বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

মাসুদ রানা সিরিজ- কালো নকশা-০২

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X সঙ্গীদের দিকে ফিরল চেননি। ‘এখন তা হলে আমি কী বুঝব?’ রাগে হিসহিস করে উঠল সে। ‘পাওচেন বলেছিল মেয়েটার কাছে মাইক্রোফিল্ম থাকবে, সেটা নিয়ে দোআনচিতে আসবে সে মাসুদ রানার সঙ্গে দেখা করতে, ঠিক?’ ‘জী, ঠিক!’ ঘন ঘন মাথা নোয়াল তার সঙ্গীরা। ‘মাসুদ রানাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়া যাবেÑএই তথ্যই তো বিরাট দামী একটা পণ্য। সেই পণ্য মোটা টাকায় বেচলাম, তাকে খতম করার চুক্তি করেও ভালো কামালাম। কিন্তু মেয়েটা তো এলই না, তার সঙ্গে দেখা করতে রানাও আসেনি। কেন?’wapsip.com ‘পাওচেন আমাদেরকে ভুল তথ্য দিয়েছে, হুজুর,’ সঙ্গীদের একজন বলল। ‘তার মতলব মনে হয় ভালো ছিল না।’ হাত দুটো মুঠো পাকাল হুন চেননি। ‘পাওচেনের শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাদের লোককে বলছে, মেয়েটা ওখানে নেই, নেই মাইক্রোফিল্মটাও। এর মানে কী?’ ‘মেয়েটা তার দেওরকে বোকা বানিয়েছে, হুজুর,’ সঙ্গীদের অপরজন বলল। ‘এখানকার কথা বলে মাসুদ রানার সঙ্গে অন্য কোথাও দেখা করেছে সে।’ ‘পাওচেনকে মারতে গেল আমাদের লোক, দেখা গেল আগেই গুলি খেয়ে মরে ভূত হয়ে আছে সে। কার এত দয়া যে আমাদের কাজটা করে দিল?’ জবাব দেওয়ার আগে প্রতিবারই মাথা নুইয়ে সম্মান জানাচ্ছে কালো নকশা ৪৯ সঙ্গীরা। তারা মুখ খুলছে পালা করে। ‘আমাদের কাজ করে দেয়নি, নিজের স্বার্থ হাসিল করেছে। আমাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী, হুজুর।’ আরেকজন বলল, ‘একটু খোঁজ নিতে হবে ওই সময়টায় মিন ভাইরা কে কোথায় ছিল।’ ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে তাকাল হুন চেননি। ‘এই, ব্যাটা উজবুক। আমরা যতক্ষণ এখানে আছি, তুই কালা, ঠিক আছে?’ ‘জী, আপনি যা বলেন।’ ঘন ঘন মাথা নোয়াল রানা। মাতৃভাষায় বিড়বিড় করল, ‘কতক্ষণই বা আছিস!’ ‘কী বললি?’ হঠাৎ বাঘের মত গর্জে উঠল চেননি। ‘বিড়বিড় করে কী বলিস, অ্যাঁ?’ ভয় পাবার ভান করে দ্রুত মাথা নাড়ল রানা। ‘না, তেমন কিছু না। বলছিলাম, কেবল্ কার আসছে।’ ‘কতক্ষণ হলো গেছে?’ সুর একটু নরম করে জানতে চাইল চেননি। ‘আধ ঘণ্টার ওপর।’ ‘তা হলে আর বেশি দেরি নেই।’ সঙ্গীদের দিকে ফিরল চেননি, আগের প্রসঙ্গের রেশ টেনে বলল, ‘ঘাঁটিতে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো কোথায় আছে ওরা দু’ভাই।’ এতক্ষণে কেবল কারটাকে আসতে দেখছে রানা। পাঁচসাতে শা গজ পরপর একটা করে টাওয়ার আছে, ঝুলন্ত কেবলকে টান-টান করে রাখাই ওগুলোর আসল কাজ। এই মুহূর্তে পাঁচশো গজ দূরের সর্বশেষ টাওয়ারটা পার হচ্ছে কেবল্ কার। সোনালি রঙের একটা মোবাইল বেরিয়ে এল চেননির এক এক শিষ্যর হাতে। বোতাম টিপে সেটটা কানে তুলল সে। ৫০ মাসুদ রানা-৩৪৮ কন্ট্রোল প্যানেলের পিছনে এসে দাঁড়াল রানা। ভালো করে দেখে নিয়ে একটা বোতাম টিপল। কার-এর গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। বরাবরের মত খালি দেখা যাচ্ছে ওটাকে। চারদিকে কোথাও কোন মানুষজন নেই। দূরের বাকি দুটো স্টেশন এই মুহূর্তে খালি। সময়টা আদর্শ। পরিস্থিতি অনুকূল। ‘দোআনচি থেকে মুলাই বলছি,’ মোবাইল ফোনে কথা বলছে লোকটা। ‘মিস্টার চৌ মিনকে দে, কথা আছে...কী বললি?...দু’ ভাই সেই ভোর বেলা বেরিয়ে গেছে, তারপর আর ফেরেনি? শোন, হুজুরের সঙ্গে কথা বল...’ হাতের ফোন চেননির দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। সেটটা নিয়ে প-্যাটফর্মের মেঝেতে প্রচণ্ড এক আছাড় মারল চেননি। ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল সেটা। ‘সবকটাকে জবাই করব আজ আমি! কুত্তার বাচ্চাগুলো বিনা পাহারায় তাদেরকে ছাড়ল কীভাবে?’ ‘হ্যাঁ, জবাই করাই উচিত!’ একযোগে বলে উঠল সঙ্গীরা, তারপর বিগ ব্রাদারের পিছু নিয়ে উঠে পড়ল কেবল্ কারে। সঙ্গে সঙ্গে একটা লিভার টেনে রিভার্স গিয়ার দিল রানা। প্রকাণ্ড লোহার খাঁচা, অর্থাৎ কারটা হেলেদুলে আবার ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল। পঞ্চাশ গজ এগোল কার। এখনই নীচের পাথুরে জমিন থেকে চলি-শ ফুট উপরে ওটা। জমিন মানে প্রায় খাড়া একটা ঢাল। অপেক্ষায় থাকল রানা, কখন কারটা দুশো গজ দূরে পৌঁছাবে। বুড়ো শিশুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে রানা, কন্ট্রোল প্যানেলে এমন কিছু সুইচ আছে যেগুলো অন করলে এদিক থেকে কেবল-এর প্যাঁচ ঠিকই খুলবে, খুলবেও অসম্ভব দ্রুতবেগে, কিন্তু কালো নকশা ৫১ টাওয়ারের ওদিকে যাবে না, আটকে থাকবে। কেবল্ আটকে থাকলে কী ঘটবে তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। দুশো গজ দূরের কারটাকে এখন অনেক ছোট লাগছে। লোকগুলোর শুধু মাথা দেখতে পাচ্ছে রানা। কোন্টা কার মাথা স্পষ্ট করে বোঝাও যাচ্ছে না। জমিন থেকে এখন কারটা এখন কম করেও দেড়শো ফুট উপরে। দ্রুত কয়েকটা সুইচে চাপ দিল রানা। প্রথমে গতি হারিয়ে স্থির হয়ে গেল ঝুলন্ত কার। রানার পিছনে বিশ ফুট লম্বা ব্যারেল বিদ্যুৎবেগে ঘুরতে শুরু করেছে, প্রতি সেকেন্ডে বেরিয়ে যাচ্ছে পাঁচ ফুট করে কেবল্। কেবল্ বেরুচ্ছে, কিন্তু টাওয়ারের ওপারে যেতে পারছে না। তারপর দেখা গেল সরাসরি নীচে খসে পড়ছে ভারী কারটা। নির্জন পাহাড়ী এলাকা বলেই বোধহয়, অত দূর থেকেও লোকগুলোর আতঙ্কিত চিৎকার অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল রানা। প্রায় যেন চোখের পলকে ঘটে গেল ব্যাপারটা। নীচের পাথুরে জমিনে পড়ে একবার মাত্র একটু লাফিয়ে উঠল বিশ ফ্টুী কার, তারপর স্থির হয়ে গেল। হুন চেননি আর তার শিষ্যরা ছিটকে কারের বাইরে পড়েছে। প্রচণ্ড ঝাঁকিতে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার কথা। তিনটে কাপড়ের তৈরি নি®প্রাণ পুতুলের মত শুয়ে রয়েছে তারা, এতটুকু নড়াচড়া করছে না। আবার সুইচে চাপ দিতে টান পড়ল কেবল্-এ, কারটাকে উপরে তুলে আনছে রানা। ৫২ মাসুদ রানা-৩৪৮ দালিয়াকে নিয়ে তাইপিনবু থেকে ট্রেনে চড়ে নানকুতে ফিরছে রানা। ব্যাগে ওর নিজের কাপড়চোপড় ছিল, ছদ্মবেশ খুলে আবার সে-সব পরে নিয়েছে ও। ওদের কমপার্টমেন্টটা প্রায় খালিই বলা যায়, এই সুযোগে দালিয়াকে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ, এবার বলো, ব্যাপারটা আসলে কী নিয়ে?’ দ্রুত সবকিছু বদলে যাচ্ছে, ফলে যতই কষ্ট হোক আর কানড়বা পাক, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল বজায় রেখে নিজেকেও মানিয়ে নিতে হচ্ছে দালিয়ার। ভাই, স্বামী আর দেওরকে হারাবার পর তার আর আপনজন বলতে কেউ রইল না। তবে রানা তাকে সান্ত্বনা দেবার পাশাপাশি মনটাকেও শক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছে, বলেছে তা না হলে দেশের জন্য তুমি যে ঝুঁকি নিয়েছ আর ত্যাগ স্বীকার করেছ তার সবই বৃথা হয়ে যাবে। পাশের সিট থেকে রানার দিকে আরেকটু ঝুঁকল দালিয়া, তারপর শুরু করল। ব্যাপারটা বছর কয়েক আগে মার্কিন দূতাবাসে শুরু হয়। সংক্ষেপে এটা হলো, চিনকে ধ্বংস করার আমেরিকান ষড়যন্ত্র। তখনই একটু খটকা মত লেগেছিল দালিয়ার, কারণ ডাটা অ্যান্ড ইনফরমেশন সেকশনের হেড হওয়া সত্ত্বেও কমপিউটারের কিছু ফাইলে ঢুকতে পারছিল না সে অ্যাকসেস কোড জানা না থাকায়। প্রায় বছরখানেক চেষ্টা করার পর অ্যাকসেস কোড সংগ্রহ করতে পারলেও কোন লাভ হয়নি, কারণ ততদিনে গোপন সমস্ত ফাইল ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি দালিয়া চিনের শিরদাঁড়া ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, চিনারা যাতে কোনদিন সুপারপাওয়ার হবার স্বপড়ব দেখতে না পারে। কালো নকশা ৫৩ সিআইএ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড আর সিক্রেট সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রতি হপ্তায় গোপনে মিটিং করে প-্যানটা তৈরি করেছে, তাদেরকে সহায়তা করে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স। সেই প-্যান একটা কমপিউটার ফাইলে বন্দি করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওয়াশিংটনে, হোয়াইট হাউস আর পেন্টাগনের অনুমোদন পাবার জন্য। পেন্টাগনের সমর্থন পেতে সমস্যা হয়নি, কিন্তু নির্বাচনের বছর বলে হোয়াইট হাউস ব্যাপারটাকে বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল। তারপর অবশ্য, দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে, হোয়াইট হাউসের টপ বস সবুজ সংকেত দিয়েছেন। হোয়াইট হাউস থেকে বেইজিঙের মার্কিন দূতাবাসে ফাইলটা ফেরত পাঠাবার সময় যথারীতি সিকিউরিটি কোড ব্যবহার করা হয়েছিল। ফাইলটা দালিয়ার কমপিউটারেও চলে আসে। আর অ্যাকসেস কোড জানা থাকায় সেটা ওপেন করতে কোন সমস্যা হয়নি তার। কেউ কিছু জানতে পারার আগেই গোটা প-্যানটা পড়ে ফেলল দালিয়া। পড়ার সময়, কী পড়ছে বুঝতে পেরে, মাথাটা তার ঘুরতে শুরু করল। মার্কিনিদের চাকরি করে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে মাতৃভূমির এত বড় সর্বনাশ তো হতে দিতে পারে না। সিদ্ধান্ত নিল, প্রমাণ সহ সরকারকে ব্যাপারটা জানাবে। বুদ্ধি করে প-্যানটার প্রিন্ট আউট বের করল দালিয়া, তারপর এক সুযোগে ওই প্রিন্ট আউট থেকে তৈরি করল মাইক্রোফিল্ম। প্রিন্ট আউট বা সিডির চেয়ে মাইক্রোফিল্ম সরানো অনেক সহজ। মাইক্রোফিল্মটা দালিয়া কারও মনে এতটুকু সন্দেহ না জাগিয়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে সরাতে পারল ঠিকই, কিন্তু ৫৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ তারপরই দেখা দিল মহা সংকট। পরদিনই মার্কিন দূতাবাসের একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার একটা ঘরে একটানা দু’ঘণ্টা বসিয়ে রেখে জেরা করল দালিয়াকে। হোয়াইট হাউস থেকে আসা টপ সিক্রেট ফাইলটা সে দেখেছে কিনা? ওটা আটশো পাতার একটা ফাইল, প্রিন্টার মেশিনের ইন্ডিকেটর-এ দেখা যাচ্ছে ওই আটশো পাতাই প্রিন্ট করা হয়েছে, সেগুলো কোথায়? অজ্ঞতার অভিনয় করে কোন রকমে সেদিন দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে দালিয়া ভেবেছিল, এ যাত্রায় বোধহয় বেঁচে গেল। কিন্তু মার্কিনিদের চিনতে তখনও বাকি ছিল ওর। ফ্ল্যাটে ফেরার পথে একবার নয়, দু’বার মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয় তাকে। দু’বারই ভাগ্যগুণে রক্ষা পায় সে। সেদিনই নিজেদের ফ্ল্যাট ছেড়ে ভাইয়ের সদ্য কেনা ফ্ল্যাটে আত্মগোপন করল দালিয়া। ভাইয়ের এই নতুন ঠিকানা কেউ জানত না বলে কয়েকটা দিন কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু নিজেদের ঠিকানায় দালিয়ার স্বামী মার্কিন দূতাবাসের লোকজন আর বিগ ব্রাদারদের হুমকি শুনতে শুনতে অসুস্থ হয়ে পড়ল। এমনকী সরকারের লোকজন আসছে, গোপনে মোটা টাকা সাধছে তাকে। দালিয়া বা তার ভাইয়ের কোন ধারণা ছিল না মার্কিনিরা কোটি কোটি ডলার খরচ করে বেইজিঙে হাজার হাজার বেঈমান তৈরি করে রেখেছে। প্রথম ধাক্কাটা এল ওদের এক আত্মীয়র কাছ থেকে। লোকটাকে সৎ, নীতিবান আর দৃঢ়চেতা বলে চিনত ওরা; কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা সে, চাকরি করে চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিসে। তার কাছে বুদ্ধি চাইতে গেল ওরা, কালো নকশা ৫৫ মাইক্রোফিল্মটা কীভাবে সরকারের বিশ্বস্ত কোন কর্মকর্তার হাতে তুলে দেওয়া যায়। লোকটার হাবভাব ওদের মোটেও ভালো লাগল না। কথাটা শুনে উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না সে। ফিসফিস করে বলল, ‘আমিই তো সরকারের একজন বিশ্বস্ত অফিসার, জিনিসটা তোমরা আমার কাছে রেখে যাও, আমি খুব যতড়ব করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব।’ ‘ওটা তো সঙ্গে নেই, নিয়ে আসতে হবে,’ বলে পালিয়ে আসতে চাইল ওরা। ‘বেশ, এখনই গিয়ে নিয়ে আসবে। তবে আরেকটু বসো। চানা স্তা আসছে, খেয়ে যাও,’ বলে অন্দরমহলে চলে গেল লোকটা। পরে দালিয়া বুঝতে পারে, লোকটা হুন চেননিকে ফোন করতে গিয়েছিল। চা খেয়ে বাইরে বেরুল ওরা, সিদ্ধান্ত নিল, মাইক্রোফিল্মটা এই লোককে দেওয়া উচিত হবে না। তারা টেরও পেল না যে হুন চেননির লোকজন তাদের পিছু নিয়েছে। তখন সন্ধ্যা রাত। হামলা হলো গভীর রাতে। দলবল নিয়ে হুন চেননি নিজে নক করল দরজায়। পুলিশ বলে পরিচয় দেওয়ায় দালিয়ার ভাই দরজা খুলে দিল। হুন চেননি তাকে নিজের পরিচয় জানিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিল, এক লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ফাইলটা কিনতে চায় সে। জবাবে দালিয়ার ভাই বলল, ‘আমরা কারও হুমকির মুখে নতি স্বীকার করব না। যা পারো করে নিয়ো, আমরা ওটা বেচব না।’ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ওদের সব কথাই নিজের কামরা থেকে শুনতে পাচ্ছিল দালিয়া। গুলির আওয়াজ আর ভাইয়ের গোঙানি ৫৬ মাসুদ রানা-৩৪৮ শুনে শিউরে উঠল সে। হুন চেননির এক সঙ্গীকে বলতে শুনল, ‘এক গুলিতেই খতম করে দিয়েছেন, বস্।’ জবাবে হুন চেননি বলল, ‘এবার দরজা ভেঙে তোরা সবাই ধর্ষণ কর মেয়েটাকে। দেখি ফাইলটা না দেয় কী করে।’ এ-কথা শুনে জানালার গ্রিল খুলে পালায় দালিয়া। দোতলা থেকে পানির পাইপ বেয়ে নীচে নামে, তারপর একটা গলি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসে নানকুতে। ওখানে তার দেওর পাওচেনের শ্বশুরবাড়ি। পালাবার সময় শুধু মাইক্রোফিল্ম আর মোবাইল ফোনটা সঙ্গে নেয় সে। ‘ঠিক কী আছে ফাইলটায়?’ মূল প্রসঙ্গে ফিরে এল রানা। দালিয়া জানাল, আটশো পাতার বিশদ বিবরণ সহ জটিল একটা প-্যান, এককথায় বলা সম্ভব নয় কী আছে। প্রথম দু’বছর তিন হাজার গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ, স্থাপনা আর প্রতিষ্ঠানের সচিত্র প্রতিবেদন সংগ্রহ আর বিশে-ষণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে চারটে অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার, বত্রিশটা এয়ারপোর্ট, রকেট আর ফাইটার পে-ন সহ নয়টা সমরাস্ত্র তৈরির কারখানা, একশো বাহাত্তরটা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রজেক্ট, পাঁচটা সমুদ্রবন্দর, আশিটা গ্যাসফিল্ড, সাতাশটা তেলকূপ, একুশটা ক্যান্টনমেন্ট আলাদা একটা তালিকায় জায়গা পায়, সেটার শিরোনাম দেওয়া হয়: টপ প্রায়োরিটি-ওয়ান। এই তালিকার প্রতিটি জায়গায় একই দিন একই সময়ে ‘দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক পার্টি’ নামে নতুন একটা রাজনৈতিক দলের সদস্যরা হামলা চালাবে। বলা হবে, নতুন এই রাজনৈতিক দল গোপনে প্রচারণা চালিয়ে আর জনহিতকর নানা কাজ করে সাধারণ চিনাদের মন জয় করে কালো নকশা ৫৭ নিয়েছিল, তারাই একটা গণ-অভুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। এরপর টপ প্রায়োরিটি-টু। এটা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী কর্মকর্তা আর মন্ত্রী পরিষদের তালিকা। ওই একই দিনে তাঁদেরকে হত্যা করা হবে। পরবর্তী তালিকার শিরোনাম: ভিআইপি। এতে আছে ‘দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক পার্টি’-র প্রথম সারির নেতা আর পৃষ্ঠপোষকদের নাম। এরপর শুরু হয় এনজিও থেকে ঋণ আর চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের কাজ। স্বেচ্ছাসেবক মানে কমিউনিজম আর সরকার বিরোধী লোকজন, মৌলবাদী জঙ্গি, চোর-বদমাশ, ভবঘুরে, পাতি গুণ্ডা আর বিশ্বাসঘাতকদের দল। সিদ্ধান্ত হয়, গণ-অভুত্থানে নেতৃত্ব দেবে ত্রিশ হাজার মার্সেনারি, তাদের নির্দেশেই পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবক গোটা চিনে একযোগে স্যাবটাজ শুরু করবে। ট্রেন কমপার্টমেন্টের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রানা বলল, ‘তুমি আসলে ওদের একটা তাজা অ্যাটম বোমা চুরি করেছ। এখনও যে বেঁচে আছ সেটাই তো আশ্চর্য।’ ‘বেঁচে থেকে আর কী লাভ হলো, বলুন? আসল জিনিসটাই তো হারিয়ে ফেলেছি...’ ‘হারিয়ে ওটা যাবে কোথায়, দালিয়া?’ দৃঢ়কণ্ঠে আশ্বাস দিল রানা, চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব নেই। ‘আমি যখন ওটার পিছু নিয়েছি, তুমি নিশ্চিত থাকো ঠিকই খুঁজে বের করব। চিন আমাদের বন্ধু, কাজেই ষড়যন্ত্রের কথাটা সরকারকে জানানো আমাদের একটা দায়িত্ব।’ ৫৮ মাসুদ রানা-৩৪৮ ‘কিন্তু যদি পানও, আপনি ওটা কার হাতে তুলে দেবেন? কী করে বুঝবেন সেই লোক বেঈমান নয়?’ ‘তোমার আসলে ঘরপোড়া গরুর অবস্থা হয়েছে,’ হালকা সুরে বলল রানা, তারপর জানতে চাইল, ‘তুমি কী করে বুঝলে আমি বেঈমান নই?’ ‘ও, আচ্ছা, সরকারী পদে পরীক্ষিত বন্ধু আছে আপনার...’ ‘অপারেশনটা কবে শুরু হবে জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা। দালিয়ার কথায় ওর বন্ধু, চিনা সিক্রেট সার্ভিসের চিফ লিউ ফু চুঙএর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ‘কোন টাইমটেবিল আছে?’ ‘জী, মাসুদ ভাই, আছে,’ বলল দালিয়া। ‘নতুন বছরের প্রথম হপ্তায়।’ এক মুহূর্ত চিন্তা করল রানা। ‘তোমাকে আমি আপাতত বেইজিঙে, আমাদের একটা সেফহাউসে রাখব, যতদিন না বিপদটা কেটে যায়, ঠিক আছে?’ মাথা ঝাঁকাল দালিয়া। ‘সেই মঠে, ঊননব্বুই সালে যেটায় ছিলাম?’ ‘না, এটা আরেকটা। তবে বেইজিঙে ফেরার আগে তুমি আমাকে তোমার দেওর পাওচেনের কাছে নিয়ে যাচ্ছ।’ ‘আপনি না বললেন পাওচেন মারা গেছে?’ ‘তার লাশটাই দেখতে যাব আমি,’ বলল রানা। ‘বলা যায় না, ওখানে হয়তো কোন ক্লু পড়ে আছে।’ বাড়িটার সদর দরজা খোলা পেল ওরা। সামনের বসার ঘরে ফার্নিচার বলতে তেমন কিছু নেই, কালো নকশা ৫৯ পুরানো এক সেট সোফা আর একটা নিচু টেবিল। টেবিলের উপর চাবি সহ একটা তালা পড়ে আছে। বিপদ হতে পারে এটা পাওচেন জানত, সেজন্যই শ্বশুরবাড়ির সব লোকজনকে আগেই সরিয়ে দেয় সে। পাহাড়ের ঢালে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি, খেয়াল করার কেউ নেই কে গেল বা কে এল। লাশটা ভিতর দিকের একটা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। চিৎ করা লাশ, ছোরাটা এখনও বাম বুকে হাতল পর্যন্ত গাঁথা। বিছানার উপর একটা খোলা সুটকেস দেখল রানা, ভিতরের জিনিস-পত্র খাটে ছড়িয়ে রয়েছে। কামরাটা বেশি বড় নয়, ঘুরে ঘুরে দেখছে রানা। কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, কারণ হুন চেননির লোকজন ছাড়াও অনেকের পা পড়েছে এখানে। আধঘণ্টা পর হাল ছেড়ে দিল রানা। নাহ্, এখানে কোন ক্লু নেই, কিংবা থাকলেও ওর চোখে ধরা পড়ছে না। ওর জন্য পাশের ঘরে অপেক্ষা করছিল দালিয়া। তাকে নিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল রানা। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ও। এক সেকেন্ড কী যেন ভাবল, তারপর ঘুরে আবার বাড়িটার ভিতর ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেরিয়ে এল রানা, হাতে চাবি সহ সদর দরজার তালাটা রয়েছে। ‘তালা যখন রয়েছেই, বাড়িটাকে খালি ফেলে রেখে যাই কেন,’ বলে দরজা বন্ধ করে তালাটা খোলার জন্য কী হোলে চাবি ঢোকাল ও। কিন্তু তালার ভিতর চাবি ঢুকছে না। ভালো করে তাকাতে কী হোলের ভিতর সাদা মত কিছু দেখতে পেল রানা, যেন মনে হলো একটুকরো কাগজ গুঁজে রাখা হয়েছে। ‘তোমার কাছে চুলের কাঁটা ৬০ মাসুদ রানা-৩৪৮ বা পিন হবে নাকি?’ মাথা থেকে একটা ক্লিপ খুলে রানার হাতে ধরিয়ে দিল দালিয়া। সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তালার ভিতর থেকে জিনিসটা বের করল রানা। ছোট্ট একটুকরো কাগজই। তাতে কিছু লেখা রয়েছে। হাতের লেখাটা চিনতে পারল ও। চৌ মিন লিখেছেÑআপনাকে যদি সত্যি চিনে থাকি, জানি তালাটাকে ব্যবহার করার কথা একমাত্র আপনার মাথাতেই জাগবে। প্রসঙ্গত, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পাওচেনকে আমরা মারিনি। কোথায় দেখা হওয়ার কথা মনে আছে তো, বস্?’ চিনা সিক্রেট সার্ভিস। হেডকোয়ার্টার বেইজিং। নিজের চেম্বারে বন্দি বাঘের মত পায়চারি করছে চিফ লিউ ফু চুঙ। এ অদ্ভুত এক পেশাগত বিড়ম্বনা শুরু হয়েছেÑসব খবরই পাচ্ছে সে, তবে ঠিক সময়মত নয়। ফলে সমস্যার সমাধান বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমেরিকানরা চিনের সর্বনাশ করার জন্য প-্যান তৈরি করছে কয়েক বছর ধরে, অথচ সিক্রেট সাভির্স সে-সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। প-্যান সহ গোপন ফাইলটা মার্কিন দূতাবাস থেকে চুরি করেছে এক চিনা মেয়ে, চুরি করার পর সেটা সরকারের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত একজন লোক খুঁজছেÑ এই খবরটাও সময় মত পায়নি তারা। খবর যখন এল, কেউ বলতে পারে না মেয়েটা বা ফাইলটা কোথায় আছে। শুধু জানা গেল, ওটার খোঁজে পাঁচ বিগ ব্রাদার, আমেরিকান দূতাবাস, সিআইএ, ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো সহ অন্য আরও বহু দেশের কালো নকশা ৬১ স্পাইরা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। স্বভাবতই চিনা সিক্রেট সার্ভিসেরও মাঠে নামার কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তারা নামেনি। কেন? চোখে যখন অন্ধকার দেখছে ফু চুঙ, এই সময় খবর এল বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানাকে রাজধানীর কোন একটা হোটেলে দেখা গেছে। প্রিয় বন্ধুর উপস্থিতিতে আশার আলোর দেখতে পেল সে, জানে চিনা সিক্রেট সার্ভিস কী কারণে মাঠে নামতে পারছে না ব্যাখ্যা করে বললে সাহায্য করতে রাজি হবে রানা। কিন্তু এই খবরটাও অনেক দেরিতে পেয়েছে তারা। তবে শেষ পর্যন্ত রানা এজেন্সির বেইজিং শাখার প্রধান বুন লি-র মাধ্যমে রানার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। গুরুতর বিপদে পড়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে দেখা র্ক, দোস্তÑ এধরে নর একটা মেসেজও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে চলছে অপেক্ষার পালা। ফু চুঙ আশা করছে যে- কোন মুহূর্তে তার চেম্বারে পৌঁছে যাবে রানা। রানা এল আরও প্রায় একঘণ্টা পর। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর ফু চুঙ এভাবে শুরু করল, ‘আগে শোন্ বিপদটা কী...’ ট্রাফিক পুলিশের মত হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রানা বলল, ‘বিপদটা কী আমি জানি। কালো নকশাটা উদ্ধার করতে হবে, এই তো?’ ‘তুই তা হলে জানিস! কালো নকশা...হ্যাঁ,’ দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল ফু চুঙ। ‘সেজন্যেই বেইজিঙের কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না তোকে?’ ‘হ্যাঁ। তোদের এই বিপদটার সঙ্গে ব্যক্তিগত একটা কারণে ৬২ মাসুদ রানা-৩৪৮ জড়িয়ে পড়েছি আমি।’ ‘সেটা কী ব্যাখ্যা করা যায়?’ ‘যায়,’ বলে ওর বেইজিঙে আসার পর থেকে কী ঘটেছে সংক্ষেপে জানাল রানা। ‘তুই তো একাই দেখছি বিগ ব্রাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিস, দোস্ত!’ বলল ফু চুঙ। ‘ভালো কথা, তুই কি এ-ও জানিস যে ওই কালো নকশার খোঁজে মাঠে সবাই থাকলেও, আমরা নেই?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল রানা। ‘মানে?’ ‘আমরা উভয় সংকটে পড়ে গেছি, দোস্ত। প্রাইম মিনিস্টারের দফতর থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, আমেরিকা যদি চিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে থাকে সেটা কী জেনে নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করো সেটা বানচাল করতে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করা চলবে না।’ ‘এর মানে? কিছুই তো বুঝলাম না!’ ফু চুঙ তখন ব্যাখ্যা করল। মার্কিন দূতাবাস থেকে চিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের একটা ফাইল চুরি করেছে এক চিনা মেয়ে জিজিয়ানা দালিয়ান। ফলে, স্বভাবতই মার্কিনিরা ধরে নেবে চিন সরকারই এই কুকর্মটি করিয়েছেÑগোয়েন্দা লাগিয়ে। হই-চই বাধিয়ে দেবে ওরা, প্রচার শুরু করবে দুনিয়াময়: কূটনৈতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করছে চিন। গণচিন নিজের স্বার্থে বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে। তাই কর্তৃপক্ষ এমন কিছু করতে রাজি নন যাতে সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্য জানা দরকার আসলে গোপন কালো নকশা ৬৩ ফাইলটায় কী আছে। ‘আমরা নিজেরা জড়াব না, কারও সাহায্যে ওই ফাইলটা পেতে চেষ্টা করব,’ সবশেষে বলল ফু চুঙ। ‘চোখে অন্ধকার দেখছিলাম, কারণ সাহায্য চাওয়া যায় এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর হঠাৎ খবর পেলাম তুই বেইজিঙে। যাক, জানে পানি এল আমার। শুনছি মার্কেটে অনেক টাকার দান চলছে, ফাইলটা হাতে পেলে চিনও অনেক টাকা খরচ করতে রাজি আছে। দোস্ত, করবি তো সাহায্য?’ ‘দ্যাখ, ব্যাটা!’ রেগে গেল রানা। ‘মেরে ছাতু করে দেব বলে দিচ্ছি! কোলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের ডান্সফ্লোর থেকে তুলে এনে তুই যেবার আমাকে বাঁচিয়েছিলি, কত টাকা দিয়েছিলাম আমি তোকে তখন?’ ‘ভুল বুঝছিস, শালা!’ হাসল লিউ ফু চুং। ‘টাকাটা তোর জন্যে না। যদি ওটা কিনতে হয় কারও কাছ থেকেÑসেজন্যে বললাম। তোকে টাকা সাধব, কটা মাথা আমার ঘাড়ে?’ ‘ঠিক আছে, যা, মাফ করে দিলাম। আর সাহায্য করবার ব্যাপারে, তুই তো জানিস, অনুমতির একটা ব্যাপার আছে। আমাদের বুড়ো খোকার সায় পেলে দেখবি কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ি।’ স্বস্তির হাসি ফুটল ফু চুঙের মুখে। রানার হাতে চাপ দিল। বলল, ‘গোটা এসপিওনাজ জগতে এক আশ্চর্য কিংবদন্তি উনি। আর তোরাও যেমন পিতার মর্যাদা দিয়ে বুড়ো মানুষটাকে মাথায় তুলে রেখেছিস...ঈর্ষা হয়।’ একটু চুপ করে থেকে আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে এল ফু চুং, ‘শুনছি, জিনিসটা নিলামে উঠতে যাচ্ছে, অনেক টাকা ডাক উঠবে। সেক্ষেত্রে তোর প্রস্তুত থাকার দরকার আছে না?’ টান দিয়ে ডেস্কের একটা দেরাজ থেকে চেক বই বের ৬৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ করল ও। ‘একটা চেক রেখে দে, দোস্ত, সঙ্গে। সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট। যত বড় অঙ্কেরই চেক হোক, অনার করা হবে।’ ‘ব-্যাঙ্ক চেক?’ ‘হ্যাঁ, ডিফেন্স মিনিস্টারের সই করা।’ স্বতঃস্ফূর্ত একটুকরো হাসি ফুটল ফু চুঙের ঠোঁটে, তাতেই বোঝা গেল বন্ধুকে কতটা বিশ্বাস করে সে। চেকটা নিয়ে পকেটে ভরল রানা। ‘তবে একটা কথা,’ বলল ও। ‘তোদের মাঠে একদম না থাকাটাও কেমন যেন দেখায়। মার্কিনিরা ভাববে তোরা মেরুদণ্ড হারিয়ে ফেলেছিস। মনে সন্দেহও জাগবে। তারচেয়ে এক কাজ র্কÑঅন্তত কয়েকটা দিন থাক তোরা মাঠে, দিশেহারার মত ছোটাছুটি করে ঘুরপাক খা, ভাব দেখা: সূত্রের অভাবে এগোতে পারছিস না। ’ ‘গুড আইডিয়া।’ খুশি হয়ে রানার পরামর্শ মেনে নিল ফু চুঙ। কালো নকশা ৬৫ ছয় হংকং। ফাইভ স্টার চায়না আনলিমিটেড থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টন রোডে চলে এল রানা, তারপর বাঁক ঘুরে জমকালো শপিং এরিয়া নাথান রোডে ঢুকল। রানার কোন ধারণা নেই চিন থেকে মাইক্রোফিল্মটা নিয়ে মিন ভাইরা আদৌ হংকঙে ফিরতে পেরেছে কিনা। জানতে হলে চৌ মিনের দেওয়া পথ নির্দেশ ধরে হংকঙের কুখ্যাত একটা এলাকায় হাজিরা দিতে হবে ওকে। ঠিকানাটা হলোÑহাংরি গোস্ট, মানে ক্ষুধার্ত ভূত। একধারে বেশ্যা পাড়া, আরেক ধারে সারি সারি শুঁড়িখানা, মাঝখানে কয়েকটা টার্কিশ বাথ, তারই একটা হাংরি গোস্ট। সেখানেই এখন যাচ্ছে রানা। মাঝখানের তিনদিন ঢাকায় কাটিয়ে এসেছে ও। চিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আমেরিকা, সেটা বানচাল করার জন্য চিনা সিক্রেট সার্ভিস বিসিআই-এর সাহায্য চাইছে, কাজেই মেজর জেনারেল (অবসর প্রাপ্ত) রাহাত খানের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দরকার ছিল। সব কথা শোনার পর অনুমতি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ৬৬ মাসুদ রানা-৩৪৮ করেননি বিসিআই চিফ। টেমপল স্ট্রিটে পৌঁছাতে পনেরো মিনিট লাগল রানার। সম্ভবত কুখ্যাতি আছে বলেই হংকঙের এদিকটায় ট্যুরিস্টদের ভিড় নেই। ফুটপাথে পাহাড়ের মত স্লতূপ করে বিক্রি হচ্ছে মোবাইল ফোন, পাশেই খোলামেলা প্রচ্ছদ সহ পর্নো ম্যাগাজিন। আরেক পাশে বিশুদ্ধ আফিম বা হেরোইন-এর পুরিয়া। রাস্তাগুলো সরু, তাই মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে পথ চলা দায়। বাইশ নম্বর টেমপল স্ট্রিট বিধ্বস্ত একটা পোড়োবাড়ি যেন। সদর দরজায় ভিতর থেকে তালা মারা। কলিং বেল বাজিয়ে স্রোতের মত ধাবমান পথচারীদের উপর নজর রাখছে রানা। তবে ওর ব্যাপারে কাউকে তেমন আগ্রহী বা কৌতূহলী বলে মনে হলো না। দরজা খুলে গেল। গাউন আর স্কার্ট পরা চিনা তরুণী মাথা নুইয়ে অভ্যর্থনা জানাল ওকে। বেশ মিষ্টি চেহারা তার, তবে বুক বলে কিছু আছে কিনা সন্দেহ। টকটকে লাল নেইলপালিশে রাঙানো আঙুল তুলে রিসেপশন রুমটা দেখিয়ে দিল সে। কামরাটার দেয়াল কালো মখমল দিয়ে ঢাকা। সোফাসেটটা সোনালি। কয়েকটা ডিভানও ফেলা হয়েছে। সবগুলোতে এক বা একাধিক জাপানি পুতুলের মত চিনা সুন্দরীরা বসে আছে। ‘আমাদের মেয়েরা খুব পরিচ্ছনড়ব,’ বলল মেয়েটা। ‘আজ নয়,’ অমায়িক হেসে জবাব দিল রানা। ‘তবে ধন্যবাদ।’ ‘তা হলে আপনাকে বরং ম্যাসাজ পারলারে পাঠিয়ে দিই।’ ‘আবারও ধন্যবাদ, তবে আজ নয়।’ ‘তা হলে এদিকে,’ বলে একটা ধাতব দরজা খুলে পাশের ঘরে ঢুকল মেয়েটা, রানাও তার পিছু নিল। কালো নকশা ৬৭ এই ঘরের মেঝে সাদা আর কালো টাইল দিয়ে ঢাকা। কোথাও থেকে বাষ্প আর ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে। ‘অ্যাটেনড্যান্ট আপনাকে লকার কী দেবে, চার্জ একশো হংকং ডলার,’ বলে চলে গেল মেয়েটা। চৌ মিন জানিয়েছে, রানার সঙ্গে এখানকার স্টিম রুমে দেখা করবে সে। কাজেই একশো ডলার দিয়ে অ্যাটেনড্যান্টের কাছ থেকে তোয়ালে আর চাবি নিয়ে লকার খুঁজছে রানা। সেটা যেন অন্য এক গ্রহতে, প্যাসেজের গোলকধাঁধা পার হয়ে পৌঁছাতে হলো। সারি সারি ধাতব লকারগুলোয় মরচে ধরেছে। ওগুলোর সামনে কাঠের লম্বা বেঞ্চ। জ্যাকেট আর শোল্ডার-হোলস্টার খোলার সময় আশপাশে কাউকে দেখল না রানা। অন্তত আপাতত পিস্তলটাকে তালার ভিতর থাকতে হবে। কোমরে যখন শুধু তোয়ালে থাকে, আগেড়বয়াস্ত্র লুকিয়ে রাখা সত্যি খুব কঠিন। ছুরিটাও লকারে চলে গেল। সঙ্গে থাকল শুধু একটা ক্যাপসুল, উরুর ভিতর দিকে টেপ দিয়ে আটকানো। মাত্র আধ ইঞ্চি লম্বা হলে কী হবে, আগেড়বয়গিরির মত ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করতে পারে। বলাই বাহুল্য যে বিষাক্ত। লক্ষ্মী ক্রেতা হয়ে যাচ্ছে রানা, অর্থাৎ চৌ মিনের তরফ থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই বলেই ধারণা করছে ও। চাবি সহ ইলাস্টিক ব্যান্ডটা কবজিতে পেঁচিয়ে নিল রানা, তারপর স্টিম রুমের দিকে এগোল। কাঁচ আর ইস্পাতের তৈরি দরজাটা খুলতেই ঘুসির মত আঘাত করল গরম বাষ্প। শুধু গরম নয়, এত ঘন যে কোথায় পা ফেলছে দেখার উপায় নেই। নিজেকে চুলোয় চড়ানো তাওয়ার ৬৮ মাসুদ রানা-৩৪৮ উপর গরম তেলে ভেসে থাকা গলদা চিংড়ি মনে হলো রানার। ঢুকতে না ঢুকতে দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। কপাল থেকে নেমে ঘামের ধারা চোখে এসে পড়ছে। গরম সিমেন্টের মেঝের উপর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছে রানা, ভয় পাচ্ছে বেঞ্চ বা ভেজা লোকজনের সঙ্গে না ধাক্কা লেগে যায়। লোকজন কেউ থাকলে তো ধাক্কা লাগবে। সন্দেহ নেই, তারা সবাই ম্যাসাজ পারলারে গিয়ে ভিড় জমিয়েছে। তাতে বরং খুশি রানা। প্রাইভেসি পাওয়া যাবে। চৌ মিনের সঙ্গে আলাপ করার সময় তা দরকারও। এই সময় রানার মনে হলো, ও বোধহয় একটু আগে পৌঁছেছে। কারণ ঘন বাষ্পের ভিতর যতদূর দেখা যাচ্ছে সবগুলো বেঞ্চই খালি। ‘চৌ মিন?’ ডাকল ও। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। চারদিকটা ভালো করে দেখার জন্য কাঠের বেঞ্চে উঠে দাঁড়াল রানা। এতক্ষণে তাকে দেখতে পেল ও। কাছাকাছি ডান দিকের একটা বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হলো টার্কিশ বাথের গরম আর ঘন বাষ্পে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নাকি ঘুমাচ্ছে? প্রশড়বই ওঠে না, তাপমাত্রা যেখানে পারদকে ১২০-এর ঘরে তুলে দিচ্ছে সেখানে একজন মানুষ ঘুমায় কী করে? কে জানে, হতেও পারে। কাঁচা ঘুম ভাঙানো গুরুতর অন্যায়ের মধ্যে পড়ে, কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই। তার পাশে এসে দাঁড়াল রানা, টোকা দিল কাঁধে। তারপরই বাষ্পের ভিতর দিয়ে রানা দেখল, চৌ মিনের নগড়ব গলায় সরু একটা লাল দাগ। গলাকাটা লাশ আগেও অনেক দেখেছে ও, তবে এরকম নিখুঁতভাবে কাটা গলা খুব কমই কালো নকশা ৬৯ দেখেছে। চৌ মিনের কোমর থেকে টান দিয়ে তোয়ালেটা খুলে নিল রানা। কিন্তু শরীরের কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখেনি সে। তারপর দেখতে পেল জিনিসটা। লকার কী, হাতের ভাঁজে ইলাস্টিক দিয়ে আটকানো। আড়ষ্ট হাত লম্বা করে কবজি আর আঙুলের উপর দিয়ে টেনে এনে ইলাস্টিক ব্যান্ডটা খুলে নিল রানা। তাতে মাত্র একটা চাবি দেখে বিস্মিত হলো ও। ওর ব্যান্ডে চাবি রয়েছে দুটো। নিঃশব্দ পায়ে স্টিম রুম থেকে বেরিয়ে এল ও। চৌ মিনের লকার রানার লকারের কাছ থেকে বেশি দূরে নয়। তালা খুলতে ভিতরে কাপড়ের স্লতূপ দেখা গেল, বেশিরভাগই তথ্য সওদাগরের গলার মত কাটা। জানা কথা খুনিও রানার মত মাইক্রোফিল্মটা খুঁজেছে এখানে। চৌ মিনের স্পোর্টস জ্যাকেট আর ট্রাউজারের লাইনিং পর্যন্ত বে-ড দিয়ে কেটে সার্চ করেছে সে। তবে খুনি কিছু পেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে রানার। কারণ চৌ ওকে জানিয়েছিল, যথার্থ মূল্য না পাওয়া পর্যন্ত মাইক্রোফিল্মটা নিরাপদ একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখবে সে। টার্কিশ বাথের লকারকে সে নিরাপদ মনে করবে না। চৌ মিন মারা যাওয়ার কারণে রানার নৌকা এখন অকূল সাগরে পড়ল, বৈঠা ছাড়া। ওর এখন একমাত্র আশা, চৌ মিন যদি কোন ধরনের ক্লু রেখে গিয়ে থাকে। কাজেই, কিছু পাবে না জেনেও, কাপড়চোপড়গুলো অত্যন্ত সাবধানে আর যতেড়বর সঙ্গে সার্চ করল রানা। এমনকী জুতোর গোড়ালি পর্যন্ত খুলে ফেলল। কিন্তু না, গোড়ালির ভিতর ফাঁপা কোন জায়গা নেই যে কিছু লুকিয়ে রাখা যাবে। ৭০ মাসুদ রানা-৩৪৮ এক এক করে প্রায় সবই দেখা শেষ হয়ে এল। সব আবার লকারে ঠাঁই করে নিচ্ছে। কাজ শেষ, কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। সিধে হতে যাবে রানা, চোখের কোণে ধরা পড়ল সাদা এক টুকরো কাগজ। সম্ভবত চৌ মিনের জ্যাকেট থেকে খসে পড়েছেÑও বা খুনি জিনিস-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়। কাগজটা লকারের মেঝে আর পাশের ধাতব দেয়ালের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে। দু’আঙুলে ধরে সেটা টেনে নিল রানা, তারপর আলোর সামনে ধরল। এটা একটা টিকিটের অর্ধেক। কাগজটা শক্ত। হংকং ইউনিভার্সিটির মিউজিয়ামে ঢুকতে হলে এই টিকিট কিনতে হয়। টিকিটটা উল্টো করে আপন মনে হাসল রানা। কাগজের খালি অংশে চিনা ভাষায় কয়েকটা হরফ আঁকা রয়েছে। একটা নাম। তোউ ওয়ান। নামটা আগে কোথাও শুনেছে বলে মনে পড়ছে না রানার। তবে একেবারে কিছু না পাওয়ার চেয়ে ভালো আর কী। লকার বন্ধ করল রানা, তালা দিল, দরজার মাথার কাছে ধাতব জাফরির ভিতর চাবিটা ঢুকিয়ে ছেড়ে দিল। সরু ক্লজিটের ধাতব মেঝেতে টং করে পড়ল সেটা। বাইশ টেমপল স্ট্রিটে আর কোন কাজ নেই রানার। ঘুরল ও, নিজের লকারের দিকে এগোচ্ছে। ছোঁয়াটা পরিচিত। শিরদাঁড়ার নীচের দিকের একটা গাঁটে লাগল। ভয়ে কাঠ হয়ে গেল রানা। ‘মরার জন্যে খুব বাজে একটা জায়গা, তাই না?’ লোকটার ইংরেজি উচ্চারণই বলে দিচ্ছে সে জাত ইংরেজ। জবাব না দিয়ে রানা বলল, ‘গান ব্যারেলের যে আকৃতি অনুভব করছি, তোমার হাতে ওটা সম্ভবত স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, কালো নকশা ৭১ ৩৯ মডেল। অনুমান করি একা নও।’ লোকটার নিঃশ্বাসের সঙ্গে শে-ষাত্মক হাসির আওয়াজ শোনা গেল। ‘ওরেব্বাপরে, এ তো দেখা যাচ্ছে ওস্তাদ লোক!’ পিছন থেকে আরেকজন হেসে উঠল। রানার অনুমান মিথ্যে নয়। ‘সহকারী বা দু’নম্বর লোক নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যে একটু বেশি জোর খাটায়,’ বলে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। এখন আর তারা হাসছে না। ‘এতই যখন বোঝো,’ ইংরেজ লোকটা বলল, ‘তুমিও সহযোগিতা করার জন্য জোর চেষ্টা চালাও।’ ওর কাঁধে হাত দিয়ে ধাক্কা মারল সে, পিস্তলের মাজল পিঠে গেঁথে যাচ্ছে। সাবধান হয়ে গেল রানা। এই লোকের রিফ্লেক্স আর ব্যালেন্স অত্যন্ত ভালো। একটু চালাকি করতে দেখলেই ট্রিগার টেনে দেবে। টিকিটের অর্ধেকটা এখনও রানার দু’আঙুলের মাঝখানে। তবে বেশিক্ষণ থাকল না ওখানে, কারণ ধাক্কা খেয়ে লকার রুম থেকে বেরুবার সময় টাইলের মেঝেতে ফেলে দিয়েছে ওটা। লোক দুজনকে এখনও দেখেনি রানা। তাড়াহুড়ো না করে ঘাড় ফেরাতে শুরু করেছে, অস্ত্রধারী তার বাম হাত দিয়ে ধাঁ করে মেরে বসল। রানা অনুভব করল, তার আঙুলে পরা আঙটির লালচে-বেগুনি পাথরটা নির্দয়ভাবে গেঁথে গেল ওর বুকে। চুনির সংস্পর্শে আসার এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি ওর। ‘কিছু করার অনুমতি নেই তোমার, স্মার্ট ফেলো,’ শে-ষ মাখা কণ্ঠে বলল লোকটা। তার হাবভাব এত ঠাণ্ডা, গরম বাষ্পও যেন তাপ হারাচ্ছে। লোকটা স্যাডিস্টিক টাইপের, নিজেকে সাবধান ৭২ মাসুদ রানা-৩৪৮ করল রানা। ওর দৃষ্টিপথে আঙটিবিহীন আরেকটা হাত দেখা গেল, আঙুলগুলো বেঁটে। ইংরেজের সঙ্গী একটা দরজা খুলছে। সেটার গায়ে চৌকো একটা বোর্ড ঝুলছে, তাতে হাতে লেখা কয়েকটা নিরীহ দর্শন হরফ দেখল রানাÑঝঅটঘঅ। কিছু করার সুযোগ পাওয়া গেল না, কাঁধে ভারী হাতের ধাক্কা খেয়ে ভিতরে ঢুকল রানা, শিরদাঁড়ার উপর পিস্তলের মাজল মুহূর্তের জন্যও সরেনি। দরজাটা ওর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল। নির্দেশ এল, ঘোরো। এই প্রথম রানা সামনাসামনি দেখল কাদের হাতে বন্দী হয়েছে ও। ইংরেজ লোকটা এখন তার পিস্তল ওর বুকে তাক করে রেখেছে। কলোনি বানিয়ে দুনিয়ার মানুষকে শোষণ করার পুরানো ঐতিহ্য স্মরণে রেখেই যেন দাগবিহীন সাদা লিনেন-এর সুট পরেছে সে, গলা থেকে ঝুলছে পুরানো ধাঁচের একটা লাল টাই। দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়েছে সে, রানার দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টিতে গাম্ভীর্য আর জিদ। ভঙ্গিটাই বলে দেয়, এ লোক ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এজেন্ট না হয়েই যায় না। দ্বিতীয় লোকটা স্পষ্টতই আমেরিকান। পরিষ্কার সিআইএ। ব-ু সুট, সাদা টাই। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। বক্সিং রিঙে নামিয়ে দিলে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বে। ‘বসো,’ নির্দেশ দিল সাদা সুট। পিছু হটল রানা, যতক্ষণ না কাঠের পিচ্ছিল বেঞ্চের স্পর্শ পেল। নির্দেশ মেনে নিয়ে বসল ধীরে ধীরে। সনার শুকনো তাপও কালো নকশা ৭৩ দরদর করে ঘামাচ্ছে। তোয়ালেতে বার বার মুছে শুকনো রাখতে হচ্ছে হাত দুটোকে, জানে সময় হলে মুঠোর আঁকড়ে ধরার শক্তি পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। ‘তুমি সত্যি কথা বলবে, কেমন? কারণ কেউ মিথ্যে বললে আমাদের মেজাজ আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না। কোথাকার কে তুমি?’ ‘শ্রীলঙ্কান। আমার নাম কুমার সম্ভব।’ এটাই রানার কাভার। পাসপোর্টও তাই বলবে। ‘আমরা ধরে নিচ্ছি তুমি হাংরি গোস্টের রেগুলার কাস্টমার নও,’ বলল সাদা কোট। ‘এ-ও ধরে নিচ্ছি চৌ মিনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা তুমি মিস করেছ।’ ‘চৌ কে?’ ‘কৌতুক শুধু আমরা করব, মিস্টার সম্ভব। তুমি শুধু রিয়্যাক্ট করবে, ঠিক আছে?’ ‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো রানা। সিআইএ-র কানে ফিসফিস করল ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ। সাদা টাই, অর্থাৎ সিআইএ, জায়গা বদলে রানার বেঞ্চের পিছনে গিয়ে পজিশন নিল। ‘এখনই?’ উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল লোকটা। ‘তোমার সময় মত, দোস্ত,’ সাদা সুট জবাব দিল। রানা নিরীহ সাধারণ মানুষ সাজার অভিনয় করছে, হঠাৎ অচেনা একটা বিপদে পড়ে সিটকে আছে ভয়ে। কিন্তু সিআইএ-র গর্ব চুপচাপ লোকটা যখন হাড় ভাঙার মত ঝাঁকি দিয়ে ওর একটা হাত ধরে মোচড় দিল, আকস্মিক ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ও। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে চেষ্টা করল, দেখল পিস্তলটা এখনও ৭৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ বুকের ঠিক মাঝখানে তাক করা। বাচাল ইংরেজ হাসল। ‘গুলি করা হবে আরও অনেক পরে। তার আগে হাত-পা ভাঙা হবে। মানে যদি উল্টোপাল্টা কথা বলো। ঠিক আছে?’ মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘কানেকশনটা কী, তোমার সঙ্গে পরলোকগত মিস্টার চৌ মিনের?’ উত্তরে কিছু বলল না রানা, তার বদলে তীব্র ব্যথায় আবার চেঁচিয়ে উঠল। পিছন থেকে বক্সার লোকটা ওর হাতটা মুচড়ে শিরদাঁড়ার কাছে তুলে দিয়েছিল। ‘এটা হুশিয়ারি,’ সামনে থেকে বলল সাদা কোট। ‘তুমি যাতে আজেবাজে কথা বলে অযথা সময় নষ্ট না করো। কানেকশনটা কী?’ ‘চৌ মিন আমাকে একটা চালান বেচতে চেয়েছিল,’ কোন রকমে বলল রানা, ব্যথায় এখনও অন্ধকার দেখছে চোখে। ‘এই তো, কী সুন্দর মূল প্রসঙ্গে চলে আসছি আমরা। কীসের চালান, মিস্টার সম্ভব?’ ‘ডায়মন্ড। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মন্ড।’ ‘তুমি বোকামি করছ, মিস্টার সম্ভব,’ বলল সাদা কোট। ‘আরও খারাপ লাগছে এইজন্যে যে তুমি নিজের চেয়েও বড় বোকা মনে করছ আমাকে।’ রানাকে ছাড়িয়ে সঙ্গীর দিকে ছুটল তার দৃষ্টি। ‘এবার দুটো হাতই, দোস্ত।’ এক পা এগিয়ে এল সে, পিস্ত লটার ট্রিগারে আঙুল শক্ত করে পেঁচাল। হাত দুটো ধরে আবার ঝাঁকি দিল বক্সার। এবার জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা হলো রানার। প্রচণ্ড ব্যথায় কালো নকশা ৭৫ বমি পাচ্ছে। ‘এবার বসে বসে হাঁটো, মিস্টার সম্ভব। ঠিক একটা হাঁসের মত।’ সিআইএ-র সাদা টাই লাথি মেরে বেঞ্চ থেকে মেঝেতে ফেলে দিল রানাকে। হাত দুটো পিঠে সেঁটে থাকায়, ওর পক্ষে সিধে হওয়া সম্ভব নয়। ভাঁজ করা পায়ে, হাঁসের হেঁটে যাবার ভঙ্গিতে, সামনে এগোতে বাধ্য করা হচ্ছে ওকে। ধীরে ধীরে পিস্তলটার কালো মাজলের দিকে এগোচ্ছে ও। ওর এই আড়ষ্ট ভঙ্গি আর কষ্ট দারুণ উপভোগ করছে সাদা কোট। ‘তুমি বেশ লম্বা তো, পজিশনটা তাই খুব মানাচ্ছে।’ তারপর সাদা টাইকে বলল, ‘ওকে ওখান থেকে ওদিকটায় নিয়ে যাও।’ হাত তুলে শেষ প্রান্তের উত্তপ্ত কিউবিকলটা দেখাল। এক মুহূর্ত পর হঠাৎ রানার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, কারণ বুঝতে পেরেছে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওকে। সরাসরি ইলেকট্রনিক হিটিং গ্রিড-এর দিকে এগোচ্ছে ও, যেখান থেকে সনা-র তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একটা টোস্টারের ভিতরটা যেমন হয়, এটার মেকানিজম সেরকম দেখতে। এক ঝাঁক ধাতব কয়েল আগে থেকেই প্রচণ্ড উত্তাপে টকটকে লাল। ইস্পাতের অবলম্বন দিয়ে গ্রিডটা ঘেরা, বাকি সব কিছুর সঙ্গে এটাও গরম আগুন হয়ে আছে বলে মনে হলো। ‘কী, মিস্টার সম্ভব? সহযোগিতা পাব? নাকি তুমি চাইছ আমরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠি?’ জানতে চাইল বিআইবি, ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ। ৭৬ মাসুদ রানা-৩৪৮ ‘বললামই তো, চৌ আমার কাছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মন্ড বেচতে চেয়েছিল। ওগুলো সে তার লোকদের দিয়ে চুরি করায়...’ ‘এ-সবে কাজ হবে না, সম্ভব।’ মাথা নাড়ছে সাদা কোট। ‘না, একদমই কাজ হবে না।’ ঘেমে সারা হচ্ছে রানা। ইলেকট্রিক গ্রিড থেকে আর বোধহয় ফুটখানেক দূরে ও, তবে আঁচটা এখনই অনুভব করতে পারছে। ‘আরেকটু সামনে বাড়াও ওকে,’ সিআইএ-কে বলল বিআইও। পিঠে তোলা রানার হাতে আরেকটু চাপ দিল সিআইএ। আর ছয় ইঞ্চি দূরে ওটা। হিটিং ইকুইপমেন্টের লালচে আভা রানার ভুরু আর চোখের পাতা পুড়িয়ে দিচ্ছে। চুল পোড়ার কটু গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। ‘এখনও সময় আছে, মিস্টার সম্ভব। চৌ মিন সম্পর্কে কী জানো বলে ফেলো।’ হাসছে ইংরেজ। ‘দোস্ত, আরেকটু কাছে।’ আরেকটু কাছে? অসম্ভব, সেটা সহ্য করার মত হবে না! রানা সিদ্ধান্ত নিল, গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই পুড়ে মরার হাত থেকে বাঁচতে চেষ্টা করতে হবে ওকে। এই সময় বাধা পেল ওরা। হঠাৎ করে সনার দরজা খুলে গেল। সন্দেহ নেই আরেকজন খদ্দের উঁকি দিচ্ছে ভিতরে, ফ্যাসিলিটিটা ব্যবহার করতে চায়Ñতবে অবশ্যই প্রচলিত নিয়মে বা প্রাপ্য সুবিধে সহ। এই ডাইভারশানটাই দরকার ছিল রানার। সাদা কোট ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, তারপর দেখা গেল ভিতর থেকে তালা লাগাচ্ছে দরজায়। মনে মনে ‘রেডি, গো!’ বলে পিছন দিকে ডান পা চালাল রানা। সাদা টাইয়ের হাঁটুতে লাগল লাথিটা। হাড় হয়তো ভাঙেনি, তবে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে রানার হাত দুটো ছেড়ে কালো নকশা ৭৭ দিল সে। কাজের সময় দেখা গেল সাদা সুট পিস্তলটাকে ব্যবহার করতে রাজি, কিন্তু ট্রিগারটাকে নয়। পিস্তলটা উল্টো করে ধরে রানার দিকে তেড়ে এল সে। লাফ দিয়ে সিধে হলো রানা, এক পায়ে ভর দিয়ে খানিকটা ঘুরল, নড়াচড়ায় বিরতি না দিয়ে ফ্লাইং কিক মারল ইংরেজের পিস্ত ল ধরা হাতে। পিস্তল উড়ল। লাথিটা থামেনি, লোকটার ঠিক চিবুকে আঘাত করল। বিদ্যুৎ-বেগে পিছনদিকে ঝাঁকি খেল মাথাটা। মট করে গা রিরি করা একটা শব্দ শোনার আশায় ছিল রানা, তবে সেটা পূরণ হলো না। জড় কাটা গাছের মত সটান পড়ে গেল ইংরেজ। শুধুই জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন দিকে ওর পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল সিআইএ। দু’হাত দিয়ে গলাটা পেঁচিয়ে ধরল সে। নখ সহ আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে উইন্ডপাইপে। পিছন দিকে কনুই চালাল রানা। কিন্তু সিআইএ ছাড়ল না ওকে। তার দুই কড়ে আঙুল মুঠোয় ভরার সময় ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল রানা। লোকটার বাকি আঙুল ওর গলায় ডেবে যাচ্ছে, উইন্ডপাইপ ভেঙে ফেলবে। তবে সেটা ঘটার আগে তার আঙুল দুটো পিছনদিকে ঠেলে দিল রানা। কানে মধু ঢেলে হাড় দুটো ভাঙল, একটার পর একটা। কিন্তু গোঁয়ার লোকটা তারপরও থামছে না। তার ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা দেখে রানা অবাক। অকেজো দুই আঙুল ছাড়াই গলা টিপে রানাকে খুন করতে ৭৮ মাসুদ রানা-৩৪৮ চাইছে সাদা টাই। দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরুচ্ছে মুখ থেকে, আসলে সবটুকু শক্তি ব্যবহার করায় কোত পাড়ছে। রানাকে ধরে সামনে-পিছনে ঘন ঘন ঝাঁকাচ্ছে সে। পাশ থেকে পা চালিয়ে তার হাঁটুর ঠিক পিছনে লাথি মারল রানা। শরীরের নীচে পাটা ভাঁজ হয়ে গেল, সেই সঙ্গে ঢিল পড়ল রানার গলায়। প্রথমটার পিছু নিয়ে ছুটল আরেকটা লাথি, এটার লক্ষ্য দ্বিতীয় হাঁটুর পিছন দিক। এই মুহূর্তে টলছে লোকটা, অবশেষে রানাকে ছেড়ে দিয়ে জ্যাকেটের ভিতর হাত ঢোকাচ্ছে, বেগুনি পোকার মত ঝুলছে অকেজো আঙুল দুটো । ‘এই ব্যাটা, থাম!’ হুঙ্কার ছাড়ল রানা, বাঁ হাত দিয়ে মারার ভঙ্গি করে চালাল ডান হাতটা। এক ঘুসিতেই ছিটকে পড়ল বক্সার। তবে পিস্তলটা ছাড়েনি, বেরিয়ে আসছে পকেট থেকে। এগিয়ে এল রানা, লাথি চালাল পিস্তল ধরা হাতে। পিস্তলটা ছিটকে পড়ল দূরে। ভাঙা আঙুলে লাথি লাগায় চোখে অন্ধকার দেখছে লোকটা। এক পা পিছু হটল রানা, তারপর আবার লাথি মারলÑএবার লোকটার কপাল লক্ষ্য করে। লাথি খেয়ে লোকটা কোন শব্দ করছে না। আবার পা চালাতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল রানা। সঙ্গীর মতই জ্ঞান হারিয়েছে লোকটা। কালো নকশা ৭৯ সাত চৌ মিনের সম্ভাব্য হত্যাকারীর তালিকাটা এত বড় যে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ধৈর্য হলো না রানার। হংকং ভার্সিটির মিউজিয়ামে ঢোকার সেই টিকিটের টুকরোটাই একমাত্র সূত্র ওর, কাজেই টার্কিশ বাথ থেকে বেরিয়ে আসার পঁচিশ মিনিট পর বোট নিয়ে হারবার পেরুতে দেখা গেল ওকে, শহরের আরেক অংশে যাচ্ছে। জেটি থেকে ম্যান্ডারিন হোটেল হাঁটা পথে অল্প দূর, সেখান থেকে মিউজিয়ামের নিজস্ব বাস ছাড়ে। তিন ডলার দিয়ে টিকিট কেটে ওই বাসে চড়ে বনহ্যাম রোডে মিউজিয়ামের সামনে পৌঁঁছাল রানা। তোই ওয়ান। একটা মেয়ের নাম বলে মনে হচ্ছে। চৌ মিনের বোন? মা? প্রেমিকা, রক্ষিতা, স্ত্রী? রানার কোন ধারণা নেই। তবে আশা করল মিউজিয়ামটার সঙ্গে সংশি-ষ্ট কেউই হবে। দালানটা তিনতলা। দ্রুত একবার সার্ভে করে আগ্রহ জাগানোর মত কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রাচীন চিনা মৃৎশিল্প, চিনামাটির কাপ-পিরিচ আর ব্রোঞ্জমূর্তির বিপুল সমাবেশ রানার ৮০ মাসুদ রানা-৩৪৮ কৌতূহলকে উসকে দিতে পারল না। এখানকার সংগ্রহ খুব উনড়বতমানের নয়, সাজানোও হয়েছে শৃংখলার প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে। চৌ মিন এরকম একটা জায়গায় জিনিসটা লুকিয়ে রাখবে, বিশ্বাস করা যায় না। মিউজিয়ামের একজন অ্যাটেনড্যান্ট রানাকে একটা কেসের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখল, দুটো কনুইই কাঁচ ছুঁয়ে আছে, চোখ দুটো আধবোজা, মন উড়ে গেছে অ্যান্টিক সিরামিক থেকে বহু দূরে। কাঁধে একটা টোকা পড়তে বাস্তবে ফিরে এল রানা। সিধে হয়ে ধীরে ধীরে ঘুরল ও। চশমা পরা, পরিপাটি এক চিনা তরুণ সবিনয়ে হাসল, তার ইংরেজি স্পষ্ট এবং বিশুদ্ধ। ‘পি-জ, সার, কেসের ওপর ভর দেবেন না,’ বলল সে, প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার সুরে। ‘অত্যন্ত পুরানো, ভঙ্গুর।’ ‘দুঃখিত,’ বিড়বিড় করল রানা। ঘুরে আরেক দিকে চলে যাবে ছেলেটা, তার আগেই শুনিয়ে দিল প্রদর্শনীটা মুগ্ধ করেছে ওকে। ‘আপনার ভালো লেগেছে?’ ভারী খুশি দেখাল তরুণকে। ‘দারুণ, দারুণ,’ আবার বলল রানা। ‘ব্যবসার কাজে হংকঙে প্রায়ই আসা হয়, কিন্তু এখানে এই প্রথম এলাম।’ ‘সত্যি দুঃখজনক!’ বলল তরুণ। বলার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন নিজের মায়ের মৃত্যুসংবাদ দিচ্ছে। স্বভাবতই জিজ্ঞেস করতে হলো রানাকেÑকেন, দুঃখজনক কেন? ‘বিশেষ একটা প্রদর্শনী হয়ে গেল, আপনি সেটা মিস করেছেন।’ আগ্রহের আতিশয্যে বিরাট হয়ে উঠল রানার চোখ দুটো। কালো নকশা ৮১ ‘কই, শুনিনি তো!’ ‘ওটা ছিল ভারী শিক্ষণীয় আর প্রেরণাদায়ক,’ জানাল তরুণ। ‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, দু’দিন আগে প্রদর্শনীটা শেষ হয়ে গেছে। হ্যাঁ, পরশুদিন।’ ‘ঠিক কী ধরনের প্রদর্শনী ছিল ওটা?’ ‘অমূল্য সম্পদ,’ বলল তরুণ, উচ্ছ্বসিত। ‘টাকা দিয়ে ওগুলোর মূল্যমান নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। পাঠানো হয়েছে মেইনল্যান্ড, বেইজিংয়ের মিউজিয়াম অভ চাইনিজ হিস্টরি থেকে।’ ‘কপাল খারাপ, তা না হলে কি মিস করি,’ সখেদে বলল রানা, এখনও তরুণের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই সব আবার বেইজিঙের পথে রওনা হয়ে গেছে?’ সবেগে মাথা নাড়ল অ্যাটেনড্যান্ট, ফলে চশমাটা পিছলে নাকের ডগায় নেমে এল। সেটাকে ঠেলে উপরে তুলল সে। ‘না, বেইজিঙে নয়। ওগুলো মায়ানমারে যাচ্ছে। গেছেন ওখানে?’ মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘ইয়াঙ্গুনে গেছি।’ ‘আপনি সত্যি ভাগ্যবান, দুনিয়ার কত জায়গায় গেছেন। তো প্রদর্শনীটা এখন ইয়াঙ্গুনে চলছে, সাংস্লৃ‹তিক আর শুভেচ্ছা বিনিময় চুক্তির আওতায়...’ ‘দেখা যাচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনার প্রচুর আগ্রহ, খবর-টবর ভালোই রাখেন,’ বলল রানা। ‘আমি এক মহিলা সম্পর্কে জানতে চাই, আপনাদের এই লাইনেরই কেউ হবেন বোধহয়...’ ‘নামটা কী বলুন তো?’ ‘তোউ ওয়ান। বলতে পারেন কে সে, কীভাবে আমি তার ৮২ মাসুদ রানা-৩৪৮ সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?’ ‘তোউ ওয়ান?’ বিড়বিড় করল তরুণ, ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল এত জোরে চুলকাতে শুরু করল, যেন খুলির ঠিক নীচেই লুকিয়ে আছে উত্তরটা। ‘না, তাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না,’ বলল বটে, অথচ মৃদু শব্দে হাসছে। এর মধ্যে হাসির কী আছে বুঝতে পারছে না রানা। ‘আপনি চেনেন না, কিন্তু অন্য কেউ?’ জিজ্ঞেস করল ও। অ্যাটেনড্যান্ট মাথাটা একদিকে কাত করে নিঃশব্দে কয়েক সেকেন্ড দেখল রানাকে। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটল। ‘আপনি সিরিয়াস? আমার সঙ্গে কৌতুক করছেন না তো?’ ‘না,’ বলল রানা। ছোকরার প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেকে বোকা বোকা লাগছে ওর। ‘আমি সিরিয়াস। কেন আপনার মনে হলো আমি কৌতুক করছি?’ ‘মনে হলো, কারণ তোউ ওয়ান মারা গেছে,’ জবাব দিল তরুণ। ‘মারা গেছে? কবে মারা গেল?’ ‘সে তো দু’হাজার বছর বা তারও আগে, সার!’ বলল সে, তারপরই গলা ছেড়ে হেসে উঠল। জানা কথা, তোউ ওয়ানের সাধ্য নেই সাহায্য করে রানাকে। এক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই থেমে গেল মিউজিয়াম অ্যাটেনড্যান্টের হাসি, বোঝা গেল ভয় পাচ্ছে রানা না আবার তার আচরণে অপমান বোধ করে। ‘সার, পি-জ, কিছু মনে করবেন না,’ বলল সে। ‘কিন্তু আপনার প্রশড়বটা...যে শুনবে সেই হেসে খুন হবে। আসলে, সার, তোউ ওয়ান ছিল হান সাম্রাজ্যের রাজকুমারী। মারা কালো নকশা ৮৩ গেলে, দু’হাজার বছরেরও আগে, তোউ ওয়ানের মৃতদেহ আর্মার সুটে রাখা হয়...হ্যাঁ, জিনিসটাকে তাই বলা উচিত। ওটা জেড দিয়ে তৈরি। আপনি জেড পাথর সম্পর্কে জানেন?’ মাথা নাড়াল রানা। জানে না। ‘মনে করা হত জেড পাথরের ভেতরে রাখলে মানুষের শরীর অবিকৃত থাকেÑচিরকাল। আসলে তা সত্যি নয়, তবে এটাই বিশ্বাস করত তোউ ওয়ান আর তার রাজ পরিবার। কাজেই আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন আমরা কেউ তাকে চিনি কিনা, হাসি পেয়ে গেল, কারণ এতদিনে তার এমনকী ধুলো পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।’wapsip.com ‘তারমানে এই জেড...এক ধরনের কাফনÑ?’ ‘একটা সুট, মৃত্যুর পর পরানো হয়, হ্যাঁ,’ বলল অ্যাটেনড্যান্ট, মাথাটা ঘন ঘন উপর-নীচে ঝাঁকাচ্ছে। ‘জেডের তৈরি এই কাফন বা সুটটাও বেইজিং থেকে পাঠানো হয়েছিল প্রদর্শনের জন্যে?’ আবার উপর-নীচে মাথা ঝাঁকাল অ্যাটেনড্যান্ট। ‘সমস্ত কালেকশানের মধ্যে ওটাই সবচেয়ে মূল্যবান, সার,’ বলল সে। ‘নির্ভেজাল সোনার তারে জড়ানো আছে অসংখ্যা জেড পাথর। শোনা যায় ওটা তৈরি করতে দশ বছর সময় লেগেছিল...’ ট্যাক্সি নিয়ে ফেরিঘাটে ফেরার সময় রানা ভাবছে, ক্লু ধরে এগোতে হলে চাইনিজ আর্টিফ্যাক্ট অনুসরণ করে মায়ানমারে ঢুকতে হয় ওকে। একটাই নিরেট ক্লু আছে ওর কাছে, আর সেটা হলো তোউ ওয়ানের ওই সর্বশেষ পরিচ্ছদÑজেড সুটটা। কিছু পাক বা না ৮৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ পাক, দু’হাতে নিয়ে জিনিসটা ভালো করে পরীক্ষা না করা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর। তার আগে পর্যন্ত বোঝারও কোন উপায় নেই যে এটা ফলস্ ট্রেইল কিনা। সময় কম, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে রানাকে। কমন সেন্স সাবধান করে দিল, সিআইএ আর বিআইবি খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না। প্রথম কাজ মায়ানমার কনসুলেট থেকে একটা এন্ট্রি ভিসা সংগ্রহ করা। ট্যাক্সি ড্রাইভার জানে ঠিক কোথায় নামিয়ে দিতে হবে ওকেÑফেরির কাছাকাছি একটা চৌরাস্তায়। ভাগ্যগুণে কনসুলেট বন্ধ হবার ঠিক আগে পৌঁছাল রানা। ফর্মগুলো ঝটপট পূরণ করল ও। ‘আটচলি-শ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে,’ ইনফরমেশন ডেস্কের পিছনে বসা বার্মিজ মেয়েটা বলল ওকে। ঝলমলে হাসি দিয়ে ওকে জাদু করার চেষ্টা করল রানা। ‘কোনভাবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সারা যায় না?’ ‘আমাদের নিয়ম খুব কড়া,’ বলল তরুণী, গর্বের সুরে। ‘শিথিল করার উপায় নেই। আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিই, মায়ানমারে আপনি মাত্র এক হপ্তা থাকতে পারবেন। সাতদিন, কোনমতে তার বেশি নয়।’ ‘কেন, মেয়াদ কি বাড়ানো যাবে না?’ ‘মায়ানমারে আপনি যেতে চাইছেন কেন, সার?’ প্রশড়ব করল মেয়েটা, চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। ‘ওখানে লেখা আছে,’ ফর্মের দিকে আঙুল তাক করল রানা। ‘ট্যুরিজম,’ মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল। ‘একটা দেশ দেখার জন্যে সাতদিন যথেষ্ট সময়। একজন কালো নকশা ৮৫ বিদেশীকে তো আর সব জায়গায় যেতে দেয়া হয় না,’ রানার পাসপোর্টের সঙ্গে ফর্মটা ক্লিপ দিয়ে আটকাল সে, তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পরদিন সকালের কাগজে খবরটা দেখল রানা। মিন ভাইদের অভিহিত করা হয়েছে ‘টপ সিক্রেট ইনফরমেশন-এর চোরাকারবারী’ বলে। এই চোরাকারবারীদের মূল হেডকোয়ার্টার হংকঙের কাউলান-এ। কাল দুপুরের দিকে অজ্ঞাতপরিচয় একদল সন্ত্রাসী সেখানে ঢুকে প্রথমে ভাঙচুর চালায়, তারপর সাততলা ভবনটার নীচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন অবশ্য ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে পুলিশের বক্তব্য থেকে জানা গেছে তিনটে ফ্লোরের সমস্ত ফার্নিচার আর কাগজ-পত্র পুড়ে গেছে, মিন ভাইদের পাঁচজন স্টাফও অল্প-বিস্তর আহত হয়েছে, তবে ভাগ্যক্রমে মারা যায়নি কেউ। পুলিশ আরও জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য মিন ভাইদের খুঁজছে তারা। খবরটা কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। একই কাগজের শেষ পৃষ্ঠায় দেখা গেল মিনদের আরেকটা খবর। চৌ মিনের লাশের গলাকাটা ছবিটা যেন লাফ দিয়ে উঠে এল রানার চোখে। ছবির নীচে ছোট্ট খবর। হেডিংটা এরকমÑ চোরাই তথ্যের ব্যবসায়ী চৌ খুন! খবরে বলা হয়েছে, পাঁচজন বডিগার্ডকে সঙ্গে নিয়ে হাংরি গোস্ট নামে একটা টার্কিশ বাথে গিয়েছিল চৌ, গভীর রাতে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তার লাশ দেখতে পায়। তার পাঁচ বডিগার্ডের ৮৬ মাসুদ রানা-৩৪৮ একজনকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুটো খবরের কোনটাতেই থৌ মিন সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। রানা ওর হোটেল চায়না আনলিমিটেডে বসেই ইয়াঙ্গুন শেরাটন-এর একটা স্যুইট বুক করল। তবে পাসপোর্ট না থাকায় পে-নের টিকিট কাটা গেল না। হাতে একটা দিন সময় আছে, তাই রানা সিদ্ধান্ত নিল পার্ল নদীর মোহনা অর্থাৎ ম্যাকাও থেকে একবার বেড়িয়ে আসবে। দ্রুতগামী জলযান হাইড্রোফয়েল-এর একটা টিকিট কেটে রাখল। যত ভাবছে ততই মায়ানমারে যাবার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে রানা। অত দামী একটা জিনিস নিজের কাছে অবশ্যই রাখেনি চৌ মিন। তার হয়তো বেইজিং মিউজিয়ামের কারও সঙ্গে পরিচয় ছিল, কিছু টাকা দিয়ে কাজে লাগিয়েছে লোকটাকে। চিন থেকে মাইক্রোফিল্মটা বের করে আনার জন্য হান সাম্রাজ্যের আর্টিফ্যাক্ট প্রদর্শনীকে ব্যবহার করার চিন্তাটা সত্যি দারুণ। স্টার ফেরি পেরিয়ে হংকং লাইব্রেরিতে চলে এল রানা, তোউ ওয়ান সম্পর্কে আরও তথ্য দরকার ওর। ট্যাক্সিতে বা ফেরিতে থাকার সময় ভালো করে দেখে নিয়েছেÑকেউ ওর পিছু নেয়নি। তোউ ওয়ান-এর জেড কফিন-সুট প্রথম আবিষ্কার হয় মাঞ্চ’য়েং শহরে, উনিশশো আটষট্টি সালে। শহরটা বেইজিং থেকে বেশি দূরে নয়। মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় একাধিক চেম্বার সহ একটা সমাধি। আসলে পাওয়া গিয়েছিল দুটো বেরিয়াল স্যুইট, দ্বিতীয়টা ছিল লিউ শেঙ-এর। লিউ শেঙ ছিলেন তোউ ওয়ান-এর স্বামী, হান কালো নকশা ৮৭ সম্রাট উ-র সৎভাই। চিনা আর্কিওলজিস্ট আর আর্ট এক্সপার্টরা প্রাচীন কারিগরদের তৈরি দু’হাজার একশো ছাপানড়বটা জেড পাথর বসানো সোনার পাত নতুন করে সাজিয়ে দেন, কারণ তু ওয়ান-এর ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে কালের আঁচড়ে ভেঙে পড়েছিল ওগুলো। রানার ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা পেয়ে গেল ও, হাতের কাছেই পড়ে ছিল, তাতে প্রাচীন চিনা আর্টিফ্যাক্ট প্রদর্শনী সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট করা হয়েছে। শুধু তোউ ওয়ানের জেড সুট নয়, প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে সব মিলিয়ে তিনশো পঁচিশটা আর্টিফ্যাক্ট। এগুলোর সবই উনিশশো নব্বুইয়ের আগে খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে সুটটার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী হতে দেখা গেল রানাকে। কিছু আর্ট ট্রেজার-এর রঙিন ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রিকাটিতে। তার মধ্যে জেডের তৈরি কফিন-সুটটাও আছে। জিনিসটা দেখতে হুবহু যেন একটা মানুষের শরীর, দেখামাত্র চেনা যায় কাঠামোটাÑহাত-পা থেকে শুরু করে নাক-কান পর্যন্ত সবই আছে, এমনকী শক্ত করা মুঠোও। গিল্ড করা ব্রোঞ্জের হেডরেস্ট তোউ ওয়ানের শেষ শয্যায় বালিশ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। তার প্রতিটি হাতের সামনে শোভা পাচ্ছে জেডের তৈরি অর্ধচন্দ্র। পাশে নীলচে-সবুজ জেড ডিস্কÑ একজোড়া ডান পাশে, আরেক জোড়া বাঁ পাশে। ওগুলোকে পাইচও বলে, স্বর্গের প্রতীক। মর্ত্যলোকে প্রশ্রয় আর সম্মান পেয়েছে সে, কাজেই সন্দেহ কী স্বর্গেও রাজকীয় অভ্যর্থনা পাবে; এ-ও নিশ্চিত যে এই বেরিয়াল সুট তার ইহজাগতিক মরদেহটাকে চিরকাল সংরক্ষণ করবে। ৮৮ মাসুদ রানা-৩৪৮ তবে সমাধিটা প্রথম যখন খোলা হয়, তার জাগতিক উপস্থিতি বলতে অবশিষ্ট ছিল এক মুঠো ধুলো মাত্র, তারচেয়ে কম বা বেশি কিছু নয়। পত্রিকাটা রেখে দিল রানা। আরেকটা দিন পার হলো। পরদিন সকালে হাইড্রোফয়েলে চড়ে চলি-শ মাইল পাড়ি দিচ্ছে রানা, সময় লাগবে ঘণ্টা দেড়েকের কিছু বেশি। হংকঙের পশ্চিমে ম্যাকাও মাথাচাড়া দিয়ে আছে পার্ল নদীর মুখে। ভারী সুন্দর আবহাওয়া। সাগর যেন গাঢ় নীল কাঁচ। আপার ডেকের একটা সিটে বসেছে রানা, অপেক্ষা করছে হাইড্রোফয়েল কখন হারবার ছাড়বে। হাইড্রোফয়েল তখনও ছাড়েনি, হঠাৎ ওর পাশের খালি সিটটা রূপ-লাবণ্যের বিপুল সম্পদে ভরাট হয়ে গেল। বয়স হবে পঁচিশ কি ছাব্বিশ; পিঠে জোড়া কালকেউটের মত বেণী, নিচু হিল লাগানো জুতো, পরনে কাশ্মীরী সালোয়ার- কামিজ। হাত দুটো কোলের উপর, ব্যাগটা এখনও কাঁধ থেকে ঝুলছে। নেইলপালিশ না লাগানো নখ ছোট করে কাটা, যেন খুব কাজের মেয়ে, সব সময় ব্যস্ত। যতই সাধারণ থাকার চেষ্টা করুক, সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে তার দেহসৌষ্ঠব আর তুলনারহিত রূপ। এই মেয়ে পাশে বসলে যে-কোন পুরুষ নেশাগ্রস্ত হবে। রানা ভাবল, মেয়েটা জানে, তা সত্ত্বেও ওকে কথাটা বলা উচিত যে তুমি সুন্দরী, তা না হলে যেন এই সৌন্দর্যকে যথাযোগ্য সম্মান জানানো হয় না। বলল রানা; বলল ষোলো আনা ভব্যতা বজায় রেখে, কালো নকশা ৮৯ সংক্ষেপে, যতটুকু পারা যায় মার্জিত বিনয়ের সঙ্গে। আরেকদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল মেয়েটি, ‘ধন্যবাদ।’ ঠোঁট জোড়া নিশ্চয় লজ্জাতেই একবার কেঁপে উঠল। দেখে মনে হলো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সে নিজেইÑতার দ্বিতীয় সত্তা নিজেকে প্রকাশ করতে আকুল, লুকাতে নয়। ‘হংকঙে এবারই প্রথম?’ জিজ্ঞেস করল রানা। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে ছোট আকৃতির একটা বিনকিউলার বের করল। ‘হ্যাঁ।’ আবশেষে ডক থেকে রওনা হলো ওরা। সিটে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলল রানা, তারপর চোখে বিনকিউলার। হাটড্রোফয়েলকে অন্য কোন জলযান অনুসরণ করছে না, নিশ্চিত হয়ে বিনকিউলারটা নামাল। বেশ কিছু প্যাসেঞ্জারকে হাইড্রোফয়েলে চড়তে দেখেছে রানা, তাদের মধ্যে সিআইএ বা বিআইবি-র সেই লোক দু’জন নেই। তবে ওর আগে পৌঁছে কোথাও যদি গা ঢাকা দিয়ে থাকে, সেটা আলাদা কথা। ‘আমি বোধহয় নিজের পরিচয় দিইনি। শ্রীলঙ্কান, কুমার সম্ভব।’ হাতটা বাড়াল রানা। দ্বিধায় ভুগল মেয়েটা, তবে মাত্র দু’সেকেন্ডের জন্য। তারপর নিজের হাতটা ধরতে দিল রানাকে। তার আঙুল নরম, উষ্ণ, তালু সামান্য ভেজা ভেজা। ‘নন্দিনী অপরূপা,’ বলল সে; একটু যেন লালচে হলো মুখ, ধরা যায় কি যায় না। ‘নন্দিনী?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘অপরূপা?’ মাথা ঝাঁকাল সে। ৯০ মাসুদ রানা-৩৪৮ ‘মানুষটার মত, নামটাও সুন্দর।’ কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলল রানা, ‘ধন্যবাদ।’ ‘ধন্য...কেন?’ কৌতূহলী হলো মেয়েটা, তবে তারচেয়ে বেশি বোধহয় বিস্মিত। ‘কোন কারণ নেই, আবার কারণের কোন অভাবও নেই। আপনি আমার যুগে জন্মেছেন, শুধু এ-কারণেও ধন্যবাদ পেতে পারেন।’ ‘সেটা কী অপাত্রে দান হয়ে যাবে না? আপনার ধন্যবাদ যাঁদের পাওনা তাঁরা তো কোলকাতায়।’ ‘ওখান থেকেই আসছেন আপনি? ভারতীয়?’ এবার ভাঙা ভাঙা বাংলায় প্রশড়ব করল রানা। ‘হ্যাঁ। এদিকটা এত...এত...’ হাতটা অসহায় ভঙ্গিতে তার সামনে ঢেউ তৈরি করছে। ‘অন্যরকম?’ ‘শুধু অন্যরকম নয়। ইগজটিক। এত সুন্দর, অথচ আগে আসা হয়নিÑআমার গবেষণার সাবজেক্ট প্রচুর থাকা সত্ত্বেও।’ একদিকে একটু কাত হয়ে বসল নন্দিনী, নিজেকে আরেকটু আরাম দেওয়ার ইচ্ছে। সন্দেহ নেই, দাঁড়ালে এই মেয়ে পাঁচফুট ছয় ইঞ্চির কম হবে না। অপলক দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করছে রানা, বোঝার চেষ্টা করছে কালো দীঘল চোখের পিছনে কী আছে। নিরীহ শব্দটাই বারবার ফিরে এল রানার মাথায়, আর কোন শব্দ সুযোগই পাচ্ছে না। ‘আপনি বোধহয় সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী বা গবেষক?’ জিজ্ঞেস করল রানা। হেসে উঠল নন্দিনী অপরূপা। ‘না! আমি আর্কিওলজির ছাত্রী।’ কালো নকশা ৯১ হঠাৎ রানার দিকে একটু ঝুঁকল। ‘ভালো কথা, সিংহলী হয়ে বাংলা শিখলেন কেত্থেকে?’ ‘কিছু দিন কোলকাতায় ছিলাম,’ বলল রানা। ‘আর্কিওলজি... সিরিয়াস সাবজেক্ট, ভাই। হেনরিক শি-ম্যানের শিষ্যা, কেমন?’ ভদ্রলোক জার্মান আর্কিওলজিস্ট ছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হোমারের লেখা মহাকাব্য ইলিয়াডে যে ট্রয় নগরীর কথা বলা হয়েছে সেটা তিনি আবিষ্কার করে ছাড়বেন। তুরস্কে একে একে নয়টা প্রাচীন নগরী খুঁজে পান তিনি, তার মধ্যে একটাকে তিনি ট্রয় বলে দাবী করেন। পরে প্রমাণ হয়, ওটা ট্রয় নগরী নয়, তারচেয়েও এক হাজার বছরের পুরানো একটা শহর। নন্দিনী অন্যমনস্ক হয়ে দূরে তাকিয়ে আছে, রানার প্রশড়ব যেন শুনতে পায়নি। ‘হারিয়ে গেলেন নাকি?’ কৌতুক করল রানা। যেন হঠাৎ স্বস্তি পেয়ে হালকা বোধ করছে নন্দিনী, বলল, ‘আমি আসলে পেগান-এ যাবার পথে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি, মোন ধ্বংসাবশেষকে নিয়ে ফিল্ড রিসার্চ করব। খুবই নাকি ইন্টারেস্টিং সাইট। শুনেছেন নাকি, মিস্টার...?’ ‘সম্ভব,’ নামটা মনে করিয়ে দিল রানা। ‘হ্যাঁ, শুনেছি। সেন্ট্রাল মায়ানমারে, তাই না?’ ‘হ্যাঁ। খুবই ছোট একটা জায়গা, কিন্তু প্রতড়ব-নিদর্শনে ঠাসা। পাঁচ হাজার মনুমেন্ট, সমাধি ইত্যিাদি। ওখানে আমার কাজ আমাকে ডক্টরেট পেতে সাহায্য করবে।’ ঠিক যেমন সন্দেহ করছে রানা, মোটেও সাধারণ একটা ট্যুরিস্ট মেয়ে নয় সে। একে ডানাকাটা পরী, তার উপর ৯২ মাসুদ রানা-৩৪৮ উচ্চশিক্ষিতা, তারও উপর বঙ্গললনাÑকাজেই সহজে তাকে হারাতে রাজি নয় ও। তবে ও-ও যে মায়ানমারেই যাবে, কথাটা তাকে জানাল না। কিছু ব্যাপার প্রকাশ না করাই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, বিশেষ করে এসপিওনাজে। ‘মায়ানমার,’ বলল রানা, মাথাটা নাড়ছে যেন তাজ্জব হয়ে পড়ায়। ‘সে তো বহুদূর, রে, ভাই। কতদিন থাকবেন ওখানে?’ ‘পাঁচ হপ্তা,’ বলল নন্দিনী। তারপর সে ব্যাখ্যা করলÑ মায়ানমার সরকার বিশেষ ভিসা ইস্যু করেছে তাকে, যেহেতু স্থানীয় আর্কিওলজিস্টদের সঙ্গে কাজ করবে সে। ‘সব কিছু ঠিকঠাক মত গুছিয়ে আনতে প্রায় এক বছর সময় লেগেছে আমার। ক্যানডিডেট ছিল সাতজন, তাদেরকে আমার পিছনে ফেলতে হয়েছে, তারপর পারমিশন যোগাড় করাÑউফ্। এখন যখন ব্যাপারটা ঘটতে চলেছে, মনে হচ্ছে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি,’ হঠাৎ আবেগের রাশ টেনে ধরে নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল মেয়েটা। ‘জানি না অনুভূতিটা ঠিক এক্সপ্রেস করতে পারলাম কিনা।’ ‘এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়,’ বলল রানা। ‘বেড়াতে বেরুলে আশ্চর্য সব অনুভূতি হয় মানুষের।’ পরিচ্ছদের মত নিজের শরীরে লেগে থাকা শুকনো ক্ষতগুলোর কথা ভাবল রানা, যেন ব্যাগেজ হিসাবে দুনিয়ার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছে। ‘তবে আমি জানি সময়টা আপনার ভালোই কাটবে।’ ‘আশা করি।’ সামনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করল নন্দিনী। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে, রানাসুলভ জাদু কালো নকশা ৯৩ দেখিয়ে মেয়েটাকে দ্রুত পটিয়ে ফেলার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে তার মানে এই নয় যে হাল ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে ও। নন্দিনীর লাজুক ভাব ওর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ, আর যতই তাকে দেখছে ততই তার রক্ষণশীলতার মুখোশ ভেঙে আসল নন্দিনীকে বের করে আনার জিদটা প্রবল হয়ে উঠছে ওর ভিতরে। কারণ মায়ের শেখানো আচরণবিধি মেনে চলা নন্দিনীকে দিয়ে ওর কাজ হবে না। তাকে হাসাতে চেষ্টা করে সফল হলো রানা যাত্রার একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছে। তবে ব্যক্তিগত গাইড হবার প্রস্তাবটা যখন মেনে নিল নন্দিনী, রানার মনে হলো সবচেয়ে বড় বাধাটা পার হওয়া গেছে। হাইড্রোফয়েল থেকে হাত ধরে তাকে দ্বীপটায় নামাল রানা, হাতছানি দিয়ে একটা রিকশা ডেকে বসতে সাহায্য করল। রানার আচরণ দেখে মনে হতে পারে, নন্দিনী যেন ভারতের কোন রাজকুমারী, আর ও নিজে দ্বীপটার মালিকÑব্যক্তিগত আগ্রহ থাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে আসা অতিথিকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। নন্দিনীকে নিয়ে কৃত্রিম গুহায় ঢুকল রানা, ম্যাকাওয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক সেন্ট পল-এর ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য লাইনে দাঁড়াল, তারপর লম্বায় এশিয়ার আট নম্বরে থাকা টাওয়ারটায় উঠে পঞ্চানড়ব মাইল পর্যন্ত চোখ বুলাল, দুপুরে লাঞ্চ খেলো চায়না আনলিমিটেড-এর ম্যাকাও শাখার রেস্তোরাঁয়, তারপর একটা ক্যাসিনোয় ঢুকে পাঁচশো ডলার দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করল দু’জনের। এত কিছুর পর এখন রানা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। একটু একটু করে বদলানো গেছে মেয়েটাকে। নন্দিনীর লাজুক, ৯৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ আড়ষ্ট ভাব অনেকটাই কেটে গেছে। এমনকী চোখে চোখ রেখে মাঝে মধ্যে হাসছেও সে। ‘সত্যি,’ ক্যাসিনো থেকে হাজার ডলার জিতে বেরিয়ে আসার পর বলল নন্দিনী, ‘দিনটা আমার জীবনে মজার একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। এত আনন্দ কখনও পাইনি, মিস্টার কুমার।’ ‘একটু আগে মিস্টার বলোনি,’ মনে করিয়ে দিয়ে হেসে উঠল রানা। ওর সঙ্গে নন্দিনীও। ম্যাকাওয়ের অভিজাত এলাকার ফুটপাত ধরে পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে ওরা, রাস্তা দিয়ে টুং-টাং বেল বাজিয়ে রিকশা চলছে। ‘তোমার মজার অভিজ্ঞতা এখনও শেষ বা পুরো হয়নি,’ নন্দিনীকে বলল রানা। ‘আজ রাতে কেউ যদি তোমাকে ডিনার খাওয়াতে চায়?’ ‘শুধু ডিনার, আর কিছু নয় তো?’ জিজ্ঞেস করল সুন্দরী অপরূপা, কুমারীসুলভ ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর। ‘ঈশ্বরের দিব্যি,’ কথা দিল রানা, এমনকী চোখ তুলে আকাশের দিকেও তাকাল একবার। কামড়ানো ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি নিয়ে মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। ‘ঠিক আছে, তবে একটা শর্তেÑতুমি রাবণ হতে চেষ্টা করবে না।’ ‘প্রশড়বই ওঠে না, যেহেতু তুমি সীতা নও,’ বলে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল রানা, নন্দিনীকে একটু কাছে টানল। যতটা টানল, তারচেয়ে বেশি কাছে সরে এল নন্দিনী। সাধারণত প্রায় সব মেয়ের ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে দেখা যায়। মন থেকে সায় থাকলে ঢলে পড়ার একটা প্রবণতা চলে আসে। কালো নকশা ৯৫ রানাকে ধরে প্রায় ঝুলে পড়তে যাচ্ছে নন্দিনী। বুঝতে পেরে না ঘাবড়ালেও, সতর্ক হয়ে গেল ও। চোখ তুলে তাকাল সে, দৃষ্টিতে দেরি করছে বলে অভিমান, ঠোঁট জোড়া আরেকটু ফাঁক হয়ে গেল। এই অবস্থায় একটা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করাটা মাসুদ রানার অভিধানে রীতিমত অপরাধ। কাজেই চুমোটা খেতে হলো। ‘না, এখানে নয়,’ নন্দিনী যেন গোঙাচ্ছে, একই সঙ্গে উত্তেজনায় অবশ, আবার নিজের আচরণে বিব্রত। তারপর দেখা গেল রানার কাঁধে মাথা রেখে শান্ত পায়ে অপেক্ষারত হাইড্রোফয়েলের দিকে হাঁটছে মেয়েটা। ডকে গিজ গিজ করছে ট্যুরিস্ট আর স্থানীয় চিনা, তবে রিটার্ন টিকিট থাকায় নিজেদের সিট ফিরে পেতে ওদের কোন অসুবিধে হলো না। দক্ষিণ চিন সাগর চঞ্চল হয়ে উঠেছে, প্রতিটি ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা দেখা গেল; পানির রঙ এখন মরচে ধরা লোহার মত। হারবার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল হাইড্রোফয়েল। রানার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল নন্দিনী। ‘আনন্দ-উত্তেজনা একটু বেশি হয়ে গেছে,’ তার কানে ফিসফিস করল রানা। ‘রক্ষণশীল ভারত থেকে মেয়েটাকে বের করে আনা যায়, কিন্তু মেয়েটার ভেতর থেকে ভারতকে বের করা সম্ভব নয়।’ কোন মতামতই দিল না নন্দিনী, এরইমধ্যে আধো ঘুমে চলে গেছে। সব মিলিয়ে, এর বেশি আর কিছু চাইতে পারে না রানা। সারাদিনের চেষ্টায় পাগল করা এক সুন্দরী নারীর জড়তা ভেঙে দিয়েছে। তাকে নিয়ে এখন বহু রঙা গোপন স্বপড়ব দেখতে আর কোন বাধা নেই। ৯৬ মাসুদ রানা-৩৪৮ সন্ধ্যা, এবং তারপর রাতটা, কীভাবে কাটাবে ভাবছে রানা। এই সময় কিছু একটাÑআসলে কেউ একজনÑপ্রথমে ওর দৃষ্টিপথে, তারপর ওর চিন্তায় ঢুকে পড়ল। প্রথমে অস্বস্তিকর একটা সচল ছায়া, তারপর সেটাকে নিয়ে অশুভ একটা আশঙ্কা। ঝট করে তাকাবার ইচ্ছেটাকে দমন করল রানা। চোখের কোণ দিয়ে একজন প্যাসেঞ্জারকে দেখতে পেলÑচেহারায় কোন বৈশিষ্ট্য নেই, শুধু সরু করা নীল চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। সে দৃষ্টি ওর দিকেই তাক করা। কোন ভদ্রলোক এভাবে কারও দিকে তাকায় না। এই ছিল, তারপরই আর নেই। এ-সব তোমার কল্পনা, নিজেকে বলল রানা। দিনটা নষ্ট করার মত কিছুই ঘটেনি বলে চোখ দুটো তোমার সঙ্গে খেলছে। তবে না, এ-ধরনের সহজ ব্যাখ্যা টিকছে না। দেখা গেল যখনই মাথা ঘুরিয়ে কোন এক পাশে তাকাচ্ছে রানা, সেই একই চঞ্চল আর অনুসন্ধানী চোখ জোড়াকে দেখতে পাচ্ছে, চোখাচোখি হওয়া মাত্র দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছে দৃষ্টি। ব্যাপারটা প্রায় ইঁদুর বিড়ালের খেলা হয়ে দাঁড়াল, অথচ রানার কোন ইচ্ছেই নেই কারও ডিনারে পরিণত হওয়ার। ‘এক মিনিটের জন্যে ক্ষমা চাই,’ বিড়বিড় করে নন্দিনীর মাথাটা কাঁধ থেকে সরিয়ে সিট ছাড়ল রানা। চোখে ঘুম, সাগরের তাজা বাতাস পেয়ে আচ্ছনড়ব, দশ সেকেন্ডের জন্য চোখ মেলে তাকাল নন্দিনী। ‘কোথায় যাচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করল সে, এত অস্পষ্ট যে কোন রকমে শোনা গেল। ‘টয়লেটে,’ বলে শান্ত ভঙ্গিতে তাকে পাশ কাটাল রানা। পিছনদিকে তাকায়নি ও, অর্থাৎ নীচের ডেকে নামার সময় লোকটা ওর পিছু নিয়েছে কিনা দেখার জন্য অপেক্ষা করেনি। কালো নকশা ৯৭ শোল্ডার হোলস্টারে প্রিয় অস্ত্র ওয়ালথার আছে; বগলের নীচে, বাহুতে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা আছে ছুরি, কাজেই নিজেকে রানা মোটেও ‘একা’ মনে করছে না। তবে আশা করা যায় এ-সব বের করার কোন দরকার হবে না। এখনও নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছে রানা, সন্দেহটা অমূলক, ওর মনের অতি সাবধানতা। খুবই সম্ভাবনা আছে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটার টার্গেট হয়তো নন্দিনী। তার রূপ-যৌবন উত্তেজিত করে তুলেছে লোকটাকে, ফলে রানাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে ওকে, আসল ব্যাপারটা কী। লোহার ধাপ বেয়ে সিঁড়ির নীচে পৌঁছাল রানা, তারপর লম্বা করিডর ধরে ‘মেন’ লেখা একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। কবাট ঠেলে দরজা খুলে প্রথমে ভিতরটা ভালো করে দেখে নিল ও। সরু ঘরগুলো খালি বলেই মনে হলো। স্টেইনলেস-স্টিলের সিঙ্ক, সামনে বড় সাইজের চারকোনা একটা আয়না। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে গরম পানির ট্যাপটা ঘোরাল রানা, অলস একটা ভঙ্গিতে হাত ধুচ্ছে, চোখ আঠার মত সেঁটে আছে আয়নায়। আয়নার ভিতর দিয়ে সুইং ডোরটা দেখতে পাচ্ছে রানা। টাওয়েলিং পেপারে হাত মুছছে রানা, এই সময় ওর সাবধানতা ফল প্রসব করল। বাতাসে সামান্য আলোড়ন তুলে নিঃশব্দে দোল খেল সুইং ডোর, ভিতরে ঢুকল একটু বেঁটেখাটো এক লোক, ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে সেঁটে আছে। লোকটার মুখে কয়েক গাছি সাদা-কালো ছাগল দাড়ি দেখা যাচ্ছে, মাথায় কাঁচাপাকা বাবরি চুল। ৯৮ মাসুদ রানা-৩৪৮ ডেকে এই লোকটাই ওকে দেখছিল। কেউ কোন কথা বলছে না। রানার আঙুল এরই মধ্যে শোল্ডার হোলস্টারের কাছে পৌঁছে গেছে। দেখল ওর মতই সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে শুরু করল লোকটা। তারপর সিধে হলো সে, টাওয়েলিং পেপার নিয়ে হাত মুছছে। রানার দিকে এখন পর্যন্ত এমনকী আড়চোখেও তাকায়নি। না তাকিয়েই মুখ খুলল সে। ‘আমার বিশ্বাস, মিস্টার সম্ভব, আমাদের কমন একজন বন্ধু আছেন।’ দুই শ্বেতাঙ্গ এজেন্ট, সিআইএ আর বিআইবি, ওকে কুমার সম্ভব নামে চিনত। ওর এই নামটা আর জানত চৌ মিন। ‘আছে নাকি?’ বিদ্রƒপের সুরে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘হ্যাঁ। ইয়ে...মানে, ছিলেন আর কী।’ বলল লোকটা, এখনও হাত মুছছে। ‘ঠিক একজনও নয়, আমাদের কমন বন্ধুর সংখ্যা আসলে দু’জন। তো তাদের একজন আমাকে বিশ্বাস করে একটা ইনফরমেশন দিয়েছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন, মিস্টার সম্ভব। আপনার ওটা দরকার।’ ‘কমন বন্ধুদের একজনের নাম বলো।’ ‘একজনকে চৌ মিন বলে ডাকা হত,’ শ্রদ্ধা আর বিনয়ের সঙ্গে নামটা উচ্চারণ করল লোকটা। ‘তবে দুঃখের বিষয় যে এখন আর তিনি স্বাভাবিক আলাপ চালাবার অবস্থায় নেই। তাই তো, মিস্টার সম্ভব?’ ধীরে ধীরে ঘুরে লোকটার মুখোমুখি হলো রানা। নিজের হাত দুটো ওর চোখের সামনে রাখার চেষ্টাটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সে। হয়তো ভয় পাচ্ছে চৌ মিনের মত তাকেও না মেরে ফেলা কালো নকশা ৯৯ হয়। লোকটা রোগা, তবে রুগড়ব নয়; কাপড়চোপড়ের নীচে পাকানো রশির মত পেশির অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাতেও বিশেষত্ব আছে, পরিষ্কার বলে দেয় কুং ফু জানে। ‘আরেকজনকে থৌ মিন বলে ডাকা হয়,’ বলল রানা। ‘কোথায় সে?’ ‘ডাকা হত,’ বলল লোকটা। ‘আজ সকাল থেকে তিনিও আর কথা বলার অবস্থায় নেই। অর্থাৎ থৌ মিনও খুন হয়েছেন।’ ‘সত্যি দুঃখজনক।’wapsip.com ‘সত্যি। তবে আমি তাঁদের ম্যানেজার হিসেবে আপনাকে জানাচ্ছি, ইনফরমেশনটা আমার কাছে আছে।’ ‘তাই? তা কী ইনফরমেশন ওটা?’ ‘মাফ করবেন?’ ‘জানতে চাইছি, তুমি আমাকে কী ধরনের ইনফরমেশন দিতে চাইছ?’ ‘আপনাকে দিতে চাইছি না, মিস্টার সম্ভব,’ ঠোঁটে টান টান হাসি ফুটিয়ে বলল লোকটা। ‘আপনার কাছে বিক্রি করতে চাইছি।’ হংকং আর ইয়াঙ্গুনের দুটো ব্যাঙ্কের চেক বই আছে রানার কাছে, কোটি কোটি টাকার চেক কাটতে পারবে ও। কিন্তু চৌ মিনের তথাকথিত ম্যানেজার ওকে আসল মাইক্রোফিল্মটা দেবে কিনা জানার উপায় কী? ‘চৌ মিনকে টাকা দেয়ার জন্যে তৈরি ছিলাম আমি, কারণ জানতাম কী পেতে যাচ্ছি। তুমি সেই একই জিনিস বেচতে এসেছ কিনা বুঝব কীভাবে?’ ১০০ মাসুদ রানা-৩৪৮ ‘জিনিস সেই একই,’ বলল লোকটা। ‘কিন্তু প্রমাণ করা বা ব্যাখ্যা করার সময় এটা নয়।’ পানি কেটে হাইড্রোফয়েলের ছুটে চলা অনুভব করছে রানা, অনুভব করছে মৃদু দোলাও। ‘এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। এখানে প্রাইভেসি আছে।’ সুইং ডোরটার দিকে একবার তাকাল লোকটা। ‘কথাটা ঠিক বললেন না।’ ‘কী বলতে চাও?’ কৌতূহলে সরু হয়ে গেল রানার চোখ। ‘মিস্টার সম্ভব, আমাদের দু’জনের ওপরই নজর রাখা হচ্ছে,’ ধীরে ধীরে বলল ম্যানেজার, প্রতিটি শব্দ যেন সযতেড়ব সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা। ‘নজর রাখছে?’ রানা বিস্মিত। ‘কারা?’ ‘মার্কিনিদের বিশ্বস্ত কোন বন্ধু।’ রানা ভাবল, তৃতীয় কোন পক্ষ, যারা টার্কিশ বাথে চৌ মিনের গলা কেটেছে? নাকি এটা আরেক দল? ‘ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই আপনি টের পেয়েছেন যে হংকঙে সারাক্ষণ আপনার পিছনে লোক ছিল,’ বলল লোকটা। ‘কোথায় আপনি যান বা কী করেন, সব তারা জানে। এমনকী এখন, আজও, তারা এই আশায় অপেক্ষা করছে যে আপনি তাদেরকে মাইক্রোফিল্মটার কাছে নিয়ে যাবেন।’ ‘তারমানে তুমি জানো মাইক্রোফিল্মটা কোথায় আছে?’ ‘হ্যাঁ, মিস্টার সম্ভব, আমি জানি।’ ‘তুমি এ-ও জানো কে আমাকে ফলো করছে?’ ‘হ্যাঁ, তাও জানি।’ ‘তা হলে বলো, কে সে?’ কালো নকশা ১০১ চওড়া হাসি দেখা গেল লোকটার মুখে, এক ঝাঁক তীরের মত প্রশড়ব করায় কৌতুক বোধ করছে। জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুলল সে, তারপর হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল স্টেইনলেস-স্টিল সিঙ্কটার উপরে। ডাইভ দিয়ে মেঝেতে পড়ার আগে রানা দেখল তার নীল চোখ গড়িয়ে মাথার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল, উন্মোচিত হলো হলদেটে সাদা অংশটা। রানার অ্যাকশন পুরোপুরি রিফ্লেক্স, একটার পর আরেকটা। মেঝেতে পড়ে শরীরটা গড়িয়ে দিয়েছে ও, একটা মাত্র গড়ান শেষ হবার আগেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে হাতে চলে এসেছে পিস্তল, চোখের দৃষ্টি ঘুরে গেছে দরজার দিকে। তেল দেওয়া মেকানিজম, নিঃশব্দে দোল খাচ্ছে সুইং ডোর। মিন ভাইদের ম্যানেজারকে এখন সাবেক ম্যানেজার বলতে হবে, সিঙ্কের কিনারা বরাবর ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। লোকটা রানার পায়ের সামনে মেঝেতে স্থির হলো, নি®প্রাণ আর রক্তাক্ত একটা স্তূপ। নিঃশব্দে সিধে হলো রানা, সুইং ডোর লক্ষ্য করে ছুটল, হাতে উদ্যত পিস্তল। কবাট পুরোপুরি ফাঁক করে সাবধানে উঁকি দিয়ে সরু করিডরে তাকাল। করিডর খালি, আততায়ী বাতাসে মিলিয়ে গেছে। এক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা। হাইড্রোফয়েল সার্চ করলেই যে খুনিকে ধরা যাবে, তা নয়। সে যদি চিনা হয়, দেড়শো আরোহীর যে-কোন একজন হতে পারে। ঘুরে লাশটার কাছে ফিরে এল রানা। কড়া ইস্ত্রি করা সাদা শার্টের সামনেটা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে তার, চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাস, সে যেন ভাবতেই পারেনি এত সহজে সরিয়ে দেওয়া হবে তাকে। এই মুহূর্তে ডেকে, কিংবা ১০২ মাসুদ রানা-৩৪৮ হাইড্রোফয়েলের অন্য কোথাও, সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলধারী এক লোক নিজের কাজে ভারি সন্তুষ্ট বোধ করছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে রানাকে। হঠাৎ কেউ এসে যদি একটা লাশের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে ওকে, পুলিশী ঝামেলা এড়ানো যাবে না। পকেট সার্চ করে হংকং থেকে ইস্যু করা একটা পাসপোর্ট পেল রানা। লোকটার নাম ফুয়া ফুয়ান। লোকটার পরিচয় যাই হোক, রানার কাছে তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল পাসপোর্টের শেষ পৃষ্ঠায় সম্প্রতি সিল মারা মায়ানমারের একটা ভিসাÑগতকালের তারিখে। এখনই নিজের পিঠ চাপড়াতে রাজি নয়, তবে রানা বুঝতে পারল ঠিক পথেই এগোচ্ছে ও। লোকটার কাছে আর কোন কাগজ-পত্র নেই। আর মাইক্রোফিল্মটা তো নে-ই। তাকে টেনে এনে একটা কিউবিকলে ঢোকাল রানা, তারপর সিটে বসিয়ে ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দিল দরজায়। পার্টিশন টপকে বেরিয়ে এল রানা, হোসপাইপ দিয়ে মেঝের রক্ত ধুয়ে ফেলল, তারপর টাওয়েলিং পেপারে হাত মুছে বেরিয়ে এল করিডরে। এখনও সেটা খালি। সিঁড়ি বেয়ে ডেকে ওঠার সময় নন্দিনীর কথা মনে পড়ল রানার। কে জানে কী ভাবছে মেয়েটা। ম্যানেজার ফুয়া ফুয়ানের ধারণা ছিল, এক বা একাধিক লোক বিশ্বাস করে রানাকে ফলো করলে মাইক্রোফিল্মটার কাছে পৌঁছাতে পারবে তারা। এই হিসাবে, অন্তত আপাতত, মৃত রানার চেয়ে জীবিত রানা অনেক বেশি মূল্যবান। তবে হিসাব যাই বলুক, এরকম একটা পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তিwapsip.com কালো নকশা ১০৩ কর নয়। আট মায়ানমার সরকার মাত্র সাতদিনের ভিসা ইস্যু করেছে। আজ তার প্রথম দিন। হংকঙের কাই টাক এয়ারপোর্ট থেকে পে-ন ধরল রানা। মায়ানমার এয়ারওয়েজের ননস্টপ ফ্লাইট। সামনে-পিছনের, দুই কেবিনের চারজন স্টুয়ার্ডই বার্মিজ; পরনে বহুরঙা সারং, তার উপর স্বচ্ছ কাপড়ের ঢোলা ব-াউজ পরেছে। এই পরিচ্ছদের নীচের অংশটাকে লুঙ্গিও বলা হয়, আর উপরের অংশটাকে বলে ইঙ্গি। বার্মিজ বিমানবালারা আইল ধরে আসা-যাওয়া করছে, রানা তাদের হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে অদ্ভুত এক ঝাঁকি আবিষ্কার করল, যে কারণে ইঙ্গির ভিতর তাদের উনড়বত স্তন প্রতি মুহূর্তে লাফাচ্ছে। দৃশ্যটা রানাকে মনে করিয়ে দিল কাল রাতে কী উপভোগ করেছে ও। বিছানায় ওর বুকের সঙ্গে সেঁটে এসে নন্দিনী অপরূপা আদুরে সুরে আবদার করেছে, ‘আরেকটা দিন থাকো না, পি-জ!’ একটা মেয়েকে যতই ভালো লাগুক, তার সঙ্গে যতই ঘনিষ্ঠতা জন্মাক, এক নম্বরে থাকবে কাজ। ১০৪ মাসুদ রানা-৩৪৮ এবং পাশাপাশি সতর্কতা। সেই সতর্কতার কারণেই নন্দিনীকে রানা বলেনি যে মায়ানমারে যাচ্ছে ও। যদি সম্ভব হয় যতটা সম্ভব কম মিথ্যেকথা বলতে চায়। নন্দিনী অনেক কথাই বলেছে, তা থেকে ধরে নেওয়া চলে আগামী কয়েকদিন মায়ানমারে ঢুকছে না সে। আশা করা যায় তার আগেই দেশটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে রানা, পকেটে মাইক্রোফিল্মটা নিয়ে। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো স্মৃতির পথ ধরে ফিরে ফিরে আসছে মনে। ‘ব্যাপারটা সত্যি খুব মজার আর অবাক করা।’ ‘কোনটা?’ ‘তুমিই প্রথমপুরুষ যাকে বিশ্বাস করেছি, যার সঙ্গে নিজেকে আমার সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে হয়েছে। আমি অত্যন্ত লজ্জা আর অসহায় বোধ করতাম...’ ‘লাজুক? হ্যাঁ,’ হেসে উঠে বলল রানা। ‘অসহায়? নেভার!’ ‘আপনি সন্তুষ্ট, সার?’ সংবিৎ ফিরল বিমানবালার মধুর কণ্ঠে। ‘ওহ্, ইয়েস!’ বলল রানা, হঠাৎ করে উপলব্ধি করল নন্দিনী শুধু ওর শারীরিক চাহিদা মেটানোর একটা মেশিন নয়, তারচেয়েও অর্থবহ কিছু। মেয়েটার সরলতা ওর ভালো লেগেছে। এমনকী আত্মসমর্পণের ভঙ্গিটিও। তবে কাজের প্রাধান্য আগে। নন্দিনী অপরূপাকে এড়িয়ে না গিয়ে আর কোন উপায় ছিল না ওর। নতুন একটা অ্যাসাইমেনন্টে রয়েছে ও, এখনও জানে না মাইক্রোফিল্মটা কোথায় আছে। জানার পর ঝামেলা আরও বাড়বে। হাতে পেতে হবে ওটাকে, তারপর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মায়ানমার থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে। কালো নকশা ১০৫ বলা যায় না, হয়তো এই মুহূর্তেও ওর উপর নজর রাখা হচ্ছে। প্যাসেঞ্জার সেজে ওর আশপাশেই হয়তো বসে আছে কেউ। কিংবা বিমানবালাদের কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শত্র“পক্ষ তো অনেক, তাদের সবার সম্পর্কে ওর ধারণাও নেই। বিকেলের দিকে মায়ানমার জাতীয় মিউজিয়ামে পৌঁছাল রানা। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে এল ও। সরু রাস্তাটার নাম পিয়ারে স্ট্রিট, সেটা ধরে খানিক হাঁটার পর ডান দিকে বাঁক ঘুরে চলে এল শয়ে ডাগন প্যাগোডা রোড। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কালচারাল ইনস্টিটিউট তৈরি করা হয় এখানে। ধীরে ধীরে ওটার পাশে বিরাট সব দালান গড়ে উঠেছেÑন্যাশনাল মিউজিয়াম, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ মিউজিক, ড্রামা অ্যান্ড ডান্স। ঘাড় ফিরিয়ে ফেলে আসা ফাঁকা রাস্তাটার দিকে তাকাল রানা। একটা বিড়াল পর্যন্ত নেই। ছায়ার ভিতরও কিছু নড়ছে না। মিনিস্ট্রি অভ কালচার লেখা প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে ঢুকল রানা। মিউজিয়ামে পৌঁছাবার আগে মার্বেল পাথরের তিন প্রস্থ সিঁড়ির ধাপ টপকাতে হলো ওকে। বিখ্যাত লায়ন থ্রোন বসানো হয়েছে একটা খিলানের পাশে। ১৯৬৪ সালে বার্মাকে ওটা ফিরিয়ে দেয় ব্রিটেন। রানা বিশেষ আগ্রহ বোধ করছে না। সম্পূর্ণ অন্য এক কাল আর অন্য এক সংস্কৃতির খোঁজে এসেছে ও। এই সময় নোটিশটা চোখে পড়ল, ইংরেজি আর বার্মিজ ভাষায় ছাপা হয়েছে। হান সাম্রাজ্যের আর্টিফ্যাক্ট মাত্র আজ সকাল থেকে প্রদর্শনের


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৮৩৫ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now