বলতে গেলাম না ওকে। লকার খুলে একজোড়া ফিদার জিগ
বেছে নিলাম। ঝাঁকের পাশ দিয়ে যাবার সময় গেঁথে ফেললাম
একটা কিংফিশ। তড়পাচ্ছে, গায়ের সোনা রঙ ঝিলিক দিচ্ছে
রোদ লেগে। লাইন গুটিয়ে নিলাম আমি। তারপর আমার ভারী
বেইট নাইফের ফলা দিয়ে মাছটার লেজের নিচে থেকে কানকোর
নিচে পর্যন্ত চিরে ফেললাম, নাড়িভুঁড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম
পানিতে।
মাথার উপর একজোড়া সী-গাল ঘুর ঘুর করছিল, সাথে সাথে
তারা তীক্ষè গলায় চেঁচামেচি করে পানির দিকে ডাইভ দিল
আবর্জনা তোলার জন্যে। তাল্ডে চেঁচামেচিতে আকৃষ্ট হয়ে আরও
কয়েক জোড়া উড়ে এসে নরক গুলজার করে তুলল আমাল্ডে
পিছন দিকে।
ওল্ডে চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে, তবু পিছনের
মৃদু ধাতব শব্দটা ঠিকই শুনতে পেলাম আমি। অত্যন্ত পরিচিত
বলেই সম্ভবত শব্দটা ফাঁকি দিতে পারেনি আমাকে। অটোমেটিক
পিস্তলের ¯−াইড টেনে ছাড়া হল লোড এবং কক করার জন্যে।
সচেতনভাবে নয়, সম্পূর্ণ ঝোঁক আর সহজাত প্রবৃত্তির বশে বিদ্যুৎ
খেলে গেল আমার শরীরে। এক পলকে বড় বেইট-নাইফটা
আধপাক ঘুরে গেল আমার ডান হাতে। সেটাকে ছুঁড়ে মারার
জনেব্ধরেই শরীরের একটা মাত্র ঝাঁকিতে ঘুরে স্ফাড়িয়ে ঝপ করে
নামলাম ডেকের উপর। পায়ের পাতা আর বাঁ হাতের তালু দিয়ে
ব্রেক ফল করছি, ইতিমধ্যে পিছিয়ে গিয়ে ছুরিটা উঠে গেছে
আমার ডান কাঁধের উপর-টার্গেট বরাবর তাক স্থির হতেই ছুঁড়তে
যাচ্ছি সেটা।
ডান হাতে বড় একটা অটোমেটিক রয়েছে প্যানথারের।
ন্যাভাল পয়েন্ট ফরটি-ফাইভ, পুরানো পিস্তল, কিন্তু খুন করার
জন্যে তুলনা হয় না-বুকে লাগলে ফুটোটা এত বড় হবে যে
অনায়াসে একটা ফুটবল ঢুকে যেতে পারবে।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫৭
বেইট নাইফের লম্বা ফলা দিয়ে চেয়ারের পিঠের সাথে গেঁথে
যাচ্ছিল প্যানথার, কিন্তু দুটো কারণে নতুন জীবন লাভ করল সে।
এক, পয়েন্ট ফরটি-ফাইভটা আমার দিকে ধরা নয়। দুই, তার
গোলাপী মুখে সকৌতুক বিস্ময়ের ভাব।
প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে নিজেকে দমন করলাম। ধাতব শব্দ
শোনার পর মাত্র দুই সেকেণ্ড হয়েছে, আর এক সেকেণ্ডের
দশভাগের এক ভাগ যদি দেরি হয়ে যেত, ছুরিটা ছুটে যেত
আমার হাত থেকে।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছি। এখন ও বুঝতে পারছে
মৃতুশু কত কাছে চলে এসেছিল। রোদ পোড়া ঠোঁটে নিঃশব্দ
হাসিটা মলিন, জোর পাচ্ছে না। সিধে হয়ে স্ফাড়ালাম আমি, টোপ
কাটার বোর্ডে গেঁথে রাখলাম বেইট নাইফটা।
‘নিজের ওপর যদি ল্ডদ থাকে,’ শান্ত গলায় বললাম ওকে,
‘ওটা আর নাড়াচাড়া কোরো না আমার পিছনে।’
নিজেকে সামলে নিয়েছে প্যানথার, আত্মবিশ্বাসে জ্বলজ্বল
করছে চোখ দুটো। হা হা করে হাসল সে। রিভলভিং ফাইটিং
চেয়ারটা ঘুরিয়ে স্টার্নের দিকে লক্ষ্য স্থির করল, এবং ফায়ার
করল পর পর দু’বার। ইঞ্জিনের আওয়াজকে মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ
করে দিল বিস্ফোরণের শব্দ, আমার নাক ছুঁয়ে বাতাসে উড়ে গেল
করডাইটের গন্ধ। ডানা মেলা দুটো সী-গাল ছিন্নভিন্ন হাজার
টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শূন্যে, পালকগুলো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে
চিকন সুতোর মত উড়তে লাগল বাতাসে। আতঙ্কে আর্তনাদ ছেড়ে যে যেদিকে পারল দ্রুত উড়ে চলে গেল ঝাঁকের অন্যান্য সী-গাল। বুঝলাম এক্সপে−াসিভ বুলেট বল্টহার করেছে প্যানথার।
চেয়ার ঘুরিয়ে আবার আমার মুখোমুখি হল সে, ঠোঁটের কাছে
পিস্তল তুলে ফুঁ দিল মাজলে। তারপর বলল, ‘দেখো ছোকরা,
তোমাকে আমার চিনতে পারা উচিত, কিন্তু চিনতে পারছি না
কেন, বল তো?’
৫৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
‘দেয়ালে মাথা ঠোকো,’ বলে আমি ব্রিজ ল্যাডারের দিকে ঘুরে
স্ফাড়ালাম।
‘থামো!’ পিছন থেকে হিস হিস করে উঠল প্যানথার।
স্ফাড়ানো উচিত আমার, বুঝতে পারলাম। ইতিমধেদ্দর
পিস্তল ছোঁড়ার নৈপুণ্য এবং গোলমাল পাকানর ব্যগ্রতা লক্ষ
করেছি। কিন্তু তবু আমি ওর হুকুমে এখন আর স্ফাড়াতে পারি না।
সুবোধ বালকের খোলস একবার ঝেড়ে ফেলার পর সেই খোলসে
আবার গা ঢাকা দেয়া চলে না। প্যানথারকে এখন বুঝতে দেয়া
উচিত যে তাকে আমি গ্রাহ্য করি না। তা নাহলে মাথায় চড়তে
চেষ্টা করবে ও।
‘থামো!’
‘লাফ দিয়ে পানিতে পড়ো!’
একহাতে জিনের গ−াস নিয়ে এতক্ষণ কেবিনের ল্ডজায়
নিঃশব্দে স্ফাড়িয়ে ছিল ব−্যাঙ্ক। পাশ দিয়ে যাচ্ছি, ফিসফিস করে
কথা বলে উঠল সে।
‘এখন বুঝতে পারছি, তুমি কে! চেনা চেনা লাগছিল, অথচ
চিনতে পারছিলাম না বলে বড়ই বেচায়েন ছিলাম আমরা।’
স্ফাড়িয়ে পড়লাম। ব−্যাঙ্কের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি
নিঃশব্দে। আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেল তার দৃষ্টি। প্যানথারকে
বলল, ‘চিনতে পারছ এখন, প্যানথার?’ মাথা নাড়ল প্যানথার-
চিনতে পারছে না। ব−্যাঙ্ক আবার বলল, ‘এর ছবি দেখেছ তুমি।
কোথায় দেখেছ একটু ভেবে দেখ। তখন এর দাড়ি ছিল না।’
প্যানথার নিশ্চুপ। এখনও সে চিনতে পারছে না। ভুরু কুঁচকে
ভাবছে।
‘ডায়মণ্ড কেলেঙ্কারি!’ আবার বলল ব−্যাঙ্ক। ছ্যাঁৎ করে উঠল
আমার বুক। মেজর জেনারেল রাহাত খানের একটা নির্দেশের
কথা মনে পড়ে গেল। যে-কোন মূলেঞ্জামার আসল পরিচয়
গোপন রাখতে হবে। এটা জানাজানি হয়ে গেলে আমার প্রাণের
আই লাভ ইউ, ম্যান
৫৯
এক পয়সা মূল্য থাকবে না আর।
‘জেসাস!’ চেয়ার ছেড়ে উঠে স্ফাড়াল প্যানথার, ‘এইবার
চিনেছি!’ বিস্ময় এবং হিংস্র উল−াস প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।
‘গুরুদয়াল সিং!’
মই বেয়ে উঠে এলাম ব্রিজে।
‘দুঃখিত,’ নিরোর কাছ থেকে হুইল নেবার সময় আমাকে
বলল সে, ‘ওর কাছে পিস্তল আছে একথা আপনাকে আমার বলা
উচিত ছিল।’
দ্রুত চিন্তা করছি আমি। কার কাছে আমার ফটো দেখেছে
এরা? সিডনি শেরিডান? তার সাথে কিসের সম্পর্ক এল্ডে? খবর
পেলেই শেরিডান আমার বল্টস্থা করার জন্যে লণ্ডন থেকে হাত
বাড়াবে। বুঝতে পারছি এখনই বাধা দিতে হবে আমাকে। তা
দিতে হলে ব−্যাঙ্ক আর প্যানথারের বেঁচে থাকা চলে না। ঘাড়
ফিরিয়ে ককপিটের দিকে তাকিয়ে দেখি নেই ওরা। প্যানথারকে
নিয়ে নিচে নেমে গেছে ব−্যাঙ্ক।
এক আঘাতে একই সাথে দু’জনকে খতম করা তেমন কঠিন
নয়, অ্যাকসিডেন্ট বলে চালিয়ে দেয়াও সম্ভব। বয়স অল্প ছিল
বলেই এই ধরনের এসপার-ওসপার সিদ্ধান্ত নেবার কথা
ভাবছিলাম আমি...কিন্তু ওদিকে সিদ্ধান্তটা কার্যকরী করার জন্যে নিজের পুরোপুরি সমর্থনও পাচ্ছিলাম না।
নিরোর দিকে তাকালাম। নিঃশব্দে হাসছে সে। প্রশংসার সুরে
বলল, ‘চোখের পলকে যা দেখালেন! আর একটু হলে মাইক
কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিল।’
এই বাচ্চাটাকেও? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। ওল্ডে দু’জনকে
যদি যেতে হয়, একেও যেতে হবে, তা নাহলে বল্টস্থাটা কাঁচাই
থেকে যাবে। হঠাৎ সাংঘাতিক ঘৃণা হল নিজের ওপর। এসব কি
ভাবছি আমি? আমি খুনী নই, অথচ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার কথা
ভাবছি কেন?
৬০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
‘আপনি অসুস্থ, স্কিপার?’ দ্রুত জানতে চাইল নিরো। আমার
মুখের রঙ বদল দৃষ্টি এড়ায়নি ওর।
‘আরে না,’ বললাম ওকে। ‘আপত্তি না থাকলে আমাল্ডে
জন্যে দুই ক্যান ঠাণ্ডা বিয়ার নিয়ে আসতে পার তুমি।’
নিরোকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে ধীর-স্থির ভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম।
ওল্ডে সাথে রফা করব আমি। গোপন একটা উদ্দেশঞ্জাছে
ওল্ডে, শেষ পর্যন্ত আমার কাছে সেটা গোপন রাখতে পারবে না
ওরা। ওল্ডেকে বলব, আমার ব্যাপারে যদি মুখ বুজে থাকে,
আমিও ওল্ডে ব্যাপারে মুখ বুজে থাকব। নিচে ওরাও সম্ভবত এই
সিদ্ধান্তেই উপনীত হচ্ছে।
হুইলে তালা লাগিয়ে পা টিপে টিপে ব্রিজের শেষ প্রান্তের
দিকে এগোচ্ছি, নিচের কেবিন থেকে যাতে ওরা আমার পায়ের
শব্দ শুনতে না পায়। সেলুন টেবিলের উপর ভেন্টিলেটারটাকে
ভয়েস টিউবের বিকল্প বলা চলে, অনেক আগেই আবিষ্কার করেছি
যে নিচের কথাবার্তা বাতাসে চড়ে ঝাঁঝরি দিয়ে চমৎকার গলে
আসে। তবে পরিষ্কার শুনতে পাওয়াটা নির্ভর করে বাতাসের
বেগ, কেবিনে বক্তাল্ডে অবস্থান, আর তাল্ডে কণ্ঠস্বরের
তারতমেশু ওপর।
বাতাসের গর্জন যখন চাপা পড়ে যাচ্ছে না তখন নিরোর গলা
পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, সম্ভবত ভেন্টিলেটারের ঠিক নিচেই স্ফাড়িয়ে
আছে সে এবং কথা বলছে ওল্ডে দু’জনের চেয়ে জোরে।
‘স্কিপারকে এখুনি জিজ্ঞেস করছেন না কেন?’ বাতাসের তীব্র
শিসে চাপা পড়ে গেল উত্তরটা। আবার যখন শিস থামল, নিরোর
গলাই ভেসে এল ভেন্টিলেটার দিয়ে।
‘আজ রাতেই যদি কাজটা করতে চাই আমরা, কোথায়
আপনি...’ পরের কথাগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল বাতাস। ‘ভোরের
আলো পেতে হলে আমাল্ডেকে...’ গোটা আলোচনাটা সময় এবং
স্থান সম্পর্কে বলে মনে হচ্ছে। ভোরে হারবার ত্যাগ করে কি
আই লাভ ইউ, ম্যান
৬১
সুবিধে পেতে চাইছে ওরা ভাবছি, এই সময় আবার শুনতে পেলাম
নিরোর গলা, প্রতিবাল্ডে সুরে সে বলছে, ‘কেন? আমি তো
বুঝতে পারছি না অসুবিধেটা কোথায়...’ ঠিক এই সময় কড়া সুরে
কথা বলে উঠল ব−্যাঙ্ক, নিশ্চয়ই এগিয়ে এসে নিরোর সামনে
স্ফাড়িয়েছে সে, এবং সম্ভবত হুমকির ভাব ফুটিয়ে তুলেছে
চেহারায়।
‘দেখো, এদিকের এসব ব্যাপারে খবরদার মাথা গলাবে না
তুমি। তোমার কাজ জিনিসটাকে খুঁজে বের করা, সে-ব্যাপারে
ঘোড়ার ডিম কিছুই করতে পারনি তুমি এখন পর্যন্ত...’
দূরে সরে যাচ্ছে ওল্ডে গলার আওয়াজ, পরিষ্কার আর কিছুই
শুনতে পাচ্ছি না। একটু পরই ল্ডজা বন্ধ বা খোলার শব্দ
পেলাম। দ্রুত ফিরে এসে স্ফাড়ালাম হুইলের কাছে। এমনি সময়ে
ডেকের কিনারায় মাথা দেখা গেল নিরোর, মই বেয়ে উঠে আসছে
সে।
ওর বাড়ানো হাত থেকে বিয়ারের ক্যানটা নিলাম। আগের
চেয়ে সহজ লাগছে ওকে। হাসির মধেল্টন্ধুত্ব এবং বিশ্বাসের ভাব
রয়েছে। ‘মি. ব−্যাঙ্ক বলছেন আজ আর বেশিদূর গিয়ে লাভ নেই।
এবার আমরা ফিরে যাব।’
স্রোতের উপর দিয়ে জলকুমারীকে ঘুরিয়ে নিয়ে পশ্চিম দিক
থেকে এগোচ্ছি দ্বীপের দিকে। টার্টল বে-র মুখ পেরিয়ে এসে পাম
গাছের ভিতর দেখতে পেলাম আমার শান্তির নীড়টাকে। হঠাৎ
একটা ক্ষোভে ভরে উঠল আমার বুক।
নিজের সম্পর্কে সব সময় উঁচু ধারণা পোষণ করেছি আমি।
নিজেকে চিনি, নিজের যোগ্যতার পু´খানুপু´খ খবর রাখি বলেই
সম্ভব হয়েছে এটা। শারীরিক যোগ্যতা এবং চিন্তার স্বচ্ছতা
অর্জনের জন্যে জ্ঞান হবার পর থেকে কঠোর পরিশ্রম করেছি।
আমার আত্মবিশ্বাস কারও চেয়ে কম নয়, তার কারণ নিজেকে
মনের মত করে গড়ে তোলার কাজে কখনও ফাঁকি দিইনি আমি।
৬২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
সু›ল্ডভাবে বেঁচে থাকার জন্যে ভদ্র হওয়া একটা অলঙঘনীয়
শর্ত, সে চেষ্টাই করছি। বসুন্ধরা শক্তের ভক্ত, নিজেকে আমি
সেভাবেই গড়ে তুলেছি। উচ্চাশা ছাড়া মানুষের উত্তরণ ঘটে না,
তাই আমিও উচ্চাকাঙক্ষী। কিন্তু তিন বছর আগে প্রমাণিত হয়ে
গেছে এসব মিথ্যে এবং পণ্ডশ্রম মাত্র। দেশের প্রতি বুকভরা
ভালবাসা ছিল, সেজন্যেই সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম। দেশের
আরও বেশি সেবা করার সুযোগ পাব বুঝতে পেরে কাউন্টার
ইন্টেলিজেন্সের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি
হল? কোন অন্যায় করিনি আমি, অথচ মাথা পেতে নিতে হয়েছে
দ্বীপান্তরের শাস্তি। তবু যদি জানতাম দেশের মস্ত ক্ষতি করছে যে
লোকটা, সেই সিডনি শেরিডান উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে, এতটা
দুঃখ হত না। অপরাধী বেঁচে গেল, শাস্তি পেতে হল আমাকে-এটা
কেমন বিচার?
বুঝতে পারি, শেষ হয়ে গেছি আমি। আমার ক্যারিয়ার খতম,
উচ্চাশা খতম, দেশ সেবার কোন সুযোগ আর কখনও পাব না।
তিনটি অমূলল্টছর নষ্ট হয়েছে, আরও কত বছর নির্বাসনে
কাটাতে হবে জানি না। যখন দেশে ফিরব, যদি কখনও ফেরার
সুযোগ হয়, কি হয়ে ফিরব তখন আমি? কে আমায় বুঝবে? গিয়ে
দেখব বদলে গেছে সব কিছু, জুনিয়ররা অনেক ধাপ টপকে উঠে
গেছে ওপরে, আরও ভাল ট্রেনিং পেয়েছে তারা-তাল্ডে তুলনায়
অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমি। সন্দেহ নেই, এই রকম স্ফাড়াবে
পরিস্থিতি। সেক্ষেত্রে নতুন করে শুরু করতে হবে আমাকে। কিন্তু
তা কি সম্ভব?
না। সম্ভব নয় জানি বলেই দেশে ফেরার কথা আর ভাবি না।
বেশ তো আছি এই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সেন্ট মেরী দ্বীপে,
কি ল্ডকার বিড়ম্বনা বাড়িয়ে? ছোট্ট একটা ভুল করেছিলাম, ব্যস,
নির্মম রায় দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হল আমাকে-ভুল সংশোধনের
একটা সুযোগও দেয়া হল না। একটা মাস সময়ও যদি পেতাম,
আই লাভ ইউ, ম্যান
৬৩
আমি জানি, সিডনি শেরিডানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব তথ্য-
প্রমাণ জোগাড় করতে পারতাম আমি। কিন্তু সে সুযোগ আমাকে
দেয়া হয়নি।
চুপচাপ হজম করেছি অবিচারটা, এছাড়া কিছু করার ছিল না
আমার। তারপর একটু একটু করে মন বসিয়েছি স্বদেশ থেকে
হাজার মাইল দূরের এই বিদেশী দ্বীপে-বেশ আনন্দেই তো আছি।
কিন্তু ভাগ্যাকাশে আজ আবার দেখা দিয়েছে অশুভ কালো মেঘ।
আবার ভাবলাম, অশুভ বটে, কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এই
কালো মেঘের ওপারেই লুকিয়ে আছে ঝলমলে সুদিন, এই কালো
মেঘই বুঝি নিয়ে এসেছে অভিশাপ-মুক্তির একটা সুবর্ণ সুযোগ।
যত্থি আমার এই মনে হওয়ার পেছনে কোনই যুক্তি-প্রমাণ নেই।
কারা এরা? কে পাঠিয়েছে এল্ডেকে? কি খুঁজছে? কোথায়
দেখেছে আমার ফটো? এক এক করে অসংখ্য প্রশ্ন ভিড় করে
আসছে মনে। একটার উত্তরও জানা নেই আমার। আমার প্রতি
নিরোর ক্ষীণ একটু দুর্বলতা লক্ষ করেছি, সেটাকে কাজে লাগানো
যায় না? এই ভেবে ফিরলাম ওর দিকে।
চ্যানেলের ওপর দিয়ে গ্র্যাণ্ড হারবারের দিকে এগোচ্ছে
জলকুমারী। গুরুত্বহীন হালকা বিষয়ে কথা বলছি আমরা।
অনুমান করতে পারছি আমি, নেকড়েজোড়া তাল্ডে উদ্দেশ্য সবটা
প্রকাশ করেনি নিরোর কাছে। ছেলেটা সরল, বুঝতেই পারছে না
কি ভয়ঙ্কর প−্যান এঁটেছে ওরা। তাই এখনও স্বাভাবিক আচরণ
করতে পারছে ও। চতুরতা ওর ধাতে নেই, তাঁর প্রমাণও দেখতে
পাচ্ছি চোখের সামনে। নিরোর পুরো নাম সামরিক গুপ্ত-তথেশু
মত গোপন করে গেছে আমার কাছে ব−্যাঙ্ক, নিশ্চয়ই নিরোকেও
সতর্ক করে দিয়েছে সে, কিন্তু নিরো সতর্ক হতে পারেনি। তার
গলায় একটা সিলভারের চেন রয়েছে, তাতে একটা পিতলের
চাকতি ঝুলছে, চাকতিতে খোদাই করা রয়েছে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে একটা সতর্কবাণী ‘জে. এ. নিরোকে পেনিসিলিন দেয়া যাবে না’।
৬৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
চাকতিটা লুকিয়ে রাখার কথা মনেই পড়েনি নিরোর।
হালকাভাবে প্রশ্ন করে এক-আধ টুকরো তথ্য জেনে নিচ্ছি।
ভবিষ্যতে এগুলো কাজে লাগতেও পারে। আমার অভিজ্ঞতায়
বলেঃ অজ্ঞানতাই তোমার সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নিজেকে আরও যাতে মেলে ধরার ইচ্ছা জাগে ওর তাই এমন সব
বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলাম যা শুনে বিস্মিত এবং কৌতূহলী
হয়ে ওঠে ও।
‘চ্যানেলের ওদিকে ওই রীফটা দেখতে পাচ্ছ, যেখানে উথলে
পড়ছে স্রোতটা? ওটা ডেভিল ফিশ রীফ-বিশ ফ্যাদম খাড়া নেমে
গেছে সাগরের নিচে। বিশাল সব বুল গ্র“পারল্ডে আস্তানা ওটা।
ওখানে ওল্ডে একটাকে মেরেছিলাম গত বছর, ওজন ছিল দুশো
কিলোর বেশি।’
‘দুশো কিলো!’ সবিস্ময়ে বলল নিরো। ‘মাই গড, তার মানে
প্রায় সাড়ে চারশো পাউণ্ড!’
‘হ্যাঁ। তার মুখের ভিতর তোমার মাথা এবং কাঁধ দুটো
অনায়াসে ঢুকে যাবে।’
এর একটু পরই মুখ খুলল নিরো। ইতিহাস এবং দর্শন নিয়ে
পড়াশোনা করছিল সে কেমব্রিজে, কিন্তু সাগরের পিছনে বড় বেশি
লেগে থাকার ল্ড“ন লেখাপড়াটা ছাড়তে হয়েছে। এখন সে
ছোটখাট একটা ডাইভিং ইকুইপমেন্ট সাপ−াই কোম্পানি এবং
আণ্ডার ওয়াটার স্যালভেজ আউটফিটের মালিক। এ থেকে খেয়ে
পরে বেঁচে থাকার মত রোজগারও করছে সে, আবার হপ্তায় প্রায়
প্রতিদিনই ডাইভ দেয়ার সুযোগও পাচ্ছে। ব্যক্তিবিশেষের অর্ডার
নেয় সে। সরকার এবং নেভীর কিছু কাজ করার জনেদ্দ চুক্তি
করেছে।
দু’বার ‘রাফেলা’ নামটা উচ্চারণ করল ও। হালকাভাবে
জানতে চাইলাম, ‘কে? গার্লফ্রেণ্ড, নাকি ওয়াইফ?’
‘বোন, স্নেহময়ী বড় বোন-ও-ই তো বল্টসার মাথা, খাতাপত্র
আই লাভ ইউ, ম্যান
৬৫
সব ঠিকঠাক রাখে।’ আরও কিছু কথা বলল ও। ওর বোন নাকি
একজন কংকোলজিস্ট, সী-শেল থেকে বছরে দু’হাজার পাউণ্ড
রোজগার করে। কিন্তু নেকড়েল্ডে সান্নিধ্যে এল কিভাবে বা
নিজের স্পোর্টস শপ ছেড়ে দুনিয়ার অর্ধেকটা ঘুরে এখানে কেন
এসেছে সে-সম্পর্কে কিছু বলল না।
অ্যাডমিরালটি জেটিতে নামিয়ে দিলাম ওল্ডেকে। তারপর
সন্ধ্যার আগে রি-ফুয়েলিংয়ের জন্যে জলকুমারীকে নিয়ে চলে
গেলাম শেল বেসিনে।
পাঁচ
সেদিন সন্ধ্যায় কয়লার গনগনে আগুনে ধরে গ্রিল করে নিলাম
কিংফিশটাকে। আলুর চপগুলোকে ঠাণ্ডা বিয়ারে ধুয়ে নিয়ে
বসলাম বারান্দায়। পামগাছের ফাঁক দিয়ে সৈকতে দেখা যাচ্ছে
সাদা ফেনারাশি। সাগর যেন উন্মাতাল হয়ে উঠেছে আজ, বড়
বেশি তোলপাড় লক্ষ করছি। নাকি মনের অস্থিরতার জন্যে এমন
লাগছে? পামগাছের ফাঁকে হেডলাইট দুটোকে দেখে একটুও
অবাক হলাম না। জানতাম ওরা আসবে। গেটটা তাই খুলেই
রেখেছি।
ভিতরে ঢুকে ট্যাক্সিটা আমার পিকআপের পাশে থামল।
ড্রাইভারকে গাড়িতে রেখে নামল ওরা দু’জন। নিরোকে হিলটনে
রেখে এসেছে ওরা।
পিছনে প্যানথারকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এল ব−্যাঙ্ক।
‘ড্রিঙ্ক?’ সাইড টেবিলের বোতল আর বরফের দিকে ইঙ্গিত
করলাম আমি। নিজেল্ডে জন্যে দুটো গ−াসে জিন ঢালল
প্যানথার। আমার সামনের চেয়ারটায় বসল ব−্যাঙ্ক।
‘গেট খোলা, টেবিলে তিনটে গ−াস, বারান্দায় অতিরিক্ত একটা
চেয়ার,’ বলল ব−্যাঙ্ক, ‘তুমি জানতে আমরা আসব?’
৬৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
নিঃশব্দে হাসলাম শুধু।
আমার মাছ খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ব−্যাঙ্ক,
তারপর বলল, ‘কয়েকটা ফোন করে জানলাম বছর তিনেক আগে
আগস্ট মাসে লণ্ডন থেকে গায়েব হয়ে গেছে গুরুদয়াল সিং, সেই
থেকে তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। আরও কয়েক
জায়গায় খবর নিয়ে জানা গেল সেই বছরেরই সেপ্টে¤ল্ফ মাসে
অস্ট্রেলিয়া থেকে মাসুল্ডানা নামে এক লোক জলকুমারী নামে
একটা বোট নিয়ে এই দিকে এসেছে। বিশ্বস্তসূত্রে প্রকাশ
গুরুদয়াল সিং এবং মাসুল্ডানা নাকি একই ব্যক্তি। হাঁটুর উপর
একটা দাগ এবং ডান বাহুর উপর একটা বুলেটের আঁচড় নাকি
তাই প্রমাণ করে। এ ব্যাপারে তোমার কিছু বলার আছে, মাসুল্ডানা?’
‘কিচ্ছু বলার নেই।’ সরু, কালো একটা চুরুট ধরিয়ে ব−্যাঙ্কের
মুখের দিকে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লাম আমি।
ঝট করে আমাল্ডে দু’জনের দিকে পিছন ফিরে স্ফাড়াল
প্যানথার। তার রাগের কারণ বোঝা গেল এক মুহূর্ত পর।
‘ওস্তাল্ডে যত নরম কায়দা!’ চাপা স্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করছে সে।
‘এত করে বললাম প্রথমে ওর ক’টা স্ফাত ভাঙার সুযোগ দাও
আমাকে, তা না...’
‘তুমি বল্টসা বোঝ না,’ মৃদু কণ্ঠে বলল ব−্যাঙ্ক। তারপর
চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘বেশ
গুছিয়ে নিয়েছ দেখছি। আরামেই আছ তাহলে? কিন্তু দুই লাখ
পঁচিশ হাজার পাউণ্ড স্টার্লিংয়ের স্ফাও মেরে কি এর চেয়ে আরামে
থাকতে পারতে না? ভয় পেয়ে একেবারে এতদূরে, এই নির্জন,
গেঁয়ো জায়গায় পালিয়ে এসেছ!’
‘সিডনি শেরিডানকে সত্যি ভয় পাই,’ মৃদু কণ্ঠে বললাম
আমি।
কিন্তু টোপটা নিল না ব−্যাঙ্ক। এই নামের কাউকে চেনে সে-
আই লাভ ইউ, ম্যান
৬৭
ভাবই দেখাল না। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সুখ এবং শান্তির সংজ্ঞা
এক-একজনের কাছে এক-এক রকম-তুমি বোধহয় এখানে খুব
সুখেই আছ, কি বল?’
‘হ্যাঁ-তবে খেটে খেতে হয়।’
‘কিন্তু জেলখানায় ইঁট ভাঙা বা মাটি কাটার চেয়ে আরামে
আছ, অস্বীকার করতে পার?’
‘তা ঠিক।’
‘আমাল্ডে নিরো খোকা কাল তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবে।
সে যা জানতে চাইবে, চেপে না রেখে সব তাকে জানাবে তুমি,
রানা। তোমার কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা চাই আমি। কাজ শেষ
করে যখন চলে যাব, আমাল্ডে সাথে দেখা হয়েছিল একথা
সম্পূর্ণ ভুলে যাবে তুমি। আমরাও কাউকে বলব না কোথায় আছে
গুরুদয়াল সিং ওরফে মাসুল্ডানা। রাজি?’
‘সম্পূর্ণ,’ বললাম আমি। কিন্তু বুঝলাম, ওল্ডে কাজ শেষ
হবার আগেই আমি কিছু করে বসতে পারি ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ে
গেছে ওরা, সেজন্যেই আমাকে অভয় দিতে এসেছে। আপোস
রফার প্রস্তাবটা ভুয়া, ওরা ফিরে যাবার আগে স্থায়ীভাবে আমার
মুখ বন্ধ করার বল্টস্থা করবে, তা সে যেভাবেই হোক।
ভাবলাম কাল সকালে ওরা খুব ভোরে রওনা হতে চাইবে,
কিন্তু সে-সম্পর্কে কোন কথা না বলেই বিদায় নিল। ঘুম আসবে
না বুঝতে পেরে সৈকতে নেমে এসে হাঁটতে শুরু করলাম আমি।
বে-র বাঁকটা নিয়ে মাটন পয়েন্ট পর্যন্ত চলে এসেছি। ঝড়ে
ধরাশায়ী একটা গাছের চওড়া কাণ্ড কবে জানি গড়িয়ে নেমে
এসেছে সৈকতে, রাতে কখনও এদিকে এলে ওটার উপর বসি
আমি। আজ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম।
চারদিকে কোথাও কেউ নেই, সামনে উত্তাল সাগর, তার
উন্মত্ত বিলাপ আর বাতাসের আহাজারী। নিজেকে নিঃসঙ্গ আর
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হল আমার। কে আমি? কোথা থেকে এলাম,
৬৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
আর কোথায় যাব? নিখিল বিশ্ব...কোথায় এর শেষ? প্রশ্নের শেষ
নেই, কিন্তু কে দেবে উত্তর?
এক সময় ক্লান্তিতে চোখ বুজলাম আমি, তারপর আবার যখন
চোখ মেলে তাকালাম, তখন মধশুাত পেরিয়ে গেছে, পাম গাছের
মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে-গ্রাম, শিশুকাল, শিশির ভেজা মাঠ,
নকশী কাঁথা, পদ্মপাপড়ির মত মায়ের খোলা চোখ আর শোলক
বলা কাজলা দিল্ডি কথা মনে পড়ে গেল। ব্যথায় টনটন করে
উঠল বুকটা। উঠে স্ফাড়ালাম আমি। চাঁল্ডে আলোয় তাকিয়ে
দেখি উথালপাথাল সাগর আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে,
বলছে, চলে এসো, চলে এসো-আমিই তোমার আদি মাতা।
পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগেই জেটিতে পৌঁছুলাম। গিয়ে দেখি
ডিঙি নৌকাটা নেই সেখানে। ফেরীর ফোরম্যান হ্যামবোন
আমাকে তার ডিঙিতে তুলে নিল। নোঙর ফেলা জলকুমারী
অনেক দূরে কুয়াশায় ঢাকা। কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম ককপিটে
ঘোরাফেরা করছে পরিচিত একটা অস্পষ্ট মূর্তি।
‘হেই রডরিক,’ লাফ দিয়ে ডেকে নেমে বললাম, ‘বেগম বুঝি
ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তোমাকে?’
আমার দিকে ফিরেও তাকাল না রডরিক। দিনের আলো
এখনও ভালভাবে ফোটেনি, অথচ গোটা ডেক ঝকঝক করছে।
ধাতুর তৈরি প্রতিটি জিনিস মেজেঘষে আয়নার মত করে তোলা
হয়েছে। জলকুমারীকে আমার মতই প্রাণ দিয়ে ভালবাসে
রডরিক, মাঝেমাঝে সন্দেহ হয়, আমার চেয়ে বুঝি একটু বেশিই
ভালবাসে।
‘এটা কি একটা বারোয়ারী পেচ্ছাবখানা, মাসুদ?’ সাবান-
পানি দিয়ে ডেকটা দ্বিতীয়বার ধুচ্ছে রডরিক। ‘কেমন লোক
তোমার এই পার্টি, বোটের মর্যাদা বোঝে না! আরে, কোথায় পা
ফেলছ!’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৬৯
এগোতে গিয়েও থমকে স্ফাড়ালাম আমি।
‘পা মুছে তারপর যেখানে খুশি যাও,’ সতর্ক করে দিল
আমাকে। তারপর বলল, ‘তোমার জন্যে কফি তৈরি করে
রেখেছি, সেলুনে চলে যাও।’
তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম সেলুনে। বুঝলাম ঘন্টা দুই আগে
পৌঁছেচে রডরিক, সেই থেকে জলকুমারীকে দম ফেলার ফুরসত
দেয়নি।
খানিক পর সেলুনে এল ও। প্রকাণ্ড মুখটা থমথম করছে।
বুঝলাম কি যেন বলতে চায় আমাকে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ল্যাম্পনি কোথায়?’
‘রায়ানো বেওয়াল্ডে মনোরঞ্জন করছে,’ কর্কশ গলায় বলল
ও।
সমর্থ সব পুরুষল্ডে কর্মসংস্থানের বল্টস্থা নেই সেন্ট মেরীতে,
তাই তাল্ডে বেশির ভাগই রায়ানো দ্বীপে মার্কিন এয়ারফোর্স
বেস-এ তিন বছরের চুক্তিতে কাজ করতে যায়। যুবতী স্ত্রীল্ডে
রেখে যায় সেন্ট মেরীতে, রডরিকের ভাষায় এই সকল মেয়েরা
রায়ানো বেওয়া।
‘ল্যাম্পনিকে দু’ঘা লাগানো ল্ডকার তোমার, মাসুদ,’
চিন্তিতভাবে বলল রডরিক। ‘এভাবে চললে আমি বাজি রেখে
বলতে পারি ওর মগজ পচে যাবে। সেই সোমবার থেকে আজ
পর্যন্ত রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা এতেই মেতে আছে ও।’
ল্যাম্পনির ভাল-ম›েল্ড ব্যাপারে সব সময়ই উদ্বিগ্ন থাকে
রডরিক, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ একটু ঈর্ষার সুরও
লক্ষ করলাম।
আমি চুপ করে আছি দেখে প্রসঙ্গ বদল করল ও। জানতে
চাইল। ‘তোমার পার্টির লোকেরা কেমন?’
‘প্রচুর টাকা দিচ্ছে।’
কফির কাপ থেকে মুখ তুলে এই প্রথম আমার দিকে তাকাল
৭০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
রডরিক। বলল, ‘তোমরা মাছ ধরছ না, মাসুদ। কুলি পীক থেকে
লক্ষ্য করেছি আমি। চ্যানেলের ধারে-কাছেও যাও না। ইনশোরে
কি যেন করছ তোমরা।’
‘ঠিক ধরেছ, রডরিক,’ এরবেশি কিছু বললাম না আমি, কোন
প্রশ্নও করল না ও।
শুধু বলল, ‘এই, মাসুদ। ওল্ডে ওপর নজর রেখো। মেজাজ
গরম করবে না, আর ভুলেও অসতর্ক হবে না। মানুষ ভাল না
ওরা। ছোকরাটার কথা জানি না, কিন্তু বাকি দু’জন অসুবিধে।’
‘মনে রাখব তোমার কথা।’
‘গত বছর হোটেলে যে নতুন মেয়েটা এসেছে, মারিয়া, তাকে
তো তুমি চেন।’
ভুরু কুঁচকে উঠল আমার। শুধু সু›ল্ডী নয়, অত্যন্ত সাদাসিধে
আর সরল মেয়ে মারিয়া। দ্বীপের সবাই ওকে পছন্দ করে। ‘কি
হয়েছে তার?’
‘গত রাতের খবর এটা,’ বলল রডরিক। ‘লালমুখোটা
মারিয়াকে নিজের কামরায় নিয়ে গিয়েছিল।’
অতিরিক্ত দু’পয়সা কামাবার জন্যে হোটেলের কাজ সেরে
বাছাই করা কিছু বোর্ডারের মনোরঞ্জন করতে যায় বটে মারিয়া।
বললাম, ‘তাতে কি হয়েছে?’
‘লোকটা প্রচণ্ড মারধোর করেছে মারিয়াকে,’ কফি শেষ করে
পিরিচে ঠক করে কাপটা নামিয়ে রাখল রডরিক। ‘তারপর এত
বেশি টাকা দিয়েছে যে মারিয়া আর পুলিসের কাছে যায়নি।’
নিঃশব্দে শুনলাম কথাটা, কিন্তু প্যানথারের উপর রাগের মাত্রা
আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়ল আমার। মারিয়ার মত মেয়ের গায়ে
হাত তোলা শুধু কাপুরষতা নয়, চরম নীচতার পরিচয়।
‘লোক ভাল নয় ওরা, মাসুদ। এটা তোমার জানা উচিত বলে
মনে করি।’
‘ধনল্টাদ, রডরিক।’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭১
পরমুহূর্তে দপ করে জ্বলে উঠল রডরিক। ‘সাবধান-ফের যত্থিরা জলকুমারীকে নোংরা করে, তোমাকে ধরব আমি। সেলুন
আর ডেক হেগে-মুতে বিচ্ছিরি করে রেখেছিল-চোখ বুজে ছিলে
নাকি?’
জলকুমারীকে অ্যাডমিরালটি জেটিতে নিয়ে আসতে আমাকে
সাহায্য করল ও, তারপর গজ গজ করতে করতে নেমে গেল।
জানি, সারাটা দিন স্ত্রীর কাছে আমার নামে অসংখঞ্জভিযোগ
করবে ও আজ। জলকুমারীর দুর্দশা দেখলে মেজাজ ঠিক থাকে
না ওর।
রোদ উঠতে একা পৌঁছুল নিরো। ‘হাই, স্কিপার,’ ডেকে
লাফিয়ে পড়ে একগাল হাসল সে।
সেলুনে নিয়ে গিয়ে কফি খেতে দিলাম ওকে। ‘আমার কাছ
থেকে কি নাকি জানার আছে তোমার, সত্যি?’
‘দেখুন, মি. রানা,’ তার বক্তবঞ্জামাকে বিশ্বাস করাবার
জনেল্ট্যস্ততার সাথে বলল নিরো, ‘আরও আগে আপনার সাহায্য না চাওয়ার জনেঞ্জামি দায়ী নই। আমি ওল্ডেকে প্রথম থেকেই
বলেছি, স্কিপার ভাল মানুষ, তার সাহায্য নিতে পারি আমরা।
কিন্তু ওরা রাজি হয়নি। যাই হোক, আজ হঠাৎ ওরা আমার কথা
মেনে নিয়েছে।’
‘যাই হোক,’ অন্যমনস্কভাবে বললাম আমি। ভাবছি অন্য কথা। নিরোকে একা আসতে দিল কেন ব−্যাঙ্ক? এর একমাত্র
সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, নিরো মূলল্টান কিছু তথ্য নিজের কাছে
রেখে দিয়েছে, যা সে এখুনি ওল্ডে সাথে ভাগাভাগি করতে চায়
না। এই রহস্যময় তথ্যগুলোই নিরোর ইনশিওরেন্স। তাই আমার
সাথে আলোচনার সময় সাথে আর কাউকে নিতে চায়নি সে।
তারাও জোর খাটাতে পারেনি।
‘স্কিপার,’ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল নিরো, ‘আমরা
একটা দ্বীপ খুঁজছি, নির্দিষ্ট একটা দ্বীপ-কেন, তা আমি আপনাকে
৭২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
বলতে পারব না। দুঃখিত।’
‘কিছু এসে যায় না,’ ওকে জানালাম। কিন্তু মনে মনে
বললাম, ওল্ডে কাছ থেকে কি আশা কর তুমি, নিরো? সেই
নির্দিষ্ট দ্বীপে ওল্ডেকে একবার নিয়ে গেলেই তোমার প্রাণের শত্র“
হয়ে উঠবে ওরা, এ কথা কি একবারও ভাবছ না? সুদর্শন
চেহারার দিকে আরেকবার তাকালাম আমি। হঠাৎ অনভ্যস্ত স্নেহে
ছেয়ে গেল আমার বুক। সম্ভবত ওর সরলতাই এর কারণ।
দেখলাম রোমাঞ্চের উত্তেজনায় ছেলেটা একেবারে অন্ধ হয়ে
গেছে, ক্লান্ত বুড়ো দুনিয়াটা যে আসলে জায়গা হিসেবে খুব ভাল
নয় সে সম্পর্কে ওর কোন ধারণাই নেই।
‘কিছু যদি মনে না কর, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘একশোবার, স্কিপার-কি আবার মনে করব!’ উৎসাহ দিয়ে
বলল নিরো।
‘কতটুকু চেন তুমি ওল্ডেকে, নিরো?’
বিস্ময় ফুটে উঠল নিরোর চোখে, পরমুহূর্তে গম্ভীর হল সে।
‘ভালই চিনি,’ সাবধানে উত্তর দিল সে। ‘কেন?’
‘একমাসও হয়নি ওল্ডে সাথে পরিচয় হয়েছে তোমার,’
অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লাম, নিরোর চেহারা দেখে বুঝলাম ঠিক
জায়গাতেই গিয়ে লেগেছে সেটা। ‘কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে এ
ধরনের লোকল্ডেকে চিনি আমি।’
‘কিন্তু আপনার এসব কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না, মি.
রানা।’ ওকে ছেলেমানুষ ধরে নিয়েছি, এটা বুঝতে পেরে বিরূপ
হয়ে উঠেছে আমার ওপর।
‘শোন, নিরো। যে উদ্দেশ্যেই এসে থাক, ভুলে যাও সব।
তোমার ভালর জন্যেই বলছি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও তুমি।
এর মধ্যে তোমার কোন স্বার্থ রক্ষা হবে না।’
‘অসম্ভব,’ বলল নিরো। ‘আপনি এসব বুঝবেন না।’
‘বুঝি, নিরো। সত্যিই বুঝি। এই একই পথের এ মাথা থেকে
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭৩
সে-মাথা পর্যন্ত আসা যাওয়া করেছি আমি কয়েকবার, এর
ভালমন্দ সব জানি।’ এরপর কাতর কণ্ঠে বললাম, ‘তোমার কোন
ক্ষতি হোক, তা চাই না, নিরো। আমি হয়ত নিজেকে নিয়েই এত
ব্যস্ত থাকব যে তোমার দিকে খেয়াল দিতে পারব না...’
‘নিজেকে রক্ষা করতে জানি আমি। দয়া করে আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করবেন না।’ মুখটা লাল হয়ে উঠেছে ওর।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমরা। বুঝতে পারছি,
ভাবাবেগ এবং সময় দুটোই অযথা ব্যয় করছি আমি। ওর বয়সে
আমার সাথে কেউ যদি এভাবে কথা বলত তাকে আমিও অথর্ব
ভাবতাম।
‘ঠিক আছে, নিরো,’ মৃদু কণ্ঠে বললাম ওকে, ‘এ প্রসঙ্গে আর
কিছু বলছি না তোমাকে। কিন্তু একথা ঠিক তোমার কিছু হলে
খারাপ লাগবে আমার।’
‘ভাববেন না, কিছুই হবে না আমার।’ ধীরে ধীরে সহজ হয়ে
এল নিরো। সরল, সু›ল্ড হাসিতে ভরে উঠল আবার তার মুখ।
‘যাই হোক, অসংখব্ধনল্টাজ্ঝাপনাকে।’
‘দ্বীপটার কথা কি বলবে বল।’
কেবিনের চারদিকে তাকাল নিরো, তারপর প্রস্তাব করল,
‘চলুন, ব্রিজে যাই।’
খোলা জায়গায় এসে চার্ট টেবিলের উপরের শেলফ থেকে
একটা প্যাড আর এক টুকরো পেন্সিল টেনে নিল ও। ‘আমার
ধারণা, আফ্রিকার তীর ভূমির ছয় থেকে দশ মাইল দূরে, এবং
রোভুমা নদীর মুখ থেকে দশ থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে পাওয়া
যাবে দ্বীপটাকে।’
‘এ তো বিশাল একটা এলাকা, নিরো,’ বললাম ওকে। ‘শুধু
এটুকু জানলে ওটাকে খোঁজার কোন মানে হয় না-পাওয়া প্রায়
অসম্ভব। আর কি জানো বল।’
আমার চোখে চোখ রেখে কয়েক সেকেণ্ড ইতস্তত করল ও।
৭৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
তারপর মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল। অবশেষে মনস্থির করে
পেন্সিল দিয়ে প্যাডে একটা নিচু দিগন্তরেখা আঁকল। ‘সী-
লেভেল...,’ বলল ও, তারপর দিগন্তরেখাটার গা থেকে একটা
রেখা তুলে পাশাপাশি উঁচু-নিচু ভঙ্গিতে টেনে নিয়ে চলল, এবং
হঠাৎ রেখাটা উঠতে শুরু করল উপরদিকে খাড়াভাবে। রেখাটা
আবার নেমেও এল প্রায় খাড়াভাবে। এইভাবে তিনবার। স্পষ্ট
তিনটে পর্বতচূড়া এঁকেছে নিরো, বুঝতে অসুবিধে হল না। বলল,
‘কাঠামোটা সাগর থেকে এই রকম দেখতে হবে। পাহাড় তিনটে
ভলক্যানিক ব্যাসাল্ট, ঘাস বা গাছপালা নেই বললেই চলে,
শুধুমাত্র পাথর।’
‘ত্থিল্ড মেন...,’ ষ্ণে জোড়া বুড়োকে দেখেই চিনেছি
আমি। ‘কিন্তু হিসেবে ভুল আছে তোমার, নিরো। তীর থেকে
কমপক্ষে বিশ মাইল দূরে ওগুলো।’
‘কিন্তু মেইন ল্যাণ্ড থেকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে তো?’ দ্রুত জানতে
চাইল ও। ‘দৃষ্টিসীমার মধ্যে হতে হবে...’
‘তা হবে। পাহাড়ের মাথা থেকে অনেকদূর দেখতে পাওয়া
যায়।’
আমার চোখে চোখ রেখে প্যাড থেকে স্কেচ আঁকা কাগজটা
ছিঁড়ে নিল নিরো। সেটাকে টুকরো টুকরো করল যতেèর সাথে,
তারপর ফেলে দিল হারবারে। ‘নদী থেকে কতটা উত্তরে?’
‘ষাট থেকে সত্তর মাইলের মধ্যে।’
চিন্তিত দেখলাম নিরোকে। একটু পর মাথা ঝাঁকাল সে,
বলল, ‘হ্যাঁ, তাই হবে-তাই হওয়া উচিত,’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে
হাসল একটু। ‘মিলে যাচ্ছে। কিন্তু নির্ভর করছে কতক্ষণ লাগবে
আমাল্ডে...’ একটু থেমে প্রশ্নটা সরাসরি করল আমাকে,
‘...ওখানে আমাল্ডেকে নিয়ে যেতে পারবেন, স্কিপার?’
‘পারব। কিন্তু অনেক দূরের পথ। বোটে রাত কাটাবার জন্যে তৈরি হয়ে এলে সবচেয়ে ভাল হয়।’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭৫
‘ওল্ডেকে ডেকে নিয়ে আসছি,’ ব্যস্ত এবং উত্তেজিতভাবে
নেমে গেল নিরো। কিন্তু জেটিতে পৌঁছে ঘুরে স্ফাড়িয়ে ব্রিজের
দিকে তাকাল আবার সে। বলল, ‘দ্বীপটা সম্পর্কে...কি রকম
দেখতে বা কি নাম ইত্যাদি বিষয়ে ওল্ডে সাথে আলোচনা
করবেন না-ও. কে?’
‘ঠিক আছে, নিরো,’ আশ্বাস দিয়ে বললাম। ‘যাও তুমি।’
অ্যাডমিরালটি চার্ট দেখার জন্যে নিচে নেমে এলাম আমি।
ব্যাসাল্ট পাথরের শৈলশিরার মধ্যে দদ্দল্ড মেন পর্বতশৃঙ্গগুলো
সবচেয়ে উঁচু। আফ্রিকার মেইনল্যাণ্ডের সাথে সমান্তরালভাবে দীর্ঘ
দুশো মাইল বিস্তার এই রীফের। পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে
রীফটা, কিন্তু খানিক পর পর আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
ছড়ানো ছিটানো প্রবাল দ্বীপ, বালি-দ্বীপ এবং মগ্নচড়ার
বিশৃ´খলতার মধ্যে এর উপস্থিতি প্রকট। ত্থিল্ড মেন বসবাসের
অনুপযোগী। পানি নেই ওখানে। ওগুলোকে ঘিরে রীফের ভিতর
দিয়ে কয়েকটা গভীর চ্যানেল রয়েছে। যে এলাকা জুড়ে নিয়মিত
আসা যাওয়া আমার, তার চেয়ে অনেক উত্তরে জায়গাটা, তবে
গত বছর একদল বায়োলজিস্টকে নিয়ে ওখানে যেতে হয়েছিল
আমাকে।
ওল্ড মেনের উল্টো দিকের একটা দ্বীপে তিন দিনের জন্যে তাঁবু গেড়েছিলাম আমরা। ঘেরা খাঁড়িতে সব আবহাওয়ার
উপযোগী একটা অ্যাঙ্কোরেজ আছে ওখানে। পামগাছের মাঝখানে
জেলেরা একটা কুয়া তৈরি করে রেখেছে, লবণাক্ত হলেও তার
পানি খাওয়া যায়। অ্যাঙ্কোরেজে স্ফাড়িয়ে চ্যানেলের ওপারে দদ্দল্ড মেন-এর কাঠামো ঠিক নিরো যেভাবে এঁকেছে সেই রকম
দেখতে লাগে। সেজন্যেই দেখা মাত্র চিনতে পেরেছি আমি।
আধঘন্টা যেতে না যেতেই গোটা দল এসে হাজির। ট্যাক্সির
মাথায় রশি দিয়ে বাঁধা এবং সবুজ ক্যানভাস দিয়ে মোড়া
মোটাসোটা কিছু, হয়ত কোন ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছে। এটাকে
৭৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
বয়ে আনার জন্যে দ্বীপের দু’জন বেকার যুবককেও ধরে আনতে
ভুল করেনি। যার যার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এল্ডেকে অনুসরণ
করছে ওরা তিনজন।
ধরাধরি করে ফোরডেকে নিয়ে এসে নামিয়ে রাখল ওরা
ক্যানভাস মোড়া জিনিসটা। কিছুই জানতে চাইলাম না আমি।
প্যানথারের কপালে এবং নাকের পাশে আঁচড়ের কয়েকটা দাগ
লক্ষ করলাম। সাদা ক্রীম লেপে সেগুলোকে চাপা èোর ব্যর্থ
চেষ্টা করেছে ও। হোটেল হিলটনের মারিয়াকে মারধোর করেছে
ও, কথাটা ভুলিনি। মারিয়া আর কিছু না পারুক, নখ দিয়ে ওর
মুখ আঁচড়ে দিয়েছে বুঝতে পেরে একটু খুশি লাগল। চোখাচোখি
হতে হাসলাম আমি। ‘তোমাকে আবার মারল কে হে?’
আমার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে বসল প্যানথার
ফাইটিং চেয়ারে। জবাব দিল না দেখে আবার বললাম, ‘যা সু›ল্ড
লাগছে তোমাকে, ইচ্ছা করলেই বিশ্ব সু›ল্ডী প্রতিযোগিতায় নাম
লেখাতে পার।’
শেষ চুমুক দিয়ে খালি বিয়ারের ক্যানটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল সে,
একটানে পিস্তল বের করে টার্গেট প্র্যাকটিস করল। ফুটো ক্যানটা
ছিটকে চলে গেল জলকুমারীর বাইরে, তারপর পানিতে পড়ল।
আমার দিকে ফিরে নিঃশব্দে অর্থপূর্ণ হাসি হাসল সে। কথা বলল
না।
সারাটা পথ একের পর এক বিয়ার খেল সে, এবং প্রতিটি
ক্যানে গুলি লাগাল অব্যর্থভাবে।
দুপুরে নিরোকে হুইল দিয়ে ডেকের নিচে নামলাম। কেবিনেট
খুলে জিনের বোতল নিয়ে বসে আছে দেখলাম ব−্যাঙ্ক।
‘আর কতদূর?’ জানতে চাইল সে। হরদম মদ খাচ্ছে বলে
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে বসেও ঘামছে। এর জন্যে ভুগতে হবে
তাকে।
‘আর ষ্ণে-দুই ঘন্টা।’
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭৭
সুযোগ বুঝে নর্দার্ণ টাইড চ্যানেলের ভিতর দিয়ে যাবার প্রসঙ্গ
তুলে আরও তিনশো ডলার খসালাম ওর পকেট থেকে।
ঝাঁ-ঝাঁ রোদে সামনেটা ঝাপসা। ত্থিল্ড মেন-এর মাথা
তিনটে কালো ভূতের মুণ্ডুর মত বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে, চ্যানেলের ওপর
ঝুলছে যেন। চোখে বিনকিউলার তুলে চূড়া তিনটে পরীক্ষা করছে
নিরো, অনেকক্ষণ ধরে দেখার পর বিনকিউলার নামাল সে,
আমার দিকে ফিরে সানন্দে হাসল। ছুটে ককপিটে নেমে যাবার
আগে বলল, ‘মিলে গেছে, স্কিপার!’
ফোরডেকের উপর দিয়ে দ্রুত এগোল ওরা, ক্যানভাসে ঢাকা
কার্গোটাকে পাশ কাটিয়ে রেলিংয়ের সামনে স্ফাড়াল পাশাপাশি,
কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে। দ্বীপটার দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে
আছে।
উজান স্রোতের অনুকূলে চ্যানেল পেরোচ্ছে জলকুমারী, ঠিক
করেছি এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ওল্ড মেনের পুবপ্রান্তে
পৌঁছুবার চেষ্টা করব এবং সবচেয়ে কাছের চূড়াটার নিচের
সৈকতে বোট ভিড়াব। এই উপকূল ভরাজোয়ারের সময় সতেরো
ফুট তলিয়ে যায়, তাই অগভীর পানিতে যেতে নেই। বোকামি
করে কেউ যদি যায়, ভাঁটার সময় বোটের নিচ থেকে পানি সরে
যাবার পর আবিষ্কার করবে শুকনো জায়গায় উঠে বসে আছে তার
বোট।
আমার হ্যাণ্ড-বিয়ারিং কম্পাসটা চেয়ে নিয়ে নিরো সেটা
প্যাকেটে ভরল তার চার্ট, পানি ভর্তি থারমস আর এক বোতল
সল্ট ট্যাবলেটের সাথে। সন্তর্পণে বীচের দিকে এগোচ্ছি
জলকুমারীকে নিয়ে, ওদিকে নিরো আর ব−্যাঙ্ক জুতো ও ট্রাউজার
খুলে তৈরি হচ্ছে। সাদা বালিতে বোটের কীল ধাক্কা খেতেই
চিৎকার করে বললাম, ‘ও. কে.-নেমে পড়ো এবার।’
রেলিং টপকাল নিরো। মই বেয়ে নেমে যাচ্ছে সে। তাকে
অনুসরণ করছে ব−্যাঙ্ক। ওল্ডে বগল পর্যন্ত ডুবে গেল পানিতে।
৭৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
মাথার উপর হ্যাভারস্যাকটা তুলে নিয়ে বীচের দিকে এগোচ্ছে
নিরো।
‘দু’ঘন্টা!’ হাঁক ছেড়ে জানিয়ে দিলাম ওল্ডেকে। ‘তার বেশি
দেরি করলে তীরেই ঘুম দিয়ো। ভাটার সময় তোমাল্ডেকে
তুলতে আসব না আমি।’
হাত নেড়ে হাসল নিরো। জলকুমারীকে সাবধানে পিছিয়ে
আনার সময় দেখলাম পায়ে ট্রাউজার গলিয়ে নিয়ে পামগাছের
ভিতর দিয়ে হাঁটছে ওরা। একটু পরই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে
গেল।
স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানিতে দশ মিনিট ঘোরাঘুরি করে যা
খুঁজছিলাম পেয়ে গেলাম। পানির তলায় গাঢ় ছায়া মত দেখে
জলকুমারীকে স্ফাড় করালাম, নিচে নামিয়ে দিলাম একটা হালকা
নোঙর।
ভুরু কুঁচকে সারাক্ষণ লক্ষ করছে আমাকে প্যানথার। একটা
ফেস পে−ট আর একজোড়া দস্তানা পরে নিলাম। সাথে নিলাম
ছোট একটা নেট আর ভারী একটা টায়ার লিভার। রেলিং টপকে
মই বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখি যা
ভেবেছি তাই। রেলিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে প্যানথার আমার দিকে। ‘এ তোমার কম্ম নয়,’
বললাম ওকে। পানির চলি−শ ফুট নিচে একেবারে তলায় দৃষ্টি চলে
গেল আমার।
পানিতে ডুব দিয়ে এক দমে জাল ভর্তি ডাব্ল-শেল সান
ক্ল্যাম তুলে আনতে পেরে নিজের ওপর খুশি হয়ে উঠলাম আমি।
ফোরডেকে বসে খোলস ছাড়ালাম ওগুলোর, রডরিকের ভয়ে খালি
শেলগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে ধুয়ে ফেললাম ডেকটা। তারপর
কিচেনে গিয়ে মিষ্টি শাঁসগুলো একটা স্টু-পটে ওয়াইন, রসুন,
লবণ, কাঁচা মরিচ এবং সামান্য শুকনো মরিচ বাটার সাথে রেখে
দিলাম। গ্যাসের চুলোটা জ্বালাই ছিল, আগুন কমিয়ে পটটা
আই লাভ ইউ, ম্যান
৭৯
বসিয়ে দিলাম তাতে, এবং ঢাকনি চাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম
ডেকে। রেলিংয়ের কাছ থেকে ফিরে এসে আবার নিজের মসনèেসেছে প্যানথার। সিগারেট ধরিয়েছে একটা, কিন্তু মুখ দেখে
বোঝা যাচ্ছে মেজাজ ভাল নেই।
‘বল, মহারথী, কি অসুবিধে হচ্ছে তোমার?’ যেচে পড়ে
জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ‘খুব বুঝি নিরস লাগছে? লাথি মারার
জন্যে ছোট একটা মেয়ে পেলে খুশি হও?’
চোখ কুঁচকে তাকাল ও আমার দিকে, ভাবছে খবরটা পেলাম
কিভাবে। ‘মুখটা বেশি ফাঁক হয়ে গেছে তোমার, রানা। মনে
হচ্ছে সেলাই ল্ডকার।’
এ-ধরনের মিঠেকড়া বুলি বিনিময় চলল আমাল্ডে মধ্যে,
তাতে চমৎকারভাবে কেটে গেল সময়টা। একসময় দূর সৈকতে
দুটো মূর্তিকে দেখা গেল-চিৎকার করে এবং হাত নেড়ে দৃষ্টি
আকর্ষণের চেষ্টা করছে। নোঙর তুলে আবার সন্তর্পণে এগিয়ে
নিয়ে চললাম জলকুমারীকে।
বোটে উঠেই প্যানথারকে নিয়ে ফোরডেকে গোপন শলা-
পরামর্শে বসল ওরা। তিনজনই মহা উত্তেজিত, কিন্তু নিরো
একেবারে টগবগ করে ফুটছে। কথা বলছে চাপা স্বরে, কিন্তু
সবেগে হাত ছুঁড়ে আর মাথা ঝাঁকিয়ে চ্যানেলের দিকটা বারবার
দেখাচ্ছে সে। এই প্রথম কোন বিষয়ে ওল্ডেকে আমি একমত
হতে দেখলাম।
ওল্ডে বৈঠক যখন শেষ হল, আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি সূর্য
ডুবতে। আলোচনার ফলাফল আমাকে ওরা জানাল না, আমিও
কোনরকম কৌতূহল দেখালাম না। কিন্তু দাবির সুরে ব−্যাঙ্ক জানাল
আরও কিছুক্ষণ এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে হবে। সরাসরি
প্রত্যাখ্যান করলাম তাকে। বললাম, ‘রাজি নই আমি। অন্ধকারে
ভাটার মধেঞ্জাটকা পড়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।’
ব−্যাঙ্কের তাকিয়ে থাকাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চ্যানেল
৮০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
পেরিয়ে খাঁড়ির নিরাপজ্ঝ্যাঙ্কোরেজে নিয়ে এলাম জলকুমারীকে।
লাল টকটকে দিগন্তরেখার নিচে সূর্য ডোবার ঠিক আগেভাগে ভারী
দুটো নোঙর ফেলে বোটটাকে শান্ত করলাম, নিজেকে বিশ্রাম
èোর জন্যে দিনের শেষ এবং সন্ধ্যার প্রথম স্কচ নিয়ে বসলাম
ব্রিজে। নিচের সেলুনে আবার শুরু হয়েছে ওল্ডে আলোচনা।
উৎসাহ নেই, তাই আড়ি পেতে শোনার জন্যে ভেন্টিলেটারের
কাছে গেলাম না। খাঁড়ি পেরিয়ে মশাল্ডে প্রথম দলটা পৌঁছে
যখন কানের কাছে সুর ভাঁজতে শুরু করল, চেয়ার ছেড়ে উঠে
পড়লাম আমি, নিচে নেমে কেবিনে পা দিতেই আচমকা সবাই
মৌনব্রত অবলম্বন করল।
জুস, পাইন অ্যাপলের সালাড, বেক করা বীফ-এর সাথে স্টু-
প্যানের ক্ল্যাম মিশিয়ে পরিবেশন করলাম। চুপচাপ চার বোবায়
খাওয়া শেষ করলাম। সবশেষে শুধু নিরো একটা কথা বলল।
তার মৃদু কণ্ঠ ব্রাশ ফায়ারের মত বাজল কানে, নিস্তব্ধতা এমনই
জমাট বেঁধে গিয়েছিল কেবিনের ভিতর। ‘স্কিপার, আমার বোনের
চেয়ে কেউ ভাল রাঁধতে পারে এ আমি বিশ্বাস করতাম না-আজ
এক ধাপ নেমে গেল সে।’
বঙ্গ ললনাল্ডে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ‘আরেকটা èে’ কিনা
জিজ্ঞেস করলাম না, তবে নিঃশব্দে হাসলাম। ওর দিকে তাকিয়ে
বললাম, ‘তোমার বোনের রান্না তো তাহলে এক দিন খেয়ে
দেখতে হয়।’
এবার ব্রাশ ফায়ার নয়, কেবিনে বোমা ফাটতে শুরু করল।
হা হা করে হাসছে প্যানথার। তার এই হাসির কারণটা বুঝতে
অসুবিধে হয়নি আমার।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠলাম আমি। জলকুমারীর নোঙর চেক
করার জন্যে বেরিয়ে এলাম ডেকে। সব ঠিকঠাক আছে দেখে
নিয়ে ফিরতে যাব, এই সময় বাধা দিল আমাকে অকাতরে নেমে
আসা ধবধবে চাঁল্ডে আলো।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৮১
আমার চারদিকে অদ্ভুত এক মহিমায় উদ্ভাসিত রাতকে
দেখতে পাচ্ছি। জলকুমারীর গায়ে স্রোতের পরশ লেগে মৃদু কল
কল শব্দ উঠছে, আর অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে আউটার
রীফের গায়ে বিধ্বস্ত স্রোতের গুরুগম্ভীর বিস্ফোরণের আওয়াজ।
খোলা সাগর থেকে বিশাল বিস্তার এবং আকাশচুম্বী আকার নিয়ে
উন্মত্ত গতিতে ধেয়ে এসে বজ্রনির্ঘোষে আছাড় খাচ্ছে ঢেউ
গানফায়ার রীফের কঠিন প্রবাল প্রাচীরের গায়ে। যে-ই রেখে
থাকুক নামটা, অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। তলপেট কাঁপানো
বুম-বুম আওয়াজটা অবিরাম কামানের তোপ দাগার মতই
শোনাচ্ছে।
চাঁল্ডে আলো ঝলমলে রূপালী করে তুলেছে চ্যানেলটাকে,
আর ওল্ড মেন-এর বিশাল গম্বুজগুলোকে হাতির স্ফাতের মত
ধবধবে সাদা দেখাচ্ছে। ওগুলোর নিচে, খাঁড়ি থেকে মোচড় আর
পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে অশান্ত আত্মার মত রাতের
কুয়াশা।
অকস্মাৎ ক্ষীণ একটা শব্দ শুনে বিদ্যুৎবেগে আধ পাক ঘুরে
স্ফাড়ালাম। দুই হাত পিছনে স্ফাড়িয়ে আছে প্যানথার, শিকারী
চিতাবাঘের মত নিঃশব্দে আমাকে অনুসরণ করে এসেছে ও। শুধু
একজোড়া জকি শর্টস পরে আছে। চাঁল্ডে আলোয় শরীরটাকে
পেশীবহুল এবং চকচকে দেখাচ্ছে। লম্বা হাতে ধরা পয়েন্ট
ফরটি-ফাইভ অটোমেটিকটা ওর ডান ঊরুর পাশে। পরস্পরের
দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকলাম। ধীরে ধীরে ঢিল পড়ল
আমার পেশীতে।
‘পিছন থেকে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না তুমি,’
বললাম ওকে।
‘এখনও সময় আসেনি। যখন আসবে, সামনেই দেখতে
পাবে আমাকে,’ চাপা স্বরে, যেন গোপন পরামর্শ করছে আমার
সাথে, বলল ও। অটোমেটিকটা বুকের সামনে তুলল। ‘তখন
৮২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
তোমার আর আমার মাঝখানে থাকবে এই মহাজন।’ তারপর
নিঃশব্দে হাসল ও। চাঁল্ডে আলো লেগে ঝিক করে উঠল
স্ফাতগুলো।
ছয়
সূর্য ওঠার আগে ব্রেকফাস্ট সারলাম আমরা। কফি নিয়ে ব্রিজে
উঠে এলাম আমি। চ্যানেলের উপর দিয়ে খোলা সাগরের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছে জলকুমারী। নিচের সেলুনে সাত সকালেই মদ নিয়ে বসেছে ব−্যাঙ্ক, আর প্যানথার তার নির্দিষ্ট ঠিকানা ফাইটিং
চেয়ারে আশ্রয় নিয়েছে। আমার পাশে স্ফাড়িয়ে আজকের দিনের
প্রোগ্রাম ব্যাখ্যা করছে নিরো।
উত্তেজনায় ছিলা টেনে ধরা ধনুক হয়ে আছে ও, নাকে প্রথম
পাখির গন্ধ নেয়া তরুণ শিকারী কুকুরের মত কাঁপছে। ওল্ড মেন-
এর চূড়াগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর
বলল সে, ‘ওগুলোর কোনাকুনি অবস্থান এবং দূরত্ব মাপতে চাই
আমি, স্কিপার। আপনার হ্যাণ্ড বিয়ারিং কম্পাসটা বল্টহার করব।
যখন যেদিকে যেতে হবে সাথে সাথে জানাব আপনাকে।’
‘তার চেয়ে তোমার বিয়ারিং দাও আমাকে, নিরো। হিসেব
কষে আমিই তোমাকে নির্দিষ্ট স্পটে পৌঁছে èে।’
অপ্রতিভ দেখাল ওকে। এক সেকেণ্ড ইতস্তত করে পরামর্শটা
প্রত্যাখ্যান করল। বলল, ‘কাজটা আমার পদ্ধতিতেই হোক।’
বিরক্তি চেপে বললাম, ‘বেশ।’
সাথে সাথে দৌড়ে চলে গেল ও পোর্ট রেইলের কাছে।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৮৩
কম্পাস লেন্সের মধ্যে দিয়ে চূড়াগুলোকে দেখছে গভীর
মনোযোগের সাথে। দশ মিনিট পর আবার কথা বলল ও। ‘এখন
আমরা পোর্টের দিকে দুই পয়েন্ট ঘুরতে পারি, স্কিপার?’
‘পারি বৈকি,’ ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছি। ‘কিন্তু তার
ফলে গানফায়ার রীফের শেষ মাথার দিকে আটকা পড়ে যাবে
জলকুমারী-এবং ধাক্কা খেয়ে দু’ফাঁক হয়ে যাবে কীল।’
রীফের পেঁচানো গোলকধাঁধায় আরও দু’ঘন্টা চক্কর খেয়ে
অবশেষে একটা পথ তৈরি করে বেরিয়ে আসতে পারলাম খোলা
সাগরে। ঘুরপথে এখন আবার ফিরে যাচ্ছি পুব দিক থেকে
গানফায়ার রীফের কাছে পৌঁছুবার জন্যে।
ঠিক কোথায় পৌঁছুতে চাইছে তা বলছে না নিরো। একটু
একটু করে সুতো ছাড়ছে ও। ফলে গোটা সমস্যাটা একসাথে
দেখার সুযোগ নেই আমার।
বাইরের দিকে স্রোত এখানে সংগ্রামী জনতার বিশাল
মিছিলের মত এগোচ্ছে মেইন ল্যাণ্ডের দিকে। ক্রমশ উঁচু সাগর
তলের ঢালে বাধা পেয়ে তা ফুলে-ফেঁপে আরও শক্তিশালী হয়ে
উঠছে। দোল খাচ্ছে জলকুমারী, কিনারা ঘেঁষে আউটার রীফের
দিকে এগোচ্ছে সে, বারবার পাক খেয়ে স্রোতের দিকে ফেরার
প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে তার আচরণে।
প্রবাল প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে স্রোতের ধাবমান মিছিল
অকস্মাৎ ভয়ঙ্কর আক্রোশে বিস্ফোরিত হয়ে অসংখঞ্জাকাশছোঁয়া
স্তম্ভের আকারে উঠে যাচ্ছে উপর দিকে, উন্মত্ত গতিতে পাঁচিল
টপকে ওপারে গিয়ে আছাড় খাচ্ছে-তার গগনবিদারী আওয়াজ
কয়েক মাইল পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে বাতাসকে। নিচে চাপা পড়া
মিছিলের অংশটা ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, সাদা ফেনার
পাহাড়ে পরিণত হয়ে পিছিয়ে আসার সময় মুহূর্তের জন্যে দেখা
যাচ্ছে প্রাচীরের বিশাল কালো ফণার বিস্তার। ইতিমধ্যে সাগর
তলের ঢালে বাধা পেয়ে ফুলে-ফেঁপে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসতে
৮৪
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
শুরু করেছে পরবর্তী স্রোতের মিছিল।
নিরো আমাকে একটানা দক্ষিণ-ঘেঁষা দিক-নির্দেশ দিয়ে
যাচ্ছে, ক্রমশ রীফের কাছাকাছি কোন স্পটের দিকে পৌঁছুতে
চাইছে ও। লক্ষণ দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছি ওর লক্ষ্যস্থলের
খুব কাছে চলে এসেছি আমরা। কম্পাস-লেন্সের ভিতর দিয়ে
ব্যগ্রভাবে একবার একটা তারপর আরেকটা চূড়ার দিকে বারবার
তাকাচ্ছে নিরো।
‘বোট সোজা রাখুন, স্কিপার,’ কাঁপা গলায় আবেদন জানাল
ও। ‘ওই হেডিংয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান।’
ভয়াল প্রবালের দিক থেকে দৃষ্টি ছিঁড়ে কয়েক সেকেণ্ডের
জন্যে সামনে তাকালাম আমি। পিঠ উঁচু করে পরবর্তী স্রোতের
মিছিল হামলা চালাতে যাচ্ছে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল সেটা-
কিন্তু পাঁচশো গজ সামনের একটা সরু পয়েন্টে স্রোতটাকে ভেঙে
পড়তে না দেখে তীক্ষè হয়ে উঠল আমার দৃষ্টি। দেখলাম লাফ
দিয়ে শূন্যে না চড়ে স্রোতটা অখণ্ডভাবে ছুটছে ল্যাণ্ড-এর দিকে।
এর দু’দিকের প্রবাল প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হচ্ছে স্রোত,
কিন্তু মাঝখানের এই পয়েন্টে একটা ফাঁক দিয়ে নির্বাধায় প্রবেশ
করছে পানির তোড়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল রডরিকের একটা বর্ণনার কথা।
যেভাবে বলেছিল আমাকে, পরিষ্কার মনে পড়ে গেল আমার,
এখনও কানে বাজছে ওর উচ্চারণ ভঙ্গি।
‘বুঝলে, মাসুদ, উনিশ বছর বয়সে গানফায়ার ব্রেক-এর গর্ত
থেকে আমার প্রথম জু-ফিশ ধরি আমি। সেই থেকে আর কেউ
আমার সাথে মাছ ধরতে যেতে সাহস পায় না। দোষ নেই
ওল্ডে। গানফায়ার ব্রেকে যাবার মত বোকামি আমি নিজেও আর
করব না-এখন বুদ্ধি হয়েছে, ম্যান।’
গানফায়ার ব্রেক! হঠাৎ বুঝতে পারলাম জলকুমারীকে নিয়ে
গানফায়ার ব্রেক-এর দিকেই এগোচ্ছি আমরা। রডরিকের সম্পূর্ণ
আই লাভ ইউ, ম্যান
৮৫
বক্তবন্ধা স্মরণ করার চেষ্টা করছি আমি।
‘...জোয়ারের ঘন্টা দুই আগে খোলা সাগরের দিক থেকে
এগোচ্ছ তুমি, ফাঁকটার মাঝখান বরাবর সোজা রাখো তোমার
বোটের নাক, যতক্ষণ না প্রকাণ্ড একটা প্রবালের মস্ত মাথাকে
তোমার স্টারবোর্ডের সাথে সমান্তরাল ভাবে দেখতে পাচ্ছ।
দেখলেই চিনতে পারবে ওটা। যতটা পার গা ঘেঁষে পাশ কাটাও
ওটাকে, তারপরই বোটের নাক স্টারবোর্ডের দিকে দ্রুতবেগে
ঘুরিয়ে নাও-ব্যস! নিজেকে তুমি মেইন রীফের পিছনের গায়ে
নিখুঁতভাবে তৈরি বিশাল এক গর্তের ভেতর আবিষ্কার করবে।
যতটা গর্তের পিছনের দেয়াল ঘেঁষে থাকবে ততই নিরাপদ তুমি,
ম্যান...’ স্পষ্ট মনে পড়ছে সব, লর্ড নেলসনের পাবলিক বারে
বসে তার এই অভিজ্ঞতার কথা বলছিল রডরিক। সবাই বিস্ময়ে
বিস্ফারিত চোখে তার কথা শুনছিল। সেন্ট মেরী দ্বীপে একমাত্র
সে-ই দুর্জয় সাহসের পরিচয় দিয়ে গানফায়ার ব্রেক পেরিয়েছে।
‘যত ভারী নোঙরই ফেলো তুমি, তোমার বোটকে ওখানে ধরে
রাখতে পারবে না। বোটকে ফাঁকটার মধ্যে স্থির রাখার জন্যে স্টীল রডের বৈঠার উপর ঝুঁকে পড়তে হবে তোমাকেÑগানফায়ার
ব্রেকে গর্তটা গভীর, ম্যান, খুবই গভীর; আর জু-ফিশগুলো ওখানে
প্রকাণ্ড। একদিন তো আমি চারটে মাছ ধরলাম, সবচেয়ে ছোটটার
ওজন ছিল তিনশো পাউণ্ড। আরও নিতে পারতাম-কিন্তু সময় হয়ে
গিয়েছিল। জোয়ারের পর গানফায়ার ব্রেকে তুমি এক ঘন্টার
বেশি থাকতে পার না। পানি একবার নামতে শুরু করলে কার
বাপের সাধিদ্দখানে টেকে-সড়াৎ করে টান দেয় সাগর,
বিদ্যুৎবেগে সব পানি ব্রেক-এর মধ্যে দিয়ে লাফ মেরে পড়ে তার
পেটে। যে পথে ঢুকেছ সেই পথ দিয়েই বেরুতে হবে তোমাকে।
শুধু আগের চেয়ে একটু সাবধান হবে তুমি, কারণ ফেরার সময়
তোমার বোটে একটন মাছ আর তোমার কীলের নিচে দশ ফুট
কম পানি রয়েছে। রীফের পেছন দিকের একটা চ্যানেল ধরে
৮৬
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
বেরুবার আরেকটা পথ আছে বটে, কিন্তু ওটার কথা আমি এমন
কি আলোচনাও করতে চাই না। মাত্র একবার বল্টহার করতে
চেষ্টা করেছিলাম।’
নিরোর বিয়ারিং জলকুমারীকে এখন স্পষ্টই গানফায়ার ব্রেক-
এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
‘যথেষ্ট হয়েছে, নিরো,’ গম্ভীরভাবে বললাম ওকে। ‘এর বেশি
এগোচ্ছি না আমরা।’ থ্রটল খুলে দিলাম, কোর্স বদলে বোটের
নাক দিগন্তরেখার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর ফিরলাম নিরোর
দিকে।
‘এ আপনি কি করলেন!’ রাগে চেঁচিয়ে উঠল নিরো। ‘প্রায়
পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা-আরও একটু যেতে পারতাম না?’
‘তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে, নিরো?’ ককপিট থেকে হুঙ্কার
ছেড়ে জানতে চাইল প্যানথার।
‘না, ঠিক আছে সব,’ চেঁচিয়ে উত্তর দিল নিরো, তারপর ঝট
করে আমার দিকে ফিরে রাগে ফেটে পড়ল। ‘এ আপনার অন্যায়,
স্কিপার। আপনার সাথে চুক্তি হয়েছে...’
‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই, নিরো...’ চার্ট টেবিলে
নিয়ে গেলাম ওকে। অ্যাডমিরালটি চার্টে ব্রেক-এর কাছে পানির
গভীরতা উলে−খ করা হয়েছে ত্রিশ ফ্যাদম, কিন্তু এর কোন নাম বা
সেইলিং ইন্সট্রাকশন দেয়া হয়নি। ব্রেক থেকে ওল্ড মেনের সর্বোচ্চ
চূড়া দুটোর বিয়ারিঙে পেন্সিলের দাগ টানলাম দ্রুত, তারপর
প্রোট্র্যাক্টর (রের্মরটর্ডমর) দিয়ে মাপলাম সদ্য তৈরি কোণটাকে।
‘কারেক্ট?’ জানতে চাইলাম আমি।
আমার লেখা সংখ্যাটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে নিরো।
‘ঠিক ধরেছি, তাই না?’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল নিরো। ‘হ্যাঁ,’ বলল
ও, ‘ওখানেই যেতে চাই।’
গানফায়ার ব্রেক-এর কথা বিশেষভাবে জানালাম ওকে।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৮৭
‘কিন্তু ওখানে আমাল্ডেকে যেতেই হবে,’ আমি থামতেই
ব্যাকুল কণ্ঠে বলল ও, যেন আমার একটা কথাও কানে ঢোকেনি
ওর।
‘উপায় নেই, দুঃখিত,’ বললাম ওকে। ‘সেন্ট মেরী দ্বীপের
গ্র্যাণ্ড হারবার ছাড়া আর কোথাও যেতে আগ্রহী নই আমি।’ কোর্স
বদলে জলকুমারীর নাক সেদিকেই ঘুরিয়ে দিলাম। যতদূর বুঝতে
পারছি, চুক্তি বাতিল হয়ে গেল।
মই বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল নিরো। সদলবলে ফিরে এল
দুই মিনিটের মধ্যে। ব−্যাঙ্ককে অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখাচ্ছে, আর
রাগে ফুঁসছে প্যানথার।
‘একবার শুধু হ্যাঁ বলো, ওস্তাদ, তারপর দেখ বানচোতের
হাত ছিঁড়ে নিয়ে ভিজে দিকটা দিয়ে পিটিয়ে কেমন লাশ বানিয়ে
ফেলি!’ শার্টের আস্তিন গুটাচ্ছে প্যানথার।
‘ছেলেটা বলছে তুমি নাকি ফিরে যাচ্ছ?’ জানতে চাইল
ব−্যাঙ্ক। ‘এ তো ভাল কথা নয়!’
গানফায়ার ব্রেক-এর বিপদ্মা আবার একবার ব্যাখ্যা করলাম,
শুনেই চুপসে গেল ওরা।
‘আমাকে আপনি যতটা সম্ভব কাছাকাছি নিয়ে চলুন, বাকিটা
আমি সাঁতরে পেরোবো,’ আবেদন জানাল নিরো।
ব−্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, ‘সেক্ষেত্রে ওকে
আপনার হারাতে হবে। সে-ঝুঁকি নেবেন আপনি?’
উত্তর দিতে পারল না ব−্যাঙ্ক। জানি, নিরো তার কাছে পরশ
পাথরের মতই দামি। অন্তত এখনও।
‘চেষ্টা করে দেখতে দিন আমাকে,’ জেল্ডে সাথে বলল
নিরো।
অস্বস্তির সাথে এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ
করল ব−্যাঙ্ক।
‘ব্রেকে যদি ঢুকতে না পারি, অন্তত ¯ে−জের সাথে আমাকে
৮৮
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
একবার রীফ বরাবর টেনে নিয়ে চলুন,’ তখনও বলে চলেছে
নিরো। ফোরডেকে সবুজ ক্যানভাস মোড়া জিনিসটা কি এখন
বোঝা গেল। ‘রীফের সামনের কিনারা বরাবর ব্রেকে ঢোকার মুখ
ছাড়িয়ে মাত্র দু’বার টেনে নিয়ে গেলেই চলবে, আমি আর কিছুই
চাই না...’ করুণ সুরে ভিক্ষা চাইছে এখন নিরো।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ব−্যাঙ্ক। আমি জানি,
প্রবাল প্রাচীরের গা ঘেঁষে, মাত্র কয়েক গজ দূরে থেকে বোট
চালাতে পারব কোন ঝুঁকি না নিয়েই। কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ
মারার এই সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই আমার।
চেহারায় উদ্বেগ ফুটিয়ে তুললাম, তারপর বললাম, ‘সাংঘাতিক
ঝুঁকি নিতে হবে আমাকে,’ শ্রাগ করলাম, ‘ঠিক আছে, ডেঞ্জার
মানি পেলে...’
ডেঞ্জার মানি হিসেবে অগ্রিম দেয়া আরও পাঁচশো ডলার
খসিয়ে আনলাম ব−্যাঙ্কের পকেট থেকে। আমরা যখন বল্টসা
করছি, ফোরডেকে ক্যানভাসের আবরণ খুলে ¯ে−জটা বের করতে
নিরোকে সাহায্য করছে তখন প্যানথার। ধরাধরি করে ককপিটে
নিয়ে এল ওরা সেটাকে।
নোটের বাণ্ডিলটা সরিয়ে রেখে ফিরে এলাম আমি। টানার
জন্যে ¯ে−জটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে।
স্টেনলেস স্টীল আর প−াস্টিক দিয়ে তৈরি করা ¯ে−জটাকে
একনজর দেখেই বুঝলাম যতè, মেধা এবং টাকা কোনটাই কম
খরচ করা হয়নি এর পিছনে। স্নো রানারের বদলে এর রয়েছে
চোখা ফিন কন্ট্রোল, রাডার এবং হাইড্রোফয়েল, এগুলো অপারেট
করার জন্যে পাইলট শিল্ডের নিচে ছোট একটা জয়স্টিক দেখা
যাচ্ছে।
¯ে−জ-এর নাকে একটা আংটা পরানো রয়েছে, দড়ির একটা
প্রান্ত বাঁধা হবে ওটায়, অপর প্রান্তটা থাকবে বোটে, ¯ে−জটাকে
টেনে নিয়ে যাবে সে। ট্র্যান্সপারেন্ট শিল্ডের পিছনে চিৎ হয়ে শুয়ে
আই লাভ ইউ, ম্যান
৮৯
থাকবে নিরো, ¯ে−জের চেসিসে তৈরি করা জোড়া ট্যাঙ্ক থেকে
অক্সিজেন নেবে ও। ড্যাশবোর্ডে রয়েছে ডেপথ আর প্রেশার গজ,
দিক নির্দেশক কম্পাস আর টাইম ইল্যাপস্ ক্লক। জয়স্টিকের
সাহায্যে ডাইভের গভীরতা কন্ট্রোল করতে পারবে নিরো।
তাছাড়া প্রয়োজনে জলকুমারীকে সোজাসুজি অনুসরণ না করে
অনেকটা ডান বা বাম দিকে সরে যেতেও পারবে।
‘খুবই সু›ল্ড জিনিস,’ মন্তব্য করলাম।
একটু লজ্জা পেল নিরো। বলল, ‘ধনল্টাদ, স্কিপার-আমার
নিজের হাতে তৈরি।’
মোটা রাবারের সুন্ধ পরল নিরো। হুডটা আটকে নিচ্ছে
মাথায়। এই সুযোগে ঝুঁকে পড়ে ¯ে−জের চেসিসে মেজার’স
পে−টটা দেখে নিলাম আমিঃ
ইঁরষঃ নু ঘবৎড়'ং টহফবৎধিঃবৎ ডড়ৎষফ
৫ চধারষষরড়হ অৎপধফব
ইৎরমযঃড়হ, ঝঁংংবী
হুডের ফোকরে নিরোর মুখটা বেরিয়ে আসছে, এই সময়
সিধে হয়ে স্ফাড়ালাম আমি। একবার দেখেই নাম এবং ঠিকানা
মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।
‘¯ে−জ টানার জন্যে ফাইভ নট যথেষ্ট স্পীড, স্কিপার,’ বলল
ও। ‘রীফ থেকে আপনি যদি একশো গজ দূরত্ব বজায় রাখেন,
বাইরের দিক থেকে প্রবালের দেহরেখা অনুসরণ করতে পারব
আমি।’
‘ও. কে।’
‘পানির নিচে থেকে আমি যদি হলুদ মার্কার ছাড়ি, গুরুত্ব
দেবেন না-পরে ওটার কাছে আবার আমরা ফিরে যাব। কিন্তু
আমি যদি লাল মার্কার ছাড়ি, বিপদে পড়তে যাচ্ছি বলে মনে
করবেন-সাথে সাথে রীফ থেকে বের করে টেনে তুলে নেবেন
আমাকে।’
৯০
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম, ‘তিন ঘন্টা সময় আছে তোমার,’
সাবধান করে দিলাম ওকে। ‘ব্রেক-এর মধ্যে দিয়ে ভাটার পানি
নামতে শুরু করলে সরে যেতে হবে আমাল্ডেকে।’
‘তিন ঘন্টা যথেষ্ট সময়।’
আমি আর প্যানথার ধরাধরি করে বোট থেকে নামালাম
¯ে−জটাকে, খানিকটা ডুবে গিয়ে পানিতে ভাসছে সেটা। ব্যস্তভাবে
নেমে গেল নিরো। ¯ে−জে উঠে স্ক্রীনের পিছনে পজিশন নিল ও।
কন্ট্রোল পরীক্ষা করছে, শেষবারের মত অ্যাডজাস্ট করে নিচ্ছে
ফেস-পে−ট। তারপর অক্সিজেন ট্যাঙ্কের সাথে যুক্ত মাউথ পীসটা
মুখে পুরে নিয়ে বুড়ো আঙুল খাড়া করে সিগন্যাল দিল আমাকে।
দ্রুত ব্রিজে উঠে এসে থ্রটল খুলে দিলাম। বোটে গতি সঞ্চার
হল, সেই সাথে স্টার্নে স্ফাড়িয়ে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে মোটা
নাইলনের রশি ফেলে দিচ্ছে প্যানথার, ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে
¯ে−জটা। একশো পঞ্চাশ গজ রশি ফেলার একটু পর টান লেগে
ঝাঁকি খেল সেটা, তারপর জলকুমারীকে অনুসরণ করতে শুরু
করল ¯ে−জ।
আমাকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল নিরো। ধীরে ধীরে স্পীড
বাড়িয়ে ফাইভ নট পর্যন্ত তুললাম আমি। বিশাল একটা বৃত্ত রচনা
করে কিনারা ঘেঁষে এগোচ্ছি রীফের দিকে, বিশাল স্রোতের মিছিল
জলকুমারীর পেটে গুঁতো মারছে, বিপজ্জনকভাবে একদিকে কাত
হয়ে আছে সে।
আরেকবার হাত নাড়ল নিরো। ¯ে−জের কন্ট্রোল কলাম
সামনের দিকে ঠেলে দিল ও। ¯ে−জের কন্ট্রোল ফিন বরাবর
উথলে উঠল পানি, সাদা ফেনা দেখা যাচ্ছে আলোড়নের মধ্যে,
তারপর হঠাৎ ¯ে−জটা নাক নিচু করে ডুব দিল পানির নিচে। দ্রুত
এবং ঘন ঘন এদিক ওদিক সরে গিয়ে দিক বদল করছে
নাইলনের রশিটা, তারপর ¯ে−জটা একেবারে নিচে নেমে গেল,
রশিটা এখন দ্রুত সরে যাচ্ছে রীফের দিকে।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৯১
জোর টান পড়ায় রশিটা সদ্য গাঁথা তীরের মত কাঁপছে থরথর
করে, গা ঝাড়া দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে। রীফ-এর সাথে
সমান্তরালভাবে এগোচ্ছে জলকুমারী, ক্রমশ কাছে চলে আসছে
ব্রেক। প্রবালের দিকে সতর্ক, সমীহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি
আমি, সংঘর্ষের কোন ঝুঁকি নিচ্ছি না। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি
নিরোকে, পানির অনেক নিচে দিয়ে তলা ঘেঁষে নিঃশব্দে ছুটে
আসছে, এদিক ওদিক সরে যাচ্ছে দ্রুত জলমগ্ন প্রবাল
প্রাচীরগুলোকে এড়াবার জন্যে। সন্দেহ নেই, রোমাঞ্চ অনুভব
করছে নিরো। একটু ঈর্ষা হল আমার। ঠিক করলাম, সুযোগ
পেলে ওই ¯ে−জে চাপব একবার।
ব্রেক-এর উল্টোদিকে এলাম আমরা, পাশ কাটালাম, এবং
ঠিক তখুনি প্যানথারের চিৎকার শুনতে পেলাম আমি। দ্রুত
স্টার্নের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখি পিছনে ফেলে আসা বোটের
তৈরি মসৃণ পানিপথে বড় একটা হলুল্ডঙের বেলুন ভেসে
উঠেছে। রশির মাথায় ভাসছে ওটা, শেষ প্রান্তের ভারী সীসাটা
তলায় পড়ে আছে।
‘পেয়েছে! কিছু পেয়েছে!’ চিৎকার করছে প্যানথার।
রীফের সাথে সমান্তরালভাবে আরও সিকি মাইল এগিয়ে
এলাম আমরা। এই সময় নাইলনের রশিতে ঢিল পড়ল এবং
অশান্ত পানির উপর মাথা তুলে ভেসে উঠল ¯ে−জটা।
রীফের দিকে পিছন ফিরে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে আনলাম
বোট, তারপর ¯ে−জটাকে তোলার জন্যে প্যানথারকে সাহায্য করতে নিচে নেমে এলাম।
ককপিটে উঠে এল নিরো। ফেস-পে−ট খুলে ফেলতেই
দেখলাম ঠোঁট জোড়া অদম্যভাবে কাঁপছে ওর, চোখ দুটো বিস্ময়
এবং আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। ব−্যাঙ্কের কব্জি চেপে ধরে নেশাগ্রস্ত
মাতালের মত তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল কেবিনের ভিতর।
রডরিকের প্রিয় ডেকটাকে সাগরের পানিতে একেবারে নাইয়ে দিল
৯২
মাসুল্ডানা-৭৮+৭৯+৮০
ও।
আমি আর প্যানথার রশি গুটিয়ে ¯ে−জটাকে তুলে নিলাম
ককপিটে। এরপর ব্রিজে ফিরে এলাম আমি, কোর্স বদলে মন্থর
গতিতে ফিরে যাচ্ছি গানফায়ার ব্রেক-এর মুখের দিকে।
ওখানে পৌঁছুবার আগেই ব−্যাঙ্ক আর নিরো উঠে এল ব্রিজে।
এখন ব−্যাঙ্ককেও সাংঘাতিক উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
‘ছেলেটা এবার একটা উদ্ধার প্রচেষ্টা চালাতে চায়।’
কি উদ্ধার করবে নিরো তা আর আমি জিজ্ঞেস করলাম না।
শুধু জানতে চাইলাম, ‘সাইজ কি?’ তারপর হাতটা চোখের সামনে
তুলে রিস্টওয়াচ দেখলাম। ব্রেক থেকে পানি বেরিয়ে আসা শুরু
হতে ষ্ণে ঘন্টা বাকি আছে আর।
‘খুব বড় নয়...’ আশ্বাস দিয়ে বলল নিরো। ‘পঞ্চাশ পাউণ্ড,
তার বেশি হবে না।’
‘ঠিক জানো?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম। ‘ওজন বেশি
হলে...’
‘বেশি নয়, যীশুর কিরে...’
‘জিনিসটা যাই হোক, ওটায় তুমি এয়ারব্যাগ বাঁধতে চাও,
তাই না?’
‘হ্যাঁ। এয়ারব্যাগের সাহায্যে পানির ওপরে তুলতে চাই,
তারপর রীফ থেকে টেনে নিয়ে আসা যাবে।’
ব্রেক-এর চোয়ালের কাছে লাফালাফি করছে হলুদ বেলুনটা।
অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বোট নিয়ে এগোচ্ছি ওটার দিকে। ‘আর
এগোচ্ছি না আমি,’ আমার চিৎকার শুনে ককপিট থেকে হাত
নেড়ে তাতেই রাজি হল নিরো। রাবারের ফ্লিপার পায়ে গলিয়ে
নিয়ে হেঁটে স্টার্নের দিকে এগোচ্ছে সে। কিনারায় স্ফাড়িয়ে
ইকুইপমেন্টগুলো অ্যাডজাস্ট করে নিচ্ছে। সাথে দুটো এয়ারব্যাগ
এবং ¯ে−জ ঢাকার সবুজ ক্যানভাসটা নিয়েছে ও, নাইলনের কুণ্ডলী
পাকানো রশির একটা প্রান্ত দিয়ে বেঁধে নিয়েছে নিজেকে।
আই লাভ ইউ, ম্যান
৯৩
কব্জির সাথে আটকানো কম্পাসের সাহায্যে হলুদ মার্কারের
বিয়ারিং নিল ও, আবার একবার ব্রিজের দিকে মুখ তুলে আমার
দিকে তাকাল। তারপর স্টার্নের কিনারার দিকে পিছন ফিরে চিৎ
হয়ে পড়ে গেল, ঝপাৎ করে পিঠ দিয়ে পড়ল পানিতে, অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে। ওর নিয়মিত নিঃশ্বাস একরাশ সাদা
বুèুদ হয়ে ভেসে উঠল পানির উপর, স্টার্নের নিচে। পানির তলা
দিয়ে রীফের দিকে এগোচ্ছে ও, বোঝা যাচ্ছে নতুন
বুèুদগুলোকে সেদিকে এগোতে দেখে। ওর পিছনে নাইলনের
বডিলাইন ছেড়ে যাচ্ছে প্যানথার।
ঘন ঘন আগুপিছু করে একই জায়গায় বোটটাকে স্থির রাখার
চেষ্টা করছি আমি। ব্রেক-এর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একশো গজ দূরে
রয়েছি আমরা। ধীরে ধীরে নিরোর বুèুদগুলো হলুদ মার্কারের
দিকে এগোচ্ছে। তারপর ওটার পাশে গিয়ে থামল সেগুলো।
বেলুনটার নিচে কাজ করছে নিরো। বুঝলাম খালি এয়ারব্যাগের
স্ট্র্যাপ দিয়ে সাগর তলায় পাওয়া জিনিসটা বাঁধছে সে। কাজটা
কঠিন। স্রোতের তোড়ে মোটাসোটা ব্যাগগুলোকে স্থিরভাবে ধরে
রাখা সহজ নয়। স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধার পরও বাকি থাকবে কাজ।
স্কুবা বটল থেকে ব্যাগে ভরতে হবে কমপ্রেসড এয়ার। রহস্যময়
জিনিসটার আকার এবং ওজন সম্পর্কে নিরোর অনুমান যদি সঠিক
হয়, তলা থেকে ওটাকে তুলতে খুব বেশি টানের ল্ডকার হবে না,
এবং একবার ওটাকে নিচের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে তুলতে
পারলে নিরাপদ জায়গায় টেনে নিয়ে এসে বোটে তোলা কোন
সমস্যাই নয়।
চলি−শ মিনিট ধরে জলকুমারীকে একই জায়গায় ধরে রেখেছি,
এই সময় একেবারে হঠাৎ করে চকচকে দুটো সবুজ এয়ারব্যাগ
বোটের পিছনে ভেসে উঠল পানির গা ফুঁড়ে। পরমুহূর্তে সেগুলোর
পাশে দেখা গেল নিরোর হুড পরা মাথা। ডান হাত সোজা ওপর
দিকে তুলে সিগন্যাল দিল আমাকে ও।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now