বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
মাসুল্ডানা
অন্ধকারের বন্ধু
কাজী আনোয়ার হোসেন
এক
বৈকাল।
কিছুটা কাস্তে আকৃতির বিখ্যাত সেই হ্রদ। ওটা রাশিয়াতেই,
তবে রাশিয়ার এশীয় অংশে। দুনিয়ার সবগুলো হ্রল্ডে মধ্যে গভীরতম স্থানটিÑ১৬৩৭ মিটারÑএই বৈকালেই পাওয়া যাবে।
৩১৫০০ বর্গকিলোমিটারের এত বড় একটা লেকের ধারে
গ্রাম, শহর, ব›ল্ড ইত্যাদি কত কিছুই তো থাকবার কথা।
আছেও। আর এ-সব জায়গায় স্বভাবতই মানুষজনও আছে
প্রচুর। কিন্তু কেউই তারা পরিষ্কার করে বলতে পারল না আসলে
কী ঘটেছিল। কিংবা হয়তো যে যা দেখেছে তাই বলছে, তবে
সে-সব বিশ্বাস করবার মত নয়।
গোটা লেকে পানির গভীরতা তিন মিটার কমে গেছে। শুধু
তাই নয়Ñশুনতে যতই আশ্চর্য লাগুকÑএই বিপুল জলরাশি অদৃশ্য হয়েছে অকস্মাৎ; পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে।
সময়টা একেবারে ভর দুপুর। লেকের পারে জেলেরা মাছ
ধরছে। চলাচল করছে বেশ কয়েকটা যাত্রীবাহী লঞ্চ। সীমান্তের
ওদিক থেকে আসা একদল মঙ্গোলিয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে নিয়ে
বড়সড় একটা ফেরি লেকের মধ্যভাগ ধরে আড়াআড়িভাবে পার
হচ্ছে। ফেরিটা আর দুই মিনিট নিজের পথে থাকতে পারলে
জেলেল্ডে এক ডজন ট্রলারকে পাশ কাটাতে পারত।
এরপর কী ঘটল তা ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা জেলেল্ডে কাছ
থেকে জানা যাবে না। কারণ তারা একটা নির্মম প্রলয়কাণ্ডের
অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। তবে কয়েক মাইল দূরের
লোকজন কী দেখেছে সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে। যত্থি
তাল্ডে বর্ণনার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া সত্যি দুষ্কর।
লেকের ধারেই বুড়োর বাড়ি, পেশায় জেলে, চোখে তেমন
ভাল দেখে না; সে বলল, আকাশ থেকে একটা স্তম্ভ নেমে
এসেছিলÑকুয়াশার স্তম্ভ, আকারে পাঁচ-সাতটা স্টেডিয়ামকে এক
করলে যত বড় হবে তত বড়।
লেকের আরেক পারের তরুণ মাঝি বলল, আকাশের
কোথাও, দৃষ্টি সীমার বাইরে, ভিনগ্রহ থেকে আসা একটা সসার
লুকিয়ে ছিল; সেই সসারই একটা টানেল তৈরি করে লেকের পানি
টেনে নিয়েছে।
দশ মাইল দূরে আকাশে ছিল একটা যাত্রীবাহী পে−ন, তার
পাইলট বলল, আকাশ থেকে নামা কুয়াশার স্তম্ভ বা সসার থেকে
নামানো টানেল নয়, ওটা ছিল বাষ্প। লোকটা কসম খেয়ে আরও
বলল, সেই বিপুল বাষ্পের ভিতর, লেকের সারফেসে, গন্গনে
আগুন জ্বলতেও দেখেছে সে।
ফেরি আর ট্রলারগুলোর কাছ থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরে
ছিল একটা হেলিকপ্টার। হঠাৎ ইউটার্ন নিয়ে ওগুলোর কাছ থেকে
দূরে সরে আসছিল পাইলট, একমাত্র আরোহী একজন বিদেশী
ট্যুরিস্টকে নিয়ে। শুধু এরা দুজনেই এত কাছ থেকে ঘটনাটা
ঘটতে দেখবার পরও প্রাণে বেঁচে গেছে। গাঁটের পয়সা খরচ করে
বিদেশ থেকে বৈকাল হ্রদ দেখতে এসেছে, ট্যুরিস্টের চোখে
বিনকিউলার থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে পিছনের
সিটে বসা ট্যুরিস্ট দু’পাঁচ সেকেন্ড পর পর হাতঘড়ির কাঁটায় চোখ
রাখলে পাইলটের তা দেখতে পাবার কথা নয়। তাই রাখছিল
লোকটা। তারপর হঠাৎ সে বলল, ‘তোমাল্ডে বৈকাল হ্রদ দেখা
শেষ হয়েছে আমার, কপ্টার ঘোরাওÑহোটেলে ফিরে চলো।’
২
ইউটার্ন নিল পাইলট। ষাট সেকেন্ড পর চমকে উঠল সে।
আসল ঘটনা তার আড়াই মাইল পিছনে ঘটছিল, স্বভাবতই
প্রথমে সেটা দেখতে পায়নি। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল
লেকের পানি আর পানিতে ভাসমান জলযানগুলো অদ্ভুত আচরণ
শুরু করায়।
লেকের পানি কাত হয়ে যাচ্ছে। যেন কোথাও একটা বিশাল
ফাঁক বা গর্ত তৈরি হয়েছে, সেটা ভরবার জন্য সগর্জনে ছুটছে
চারদিকের বিপুল জলরাশিÑফলে ক্ষিপ্র আর খেপাটে একটা ভাব
নিয়ে একই সঙ্গে ছুটছে লঞ্চ, ট্রলার আর নৌকাগুলোও।
তারপর ইঞ্জিনের গর্জনকে ছাপিয়ে ওঠা একটা শোঁ শোঁ
আওয়াজ। পানি পিছন দিকে ছুটছে, আওয়াজটাও আসছে ওদিক
থেকে, তাই কী ঘটছে দেখবার জন্য কপ্টার একটু ঘোরাল
পাইলট।
মাইল তিনেক দূরে, লেকের সারফেসে, প্রকাণ্ড একটা গহ্বর
দেখতে পেল সে। দু’তিনটে স্টেডিয়াম এক করলে যে ব্যাস
পাওয়া যাবে, আকারটা তার চেয়ে ছোট নয়। গভীরতাও খুব
বেশি হওয়ার কথা, কারণ এত দূর থেকে পাইলট তলাটা দেখতে
পাচ্ছে না।
সেই গহ্বরের মাথায় প্রথমে পাইলট বিপুল বাষ্পের মেঘ
দেখতে পেল। শুধু লেক নয়, বহুদূর পর্যন্ত আশপাশের এলাকার
উপর ছড়িয়ে পড়ল সেই বাষ্প।
পানির প্রবল তোড়ে গহ্বরটার দিকে ছুটছে জলযানগুলো।
গহ্বরের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই ডুবে গেল কয়েকটা।
চোখে বিনকিউলার থাকায় ট্যুরিস্ট লোকটা দেখতে পেল
লঞ্চ, ট্রলার আর নৌকার আরোহীরা পাগলামি শুরু করেছে।
প্রথমে তাল্ডে মধ্যে দেখা গেল অদ্ভুত এক অস্থিরতা। যেন মনে
হলো চারদিক থেকে অদৃশ্য কিছুর তাড়া খেয়ে পালাবার পথ
খুঁজছে। কেউ কেউ টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলছে পরনের
কাপড়চোপড়। অনেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ল, যেন একমাত্র
পানিতেই শান্তি পাবে।
তখনও অনেক জলযান ডোবেনি, অনেক মানুষ লাফ
দেয়নি। সেইসব জলযান আর আরোহীরা পুড়ে যাচ্ছে। প্রথমে
ধোঁয়া বেরুতে দেখা গেলÑচুল থেকে, কাপড় থেকে; ল্ডজা, ছাদ,
পাটাতন, গলুই, বৈঠা থেকেও। তারপর দপ্-দপ্-দপ্-দপ। এক
এক করে জ্বলে উঠল প্রতিটি জলযান। প্রতিটি মানুষ হয়ে গেল
জ্বলন্ত মশাল ।
‘এ আমরা কী দেখছি, সার?’ প্রায় কেঁদে উঠে আরোহীর
দিকে ঘাড় ফেরাল পাইলট। ‘কেয়ামত শুরু হয়ে গেল নাকি?’
ট্যুরিস্ট লোকটা চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে হাঁটুতে রাখা
একটা রাইটিং প্যাডে দ্রুত কলম চালাচ্ছে। মুখ না তুলেই জবাব
দিল, ‘এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমার জানা মতে আগে কখনও
ঘটেনি। লিখে রাখছিÑপ্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবে আমেরিকায়
মোটা টাকায় বেচতে পারব।’ প্রসঙ্গত, নিজেকে আমেরিকান
বলেই পরিচয় দিয়েছে লোকটা; তার পাসপোর্টও তাই বলে।
তবে কী কারণে কে জানে আমেরিকা বা অন্য কোন দেশের
মিডিয়ায় ওই লোকের কোন প্রতিবেদন প্রচারিত হয়নি।
বৈকাল হ্রল্ডে পানি হঠাৎ করে কমে গেছে বলে দেশে-
বিদেশে হালকা একটা গুজব ছড়াল বটে, তবে সেটা ডালপালা
মেলবার সুযোগ পেল না। কথায় যেমন আছে, স্বভাব যায় না
ম’লেÑরাশিয়ানল্ডে হয়েছে সেই অবস্থা। কমিউনিস্টল্ডে আমলে
সমস্ত দুঃসংবাদ হয় লৌহ যবনিকার অন্তরালে চাপা ত্থেয়া হত,
তা না হলে উদোর পিণ্ডি চাপানো হত বুধোর ঘাড়ে; বর্তমান
আমলেও সেই একই পন্থা অবলম্বন করা হয়। বৈকাল হ্রদে পানি
কমে গেছে, সরকারী বিবৃতিতে এ-কথা স্বীকারই করা হলো না।
বলা হলো, স্বাধীনতাকামী মুসলিম চেচেনল্ডে এটা আত্মঘাতী
৩
এবং অন্তর্ঘাতমূলক বর্বরতা; তারা একের পর এক বেশ কিছু
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটা ফেরি, কয়েকটা লঞ্চ আর ট্রলার ডুবিয়ে
দিয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে দেখা হচ্ছে।
দু®কৃতকারীরা আবারও হামলা চালাতে পারে, এই আশঙ্কায়
লেকের কিনার থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।
পরবর্তী নির্দেশ না ত্থেয়া পর্যন্ত লেকে কেউ মাছ ধরবে না, কোন
রকম জলযানও চলাচল করবে না।
দু’হপ্তা পরের ঘটনা।
কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় একশো ষাট মাইল উত্তর-পুবে
জায়গাটা, তেরেঙ্গানু প্রদেশের ডাঙ্গুর নদীর পাশে মাঝারি
আকারের একটা রাবার বাগান।
গাছেরও প্রাণ আছে, কাজেই প্রাণহানি হয়নি বললে ভুল
হবে। সময়টা শেষ বিকেল, সূর্য পাটে বসেছে। সুপারভাইজার
সিদ্দিক মোল−ার নেতৃত্বে বাংলাদেশী শ্রমিকরা রাবার সংগ্রহের
কাজ আজকের মত শেষ করে দু’মাইল দূরের চালাঘরে ফিরে
গেছে।
হঠাৎ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল একটা পোড়া গন্ধ।
কী পুড়ছে দেখবার জন্য চালাঘর থেকে বেরিয়ে এল
শ্রমিকরা। ভালই বাতাস বইছে; কিন্তু এ এমনই এক বাতাস,
সবাই যেন অদৃশঞ্জার উত্তপ্ত একটা পাঁচিলে ধাক্কা খেল।
পড়িমরি করে ছুটে যে-যার ঘরে ফিরে এল সবাই। ঘরের
ভিতরও গরম হয়ে উঠল বাতাস। হাঁপাচ্ছে মানুষ, দম নিতে কষ্ট
হচ্ছে। কী ঘটছে কেউ বলতে পারছে না। তবে সবাই এক বাক্যে জানাল বাইরে বেরিয়ে কেউ তারা কোথাও আগুনের চিহ্ন মাত্র
দেখেনি।
ধীরে ধীরে গরম ভাবটা কেটে গেল। সাহস করে আবার ঘর
থেকে বেরিয়ে এল শ্রমিকরা। বাতাস আগের চেয়ে জোরে বইছে;
গরম না হলেও, পোড়া গন্ধটা এখন আরও তীব্র। ওই বাগানের
দিক থেকেই আসছে।
বাগানে ঢুকে তারা অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল। প্রতিটি গাছের
তাজা সবুজ পাতা শুকিয়ে তামাটে আর কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেছে।
যেন সচেতনভাবেই নির্দিষ্ট মাত্রার তাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে
গাছ আর পাতা ধীরে ধীরে শুধু শুকাবে, কিন্তু আগুন লাগবে না।
শুকনো, খসে পড়া পাতা হাতে নিয়ে সামান্য চাপ দিলেই
পাঁপরের মত মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে। খানিক আগেও তারা
দেখে গেছে পায়ের তলায় মাটি ছিল ভেজা ভেজা, এখন শুকনো
খটখট করছে। বিবর্ণ হয়ে গেছে গাছগুলোর সমস্ত ডাল আর
প্রতিটি কাণ্ড। এই বাগানের যে দফা শেষ তাতে আর সন্দেহ
নেই। একটা গাছও বাঁচবে না।
দশ মাইল দূরের একটা পাহাড় চূড়া থেকে, চোখে
বিনকিউলার সেঁটে, সবই দেখল সেই ট্যুরিস্ট লোকটা।
এক হপ্তা পর।
ইন্দোনেশিয়ার ছোট একটা দ্বীপ, নাম নতুনা। দ্বীপটায় শুধু
ধান চাষ হয়। গোটা দ্বীপে আন›েল্ড জোয়ার বইছে বললে
অত্যুক্তি হয় না। ধানের ফলন এবার খুব ভাল হয়েছে। শেষ
বিকেলের রোদে খেতের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজন কৃষক,
আন›েজ্ঝার গর্বে ফুলে উঠছে তাল্ডে বুক। বাতাস লাগায় পাকা
ধান খেতে একের পর এক ঢেউ উঠছে। তাল্ডে আনন্দ, গর্ব আর
আশা-আকাক্সক্ষা অকস্মাৎ এক নিমেষে পুড়ে গেল।
কোথাও কিছু নেই, কয়েকশো একর ধান খেত একসঙ্গে
জ্বলে উঠল। আগুন লাগবার পর সমস্ত গাছ পুড়ে ছাই হতে দুই
কি তিন মিনিট লেগেছে, তার বেশি নয়।
এরপর তিন হপ্তা কেটে গেছে। এই একুশ দিনে আরও দুটো
৪
ঘটনা ঘটল।
মস্কোর কাছাকাছি একটা সাইলোয় আগুন ধরল, ফলে আড়াই
লাখ টন গম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আটজন প্রহরীকে বরখাস্ত
করেছে কর্তৃপক্ষ। তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইলেকট্রিক্যাল
শর্ট-সার্কিট কিংবা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ থেকে আগুন ধরেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল জার্মানির মিউনিকে।
ছোট, কিন্তু পাথরের তৈরি প্রাচীন একটা জেলখানায় আগুন
লাগল। প্রাচীন হলেও, অত্যন্ত মজবুত দালান ওটা। পাথরের
পাঁচিলগুলো এত চওড়া, দুজন মানুষ পাশাপাশি দৌড়াতে
পারবে। ল্ডজাগুলো কাঠের নয়, লোহার।
কেউ বলতে পারল না কীভাবে লাগল আগুনটা। বলবে কি,
কেউ বেঁচে থাকলে তো। কয়েদীরা সবাই ছিল বৃদ্ধ, কারুরই বয়স
আশির কম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে
হাত মিলিয়ে গুরুতর সব অপরাধ করবার কারণে আজীবন জেল
খাটছিল তারা।
মাত্র পাঁচ মাইল দূরে দমকল বাহিনীর স্টেশন। আগুন
লাগবার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে খবর পায় তারা। অকুস্থলে
পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র সাত মিনিট।
অথচ পাথরের তৈরি জেলখানা, সমস্ত কয়েদী আর প্রহরীসহ,
এরই মধ্যে পুড়ে গেছে। দমকল বাহিনী পৌঁছে দেখল পুড়বার
আর কিছু বাকি না থাকায় ধ্বংস¯তূপে কোথাও এতটুকু শিখা
নেই। আছে শুধু গন্গনে আগুন।
সবার মুখেই একটা প্রশ্ন: আগুনের তীব্রতা কত বেশি হলে
লোহা আর পাথর এত তাড়াতাড়ি গলে যেতে পারে?
দুটো ঘটনাই দূর থেকে দেখে খসখস করে নোট নিল সেই
ট্যুরিস্ট।
এরপর ক্ষতি হলো বাংলাদেশের।
সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ হাজার টন সয়াবিন তেল আর এক
হাজার টনের মত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে দেশে ফিরছে বাংলার
মুখ। বাংলার মুখ গ্রিস থেকে কেনা একটা পুরানো জাহাজ,
আকারে বিশাল; পুরোটাই লোহার তৈরি, কাঠের বল্টহার খুবই
কম।
ভারত মহাসাগরকে পিছনে ফেলে বঙ্গোপসাগরে ঢুকছে
জাহাজ। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। দুপুরবেলার রোদ তাই খুব কড়া। তবে সাগর একদম শান্তÑআয়নার মত মসৃণ।
পাশে সেকেন্ড অফিসারকে নিয়ে ব্রিজে স্ফাড়িয়ে আছেন
ক্যাপটেন শেখ জয়ী লুৎফর।
‘সার,’ চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে সেকেন্ড অফিসার
সাযযাদ সহাসেল্টললেন, ‘চারপাশে আর কোন জাহাজ নেই,
দিগন্তের কাছে শুধু একটা হেলিকপ্টার আছে।’
‘কে বলল জাহাজ নেই?’ ক্যাপটেনও সহাস্যে জবাব দিলেন,
জানেন এটা একটা কথার কথা বলছেন সেকেন্ড অফিসার।
কন্ট্রোল প্যানেলের মাঝখানে বসানো রেইডার ডিসপে−-র দিকে
তাকিয়ে আছেন তিনি। ‘পিছনে তিন তিনটে জাহাজ
রয়েছেÑসম্ভবত বোম্বে, করাচী আর কলম্বো থেকে আসছে।
সামনেও কয়েকটা আছে।’
দুজনেই জানেন যে ওল্ডে চারপাশের সবগুলো জাহাজই
কমপক্ষে আঠারো মাইল দূরে রয়েছে, আর দেখতে না পাওয়ার
সেটাই কারণ।
অদ্ভুত জিনিসটা উত্তর দিক থেকে এল। সেকেন্ড অফিসারের
চোখে এই মুহূর্তে বিনকিউলার নেই, বোধহয় সেজন্যই দেখতে
পেলেন তিনি; তা না হলে তাঁর দৃষ্টি থাকত অনেক দূরে।
মাত্র দুশো গজ সামনে থেকে এল ওটা। এল বললে শুনতে
কেমন যেন লাগে, কিন্তু অন্য কোন ভাবে বর্ণনা করা কঠিন।
নীল, মসৃণ সাগর ষ্ণে কি দু’হাজার বর্গগজ জায়গা জুড়ে টগবগ
৫
করে ফুটছে। বৃত্তাকার একটা আয়তন। ছুটে আসছে
সবেগেÑমাথায় রাশি রাশি বাষ্পের মেঘ নিয়ে। সেকেন্ড অফিসার
দেখলেন, অথচ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন
নাÑবঙ্গোপসাগরের মাঝখানে একটা গহ্বর তৈরি হয়েছে।
গহ্বরের কিনারার পানি ফুটছে, আর গভীর তলদেশ থেকে
উঠে আসছে ঘন বাষ্প।
‘সার!’ তাঁর গলা থেকে এই একটা মাত্র আওয়াজ বেরুতে
পারল।
ক্যাপটেন জয়ী লুৎফর তখনও রেইডার ডিসপে− দেখছেন।
সেকেন্ড অফিসারের ডাক তাঁর কানে গেল, কিন্তু মুখ তুলে
তাকাবার সময়টুকুও তিনি পেলেন না।
টগবগ করে ফুটন্ত পানির সচল কিনারা বাংলার মুখকে স্পর্শ
করল। ব্রিজ আর আপার ডেকে যারা ছিলেন, চোখের নিমেষে
বাষ্প হয়ে উড়ে গেলেন। একই সঙ্গে গলে গেল সমস্ত লোহা আর
ইস্পাত। গহ্বরের ভিতর পড়বার সময়ও পেল না জাহাজ,
তাপের অবিশ্বাস্য প্রচণ্ডতা এমনভাবে গ্রাস করল, ওটা যেন বিশ
হাজার টনী কোন জাহাজ নয়, স্রেফ তরল পদার্থÑএই ছিল, এই
নেই, ডুবে গেল ফুটন্ত পানির নীচে।
বাংলার মুখ অস্তিত্ব হারাবার পর দিগন্তে ঝুলে থাকা
হেলিকপ্টারটি আর দেরি করেনি, বাঁক নিয়ে চলে গেছে আরেক
দিকে।
কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেল না, সংশি−ষ্ট কর্তৃপক্ষ জানাল
বাংলার মুখ মাঝ সাগর থেকে নিখোঁজ হয়েছে।
দুই
বিসিআই হেডকোয়ার্টার, ঢাকা।
ইন্টারকমে জরুরি তলব। মাসুল্ডানাকে এই মুহূর্তে
ল্ডকার। মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান ওর জন্য তাঁর চেম্বারে অপেক্ষা করছেন।
‘কিন্তু, ইলোরা,’ রানার প্রাইভেট সেক্রেটারি কাকলি একটু
নার্ভাস হয়ে পড়ল, ‘মাসুদ ভাই তো এখনও অফিসেই
আসেননি।’
‘সেটা জানি বলেই তো মেসেজটা তোমাকে দিলাম,’
ইন্টারকমের অপরপ্রান্ত থেকে ইলোরার কাঠকাঠ কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে
এল। ‘রানা এলেই পাঠিয়ে দেবে।’
এই সময় প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠল কাকলি। ‘কার সঙ্গে কথা
বলছ?’
ঝট করে ঘুরতেই দোরগোড়ায় যেন একজন èেদূতকে
স্ফাড়িয়ে থাকতে দেখল কাকলি; চেনে অথচ যেন চেনে না।
èেদূত মনে হলেও, চলনে বলনে ভারী স্মার্ট আর আধুনিক।
কাকলি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবল, মেয়েল্ডে আর কী দোষ,
তারা তো ওর মায়াবী রূপ আর মোহনীয় ভাবভঙ্গি দেখে পাগল
হবেই। তারপর নিজের কথা ভাবল সে: হায়, কেউ কোনদিন
জানতে পারবে না, প্রতিদিন একটু একটু করে খুন হয়ে যাচ্ছি
আমি। এ হলো কাছাকাছি থেকেও না পাওয়ার অভিশাপ। এক
৬
সঙ্গে কাজ করো, কিন্তু লোভ করতে পারবে নাÑঅলিখিত
নিষেধাজ্ঞা আছে।
এ-সব চিন্তা মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ডের মধ্যে খেলে গেল
কাকলির মাথায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল সে। ‘মাসুদ ভাই,’ তাড়াতাড়ি বলল, ‘ইলোরা ফোন করে বলল, বস্ তোমার
জনেঞ্জপেক্ষা করছেন... জরুরি ...।’
রানার বুক ধক্ করে উঠল। জরুরি ডাক? তা হলে নিশ্চয়ই
কোন অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া যাবে। বিপজ্ঝার রোমাঞ্চের আগাম
আভাস পেয়ে রক্তে অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে গেল হঠাৎ।
তবে কাকলির অনুসন্ধানী আর কৌতূহলী দৃষ্টি রানার বিশেষ
পছন্দ হলো না; ভাবটা যেন, বসের জরুরি তলব পেয়ে ও কেমন
কুঁকড়ে যায়, এটা চাক্ষুষ করবার জনঞ্জপেক্ষায় আছে।
‘ওই ডাইনী ইলোরা আর আমাল্ডে বুড়ো বসকে তুমি চেনো
না,’ তাচ্ছিলেশু সুরে বলল রানা। ‘কিছু ঘটুক বা না ঘটুক,
মানুষকে তটস্থ করে রাখা ওল্ডে একটা ভারী বদ স্বভাব।’
কাকলি কিছু বলবার আগেই ইন্টারকম জ্যান্ত হয়ে উঠল:
‘রানা?’ এবার স্বয়ং রাহাত খানের জলদগম্ভীর কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে এল,
‘আমি তোমাকে ডেকেছি।’
মুখ থেকে সব রক্ত নেমে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ,
যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে এসে ইন্টারকমের সামনে মুখ নামিয়ে
কোন রকমে বলল, ‘জী, সার। আমি...’
‘তা হলে আসছ না কেন? আর আজেবাজে কথা বলবার
আগে ইন্টারকম বন্ধ করতে পারো না?’
যোগাযোগ কেটে যাওয়ার আওয়াজ শুনে সিধে হলো রানা,
ঘাড় ফিরিয়ে কাকলির দিকে তাকাল। ‘তুমি ওটা বন্ধ করোনি
কেন?’
‘এমনভাবে চমকে দিলে, সময় পেলাম কখন?’ নরম সুরে
পাল্টা প্রশ্ন করল কাকলি।
‘তুমি বললে ইলোরা মেসেজটা দিয়েছিল। তা হলে বস্
কীভাবে আমার কথা শুনতে পেলেন?’ ভয়ানক নার্ভাস রানা। না
জানি কি আছে আজ কপালে!
‘আমি কী করে জানব যে ইলোরা বসের চেম্বার থেকে ফোন
করেছেÑনিশ্চয়ই তাই করেছে, তা না হলে...’ চোখ তুলে থেমে
গেল কাকলি, কারণ কামরা ছেড়ে এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে
মানুষটা।
সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় উঠে এল রানা। করিডর পার হয়ে শেষ
মাথার ল্ডজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
ইন্টারকমে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে ইলোরা, চোখ ইশারায়
চেম্বারের ল্ডজাটা দেখিয়ে দিল রানাকে, ভাব দেখে মনে হলো না
রানার বিপদ সম্পর্কে সচেতন।
একটা ঢোক গিলে চেম্বারের ল্ডজায় নক করল রানা।
আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবার চেষ্টা বিশেষ সফল হচ্ছে না, তবে সেটা
অন্তরে; বাইরের চেহারা দেখে বুঝবার কোন উপায় নেই যে
শুকিয়ে গেছে ওর কলজেটা।
‘কাম ইন,’ ভারী আওয়াজটা যেন দূর থেকে ভেসে এল।
দুরু দুরু বুকে ভিতরে ঢুকে রানা দেখল বস্ তাঁর রিভলভিং
চেয়ারে নেই।
‘এদিকে এসো,’ কামরার ডান দিক থেকে বললেন রাহাত
খান।
চেম্বারের ওদিকের দেয়ালে প্রায় পুরোটা জুড়েই মানচিত্র
টাঙানো। মানচিত্রের পাশে বড়সড় একটা কমপিউটার মনিটরও
আছে; মানচিত্রের কোন বিশেষ অংশ বড় করে দেখতে চাইলে
রিমোট কন্ট্রোল বল্টহার করে মনিটরে তা দেখা সম্ভব। এই
কমপিউটারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইটেরও সংযোগ
আছে। হাতে রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটা নিয়ে ওটার সামনেই স্ফাড়িয়ে
৭
রয়েছেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান।
সাবধানে এগিয়ে এসে বসের পাশে, সম্মানসূচক দূরত্ব বজায়
রেখে, স্ফাড়াল রানা। মনিটরে চোখ পড়তে মরুভূমি দেখতে
পেল। সম্ভবত নেগেভ।
নেগেভ মরুভূমি ইজরায়েলে।
হার্টবিট একটু বেড়ে গেল রানার। ইন্টারকম কেলেঙ্কারির
কথা বেমালুম ভুলে গেছে।
‘চিনতে পারছ?’ জানতে চাইলেন বস্।
‘জী, সার। নেগেভ মরুভূমি।’
‘এই জায়গা দুটো দেখো,’ পালা করে একজোড়া লাল বিন্দুর
দিকে পয়েন্টার তাক করলেন বিসিআই চিফ। দুটোর মাঝখানে
দূরত্ব প্রায় ষ্ণেশো মাইল। জায়গা দুটোর নাম আইয়াম আর
নাজাফি। ‘কিছু স্মরণ করতে পারো?’
‘আইয়াম...নাজাফি...’ মনে মনে আওড়াচ্ছে রানা, কিন্তু
কিছুতেই মনে করতে পারল না জায়গা দুটোর কী বৈশিষ্টল্টা
তাৎপর্য।
বসকে একটু গম্ভীর আর অসন্তুষ্ট দেখাল। ‘স্মরণশক্তি কী
ভাবে বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করো,’ বলে ঘুরলেন, ডেস্কের দিকে
ফিরে যাচ্ছেন। ‘এসো।’
অনুগত মেষ শাবকের মত পিছু নিল রানা।
ডেস্ক ঘুরে এসে নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসলেন রাহাত
খান, বসেই পাইপে সুগন্ধি তামাক ভরবার কাজে মন দিয়েছেন।
‘বসো।’
একটা আর্ম-চেয়ারে বসল রানা।
‘কী সব ঘটছে খেয়াল করছ?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন বস্।
‘শুরুটা হয়েছিল বোধহয় বৈকাল হ্রদ থেকে। এত তাপ কোত্থেকে
আসছে?’
রানা অথৈ সাগরে, একেবারে হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা।
বৈকাল হ্রদে চেচেন গেরিলারা বিস্ফোরকের সাহায্যে কয়েকটা লঞ্চ
আর একটা ফেরি ডুবিয়ে দিয়েছে, মাস ষ্ণে-দুই আগে এটা
খবরের কাগজে পড়েছে ও। কিন্তু তার সঙ্গে তাপের কী সম্পর্ক?
তাপ...তাপ...তারপরই ঝট করে মনে পড়ে গেল। বেশ কয়েকটা
খবর ছাপা হয়েছে কাগজে, কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটার কী
সম্পর্ক ওর জানা নেই।
মালয়েশিয়ায় রাবার বাগান পুড়ে গেছে, ইন্দোনেশিয়ায়
পুড়েছে ধানখেত, আগুন লেগেছে রুশ খাদ্য গুদামে আর
জার্মানির একটা জেলখানায়।
বস্ বলছেন, এত তাপ কোত্থেকে আসছে। মাই গড! এ-সব
কি তা হলে এক সুতোয় গাঁথা? দুর্ঘটনা নয়, স্যাবটাজ? ‘জী,
সার,’ সাবধানে বলল ও, ‘মনে পড়েছে। কিন্তু বৈকালের ঘটনাটা
তো চেচেনল্ডে...’
‘ওটা রুশ সরকারের ভাষ্য, জনগণের কাছে ব্যাপারটা গোপন
রাখতে চেয়েছে,’ রানাকে বাধা দিয়ে বললেন রাহাত খান।
‘আমাল্ডে কাছে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট আছে, ওটাও আসলে
একটা স্যাবটাজের ঘটনা ছিল। কে বা কারা প্রচণ্ড উত্তাপ বল্টহার
করেছে।’
‘উত্তাপ... কীভাবে, সার?’
‘সেটাই তোমাকে জানতে হবে,’ পাইপে আগুন ধরালেন
বিসিআই চিফ। ‘আমাল্ডে গায়েও যখন আঁচ লেগেছে, আমরা
তো চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’
‘সার?’ রানা শুধু বিস্মিত নয়, ওর চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া
ফুটে উঠল।
মাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করলেন রাহাত খান। ‘বাংলার মুখ।’
‘কিন্তু ওটা তো, সার, মাঝ সাগর থেকে নিখোঁজ...’ বসকে
মাথা নাড়তে দেখে থেমে গেল রানা।
‘চট্টগ্রাম বন্দরের রেইডার থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছে ওটা,’
৮
বললেন তিনি। ‘ওই সময় রেইডারে একটা হেলিকপ্টারও ছিল।’
যোগাযোগটা কী বা কোথায়, ধরতে না পারায় গোটা
ব্যাপারটা দুর্বোধ্য লাগছে রানার কাছে।
‘শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি একটা জাহাজে ল্যান্ড করে ওই কপ্টার,’
বললেন রাহাত খান। ‘জাহাজটা লোহিত সাগরের দিকে চলে
যায়।’
‘লোহিত সাগর...’
‘তার আগে সর্বশেষ হামলাটা সম্পর্কে তোমার জানা
ল্ডকার।’
এরপর বস্ যা বললেন, গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনে গেল রানা:
দিন কয়েক আগের এক সকাল। ইজরায়েল-লেবানন
সীমান্ত। দু’দেশের সৈন্য, ট্যাংক, আর্মারড্ ভেহিকেল, মর্টার,
রকেট লঞ্চার, মেশিন গান, রাইফেল, গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে
মুখোমুখি পজিশন নিয়ে আছে।
এটা রোজকার পরিচিত একটা দৃশ্য। দু’পক্ষই পরস্পরের
রুটিন কাজ-কর্ম সম্পর্কে জানে। নতুন ট্রেঞ্চ কাটা শুরু হলে বা
সৈন্য সংখ্যা বাড়ছে দেখলে প্রতিপক্ষ ধরে নেয় হামলা হতে
যাচ্ছে। তখন তারাও প্রস্তুত হয়।
সেদিন সকালে এমন একটা ঘটনা ঘটল, যেটাকে কোন
রুটিনের মধ্যে ফেলা গেল না।
সকাল ছ’টায় ইজরায়েলি সৈন্যল্ডে পালাবদল শেষ হয়েছে।
তার এক ঘণ্টা পর ওই একই কাজ শেষ করেছে লেবাননী
সৈনশুা। তারপর, ন’টার দিকে, লেবাননী পক্ষ বিস্মিত হয়ে
দেখলÑযে যার কাভার ছেড়ে ইজরায়েলি সৈনশুা পিছিয়ে যাচ্ছে।
শুধু যে সৈন্য, তা নয়Ñট্যাংক, আর্মারড্ ভেহিকেল, চাকার উপর
বসানো রকেট লঞ্চার আর মেশিন গানও প্রত্যাহার করে নিচ্ছে
ইজরায়েলিরা।
সীমান্ত এভাবে অরক্ষিত রেখে ইজরায়েলিরা ফিরে যাচ্ছে
কেন? লেবাননী কর্নেল জয়নাল জিলানি ব্যাপারটাকে ভাল চোখে
দেখলেন না। ইজরায়েলিল্ডে উদ্দেশ্য বোঝা না গেলেও, সেটা যে
শুভ বা মহৎ কিছু নয়, এ-ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ।
কমান্ডারল্ডে ডেকে টহল আর প্রহরা আরও জোরদার করবার
নির্দেশ দিলেন কর্নেল জিলানি। কালবিলম্ব না করে আর্মি
হেডকোয়ার্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করলেন। কী ঘটছে রিপোর্ট
করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চাইলেন তিনি।
মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে সীমান্ত ত্যাগ করে ফিরে গেছে
ইজরায়েলি সৈনশুা। কর্নেল জিলানি ফিল্ড-টেলিফোনে আর্মি
হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে এখনও কথা বলছেন। এই সময় চোখের
নিমেষে সব কিছুতে আগুন ধরে গেল।
লেবাননী সীমান্ত চৌকিতে যা কিছু ছিলÑসৈন্য, ট্যাংক,
আর্মারড্ ভেহিকেল, মেশিন গান, রকেট লঞ্চার, আধ মাইল
পিছনের অ্যামিউনিশন ডিপোÑহয় পুড়ে ছাই হয়ে গেল, নয়তো
বিস্ফোরিত হয়ে উড়ে গেল।
আর্মি হেডকোয়ার্টার সংশি−ষ্ট সীমান্ত চৌকির সঙ্গে যোগাযোগ
করতে ব্যর্থ হয়ে নতুন একদল সৈন্যকে পাঠাল। অকুস্থলে
পৌঁছাতে দু’ঘণ্টা সময় লাগল তাল্ডে। চারদিক দেখে কী ঘটে
গেছে, কীভাবে ঘটেছে, কিছুই তাল্ডে মাথায় ঢুকল না।
তারা রিপোর্ট করল: ‘সাড়ে তিনশো সৈনিক আর অফিসার
পুড়ে স্রেফ ছাই হয়ে গেছে...আর ধারণা করা হচ্ছে সমস্ত
হার্ডঅয়্যার গলে গিয়েছিল...ইজরায়েলি সৈনশুা হঠাৎ প্রচণ্ড গরম
অনুভব করায় সীমান্ত ছেড়ে পালায়। অন্তত এ-কথাই
বলছে...তারা ফিরে আসে আমরা এখানে পৌঁছানোর আধ ঘণ্টা
পর...’
বসের মুখে ঘটনাটা শুনে রানা মন্তব্য করল, ‘পবিষ্কার বোঝা
যায়, ইজরায়েলি সৈনশুা জানত বিপদ একটা আসছে। সার,
ওল্ডে এলাকার কোন ক্ষতি হয়নি?’
৯
‘না,’ বললেন রাহাত খান। ‘আমার ধারণা, ওরা সরে
গিয়েছিল স্রেফ ঝুঁকি নিতে চায়নি বলে। একবার চিন্তা করে
দেখো, অস্ত্রটা কী রকম কাজের জিনিস।’
‘অস্ত্র, সার?’ রানা প্রায় হকচকিয়ে গেল।
‘এতক্ষণ তা হলে কী বুঝলে?’ রাগী হেডমাস্টার মনে হলো
রাহাত খানকে। ‘প্রচণ্ড উত্তাপ দিয়ে খেত, সাইলো, জাহাজ, সৈনঞ্জার ট্যাংকসহ সীমান্ত চৌকি ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। এই তাপ
কোনও অস্ত্র থেকে আসছে না?’
এই মুহূর্তে বোবা মনে হলো রানাকে, নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল।
‘প্রতিটি ক্ষেত্রে, খেয়াল করো, একটা নির্দিষ্ট টার্গেটে আঘাত
করা হয়েছে। অস্ত্রটার বৈশিষ্ট্য হলো, যেখানে আঘাত করতে চায়
ঠিক সেখানেই লাগেÑলক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’
‘তারমানে কি ইজরায়েল এরকম একটা অস্ত্র বানিয়েছে?’
জানতে চাইল রানা।
‘আমেরিকানল্ডে সাহায্য নিয়ে তা যত্থিরা বানিয়ে থাকে,
আমি মোটেও আশ্চর্য হব না।’ বিসিআই চিফ গম্ভীর হলেন।
‘ওল্ডে নেগেভ মরুভূমির ওপর সেজন্যেই চোখ বুলাচ্ছিলাম।
মনে নেই, বছর তিনেক আগে ইজরায়েলিরা...’
‘জী, সার,’ হঠাৎ বলল রানা, ‘মনে পড়েছে। আমেরিকানরা
নেগেভের আইয়ামে একটা মিলিটারি এয়ার বেইস তৈরি করবার
ঘোষণা দিয়েছিল। আর ইজরায়েল বলেছিল, নাজাফিতে তারা
একটা রকেট লঞ্চিং ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলবে।’ ওর আরও মনে
পড়ল, তখন ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসাহাসিও হয়েছিল। ইহুল্ডিা
জানে প্যালেস্টাইন সহ দুনিয়ার কোথাও তারা টিকতে পারবে না,
তাই নাজাফিতে স্পেস সেন্টার তৈরি করছে, ভবিষ্যতে যাতে
মঙ্গলগ্রহে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে পারেÑএ-ধরনের সব
কৌতুক শোনা গেছে।
রাহাত খান জানালেন, আসলে ওই দুই জায়গায় ঠিক কী
বানানো হয়েছে কেউ তা জানে না।
তবে তাঁর কানে এসেছেÑনাজাফিতে রকেট, বেলুন, মিসাইল
ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা চালায় ইজরায়েলিরা। আর আমেরিকানরা
মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইয়ামে। এ-সব
কতটুকু সতিল্টলা মুশকিল, স্যাটেলাইট জ্যামিং করায় নেগেভের
কোন ছবিই সংগ্রহ করা যায় না।
‘ওরা আসলে কী করছে, অস্ত্রটা ইজরায়েলিরা বানিয়েছে নাকি
আমেরিকানরা, সব ওখানে গিয়েই জানতে হবে তোমাকে,’
সবশেষে বললেন রাহাত খান।
এক সেকেন্ড ইতস্তত করে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘জিনিসটা
আসলে কী হতে পারে, সার? লেযার গান?’
‘আমার কোন ধারণা নেই। এক দিক থেকে এটা পারমাণবিক
বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর। যে বিপদ কোত্থেকে আসছে ধরা যায় না,
তার জন্যে তুমি কাকে দায়ী করবে?’
রক্তে যতই বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বার নেশা থাকুক, এবারের
অ্যাসাইনমেন্টটা যে খুব শক্ত, সেটা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে
পারছে রানা। ‘সার, ওই একটাই তা হলে সূত্র? লেবাননী সীমান্ত
চৌকি আক্রান্ত হবার ঠিক আগে ইজরায়েলি সৈনশুা সরে
গিয়েছিল? কিন্তু আমরা যদি ভুল অর্থ করে থাকি, আমার নেগেভে
যাওয়াটা বৃথা হয়ে যাবে না?’
‘না, আমরা ভুল অর্থ করিনি। প্রমাণ আছে, অন্তত দুটো
ঘটনার সঙ্গে মোসাদ জড়িত।’
রানা অপেক্ষা করছে।
পাইপে নতুন করে তামাক ভরছেন রাহাত খান। ‘তখন কি
বললাম মনে আছে? কপ্টার ল্যান্ড করার পর জাহাজটা লোহিত
সাগরের দিকে চলে যায়?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘জী।’
‘সুয়েজ খাল পার হয়ে হাইফা বন্দরে ভিড়েছে জাহাজটা।’
১০
পাইপে টান দিতে গিয়েও দিলেন না বিসিআই চিফ, হাতটা
নামিয়ে নিলেন। ‘বৈকাল হ্রত্থে একটা চার্টার করা হেলিকপ্টার
ছিল,’ ধীরে ধীরে বললেন। ‘কপ্টারের পাইলট আমেরিকান এক
ট্যুরিস্টকে লেক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ট্যুরিস্ট লোকটার
আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় চেহারাটা মনে গেঁথে রাখে সে।
বিসিআই-এর একজন এজেন্ট তাকে দিয়ে লোকটার চেহারা
আঁকিয়ে নিয়েছে।’ ল্ডোজ খুলে একটা এনভেলাপ বের করে
রানার দিকে ঠেলে দিলেন।
এনভেলাপ খুলে স্কেচটায় চোখ রাখল রানা। বোঝা যায়,
ঢাকায় এটা পাঠানো হয়েছে ফ্যাক্স করে। চেহারাটা চিনতে
দু’সেকেন্ড দেরি হলো ওর। তবে চিনবার পর মনে কোন সন্দেহ
থাকল না যে এই লোক অবশ্যই এবরান বারাইদি।
মেজর এবরান বারাইদি দুর্ধর্ষ মোসাদ এজেন্ট। প্রথম
ইজরায়েলি এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিল সে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে
নাসার সহযোগিতায় অ্যাস্ট্রনট হওয়ার ট্রেনিং নেয়। পরে যোগ
দেয় মোসাদে।
বেশ কয়েকবারই পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে ওরা,
কোনবারই কেউ জেতেনি বা হারেনিÑকখনও রানা তাকে ফাঁকি
দিয়ে সরে এসেছে, কখনও বারাইত্থিকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে
গেছে; চেষ্টা করেছে দু’জনেই, কিন্ত কেউ কাউকে শেষ করতে
পারেনি।
চোখ তুলে বসের দিকে তাকাল রানা। ‘এবরান বারাইদি,
সার।’
মাথা ঝাঁকালেন রাহাত খান। ‘ইজরায়েলে ঢোকার পর যে-
সব কাগজ-পত্র লাগবে, বেশির ভাগই তৈরি করা হয়েছে,’
বললেন তিনি। ‘ইলোরার কাছ থেকে ব্রিফকেসটা চেয়ে নাও।
ওটায় অন্যানঞ্জারও কিছু তথঞ্জাছে।’ চোখ নামিয়ে একটা
ফাইল টেনে নিলেন। ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, এবার তুমি আসতে
পারো।’
বসের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে চেয়ার ছাড়বার সময়
বুকে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল রানা; ইজরায়েল চিরকালই
সবচেয়ে বিপজ্জনক রণক্ষেত্র ওর, প্রাণ নিয়ে ফিরে আসবার জন্য প্রতিবারই সাহস আর বুদ্ধির সঙ্গে ভাগেশু সহায়তাও ল্ডকার
হয়েছে। মনে মনে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল ও, ‘এবার ফিরে
আসতে পারব তো, সার?’
কে জানে কী হবে এবার!
তিন
রঙচটা এই ডিসি-থ্রি পে−নটা এতই পুরানো আর নড়বড়ে, রানার
ভয় হচ্ছে সমস্ত কলকব্জা না খুলে পড়ে যায়।
হাতঘড়ি দেখল। রাত বারোটা এক মিনিট। মাত্র ষাট
সেকেন্ড আগে সমস্ত আলো নিভিয়ে চোরের মত সীমান্ত পার হয়ে
ইজরায়েলে ঢুকেছে ওরা।
পে−ন এই মুহূর্তে ত্রিশ হাজার ফুট উপরে। এখন থেকে ঠিক
সতেরো মিনিট পর, সীমান্ত থেকে ইজরায়েলের পঞ্চাশ মাইল
ভিতরে পৌঁছে, গোত্তা খেয়ে বিশ হাজার ফুট নীচে নামবে জর্দানি
পাইলট সালামাত হাবিবি।
প্যারাশুট নিয়ে নেগেভ মরুভূমিতে নামতে যাচ্ছে রানা।
নাজাফি থেকে যথেষ্ট দূরে, ওটার কাছাকাছি শহর তুফা ওর প্রথম
গন্তব্য। পাইলটকে দেখতে বলা হয়েছে, রানা যাতে তুফা শহরের
১১
পুবদিকের উপত্যকায়, খেজুর বাগানের ভিতর নামতে পারে।
তুফা শহরে একজন প্যালেস্টাইনি ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট ওকে
খুঁজে নেবে। রানা শুধু তার কোড নাম্বার জানে। তুফার উত্তরে
একটা মেশিন-টুলস্ ফ্যাকটরি আছে, সিক্সটিনাইন ওখানকার
একজন মেকানিকাল ডিজাইনার। সে-ই তুফা থেকে পথ দেখাবে
ওকে, নাজাফি সম্পর্কে তথ্য দেবে, প্রয়োজন হলে ওখানকার
ইজরায়েলি ফ্যাসিলিটিতে পৌঁছেও দিয়ে আসবে।
ইলোরার কাছ থেকে ছোট আকারের, অত্যন্ত পুরানো একটা
ব্রিফকেস পেয়েছে রানা। তাতে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র, ফলস
বটমে কিছু অস্ত্র, মখমলের উপর সাজানো প্রচুর মণি-মাণিক্য ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথঞ্জাছে। সে রকম একটা তথ্য হলো:
সিক্সটিনাইন বিসিআই-এর হয়ে আগেও কাজ করেছে।
রানার সঙ্গে একটা ব্যাক-প্যাক আছে, তারপরও ব্রিফকেসটা
সঙ্গে নিতে হবে।
‘আর দশ মিনিট, মিস্টার রানা,’ বলল হাবিবি। ‘আপনার
জন্যে দোয়া করি, সার। যান, শালাল্ডে কচুকাটা করে আসুন।’
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখবার
নেই। পে−ন বাঁক নিয়ে নীচে নামছে, ফলে নড়বড়ে নাট-বল্টুগুলো
আরও বেশি আপত্তি জানাতে শুরু করলÑকর্কশ আওয়াজে কান
পাতা দায়।
সিট ছেড়ে প্যারাশুট পরছে রানা, পাইলটের দিকে প্রশংসার
দৃষ্টিতে তাকাল একবার। ভাবল, ভয়ানক দুঃসাহসী না হলে
এরকম ঝুঁকি কেউ নেয় না। তবে শুধু দুঃসাহস নয়, মার্কিনীল্ডে
প্রতি ইরাকীল্ডে যেমন, ঠিক তেমনি ইজরায়েলিল্ডে প্রতি এল্ডে
তীব্র ঘৃণারও বিরাট ভূমিকা আছে।
জনমতের তোয়াক্কা না করে জর্দানের বাদশা আর সরকার
আমেরিকার বন্ধু থাকতে চায়, তাই তারা এমন কিছু করবে না
যাতে ইজরায়েলি স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। এটা জানা কথা, তাই বিসিআই
জর্দানের কাছে সরকারী পর্যায়ে কোন সাহায্য চায়নি। তবে
সাহায্য যেহেতু ল্ডকার, সেটা চাওয়া হয়েছে ব্যক্তি পর্যায়ে।
ভদ্রলোক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) তাহির জাকারিয়া।
মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের চিফ ছিলেন, তিন বছর হলো অবসর
নিয়েছেন। বর্তমানে আম্মানের সফল একজন বল্টসায়ী তিনি।
তাঁর বল্টসার সংখ্যা কম নয়, তবে সবচেয়ে সুখ্যাতি অর্জন
করেছে বোরাক নামে এয়ার লাইন্স কোম্পানিটি।
মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সে দায়িত্ব পালনের সময় যখনই কোন
সংকটে পড়ে বিসিআই-এর সাহায্য চেয়েছেন, একবারও বিমুখ
হতে হয়নি তাঁকে। সে কথা তিনি ভোলেননি, তাই বিসিআই-এর
অনুরোধ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান।
গোপনীয়তার স্বার্থে বিশ্বস্ত পাইলট সালামত হাবিবিকে বেছে
নিয়েছেন জেনারেল জাকারিয়া। ইজরায়েলিল্ডে ক্ষতি করবার
সুযোগ পেলে এই লোক বিনা দ্বিধায় জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নেবে।
কিন্তু একটা কথা তাঁর জানা নেই, হাবিবির একটা দোষ হলো
ইজরায়েলিল্ডে প্রতি নিজের ঘৃণার কথা সে চেপে রাখবার চেষ্টা
করে না। প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ পাওয়া গেছে, এই কথাটাও
তার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার
সময়। আর কে না জানে যে কান ছাড়া ত্থেয়াল নেই!
পুরানো একটা ডিসি-থ্রি মাঝে মধ্যে ট্রেনিং-এর কাজে
বল্টহার করা হয়, কাজেই ওটাকে টেক-অফ করতে দেখলে
কারও মনে কোন সন্দেহ জাগবে না; জেনারেল সিদ্ধান্ত নেন,
ওটাই বিসিআই এজেন্টকে নেগেভের ড্রপ জোন-এ পৌঁছে দিয়ে
আসবে।
‘আমরা ড্রপ জোনে, মিস্টার রানা,’ বলল হাবিবি। ‘তবে
বাতাস খুব বেশি। আপনি রেডি তো?’
প্যারাশুটের শেষ বাকলটা ঠিকমত আটকেছে কি না দেখে
নিয়ে মাথা ঝাঁকাতে যাবে রানা, পে−ন অকস্মাৎ কাত হয়ে পড়ল।
১২
দেয়ালে ধাক্কা খেল ও। বাইরে তাকাতে দেখল ফ্লেক্সিবল্ উইং
আহত আলব্যাট্রস-এর ডানার মত ঘনঘন উপর-নীচে ঝাপটাচ্ছে।
হাবিবি পে−নটাকে আরেক দিকে কাত করল। ফলে আবার
ভারসাম্য হারাল রানা। এবার কোন দেয়াল নয়, খোলা ল্ডজার
দিকে ছিটকে পড়ল ও।
এখানেই যখন পড়তে হবে, নিজেকে থামাবার কোন চেষ্টাই
করল না রানা, খোলা ল্ডজা দিয়ে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সিদ্ধান্তটায় অবশ্যই ভাগেশু সহায়তা ছিল। পে−ন ত্যাগ
করবার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা হাই ভেলোসিটি
সারফেস-টু-এয়ার মিসাইলকে ধোঁয়ার ট্রেইল তৈরি করে উপর
দিকে উঠে যেতে দেখল রানা।
যেভাবেই হোক, জর্দানী পাইলট ইজরায়েলি রাডার
নেটওঅর্ককে ফাঁকি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ডিসি-থ্রিকে দেখামাত্র
মিসাইল ছুঁড়েছে তারা।
পে−নের বাম ডানা ছুঁয়ে গেল মিসাইল, তারপর যেন সূর্যের
চেয়ে কোটি গুণ উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হলো একটা নক্ষত্র।
শব্দ, তাপ আর বিস্ফোরণের ধাক্কা খেল রানা; শূন্যে পাক খাচ্ছে
শরীরটা।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রাণে বেঁচে গেল রানা। ওই
সময় যদি প্যারাশুট খুলত, ডিসি-থ্রির ফুয়েল ট্যাংকের বিস্ফোরণ
আগুন ধরিয়ে দিত ওটায়। তার বদলে উত্তপ্ত বাতাসের ঢেউ পাশ
কাটাল ওকে, ভারী জ্যাকেটের কয়েক জায়গায় শুধু খুদে দু’তিনটে
আগুন জ্বলল।
শক্তি খাটিয়ে শরীরের পাক আর ডিগবাজি খাওয়া বন্ধ করল
রানা, হাত দিয়ে চাপড় মেরে খুদে শিখাগুলো নিভাল। তারপর
রিপকর্ড ধরে দিল হ্যাঁচকা এক টান।
পাহাড়ী ঢাল থেকে এক হাজার ফুট উপরে খুলল প্যারাশুট।
তীব্র বাতাস ওকে দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। প্রচণ্ড
ঝাঁকি লাগায় ফুসফুস প্রায় খালি হয়ে গেছে রানার।
শেষবারের মত একটা ডিগবাজি খেয়ে পাহাড়ের চূড়া টপকে
অপর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল জ্বলন্ত পে−নটা। ক্ষণস্থায়ী, তবে তীব্র
একটা মর্মবেদনা অনুভব করল রানা পাইলটের জন্য।
নরম, ভেজা ভেজা মাটিতে পড়ে শরীরটাকে গড়িয়ে দিল
রানা। স্থির হলো একটা খেজুর গাছের গোড়ায়। ড্রপ জোন থেকে
সম্ভবত মাইল কয়েক দূরে নেমেছে ও।
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। আকাশে প্রচুর তারা;
দৃষ্টিসীমার ভিতর চাঁদ, মেঘ বা অন্য কিছু নেই।
দম ফিরে পেয়ে গা থেকে বাকল্ আর স্ট্র্যাপগুলো খুলল।
প্যারাশুট জড়ো করে নরম মাটি খুঁড়তে বেশি সময় নিল না,
তাড়াতাড়ি পুঁতে ফেলল ওটা, তারপর ঘাসের চাপড়া আর পাতা
ছড়িয়ে ঢেকে দিল জায়গাটা।
ইজরায়েলি সৈনশুা মিসাইল ছুঁড়ে পে−নটাকে যখন ফেলে
দিয়েছে, ধরে নিতে হয় রানাকেও তারা জাম্প করতে দেখেছে।
আর অন্ধকারে যদি জাম্প করতে না-ও দেখে থাকে, ডিসি-থ্রির
ফুয়েল ট্যাংক বিস্ফোরিত হওয়ার সময় আলোর কোন কমতি ছিল
না আকাশে, প্যারাশুটের নীচে নিশ্চয়ই ঝুলে থাকতে দেখা গেছে
ওকে।
ইজরায়েলের মাটিতে পা ত্থেয়ার আগেই রানা সম্ভবত শক্রর
চোখে ধরা পড়ে গেছে।
এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে ওকে।
অন্ধকার খেজুর বাগানের কোথাও কোন শব্দ নেই।
একজোড়া খেজুর গাছের কাছে সরে এসে ব্যাকপ্যাক খুলে
ছদ্মবেশ নিল রানা। সঙ্গে ছোট্ট আয়না আর পেন্সিল টর্চ আছে,
চাপ দাড়ি আর কাধ পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়া চুল ভাল ভাবেই
অ্যাডজাস্ট করা গেল। জ্যাকেট আর ট্রাউজারের উপর ঢোলা
আর খানিকটা নোংরা আলখেল−া পরে আরব বেদুইন সাজল ও।
১৩
গলায় ঝোলাল সুতির মোটা চাল্ড, কিনারায় সারি সারি গোলাপ
বোনা। এই চাল্ড দেখেই চিনে নেবে ওকে সিক্সটিনাইন।
এলাকার একটা ম্যাপে চোখ বুলাল রানা, এক পাশে তুফা
শহরের নকশাও আঁকা আছে। আশপাশের প্রায় সবগুলো গ্রামই
মুসলমানল্ডে, তবু বাধ্য না হলে ওল্ডে কারও সাহায্য নেওয়ার
ইচ্ছে নেই ওর। এমনিতেই বিপজ্ঝোছে ওরা, দখলদার
ইজরায়েলিল্ডে নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আছে, তাল্ডে বিপজ্ঝারও
বাড়াবার কোন মানে হয় না।
প্যারাশুটের মত ব্যাকপ্যাকটারও কবর হয়ে গেল, ওটার
ভিতর ম্যাপটাও আছে। পুরানো, তোবড়ানো ব্রিফকেস নিয়ে ঢাল
বেয়ে নামছে রানা। প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র কিছু ব্রিফকেসের
ফলস্ বটমে আছে, কিছু আছে পকেটে।
লোডেড ওয়ালথারটা রানা সহজে নাগাল পাওয়ার জন্য কোমরে গুঁজে রেখেছে। তবে তুফা শহরে ঢুকবার সময় আবার
ব্রিফকেসের ফলস্ বটমে লুকিয়ে রাখতে হবে ওটাকে, কারণ যে-
কোনও শহরের প্রবেশ মুখে রাস্তা বন্ধ করে লোকজনের শরীরে
তল−াশি চালায় ইজরায়েলি সৈনশুা। তবে বেদুইনল্ডে সঙ্গে ছুরি
পেলে সাধারণত কিছু বলে না তারা।
গ্রামগুলোকে এড়িয়ে সমতল ভূমিতে নেমে এল রানা। তুফা
এখান থেকে সাত-আট মাইল পশ্চিমে, পা চালিয়ে হাঁটলে ভোর
হওয়ার আগেই পৌঁছানো যাবে। কিন্তু পশ্চিমে নয়, দক্ষিণ দিকে
হাঁটছে ও এখন।
ছদ্মবেশটা নিখুঁত করতে হলে একটা মরু জাহাজ কিনতে হবে
রানাকে। জুম্মার দিন কেল−ার ভিতর বেদুইনল্ডে বাজারটা সকাল
থেকেই জমে ওঠে, তবে তুফায় একটু বেলা করেই পৌঁছাতে চায়
ও। সিক্সটিনাইন ওকে খুঁজে নিতে আসবে বেলা এগারেটা থেকে
দুটোর মধ্যে। একটু বেলা করে তুফায় পৌঁছাতে চাওয়ার আরও
একটা কারণ হলো, খোলা মরুভূমির কোথাও সেঁটে একটা ঘুম
দিতে চায় ও!
*
ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই হেলিকপ্টার গানশিপ আর ট্যাংক
নিয়ে রানার খোঁজে তুফায় পৌঁছে গেল ইজরায়েলি সৈনশুা।
বেশ সমৃদ্ধ আর ব্যস্ত একটা মরুশহর তুফা। শহরের প্রধান
আকর্ষণ পাথরের তৈরি প্রাচীন একটা কেল−া।
দূর অতীতের কথা জানা যায় না, তবে পাঁচ সাতশো বছরের
পুরানো শহরটা এই কেল−ার চারপাশেই গড়ে উঠেছে।
বিশাল কয়েকটা উঠান সহ কেল−াটাও পুরানো শহরের একটা
অংশ। ভিতরে কয়েকশো পরিবার বাস করে।
মূল উঠানে বাজার বসে। আরেক উঠানে আছে মসজিজ্ঝার
গির্জা, প্রায় পাশাপাশি। আরও আছে কবরস্থান, বড় আকারের
কুয়া, পাথরের তৈরি প্রাচীন সুড়ঙ্গ, হস্তশিল্পের কারখানা আর
বেশ্যাপাড়া।
পুরানো শহরের বেশিরভাগ মানুষই মুসলমান, খ্রিস্টানল্ডে
সংখ্যা নগণ্য। মুসলমানরা সবাই ফিলিস্তিনি নয়, মিশরের সিনাই
মরুভূমি আর সিরিয়ার গোলান মালভূমি থেকে আসা বেশ কিছু
উদ্বাস্তুও আছে। পুরানো শহরের লোকসংখ্যা পনেরো হাজারের
কাছাকাছি। এখানে কোন ইহুদি নেই।
কেল−ার বাইরে, পুবদিকে, নিজেল্ডে জন্য নতুন এবং
আধুনিক একটা শহর গড়ে তুলেছে ইজরায়েলিরা। নতুন শহরের
উত্তরে রয়েছে মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরিটা।
ভোর রাতে এই নতুন শহর আর মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরির
মাঝখানে এসে নামল দুটো হেলিকপ্টার গানশিপ। আর রাস্তা ধরে
এল একটা ট্রুপস ক্যারিয়ার।
ক্যারিয়ারে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সৈনশুয়েছে বাহান্নজন,
তাল্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেজর ফালাক আবরা। তার উপর নির্দেশ
আছে, মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরির চারধারে মোতায়েন করা কয়েকটা
১৪
ট্যাংক আর কিছু সৈন্য নিয়ে প্রথমে তুফা শহর ঘিরে ফেলতে
হবে, তারপর বিদেশী একজন গুপ্তচরের খোঁজে চালাতে হবে
তল−াশি অভিযানÑপ্রয়োজন হলে ঘরে ঘরে।
মেজর ফালাক আবরা-র সঙ্গে একই কপ্টারে চড়ে মোসাদ এজেন্ট এবরান বারাইত্থি পৌঁছেছে তুফায়।
বারাইদি ছিল তেল আবিবে। জর্দানের বোরাক এয়ার লাইন্সে
রোপণ করা ইনফরমার কাল রাতে রেডিও-টেলিফোনে ভয়ানক
একটা খবর দিয়েছে তাকে। তাজা বোমার সঙ্গে তুলনা করা যায়
সেটাকে। চির প্রতিদ্বন্দ্বী বিসিআই এজেন্ট মাসুল্ডানা নেগেভ
মরুভূমিতে, তুফা শহরের কাছাকাছি কোথাও, জাম্প করবে পে−ন
থেকে।
তারপর রাত সাড়ে বারোটায় নেগেভ থেকে একটা অ্যান্টি-
এয়ার ক্রাফট ইউনিট মোসাদ হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করল:
অজ্ঞাত পরিচয় একটা ছোট পে−নকে সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ মাইল
ভিতরে মিসাইল ছুঁড়ে ফেলে ত্থেয়া হয়েছে। পে−নের ফুয়েল
ট্যাংক আকাশেই বিস্ফোরিত হয়, তার আলোয় পাইলট কিংবা
একজন আরোহীকে প্যারাশুট নিয়ে নামতে দেখা গেছে।
সঙ্গে সঙ্গে রেড অ্যালার্ট ঘোষণা করে মোসাল্ডে তরফ থেকে
সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা হলো, কাল বিলম্ব না করে গোটা
এলাকায় চিরুনি অভিযান চালানো ল্ডকার। আর্মি হেডকোয়ার্টার
থেকে রাতেই রওনা হয়ে যায় হেলিকপ্টার গানশিপ দুটো, তার
একটায় সাদা পোশাকে চড়ে বসে মোসাদ এজেন্ট এবরান
বারাইদি।
রানা ড্রপ জোন ত্যাগ করবার এক ঘণ্টার মধ্যেই ইজরায়েলি
সৈন্যল্ডে একটা ইউনিট পাহাড়ের ঢালটায় পৌঁছে যায়। রানাকে
তারা না পেলেও, মাটিতে পুঁতে রাখা প্যারাশুট আর ব্যাকপ্যাক
খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় নেয়নি ওল্ডে কুকুর।
ঢাল থেকে নেমে পশ্চিম, অর্থাৎ তুফার দিকে রওনা হয়
সৈনশুা, কারণ কাছাকাছি ওই একটাই শহর। কিন্তু রানা গেছে
দক্ষিণে, খোলা মরুভূমির দিকে; ফলে তারা ওকে খুঁজে পায়নি।
এখনও।
সাড়ে তিন মাইল হেঁটে একটা ছোট পাহাড়ের নীচে, সরু গুহার
ভিতর ঘুমিয়েছে রানা। রাতেই টের পেয়েছিল কাছাকাছি কোথাও
বেদুইনরা আছেÑরবাবের তারে দু’একটা টোকা পড়ছিল, মাঝে
মাঝে বিচ্ছিরি খেঁক-খেঁক শব্দে ডেকে উঠছিল উটের দল।
সকালে তাল্ডেই চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল ওর।
গুহা থেকে বেরিয়ে দেখল, পাহাড়ি ঝরণার পাশে ভোরবেলাই
পশুর হাট বসে গেছে।
হাট যখন, রানার জন্য সুবিধেই হলো। নোংরা কাপড়চোপড়
পরা প্রচুর বেদুইন ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাল্ডে সঙ্গে ওর যদি কোন
অমিল থাকেও, সহজে চোখে পড়বার মত নয়।
ঝরণার পানিতে মুখ-হাত ধুয়ে তাওয়ায় সেঁকা আটার রুটি
খেল ও, ছাগলের দুধ দিয়ে তৈরি পনির আর অসম্ভব মিষ্টি চা
সহযোগে।
দেখে-শুনে একহারা গড়নের একটা উট কিনল রানা,
তারপর সকাল আটটার মধ্যে কাফেলার সঙ্গে রওনা হয়ে গেল
তুফার উদ্দেশে।
এত তাড়াতাড়ি শহরে ঢুকবার ইচ্ছে ওর ছিল না, তবে একটা
কাফেলার সঙ্গে থাকবার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে
সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে।
উত্তর-পশ্চিমের পথ ধরে তিন মাইল হাঁটলেই তুফা। এক
মাইলও পার হয়নি কাফেলা, হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে মাথার
উপর দু’তিনবার চক্কর দিল একটা হেলিকপ্টার গানশিপ, তারপর
শহরের দিকে চলে গেল।
মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল রানা। ভাবছে, ইজরায়েলি এয়ার
১৫
ফোর্স-এর এই তৎপরতার সঙ্গে ওর অনুপ্রবেশের কি কোন
সম্পর্ক আছে?
একটু পরই জানা গেলÑআছে।
প্রথম হেলিকপ্টার গানশিপ অদৃশ্য হয়েছে কি হয়নি, দ্বিতীয়টা
চলে এল মাথার উপর। খোলা ল্ডজার সামনে মেশিন গান বসিয়ে
কাফেলার উপর কড়া নজর রাখছে সৈনশুা।
কাফেলার সঙ্গেই থাকতে হবে রানাকে, তুফাতেও ঢুকতে
হবে, পালাবার কোন উপায় নেই।
ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে তুফা।
দূর থেকেই দেখা গেল শহরের প্রবেশ মুখে একজোড়া ট্যাংক
স্ফাড়িয়ে রয়েছে। পাথুরে প্রাচীর ঘেঁষে টহল দিচ্ছে ইজরায়েলি
সৈনশুা। কাফেলাকে আসতে দেখে দু’সারিতে স্ফাড়িয়ে একটা
প্যাসেজ তৈরি করল কিছু সৈন্য।
আরবী আর হিব্র“ ভাষায় নির্দেশ দিল তারা। উট থেকে নেমে
পায়ে হেঁটে শহরে ঢুকতে হবে বেদুইনল্ডে। তার আগে
প্রত্যেকের মাল-সামান আর দেহ সার্চ করা হবে, পরীক্ষা করে
দেখা হবে শহরে ঢুকবার অনুমতি-পত্র নবায়ন করা হয়েছে কিনা।
পঞ্চাশটা উটের কাফেলা। কমবেশি সত্তরজন নানা বয়সের
বেদুইন বল্টসায়ী। রানা রয়েছে সতেরো জনের পিছনে। সকাল
এগারোটার আগে শহরে ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না।
ওর পালা আসবার আগেই দু’জনকে ধরে কাছাকাছি ক্যাম্পে
নিয়ে যাওয়া হলো ইন্টারোগেট করবার জন্য। একজনের অপরাধ,
অন্য কোন লোকের অনুমতি-পত্রে নিজের ফটো লাগিয়েছে।
আরেকজনের কাছে পাওয়া গেছে সাদা পাউডার, সম্ভবত নিষিদ্ধ
হেরোইন।
এবার রানার পালা। তখনও ওকে সার্চ করা শুরু হয়নি, হঠাৎ
হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে একটা মেশিন গান গর্জে উঠল।
ওল্ডে সবার চোখের সামনে খুন হয়ে গেল দু’জন বেদুইন তরুণ।
ওল্ডে মাথার উপর সারাক্ষণই চক্কর দিচ্ছিল একটা
হেলিকপ্টার। হয়তো ফাঁল্ডে একটা অংশ হিসাবেই সেটাকে
দু’তিন মিনিট কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। এটাকে সুযোগ মনে
করে দুজন বেদুইন তরুণ কাফেলা ছেড়ে কেটে পড়বার তাল
করেছিল।
তাল্ডে ধারণা ছিল সৈন্যল্ডে চোখকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটা
বালিয়াড়ি পেরুতে পারলেই এ-যাত্রা রক্ষা পেয়ে যাবে।
কিন্তু প্রথম বালিয়াড়ি টপকে দ্বিতীয়টায় উঠেছে মাত্র, এই
সময় শিকারি বাজপাখির মত ছুটে এল সেই লুকানো হেলিকপ্টার
গানশিপ।
ওল্ডে চোখের সামনে, মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে, মেশিন গানের
ব্রাশ ফায়ারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল ছেলে দুটো। বালিয়াড়ি থেকে
গড়িয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল তারা, তারপরই পরপর দুটো
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল।
বালিয়াড়ির ওদিকটায় ধুলো-বালির মেঘ সৃষ্টি হলো, ভিতরে
মুহূর্তের জন্য দেখা গেল আগুনে লাল শিখা। তারপর ধীরে ধীরে
মিলিয়ে গেল মেঘটা।
কারও আর বুঝতে বাকি থাকল না যে তরুণ দু’জন
বেদুইনল্ডে ছদ্মবেশ নিয়ে তুফায় ঢুকবার জন্য এসেছিল। নিশ্চয়ই
ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাÑহামাস কিংবা হিযবুল−াহর সদস্য। প্রচুর
বিস্ফোরক ছিল ওল্ডে সঙ্গে।
শহরের ঢুকবার ফটকে সারা বছরই সৈন্যল্ডে পাহারা থাকে,
তবে টহল পার্টি থাকে না। শহরটাকে ঘিরে রাখা প্রাচীন পাথুরে
পাঁচিল অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে, তরুণ দু’জন সম্ভবত
ওরকম কোন ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকবার প−্যান করেছিল।
মেশিন গানের গর্জন আর বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনে
বেদুইনল্ডে মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দিল।
‘খামোশ!’ গর্জে উঠল সৈনশুা। ‘খবরদার কেউ যদি লাইন
১৬
ভাঙো!’
‘এই, উজবুক,’ সামনে স্ফাড়ানো সৈন্য এক হাতে বাগিয়ে ধরা
স্টেনগান দিয়ে খোঁচা মারল রানার পাঁজরে, ‘এ দিকে তাকা।’
তাকাল রানা। ‘হাতের ব্রিফকেসে কী?’
‘তোর নিয়তি,’ আরবীতেই বলল রানা।
সৈনন্ধা হকচকিয়ে গেলেও, তা মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য।
‘কী! আমার সঙ্গে রসিকতা করছিস? চোখের সামনে দুটো লাশ
পড়ে যেতে দেখেও তোর...’
‘আমি সব সময় সত্যি কথা বলি।’ রানা নির্লিপ্ত, চোখে-মুখে
কিছুটা দার্শনিকসুলভ ভাব। ‘মানুষের নিয়তি বদলে দেয়াই আমার
সারা জীবনের সাধনা। কেউ যজ্ঝিামার সাহায্য চায়,’ ইঙ্গিতে
ব্রিফকেসটা দেখাল, ‘তার জন্যে এর ভিতর ভাগ্য পরিবর্তনের
উপকরণ আছে।’
‘তারমানে বোমা...’ পিছাতে শুরু করে একজন সৈনঞ্জস্ফুটে
বলল।
সৈনশুা ভুল বুঝে অপ্রত্যাশিত কিছু করে বসবার আগেই
ব্রিফকেসটা খুলে তাল্ডে চোখের সামনে মেলে ধরল রানা।
দেখে মনে হয় ব্রিফকেস, আসলে এটা একটা মোবাইল শো-
কেস। ভিতরে প্রথমেই কাঁচের একটা আচ্ছাদন দেখা গেল। তার
নীচে কালো মখমল দিয়ে মোড়া খুজ্ঝোকৃতির খোপ। প্রতিটি
খোপে একটা করে রঙিন পাথর।
সবই যে দামী রতœ, তা নয়Ñতবে আসল হীরে থেকে শুরু
করে নীলা, আকিক, প্রবাল, বৈদুর্যমণি, ক্যাটস আই, মুনস্টোন,
ইরানি ফিরোজা, সিংহলী টোপায, বার্মিজ চুনি, ব্রাজিলিয়ান পান্না
ইত্যাদি নানান জাতের পাথরের অনেকগুলোই নির্ভেজাল।
সৈন্যল্ডে পেশীতে ঢিল পড়ল। রানাকে শো-কেস বন্ধ
করতে বলে শহরে ঢুকবার অনুমতি-পত্র দেখতে চাইল তারা।
বিস্ফোরক বহনকারী দুই তরুণ গুলি খেয়ে মরে যাওয়ার পর
ইজরায়েলি সৈন্যল্ডে মধ্যে শিথিল একটা ভাব এসে গেছে, কারণ
তাল্ডে ধারণা হয়েছে, ওই দুই তরুণকে ধরবার জন্যই এখানে
তাল্ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কাফেলার বাকি বেদুইনল্ডে দেহ
তল−াশি করা এখন স্রেফ একটা রুটিন হয়ে স্ফাড়িয়েছে।
একজন সৈনশুানার অনুমতি পত্রে চোখ বুলিয়ে ইঙ্গিতে ওকে
সামনে এগোতে বলল। কোমরে জড়ানো উটের রশিটা হাত দিয়ে
ধরে হেলেদুলে ফটক পার হলো রানা। রঙচঙে ডায়ালসহ ঢাউস
একটা জাপানি রিস্টওয়াচে সাড়ে এগারোটা বাজে।
একবার চোখ বুলিয়েই টের পেয়ে গেল ও, শহরের পরিবেশ
কী রকম বিপজ্জনক হয়ে আছে। রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয়
বালির বস্তার ¯তূপ তৈরি করে পজিশন নিয়েছে সেনাবাহিনীর
সদসশুা। দু’তিনজনের একটা করে টিম টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে
চারদিকে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, শহরের মানুষ কিন্তু আতঙ্কিত নয়।
গম্ভীর এবং উত্তেজিত, কিন্তু সন্ত্রস্ত কিংবা ভীত বলে মনে হচ্ছে না;
বরং চলন-বলন আর হাবভাবে বেপরোয়া একটা ভাবই চোখে
পড়ছে।
এর সম্ভাবল্ট্যাখ্যা: অভ্যাস। কম দিন তো হলো না ওরা
এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধেল্টসবাস করছে।
আরেক ফটক দিয়ে কেল−ার ভিতর ঢুকবার সময় দু’পাশে
আট-দশজন সৈন্যকে স্ফাড়িয়ে থাকতে দেখল রানা, তাল্ডে মধ্যে একজন মেজর রয়েছে।
বোরকা পরা, তবে মুখের আবরণ খোলা, পাঁচ-সাতজন
তরুণীকে স্ফাড় করিয়ে রেখেছে সৈনশুা। মেজর ফালাক আবরা
বলছে, তাল্ডেও দেহ তল−াশি করতে দিতে হবে, তা না হলে
একজনকেও কেল−ার ভিতর ঢুকতে ত্থেয়া হবে না।
রানার চোখে মেয়েগুলোকে অসাধারণ সু›ল্ড লাগল। কিন্তু
ইজরায়েলি মেজরের সঙ্গে তাল্ডে সকৌতুক আচরণ বিস্মিত করল
১৭
ওকে।
ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ধরে রেখে, চোখের তারা কোণে
সরিয়ে এনে উত্তরে তারা বলছে, দেহ তল−াশি করতে হলে মেজর
সাহেবকে তাল্ডে বাড়িতে ঢুকতে হবে, কারণ শুধু চার-দেয়ালের
ভিতরই একজন পুরুষ কোন মেয়েমানুষের গায়ে হাত দিতে
পারে।
এসব কথা বলবার সময় মেয়েগুলো উচ্ছল, তরল হাসিতে
ভেঙে পড়ছে, ঢলে পড়ছে পরস্পরের গায়ে। রানাকে দেখে
তাল্ডে মধ্যে একটা সকৌতুক ফিসফিসানিও লক্ষ করা গেল।
সৈনশুা ফটকের কাছে কাউকে স্ফাড়াতে দিচ্ছে না। উট নিয়ে
মূল উঠানে ঢুকে পড়ল রানা। সিক্সটিনাইন ওকে খুঁজে নেবে
ঠিকই, তবে নির্দিষ্ট একটা এলাকা থেকে।
বেদুইনল্ডে বাজারটা সকাল থেকেই জমে উঠেছে।
ক্রেতাল্ডেও উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করল রানা। সৈন্যল্ডে
উপস্থিতি কেউই যেন গায়ে মাখতে চাইছে না।
বিশাল উঠানের এক কোণে উট বেঁধে রেখে বাজারে ঢুকল
রানা। বেদুইন হকাররা দেয়ালবিহীন চালাঘরের নীচে শতরঞ্চি বা
চাল্ড বিছিয়ে নিজেল্ডে পসরা সাজিয়ে বসেছে। ভিড় ঠেলে
এগোচ্ছে রানা, সুবিধে মত ফাঁকা একটা জায়গা পেলে বসবে।
চেহারা-সুরত দেখেই বোঝা যায় ক্রেতারা সবাই ফিলিস্তিনি
অর্থাৎ পুরানো শহরের লোকজন নয়। নতুন শহরের ইহুল্ডিা আজ
জুম্মার দিন বলে নয়, প্রায় প্রতিদিনই এখানে কেনাকাটা করতে
আসে। তারা শার্ট-ট্রাউজার বা কোট-টাই পরা লোকজন। ওল্ডে
মেয়েগুলোও স্কার্ট পরা।
নতুন শহরে বাজার নেই। নেই আরও একটা
জিনিসÑছোটখাট কাজ করবার মানুষ: মিস্ত্রি, মালী, চাকর,
মেশিন-টুলস্ ফ্যাক্টরির জনঞ্জাধা দক্ষ শ্রমিক ইত্যাদি।
সবাই যদি হাঁটে, তাল্ডে মধ্যে হঠাৎ কেউ থমকে স্ফাড়ালে,
তা এক সেকেন্ডের জন্য হলেও, চোখের কোণে ধরা পড়বে।
রানার ঠিক তাই হলো। উল্টোদিক থেকে আসা জনস্রোত
ঠেলে এগোচ্ছে ও। লোকটা যথেষ্ট লম্বা বলেই তার হাঁটবার ছন্দে সামান্য পতন হলেও ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ল ওর দৃষ্টিতে।
পরমুহূর্তে চোখাচোখি হলো।
এবরান বারাইদিকে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারল রানা।
তবে এক পলকেই নিজেকে সামলে নিয়েছে ধূর্ত মোসাদ এজেন্ট। নির্লিপ্ত, প্রায় বিষণœ চেহারা দেখে বুঝবার উপায় নেই
রানার ছদ্মবেশ সে ধরে ফেলেছে কি না।
যতই নিখুঁত হয়ে থাকুক রানার ছদ্মবেশ, ওকে সম্ভবত চিনে
ফেলেছে বারাইদি; তা না হলে কী থমকাত?
বারাইল্ডি ঠিক পিছনেই রয়েছে তিনজন সৈনিক; একটা টহল
পার্টি।
চার
রানা গম্ভীর, চেহারায় রগচটা ভাব, দম্ভে যেন মাটিতে পা পড়ছে
নাÑহুবহু একজন বেদুইন তরুণের স্বাভাবিক প্রতিচ্ছবি।
পাশ কাটানোর সময় দু’জনের দুই কাঁধ সামান্য ঘষা খেল।
আবার রানার দিকে তাকাল বারাইদি, দৃষ্টিতে অন্তর ভেদ করবার প্রয়াস।
তা হলে এখনও কি সে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়?
রানার চেহারায় কোন পরিবর্তন নেই। কল্পনার চোখে ছবিটা
১৮
দেখতে পাচ্ছে ও: ছুরিটা বগলের নীচে স্ট্র্যাপ দিয়ে
আটকানোÑবিদ্যুদ্বেগে বের করে বারাইল্ডি সোলার পে−ক্সাসে
হাতলের কিনারা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কল্পনাটা বাস্তবে পরিণত করবার প্রয়োজন হলো না; চোখে-
মুখে সংশয় নিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল বারাইদি। পিছু
পিছু টহল পার্টিও।
গলার চাল্ডটা দিয়ে মাথা ঢেকে দ্রুত নকল দাড়ি গোঁফ খুলে
পকেটে রাখল রানা, তারপর হন হন করে এগোল।
বিশ-বাইশ গজ হেঁটে দুই হকারের মাঝখানে প্রায় গায়ের
জোরে সামান্য একটু জায়গা করে নিল রানা, গলায় জড়ানো
চাল্ডটা খুলে খানিকটা বিছাল, বাকিটা দিয়ে ঢেকে ফেলল
ব্রিফকেস।
নাগালের মধ্যে শুধু ছুরিটা আছে, ওয়ালথারটা রয়েছে
ব্রিফকেসের ফলস্ বটমেÑপ্রথম কাজ ওটাকে বের করা। বারাইদি নিজের চেহারায় সংশয় ফুটিয়ে তুললেও, তার মানে এই নয় যে
রানাকে নিশ্চিতভাবে চিনতে পারেনি সে। যে-কোন এসপিওনাজ
এজেন্টকে ভাল অভিনেতা হতে হয়, বারাইদিকে রানা নির্দ্বিধায়
প্রথম শ্রেণীর একজন এজেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
অর্থাৎ, মোসাল্ডে চোখে ধরা পড়ে গেছে ও।
যে-কোন মুহূর্তে, যে-কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে।
এত সৈন্য, ট্যাংক আর হেলিকপ্টার গানশিপÑশুধু ওকে ধরবার
জন্য। টের পেল কীভাবে?
হকার দু’জন বেদুইন তরুণ, তাল্ডে দাম্ভিকতা আর
বদমেজাজ কৃত্রিম নয়; রানা ঠেলেঠুলে ওল্ডে মাঝখানে জায়গা
করে নিয়েছে দেখে ফণা তুলল তারা। একজন কনুই দিয়ে গুঁতো
মারল ওর পাঁজরে, আরেকজন ব্রিফকেস ঢেকে রাখা চাদরের
একটা প্রান্ত ধরে টান দিল।
বারাইদিকে দেখে কোণঠাসা বিড়ালের মত হিংস্র একটা ভাব
চলে এসেছে রানার মনে, রাস্তার উপর সতর্ক দৃষ্টি। ওর হাত
দুটো চাদরের ভিতর নড়াচড়া করছে। এই সময় পাঁজরে লাগল
গুঁতোটা, পরক্ষণে টান পড়ল চাদরে।
পালা করে দু’জনের দিকে তাকাল রানা। ওর দৃষ্টিতে কী ছিল
ব্যাখ্যা করতে পারবে না ওরা, তবে চোখের পলকে পাথর হয়ে
গেল বেদুইন তরুণরাÑশিরস্ফাড়ায় শিরশিরে অনুভূতি হলো, ছলকে
উঠল বুকের রক্ত, একই সঙ্গে যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই সেই টহল পার্টিকে ফিরে আসতে দেখা গেল।
দাড়ি গোঁফ আছে, এমন লোকজনল্ডে দিকে সন্দেহের চোখে
তাকাচ্ছে, দেখছে তাল্ডে কারও কাছে ব্রিফকেস আছে কি না।
এক সময় রানার সামনে এসে স্ফাড়াল তারা।
মুখ তুলে তাকাল রানা। তিনজন সৈনিক হাতে বাগিয়ে ধরা
স্টেনগান। আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বারাইদি পাঠিয়েছে।
হয়তো নিশ্চিত হতে চাইছে সে, কিংবা বুঝতে চাইছে রানার সঙ্গে
আরও কেউ আছে কি না।
একজন দেখছে রানাকে, বাকি দু’জন এদিক-ওদিক তাকিয়ে
কী যেন খুঁজছে। প্রথম লোকটা হঠাৎ ঝুঁকল, সাদা চাল্ড টান
দিয়ে সরিয়ে নিল ব্রিসকেস থেকে।
ইতিমধ্যে, চাদরের আড়ালে থাকতেই ব্রিফকেসটা খুলে
ফেলেছে রানা; ফলস বটমের আগ্নেয়াস্ত্র এখন আবার ওর
কোমরের বেল্টে উঠে এসেছে।
ব্রিফকেসটাকে এখন আর ব্রিফকেস বলে চিনবার কোন উপায়
নেই। এই মুহূর্তে ওটা একটা শো-কেস, কাঁচের ভিতর কালো
মখমলের খোপে মূলল্টান সব মণি-মানিকঞ্জালোর দ্যুতি
ছড়াচ্ছে।
চাদরের প্রান্ত ছেড়ে দিল সৈনিক, থমথম করছে চোখ-মুখ।
বাকি দু’জন বসে পড়ল রানার সামনে, যে যার হাতের তালু
বাড়িয়ে ধরেছে।
১৯
শো-কেসের পাশে কালো রঙ করা ছোট একটা কার্ডবোর্ডের
সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে সাদা রঙ দিয়ে আয়ু আর ভাগ্য রেখা সহ মানুষের একটা তালু আঁকা। সাইনবোর্ডের সামনে
বিছানো হয়েছে রাশিচক্রের নকশা আঁকা একটা কাপড়।
অর্থাৎ রানা একজন জ্যোতিষী, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়
করে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আভাস দেয়।
দ্বিতীয় আর তৃতীয় সৈনিক রানাকে সন্দেহই করেনি, কারণ
মোসাদ এজেন্ট বারাইল্ডি ত্থেয়া বর্ণনার সঙ্গে ওর চেহারা
মেলেনিÑদাড়ি-গোঁফ নেই।
তবে প্রথম সৈনিক, একজন ক্যাপটেন, দাড়ি-গোঁফ না
থাকাটাকে গুরুত্ব দেয়নি। ইহুদিল্ডে ক্ষতি করবার জন্য প্যারাশুট
নিয়ে ইজরায়েলে নেমেছে, ওগুলো নকল হওয়ারই তো বেশি
সম্ভাবনা। তা ছাড়া, তার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে চাল্ডটা।
এই চাদরের কথা মেজর বারাইদি তাকে বলেছেন। কী ফুল
বা ফুলগুলো সাদা কি না তা না বললেও, চাল্ডটার কিনারায় ফুল
তো সে দেখতেই পাচ্ছে।
মেজর বলে দিয়েছেন, চেহারার বর্ণনা মিললে যা করবার
অত্যন্ত সাবধানে করতে হবে, কারণ এই লোক নাকি নিজের
জানেরও পরোয়া করে না। কী করতে হবে তাও তিনি বলে
দিয়েছেন।
‘এই, ওঠো তোমরা।’ সঙ্গীল্ডে নিত¤েল্গুটের ডগা দিয়ে
খোঁচা মারল ক্যাপটেন। তারা স্ফাড়াচ্ছে দেখে সরাসরি রানার
দিকে তাকাল সে। ‘মেজর এবরান বারাইদি তোমার জনেঞ্জামাল্ডে ক্যাম্পে অপেক্ষা করছেন,’ রানাকে বলল। ‘শো-কেস
বন্ধ করে চলো আমাল্ডে সঙ্গে।’
‘মেজর এবরান বারাইদি?’ হঠাৎ হাসল রানা। ‘তিনি তুফায়?
অনেকদিনের পরিচয়, বন্ধুই বলতে পারো। ঠিক আছে, তোমরা
যাও, একটু পর আসছি আমি। এই তো সবে দোকান খুলে
বসেছি, বউনিটা অন্তত করি।’
‘না।’ স্টেনগানটা সরাসরি রানার বুকে তাক করল
ক্যাপটেন। ‘তোমাকে এখনই আমাল্ডে সঙ্গে যেতে হবে, ওঠো।’
স্টেনগানটা দেখেও না দেখবার ভান করল রানা। ‘ঠিক
আছে, তা হলে তাই চলো।’ রাজি হলো ও। শো-কেস বন্ধ
করল। ক্যাপটেন লক্ষ করল, জিনিসটা আসলে ব্রিফকেস।
সিধে হচ্ছে রানা, ব্রিফকেসটা বাকি দুই সৈনিকের দিকে
বাড়িয়ে ধরল; অপর হাতটা আলখেল−ার ভিতর অদৃশ্য হয়ে
গেছে। দুর্লভ রতেœ ভরা ব্রিফকেসটা ধরে ফেলল একজোড়া চঞ্চল
হাত।
ব্রিফকেস ঠিক যখন ছেড়ে দিচ্ছে, খালি হাতটায় চলে আসা
ওয়ালথারের ট্রিগার টেনে দিল রানা। বাজার গমগম করছে,
বহু লোকের সেই গুঞ্জনকে ছাপিয়ে উঠল ওয়ালথারের কর্কশ
গর্জন।
ক্যাপটেন যেন এইমাত্র তার কপালে বেশ বড় একটা লাল
টিপ পরেছে।
এক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরও দু’বার গর্জে উঠল
ওয়ালথার। দুই সৈনিক ব্রিফকেস ছেড়ে দিয়ে যে যার বাম বুক
চেপে ধরল।
ব্রিফকেসটা এখন আবার রানার হাতে, আরেক মুঠোয় উদ্যত
পিস্তল। লাফ দিয়ে ক্যাপটেনের লাশ টপকাল, বোকামির নিদর্শন
চাল্ডটা পড়ে থাকল পিছনে। বাজারের ভিতর দিয়ে প্রাণপণে
দৌড়াচ্ছে ও।
মূলল্টান পাথর সহ কালো মখমল খুদে একটা পোঁটলার
আকৃতি পেল, চালান হয়ে গেল আলখেল−ার পকেটে। দৌড়ের
মধেঞ্জারও একটা কাজ সারল রানা। ফলস্ বটম থেকে
প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বের করে নিয়ে ব্রিফকেসটা ফেলে দিল
একপাশে।
২০
রানার সামনে ভোজবাজির মত দু’ফাঁক হয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ
বেদুইন ফেরিঅলা আর ক্রেতাল্ডে ভিড়। বিশেষ করে কেল−ার
বাসিন্দারা, প্রায় সবাই ফিলিস্তিনি, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা নিয়ে
এরই মধ্যে লম্বা একটা প্যাসেজ তৈরি করে ফেলেছেÑযেন গাইড
করছে রানাকে।
নিজেল্ডে মধ্যে ফিসফাস করছে তারা: বিদেশী বন্ধু! যেভাবে
পারো সাহায্য করো!
ভিড় হটিয়ে তৈরি করা প্যাসেজ ধরে ছুটছে রানা। ছোট
একটা তোরণ পেরিয়ে কেল−ার দ্বিতীয় উঠানে বেরিয়ে এল।
অনেকটা দূরে একটা চার্চের চূড়া দেখা যাচ্ছে। নাক বরাবর
সামনে, কেল−ার দেয়াল ঘেঁষে স্ফাড়িয়ে দোতলা মসজিদ।
মসজিল্ডে এক কোণে বিরাট একটা স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে
জাফরি কাটা, ভিতরে সিঁড়ির ধাপ দেখা যাচ্ছে। স্তম্ভটা আসলে
মিনার, মাথায় চারদিকে তাক করা চারটে লাউডস্পিকার।
‘এখনই আজান শুরু হবে,’ কে যেন ফিসফিস করল কানের
কাছে। ‘নামাজীল্ডে কাতারে স্ফাড়িয়ে যান।’
এখনও ছুটছে রানা। ভিড় সরিয়ে তৈরি করা প্যাসেজ ওর
পিছনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার মানুষের নিরেট পাঁচিলে পরিণত
হচ্ছে।
সামনে মসজিল্ডে পাকা চাতাল। একপাশে লম্বাটে চৌবাচ্চা,
ওজু করবার জন্য পরিষ্কার পানি টলটল করছে।
ঠাসঠাস করে গুলি হলো রানার পিছনে। শুরু হলো ছুটোছুটি
আর চিৎকার-চেঁচামেচি। রানার পিছনে জোড়া লাগা প্যাসেজ
নতুন করে খুলে যাচ্ছে। ফাঁকা আওয়াজ করে পথ করে নিচ্ছে
ইজরায়েলি সৈনশুা। রানার নাগাল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে
ছুটছে তারা।
রানার এখন আর মসজিদে ঢোকা চলে না। ইজরায়েলি
সৈনশুা ভিতরে ঢুকে কোণঠাসা অবস্থায় পাবে ওকে।
এক সেকেন্ডের জন্য স্ফাড়িয়ে পড়ল রানা। মুসল−ীরা ওকে
দেখছেন। আশপাশ থেকে দু’একজন বিড়বিড় করল: ‘এসে
পড়ল...পালাও বাপ্!’
কিন্তু কোথায় পালাবে রানা?
ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত লাগছে নিজেকে।
অবশেষে মসজিদকে পাশ কাটিয়ে এক ছুটে মিনারের
আড়ালে চলে এল রানা।
স্তম্ভ বা মিনারে ঢুকবার ল্ডজাটা খোলাই পেল। সিঁড়িটা এক
পাশে, আরেক পাশে একটা কাঠের আলমারি।
আলমারির সামনে স্ফাড়িয়ে মধল্টয়স্ক মোয়াজ্জিন গায়ে একটা
আচকান চাপাচ্ছেন।
পায়ের আর নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনে ঘাড় ফেরালেন তিনি।
‘আমি বিদেশী, আপনাল্ডে বন্ধু,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
রানা। ‘ইজরায়েলি সৈনশুা আমাকে ধরতে আসছে।’
কান পেতেই ছিলেন মোয়াজ্জিন, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ,
আসছে।’ আচকানটা তিনি গুঁজে দিলেন রানার হাতে। তারপর
লাল আর সাদা রঙের সুতি চাল্ডটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রানার
পিঠে আর ঘাড়ে জড়ালেন, মাথা থেকে খুলে পরিয়ে দিলেন
টুপিটাও। ইঙ্গিতে সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলেন। ‘আল−াহ আপনাকে
নিশ্চয়ই বাঁচবার পথ দেখাবেন।’ হাতঘড়ির ডায়ালে চোখ
বুলালেন। ‘আর মাত্র এক মিনিট...’
বাকিটা শুনবার জনদ্দখানে রানা স্ফাড়িয়ে নেই। প্রতিবার
দুটো করে ধাপ টপকে উপরে উঠছে ও।
ত্রিশ ফুট উঁচু মিনারের মাথাটা রেইলিং দিয়ে ঘেরা। কেল−ার
এটা দক্ষিণ প্রান্ত, চওড়া সীমানা প্রাচীর আট-দশ ফুট নীচে।
মসজিল্ডে পাশে তিনতলা মাদ্রাসা, খোলা বারান্দায় ধর্মীয় কিতাব
খুলে বসেছে একদল শিশু কিশোর।
মাউথপিসে দু’বার টোকা দিয়ে দেখে নিল রানা সিস্টেমটা
২১
ঠিক আছে কিনা। তারপর শুরু করল:
আল−াহু আকবার, আল−াহু আকবার!
আল−াহু আকবার, আল−াহু আকবার!
আশহাদু আল−া ইলাহা ইল−াল−াহ,
আশহাদু আল−া ইলাহা ইল−াল−াহ।
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল−াহ,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল−াহ।
হাইয়্যা আলাস্ সালাহ,
হাইয়্যা আলাস্ সালাহ।
হাইয়্যা আলাল ফালাহ,
হাইয়্যা আলাল ফালাহ।
আল−াহু আকবার, আল−াহু আকবার!
লা ইলাহা ইল−াল−াহ!
আজান ত্থেয়া তখনও শেষ হয়নি, মসজিল্ডে সামনের
চাতাল থেকে ভেসে আসা উত্তেজিত তর্ক-বিতর্কের আওয়াজ
শুনতে পেল রানাÑনামাজ পড়তে আসা মুসল−ীরা ইহুদি সৈন্যল্ডে
মসজিল্ডে ভিতর ঢুকতে নিষেধ করছেন।
আজান ত্থেয়া শেষ হওয়া মাত্র গর্জে উঠল কয়েকটা
স্টেনগান। রানা আশা করল, ফাঁকা আওয়াজÑআহত কারও
কাতরানি শোনা গেল না। তবে তারপরই মুসল−ীরা একযোগে
প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।
তাতে অবশ্য কোন কাজ হলো না। থেমে থেমে গুলির
আওয়াজ হচ্ছেই। সৈন্যল্ডে বুট পরা পায়ের আওয়াজ শুনে রানা
বুঝতে পারল মসজিল্ডে ভিতর ঢুকে পড়েছে তারা।
মসজিত্থেকে না পেলে জানা কথা মিনারে উঠে আসবে
সৈনশুা। মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে শুধু এই মিনারেই ওঠা যায়।
পাঁচিল টপকে পাশের মাদ্রাসা বা অন্য কোন দালানে যাওয়া প্রায়
অসম্ভব, কারণ চারপাশের একটা পাঁচিলও বিশ ফুটের কম উঁচু
নয়।
কী করবে ভাবছে রানা, কিন্তু যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল না।
পেঁচানো সিঁড়ির গোড়ায় একটা হইচই বেধেছে। মনে হলো
মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ¯ল্ফ, বলছেনÑপ্রাণ থাকতে তিনি কোন ইহুদিকে
মিনারে উঠতে দেবেন না, তাতে মিনারের পবিত্রতা নষ্ট হবে।
তারপর একটা গুলি। এবং আর্তনাদ। কাতর কণ্ঠে
সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছেন মোয়াজ্জিন।
পেঁচানো লোহার সিঁড়িতে কয়েক জোড়া বুটের আওয়াজ।
সৈনশুা উঠে আসছে।
রানা জানে না কী নির্দেশ ত্থেয়া হয়েছে তাল্ডেকে।
দেখামাত্র গুলি করবে ওকে? নাকি জ্যান্ত ধরে নিয়ে যাবে
ইন্টারোগেট করবার জন্য?
লাফ দিয়ে আট কি দশ ফুট নীচের চওড়া দুর্গ-প্রাকারে
নামতে যাচ্ছে রানা। তারপর প্রাচীরের কিনারা ধরে ঝুলে পড়লে
বিশ ফুট নীচের নরম জমিনে নামা খুব একটা ঝুঁকির ব্যাপার হবে
না হয়তো।
রেইলিং টপকাচ্ছে, এই সময় মাদ্রাসার ফাঁকা বারান্দায় চোখ
পড়ল।
আজান শুরু হতেই যে যার কিতাব বন্ধ করে নামাজ পড়তে
চলে গেছে শিশু কিশোর-ছাত্ররা।
তবে একজন ফিরে এসেছে। সাত কি আট বছরের একটা
ছেলে রানার কাছ থেকে মাত্র সাড়ে তিন হাত দূরে নিঃশব্দে
স্ফাড়িয়ে আছে, হাতের ¯ে−টটা দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে ধরা।
¯ে−টে লেখা: ৬৯।
২২
পাঁচ
এক রেইলিং থেকে লাফ দিয়ে আরেক রেইলিঙে। পিলার ধরে
ভারসামশুক্ষা। সবই যেন ¯ে−া মোশনে ঘটছে। বারান্দার
মেঝেতে পা দিয়ে নিজের কব্জি ছেলেটাকে ধরতে ত্থেয়া। তার
সঙ্গে দৌড়। খোলা ল্ডজা দিয়ে একটা ঘরের ভিতর ঢুকল ওরা।
পরমুহূর্তে মিনারের চূড়ায় বেরিয়ে এসে রানাকে দেখতে না
পেয়ে হিংস্র আক্রোশে ফেটে পড়ল সৈনশুা।
‘ডাইভারশন ক্রিয়েট করে বিদেশী স্পাইকে অন্যদিকে সরিয়ে
নেয়া হয়েছে।’
‘জাহান্নাম ছাড়া সরাবার জায়গা কোথায় ওল্ডে? গোটা কেল−া
আমরা ঘিরে ফেলেছি।’
‘মেজর আবরা বলেছেন, একটা পিঁপড়েও যাতে বেরুতে না
পারে...’
রানাকে নিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে চলে এল ছেলেটা।
তারপর একটা করিডর পেরুল। শেষ মাথায় সিঁড়ি।
আবার করিডর, আবার সিঁড়ি। অবশেষে সরু প্যাসেজ। ঝড়
তুলে ছুটছে ওরা। কারও সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। তবে গুলির শব্দ
হচ্ছে, আর গুলি হলেই নিজের অজান্তে শিউরে উঠছে ছেলেটা।
মুহূর্তের জন্য থমকাচ্ছে, তারপর আবার ছুটছে।
পাকা একটা চত্বরে বেরিয়ে এল ওরা। চত্বরের মাঝখানে,
মাথায় কংক্রিটের ছাদসহ, বিরাট কুয়া।
কুয়ার পাশে কালো বোরকা পরা এক তরুণী। মুখটা খোলা।
ভরাট স্বাস্থ্য, টানা টানা চোখ। আগেও তাকে দেখেছে রানা।
দেখেছে শহরে ঢুকবার সময়, প্রধান ফটকেÑএকজন
মেজরের সঙ্গে রসিকতা করছিল। একা নয়, তার সঙ্গে আরও
পাঁচ-ছয়টা মেয়ে ছিল।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল তরুণী। যে পথ দিয়ে এসেছিল
সেই পথ ধরে প্রায় চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল বাচ্চাটা।
‘সিক্সটিনাইন?’ রানার প্রথম প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল তরুণী। ‘তুমি নাইনটিসিক্স।’ এখনও ছেলেটার
গমন পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, দৃষ্টিতে বিষণœতা। ‘ওর নাম
নাবিল। জানে না ফিরে যাচ্ছে আব্বার লাশের কাছে।’
‘ওর আব্বা...মুয়াজ্জিন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি কী করে জানলে তিনি মারা গেছেন?’ জিজ্ঞেস করল
রানা।
বোরকার ভিতরের পকেট থেকে একটা ওয়ায়্যারলেস সেট
বের করে দেখাল মেয়েটি, তারপর বোতাম টিপে কাউকে একটা
মেসেজ দিল আরবী ভাষায়: সুরাইয়া বলছি। আমরা নামব,
টানেলের মুখ খুলে দাও।’
রানা কিছু বলতে যাবে, বাধা দিয়ে ইঙ্গিতে কুয়াটা দেখাল
সুরাইয়া, ‘তুমি আগে থাকো, আমি তোমার পিছু নিই।’
উঁকি দিয়ে কুয়ার নীচে তাকাল রানা। দু’ফুট নীচে লোহার
একটা রড, প্রান্ত দুটো কুয়ার ভিতরের দেয়ালে গাঁথা। রডের
সঙ্গে একটা কপিকল দেখা যাচ্ছে, ওটার সাহাযেল্টড় আকারের
বালতি করে পানি তোলা হয়। তবে কুয়ার তলার দিকটায় গাঢ়
অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কপিকলের পাশে রশির তৈরি একটা মইও রয়েছে। নষ্ট
২৩
করবার মত সময় নেই, মই বেয়ে নামতে শুরু করল রানা।
নাইলন রশি দিয়ে তৈরি মইটা যথেষ্ট মজবুত, দু’জনের ভারে
ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় নেই। প্রায় পঁয়ত্রিশ ফুট নামবার পর আরও
অনেকটা নীচে পারল্ডে মত চকচকে একটা ভাব দেখতে পেল
রানা।
একটু পর ওর মাথার উপর থেকে মেয়েটি বলল, ‘থামো।’
সরু মই, তাই পাশ কাটাবার সময় রানার সঙ্গে ঘষা লাগল
মেয়েটির কোমর। ‘টানেলের মুখে অচেনা মানুষ দেখে ঘাবড়ে
যেতে পারে ওরা,’ বলল সে।
আর মাত্র দশ ফুট নামতে হলো। কুয়ার দেয়ালে চওড়া
একটা গর্ত দেখা গেল, তিন ফুট উঁচু, দশ ফুট লম্বা। টানেল নয়,
বড়জোর গুহা বলা যেতে পারে। আসলে যান্ত্রিক কোন কৌশলে
কুয়ার দেয়াল পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গুহার শেষ মাথায়
মাটি, অর্থাৎ ওদিক দিয়ে বেরুনো যাবে না।
একজোড়া কর্ড ধরে টান দিতে রশির মইটা উপরের রড
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীচে পড়ল। সেটা গুছিয়ে নিয়ে গুহায় ঢুকল
মেয়েটি। রানা তাকে ডান দিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল।
মেয়েটির পিছু নিয়ে ফুট পাঁচেক এগিয়ে ডান দিকে আরও
একটা গুহা দেখল রানাÑনা, এটাকে টানেল বলতে হবে। মেঝেটা
পাকা, ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। বাল্ব জ্বলছে সিলিঙে, সেটা
এতটাই উঁচু যে সিধে হয়ে স্ফাড়ানো যাচ্ছে।
আলখেল−া পরা একজন ফিলিস্তিনি তরুণ সালাম দিল
ওল্ডেকে। তার হাতে একটা রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র দেখল রানা।
বোতামে চাপ দিল তরুণ, সঙ্গে সঙ্গে গুহার পিছনের দেয়াল
সচল হওয়ার আওয়াজ ভেসে এল। ওটা আসলে কুয়ারই নিরেট
একটা অংশ, এখন আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে, ফলে
ওল্ডে চোখের সামনে বন্ধ হয়ে গেল টানেলে ঢুকবার পথটাও।
ওল্ডেকে পথ দেখাল সিক্সটিনাইন। রানার পিছনে ফিলিস্তিনি
তরুণ। সামনে একটা সিঁড়ি পড়ল। ধাপ বেয়ে উঠবার সময়
মেয়েটি বলল, ‘তোমাকে আমি কেল−ায় ঢুকবার সময়
দেখেছিÑআমার সঙ্গে কয়েকটা মেয়ে ছিল।’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। তারপর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে
জানতে চাইল, ‘কারা ওরা?’
‘পাড়ার মেয়ে,’ জবাব দিল সিক্সটিনাইন। ‘বোঝো তো
পাড়ার মেয়ে কাল্ডে বলে?’
মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে রানা শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর
দিল।
‘আমার নাম সুরাইয়া,’ বলল সিক্সটিনাইন। ‘নাম না জানলে
কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।’
‘আমি রানা।’
‘ভাবলাম, তুমি যখন কেল−ায় ঢুকবে তখন হয়তো ডাইভারশন
ক্রিয়েট করার ল্ডকার হবে, তাই মেয়েগুলোকে কেল−ার বাইরে
আসতে বলে দিই আমি।’
‘ধনল্টাদ,’ বলল রানা। ‘তোমাল্ডে মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে
সঙ্গে একদল শিকারি কুকুর পিছনে লেগেছে...’
‘ভুল হলো না?’ সুরাইয়ার কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ কৌতুকের সুর।
‘যেমন?’
‘তোমার আগে তুফায় পৌঁছেছে ওরা, কাজেই তুমি বলতে
পারো না যে...’
‘পারি,’ বাধা দিল রানা। ‘কেন না আগে পৌঁছেও আমার
চেয়ে পিছিয়ে আছে ওরা। যতক্ষণ না ধরতে পারে ততক্ষণ
পিছিয়ে থাকবে।’
‘ধরতে যাতে না পারে, সেজন্যেই তো আমাল্ডে
আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যামিউনিশন ডিপোর ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি
তোমাকে।’
‘আমাল্ডে মানে? হামাস, না হিযবুল−াহ?’ জানতে চাইল
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now