বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
২৪
রানা।
‘হামাস।’
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।’
‘পাড়ায়, ওই মেয়েগুলোর কাছে।’
রানা একটু বিব্রত। ‘কেন?’
‘কারণ,’ ব্যাখ্যা করল সুরাইয়া, ‘ইজরায়েলি সৈন্যল্ডে বারণ
করা আছে, মুসলমানল্ডে বেশ্যাপাড়ায় ঢোকে না তারা।
আপাতত এর চেয়ে নিরাপজ্ঝাশ্রয় কোথাও তুমি পাবে না।’
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা ধাপ টপকে একটা ল্ডজার চৌকাঠ পেরুল
ওরা। ছোট একটা কামরা, মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত কয়েক সারি
কাঠের বাক্স সাজানো।
প্রতিটি বাক্স ইস্পাতের সরু পাত দিয়ে জড়ানো, গায়ে
লেখাÑজেলিগনাইট।
পাশের কামরায় কয়েক ডজন একে-ফোরটিসেভেন রাইফেল,
গ্রেনেড ভর্তি বিশ-বাইশটা বাক্স, দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা
কয়েকটা বাজুকা দেখা গেল।
‘এক মিনিট...কখন আবার ভুলে যাই,’ বলতে বলতে
আলখেল−ার ভিতর থেকে কালো মখমলের ছোট্ট পোঁটলাটা বের
করল রানা। ‘এই দায়িত্বটা তুমি নেবে? এটা পৌঁছে দিতে পারবে
নাবিলের গুরুজনল্ডে কাছে?’
‘কেন, কী আছে ওটায়?’
‘কয়েকটা পাথর। বেচলে, এই ধরো মার্কিন ডলারে হাজার
পঞ্চাশেক পাওয়া যাবে।’
একটু যেন কঠিন হলো সুরাইয়ার চোখ দুটো। ‘এটা যদি ক্ষতিপূরণ হয়, তার কিন্তু সত্যিই কোন প্রয়োজন নেই। আমরা,
ফিলিস্তিনিরা, কোন রকম প্রতিদান আশা না করে রোজই
দু’চারজন স্বেচ্ছায় মারা যাচ্ছি।’
‘জানি,’ নরম সুরে বলল রানা। ‘প্রাণের ক্ষতিপূরণ আদৌ কি
কারও পক্ষে দেয়া সম্ভব? বলতে পারো, এ আমার কৃতজ্ঞতার
প্রকাশ।’
‘মানে?’
‘নাবিলের আব্বা আমাকে মুয়াজ্জিনের পোশাক দিয়েছিলেন,
মিনারের নীচে সৈন্যল্ডে দেরি করিয়ে দিয়েছিলেন, সেজন্যেই
এখনও বেঁচে আছি আমি।’
‘ও।’ রানার বাড়ানো হাত থেকে মখমলের ছোট্ট পোঁটলাটা
নিল সুরাইয়া। আরও কিছু বলতে যাবে, তার আলখেল−ার ভিতর
পিপ পিপ করে উঠল ওয়ায়্যারলেস সেট।
সেটটা বের করে আরবীতে কথা বলল সুরাইয়া।
রানা দেখল, মেয়েটির মুখ ধীরে ধীরে আতঙ্কের একটা
মুখোশে পরিণত হচ্ছে। অপরপ্রান্ত থেকে কী মেসেজ আসছে
বোঝা যাচ্ছে না, এদিক থেকে সুরাইয়া শুধু বেসুরো গলায় ‘হুঁ-হাঁ’
করে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি ভাল নয়, বুঝতে পেরে ফিলিস্তিনি তরুণটিও অস্থির
আর উত্তেজিত হয়ে উঠল। আলখেল−া ফাঁক করে ভিতর থেকে
বেঢপ আকৃতির একটা মেশিন পিস্তল বের করছে সে, রানা দেখল
তার শরীরে সরু আকৃতির অসংখ্য জেলিগনাইটের স্টিক এক
করে বাঁধা রয়েছে, ডেটোনেটিং মেকানিজমসহ।
ওয়ায়্যারলেস সেট বন্ধ করে রানার দিকে তাকাল সুরাইয়া।
একটা ঢোক গিলে বলল, ‘আগে কখনও এরকম হয়নি।’ স্থির
হয়ে স্ফাড়িয়ে থাকতে পারছে না, হাঁটাহাঁটি করছে।’
‘কী?’
‘ইজরায়েলি সৈনশুা পাড়ায় ঢুকে পড়েছে। ঘরে ঘরে তল−াশি
চালাচ্ছে তারা...’
‘তার মানে এখানে আমরা নিরাপদ নই?’ প্রশ্ন করল রানা।
হঠাৎ স্থির হয়ে রানার দিকে তাকাল সুরাইয়া। ‘এই মুহূর্তে
আমি তোমার বা আমাল্ডে নিরাপত্তার কথা ভাবছি না, রানা।
২৫
আমি ভাবছি এই গোপন অ্যামিউনিশান ডিপো আর ঘাঁটির কথা।
এটা হয়তো আমাল্ডেকে খোয়াতে হবে।’
‘আপনি শহীদ হবেন, না ধরা দেবেন?’ এই প্রথম কথা বলল
ফিলিস্তিনি তরুণ, তাকিয়ে আছে সুরাইয়ার দিকে।
ঠোঁটে তিক্ত হাসির ক্ষীণ আভাস নিয়ে সুরাইয়া তাকে বলল,
‘কে চায় নরকের স্বাদ পেতে? আমি সরাসরি স্বর্গে যাব।’
তরুণ ঘুরল, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে। ইঙ্গিতে
অনুসরণ করতে বলে তার পিছু নিল সুরাইয়া।
‘এক মিনিট,’ পিছন থেকে বলল রানা। ‘বিপদ্মা কী রকম,
কোণ দিক থেকে আসছে, এ-সব জানা থাকলে আমি হয়তো
কোন সাহায্য করতে বা পরামর্শ দিতে পারতাম।’
‘সেটা পরে,’ ঘুরে স্ফাড়িয়ে জবাব দিল সুরাইয়া, চোখ দুটো
দপ করে যেন জ্বলে উঠল। ‘তার আগে এই ঘাঁটি উড়িয়ে দেয়ার
প্রস্তুতি নিতে হবে...’
‘ঘাঁটি ওড়ানো এক পলকের ব্যাপার...আগুনের একটা ফুলকি
তৈরি করতে কতক্ষণ লাগে?’
‘শুধু তো ঘাঁটি নয়, সঙ্গে যত বেশি পারা যায় দুশমনও
মারতে হবে।’ আবার ঘুরে পাশের কামরায় ঢুকে পড়ল সুরাইয়া।
তার পিছু নিয়ে রানাও ঢুকল। এটাও ছোট একটা কামরা,
বিস্ফোরকে ভর্তি। তবে এই বিস্ফোরক শুধু বিশেষ একটি কাজে
বল্টহার করা হয়।
প্রথমে মোটা সুতি কাপড় দিয়ে হাত কাটা একটা জ্যাকেট
বানানো হয়েছে। জ্যাকেটের গায়ে অসংখ্য পকেট, সেগুলোয় ভরা
হয়েছে সরু ও লম্বা জেলিগনাইটের টুকরো। একেকটা জ্যাকেটে
কম করেও চার কেজি বিস্ফোরক ধরবে।
ডেটোনেটিং মেকানিজমের সরু তার প্রতিটি বিস্ফোরককে
ছুঁয়ে উঠে এসেছে কলারের কাছে; ওটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেই
সবগুলো জেলিগনাইটের টুকরো একযোগে বিস্ফোরিত হবে।
জেলিগনাইট যাতে পকেট থেকে পড়ে না যায়, সেজন্য ইলাস্টিক
লাগানো চওড়া ফিতে দিয়ে জ্যাকেটটাকে জড়ানোর বল্টস্থাও করা
আছে।
কামরাটার ভিতর শুধু এই জ্যাকেট আর একটা বাক্সে বেশ
কিছু টাইমার আছে। আর কিছু নেই। হামাস সদস্য যারা
আত্মঘাতী হতে চায়, এগুলো তাল্ডে জন্য। কিছু জ্যাকেট
দেয়ালে ঝুলছে, বাকি সব মেঝেতে ¯তূপ করে রাখা।
ঝটপট বোরকা খুলে কামিজের উপর একটা জ্যাকেট পরছে
সুরাইয়া। ‘তাড়াতাড়ি করো, পি−জ, রানা,’ বলল সে।
‘তুমি কি আমাকে আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিতে বলছ?’
জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আমরা এখানে ফাঁদে পড়া ইঁদুর,’ বলল সুরাইয়া। ‘মরতে
আমাল্ডে হবেই। প্রশ্ন হলো, তুমি বন্দি হয়ে ওল্ডে নির্যাতন
ভোগ করে মরতে চাও, না কি ওল্ডে কয়েকজনকে নিয়ে
আত্মঘাতী হবে?’
মাথা নাড়ল রানা। ‘ইজরায়েলে আমি আত্মঘাতী হতে
আসিনি, সুরাইয়া। এসেছি বিশেষ একটা মিশন নিয়ে।
‘তুমি বলছ, মরতে আমাল্ডে হবেই, কারণ এখানে এটা
ফাঁদ, আর সেই ফাঁজ্ঝোমরা আটকা পড়েছি। সত্যিই কি তাই?
ব্যাখ্যা করো। ওয়ায়্যারলেসে কী মেসেজ পেলে তখন?’
জ্যাকেটের উপর আবার বোরকা পরবার সময় দ্রুত
পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করল সুরাইয়া।
কুয়ার ভিতর নেমে, গুহা আর টানেলে ঢুকে, এই কামরাগুলো
পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যায় একটা কাঠের ঘরে।
কাঠের ঘরটা আসলে একটা দেয়াল-আলমারি। ওটা থেকে
বেশ্যাপাড়ার নেত্রী জয়তুন নেসার দুটো বেডরুমের একটায়
বেরুনো যায়।
জয়তুনের বাড়ির ড্রইংরুমটাকে মেজর ফালাক আবরা তার
২৬
অফিস বা হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে। ওখানে বসে সৈনিকল্ডে
নির্দেশ দিচ্ছে সে, সেই নির্দেশ পেয়ে একটা সিস্টেম ধরে পাড়ার
প্রতিটি বাড়ি আর কামরা তন্নতন্ন করে সার্চ করছে তারাÑমূল
উদ্দেশ্য, কেল−ার ভিতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চোরাই পথ খুঁজে
বের করা।
‘এই মেসেজ কে তোমাকে দিল? কোত্থেকে?’ জানতে চাইল
রানা।
‘জয়তুন নিজে,’ বলল সুরাইয়া। ‘তার একটা বেডরুম
থেকে।’
‘বেরুবার শুধু এই একটা পথ?’ জানতে চাইল রানা।
‘জয়তুনের একটা বেডরুমের দেয়াল-আলমারি?’
মাথা ঝাঁকাল সুরাইয়া। ‘হ্যাঁ।’
‘আর তুমি ভয় পাচ্ছ, মেজর ফালাক আবরা এক সময়
জয়তুনের বেডরুম দুটোও সার্চ করার নির্দেশ দেবে?’
‘দেবে না?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সুরাইয়া।
মাথা চুলকাল রানা। ‘হ্যাঁ, দেয়ারই কথা।’ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে
উঠল চোখ দুটো। ‘কিন্তু পালাবার পথ যে একেবারে বন্ধ, তা তো
নয়। যে পথ দিয়ে এলাম...অর্থাৎ কুয়া দিয়ে আবার বেরিয়ে
যেতে পারি আমরা।’
‘পারি না,’ বলল সুরাইয়া। ‘কারণ, কুয়াটা সম্পর্কে রিপোর্ট
পাবার পর মেজর আবরা নির্দেশ দিয়েছে, বিস্ফোরকের সাহাযেদ্দটাকে বুজিয়ে দিতে হবে।’
চকচকে ভাব হারিয়ে আবার ¤−ান হয়ে গেল রানার চোখ
দুটো। চিন্তার ভারে নত হয়ে থাকল মাথাটা। তবে তা মাত্র
দু’সেকেন্ডের জন্য।
মুখ তুলতে দেখা গেল রানার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ একটু
হাসির রেখা ফুটে আছে। ‘হ্যাঁ,’ বিড়বিড় করল ও। ‘এটাই
একমাত্র উপায়।’
‘কী?’ সুরাইয়া মোটেও উৎসাহ পাচ্ছে না, বরং যেন একটু
বিরক্তই।
‘তার আগে বলো, জয়তুনের সঙ্গে আবার কখন তোমার
যোগাযোগ হবে?’
হাতঘড়ি দেখল সুরাইয়া। ‘বিশ মিনিট পর পর মেসেজ
বিনিময় করার কথা। ওর সঙ্গে কথা বলতে হলে আরও পনেরো
মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।’
‘সেক্ষেত্রে প্রার্থনা করো আগামী পনেরো মিনিট যেন
ইজরায়েলিরা জয়তুনের বেডরুমে না ঢোকে।’
‘তোমার প−্যানটা কী, বলবে আমাকে?’ রাগ চেপে জানতে
চাইল সুরাইয়া।
‘খুব সহজ,’ বলল রানা। ‘দেয়াল-আলমারিটা যে ঘরে আছে,
সেই ঘরে বিছানায় শোয়াতে হবে মেজর আবরাকে। একা নয়,
তার সঙ্গে একটা মেয়েও শোবে। মেয়ে দু’তিনটে হলেও ক্ষতি
নেইÑতাতে তাকে ব্যস্ত রাখা সহজ হবে।’
‘রাখল ব্যস্ত, তাতে লাভ?’ চেহারা একটু লালচে হয়ে উঠল
সুরাইয়ার। প−্যানটা তার মাথায় ঢুকছে না।
‘কোথায় লাভ বুঝতে পারছ না? লাভ হলোÑকোন লোক
মেয়েল্ডেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সে তার বেডরুমে অন্য কোন
পুরুষকে ঢোকার অনুমতি দেয় না।’
এক সেকেন্ড চিন্তা করল সুরাইয়া। ‘এটা যে একটা চালাকি,
মেজর আবরা তা বুঝে ফেলবে। তা ছাড়া, এমনিতেও, ডিউটির
সময় ফুর্তি করতে রাজি হবে না সে।’
‘কেল−ায় ঢোকার সময় আমি তার চোখে যে ভাবটা দেখেছি
তাকে বলে...লোলুপ দৃষ্টি। এ হলো সেই জাতের পুরুষ, সু›ল্ডী
মেয়ে দেখলে যার মাথা খারাপ হয়ে যায়।’
মাথা নাড়ল সুরাইয়া। ‘আমি তাকে একদম সামনে থেকে
দেখেছি, সেজন্যেই একমত হতে পারছি না। এ লোক নারীর
২৭
ছলনায় ভুলবে না।’
‘ঠিক আছে, মেয়েল্ডে প্রতি তার দুর্বলতা কম,’ বলল রানা।
‘কিন্তু প্রফেশনাল মেয়েগুলো ওখানে আছে কী করতে? একটা
লোককে বেডরুমে এনে শোয়াতে পারবে না?’
‘ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখতে পারে ওরা,’ বলল সুরাইয়া।
‘কিন্তু ভেবে দেখেছ, একটা পুরুষকে কতক্ষণ বিছানায় আটকে
রাখা সম্ভব? তারপর কী হবে?’
‘তারপর অনেক কিছু হতে পারে,’ বলল রানা। ‘ধরো, আমরা
আলমারির ভেতর স্ফাড়িয়ে বেডরুমে চোখ রাখলাম। মেজরের
ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে
যেতে পারি। পাশের ঘর থেকে পাশের বাড়িতে...’
‘সম্ভব নয়,’ তাড়াতাড়ি বলল সুরাইয়া। ‘জয়তুনের বাড়ির
সামনে অন্তত আধ ডজন সৈনিক পাহারা দিচ্ছে।’
‘সম্ভব,’ বলল রানা, ‘কারণ আমরা বাড়িটার সামনে দিয়ে
বেরুব না, বেরুব পাঁচিল টপকে বা খিড়কি ল্ডজা
দিয়েÑপ্রতিবেশী কারও বাড়িতে; যে বাড়ি সৈনিকরা আগেই সার্চ
করেছে।’
রানার দিকে এবার সুরাইয়া যেন নতুন দৃষ্টিতে তাকাল।
‘এটাই বোধহয় তোমার বৈশিষ্ট্য। কোনমতে হাল ছাড়তে জানো
না।’
রানার কোন প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় মনে মনে হতাশ হতে
হলো সুরাইয়াকে।
নির্লিপ্ত, ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে ঝুলন্ত জ্যাকেটগুলোর সামনে এসে
স্ফাড়াল রানা। পকেট থেকে জেলিগনাইটের কিছু স্টিক আর
ডেটোনেটর এবং বাক্স থেকে কিছু টাইমার তুলে চালান করে দিল
আলখেল−ার ভিতর।
তারপর হাতঘড়ির উপর চোখ রেখে সুরাইয়াকে বলল,
‘কাজের কথা এখনও আমরা শুরুই করতে পারলাম না।
জয়তুনকে মেসেজ পাঠাবে তুমি আরও দশ মিনিট পর, এই ফাঁকে
আমাকে বলবে, আইয়াম আর নাজাফিতে আসলে কী ঘটছে।’
‘পিএলও-র ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে তোমাল্ডে
বিসিআই মাত্র তিন দিন আগে অ্যালার্ট করেছে আমাকে,’ বলল
সুরাইয়া। ‘আইয়াম বা নাজাফি সম্পর্কে নতুন কোন তথঞ্জামি
সংগ্রহ করতে পারিনি।’
‘তোমরা এটুকু অন্তত জানো তো যে ইজরায়েল নতুন ধরনের
একটা মারণাস্ত্র তৈরি করেছে? সেটা দিয়ে ইচ্ছে করলে এক
পলকে ইস্পাত পর্যন্ত গলিয়ে দিতে পারে?’
বোবাদৃষ্টিতে রানার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকবার পর
কলের পুতুলের মত মাথা নাড়ল সুরাইয়া। ‘না তো!’
‘তা হলে কী জানো?’
‘আইয়াম সম্পর্কে জানি, মার্কিনিরা ওখানে একটা এয়ার
বেইস গড়ে তুলছে,’ বলল সুরাইয়া। ‘আর নাজাফি সম্পর্কে বলা
হয়, ইজরায়েলিরা ওখানে একটা স্পেস সেন্টার তৈরি করেছে।
মাঝে মধেশুকেট পরীক্ষা করে। লোকে ঠাট্টা করে বলে,
আমাল্ডে মার খেয়ে টিকতে না পারলে ইজরায়েলিরা মঙ্গলগ্রহে
গিয়ে বসতি গাড়বে।’
‘তোমরা আরও ভাল করে খোঁজ নাওনি, বিশেষ করে
নাজাফিতে কী করছে ওরা?’
মাথা নাড়ল সুরাইয়া। ‘এরকম আরও অনেক জায়গায় অনেক
কিছু করছে দখলদার ইজরায়েলিরা, সিকিউরিটি এত কড়া যে
ধারেকাছে ঘেঁষা যায় না। তা ছাড়া, নতুন নতুন এলাকা দখল
করে ঘর-বাড়ি তৈরি করছে ইহুল্ডিা, সে-সব কাজে বাধা দিতেই
আমাল্ডে সব সময় বেরিয়ে যায়...’
‘মোসাদ এজেন্ট মেজর এবরান বারাইল্ডি নাম শুনেছ? তাকে
থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল রানা।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল সুরাইয়া। ‘হ্যাঁ, বলোÑতার সম্পর্কে
২৮
জানি।’
‘কী জানো?’
‘অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছে। এয়ার ফোর্সের
পাইলট ছিল। অ্যাস্ট্রনট হবার ট্রেনিং নিতে নাসায় গিয়েছিল।
বেশ ক’বছর হলো মোসাজ্ঝোছে।’
‘আর কী জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘এখন সে কোথায়?’
‘বর্তমানে নাজাফিতে আছে সে,’ বলল সুরাইয়া। ‘শোনা যায়
দুটো পদেÑরিসার্চ অ্যাসিন্ট্যান্ট আর অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ সিকিউরিটি
অফিসার। প্রথম পদ্মা সম্ভবত কাছ থেকে বিজ্ঞানী আর
টেকনিশিয়ানল্ডে ওপর নজর রাখার জন্য দেয়া হয়েছে।’
‘তুমি জানো সে এখানে, তুফায়?’
নিজের অজান্তেই শিরস্ফাড়া খাড়া হয়ে গেল সুরাইয়ার। ‘না।
সত্যি?’
মাথা ঝাঁকাল রানা, তারপর বলল, ‘বারাইদিকে ল্ডকার
আমার, সুরাইয়া। এখান থেকে বেরুতে পারলে আমার প্রথম
কাজ হবে ওকে ধরে ইন্টারোগেট করা।’
‘কিন্তু আমার ধারণা ছিল খুব তাড়াতাড়ি নাজাফিতে পৌঁছাতে
চাও তুমি,’ বলল সুরাইয়া। ‘এটা ধরে নিয়েই প−্যানটা তৈরি করে
রেখেছি আমি...’
‘কী প−্যান শুনি তো?’
‘বেদুইনরা ঘোড়া নিয়ে গিরিখাজ্ঝেপেক্ষা করবে...’
এই সময় প্রবল একটা ঝাঁকি খেল কামরাটা। তাল সামলাতে
না পেরে সুরাইয়া আর ফিলিস্তিনি তরুণ ছিটকে পড়ল, শুধু রানা
দেয়াল ধরে কোন রকমে স্ফাড়িয়ে থাকতে পারল। অনেক দূর
থেকে ভেসে এল বিস্ফোরণের ভোঁতা একটা আওয়াজ।
সুরাইয়াকে সিধে হয়ে স্ফাড়াতে সাহায্য করল রানা। তরুণ
ফিলিস্তিনি নিজের চেষ্টায় স্ফাড়াল। তার দিকে ফিরে সুরাইয়া
আরবীতে বলল, ‘কুয়া দিয়ে আর বেরুনো যাবে না।’
‘আমি দেখে আসি কতটুকু কী ক্ষতি হয়েছে,’ বলেই ছুটল
তরুণ।
‘আমরা দেয়াল-আলমারির কাছে থাকব,’ তার পিছন থেকে
গলা চড়িয়ে বলল সুরাইয়া।
ছয়
রানা দেয়াল-আলমারির পিছনে স্ফাড়াবার পর বিশ মিনিট পার
হতে চলেছে, অথচ প্রায় ওই একই সময় থেকে চেষ্টা করা সত্ত্বেও
তিন-তিনটে অপরূপ সু›ল্ডী বারাঙ্গনা মেজর আবরাকে বিছানায়
কাত করতে পারছে না।
প্রকাণ্ডদেহী আবরা বিছানার কিনারায় বসে পা দোলাচ্ছে, বাম
হাতের ওয়াকি-টকি চেপে ধরে রেখেছে কানে। সৈনিকল্ডে
পাঠানো রিপোর্ট মন দিয়ে শুনছে সে, মাঝে মধ্যে কর্কশ গলায়
হিব্র“ ভাষায় খেঁকিয়ে উঠছে।
ফিলিস্তিনি তরুণ কুয়াটার ক্ষয়-ক্ষতি দেখবার জন্য কামরা
থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার পর রানাকে নিয়ে প্রায় দুশো গজ
লম্বা একটা টানেলে বেরিয়ে আসে সুরাইয়া।
টানেলের মাঝামাঝি পৌঁছে ওয়য়্যারলেসে জয়তুনের সঙ্গে
কথা হলো তার।
কী করতে হবে বুঝে নিয়ে সেট বন্ধ করে দিল জয়তুন।
টানেলের বাকিটুকু পেরিয়ে একপ্রস্থ সিঁড়ি বেয়ে একটা ঘরে
ঢুকল ওরা। ঘরটার একদিকের দেয়াল ইস্পাতের পাত দিয়ে
২৯
তৈরি, লোহার ফ্রেমে আটকানো।
গোল একটা হুইল ঘুরিয়ে ইস্পাতের পাত অর্থাৎ কবাটসদৃশ
অংশটা প্রায় নিঃশব্দে খোলা যায়। কবাটের অপর পিঠে রয়েছে
ইঁটের গাঁথুনি আর সিমেন্টের প−াস্টার, তার উপর পেরেক দিয়ে
গাঁথা পালিশ করা তক্তাÑএকটা দেয়াল-আলমারির পিছনটা ঠিক
যেমন হওয়ার কথা।
সুরাইয়া হাতল ঘুরিয়ে ইস্পাতের পাল−া খুলবার পর দেয়াল-
আলমারির ভিতরটা দেখতে পেল রানা।
আলমারির ভিতর তিনটে সেলফ বা তাক রয়েছে, নানা
ধরনের সৌখিন জিনিস-পত্রে ঠাসা। ওটার কবাটের দুই
তৃতীয়াংশে কাঁচ লাগানো। নীচের সেলফে কিছু নেই, ওটার
সামনে কাঁচের বদলে কাঠের পাল−া দেখা যাচ্ছে। ওই পাল−া খুলে
আলমারির ভিতর দিয়ে বেডরুমটায় ঢোকা যায়।
ঘরের ভিতর আলো জ্বালেনি ওরা, ফলে জয়তুনের বেডরুম
থেকে আলমারির তাকগুলোর পিছনটা কেউ দেখতে পাবে না।
আর বেডরুমে আলো থাকায় ওখানে কি ঘটছে না ঘটছে তার
সবই আলমারির পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছে ওরা।
বেডরুমে তাকিয়েছে রানা দু’মিনিটও হয়নি, চারটে মেয়ে
মেজর আবরাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। তাল্ডে মধ্যে একজনের
বয়স একটু বেশি, পঁয়ত্রিশের কম হবে না। তাকেই জয়তুন বলে
ধরে নিল রানা। চারজনের কেউ ভুলেও দেয়াল-আলমারির দিকে
তাকাচ্ছে না।
আনন্দ-ফুর্তি করবে কী, পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসেই হাতের
ওয়াকি-টকি অন করে সৈন্যল্ডে নির্দেশ দিতে শুরু করল মেজর
আবরা।
জয়তুনের ইঙ্গিতে বিছানায় তার দু’পাশে দুটো মেয়ে বসল।
অপর মেয়েটা বসল তার পায়ের কাছে। সকৌতুক আচরণ
তাল্ডে; কখনও হেসে গড়িয়ে পড়ছে মেজরের গায়ে, কখনও
কামানো গালে হাত বুলিয়ে আল্ড করছে।
এ-সবই উত্তেজিত করবার চেষ্টা, তবে হালকা ভাবে। জয়তুন
ইঙ্গিতে বেশি বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে দিল, তা না হলে
মেজর আবরা সন্দেহ করে বসতে পারে। সেজন্যই মেঝেতে বসা
মেয়েটা আবরার ট্রাউজার খুলবার কাজটা শুরু করেও শেষ করল
না।
মিনিট দশেক পর ওল্ডে চারজনকে রেখে বেডরুম ছেড়ে
বেরিয়ে গেল হতাশ জয়তুন। পাঁচ মিনিট পর আবার ফিরে এল
সে, হাতের ট্রেতে একটা কাঁচের জগ আর কয়েকটা গ−াস। জগে
পেস্তা বাদাম আর জাফরান দিয়ে তৈরি শরবত, উপরে বরফের
টুকরো ভাসছে।
একটা মেয়ে মেজর আবরার ঠোঁটের কাছে শরবতের গ−াস
ধরল, আদুরে গলায় চুমুক দিতে বলছে। গ−াসটা নিল আবরা,
তারপর মেয়েটির আদুরে ভঙ্গি অনুকরণ করে তাকেই চুমুক দিতে
বলছে।
‘দেখলে, হারামজাদা কী রকম সাবধানী?’ ফিসফিস করল
রানা।
ওর পিছন থেকে উঁকি দিয়ে সুরাইয়াও বেডরুমের ভিতর
তাকিয়ে আছে। সে-ও ফিসফিস করে জবাব দিল, ‘হুঁ। শরবতে
বিষ থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে।’
জয়তুনের ইঙ্গিতে অর্ধেক গ−াস খালি করে ফেলল মেয়েটি।
দ্বিতীয়বার সাধতে এতটুকু ইতস্তত না করে মেজর আবরাও
বাকিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল।
জয়তুনের ইশারা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গ−াসটা আবার ভরে দিল
মেয়েটি।
রানার বুঝতে বাকি থাকল না, আবরাকে জয়তুন শরবত
খাওয়াচ্ছে এই আশায় যে তার যাতে পেচ্ছাবের বেগ হয়। তা
হলে তাকে বাথরুমে যেতে হবে। জয়তুন ভাবছে, সেই সুযোগে
৩০
দেয়াল-আলমারি থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে
রানা আর সুরাইয়া।
তারপর একেবারে বিনা নোটিশে হুড়মুড় করে কয়েকজন
সৈনিক ঢুকল বেডরুমে। ইউনিফর্ম দেখে বোঝা গেল তাল্ডে
নেতৃত্বে রয়েছে একজন তরুণ ক্যাপটেন।
দেখা গেল সৈনিকরা দু’দলে বিভক্ত। এক দল সার্চ পার্টি।
আরেক দল এই বাড়ির গেটে পাহারা দিচ্ছিল।
সার্চ পার্টির উপর নির্দেশ আছে, এক এক করে গলির
সবগুলো বাড়িতে তল−াশি চালাতে হবে। সেভাবেই তারা
এগোচ্ছিল।
কিন্তু এই বাড়ির সামনে এসে বাধা পেল তারা। প্রহরী
সৈনিকরা মেজরের দোহাই দিয়ে তাল্ডেকে ভিতরে ঢুকতে দিতে
রাজি হয়নি। কিন্তু ক্যাপটেনের যুক্তি হলো, মেজর আবরাই তো
তাকে প্রতিটি বাড়ি সার্চ করবার নির্দেশ দিয়েছে, কাজেই কারও
প্রতিবাদে কান না দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে সে, সরাসরি মেজরের মুখ
থেকে শুনতে চায় সার্চ করতে হবে কি হবে না।
কথা শেষ করে মেজর আবরার কানের কাছে মুখ নামিয়ে
ফিসফিস করল সে।
মেজর আবরা চট করে একবার আড়চোখে দেয়াল-আলমারির
দিকে তাকাল।
ক্যাপটেন আর মেজরের আচরণ দেখে দম আটকাল
সুরাইয়া। রানার কাঁধে টোকা দিয়ে পিছিয়ে আসবার ইঙ্গিত দিল
সে, নিজে এক লাফে চলে এল হুইলটার কাছে।
হুইল ঘুরিয়ে আলমারির পিছনের দেয়াল জায়গা মত সরিয়ে
আনল সুরাইয়া। বেডরুম থেকে আলমারির কবাট এখন কেউ
খুললে তার চোখে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়বে না। তবে সে যদি কোনভাবে জেনে থাকে যে এখানে একটা চোরা পথ আছে, তা
হলে আলাদা কথা।
সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালল সুরাইয়া। দেখল রানার
হাতে ওয়ালথার বেরিয়ে এসেছে। ফিলিস্তিনি তরুণের হাতেও
একটা মেশিন পিস্তল দেখা যাচ্ছে; কুয়ার ওদিক থেকে কিছুক্ষণ
আগে ফিরেছে সে।
তিনজনই ওরা ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি দেয়ালটা থেকে
যতটা সম্ভব দূরে সরে এসেছে, যেন ভয় পাচ্ছে বেডরুম থেকে
বিস্ফোরকের সাহাযেদ্দটা উড়িয়ে দিতে পারে ইজরায়েলি
সৈনশুা।
‘যেভাবেই হোক সার্চ পার্টির ক্যাপটেন এই ঘাঁটির কথা জেনে
ফেলেছে,’ বলল রানা।
‘হ্যাঁ, এখন মেজর আবরাও জানে।’ একটা ঢোক গিলল
সুরাইয়া। ‘এখন উপায়?’
‘আমি খুন হবার জন্য প্রস্তুত,’ আরবীতে বলল ফিলিস্তিনি
তরুণ।
রুদ্ধশ্বাসে পার হয়ে যাচ্ছে সেকেন্ডগুলো। কেউ জানে না কী
করতে হবে।
তারপর অকস্মাৎ ওল্ডে বুকের রক্ত ছলকে দিয়ে জ্যান্ত হয়ে
উঠল সুরাইয়ার ওয়য়্যারলেস সেট। জয়তুন কোন মেসেজ দিতে
চায়? নাকি সেটটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে ইজরায়েলিরা?
না, সুরাইয়ার কানে জয়তুনের কণ্ঠ¯ল্ফই; তবে তা মধু নয়,
বর্ষণ করল গরল: ‘পাশের বাড়ির এক মাগী টাকার লোভে সার্চ
পার্টির ক্যাপটেনকে আন্ডারগ্রাউন্ড ঘাঁটির কথা বলে দিয়েছে। ওই
বাড়ির চাকরানি এইমাত্র খবরটা দিয়ে গেল আমাকে।’
সুরাইয়ার গলা ভেঙে গেল, ‘এখন কী হবে?’
‘আমাকে ক্ষমা করবেন, বোন,’ জবাবে বলল জয়তুন। ‘কথা
দিয়েও আপনাকে আমি কোন সাহায্য করতে পারলাম না। মেজর
আবরা বিদেশী বন্ধুর কথা জানে, বিস্ফোরক দিয়ে দেয়াল-
আলমারি উড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবছে।’
৩১
‘তুমি লুকিয়ে পড়ো, জয়তুন,’ তাগাদা দিল সুরাইয়া।
‘তোমাকে পেলে ওরা নির্যাতন করবে।’
‘বিপদ টের পেয়ে পাড়া থেকে সরে এসেছি,’ বলল জয়তুন।
আমি এখন কেল−ার ছাদে। আমার মেয়েল্ডে এখন আমি খবর
পাঠাব, তারাও যেন সুযোগ বুঝে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
কারণ আমি জানি আপনি বা ইউসুফ ইজরায়েলিল্ডে হাতে ধরা
দেবেন না, টন খানেক বিস্ফোরক আর একদল ইজরায়েলির সঙ্গে
নিজেরাও উড়ে যাবেন।’
‘আমরা কী করব, কখন করব, একটু পরেই জানাচ্ছি। তুমি
সেট খুলে রাখো,’ বলে যোগাযোগ কেটে দিয়ে রানার দিকে
তাকাল সুরাইয়া। ‘সত্যি সর্বনাশ হয়ে গেছে!’
‘বলো।’
‘ওরা সত্যি সত্যি জানে দেয়াল-আলমারির পিছনে এটা
হামাসের একটা ঘাঁটি। এ-ও জানে যে তুমি এখানে লুকিয়েছ...’
কী ঘটেছে দ্রুত বলে গেল সুরাইয়া। সবশেষে বলল, ‘দুঃখিত,
রানা। দিস ইজ দা এন্ড অভ দা রোড। এরপর আর পথ নেই।’
ফিলিস্তিনি তরুণ ইউসুফ আলখেল−ার সামনেটা খুলে
জেলিগনাইটের সঙ্গে ডেটোনেটিং মেকানিজমের সংযোগগুলো
পরীক্ষা করছে, ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক চিলতে হাসি লেগে
রয়েছে।
দেখাদেখি সুরাইয়াও তার বোরকা ফাঁক করে গায়ে জড়ানো
বিস্ফোরক আর ডেটোনেটিং মেকানিজম খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে।
কোথাও একটু খুঁত থাকলে প্রয়োজনের সময় বিস্ফোরণ ঘটবে
না।
‘একটু থামো,’ বলে ইউসুফের দিকে হাত বাড়াল রানা।
কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারেনি ইউসুফ, হ্যাঁচকা টান দিয়ে
বিস্ফোরকের সঙ্গে জোড়া লাগানো এক গোছা তার ছিঁড়ে ফেলল
রানা।
‘রানা!’ সুরাইয়া হতভম্ব। ‘মানে?’
বন্ করে ঘুরে ফাঁক করা বোরকার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে
আরও এক গোছা তার ধরে টান দিল রানা। সুরাইয়া পিছিয়ে
যাওয়ার চেষ্টা করল, তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে তার।
‘এর মানে?’ অকস্মাৎ সাপের মত ফণা তুলল সুরাইয়া।
‘তোমরা মরতে চাও মরো, আপত্তি করব না, হিসহিস করে
বলল রানা। ‘কিন্তু তোমাল্ডে সঙ্গে আমাকেও মরতে হবে কেন?’
‘এতক্ষণ তা হলে কী বললাম তোমাকে?’ সুরাইয়ার দৃষ্টি
দেখে মনে হলো রানাকে বদ্ধ একটা উন্মাদ ভাবছে সে।
‘ইজরায়েলিরা ইস্পাতের ল্ডজা উড়িয়ে দেবে। তারপর ভেতরে
ঢুকে পাখি শিকারের মত গুলি করবে আমাল্ডে। আমরা তা হতে
দিতে পারি না।’
‘পারার মধ্যে পারো শুধু আত্মঘাতী হতে?’ জিজ্ঞেস করল
রানা। ‘বাঁচার কোন বুদ্ধি করতে পারো না?’
‘জনাবের আপার চেম্বারে সে রকম কোন বুদ্ধি আছে কি?’
হঠাৎ ইংরেজিতে জানতে চাইল ইউসুফ, বাঁকা চোখের দৃষ্টিতে
তাচ্ছিল্য।
‘আছে,’ বলল রানা। সুরাইয়ার দিকে ফিরল। ‘যদি সম্ভব
হয়, ওল্ডে আগে আমরাই ইস্পাতের ল্ডজাটা উড়িয়ে èে। ওটা
ভাঙবার জনদ্দরা খুব বেশি হলে এক আধ পাউন্ড জেলিগনাইট
ফাটাবে। আমরা ফাটাব...এই ধরো দুশো পাউন্ড, কিংবা আরও
বেশি।
‘ফলে কী হবে? গোটা পাড়াটাই উড়ে যাবে, তাই না? ধোঁয়া,
আগুন আর আবর্জনা ছাড়া আরও একটা জিনিস দেখতে পাব
আমরা।’ ইউসুফের দিকে তাকাল। ‘কী?’
ইউসুফ হাঁ হয়ে গেছে। জবাব দিতে এক সেকেন্ড দেরি
করল: ‘ইজরায়েলি সৈন্যল্ডে লাশ।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, বুঝলাম এটা একটা প−্যান,’ বলল সুরাইয়া,
৩২
‘কিন্তু প−্যানটা কি আমাল্ডে প্রাণ বাঁচাতে পারবে? না পারলে
ওটার মূল্য কী?’
‘সে তো ঠিক কথাই,’ তার সুরে সুর মিলিয়ে বলল রানা।
‘তবে আমার ধারণা, প্রাণে আমরা বেঁচে যাব, শুধু তোমরা যজ্ঝিামাকে সাহায্য করো, আর অযথা সময় নষ্ট না করো।’
সুরাইয়া আর ইউসুফ নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় করল। চোখে
প্রত্যাশা নিয়ে আবার রানার দিকে ফিরল তারা।
‘জয়তুনকে জিজ্ঞেস করো, সে কি বলতে পারবে আলমারিতে
বিস্ফোরক লাগানো হচ্ছে কিনা,’ বলল রানা। তারপর ইউসুফের
দিকে তাকাল। ‘এক ছুটে এক বাক্স জেলিগনাইট আর
ডেটোনেটর নিয়ে এসো, যাও। আর আলখেল−ার পকেটে ভরে
কিছু গ্রেনেডও।’
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ছুটে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল
ইউসুফ।
‘জয়তুন? সুরাইয়া,’ ওয়য়্যারলেসে কথা বলছে সুরাইয়া।
‘তোমার বাড়িতে কী ঘটছে খবর পাচ্ছ?’
জয়তুনের জবাব শুনবার জনদ্দয়য়্যারলেসের স্পিকারের
কাছে নিজের একটা কান যতটা পারা যায় সরিয়ে আনল রানা।
‘আমার মেয়েরা এখনও রয়েছে ওখানে, একজনের কাছে
একটা ওয়য়্যারলেসও আছে,’ বলল জয়তুন, ‘কিন্তু সেটা বন্ধ।
মেয়েটা ধরা পড়ে গেছে কি না বুঝতে পারছি না।’
‘আলমারিতে বিস্ফোরক বসাতে কতক্ষণ লাগবে ওল্ডে,
পাড়ায় এই মুহূর্তে আন্দাজ কত সৈনঞ্জাছে, তোমার মেয়েরা
পাড়া ছাড়তে কতক্ষণ সময় নেবে, এ-সব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
জানতে চাই আমরা।’
‘পাঁচ-সাত মিনিট পর যোগাযোগ করুন,’ বলল জয়তুন।
‘বিস্ফোরক আনতে লোক গেছে, ফিরতে কিছু দেরি হবে, এটুকু
জানি। বাকি সব খবর নিচ্ছি।’
‘আরও কথা আছে,’ বলল রানা।
‘লাইনে থাকো, জয়তুন,’ বলল সুরাইয়া।
‘যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন,’ জয়তুন উত্তেজিত। ‘নীচে রাস্তা
থেকে একজন সৈনিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে।’
‘আমাল্ডে প−্যানটা ব্যাখ্যা করো ওকে,’ সুরাইয়াকে নির্দেশ
দিল রানা। ‘গোটা পাড়া উড়িয়ে èে। তারপর আগুন আর
আবর্জনার ভিতর দিয়ে ছুটব। সৈন্য দেখলেই গ্রেনেড ছুঁড়ব।
জয়তুন আমাল্ডেকে ওয়য়্যারলেসে পথ নির্দেশ দেবে, আমরা ওর
কাছে পৌঁছাব। কেন?
‘ক্যাপটেন র্যাঙ্কের একজোড়া ইউনিফর্ম যোগাড় করে রাখবে
সেÑএকটা লেডিস, একটা জেন্টসÑআমরা ওগুলো নেয়ার জন্যে যাব।’
খানিক পরপর সুরাইয়ার সঙ্গে কথা বলছে জয়তুন।
নতুন নতুন তথ্য পাওয়ায় দুশো গজ লম্বা টানেলের কোথায়
কী পরিমাণ বিস্ফোরক বল্টহার করতে হবে, হিসাব করতে সুবিধে
হচ্ছে রানার। ইতিমধ্যে সুরাইয়া আর ইউসুফের সাহাযেঞ্জান্ডারগ্রাউন্ড হামাস ঘাঁটির উপর কোথায় কী আছে তার একটা
নকশা তৈরি করেছে ও।
বিস্ফোরণ ঘটবে পতিতালয়ের পাঁচ জায়গায়। জয়নালের
ত্থেয়া তথঞ্জনুসারে, পাড়ার ভিতর ইজরায়েলিল্ডে সংখ্যা আশি
জনের কম নয়, দুই প্রবেশ পথে দুটো ট্যাংকও মোতায়েন করা
হয়েছে।
জয়তুনের বেডরুম হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ঘাঁটিতে পৌঁছানো যায়,
এ তথ্য পেলেও ইজরায়েলি ক্যাপটেন বিশ্বাসঘাতিনী মেয়েটার
কাছ থেকে জানতে পারেনি দেয়াল-আলমারির ঠিক পিছনে
আসলে কী আছে। ফলে প্রথমে তারা আলমারি খুলে চেষ্টা করল
পিছনের দেয়ালটা ভাঙা যায় কি না। এতে বেশ কিছুটা সময় ব্যয়
৩৩
হলো।
সেই সময়টাই কাজে লাগাল রানা।
জয়তুনকে দু’বার প্রশ্ন করা হলো, সৈনিকটা কি এখনও তার
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে? দু’বারই জয়তুন জবাব দিল,
নীচের রাস্তায় তাকে সে দেখতে পাচ্ছে না।
না পারারই কথা, কারণ অন্য এক রাস্তায় সরে গিয়ে
জয়তুনকে পিছন থেকে দেখছে সে।
ইতিমধ্যে জানা গেছে, জয়তুনের প্রতিবেশী মেয়েটার পেটে
কে যেন ছুরি চালিয়েছে। নিজের বাড়ির গেটের ঠিক বাইরেই
কাত হয়ে শুয়ে আছে সে, বিস্ফারিত চোখে দেখছে সদ্য বেরিয়ে
আসা নিজের নাড়িভুঁড়ি। রাস্তা দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে
ইজরায়েলি সৈনশুা। গলা থেকে চিঁ-চিঁ আওয়াজ বের করে
তাল্ডে সাহায্য চাইছে মেয়েটা। ঘৃণার সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে
তারা।
জয়তুনকে জানিয়ে ত্থেয়া হলো, বিস্ফোরক বসানোর কাজ
শেষ করেছে ওরা। কোন সমস্যা না থাকলে পাড়াটা এখনই রানা
উড়িয়ে দিতে পারে।
জয়তুন মেসেজ দিল, ‘সমস্যা আছে।’
ভুরু কোঁচকাল সুরাইয়া। ‘মানে?’
‘আপনারা না তখন বললেন, মেজর আবরা যেন মরে? এখন
পাড়া উড়িয়ে দিলে সে মরবে না।’
‘মরবে না...কী বলছ তুমি?’
‘সে তার লোকজনকে আলমারির পিছনে বিস্ফোরক বসাতে
বলে পাড়া থেকে বেরিয়ে এসেছে।’
‘কেন?’
‘আমি তাকে কেল−ার ছাদ থেকে নীচের রাস্তায় দেখতেও
পাচ্ছি,’ বলল জয়তুন। ‘স্ফাড়ান, বিনকিউলারটা অ্যাডজাস্ট করে
নিই। হ্যাঁ, ঠিক আছে। মেজর আবরা সাদা প্যান্ট শার্ট পরা এক
লোকের সঙ্গে কথা বলছে।’
জয়তুনের কথা রানাও শুনছে। আরবীতে প্রশ্ন করল ও:
‘লোকটা দেখতে কেমন?’
জয়তুনের মুখে বর্ণনা শুনে ওর আর বুঝতে বাকি থাকল না
যে লোকটা এবরান বারাইদি।
‘ওকে আমার ল্ডকার।’ জয়তুনকে বলল ও। ‘কোথায় যায়,
কী করে লক্ষ রাখুন। ভাল কথা, ইউনিফর্মের বল্টস্থা ...’
‘ওগুলো যোগাড় করতে হয়নি,’ রানা প্রশ্নটা শেষ করবার
আগেই জবাব দিল জয়তুন। ‘কেল−ার একজনের কাছে আছে শুনে
আনিয়ে রেখেছি। শুনুন, হুজুর...’
‘হ্যাঁ, বলুন। তবে আমি হুজুর বা সার নই।’
‘মেজর আবরা ফটক থেকে আবার কেল−ার ভেতর ঢুকছে...’
‘আর লোকটা?’ দ্রুত জিজ্ঞেস করল রানা।
‘সে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল,’ বলে হেসে উঠল জয়তুন।
‘এই হাসির নিশ্চয় কোন মানে আছে।’
‘তুফা শহরের সব হামাস সদস্য জড়ো হয়েছে ওই রেস্তোরাঁর
পিছনের কামরায়। কেল−ার ভেতর এতগুলো ইজরায়েলি সৈন্যকে
এক সঙ্গে পেয়ে ছেড়ে দিতে রাজি নয় ওরা।’
‘ওল্ডেকে খবর পাঠাননি যে যা করবার আমরাই করব?’
জিজ্ঞেস করল রানা।
‘পাঠিয়েছি খবর। আপনারা কী করেন দেখার অপেক্ষাতেই
ওখানে বসে আছে ওরা। আপনারা ব্যর্থ হলে কিছু একটা করবে
ওরা।’
‘জানি খুব বেশি আশা করা হয়ে যাচ্ছে,’ বলল রানা। ‘তবে
সত্যি খুব ভাল হত হামাসরা যদি লোকটার গায়ে বিস্ফোরক
বসিয়ে রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রের সাহাযেদ্দটা ফাটাবার বল্টস্থা করে
রাখত।’
‘কী লাভ হত তাতে?’
৩৪
‘মেজর এবরান বারাইল্ডি প্রাণ ভোমরাটা থাকত আমার
হাতে,’ বলল রানা। ‘তা থাকলে তাকে দিয়ে আমি যেমন খুশি
তেমন গান গাওয়াতে পারতাম।’
‘শুনুন, মেজর আবরা একজন ট্যাঙ্ক কমান্ডারের সঙ্গে কথা
বলছে,’ বলল জয়তুন। ‘ট্যাঙ্ক কমান্ডার ইঙ্গিতে কেল−ার ছাদ দেখাল মেজরকে...আমাকে ছাদে একা দেখে হয়তো সন্দেহ
হয়েছে তার। শুনুন, পরে কথা বলব।’ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেল।
আবার যোগাযোগ করল জয়তুন বারো মিনিট পর।
‘কী খবর?’ দ্রুত জানতে চাইল রানা। ‘মেজর আবরা
কোথায়?’
জয়তুন বলল, ‘একদল সৈনিককে নিয়ে আমার বাড়ির দিকে
এগোচ্ছে মেজর আবরা। আর বড় জোর এক মিনিট, তারপরই
আমি তাকে দেখতে পাব না।’
‘শুনুন,’ বলল রানা। ‘আবরা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র
জানাবেন আমাকে। তারপর আমি ত্রিশ পর্যন্ত গুণে ফাটিয়ে èে
সব।’
সাত
কেল−াটা পাথরের তৈরি হলেও, কয়েকশো বছরের পুরানো। সেই
কেল−ার ভিতর, বড় একটা উঠানের নীচে, জোরাল বিস্ফোরণ
ঘটলে তার ধাক্কা কতটা সামলাতে পারবে বলা মুশকিল।
বিস্ফোরক বসাবার সময় কথাটা মাথায় রাখতে হয়েছে রানাকে।
তবে পতিতালয়ের চারপাশে মসজিদ, গির্জা, আর খোলা মাঠ
থাকায় নিরীহ মানুষ হতাহত হওয়ার তেমন আশঙ্কা নেই।
দুশো গজ টানেলের পাঁচ জায়গায়, আর ইস্পাতের দেয়ালে,
মোট এই ছ’জায়গায় বিস্ফোরক বসানো হয়েছে। প্রথমে ভাবা
হয়েছিল বিস্ফোরণ থেকে বাঁচবার জন্য কুয়ার কাছাকাছি, সিঁড়ির
ধাপে আশ্রয় নেবে ওরা। কিন্তু পরে চিন্তাটা বাতিল করে দিতে
হয়েছে।
ইজরায়েলিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কুয়াটাকে বুজিয়ে দিয়েছে,
ফলে ওদিক দিয়ে বেরুবার কোন উপায় নেই। এখন যদি কুয়ার
কাছাকাছি আশ্রয় নিয়ে টানেলের পাঁচ জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো
হয়, প্রাণ নিয়ে মাটির উপর উঠতে পারবে কোন দিন? টানেলটা
তো সম্পূর্ণই ধসে পড়বে, প্রায় গোটা পতিতালয় নিয়ে।
চিন্তা-ভাবনা করে দু’দফা বিস্ফোরণ ঘটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
রানা। প্রথম বার টানেলে বসানো বিস্ফোরকগুলো ফাটানো হবে,
ওরা তখন থাকবে আলমারির পিছনের ঘরটায়।
ওই ঘরের ইস্পাতের দেয়ালে ফিট করা বিস্ফোরক ফাটানো
হবে বিশ কি ত্রিশ সেকেন্ড পর, ওরা তখন থাকবে ওই ঘরের ঠিক
বাইরেÑটানেলের যে অংশে বিস্ফোরক বসানো হয়নি।
কেল−ার ছাদ থেকে মেজর আবরাকে অনুসরণ করছে জয়তুনের
তীক্ষèদৃষ্টি। এই লোক বডিগার্ডল্ডে নিয়ে চোখের আড়াল হোক,
সঙ্গে সঙ্গে সুরাইয়ার বিদেশী বন্ধুকে খবরটা জানিয়ে দেবে সে।
এই সময় হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল ওয়য়্যারলেস সেট।
‘একটুর জনেব্ধরা পড়িনি!’ অপর প্রান্ত থেকে হাঁপাতে
হাঁপাতে রিপোর্ট করল একটা মেয়ে। ‘রেস্তোরাঁর পিছনের কামরায়
এসে দেখে কেউ নেই। ট্র্যাপ ডোর খুলে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে
এসে দেখি একটা পাগলকে বেঁধে রেখে সবাই চলে গেছে।’
৩৫
‘পাগল? এর মধেঞ্জাবার পাগল এল কোত্থেকে?’
‘তা আমি কী করে বলব! লোকটা গলায় এমনভাবে আঙুল
ঢোকাচ্ছে, পারলে যেন গোটা হাতটাই সেঁধিয়ে দেয়।’
‘এই না বললি তাকে বেঁধে রেখে গেছে!’
‘গেছেই তো, তবে শুধু পা দুটো।’
‘ঠিক আছে, ওই লোকের নাগালের বাইরে ব্যাগটা রেখে চলে
আয় তুই,’ নির্দেশ দিল জয়তুন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল সে। পরমুহূর্তেই রানার সঙ্গে
যোগাযোগ করল: ‘মেজর আবরাকে এই মু-হূ-র্ত থে-কে আ-মি
দে-খ-তে পা-চ্ছি...না!’
‘ধনল্টাদ,’ রানার যান্ত্রিক কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে এল জয়তুনের
কানে।
জানে রানা গুণছে, ওর সময়ের সঙ্গে থাকবার জন্য জয়তুনও
গুণতে শুরু করল: ‘এক...দুই...তিন...চার...’
নীচের রাস্তা থেকে ইজরায়েলি সৈনিক দেখল কেল−ার ছাদে বোরকা পরা নিঃসঙ্গ মেয়েটা কার সঙ্গে যেন ওয়য়্যারলেসে কথা
বলছে। কোমরে আটকানো ওয়াকি-টকি মুখের সামনে তুলে
মেজর আবরার সঙ্গে যোগাযোগ করল সে।
বেশ্যাপাড়ায় ফিরে জয়তুনের বাড়ির দিকে এগোচ্ছে মেজর
আবরা, সঙ্গে বডিগার্ড ছাড়াও একজন ক্যাপটেনের অধীনে
কয়েকজন সৈনিক রয়েছে। পাড়ার বাড়িগুলো সব খালি দেখে
ক্যাপটেনকে প্রশ্ন করতে যাবে, এই সময় ওয়াকি-টকি জ্যান্ত হয়ে
উঠল।
‘মেজর আবরা।’ ওয়াকি-টকি মুখের সামনে তুলল সে।
সৈনিক নিজের পরিচয় দিয়ে রিপোর্ট করল: ‘কেল−ার ছাদে একা একটা মেয়ে। চোখে বিনকিউলার দেখে আমার সন্দেহ
হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর এখন দেখছি ওয়য়্যারলেসে
কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।’
‘কিল হার!’ নির্দেশ দিল মেজর আবরা।
‘সার!’ সৈনিক ভাবল, ভুল শুনেছে। মেয়েটার যেহেতু
পালাবার উপায় নেই, সে আশা করছিল মেজর তাকে ধরে এনে
ইন্টারোগেট করতে চাইবে।
‘কিল হার!’ এবার গর্জে উঠল মেজর আবরা।
ওয়াকি-টকি বন্ধ করে কাঁধ থেকে একে-ফোরটিসেভেন
নামাল সৈনিক। তার এই অটোমেটিক রাইফেলে টেলিস্কোপ
লাগানো আছে।
কিন্তু সব বৃথা হয়ে গেল আপাতত। ছাল্ডে কিনারা থেকে
সরে গেছে মেয়েটি। তার মাথার উপরের অংশটুকু, ইঞ্চি দেড়েক,
দেখা যাচ্ছে শুধু। এত দূর থেকে ওটাকে টার্গেট করা সম্ভব নয়।
অপেক্ষায় থাকল সৈনিক।
জয়তুন গুণছে: ‘পঁচিশ...ছাব্বিশ...সাতাশ...’
মেজর আবরা জয়তুনের বাড়িতে ফিরে এসেছে। এই মুহূর্তে
বেডরুমে স্ফাড়িয়ে রয়েছে সে, সেই রহস্যময় দেয়াল-আলমারিটার
সামনে। এখানে তার জনঞ্জপেক্ষা করছিল কয়েকজন সৈনিক।
আলমারির পিছনে ইস্পাতের দেয়াল পাওয়া গেছে।
সৈনিকরা তাতেই বিস্ফোরক বসিয়েছে। এখনই ফাটানো হবে
বিস্ফোরক, কাজটায় কোন খুঁত আছে কিনা মেজর আবরা দেখে
নেওয়ার পর।
রানা গুণলÑত্রিশ।
জয়তুন গুণলÑত্রিশ।
কেল−াটা অকস্মাৎ এমন দুলে উঠল, তাল সামলাতে না পেরে
ছাদে পড়ে গেল জয়ত্নু। দোলাটা থামতে দেরি হচ্ছে দেখে
জয়তুন আতঙ্কিত হয়ে উঠল। ভাবল, এতদিনের পুরানো কেল−া
না পড়ে যায়।
পাঁচিল ধরে স্ফাড়াল সে। দোলাটা থেমে গেছে। কেল−া
পড়েনি। সে তার পাড়ার দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল।
৩৬
জয়তুন না স্ফাড়ালে এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হত।
তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে পতিতালয়ের একটা অংশ এখনও
মাটির তলায় ডেবে যাচ্ছে।
টানেলে বিস্ফোরণ ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে টহলরত সৈনিকল্ডে
নিয়ে পাড়ার এই অংশটা ধসে পড়েছিল। কাত হওয়া বাড়ি-ঘরের
নীচে চাপা পড়া ইজরায়েলি সৈনিক যারা তখনও মারা যায়নি তারা
ভাঙা দেয়াল আর আবর্জনা সরিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা
করছিল, কিন্তু দেখল মাটির তলায় আরও ডেবে যাচ্ছে জমিন।
বিস্ফোরণের পর মাত্র দশ কি পনেরো সেকেন্ড পার হয়েছে,
অভিশপ্ত ইজরায়েলি সৈনিকল্ডে উপর ব্রাশ ফায়ার শুরু করল
হামাস সদসশুা।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে পাড়ার কাছাকাছি বিস্ফোরণের
অপেক্ষায় ছিল তারা। এমন সুযোগ খুব কমই পাওয়া
যায়Ñআত্মঘাতী না হয়েও ডজন ডজন ইজরায়েলি সৈন্যকে খতম
করা যাচ্ছে।
ওল্ডে লিডার ভাবছে, যিনি ওল্ডেকে এ রকম একটা সুযোগ
করে দিয়েছেন তিনি শুধু বিদেশী শুভানুধ্যায়ী হতে পারেন না, ইনি
নিশ্চয়ই আল−াহর তরফ থেকে পাঠানো কোন ফেরেশতা হবেন।
জয়তুনের বেডরুমে যারা ছিল তারা প্রথমে ভাবল ভূমিকম্প
শুরু হয়েছে। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সবাই, সবার আগে
রয়েছে মেজর আবরা। কিন্তু দেখা গেল বাইরের পাহারাদার
সৈনিকরা ছুটে ঘরে ঢুকতে চাইছে। হইচই আর চিৎকার-
চেঁচামেচির মধ্যে জানা গেল, পাড়ার মধঞ্জার দক্ষিণ ভাগ ধীরে
ধীরে মাটির তলায় নেমে যাচ্ছে। সেই ভূমিধসের নীচে পড়া
আহত সৈন্যল্ডে পাখির মত গুলি করে মারছে হামাস।
আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা মেজরসহ সৈনিকল্ডে আবার
জয়তুনের বেডরুমে তাড়িয়ে নিয়ে এল।
আর ঠিক তখনই ঘটল আরেক দফা বিস্ফোরণ।
লোহার ফ্রেমে ইস্পাতের পাত দিয়ে বানানো দেয়াল ছিটকে
এসে পড়ল বেডরুমের ভিতর। বিস্ফোরণের ধাক্কাতেই মেজর
আবরা আর সৈনিকল্ডে প্রাণবায়ু বের হয়ে যাওয়ার কথা, তা না
হলে ভারী দেয়ালটা সবার হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিয়ে সেই অসমাপ্ত
কাজটা নিশ্চয়ই শেষ করেছে।
ছিটকে পড়া ইস্পাতের দেয়ালের উপর দিয়ে ছুটছে রানা,
পিছনে সুরাইয়া আর ইউসুফ। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র,
জয়তুনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তীর বেগে, ছুটছে উত্তর
দিকে। ওয়য়্যারলেস সেটটা কানে চেপে ধরেছে রানা।
বিস্ফোরণের ত্রিশ সেকেন্ড পর কেল−ার ছাদ থেকে ওল্ডেকে
দেখতে পেল জয়তুনÑপাড়ার যে অংশটা তার দৃষ্টিপথের মধ্যে,
ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল সেখানে। প্রথমে রয়েছে রানা, তারপর
সুরাইয়া, সবশেষে ইউসুফ।
‘আপনাল্ডে এখন আমি দেখতে পাচ্ছি। আপনারা সিঁড়ির
দিকে আসবেন না,’ রানাকে বলল জয়তুন। ‘কেল−ার ছাত্থেঠার
ল্ডকার নেই। বাঁ দিকের গলিটা ধরে আরেক উঠানে
বেরোনÑরেস্তোরাঁটা ওদিকেই। ওই রেস্তোরাঁর পিছনের ঘরে
ঢুকবেন। কার্পেট সরালে একটা ট্র্যাপ...’
‘ওখানে কেন যেতে হবে?’ জানতে চাইল রানা।
‘ওখানে আমার তরফ থেকে আপনার জন্যে একটা তোফা
আছে, হুজুর...সরি, ভাই।’
‘কিন্তু আপনাকে যে ইউনিফর্মের কথা বলেছিলাম...’
‘একটা ব্যাগে পাবেন,’ বলল জয়তুন, ছাল্ডে কিনারা ধরে
হাঁটছে সে, জানে একটু পরই দৃষ্টি পথের আড়ালে চলে যাবে
রানা।
‘মেজর বারাইল্ডি খবর কিছু জানেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
নীচের রাস্তা থেকে তার টার্গেট পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে
৩৭
ইজরায়েলি সৈনিক। টেলিস্কোপিক সাইটে চোখ রেখে একে-
ফোরটিসেভেনের ট্রিগার টেনে দিল সে।
কাছাকাছি থেকে হামাসের অবিরাম গুলি বষর্ণের আওয়াজ
ভেসে আসছে, ফলে সৈনিকের গুলির শব্দ রানা শুনতে পাবে না।
তবে জয়তুন জবাব দিতে দেরি করছে বলেই হোক বা ষষ্ঠ
ইন্দ্রিয়ের প্ররোচনাতেই হোক, ঘাড় ফিরিয়ে কেল−ার ছাল্ডে দিকে
তাকাল ও।
দুর্গ প্রাকারের কিনারায় স্ফাড়িয়ে রয়েছে জয়তুন। অকস্মাৎ
বিস্ফোরিত হলো কালো কাপড়ে ঢাকা তার খুলি। বেলা দুটোর
তেতে ওঠা ফিলিস্তিনি রোদ্মেকটকে লাল কুয়াশা বা ধোঁয়ার মত
দেখা গেল ঠিক যেখানটায় তার মাথা ছিল। বুঝতে অসুবিধে হয়
না, ওগুলো রক্তকণা, বাষ্পের মত উড়ে গেল বাতাসে।
জয়তুনের শরীরটা আগেই ছাল্ডে মেঝেতে পড়ে দৃষ্টিপথ
থেকে হারিয়ে গেছে।
ট্র্যাপডোর খুলে মাটির তলার ঘরটায় নামছে রানা। পায়ে লোহার
আঙটা পরানো, আঙটার সঙ্গে শিকল রয়েছে, জানালার গ্রিলে
আটকানো মেজর এবরান বারাইদিকে এই অবস্থায় দেখে খুব যে
একটা অবাক হলো, তা নয়। তবে ওকে বিমূঢ় করে তুলল
মোসাদ এজেন্টের নোংরা আচরণ।
গলায় আঙুল দিয়ে মেঝেতে প্রচুর বমি করেছে বারাইদি, আর
সেই বমি আঙুল দিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে।
‘কী হয়েছে তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
ঝট করে মুখ তুলে তাকাল বারাইদি। সিঁড়ি বেয়ে রানাকে
নেমে আসতে দেখে স্থির হয়ে গেল সে। ‘না, কই, কিছু
হয়নিÑআমি অসুস্থ,’ নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল সে।
সিঁড়ির পাশেই একটা টেবিল, তাতে রাখা ক্যানভাসের
পেটমোটা ব্যাগটার উপর চোখ পড়ল রানার। পিছন দিকে
তাকিয়ে সুরাইয়াকে বলল, ‘ইউনিফর্ম বের করে তাড়াতাড়ি পরে
নাও। জায়গাটা বিপজ্জনক।’
‘চিন্তা কোরো না,’ দ্রুত বলল সুরাইয়া। ‘ইউসুফ নিজের প্রাণ
দিয়ে হলেও আমাল্ডেকে রক্ষা করবে।’
ব্যাগটার পাশে একটা রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র দেখতে পেল
রানা, পেপার ওয়েট হিসাবে বল্টহার করা হয়েছে। একপাশে
লোহার একটা চাবিও পড়ে রয়েছে।
যন্ত্রটা সরিয়ে কাগজটার ভাঁজ খুলল রানা। আরবী হরফে
একটা মেসেজ ত্থেয়া হয়েছে: ‘জয়তুনের অনুরোধে মোসাদ এজেন্টের প্রাণ ভোমরা আপনার হাতে তুলে ত্থেয়া হলো।
বারাইদিকে আড়াই ইঞ্চি লম্বা একটা ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়েছে।
ক্যাপসুলের ভিতর বিস্ফোরক আছে, রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটার
সাহায্যে দুশো গজ দূর থেকে ফাটানো যাবে। তবে দশ ফুট দূর
থেকে ফাটালেও ভয়ের কিছু নেই, আপনার কোন ক্ষতি হবে না।
‘যন্ত্রের লাল বোতামটায় তিনবার চাপ দিতে হবে। আশা করি
বারাইদিকে নিজের মনের সাধ মিটিয়ে গান গাওয়াতে পারবেন
আপনি।’
‘হ্যাঁ, শুরু করতে পারো তুমি,’ সুরাইয়ার হাত থেকে এক
সেট ইউনিফর্ম নিয়ে পরছে রানা, তাকিয়ে আছে বারাইল্ডি
দিকে।
‘মানে?’ বোকা সাজবার ভান করল বারাইদি।
‘বমি তো যা করার করেছ। আরও যদি করতে পারো করো,
কিন্তু তাতেও কোন লাভ হবে না। কারণ ক্যাপসুলটা আকারে
এত বড় যে ওপরে ওঠার সময় বাধা পাচ্ছে। তারচেয়ে তোমাল্ডে
নতুন অস্ত্র আর নাজাফি সম্পর্কে যা জানো সব বলে ফেলো।
আমার যদি দয়া হয়, প্রাণে বাঁচবার একটা সুযোগ পেলেও পেতে
পারো।’
‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
৩৮
‘পারছ, পারছ। তুমি আমার সঙ্গে নাজাফি পর্যন্ত যাচ্ছ,
কাজেই মিথ্যে কথা বলছ কিনা ধরে ফেলব আমি। মনে রেখো,
রিমোটটা আমার কাছে।’
ল্ডল্ড করে ঘামছে বারাইদি। শার্টের আস্তিন দিয়ে মুখ
মুছল।
‘দাও, রিমোটটা আমাকে দাও,’ হঠাৎ হাত পাতল সুরাইয়া।
‘একটা মোসাদ মেরে কিছুটা পুণঞ্জর্জন করি।’
হঠাৎ হেসে উঠল বারাইদি। তারপর ঝট করে হাসি থামিয়ে
কর্কশ ঘরঘরে কণ্ঠে বলল, ‘আমি যদি সব কথা তোমাল্ডে
জানিয়েও দিই, ইজরায়েলের তাতে কোনও ক্ষতি হবে না। তবে
তার আগে জানতে হবে, আমার কি সত্যি কোন লাভ হবে?’
‘হ্যাঁ, হবে,’ বলল রানা। ‘তোমাকে মেরে না ফেলে কোথাও
আটকে রাখব আমরা। তুমি নিজেই নিজের চেষ্টায় সেখান থেকে
মুক্ত হতে পারবে, তবে আমি ইজরায়েল থেকে বেরিয়ে যাবার
পর।’
‘তোমরা যে বেঈমানী করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?’
‘কোন নিশ্চয়তা নেই। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে।’ হাসল
রানা। ‘এটা জুয়া, বারাইদি। যেহেতু হারাবার কিছু নেই, তোমার
খেলাই উচিত।’
এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বারাইদি কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তোমাকে
আমি একজন ভদ্রলোক বলেই জানি, রানা। কাজেই তোমার
কথায় বিশ্বাস রাখছি। তবে আরেকটা প্রতিশ্র“তি চাই আমি।’
‘কী?’
‘তোমার সঙ্গিনীর হাতে রিমোটটা দিতে পারবে না।’
‘ঠিক আছে,’ হাসি চেপে বলল রানা।
‘বলো, প্রথমে কী জানতে চাও তুমি?’
‘তুমি আগাগোড়া যা জানো, গড়গড় করে বলে যাবে সব,’
বলল রানা। ‘মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করব আমি। তবে এখনই নয়।’
কাপড় ছেড়ে ইউনিফর্ম পরা হয়ে গেল রানা আর সুরাইয়ার।
আলখেল−া খুলে ফেললেও, ইউনিফর্মটা নিজের শার্ট আর
ট্রাউজারের উপরে পরেছে রানা। আলখেল−ার পকেটে যা যা ছিল
সব এখন ওর ট্রাউজার বা ইউনিফর্মের পকেটে জায়গা করে
নিয়েছে।
সুরাইয়াও শুধু বোরকাটা ছাড়ল, সালোয়ার-কামিজের উপর
বাঘের ছাপ মারা উর্দি পরেছে।
‘রাইট,’ রানা থামতে সুরাইয়া বলল, ‘আগে এই জায়গা
থেকে বেরোই আমরা।’
টেবিল থেকে লোহার চাবিটা তুলে নিয়ে শিকলের তালা
খুলল রানা। শিকল মুক্ত হয়ে টলোমলো পায়ে স্ফাড়াল বারাইদি।
রানার হাতে রিমোট নয়, পিস্তল; ইঙ্গিতে সামনে থাকতে
বলল বারাইদিকে।
ট্র্যাপডোর খুলে রেস্তোরাঁর পিছনের কামরাটায় উঠে এল
ওরা। রেস্তোরাঁর একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে রাস্তার উপর
নজর রাখছিল ইউসুফ, ওল্ডে আওয়াজ শুনে ফিরে এসে ল্ডজা
বন্ধ করে দিল।
‘চারদিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে ওরা,’ বলল সে। ‘তবে
এদিকে আসছে না।’
‘তা না এলেও, বারাইদিকে নিয়ে রাস্তায় বেরুনো সম্ভব নয়,’
বলল সুরাইয়া। ‘অফিসারল্ডে অনেকেই ওকে দেখা মাত্র চিনে
ফেলবে।’
‘চিনলে তো আরও ভাল,’ বলল রানা। ‘তাল্ডেকে বারাইèিলতে পারবে, তাড়াতাড়ি একটা গাড়ির বল্টস্থা করে দাও, আমরা
নাজাফিতে যাব।’
‘তুমি বলতে চাইছ, বারাইজ্ঝিামাল্ডেকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা
করবে না?’
‘রিমোটের কথা ভুলে?’ সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল রানা,
৩৯
তারপর মাথা নাড়ল।
‘জুয়াটা আমি খেলব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,’ আত্মসম্মান ফিরে
পাওয়ার জন্য কিছু বলতে হয়, তাই বলছে বারাইদি। ‘তা ছাড়া,
আত্মহত্যা করাটাকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি কাপুরুষতা বলে মনে
করি।’
‘ইউসুফ,’ বলল রানা। ‘বিদায়। আমরা বেরিয়ে যাবার পাঁচ
মিনিট পর বেরুবে তুমি। কোথায় যাবে?’
‘কেল−ার দক্ষিণ দিকটায়,’ জবাব দিল ইউসুফ।
‘ইজরায়েলিল্ডে সঙ্গে গানফাইটটা ওদিকেই সরে গেছে বলে মনে
হয়।’
‘শুভেচ্ছা রইল, ইউসুফ,’ বলল সুরাইয়া।
ল্ডজা খুলে রেস্তোরাঁর ভিতর দিয়ে বাইরে তাকাল ইউসুফ।
রাস্তা, রাস্তার পর উঠান পড়ে আছে; না আছে সৈন্যল্ডে টহল, না
আছে লোকজনের চলাচল।
প্রথমে সুরাইয়া বেরুলÑসুদর্শনা ক্যাপটেন, চেহারা আর
হাঁটাচলায় দৃঢ়তা, তবে কী কারণে যেন ব্যস্ত। তার পিছনে
রানাÑস্মার্ট, সুপুরুষ, চেহারায় আর হাবভাবে কাঠিন্য। ওর পাশে
দীর্ঘকায় মোসাদ এজেন্টÑউদ্বিগ্ন, ক্লান্ত।
রানা আর বারাইদি নিচু গলায় আলাপ করছে। যা বলবার
গড়গড় করে বারাইদিই বলছে, রানা শুধু মাঝে মধ্যে দু’একটা
প্রশ্ন করছে।
কেল−ার প্রধান ফটক এড়িয়ে অন্য পথ ধরে এগোচ্ছে
সুরাইয়া। দূর থেকেই ট্যাংক আর সৈনিকল্ডে জটলা দেখা যাচ্ছে
ওদিকে। মিনিট তিনেক এ-গলি সে-গলি ধরে হাঁটল, তারপর
ভাঙা একটা পাঁচিল টপকে ওল্ডেকে বের করে আনল বাইরে।
কেল−ার বাইরেও শহরের পরিবেশ থমথম করছে। ট্যাংক
আর ট্রুপস ক্যারিয়ার স্ফাড়িয়ে আছে। বালির বস্তা দিয়ে ঘেরা হেভি
মেশিন গান দেখা যাচ্ছে। ধুলো উড়িয়ে একটা জিপ ছুটে
গেলÑপাঁচজন আরোহী। সেটার পিছু নিয়ে আরেকটা
আসছেÑএটায় ড্রাইভার একা।
রাস্তার প্রায় মাঝখানে চলে এল রানা আর সুরাইয়া,
বারাইদিকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে রেখেছে। ড্রাইভারের উদ্দেশে
একটা হাত এমন ভাবে তুলল, ওটা যেন একটা ব্যারিয়ার।
দ্রুত ব্রেক কষে ওল্ডে পাশে জিপ থামাল ড্রাইভার।
ইউনিফর্ম বলে দিল সে একজন লেফটেন্যান্ট।
হুইল থেকে একটা হাত তুলে স্যালুট করল লেফটেন্যান্ট।
‘ইয়েস, সার?’
জবাবে কেউ কিছু না বলে দ্রুত উঠে বসল জিপে।
বারাইদিকে নিয়ে রানা উঠল পিছনে। সুরাইয়া বসেছে
লেফটেন্যান্টের পাশের সিটে।
‘তুমি নাজাফিতে যাচ্ছ, তাই না?’ পিছন থেকে আরবীতে
জিজ্ঞেস করল রানা।
‘না, সার,’ হিব্র“ ভাষায় জবাব দিল ড্রাইভার, ভ্যাবাচাকা
খেয়ে গেছে।
‘যাচ্ছ,’ বলল সুরাইয়া, হিব্র“ ভাষায়।
সুরাইয়াকে
দেখল
লেফটেন্যান্ট।
‘আ-আ-প-নি...’
সুরাইয়াকে চিনতে পেরেছে সে।
‘হ্যাঁ, আমি,’ চাপা গলায় খেঁকিয়ে উঠল সুরাইয়া। ‘জিপ
ছাড়ো!’
‘কিন্তু আমি তো মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছি, ক্যাম্প
লিডারকে রিপোর্ট করতে।’ ঘাড় ফেরাতে রানার হাতে পিস্তল
দেখতে পেল সেÑবারাইল্ডি দিকে তাক করা।
হাতের পিস্তলটা ড্রাইভারের পাঁজরে চেপে ধরল সুরাইয়া।
‘আবার বলো, কোথায় যাচ্ছ?’
জিপ ছেড়ে দিল লেফটেন্যান্ট। ‘আপনারা যেখানে বলবেন,’
বিড় বিড় করল সে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরতি পথ ধরল।
৪০
‘তোমার আর তোমার কমান্ডিং অফিসারের নাম বলো,’
খানিক পর ইংরেজিতে জানতে চাইল রানা।
সুরাইয়ার দিকে ফিরে লেফটেন্যান্ট বলল, সে ইংরেজি জানে
না।
‘আমরা তা হলে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে পারি,’
সুরাইয়াকে বলল রানা, পাশের সিটে বসা বারাইল্ডি উপর থেকে
ভুলেও চোখ সরাচ্ছে না।
‘পারি।’ মাথা ঝাঁকাল সুরাইয়া।
‘বারাইèিলছে,’ শুরু করল রানা, ‘বছর তিনেক আগে
নাজাফির স্পেস সেন্টার থেকে বিদেশী বিজ্ঞানীল্ডে সহায়তা নিয়ে
মহাশূন্যে একটা স্পেস স্টেশন পাঠিয়েছে ইজরায়েল।’
‘ওখান থেকে রকেট-টকেট ছোঁড়া হয় বলে শুনেছি,’ বলল
সুরাইয়া। ‘নিশ্চয়ই অরবিটিং ল্যাবরেটরির কথা বলছে।’
‘না, সুরাইয়া। ওটা পুরোদস্তুর একটা স্পেস স্টেশন। ওটার
নাম অ্যাবি। অ্যাবির এক প্রান্তে অত্যন্ত সফিস্টিকেটেড একটা
মিলিটারি পোস্টও বসিয়েছে ওরা।’
‘মানে? মহাশূন্যে মিলিটারি পোস্ট কী কাজে আসবে?’
সুরাইয়ার কান যেদিকেই থাকুক, চোখ দুটো শুধু রাস্তা আর
লেফটেন্যান্টকে নিয়ে ব্যস্ত।
‘বারাইèিলছে, অ্যাবির বাইরে ওরা কাঁচ বসিয়েছে।
সাধারণ কাঁচ নয়, ম্যাগনিফাইং। ফ্রেমে আটকানো ওই কাঁচ
ঘুরিয়ে পৃথিবীর যে-কোন এলাকায় ফোকাস করা যায়। রোদকে
কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ গুণ উত্তপ্ত করা যায় ওটার
সাহায্যে। যে-কোন জিনিস, ইস্পাত পর্যন্ত চোখের পলকে গলিয়ে
ফেলা যায়।’
খবরটা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুরাইয়া।
ইতিমধ্যে শহর পিছনে ফেলে ঊষর মরুভূমিতে বেরিয়ে
এসেছে ওল্ডে জিপ। দূরে দু’সারি পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সরল
রাস্তাটা সেদিকেই এগিয়েছে।
‘ওটাকে ওরা অস্ত্র হিসেবে বল্টহার করবে? ওই তাপকে?’
অবশেষে জানতে চাইল সুরাইয়া।
‘হ্যাঁ। বারাইèিলছে, অস্ত্রটা নিয়ে এখনও এক্সপেরিমেন্ট
করছে ইজরায়েলি বিজ্ঞানীরা। তাল্ডে ধারণা, এই অস্ত্রের কাছে
পারমাণবিক বোমা কিছুই নয়।’
‘ওর কথা তুমি বিশ্বাস করো?’ জানতে চাইল সুরাইয়া।
‘অনেকটাই করি,’ বলল রানা। ‘কারণ অস্ত্রটা কতটুকু কী
ক্ষতি করতে পারে, সে-সম্পর্কে আমার ধারণা আছে।’
‘এখন তা হলে একটা প−্যান তৈরি করতে হয়,’ বলল
সুরাইয়া। ‘কী ভাবে নাজাফি স্পেস সেন্টার ধ্বংস করা যায়।’
রানা কিছু বলবার আগে হেসে উঠল মোসাদ এজেন্ট
বারাইদি। ‘সিকিউরিটি এত কড়া যে স্পেস সেন্টারে তোমরা
ঢুকতেই পারবে না,’ হাসি থামিয়ে বলল সে। ‘আর ঢুকলেই বা
কী, অস্ত্রটা তোমরা পাচ্ছ কোথায়? ওটা তো মহাশূন্যেÑস্পেস
স্টেশনে। আমাল্ডে বিজ্ঞানীরা খেয়াযান জুবিলিতে চড়ে আসা-
যাওয়া করে, কিন্তু তোমরা তো ওটার ধারে কাছেও ঘেঁষতে
পারবে না।’
রানার মাথায় একের পর এক আইডিয়া আসা-যাওয়া করছে।
একটা স্পেস স্টেশনে প্রচুর পরিমাণে লাফিং গ্যাস পাওয়া যায়।
স্পেস স্টেশনে সাপ−াই ত্থেয়া হবে, এরকম অক্সিজেন ট্যাংকে
ওই লাফিং গ্যাস ভরে দিলে কেমন হয়? কিংবা স্টেশনের বিজ্ঞানী
আর টেকনিশিয়ানল্ডে খাবারে মিশিয়ে ত্থেয়া যায় মারাত্মক
কোন জীবাণু বা বিষ।
সবচেয়ে ভাল আইডিয়াটা সবশেষে খেলল মাথায়। স্পেস
স্টেশনে আসা-যাওয়ার জন্য যে খেয়াযানটা নিয়মিত বল্টহার করা
হচ্ছে, সময়সূচি জেনে নিয়ে সেই জুবিলিতে টাইমার সহ প্রচুর
বিস্ফোরক ফিট করতে হবে। স্পেস স্টেশনে পৌঁছেইÑবুম! প্রচণ্ড
৪১
বিস্ফোরণে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে আয়না সহ ইজরায়েলিল্ডে স্পেস
স্টেশন অ্যাবি।
রানার চোখ দুটোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বারাইদি,
হঠাৎ খুক খুক করে হেসে উঠে বলল, ‘জানি কী ভাবছ তুমি।’
রানা কিছু বলল না।
‘ভাবছ,’ আবার বলল বারাইদি, ‘খেয়াযান জুবিলি অচল করে
দেবে। রাইট?’
‘যদি সম্ভব হয়,’ বলল রানা।
‘সেক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছাতে হবে তোমাকে।
কীভাবে পৌঁছাবে সেটা অবশ্য তোমার ব্যাপার। তবে দেরি
করলে জুবিলি আবার না রওনা হয়ে যায়!’
এদিকে দুইসারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এগিয়েছে রাস্তা।
চট্ করে একবার রানার দিকে তাকাল সুরাইয়া। ‘সামনে খাদ।
ড্রাইভিং সিটে আমাল্ডে একজনকে বসতে হবে।’
যুক্তিটা বুঝল রানা। ইজরায়েলি ড্রাইভার মরতে ভয় না পেলে
আরোহীসহ জিপ নিয়ে নীচের খাদে পড়তে ইতস্তত করবে না।
‘এই, জিপ থামাও,’ ড্রাইভারকে বলল রানা।
ধীরে ধীরে থামল জিপ। ড্রাইভারের উপর চোখ রেখে নীচে
নামল সুরাইয়া।
‘আমি পেচ্ছাব করব,’ আরবীতে বলল বারাইদি।
‘আমিও,’ বলল লেফটেন্যান্ট।
জিপ থেকে নেমে ইঙ্গিতে রাস্তার ওপারটা দেখাল রানা
বারাইজ্ঝিার ড্রাইভারকে। ‘পাশাপাশি স্ফাড়িয়ে কাজ সারো।
আমরা ঠিক পিছনেই থাকব।’
জিপ থেকে নেমে রাস্তা পেরুল বারাইজ্ঝিার ড্রাইভার। এক
জায়গায় পাশাপাশি স্ফাড়িয়ে ট্রাউজারের চেইন খুলতে যাবে, পিছন
থেকে ড্রাইভারকে বাধা দিল সুরাইয়া।
‘এত কাছাকাছি স্ফাড়িয়েছ কেন?’ কর্কশ গলায় বলল সে।
‘আরও পাঁচ-সাত হাত সরে স্ফাড়াও।’
কাঁধের উপর দিয়ে সুরাইয়াকে একবার দেখল লেফটেন্যান্ট।
বারাইল্ডি কাছ থেকে হাত পাঁচেক দূরে সরে স্ফাড়াল সে, সারা
শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে।
প্রথমে সে-ই শেষ করল। চেইন টেনে তুলতে যাচ্ছে, এই
সময় পয়েন্ট ব−্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তার খুলিটা উড়িয়ে দিল সুরাইয়া।
গুলির শব্দ পাহাড়ে লেগে প্রতিধ্বনি তুলছে।
আট
‘হোয়াট দা হেল!’ রানা হতচকিত, ঝট্ করে ঘাড় ফিরিয়ে
সুরাইয়ার দিকে তাকাল।
সটান পড়ে গেল লেফটেন্যান্টের লাশ। সেটাকে পাশ কাটিয়ে
সামনে এগোল সুরাইয়া। ‘লোকটা আমাকে চিনে ফেলেছিল,
মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরির গেটে ডিউটি দেয়ার সময় দেখে থাকবে।’
ড্রাইভারের হাত দুটো ধরে টানছে সে। ঘন একটা ঝোপের ভিতর
লাশটা লুকিয়ে রাখবে।
রানা কিছু বলতে যাবে, চোখের কোণে ক্ষিপ্র বেগে কিছু
একটা নড়ে উঠতে দেখল। এই মুহূর্তে সরাসরি বারাইল্ডি দিকে
তাকিয়ে নেই বটে, তবে হাতের পিস্তল তার দিকেই তাক করা।
জানে কী ঘটতে যাচ্ছে, কাজেই ট্রিগার টেনে দিল রানা।
একটা ঝাঁকি খেল বারাইদি, ছুটে পালাবার গতি আরও দ্রুত
হলোÑতবে তা মুহূর্তের জন্য মাত্রÑতারপরই ষ্ণাম করে আছাড়
৪২
খেল মাটিতে।
ঢিল পড়ল রানার পেশীতে।
আর ঠিক তখনই ছেড়ে ত্থেয়া ¯িপ্রঙের মত একটা লাফ
দিয়ে আবার ছুটল বারাইদি। ওল্ডে আর জিপটার কাছ থেকে
দূরে সরে যাচ্ছে সে, ফিরে যাচ্ছে তুফার দিকে।
বারাইদিকে নিয়ে কী করা হবে, এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি রানা।
তবে আশা করছিল তার সাহায্য নিয়ে নাজাফি স্পেস সেন্টারে
ঢোকা সহজ হবে।
সে আশায় এখন গুড়ে বালি। জরুরি অবস্থা, কাজেই
সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করেই নিতে হচ্ছে। বারাইদিকে রানা তুফায়
ফিরে যেতে দিতে পারে না। তুফায় পৌঁছাতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে
নাজাফি স্পেস সেন্টারের সিকিউরিটিকে টেলিফোনে সাবধান করে
দেবে সে, ফলে ওর জন্য ভিতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
পকেট থেকে রিমোটটা বের করল রানা। বারাইদি প্রাণপণে
ছুটছে, তবে ওর সঙ্গে তার দুরত্ব বিশ গজের বেশি হবে না।
রানার গুলি পুরোপুরি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। বারাইল্ডি কাঁধ ছুঁয়ে
বেরিয়ে গেছে বুলেট। ওটা আদৌ তার কোন মাংস নিতে পেরেছে
কিনা বলা কঠিন, তবে শার্টের কলার অনেকটাই নিয়ে গেছে।
রিমোট ধরা হাতটা লম্বা করল রানা। তারপর লাল
বোতামটায় চাপ দিল। পর পর তিনবার।
অকস্মাৎ বিস্ফোরিত হলো ছুটন্ত মোসাদ এজেন্ট, তবে তা
শুধু রানার কল্পনায়। এবরান বারাইদি যেমন ছুটছিল, এখনও
তেমনি ছুটছে।
যে-কোন কারণেই হোক, রিমোট কাজ করেনি। বারবার
বোতামে চাপ দিল রানা। কিন্তু বৃথা। ইতিমধেঞ্জনেকটা দূরে
চলে গেছে বারাইদি, পিস্তলের গুলিও লাগবে বলে মনে হয় না।
ঘুরে জিপের দিকে ছুটল রানা, দেখল ড্রাইভিং সিটে বসতে
যাচ্ছে সুরাইয়া। তার উপর রেগে আছে ও, তবে সেটা পরে ঝাড়া
যাবে। ‘জিপ ঘোরাও!’ লাফ দিয়ে জিপের পিছনে উঠল ও,
চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে। ‘ফলো হিম!’
জিপ ছাড়ল না সুরাইয়া। ‘শোনো, রানা। আমার একটা প−্যান
আছে। সেটা ধরে এগোতে চাইলে এখানে আর একটা মিনিটও
নষ্ট করা চলে না।’
‘তোমার প−্যান নিয়ে পরে কথা হবে,’ বলল রানা। ‘তুমি জিপ
ঘোরাও। আগে বারাইল্ডি বল্টস্থা ... ’
‘এই জিপ খাদে ফেলে দিয়ে পায়ে হেঁটে দুটো পাহাড়
টপকাতে হবে, রানা,’ বাধা দিয়ে বলল সুরাইয়া, হাতঘড়ির উপর
চোখ। ‘বেদুইন গাইড আমাল্ডে জন্য ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা
করছে। এক ঘণ্টার মধেদ্দখানে যদি পৌঁছাতে না পারি, ওরা
ফিরে যাবে।’
‘বেদুইন গাইড আমাল্ডে কেন ল্ডকার?’
‘ল্ডকার এই জন্যে যে পরশু রাতে ওল্ডে সর্দার বাহাউদ্দিন
চাচা আমাকে বলেছেন, তাঁর আব্বা পাহাড়ের একটা শিরস্ফাড়া
চেনেন, যেটার ভিতর দিয়ে অন্তঃসলিল বইছেÑআসলে টানেলের
ভিতর একটা ঝরণা ছুটছে, গোপন একটা পথ আর কী। আজ
দেখা হলে ওই পথের সমস্ত তথ্য জানতে পারব আমরা।’
রানা ইতস্তত করছে।
‘তুমি বললে আমি জিপ ছাড়তে পারি,’ তাগাদা দিল
সুরাইয়া। ‘এখন যদি কোন গাড়ি আসে, বিপদে পড়ে যাব
আমরা।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘তোমার প−্যান যদি স্পেস
সেন্টারের ভিতরে পৌঁছে দিতে পারে আমাকে, মন্দ কী।’
‘তোমাকে নয়, আমাল্ডেকে,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল সুরাইয়া।
‘ওল্ডে স্পেস সেন্টারে আমিও ঢুকব।’
জিপ ছেড়ে দিল সে। স্পীড দ্রুত বাড়াচ্ছে।
‘কেন, আমার মিশনের বারোটা বাজাবার জন্যে?’
৪৩
ঝট করে রানার দিকে একবার তাকাল সুরাইয়া। ‘তোমার
এ-কথার মানে?’
‘আমার অনুমতি না নিয়ে, একটু আভাস পর্যন্ত না দিয়ে,
ড্রাইভারকে তুমি কোন বুদ্ধিতে গুলি করলে? সঙ্গে এ রকম চমকে
দেয়ার লোক থাকলে মিশন কোঁচে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে
না।’
একদম বোবা হয়ে বসে থাকল সুরাইয়া।
একটু পর রানা বলল, ‘আমাকে আবার অকৃতজ্ঞ ভেবো না।
এই যে এত দূর আসতে পেরেছি, সে তো তোমার সাহায্য নিয়েই। কিন্তু তারপরও তোমাকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারছি
নাÑছোট্ট একটা ভুলের জনেঞ্জামরা দু’জনই মারা যেতে পারি।
তারচেয়ে বড় ক্ষতি, অর্থাৎ মিশনটাও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।’
‘সতিঞ্জামি দুঃখিত,’ অবশেষে মুখ খুলল সুরাইয়া। ‘কথা
দিচ্ছি, এরকম ভুল আর হবে না।’
‘ধনল্টাদ।’
আরও দশ মিনিট গাড়ি চালাবার পর একপাশে তিনশো ফুট
গভীর খাদ দেখা গল, আরেক পাশে পাথুরে পাহাড়ের ঢাল। জিপ
থামিয়ে নেমে পড়ল ওরা।
রাস্তাটা খাল্ডে দিকেই ঢালু, তাই সামান্য একটু ধাক্কা দিতেই
জিপের চাকা গড়াতে শুরু করল। পতনটা দেখবার জন্য কিনারায়
স্ফাড়িয়ে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকতে হলো ওল্ডেকে।
নীচের নদী মন্থর গতিতে বইছে, গভীরতা খুব বেশি হবে
বলে মনে হয় না। তবে জিপটা ওল্ডে পছন্দসই ভঙ্গিতে স্থির
হলো। খাল্ডে নীচের দিকের ঢালে তিনটে ডিগবাজি খেল ওটা,
তারপর একটা লাফ দিয়ে পৌঁছে গেল নদীর প্রায় মাঝখানে।
চারচাকা আকাশের দিকে তুলে স্থির হলো জিপ, পানির উপর ওই
চাকাগুলো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
খাল্ডে নীচে জিপ স্থির হতেই রানাকে পথ দেখাল সুরাইয়া।
ওল্ডে ভাগ্যই বলতে হবে যে তুফা বা নাজাফির দিক থেকে
এখন পর্যন্ত কোন গাড়ি আসেনি। পাহাড়ের ঢালে প্রচুর বোল্ডার
পড়ে আছে, আড়াল নিয়ে চূড়ায় উঠে এল ওরা।
সঙ্গে ম্যাপ আছে, মাঝে মধ্যে সেটার ভাঁজ খুলে দেখে নিল
সুরাইয়া। প্রথম পাহাড়টা টপকাতে সময় লাগল এক ঘণ্টা।
দ্বিতীয়টা ছোট পাহাড়, ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পেরুনো গেল।
একটা গুহার ভিতর অপেক্ষা করছিল ওল্ডে গাইড, দু’জন সঙ্গী
আর চারটে ঘোড়া নিয়ে।
তিনজনই তারা বেদুইন তরুণ। ঘোড়া পালা, ট্রেনিং ত্থেয়া
আর বেচা-কেনা করা তাল্ডে পেশা। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে হামাসের
সম্পর্ক খুব ভাল, তাই প্রয়োজনে যখনই কোন সাহায্য চাওয়া হয়,
বিমুখ হতে হয় না।
নিজেল্ডে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই হামাসের কাছ থেকে গেরিলা
যুদ্ধের কিছু ট্রেনিং নিয়েছে তারা। প্রায় সবাই রাইফেল চালাতে
জানে।
ওল্ডে সর্দার বাহাউদ্দিন গাইডকে কিছু নির্দেশ দিয়ে
পাঠিয়েছে। তাই প্রথমেই সে তুফার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে
চাইল।
কী ঘটেছে সংক্ষেপে জানাল সুরাইয়া। সে থামতে গাইড
বলল, ‘তারমানে আপনাল্ডে খুঁজে বের করার জন্যে কপ্টার
পাঠাবে ওরা।’ তার ইঙ্গিতে এক লোক একটা ব্যাগ নিয়ে এল
গুহার ভিতর দিক থেকে। ‘এটায় ঢোলা আলখেল−া আর নকল
দাড়ি-গোঁফ আছে,’ রানাকে বলল সে। ‘পরে নিন।’ সুরাইয়ার
দিকে ফিরল। ‘আপনাকে ছেলে সাজতে হবে, ম্যাডাম। তবে চুল
কাটার ল্ডকার নেই, পাগড়ির মত করে মাথায় একটা লম্বা কাপড়
জড়িয়ে নিন। ইউনিফর্মগুলো বালির নীচে পুঁতে ফেলতে হবে।’
‘এত ঝামেলা না করলেই কি নয়?’ বলল সুরাইয়া। ‘আর
৪৪
এক ঘণ্টা পরেই তো সন্ধে হয়ে যাবে।’
‘সন্ধে হতে এখনও দু’ঘণ্টা বাকি, ম্যাডাম,’ বলল বেদুইন
গাইড। ‘আমরা রওনা হবার পর হঠাৎ যদি মাথার ওপর একটা
হেলিকপ্টার গানশিপ চলে আসে, তখন কিন্তু এই সাবধানতাকে
ঝামেলা বলে মনে হবে না।’
মনে মনে তাকে সমর্থন করল রানা। ও জানতে চাইল,
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা? সেখানে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘আমরা যাচ্ছি হার বারমন পাহাড়ের কাছাকাছি,’ বলল
গাইড। ‘ওখানে আপনাল্ডে জনেঞ্জামাল্ডে সর্দার অপেক্ষা
করছেন। রাস্তা নয়, পাহাড়ী এলাকার ওপর দিয়ে যাব, তা-ও
অনেক ঘুরে, তাই পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে...’
‘সারা রাত ঘোড়া ছুটিয়ে?’
‘ঘোড়া ছুটবে আর কতক্ষণ।’ হাসল গাইড। ‘পথ বলতে তো
বেশির ভাগই খাল্ডে মাথায় সরু কারনিস।’
‘কিন্তু সুরাইয়ার বিশ্রাম ল্ডকার, অন্তত দু’তিন ঘণ্টা হলেও,’
বলল রানা।
‘না-না, বিশ্রাম না নিলেও চলবে আমার,’ তাড়াতাড়ি বলল
সুরাইয়া। ‘তবে খিদে পেয়েছেÑদুপুরে আমরা কিছু খাইনি।’
বিব্রত হলো গাইড। ‘ছি-ছি, আগে বলবেন তো! এই, খাবার
কী আছে নিয়ে এসো।’
প্রচুর খোরমা, পনির, পাঁপরের মত দেখতে শুকনো রুটি, মধু
আর সবশেষে কড়া এক কাপ করে কফি খেয়ে রওনা হলো ওরা।
গাইডের সঙ্গীরা স্কাউট হিসাবে একটা ঘোড়ার পিঠে সামনে
থাকল। তারপর থাকল দুটো আলাদা ঘোড়ায় রানা আর
সুরাইয়া। গাইড কখনও ওল্ডে পিছনে থাকল, আবার কখনও
সামনে।
রওনা হবার আধঘণ্টা পর হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনল
ওরা। অনেকক্ষণ ধরে শোনা গেল, কখনও কম কখনও বেশি।
অর্থাৎ একটা প্যাটার্ন ধরে সার্চ করছে ইজরায়েলিরা। নিশ্চয়ই
ওল্ডে দু’জনের খোঁজে।
এবরান বারাইদি তা হলে তুফায় পৌঁছেছে। তার কাছ থেকে
খবর না পেলে এত তাড়াতাড়ি এদিকে ওরা খুঁজতে আসত না।
কপ্টারের আওয়াজ এক সময় মিলিয়ে গেল।
একটানা পাঁচ ঘণ্টা ঘোড়ার পিঠে থাকবার পর রাত ন’টায়
বিশ্রামের জন্য থামল ওরা।
রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা, রানা আর সুরাইয়ার খোঁজে
এই ছয় ঘণ্টা দুই ঝাঁকে অন্তত ছয়টা হেলিকপ্টার গানশিপ পালা
করে গোটা পাহাড়ী এলাকায় কম্বিং, অর্থাৎ চিরুনি অভিযান
চালাল।
এমন নকশা ধরে সার্চ করছে, এক ইঞ্চি জমিনও যাতে চোখ
ধাঁধানো স্পট লাইটের বাইরে থেকে না যায়।
গাইড ওল্ডেকে নিয়ে রওনাও হয়েছে ওই এগারোটার সময়।
তবে ওল্ডে সুবিধে হলো, কপ্টার আসার আগে আওয়াজ চলে
আসে, দূরে থাকতে দেখতে পাওয়া যায় আলোটাও। সাবধান
হওয়ার অর্থাৎ গা ঢাকা ত্থেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
খাল্ডে মাথার দিকে ঝুলে থাকা কারনিস ধরে এগোচ্ছে ওরা,
খাদ খুব চওড়া না হওয়ায় পাইলটরা কপ্টার নিয়ে নীচে নামতে
পারছে না। স্পট লাইট ঘুরিয়ে কারনিসে তাক করতে যে সময়
লাগছে, তার আগেই একটা বাঁক ঘুরবার বা কোন গুহায় লুকাবার
সময় পাওয়া যাচ্ছে।
তল−াশি চালাবার ধরন দেখে গাইড আর সুরাইয়া খুব চিন্তায়
পড়ে গেছে। দিনের আলোয় এই অভিযান যে আরও বহুগুণ
জোরদার করা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ওল্ডে মত রানাও চিন্তিত, তবে গোটা ব্যাপারটার মধ্যে বিশেষ একটা তাৎপর্য দেখতে পাচ্ছে ও। যেভাবে আদাজল খেয়ে
৪৫
ওল্ডেকে খুঁজছে ইজরায়েলিরা, এর একটাই অর্থ হতে
পারেÑরানাকে তারা নাজাফি স্পেস সেন্টারের ধারেকাছে ঘেঁষতে
দিতে চাইছে না।
কেন?
স্পেস সেন্টারে হয়তো এমন কিছু আছে বা এমন কিছু
ঘটতে যাচ্ছে, রানার পক্ষে তা নষ্ট বা ভণ্ডুল করে ত্থেয়া সম্ভব।
রানা ভাবছে, বারাইদি বোধহয় কথাটা গর্ব করবার জনল্টলেনি, খেয়াযান জুবিলি হয়তো সত্যি সত্যিই স্পেস স্টেশন
অ্যাবির উদ্দেশে রওনা হতে যাচ্ছে।
হয়তো রিফুয়েলিঙের জন্যই দিনের আলোয় চারদিক ফরসা হবার
ঠিক আগে কপ্টারের ঝাঁকগুলো পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে ফিরে
গেল। উপত্যকায় নেমে এসে মরুভূমির ফাঁকা পথ ধরল
ঘোড়সওয়াররাও।
আধ ঘণ্টা পরই বোঝা গেল এলাকাটার উপর এত কেন কড়া
নজর রাখছে ইজরায়েলি সৈনশুা।
নাজাফিতে পৌঁছে গেছে ওরা।
দুই পাহাড়ের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে এগিয়ে একটা
ঢাল আর গুহা পেরোবার পর স্পেস স্টেশনটা দেখতে পেল।
তবে তারও আগে সাক্ষাৎ ঘটল বেদুইনল্ডে মূল দলের সঙ্গে।
সর্দার বাহাউদ্দিনের লোকেরা ওল্ডেকে স্বাগত জানাল।
পরবর্তী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মিনিট দশেক উঠবার পর একটা
কারনিস পড়ল সামনে। উল্টোদিকে কয়েকটা গুহা রয়েছে।
বড়সড় একটা গুহায় দশ-বারোটা ঘোড়াকে দেখা গেল, বেদুইনরা
পাহারা দিচ্ছে। কিছু লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে স্ফাড়িয়ে
আছে। তাল্ডে মধ্যে থেকে এগিয়ে এল আলখেল−া পরা দীর্ঘদেহী
এক লোক, বয়স হবে পঞ্চাশের আশপাশে।
‘উম্মে সুরাইয়া, আমার বেটি!’ সুরাইয়াকে দেখে উচ্ছ্বসিত
হয়ে উঠল লোকটা। তারপর তার চোখ পড়ল রানার দিকে।
‘পরদেশী, মেহমান, আস্সালামো আলায়কুম।’
সালামের জবাব দিল রানা। চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঘোড়া
থেকে নামছে।
‘সর্দার চাচা, ইনি মাসুল্ডানা,’ ঘোড়া থেকে নামতে নামতে
বলল সুরাইয়া। ‘রানাÑসর্দার বাহাউদ্দিন।’
‘আল−াহ মেহেরবান, আপনারা বহাল তবিয়তে পৌঁছাতে
পেরেছেন। কাল সারারাত আকাশে যেভাবে টহল দিচ্ছিল ওরা...’
‘জী, চাচা, আমরাও খুব ভয় পেয়েছিলাম,’ বলল সুরাইয়া।
‘তবে আল−াহ সত্যিই মেহেরবান।’
আবার রানার দিকে ফিরল সর্দার। ‘আমাল্ডে বড়ই খুশনসিব
যে বিদেশী হয়েও জালেম ইহুদিল্ডে শায়েস্তা করতে এসেছেন
আপনি, আপনার মঙ্গল কামনা করি।’
‘চাচা, এদিকের খবর কী?’ জিজ্ঞেস করল সুরাইয়া, হঠাৎ
সিরিয়াস প্রসঙ্গে চলে গেল সে।
‘আব্বার বয়স হয়েছে। কথাটা বলেওছিলেন বিশ-পঁচিশ বছর
আগে, তখন নাজাফি স্পেস সেন্টার তৈরি হয়নি। প্রসঙ্গটা তুলতে
দেখা গেল সব বেমালুম ভুলে গেছেন।’
‘কী বলছেন, চাচা!’ চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সুরাইয়ার।
‘এখন তা হলে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হবে?’
‘ওই বেড়া টপকানো অসম্ভব,’ বলল সর্দার। ‘পনেরো ফুট
উঁচুই শুধু নয়, ইলেকট্রিফাইডও। বেড়া টপকাতে পারলেও
সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, মাটিতে আর পাথরে লুকানো আছে
শয়ে শয়ে খুদে সেনসর। একটু ধাক্কা লাগলেই সেন্টারের রেইডার
ডিসপে−তে লাল আলো জ্বলে উঠবে। আর আলো জ্বললেই সশস্ত্র
সৈনশুা ছুটে আসবে জিপ নিয়ে।’
‘তা হলে?’
‘এত ঘাবড়াচ্ছ কেন, বেটি,’ আশ্বাস দিয়ে একটু হাসল সর্দার
৪৬
বাহাউদ্দিন। ‘বল্টস্থা একটা হতেই হবে। আব্বা ভুলে গেছেন
ঠিকই, কিন্তু আমি তো তাঁর বলা কথাগুলো ভুলিনি।’
‘পাহাড়ের একটা শিরস্ফাড়া,’ সর্দার থামতেই বলে গেল রানা,
মুখস্থ করে রেখেছে, ‘ভেতরে অন্তঃসলিলা বইছে। আসলে
টানেলের ভেতর একটা ঝরণা। গোপন একটা পথ।
‘পাথুরে শিরস্ফাড়া আর ঝরণা কোথায় আছে, এটা জানা কোন
ব্যাপারই নয়, বিশেষ করে এদিকে যাল্ডে আসা-যাওয়া আছে।’
‘শাবাশ! শাবাশ, পরদেশী!’ প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল
সর্দার। ‘এদিকে সতিঞ্জামার আসা-যাওয়া আছে, কাজেই
পাহাড়ের শিরস্ফাড়া আর ঝরণা আমি চিনি। কাল কিছুক্ষণ খোঁজার
পর মাটির তলার স্রোতটাও পেয়ে গেছি।’
গুহাটা আসলে বিরাট লম্বা একটা টানেল, ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে
উঠে গেছে পাথুরে মেঝে।
একটানা ছয় ঘণ্টা ঘোড়া ছুটিয়ে এলেও, সুরাইয়া অক্লান্ত;
বিশ্রাম গ্রহণের সর্দারের প্রস্তাবে রাজি হয়নি, বলেছে আগে ওরা
জানতে চায় স্পেস সেন্টারে ঢুকবার গোপন পথ সতিঞ্জাছে কি
না। সেটা জানবার জন্যই হাঁটছে এখন ওরা।
মিনিট দশেক পর টানেলের আরেক মুখ দিয়ে বাইরে বেরুনো
গেল। পাহাড়ের এটা আরেক দিক। সামনে মরুভূমি। চোখে
বিনকিউলার তুলতে ধু-ধু বালির রাজ্যে শুধু কাঁটাতারের বেড়াটা
দেখা গেল, তাও অন্তত মাইল খানেক দূরে।
বেড়ার ওপারে একটা পাহাড় আর বালি ছাড়া কিছু নেই।
‘ডান দিকে তাকান, পরদেশী,’ বলল সর্দার।
সেদিকে তাকিয়ে, বেড়ার বাইরে, একটা পাহাড় দেখতে পেল
রানা, সেটাও মাইল দুয়েক দূরে। দেখতে পেল পাথরের
শিরস্ফাড়াটাও।
শিরস্ফাড়া না বলে ‘হাইওয়ে’ বললেই যেন বেশি মানায়।
আসলে একটা রিজ। রানার মনে হলো, মরুভূমির উপর কেউ
যেন ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউটাকে এনে বসিয়ে
দিয়েছেÑএকই রকম চওড়া, কালো আর মসৃণ; পাহাড়ের গা
থেকে নেমে তিন মাইল বি¯তৃত, বালির মেঝে থেকে পাঁচ-সাত
ফুট উঁচু।
কাঁটাতারের বেড়া এই শিরস্ফাড়া বা অকৃত্রিম হাইওয়ের উপর
দিয়ে চলে গেছে। অপর প্রান্তটা স্পেস সেন্টারের ভিতর
কাছাকাছি পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে।
‘ওই শিরস্ফাড়ার নীচে রয়েছে পানির স্রোত,’ বলল সর্দার।
‘আসলে হিম-শীতল পানি, ওই সারি সারি পাহাড়ের মাথা থেকে
নেমে গেছে পাতালে। খানিক দূর নেমে দু’ভাগ হয়ে গেছে ওটা।’
‘একটা শাখা পাহাড়ী ঝরণা হয়ে বেরিয়েছে ডান পাহাড়েরই
একটা ঢালে, দ্বিতীয়টা বেরিয়েছে বেড়ার ওপারের পাহাড়টার
পাশেÑএকটা নালার গায়ে।’
সুরাইয়া জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা দ্বিতীয় শাখা বা টানেল ধরে
যাব?’
মাথা ঝাঁকাল সর্দার। ‘দ্বিতীয় শাখায় পৌঁছাতে হলে প্রথম
শাখায় ঢুকতে হবে। সেটাও চওড়া একটা টানেলের মত।’
‘আপনি এই পথ ধরে গেছেন কাল?’ জানতে চাইল রানা।
‘দ্বিতীয় শাখার শেষ মাথা, নালা পর্যন্ত?’
‘হ্যাঁ, গেছি। তবে ভেতরটা বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়। ভয়ানক
অন্ধকার। কোথাও কোথাও টানেল এত সরু যে নিজেকে মনে
হয়েছে বোতলের গলায় আটকে যাওয়া ছিপি।’
‘নালা থেকে বেরিয়ে চারপাশে কী দেখলেন?’
‘শুধু ওই পাহাড়টা। আর কিছু নেই।’
‘আর কিছু নেই মানে?’ ভুরু কোঁচকাল রানা। ‘ভেতরে
দালান, রাস্তা কিংবা লঞ্চ ফ্যাসিলিটি দেখেননি?’
মাথা নাড়ল সর্দার বাহাউদ্দিন। ‘তখন সন্ধে হয়ে এসেছিল,
(চলবে)
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now