বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
কালো নকশা ১
মাসুদ রানা
কালো নকশা
কাজী আনোয়ার হোসেন
এক
গণচিন।
ঘণ্টাখানেক নির্বিঘেড়ব উড়ল পে-ন। তারপর, মাসুদ রানার মত
আরও হয়তো দু’একজন খেয়াল করল ব্যাপারটাÑবড়সড় বৃত্ত
তৈরি করে ফিরতি পথ ধরছে ওরা।
চারশো প্যাসেঞ্জার নিয়ে সাংহাই শহর থেকে টেক-অফ
করেছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স-এর প্রকাণ্ড বোয়িং সেভেন-সেভেন-
সেভেন। জিলান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে রিফুয়েলিং শেষে
আবার রওনা হয়েছে, গন্তব্য মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাতোর।
মাঝপথে কী ঘটল যে...
একটু পরে সবিনয়ে জানালেন পাইলট, যান্ত্রিক গোলযোগের
কারণে বাধ্য হয়ে বোয়িংকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন তিনি, আর
কিছুক্ষণের মধ্যে রাজধানী শহর বেজিঙের লান্তিয়ানচাঙ
ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছেন। তারপর
যথাবিহিত অভয়দান আর দুঃখপ্রকাশ করলেন।
নিরাপদেই ল্যান্ড করল পে-ন। এর মধ্যে আর কিছু নেই,
ব্যাপারটা স্রেফ যান্ত্রিক ত্র“টিই বটে।
২ মাসুদ রানা-৩৪৮
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মঙ্গোলিয়ায় যাবে এরকম কোন
কানেকটিং ফ্লাইট আপাতত পাওয়া সম্ভব নয়।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের তরফ থেকে বলা হলো, বারো ঘণ্টার
মধ্যে আরেকটা বোয়িং নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছে তারা, ততক্ষণ
প্যাসেঞ্জাররা ফাইভ স্টার কুবলাই খান হোটেলে উঠে সময়টা
উপভোগ করুন।
অর্থাৎ অন্তত বারো ঘণ্টার জন্য বেজিঙে আটকা পড়তে হলো
বিসিআই এজেন্ট এমআরনাইনকে।
কাজের মধ্যেই রয়েছে রানা, তবে লম্বা একটা ট্যুরে; বিশেষ
করে পুব এশিয়ার বিভিনড়ব দেশে ঘুরে ঘুরে ওর এজেন্সির
শাখাগুলোর কী অবস্থা দেখছে, কমপিউটার খুলে হিসাব নিচ্ছে
আয়-ব্যয়ের, কোথাও কোনও সমস্যা থাকলে সমাধান খুঁজে বের
করছে। wapsip.com
ব্যাংকক, ভিয়েনতিয়েন, হ্যানয়, তাইপে আর হংকং হয়ে চিনে
ঢুকেছিল রানা। বেইজিং বাদে তিনটে বড় শহরে কাজ ছিল, সেসব
সেরে সাংহাই থেকে পে-ন ধরে যাচ্ছিল মঙ্গোলিয়া।
মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাতোরে রানা এজেন্সির নতুন
একটা শাখা অফিস খোলা হবে কাল সকালে, কিন্তু বেইজিঙে
আটকা পড়ে যাওয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এখন
অনিশ্চিত হয়ে পড়ল রানার জন্য।
এই মুহূর্তে ফাইভ স্টার কুবলাই খান-এর একটা বার-এ
রয়েছে রানা, বিয়ারের গ-াসে চুমুক দিচ্ছে আর হঠাৎ পেয়ে বসা
নিঃসঙ্গতায় বিচ্ছিরিভাবে নাজেহাল হচ্ছে।
কবজি একটু উঁচু করে রোলেক্স দেখল রানা। সাড়ে সাতটা
বাজে। মাত্র সন্ধে, রাত এখনও শুরুই হয়নি। সময়টা কীভাবে
কালো নকশা ৩
কাটাবে ভাবছে ও। নিজের ভিতর টুপ করে একটা ডুব দিয়ে দেখে
নিতে চেষ্টা করল, আসলে চাইছেটা কী ও।
কী চাইছে সেটা পরিষ্কার হলো না, তবে জানা গেল কী চাইছে
না।
রানা এজেন্সির অফিসে সারপ্রাইজ ভিজিট বাদ। বাদ
হোটেলের গ্যাম্বলিং রুমে ভাগ্যপরীক্ষাও। পুরানো কোন বন্ধুর
সঙ্গ? নাহ্, ভালো-াগছে না। তা হলে আর বাকি রইল কী?
বাকি থাকল পুরুষকে ঈশ্বরের তরফ থেকে দেওয়া সবচেয়ে
বড় পুরস্কারটি: সুন্দরী নারীর মধুর সানিড়বধ্য।
বার-এর এদিক ওদিক তাকালেই ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে
রানা, রূপ আর যৌবনের চোখ-ধাঁধানো ডালি। এদের মধ্যে
কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
ও জানে, এদের বেশিরভাগই অভিজাত পারিবারিক পরিবেশ
আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক আবহের ভিতর বড় হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের
মত কমিউনিস্ট চিনে হোটেল বা পাবে বারবণিতাকে আশ্রয় বা
প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। এদের কারও সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে সময়
কাটানো যেতে পারে, হোটেল-কামরায় নিয়ে যাওয়ার
বাধ্যবাধকতা নেই।
নিজের উপর আস্থা আছে রানার, তা ছাড়া অভিজ্ঞতা থেকে
জানে যে সহজেই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয় মেয়েরা, কাজেই চেষ্টা করে
দেখা যেতে পারত, কিন্তু না, এতেও মনের তরফ থেকে সায়
পাওয়া গেল না।
আচ্ছা, হোটেল রুমে ফেরার সময় শিভাস রিগাল-এর একটা
বোতল নিয়ে গেলে কেমন হয়? সেটা খালি করতে পারলে কাল
অনেক বেলা পর্যন্ত অঘোরে ঘুমানো যাবে।
৪ মাসুদ রানা-৩৪৮
ভিতর থেকে মানা করে দেওয়া হলো, নিজেকে সুস্থ আর
সচেতন রাখা প্রয়োজন, কখন কী ইমার্জেন্সি দেখা দেয় ঠিক নেই।
দূর ছাই, বিরক্ত হয়ে ভাবল রানা, আমি কি কোন অ্যাসাইনমেন্টে
আছি নাকি যে...
তারপর, একেবারে ভোজবাজির মত, আশ্চর্য একটা কাণ্ড
ঘটল।
যেন কারও অশ্র“ত নির্দেশে ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে বারে
ঢোকার সুইং ডোরটার দিকে তাকাল রানা। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে
ওটা।
আর তারপরই অবাক হয়ে দেখল রানা, শান্ত পায়ে ভিতরে
ঢুকছে জিজিয়ানা দালিয়ান।
ভুলটা অবশ্য পরমুহূর্তেই ভাঙলÑকোথায় দালিয়ান? এ তো
অন্য এক অচেনা মেয়ে! এমনকী জিজিয়ানা দালিয়ানের সঙ্গে এর
কোন মিলও নেই। তা হলে এমন হলো কেন?
হলপ করে বলতে পারবে রানা, এই অচেনা মেয়েটির মুখের
জায়গায় হুবহু দালিয়ার মুখ দেখেছে ও। পরিষ্কার,স্পষ্ট; সন্দেহের
বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না।
শুধু যে দেখেছে, তা নয়, যাতে দেখতে পায় সেজন্য কে যেন
ঝট করে সুইং ডোরের দিকে ঘাড় ফেরাতে বাধ্যও করেছে ওকে।
ব্যাপারটা কী?
মাঝে মধ্যে এমন হতে দেখা যায়; নিয়তির অদৃশ্য অঙ্গুলি
হেলনে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে হয়তো একটা ব্যাঘাত
সৃষ্টি হলো। এই ছন্দপতনের পরিণতি কখনও শুভ হয়, কখনও
অশুভ, আবার স্রেফ অর্থহীন বিড়ম্বনা ছাড়া অন্য কিছু না-ও হতে
পারে।
কালো নকশা ৫
নিয়তির সেরকম একটা ইঙ্গিতেই কি বাংলাদেশ কাউন্টার
ইন্টেলিজেন্স-এর অন্যতম দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা মাঝ আকাশে
ছন্দ হারিয়ে ফেলে এই মুহূর্তে হোটেল কুবলাই খানের বারে বসে
আছে?
তারপর এখন আবার সেই রহস্যময় নিয়তিই অবচেতন মনকে
প্ররোচিত করছে বা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে?
এরপর স্বভাবতই রানা ভাবল, একটা ফোন করে দেখা উচিত
না কেমন আছে মেয়েটা? বেশ অনেকদিন হয়ে গেল দালিয়ার
কোন খবর-টবর নেওয়া হয় না।
বার কাউন্টার ছেড়ে পে বুদের দিকে এগোল রানা। মনে পড়ে
গেল সবÑকে দালিয়া, কী দালিয়া।
জুন, ১৯৮৯। বেইজিঙ।
সে-সব দুঃস্বপড়ব ভরা দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও
শিউরে উঠতে হয়।
চাই গণতন্ত্র, চাই মত প্রকাশের স্বাধীনতাÑএই শে-াগান তুলে
ছাত্রদের নেতৃত্বে তখন গোটা চিন জুড়ে চলছে তুমুল আন্দোলন।
বলা হয়, ছাত্রদের এই আন্দোলনে গোপনে ইন্ধন যোগাচ্ছিল
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, যারা চায় না শতকোটি মানুষের দেশ চিন
তার অর্জনগুলো ধরে রাখতে পারুক।
আন্দোলন থামাবার জন্য গতমাসের বিশ তারিখে মার্শাল ল
জারি করেছে সরকার। বিদেশীদের চিন ছাড়তে বলা হয়েছে
ঠিকই, কিন্তু গ্রাউন্ড ক্রুরা কাজ না করায় বিমানবন্দর অচল হয়ে
পড়ে আছে।
ছাত্ররা মার্শাল ল মানছে না, বড় বড় শহরে প্রতিদিন বিক্ষোভ
৬ মাসুদ রানা-৩৪৮
মিছিল হচ্ছেই।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাবলিক প-াজা তিয়ানানমেন স্কয়্যারে
গণতন্ত্রের প্রতীক হিসাবে তেত্রিশ ফুট উঁচু একটা দুধসাদা মূর্তি
তৈরি করেছে ছাত্ররা, নাম দিয়েছে ‘গণতন্ত্রের দেবী’।
সবারই জানা আছে যে ১৯৪৯ সালের পয়লা অক্টোবরে ঠিক
এখানে দাঁড়িয়ে লালচিনের মহান নেতা মাও সে-তুং ‘পিপল’স্
রিপাবলিক অব চায়না’ ঘোষণা করেছিলেন। দুনিয়ার মানুষ এ-ও
জানে যে আধুনিক চিনের যা কিছু অর্জন তার সবই কমরেড মাও
সে-তুংয়ের যোগ্য নেতৃত্বের গুণে সম্ভব হয়েছে।
বিশেষ জরুরি একটা কাজে এসে বেইজিঙে আটকা পড়ে
গেছে রানা। অলস বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে, সিদ্ধান্ত
নিয়েছে রাজধানীতে যা যা দেখার আছে এই সুযোগে সব দেখে
নেবে।
ওর ফাইভ স্টার হোটেল দা মোঙ্গল বিখ্যাত তিয়ান তান
পার্কের একধারে, টেমপল অভ হেভেন থেকে বেশি দূরে নয়।
টেমপল অভ হেভেনকে আর্কিটেকচারাল বিস্ময় বলা
হয়Ñকাঠের তৈরি, অথচ কোন পেরেক ব্যবহার করা হয়নি। মিং
আর কিং আমলের সম্রাটরা এখানে প্রার্থনা করতে আসতেন।
ওখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে নিষিদ্ধ নগরী।
ওটার আরেক নাম, ইমপেরিয়াল প্যালেসÑআটশো ভবনের একটা
গুচ্ছ, মিং আর কিং সম্রাটরা বসবাস করতেন। নিষিদ্ধ নগরী তৈরি
করা হয় পনেরো শতকে।
৩ জুন বিকেল চারটের সময় ওর গাইড লুসান হুমা ওকে
নিতে আসবে। হুমা আসলে রানা এজেন্সির বেইজিং শাখার
প্রধানও বটে।
কালো নকশা ৭
বেইজিঙেই জন্ম আর বেড়ে ওঠা হুমার, তবে কাজ শুরু করে
সাংহাইয়ে। এজেন্সির সাংহাই শাখা থেকে প্রমোশন দিয়ে এখানে
নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। মাত্র দু’দিন হলো অফিসে বসছে, ফলে
বেইজিং শাখার অনেক গোপন রহস্য সম্পর্কে এখনও অবহিত নয়
সে।
আজ হুমা যেমন তার প্রাণপ্রিয় মাসুদ ভাইকে ঐতিহাসিক
কয়েকটা জায়গা দেখাতে নিয়ে যাবে, তেমনি রানাও ওর বিশ্বস্ত
একজন শাখাপ্রধানকে গোপন কিছু ফ্যাসিলিটির কথা জানাবে।
কিন্তু তিন তারিখ ভোরবেলা থেকেই রাজধানীতে কারফিউ
জারি করা হলো। সরকারের হুকুম পেয়ে আন্দোলন থামাতে
ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এল পিপল’স্ লিবারেশন আর্মি।
অবরুদ্ধ শহরে ছড়িয়ে পড়ল অসম্ভব আর অবিশ্বাস্য সব
গুজব। তারপর জানা গেল, সামরিক বাহিনী আসলেও নির্বিচারে
পাখি মারার মত করে মানুষ মারছে।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চিনকে সবার জন্য প্রাচুর্যময় একটা
দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে কঠোর নিয়ম-শৃংখলা আর বিধিনিে
ষধের বেড়া তুলে নেওয়া যাবে না। সংখ্যাগুরুর স্বার্থ রক্ষা
করার জন্য তাই সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। এটা অঙ্ক, এর
মধ্যে আবেগের কোন ভূমিকা রাখা হয়নি।
তিয়ানানমেন স্কয়্যার আক্ষরিক অর্থেই রক্তে ভেসে গেল।
প্রথম দফাতেই লাশ পড়েছে কয়েকশো। শুরু হওয়ার পর আর
থামছে না, থেমে থেমে হামলা চলছেই।
মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে আহতদের নিয়ে। সংখ্যায়
তারা কয়েক হাজার; শহরের সবগুলো হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা
নেওয়া সত্ত্বেও জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র এক চতুর্থাংশ
৮ মাসুদ রানা-৩৪৮
রোগীকে।
বাকি সবাই এখনও তিয়ানানমেন স্কয়্যারে পড়ে কাতরাচ্ছে,
তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যাচ্ছে রক্তক্ষরণে।
তারপর আরও খারাপ খবর এল। সেনাবাহিনীর ছোঁড়া
বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়ার জন্য সকাল দশটা থেকে
নতুন করে আবারও শুরু হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল, নেতৃত্ব দিচ্ছে
পিকিং ইউনিভার্সিটির কয়েকজন অকুতোভয় ছাত্র-ছাত্রী।
এরকম একটা অবস্থায়, বিকেল চারটের দিকে মোঙ্গলের
রুফ-টপ বার-এ বসে খুদে ট্র্যানজিসটার খুলে বিবিসি ধরার চেষ্টা
করছে রানা, হঠাৎ ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। নম্বরটা
দেখেই বুঝতে পারল ও, লুসান হুমা ফোন করেছে।
‘মাসুদ ভাই,’ ভারী, থমথমে গলায় বলল হুমা, ‘আমি ভুলিনি
আপনাকে নিয়ে বেরুবার কথা ছিল আমার। কথাটা রাখতে
পারলাম না বলে আপনি আমাকে মাফ করে দেবেন, পি-জ!’
একজন চিনা হিসাবে যথেষ্ট বিনয়ী হুমা, জানে রানা, কিন্তু এই
মুহূর্তে তার কথাগুলো প্রলাপের মত লাগল কানেÑশহরের এরকম
বিপজ্জনক অবস্থায় দেখা করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা
চাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ‘কী ব্যাপার, লুসান, কিছু
ঘটেছে? তুমি কোত্থেকে বলছ?’
‘আমরা এখন, মাসুদ ভাই, আপনার হোটেলের পিছনেÑ
তিয়ান তান পার্কে। ছাদে উঠে তাকালেই দেখতে পাবেন।’
‘কেন?’ আঁতকে উঠল রানা। ‘এই পরিস্থিতিতে কোন বুদ্ধিতে
তুমি বাইরে বেরিয়েছ...’ হঠাৎ চুপ করে গেল রানা, তারপর
জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা মানে?’
‘আমরা মানে কয়েকশো মানুষ, মাসুদ ভাই...’
কালো নকশা ৯
‘কয়েকশো মানুষ...কিন্তু তাদের সঙ্গে তুমি কী করছ পার্কে?
শোনো, হুমা, এখনই আমার হোটেলে চলে এসো...’
‘কী করে যাব, মাসুদ ভাই? আমার কাঁধে যে ভারী একটা
বোঝা !’ এটুকু বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল হুমা।
পরবর্তী দশ মিনিট চেষ্টা করে উদভ্রান্ত আর কাতর হুমার
কাছে বেশি কিছু জানতে পারল না রানা। তবে ঠিক কী ঘটেছে
বুঝে নিতে তেমন অসুবিধেও হলো না ওর।
ছোট এক ভাই ও এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই হুমার।
বোন জিজিয়ানা দালিয়ান হোস্টেলে থাকে, বেইজিং ভার্সিটি থেকে
কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেÑআগামী
মাসে রেজাল্ট। ভাই থাকে দেশের বাড়িতে, লেখাপড়ায় তেমন
ভালো না হওয়ায় চাষবাস করে। এ-সব আগে থেকেই জানা আছে
রানার।
ছাত্রদের বিক্ষোভ দমন করার জন্য রাস্তায় আর্মি নামানো
হয়েছে, এই খবর পেয়ে সকাল ন’টার দিকে বোনের হোস্টেলে
ছুটে যায় হুমা, জানে ভয় পেয়ে চারদেয়ালের ভিতর বসে থাকার
পাত্রী নয় সে।
কিন্তু সেখানে পৌঁছে শুনল, গোলাগুলি শুরু হয়েছে জানার
পরই ছোট একটা মিছিল নিয়ে তিয়ানানমেন স্কয়্যারের উদ্দেশে
রওনা হয়ে গেছে দালিয়ান।
বোনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল হুমা।
তারপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে-ও ছুটল ওদিকে। ওই বোনই তো
তার সব, কাজেই যেভাবে হোক তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
যাবার পথে সে দেখল, শহরের চারদিক থেকে প্রতিবাদে
মুখর ছোট ছোট অসংখ্য মিছিল বেরুচ্ছে।
১০ মাসুদ রানা-৩৪৮
কিন্তু তিয়ানানমেন স্কয়্যারে পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেলল
হুমা।
মিছিল নিয়ে স্কয়্যারে পৌঁছাতে পারেনি দালিয়ান, তাদেরকে
লক্ষ্য করে কয়েকটা হেলিকপ্টার থেকে মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ার
হলো। হুমার চোখের সামনে দালিয়ান সহ প্রায় সবাই লুটিয়ে
পড়ল রাস্তার উপর।
লোকজন যে-যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছে। গুলি করে এক
ঝাঁক হেলিকপ্টার চলে গেল, পরক্ষণে দেখা গেল আরেক ঝাঁক
ছুটে আসছে অন্যদিক থেকে। এরকম গোলাগুলির মধ্যেই ক্রল
করে বোনের কাছে পৌঁছাল হুমা।
পাঁজরে আর হাঁটুর উপর গুলি খেয়েছে দালিয়ান। নিজের শার্ট
ছিঁড়ে ক্ষতস্থান বাঁধলেও, তাতে রক্তক্ষরণ পুরোপুরি বন্ধ করা গেল
না।
অজ্ঞান বোনকে কাঁধে নিয়ে সেই সকাল সাড়ে দশটা থেকে
রাজধানীর অন্তত এক ডজন হাসপাতাল আর ক্লিনিকে ছুটোছুটি
করল হুমা, কিন্তু কোথাও থেকে সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসাও পেল
না।
তারপর জানা গেল বেইজিং মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদ
আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তিয়ান তান পার্কে একটা
ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বলা হয়েছে আহত লোকজনকে
যেন ওখানে পৌঁছে দেওয়া হয়।
খবরটা পেয়ে কাঁধের ভারী বোঝা নিয়ে আরও কয়েকশো
লোকের মত হুমাও পৌঁছেছে ওখানে। কিন্তু ইতিমধ্যে ঘণ্টাখানেক
পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ক্লিনিক খোলার কোন লক্ষণ তার
চোখে পড়েনি। বরং অন্যরকম একটা বিপদের আশঙ্কা করছে সে।
কালো নকশা ১১
কোথাও থেকে পাঁচ-সাতজন ছাত্র-ছাত্রী এসে জড়ো হয়েছিল
পার্কের একধারে, তাদের শে-াগান শুনে চারদিক থেকে তরুণতরু
ণীরা এসে ভিড় করছে।
ইতিমধ্যে একবার কেউ একজন ‘আর্মি আসছে’ বলে চেঁচিয়ে
ওঠায় ছুটোছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরে জানা গেল পাশের রাস্তা
দিয়ে মার্চ করে চলে গেছে তারা।
তবে এখানে যদি ছাত্ররা সমাবেশ করে, এক সময় না এক
সময় আর্মি আসবেই; ব্যাপারটা এরইমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে,
আন্দোলনের নাম-নিশানা মুছে ফেলার জন্য মাঠে নেমেছে তারা।
মিছিল করা তো দূরের কথা, কারফিউ-এর মধ্যে রাস্তায় যাকে
দেখবে তাকেই খুন করার জন্য গুলি করবে। ইতিমধ্যে
লাউডস্পিকারে সেরকমই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
মোবাইল ফোনে ফোঁপাচ্ছে লুসান হুমা, রানার প্রশেড়বর কোন
উত্তরই দিতে পারছে না সে। রানা তাকে জরুরি একটা মেসেজ
দিতে চাইছে, কিন্তু মাথাটা ঠিকমত কাজ না করায় ওর কোন কথা
ভালো করে শুনছেই না সে।
‘শোনো, আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি!’ মোবাইল সেটে
চেঁচাচ্ছে রানা। ‘জায়গাটা কাছেই, একটা কোড বললেই ওরা
তোমার বোনকে...’
এই সময় পরপর কয়েকটা আওয়াজ শুনে শিউরে উঠল রানা।
প্রথমে কপ্টার ইঞ্জিনের কর্কশ যান্ত্রিক গর্জন, পরমুহূর্তে সাবমেশিন
গান থেকে ব্রাশ ফায়ারের একঘেয়ে শব্দ। তারপর একের পর এক
গ্রেনেডের বিস্ফোরণ।
এক কি দু’সেকেন্ড পর একটা আর্তনাদও শুনতে পেল ও,
এটা বেরিয়ে এল মোবাইল সেটের ভিতর থেকে।
১২ মাসুদ রানা-৩৪৮
পার্কের ভিতর আর্মি ঢুকেছে বুঝতে পেরে বার থেকে খোলা
ছাদে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশী কিছু রিপোর্টার, কারণ বিশতলা
দালানটার পিছন থেকে টাইয়ান তান পার্কের অনেকটাই দেখা
যায়।
‘হুমা? হুমা?’ মোবাইল ফোনে চিৎকার করছে রানা।
ওদিকে ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে হুমা। ‘মাসুদ...ভাই...’ থেমে থেমে
কিছু বলতে চেষ্টা করল সে, ‘...বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, আমি
বাঁচব না...কিন্তু চিকিৎসা পেলে দালিয়ান বাঁচত...’ তারপর হঠাৎই
থেমে গেল সে। এমনকী নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না।
অনেক ডাকাডাকি করেও হুমার আর সাড়া পাওয়া গেল না।
অগত্যা বাধ্য হয়ে যোগাযোগ কেটে দিল রানা। টেবিল থেকে
তুলে ক্যামেরাটা কাঁধে ঝোলাল ও, তারপর বার থেকে বেরিয়ে
এল খোলা ছাদে।
মোঙ্গল বিল্ডিঙের ছাদের পিছনে ইতিমধ্যে অনেক লোকের
ভিড় জমে গেছে। পার্কের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে তারা।
নিজেদের কাজ সেরে ফিরে গেছে কপ্টারগুলো। গাছের নীচে আর
ঝোপের ভিতর পড়ে আছে আহত মানুষ। সংখ্যায় তারা এত বেশি
যে গুণে শেষ করা যাবে না।
পার্কের ভিতর মানুষে টানা তিন চাকার ভ্যান দেখা গেল বেশ
কিছু। আহত লোকজনকে সম্ভবত ওই ভ্যানে তুলেই তিয়ানানমেন
স্কয়্যার থেকে পার্কে নিয়ে আসা হয়েছে।
কয়েকজন সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নিল, দুনিয়ার মানুষকে এই বর্বর
হত্যাকাণ্ডের কথা জানানো তাদের কর্তব্য, কাজেই প্রাণের উপর
ঝুঁকি নিয়ে হলেও আহতদের ছবি তুলতে পার্কের ভিতর ঢুকবে
তারা।
কালো নকশা ১৩
রানাও বেজিঙে এসেছে একজন রিপোর্টার-এর কাভার নিয়ে,
ফলে তাদের সঙ্গে ভিড়ে যেতে ওর কোন অসুবিধে হলো না।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে হোটেলের পিছনের বাগান দিয়ে পথ করে
নিল ওরা, চুপিসারে পাঁচিল টপকে পৌঁছে গেল তিয়ান তান পার্কে।
মিনিট তিনেক হাঁটার পর ফটো তোলার প্রথম সাবজেক্ট পেয়ে
গেল জার্নালিস্টরাÑএকসঙ্গে তিনটে লাশ।
একটু পর রানার মনে হলো জেগে নেই ও, ঘুমের মধ্যে
দুঃস্বপড়ব দেখছে। এরপর যাদেরই লাশ দেখল, তাদেরকে ভাগ্যবান
বলে মনে হলো ওরÑকারণ মরে গিয়ে বেঁচে গেছে তারা।
যারা বেঁচে আছে তাদের অনেকেরই হাত বা পা বিচ্ছিনড়ব হয়ে
পড়ে আছে কাছাকাছি, কারও হয়তো অর্ধেক শরীরই নেই। কেউ
পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা নিজের নাড়িভুঁড়ির দিকে হাঁ করে
তাকিয়ে আছে, কেউ নিজের রক্তস্রোতে সাঁতরাচ্ছে।
বিদেশী লোকজন দেখে সাহায্যের আশায় হাত বাড়াচ্ছে
তারা। চারপাশ থেকে ভেসে আসা কাতর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে
রানা। কেউ বলছে, ‘একটু পানি!’ আবার কেউ মিনতি করছে,
‘মেরে ফেলো, পি-জ!’
আধ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর লুসান হুমাকে দেখতে পেল রানা।
নিজের শরীর দিয়ে বোনকে আড়াল করে রেখেছে সে, বোধহয়
সেজন্যই মেয়েটির গায়ে নতুন করে কোন আঘাত লাগেনিÑনা
বুলেটের, না গ্রেনেডের। দু’জনেরই পালস দেখল রানা।
হুমা মারা গেছে।
কিছু লোক লাশ বা আহত তরুণ-তরুণীদের ভ্যানে তুলে পার্ক
থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত একটা ভ্যান ঠেলে পার্ক
থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল রানাকেও।
১৪ মাসুদ রানা-৩৪৮
বেজিঙে রানা এজেন্সির কয়েকটাই সেফহাউস আছে, তার
মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হয় শহরের উপকণ্ঠে বৌদ্ধ
ভিক্ষুদের একটা মঠকে। মোবাইল ফোনে এই মঠের ঠিকানাই
হুমাকে দিতে চেয়েছিল রানা।
সরু অলিগলি ধরে মঠে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার উপর লেগে
গেল রানার। তবে একবার পৌঁছানোর পর আর কোন সমস্যা
হলো না।
মঠটা বিরাট, পাঁচশো ভিক্ষু বসবাস করেন। ভিতরে ছোট
একটা ক্লিনিক আছে, বাইরের রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা
হয়। ভিক্ষুদের মধ্যেও সবাই জানেন না যে ক্লিনিকের সমস্ত খরচ
বহন করছে রানা এজেন্সি।
একদল ভিক্ষু হুমার লাশ নিয়ে চলে গেল, যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হবে তার।
খানিক পর দালিয়ানকে পরীক্ষা করে ক্লিনিকের ডাক্তাররা
রানাকে ডেকে পাঠালেন। রক্তের গ্র“প জানিয়ে ওকে বলা হলো,
রোগিণীকে বাঁচাতে হলে অন্তত দুই ব্যাগ রক্ত এই মুহূর্তেই
দরকার।
ডাক্তারদের আন্তরিক চেষ্টা, নার্সদের সযতড়ব সেবা আর
ভাগ্যগুণে তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে পেল দালিয়ান। ডাক্তররা
জানালেন, সংকট কেটে গেছে; তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে অন্তত
দু’মাস সময় লাগবে তার।
এক হপ্তা পর চিন থেকে দেশে ফিরে আসে রানা।
কিন্তু দালিয়ানের বিপদ তখনও কাটেনি। আন্দোলনের সঙ্গে
জড়িত ছিল, আহত হয়ে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছে, এরকম ছাত্র-
ছাত্রীদের খোঁজে হসপিটাল আর ক্লিনিকগুলোয় হানা দিচ্ছে
কালো নকশা ১৫
মিলিটারি।
ধরতে পারলে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে পাঠিয়ে দিচ্ছে,
সেখানে বিচারের নামে চলছে নিষ্ঠুরতাÑমৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোন
সাজা নেই, কারণ কারফিউ অমান্য করে যারাই বাইরে বেরিয়ে
ছিল সামরিক বাহিনীর দৃষ্টিতে তারা সবাই দেশদ্রোহী।
মঠের কাছাকাছি খ্রিস্টানদের একটা মিশনারি আছে।
আমেরিকান দূতাবাস থেকে ফাদারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,
আহত ছাত্র-ছাত্রীরা আশ্রয় চাইলে তাদেরকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া
না হয়। খুব কম মানুষই জানে যে মিশনারিটা আসলে সিআইএ-র
একটা আস্তানা।
ডাক্তার আর ভিক্ষুরা আর কোন উপায় না দেখে ওই
মিশনারিতে পাঠিয়ে দিলেন দালিয়ানকে, কারণ জানেন মিলিটারি
ওখানে হানা দেবে না। তবে দালিয়ান কেমন আছে না আছে
নিয়মিত খোঁজ নেন তাঁরা।
শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারদের চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল
দালিয়ান। রেজাল্ট বেরুতে দেখা গেল ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে সে।
ইতিমধ্যে ভিক্ষুরা জানিয়েছেন, পার্ক থেকে মিস্টার রায়হান
চৌধুরী তাকে ভ্যানগাড়িতে তুলে মঠে নিয়ে আসেন, গ্র“প মিলে
যাওয়ায় তিনিই তাকে রক্ত দিয়েছেন, আর তার ভাই লুসান হুমা
কীভাবে মারা গেছেন। বলাই বাহুল্য যে মঠের ভিক্ষুরা রানাকে ওই
নামেই চেনে।
প্রায় এক বছর পর ঢাকায় বসে দালিয়ানের একটা চিঠি পেল
রানা।
তার চিঠির একটা অংশ ছিল এরকমÑ‘বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুখে
সব কথা শোনার পর যে-কারও মনে এরকম ধারণা জন্মানোটা
১৬ মাসুদ রানা-৩৪৮
স্বাভাবিক যে মর্ত্যলোকে নেমে আসা কোন দেবতার পবিত্র স্পর্শে
জীবনটাকে নতুন করে ফিরে পেয়েছি আমি। কিন্তু কাউকে
দেবতার আসনে বসালে ঋণ পরিশোধ করার কোন উপায় থাকে
না, তাই আপনাকে মহৎপ্রাণ একজন মানুষ হিসাবেই ভাবতে
চাই। আমি কখনও ভুলব না যে আমাদের সম্পর্কটা এখন
রক্তের...’
ওই চিঠিতেই কয়েকটা খবর দেয় দালিয়ান। মার্কিন
দূতাবাসের কমপিউটার সেকশনে খুব ভালো একটা চাকরি
পেয়েছে সে। আগামী মাসে তার বিয়েও হয়ে যাচ্ছে। চৌচেন ঝাও
বেইজিং ভার্সিটিরই তরুণ ইংলিশ লেকচারার। পরস্পরকে
অনেকদিন ধরে ভালোবাসে তারা।
এরপর বেশ কয়েকবারই চিনে এসেছে রানা, তবে ব্যস্ততার
কারণে প্রথমবার দালিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চার বছর লেগে যায়
ওর। আনুষ্ঠানিক পরিচয়, কুশলাদি বিনিময় ইত্যাদির পর লুসান
হুমার স্মৃতি রোমন্থন করেই সময়টা পার করে ওরা।
রানার সসেড়বহ আচরণ দালিয়ানকে বুঝিয়ে দেয়, তাকে নিয়ে
ওর কোন ‘মতলব’ নেই। বুঝতে পারে, এ সম্পূর্ণ অন্য ধাতুতে
গড়া মানুষ, এর সামনে এমনকী ঠাট্টা করেও ঋণ পরিশোধের
কথাটা তোলা উচিত হবে না।
তারপর এক সময় দালিয়ার স্বামী চৌচেন ঝাওয়ের সঙ্গেও
পরিচয় হয় রানার। বুদ্ধিমান আর বিনয়ী তরুণ, দালিয়ার মত
তারও খুব ভক্তি আছে রানার প্রতি।
সেই থেকে ওদের মধ্যে শ্রদ্ধা আর সেড়বহের একটা সম্পর্ক
দাঁড়িয়ে গেছে। দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হয়, তবে পরস্পরের খবর
রাখার চেষ্টা করে।
কালো নকশা ১৭
দুই
আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি, এ-সময় অফিসে দালিয়াকে
পাওয়া যাবে না। পে বুদ থেকে দালিয়াদের ফ্ল্যাটের নম্বরে ডায়াল
করল রানা।
‘হ্যালো?’ সর্তক কণ্ঠস্বর, যেন খুব ভয়ে ভয়ে আছে।
আওয়াজটা চৌচেন ঝাওয়ের বলে চিনতে পারল রানা। ‘আমি
রায়হান চৌধুরী...’ শুরু করতে না করতে বাধা পেল ও।
‘কী বললেন? রায়হান ভাই?’ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল
চৌচেন। এক কি দু’সেকেন্ডের বিরতি, তারপরই রানাকে হতভম্ব
করে দিয়ে আবার বলল, ‘সরি, রঙ নাম্বার!’ সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিল
লাইন।
তারপরও ক্লিক করে একটা আওয়াজ শুনল রানা। তারমানে
কি আরেকটা রিসিভারে ওদের কথা শুনল দালিয়া? নাকি
দালিয়াদের টেলিফোন লাইনে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে?
অন্তত ওর মনে কোন সন্দেহ নেই যে চৌচেন রিসিভার রেখে
দেওয়ার পর আরও একজন কেউ তার রিসিভার নামিয়েছে।
তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কেটে দিয়ে বুদের ভিতরই দাঁড়িয়ে
থাকল রানা, দ্রুত চিন্তা করছে। চৌচেন ঝাও ওকে চিনতে
১৮ মাসুদ রানা-৩৪৮
পেরেছে ঠিকই, তা না হলে ‘ভাই’ বলত না। তা হলে ‘সরি, রঙ
নাম্বার’ বলার কারণ কী?
নিশ্চয়ই ওরা কোন কঠিন বিপদে পড়েছে। কিংবা পড়তে
যাচ্ছে। একটা আশঙ্কার কথা মনে জাগতে বুকটা মোচড় দিয়ে
উঠল রানার।
দালিয়া বেঁচে আছে তো ?
রঙ নাম্বার বলার কারণটা পরিষ্কারÑচৌচেনের মনে পড়ে গেছে
বা সন্দেহ হয়েছে যে ওদের ফোনে কান পেতে আছে কেউ, তাই
রানাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে যোগাযোগ কেটে দিয়েছে।
যোগাযোগ কেটে দিয়েছে নিশ্চয়ই আবার যোগাযোগ করবে
বলে। বিপদ বা রহস্য যাই হোক, সেটা কী জানতে হলে অপেক্ষা
করতে হবে রানাকে।
তবে কুবলাই খান হোটেলে নয়।
বুদ থেকে বেরিয়ে এসে এলিভেটরে চড়ল রানা। নিজের রুম
থেকে সুটকেস নিয়ে হোটেল ছাড়তে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না
ওর।
আধ মাইলটাক হেঁটে উল্টো দিক থেকে আসা একটা ট্যাক্সি
থামাল রানা, মধ্যবয়স্কা ড্রাইভার হোটেল গ্রেটওয়াল-এ পৌঁছে
দিল ওকে ।
নতুন হোটেলে উঠে নিজের স্যুইট থেকে ওর এজেন্সির
বেইজিং শাখার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করল রানা, জরুরি
কয়েকটা নির্দেশ দেবে ওদেরকে। ওর কল সরাসরি বুন লি রিসিভ
করল। সে-ই বেইজিং শাখার বর্তমান প্রধান।
‘মাসুদ ভাই!’ কে ফোন করেছে বুঝতে পেরে আবেগে আর
উত্তেজনায় কেঁপে গেল বুন লির কণ্ঠস্বর। ‘আপনিও বেইজিঙে?’
কালো নকশা ১৯
সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল রানার। ‘আমিও বেইজিঙে
মানে?’
‘ওহ্, গড! মাসুদ ভাই, আপনি সত্যি কিছু জানেন না?’
উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে বুন।
‘বেইজিংকে এখন আপনি স্পাই নগরী বলতে পারেন। এ তল-াটের
এমন কোন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ নেই যারা গত এক হপ্তার মধ্যে
নিজেদের লোক পাঠায়নি এখানে। আর ইঙ্গ-মার্কিন এজেন্টদের
কথা কী বলব! সিআইএ আর ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ গিজগিজ
করছে...’
‘কেন?’ শান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে জানতে চাইল রানা, ‘কী ব্যাপার
বলো তো?’
‘এটাই তো সবার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে, মাসুদ ভাই! কেউ
বলতে পারছে না কী ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। অথচ এদিকে
আমরা খবর পাচ্ছি বিগ ব্রাদাররা পর্যন্ত মাঠে নেমে পড়েছে...’
মনে মনে একটা ধাক্কা খেল রানা। লিজ-এর মেয়াদ শেষ হয়ে
যাওয়ায় ১ জুলাই, ১৯৯৭ সালে হংকং ছেড়ে চলে গেছে
ইংরেজরা। তবে অনেক আগেই হংকঙের মাটিতে বিভিনড়ব খাতে
নৈতিক অধঃপতনের মারাত্মক বীজ বপন করেছিল তারা, সে-সব
এখন বিশাল একেকটি মহীরুহ। মূল ভূখন্ডের সঙ্গে নতুন করে
এক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হংকঙের সেই বিষাক্ত বীজের ফলশ্র“তি,
অর্থাৎ পশ্চিমা ধাঁচের গ্যাঙস্টাররা নিজেদের পেশিশক্তি নিয়ে ঢুকে
পড়েছে সাংহাই আর বেইজিং সহ চিনের সবগুলো বড় শহরে।
এই সব মহা প্রতাপশালী গ্যাঙস্টার বা গডফাদারদের বলা হয়
‘বিগ ব্রাদার’।
বিগ ব্রাদারদের দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে
২০ মাসুদ রানা-৩৪৮
পুলিশ, তবে এখনও ঠিকমত পেরে উঠছে নাÑনানান ধরনের
ছলচাতুরীর মাধ্যমে টিকে আছে তারা মূল ভূখণ্ডে।
বিগ ব্রাদাররা সাধারণত মোটা টাকার গন্ধ না পেলে কোন
অপারেশনে আগ্রহ দেখায় না। তবে একবার যদি দেখায়, ওই
ব্যাপারটায় আর কারও কিছু করার থাকে না।
বিগ ব্রাদারদের কাজের ধারাই হলো প্রথমে একের পর এক
লাশ ফেলে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, মাঠে যাতে তারা ছাড়া আর কেউ না
থাকে।
‘আমাদের সোর্স?’ বুনকে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড
থেকে তারাও কিছু জানাতে পারেনি?’
‘আন্ডারগ্রাউন্ডে শুধু একটা গুজব শোনা যাচ্ছে, যাই ঘটে
থাকুক, তার সঙ্গে নাকি মার্কিন দূতাবাস জড়িত।’
বুনকে আরও দু’একটা প্রশড়ব করে নিশ্চিত হলো রানা, এব
্যাপারে তার কাছ থেকে আর কিছু জানার নেই। তাকে জরুরি
কয়েকটা নির্দেশ দিল ও, তারপর বলল, ‘শোনো, বুন, আমার
একটা পিস্তল দরকার, কাউকে দিয়ে হোটেলে পাঠিয়ে দাও। আর
একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি, মুখস্থ করে নাও।’
যোগাযোগ কেটে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা।
দালিয়া মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করে। আর আন্ডারগ্রাউন্ডে গুজব
ছড়িয়েছেÑযাই ঘটে থাকুক, তার সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস জড়িত।
এই দুটো তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে টেলিফোনে চৌচেন
ঝাওয়ের অদ্ভুত আচরণের একটা তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না?
রানার ধারণা, দালিয়া বা চৌচেন ওর সঙ্গে অবশ্যই
যোগাযোগ করবে। তবে সেটা আজ রাতে না হয়ে কাল সকালে
হবারই সম্ভাবনা বেশি।
কালো নকশা ২১
কাজেই, সিদ্ধান্ত নিল ও, বেজিঙের অন্যতম বিগ ব্রাদার হুন
চেননি-র একটা আস্তানায় ঢুঁ মারা যেতে পারে। ভাগ্য ভালো হলে
রানা এজেন্সির সোর্স তুন পানচু-র সঙ্গে ওর দেখাও হয়ে যেতে
পারে ওখানে।
চেহারা একটু পাল্টে নিতে আধ ঘণ্টা সময় নিল রানা। সুতি
ক্যাপের বাইরে বেরিয়ে থাকা জুলফিতে সামান্য পাক ধরেছে,
গোঁফ জোড়া পাকানো, নাকের ডগায় ঝুলে আছে ঢাউস গ-াস
লাগানো চশমা।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেইজিঙের দক্ষিণ উপকণ্ঠে চলে এল
রানা। শহর আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার মাঝখানে জায়গাটার নাম
তাইমাই।
হঙকঙ থেকে আসা বিগ ব্রাদাররা তাইমাইকে বেইজিঙের
ক্রাইম জোন হিসাবে কুখ্যাত করে তুলেছে। বিশাল এলাকা, ত্রিশ
লাখ লোকের বসবাস। পুলিশকে আমরা সাহায্য করতে চাই, একথ
া বলে এলাকাটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে এখানকার
আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে কুখ্যাত পাঁচজন বিগ ব্রাদার।
গুরুতর অপরাধ সারাক্ষণই ঘটছে এখানে, তবে সে-সব
ধামাচাপা দিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি অম্ল-ান রাখতে সম্ভাব্য সব কিছু
করছে পাঁচ বিগ ব্রাদার।
গোটা এলাকায় শুধু বৈধ মদের দোকানই আছে হাজার
দুয়েক। বলা হয় প্রতিদিন কম করেও দশ হাজার ছদ্মবেশী বেশ্যা
আসা-যাওয়া করে এখানেÑএরা আসলে কল-কারখানার শ্রমিক,
বিশেষ করে গার্মেন্টস-এর, ছুটি পেলেই উপরি রোজগারের
আশায় চলে আসে এদিকে।
আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন আলাদা জায়গায়
২২ মাসুদ রানা-৩৪৮
চোরাই মালের পাইকারী বাজারও বসে, অবৈধ আগেড়বয়াস্ত্রের
ছড়াছড়ি সেখানে।
আর বসে জুয়ার আসর।
বিশেষ করে ট্যুরিস্টদের কথা মনে রেখে সম্প্রতি ক্যাসিনো
খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, ফলে তাইমাই এলাকার প্রতিটি
হোটেলে জমজমাট জুয়ার আসর বসছে।
এলাকায় ঢোকার আধ ঘণ্টার মধ্যেই রানা এজেন্সির সোর্স বা
ইনফর্মার তুন পানচুকে খুঁজে নিল রানা। ছদ্মবেশ থাকায় ওকে
প্রথমে চিনতে পারেনি সে, ও-ই কাছে ডেকে পরিচয় দিল।
‘আপনিও চলে এসেছেন, সার?’ ছুঁচোর মত চেহারা, রানাকে
চিনতে পেরে নিজের টাকে একটা টোকা মারল পানচু। এটা তার
একটা মুদ্রাদোষ।
একটা বার-এ বসে মিনিট দশেক কথা বলল ওরা।
না, বিভিনড়ব দেশের স্পাইরা কী কারণে রাজধানীতে ভিড়
করেছে পানচু তা জানে না। তবে শুনতে পাচ্ছে মার্কিনিদের কিছু
একটা নাকি হারিয়ে গেছে।
‘কী হারিয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
চকচকে মাথাটা নাড়ল পানচু। ‘তা কেউ বলতে পারছে না,’
বলল সে। একটু পর আবার বলল, ‘তবে তিনশো ডলার দামের
একটা ইনফরমেশন আছে আমার কাছে।’
‘কী ইনফরমেশন?’ জানতে চাইল রানা।
কথা না বলে টাকে আরেকটা টোকা মারল পানচু।
মানিব্যাগ বের করে তার হাতে দুটো একশো ডলারের নোট
গুঁজে দিল রানা। ‘বলো এবার।’
প্রথমে টাকাটা পকেটে ভরল পানচু। তারপর বলল, ‘হংকঙের
কালো নকশা ২৩
মিন ভাইরাও এখন বেইজিঙে।’
‘আচ্ছা?’ শিরদাঁড়া একটু খাড়া হলো রানার। ‘চৌ আর থৌ
দু’জনই?’
টাক চুলকাল অপরাধ জগতের বাসিন্দা পানচু। ‘আমি তো
সেরকমই শুনেছি। তবে একা শুধু বড়টাকে দেখেছি, চৌ মিনকে।’
উত্তেজনা বোধ করছে রানা, কারণ জানে মায়ানমার আর
হংকঙের গোপন আস্তানা ছেড়ে মিন ভাইরা সাধারণত বেরোয় না।
তাদের মাথায় যত চুল, শত্র“র সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হবে তো
কম নয়।
তথ্য সওদাগর বলা হয় মিন ভাইদের। তাদের পণ্য হলো
এওপিওনাজ জগতের চুরি করা টপ সিক্রেট ইনফরমেশন।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ যেমন চড়া দামে কেনে, তেমনি অবিশ্বাস্য
দামে বিক্রিও করে। ওদের বেশিরভাগ তথ্যই মিলিয়ন ডলারের
কমে বিকোয় না। সব তথ্য যে কেনে তারা, তা নয়, অনেক সময়
চুরিও করে।
ক্রেতার সংখ্যা বেশি দেখলে নিজেদের পণ্য নিলামে তুলে
দেয় মিনরা। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা সবচেয়ে বেশি শোনা
যায়Ñএকই তথ্য একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। তবে
রানাকে কখনও ঠকাবার চেষ্টা করেনি তারা। রানা ওদের নাড়িন
ক্ষত্রের সমস্ত খবর জানে, আর তারাও ওর ক্ষমতা সম্পর্কে
ওয়াকিফহালÑসেটাই বোধহয় কারণ।
‘কোথায় সে?’ পানচুর হাতে আরও একটা একশো ডলারের
একটা নোট গুঁজে দিয়ে জানতে চাইল রানা।
‘আধ ঘণ্টা আগের খবর জানি, বিগ ব্রাদার হুন চেননির নতুন
ক্যাসিনোয় বসে তাস খেলছে চৌ মিন,’ বলে কাঁধ ঝাঁকাল পানচু,
২৪ মাসুদ রানা-৩৪৮
টোকাও মারল টাকে। ‘তার চারপাশে হুন চেননির স্পেশাল গার্ডরা
যেভাবে দেয়াল তুলে রেখেছে, কাছে ঘেঁষতে পারবেন বলে মনে
হয় না। দেখেন!’
তাকে টেবিলে বসিয়ে রেখে বার থেকে বেরিয়ে এল রানা।
দশ মিনিট এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ
ওর পিছু নেয়নি, তারপর কাজ শুরু করল।
হুন চেননির ক্যাসিনোয় ঢুকে চৌ মিনকে খুঁজলই না রানা।
মেইন কাউন্টারে এসে একটা কাগজে কিছু লিখল, তারপর সেটা
বাড়িয়ে ধরল একজন অ্যাটেনড্যান্টের দিকে, মেয়েটিকে দেখিয়ে
কাগজের ভাঁজে একশো ডলারের একটা নোট ঢুকিয়ে দিতে
ভোলেনি। ‘এটা এই মুহূর্তে মিস্টার চৌ মিনের কাছে পৌঁছে দিতে
হবে, পি-জ।’
রানা লিখেছে, ‘কোন্ স্পর্ধায় গর্ত থেকে বেরিয়েছ, তোমাদের কি
মরার ভয় নেই? জিনিসটা কী জানাও আমাকে। আর ক্রেতার
তালিকায় আমাকেও যেন রাখা হয়। মাসুদ রানা। মোবাইল নম্বর...’
নাকি সুরে চিঁ-চিঁ করে চৈনিক সুন্দরী বলল, ‘ইউ আর
ওয়েলকাম, সার।’ তারপর ইউনিফর্ম পরা একজন ওয়েটারকে
ডেকে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কাগজটা নিয়ে এলিভেটরের
দিকে ছুটল ওয়েটার।
আট মিনিটের মাথায় ফিরে এল সে, হাতে সেই একই কাগজ,
তবে এবার তাতে চৌ মিনের লেখা কয়েকটা লাইন রয়েছে।
রানার প্রশেড়বর উত্তরে চোরাই তথ্যের সওদাগর চৌ মিন
লিখেছে, ‘আমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে, বস্, এখানে
আমরা বিগ ব্রাদার হুন চেননির মেহমান। জিনিসটা কী এখনও
জানার সুযোগ হয়নি। তবে বলা হচ্ছে কালো একটা নকশা।
কালো নকশা ২৫
তালিকায় নাম আছে একুশজনের, আপনার নামটা তিন নম্বরে
রাখতে চেষ্টা করব। চৌ মিন।’
২৬ মাসুদ রানা-৩৪৮
তিন
জিজিয়ানা দালিয়ান আর তার স্বামী চৌচেন ঝাওয়ের ফ্ল্যাটটা
এয়ারপোর্ট রোডের উপর অভিজাত এলাকায়।
এলাকায় কোন হোটেল-রেস্তোরাঁ, বাজার-হাট বা দোকানপাট
নেই, নেই কোন পাবলিক পার্কিং ফ্যাসিলিটিও, তার উপর
সারাক্ষণ সশস্ত্র পুলিশ টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, ফলে কাছাকাছি
কোথাও থেকে ফ্ল্যাটটার উপর নজর রাখা অত্যন্ত কঠিন।
অগত্যা তাইমাই ক্রাইম জোনের পাঁচ বিগ ব্রাদারদের মধ্যে
চারজনই ওদের আশপাশে একটা করে ফ্ল্যাট ভাড়া করতে বাধ্য
হয়েছে।
একা শুধু বিগ ব্রাদার হুন চেননি এ-সব ঝামেলার মধ্যে
যায়নি। তার কাজের ধারাই আলাদা। সরকারী টেলিফোনের
দু’জন ইঞ্জিনিয়ারকে ঘুষ দিয়েছে, ফলে নিজের আস্তানায় বসে
ঝাও পরিবারের ফোন লাইনে কান পাতার সুবিধে ভোগ করছে
সে।
তারচেয়েও বড় কাজ হলো, ওই ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দাকে
জলজ্যান্ত দুটো প্রাণ আর নগদ এক লাখ মার্কিন ডলারের
কালো নকশা ২৭
বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে সে। ওই
বাসিন্দাও একজন ঝাও।
রাত আটটায় দালিয়াদের নম্বরে করা রানার ফোনটা নিজ
ক্যাসিনোর অফিসে বসে শুনল হুন চেননি। রিসিভিং মেশিনের
ভলিউম বাড়িয়ে দেওয়ায় রানা আর চৌচেন ঝাওয়ের কথা
উপস্থিত সবাই শুনতে পেল।
তার দু’পাশে নিজস্ব বাহিনীর কয়েকজন লিডার ছাড়াও সামনে
বসে রয়েছে চৌ মিন আর তার ভাই থৌ মিন। কুখ্যাত এই দুই
ভাইকে হংকং থেকে সে আনিয়েছে কালো নকশা নামে একটা
ফাইল বিক্রি করার জন্য।
ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কারণ যে জিনিস
সম্পর্কে কারও কোন ধারণা নেই, এমনকী কোথায় আছে তাও
কেউ জানে না, সেটা সে বিক্রি করতে চাইছে কীভাবে?
কেউ কিছু না জানলেও, হুন চেননি ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছুটা
অন্তত জানে। যেমনÑসিআইএ-র একজন এজেন্ট তার সঙ্গে দেখা
করে ওটার বিনিময়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার সেধেছে।
মার্কিন দূতাবাসের এক বুড়ো কর্মকর্তা টাকার অঙ্কটা আরও
বাড়িয়ে দিয়ে গেছেÑসাত মিলিয়ন ডলার।wapsip.com
এদের কাছ থেকেই প্রথম জানা যায়, মার্কিন দূতাবাস থেকে
সাত রাজার ধনটা হারিয়ে গেছে। সাত রাজার ধন মানে একটা
টপ সিক্রেট ফাইল। এই ফাইলটাকেই বলা হচ্ছে কালো নকশা।
প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া আর ভারতের ইন্টেলিজেন্সও কম
আগ্রহ দেখাচ্ছে না, বলছে পনের কি বিশ লাখ ডলার দিয়ে তারা
ওই কালো ফাইলটায় একবার শুধু চোখ বুলাতে চায়।
এরকম আরও বেশ কয়েকটা দেশের ইন্টেলিজেন্স হুন চেননির
২৮ মাসুদ রানা-৩৪৮
সঙ্গে এ-ব্যাপারে আলাপ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে।
শুধু কী তাই! একাধিক সরকারী, অর্থাৎ চিনা ইন্টেলিজেন্সও
যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে। তারা টাকার অঙ্কটা বাড়ায়নি
ঠিকই, তবে উপরি পাওনা হিসাবে ভবিষ্যতে তার অনেক কেস
হালকা করে দেখা হবে বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে।
হংকং থেকে আসা হুন চেননি সাত ঘাটের পানি খাওয়া বিগ
ব্রাদার, ঠাণ্ডা মাথায় অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কী
করবে। তার যে প-্যান, তাতে কোন সন্দেহ নেই যে কালো
নকশাটা সে-ই পেতে যাচ্ছে। প্রশড়ব হলো, পাবার পর দেবে
কাকে।
হুন চেননি খুব ভালো করেই জানে যে তাইমাই এলাকার যত
প্রতাপশালী ব্রাদারই হোক সে, সম্ভাব্য ক্রেতারা প্রত্যেকে তার
সর্বনাশ করার ক্ষমতা রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো দুনিয়ার
একমাত্র সুপারপাওয়ার আর তার নিজের দেশ হলো হিকমতে
চিন। ফাইলটা সে যার কাছেই বিক্রি করুক, সে ছাড়া বাকি সবাই
তার শত্র“ হয়ে যাবে, এবং হয়তো আক্রোশের বশে প্রতিশোধও
নিতে চাইবে।
কাজেই এত সব ঝামেলা আর বিপদের মধ্যে না গিয়ে আঙুল
তুলে একজন লোককে দেখিয়ে দেবে সে, বলবেÑফাইলটা ওই
লোকের কাছে আছে, তোমরা যে পারো কিনে নাও।
সবাই তা বিশ্বাসও করবে। কারণ লোকটাকে তারা চেনে।
তার নাম, বলাই বাহুল্য, চৌ মিন।
চৌ মিনের কাছে সত্যি থাকবেও ফাইলটা। কারণ হুন চেননি
ওটা হাতে পাওয়া মাত্র একটু দেরি না করে তার কাছেই বিক্রি
করে দেবে। এই হলো তার প-্যান। মিন ভাইদের হংকং থেকে
কালো নকশা ২৯
বেইজিংয়ে দাওয়াত দিয়ে আনার পিছনে এটাই কারণ।
দুই ভাইয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত আলাপটাও সেরে ফেলেছে হুন
চেননি। কালো নকশার বিনিময়ে মাত্র চার মিলিয়ন ডলার পাবে
সে। এর বেশিতে কিনতে রাজি করানো গেল না মিন ভাইদের।
সন্দেহ নেই এর দ্বিগুণ বা তারচেয়েও বেশি দামে বেচবে তারা।
তা বেচুক, ঝক্কি-ঝামেলাও তো কম পোহাতে হবে না তাদের।
দুই ভাইয়ের উদ্দেশ্য বা মতলব সম্পর্কে আসলে হুন চেননির
কোন ধারণা নেই। তারা পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে,
মাত্র এক লাখ ডলারে জিনিসটা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে চেননি। এক
লাখে কিনে চলি-শ লাখের কমে বেচবে না, এটা কি মেনে নেওয়া
যায়?
মিন ভাইরা চিন্তা করছে, বিকল্প অন্য কী উপায়ে
মাইক্রোফিল্মটা পাওয়া যায়। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার সুযোগ
পেলে সেটা তারা হাতছাড়া করবে কেন।
রাত আটটায় দালিয়াদের নম্বরে করা রানার ফোনটা শুনে
দু’পাশে দাঁড়ানো কর্মীবাহিনীর লিডারদের উপর চোখ বুলাল বিগ
ব্রাদার হুন চেননি। ‘এই রায়হান লোকটা কে?’
লিডাররা কেউ কথা বলছে না।
‘জানো না।’ অসন্তুষ্ট দেখাল হুন চেননিকে। ‘ঠিক আছে,
যাও, ধরে এনে লোকটার চামড়া খুলে নিয়ে গায়ে লবণ মাখাও।’
লিডাররা কেউ নড়াচড়া করার আগে মাঝখান থেকে চৌ মিন
বলল, ‘আমার ভুলও হতে পারে, তবে যেন মনে হলো ভদ্রলোকের
গলার আওয়াজটা খুব পরিচিত। আমি যদি ঠিক চিনে থাকি, তাঁকে
না ঘাঁটানোই ভালো।’
‘পরিচিত?’ হুন চেননি নড়েচড়ে বসল। ‘না ঘাঁটানো ভালো?
৩০ মাসুদ রানা-৩৪৮
মানে?’
‘একটা ইনভেস্টিগেটিং ফার্মের মালিক ভদ্রলোক, সারা
দুনিয়ায় কোথায় না শাখা অফিস খুলেছেন। চিনা সিক্রেট
সার্ভিসের এখন যিনি চিফ, তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটেন।
আসল নাম রায়হান চৌধুরী নয়, মা...’
‘চিনেছি এবার,’ চৌ মিনকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
হুন চেননি। ‘মূর্তিমান অভিশাপ।’ চিন্তিত হয়ে পড়ল সে। ‘আমরা
তাকে না ঘাঁটালেই যে পার পাব, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।’
লিডারদের দিকে ফিরে চোখ রাঙাল। ‘মাথা খাটিয়ে বের করো
কীভাবে এড়ানো যায় মাসুদ রানাকে।’
পরিবেশটা হালকা করতে চাইল চৌ মিন, বলল, ‘আপনার
ক্যাসিনোয় আছি, অথচ ভাগ্য পরীক্ষা করব না, তা কি হয়? কাজ
সেরে আমাকে ছুটি দিন, মিস্টার হুন চেননি।’
‘ঠিক, কাজটা সেরে ফেলা দরকার।’ পকেট থেকে একটা
খুদে মোবাইল সেট বের করে বোতামে চাপ দিচ্ছে হুন চেননি।
তারপর কানে তুলল সেটা। শুনতে পেল অপরপ্রান্তে রিঙ হচ্ছে।
‘মিস্টার পাওচেন ঝাও নাকি?’
অপরপ্রান্ত থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যাঁ,
মিস্টার হুন চেননি।’
‘আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মিস্টার...’
‘আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি।’
‘ওয়ান্ডারফুল! মার্ভেলস!’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল হুন চেননি।
তারপর হঠাৎ বিগ ব্রাদার সুলভ গাম্ভীর্যের সঙ্গে জানতে চাইল,
‘মিস্টার পাওচেন ঝাও, আপনি এখন কোথায়?’
‘আমি এখন আমার ভাই-ভাবীর এয়ারপোর্ট রোডের ফ্ল্যাট
কালো নকশা ৩১
থেকে বেরুচ্ছি।’
‘গুড। মিস্টার পাওচেন, আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে
আপনি সত্যি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। বলুন তো, গত
বিশ মিনিটের মধ্যে আপনার ভাই-ভাবীর ফ্ল্যাটে গুরুত্বপূর্ণ কী
ঘটেছে?’
চৌচেন ঝাওয়ের ভাই, অর্থাৎ দালিয়ার একমাত্র দেওর
পাওচেন ঝাও জবাব দিল, ‘রায়হান চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক
ফোন করেছিলেন ভাইকে।’
‘চমৎকার! এবার বলুন, ওই ভদ্রলোকের আসল নাম কি?’
‘মাসুদ রানা। ভাইয়ের ধারণা, একমাত্র এই ভদ্রলোকই নাকি
আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন।’
‘কিন্তু বাইরের কারও সাহায্য না নিয়ে, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন
আপনিই নিজেদের জন্যে যা করার করবেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ। কারণ, তা না হলে, আপনি আমাদের দুই ভাইকে মেরে
ফেলবেনÑঠিক যেভাবে আমার ভাবীর ভাইকে মেরে ফেলেছেন।’
‘বিষয়টাকে এভাবেও দেখা যায়Ñছোট্ট একটা তথ্যের
বিনিময়ে আপনাদের দু’জনের প্রাণ তো রক্ষা পাবেই, ফাও
হিসেবে এক লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কারও জুটবে কপালে।
আপনার ভাইয়ের শ্যালক আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি।’
‘আমি রাজি হয়েছি ঠিকই,’ বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলল পাওচেন ঝাও। ‘তবে সারাজীবন একটা অপরাধ বোধ বয়ে
বেড়াতে হবে, এই আর কী!’
‘এ নিয়ে আগেও আলাপ করেছি আমরা। আপনার মধ্যে কী
কারণে অপরাধ বোধ আসবে, এটা আমি এখনও বুঝতে অক্ষম।
আপনার ভাবী মার্কিনিদের একটা জিনিস চুরি করে একা শুধু
৩২ মাসুদ রানা-৩৪৮
নিজের নয়, আপনার ভাই আর আপনাকেও মারাত্মক বিপদের
মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শুধু চুরি করলে কথা ছিল, জিনিসটা সে
বেচতেও রাজি নয়। এটা কি মিথ্যে?’
‘না, মিথ্যে কেন হবে...’
‘মারাত্মক বিপদ মানে, আমরা আপনাকে হুমকি দিয়েছি,
যেভাবেই হোক ভাবীর কাছ থেকে আদায় করে ফাইলটা আমাদের
হাতে তুলে দেবেন আপনি, সেই সঙ্গে ভাবীর হদিশও জানাবেন,
তা না হলে আপনারা দু’ভাই আমাদের হাতে খুন হয়ে যাবেন।
আপনি আমাদের হুমকিটাকে গুরুত্ব দিয়ে বুদ্ধির পরিচয়
দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রাণে বাঁচার বিনিময়ে আমাদের সঙ্গে
সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছেন। ঠিক তো?’
‘এ-সব তো ঠিকই আছে...’
‘তা হলে এরমধ্যে অপরাধ কোথায়?’
‘না, মানে...ভাবীকে...মানে...’
‘আপনি কি তার মৃত্যু চাইছেন না?’ কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করল
বিগ ব্রাদার হুন চেননি। ‘যুক্তিটা তা হলে আরেকটু ব্যাখ্যা করতে
হয়, মিস্টার পাওচেন ঝাও।’
অপরপ্রান্তে চুপ করে আছে পাওচেন।
‘আপনার ভাবী দালিয়ানকে বাঁচিয়ে রাখলে এক সময় সে
ঠিকই বুঝতে পারবে যে আপনি তার সঙ্গে বেঈমানী করে ফাইলটা
আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। দালিয়ান তখন পুলিশের কাছেও
যেতে পারে। কি, পারে না?’
‘দৃঢ়চেতা, নীতিবান মানুষ...হ্যাঁ, তা তো পারেনই।’
‘পুলিশ আপনাকে তুলে দেবে সিক্রেট এজেন্টদের হাতে।
টরচার সহ্য করতে না পেরে আপনি তাদেরকে আমার নাম
কালো নকশা ৩৩
বলবেন। বুঝতে পারছেন, কি বলছি আমি? কিন্তু এটা তো আমরা
হতে দিতে পারি না, মিস্টার পাওচেন।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, বুঝতে পারছি।’
‘ধন্যবাদ, বুঝতে পারলেই ভালো। তো যাই হোক, আপনি
একশোয় একশোই পাচ্ছেন, মিস্টার পাওচেন। এবার বলুন,’ নরম
সুরে প্রশড়ব করল হুন চেননি, ‘ফোনটা পাবার পর মিস্টার চৌচেন
আপনার সঙ্গে কী আলাপ করলেন?’
‘ভাই বলল, তোর ভাবীকে জানানো দরকার মাসুদ ভাই ফোন
করেছিলেন। ভাইয়ের পক্ষে বাইরে বেরুনো সম্ভব নয়, পিছনে
লোক লেগে যায়। তাই আমাকে ভাবীর কাছে যেতে বলল।
সেখানেই এখন যাচ্ছি আমি।’
‘ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল!’ হুন চেননির উল-াস দেখে কে।
‘মিস্টার পাওচেন, কালই আপনার অ্যাকাউন্টে এক লাখ ডলার
জমা হয়ে যাবেÑপ্রমিজ! এবার বলুন, জায়গাটা কোথায়? ফাইলটা
ওখানেই আছে তো, মানে, আপনার ভাবীর কাছে?’
‘হ্যাঁ, আমি তো তাই জানি। তবে ওই ঠিকানায় নয়, ভাবী
মিস্টার রানার সঙ্গে দেখা করবেন অন্য জায়গায়। সাবধানের মার
নেই, তাই ভাই চাইছেন শহরের বাইরে দূরে কোথাও দেখা হওয়া
উচিত। দুটো ঠিকানাই লিখে নিন...’
‘হ্যাঁ, এক মিনিট। তার আগে একটা কথা। ভাবীর সঙ্গে কী
কথা হলো, ফাইলটা ঠিক কোথায় আছে, এ-সব ভালো করে
জেনে নিয়ে আমাদেরকে ফোন করবেন আপনি, ঠিক আছে?’
‘বেশ।’ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল পাওচেন ঝাও।
রাত তিনটের সময় গ্রেটওয়াল হোটেলের স্যুইটে পিপ-পিপ শুরু
৩৪ মাসুদ রানা-৩৪৮
করল রানার মোবাইল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল ওর। নিশ্চয়ই
জরুরি কোন কল, চোখ না খুলেই বেডসাইড টেবিলটার দিকে
হাত বাড়িয়ে ভাবল, ভাগ্যিস সেটটা অন করে শুয়েছিল।
মোবাইল সেটের ডিসপে-তে চোখ বুলাতেই ভুরুজোড়া কুঁচকে
উঠল রানার। ভেবেছিল ওর এজেন্সির শাখা অফিস থেকে বুন লি
ফোন করেছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা নয়Ñনম্বরটা অচেনা।
‘হ্যালো?’
‘বস্, আমি চৌ মিন। এত রাতে ঘুম ভাঙানোর জন্যে সত্যি
দুঃখিত, বস্।’
‘কেন ফোন করেছ সেটা বলো।’
‘কথাটা আমাকে বলতে বলা হয়েছে, বস্, তাই বলছি।’
‘কী কথা?’ রানা সাবধানে জানতে চাইল। ‘কে বলতে
বলেছে?’
‘তার পরিচয়টা না হয় নাই জানলেন, বস্...’
‘কী কথা?’ আবার জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ওদের সঙ্গে আপনি জড়াবেন না, বস্।’
‘ওদের সঙ্গে জড়াব না...ওদের সঙ্গে মানে কাদের সঙ্গে? তা
ছাড়া, কারও নিষেধ আমি শুনবই বা কেন?’
‘মাফ করবেন, বস্। আমাকে শুধু এটুকুই বলতে বলা হয়েছে।
আর ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি চাই না
আপনার মত সম্ভাব্য একজন ক্রেতাকে হারাই।’
কঠিন সুরে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা, ওকে থামিয়ে দিয়ে
আবার বলল চৌ মিন, ‘আজ থেকে বিশদিন পর আপনার সঙ্গে
আমার হংকঙে দেখা হতে পারে, মানে তখনও যদি ফাইলটার
ব্যাপারে আপনার আগ্রহ থাকে আর কী। কী নামে দেখা করবেন
কালো নকশা ৩৫
এখনই আমাকে জানিয়ে দিন। তারপর হংকঙের কোথায় বলছি...’
রানা কী নামে দেখা করবে শোনার পর তিন মিনিট
একনাগাড়ে কথা বলে গেল চৌ মিন, তারপর রানাকে আর কিছু
বলার সুযোগ না দিয়ে যোগাযোগ কেটে দিল।
চৌ মিনকে দিয়ে কে কথাটা বলাল সেটা না বোঝার কিছু
নেই। বিশেষ করে রানা যখন জানেই যে মিন ভাইরা বিগ ব্রাদার
হুন চেননির অতিথি হিসাবে বেইজিঙে এসেছে। হেঁয়ালির মাধ্যমে
ঠিক কী বলতে চাওয়া হয়েছে তাও পরিষ্কার।
বাথরুম থেকে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে এসে দুয়ে দুয়ে চার
মেলাবার চেষ্টা করছে রানা।
ধরে নিতে হয় হুন চেননির দলই দালিয়ানদের টেলিফোনে
আড়ি পেতেছে। কাজেই তারা ওর আর চৌচেন ঝাওয়ের
কথাবার্তা শুনেছে। ‘সরি, রঙ নাম্বার’ বললেও চৌচেন যে
রায়হানকে চিনতে পেরেছে, এটা হুন চেননির কাছে গোপন নেই।
আর রায়হানের কণ্ঠস্বর শুনে থাকলে চৌ মিন বলে দিতে
পারবে ওটা মাসুদ রানার। ও যখন চৌচেন ঝাওকে ফোন
করেছিল, আড়িপাতা যন্ত্রের অপরপ্রান্তে হুন চেননির সঙ্গে হয়তো
চৌ মিনও ছিল।
হুন চেননি এরপর স্বভাবতই ধরে নেবে চৌচেন বা দালিয়া
গোপনে যোগাযোগ করবে ওর সঙ্গে। অর্থাৎ ওদের সঙ্গে জড়িয়ে
পড়বে ও।
হুন চেননি তা চাইছে না।
অকস্মাৎ রানার মনে আশঙ্কা জাগল, দালিয়া আর তার স্বামীর
বোধহয় খুব বড় কোন বিপদ হতে যাচ্ছে।
কার্পেট মোড়া বেডরুমে পায়চারি শুরু করল রানা, মোবাইল
৩৬ মাসুদ রানা-৩৪৮
সেট অন করে দালিয়াদের নাম্বার টিপছে।
উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় শীত শীত করছে রানার। অপরপ্রান্তে
রিঙ হচ্ছে, কিন্তু কেউ ধরছে না।
আট-দশবার চেষ্টা করেও যখন সাড়া পেল না, সিদ্ধান্ত নিল
দালিয়াদের ফ্ল্যাটে যাবে।
কাপড়চোপড় পরে তৈরি হচ্ছে রানা, আরেকটা ফোন এল।
ডিসপে-তে চোখ বুলাতে বোঝা গেল বুন লির কল। প্রত্যাশায়
উন্মুখ হয়ে উঠল রানা। ‘বলো।’
‘মাসুদ ভাই,’ বুনের গলায় চাপা উত্তেজনা, ‘তিন মিনিট হলো
একটা মেয়ে পাবলিক বুদ থেকে ফোন করে আপনাকে একটা
মেসেজ দিয়েছে। ফোন নম্বরটা রাজধানীর বাইরের। মেয়েটি নাম
বলল, জি.ডি...’
স্বস্তির ঠাণ্ডা পরশ অনুভব করল রানা। জি.ডি নিশ্চয়ই
জিজিয়ানা দালিয়ান-এর সংক্ষেপ। ‘মেসেজটা দাও,’ বুনকে
নির্দেশ দিল ও।
‘বলছি, মাসুদ ভাইÑ‘‘ভয়ানক বিপদের মধ্যে আমরা। এই
সময় নিশ্চয় ঈশ্বর আপনাকে বেইজিঙে পাঠিয়েছেন। যদি পারেন
দেখা করুন এই ঠিকানায়’’। ব্যস, এটুকুই।’
‘ঠিকানাটা দাও,’ বলল রানা।
‘লিখতে হবে, মাসুদ ভাইÑপথের হদিশ ছাড়াও কিছু পরামর্শ
দেয়া হয়েছে।’ কয়েক সেকেন্ড পর মেসেজটা শুরু করল বুন।
‘সকাল আটটায় সতেরো নম্বর গেট দিয়ে নেমে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন
ধরবেন। প্রথমে চাংপিং-এর টিকিট কাটবেন, রাজপুর আর কিংঘে
হয়ে চাংপিং যাবে ওটা। ওখানে পৌঁছে ট্রেন বদলে রওনা হবেন
পশ্চিমে, নানকু হয়ে পৌঁছাবেন তাইপিনবু-র শহরতলিতে...’
কালো নকশা ৩৭
চার
সকাল ন’টার মধ্যে রাজধানী বেইজিং থেকে একশো মাইল দূরে
চলে এসেছে রানা। জায়গাটার নাম তাইপিনবু।
তাইপিনবু পাহাড়ী এলাকা, এখান থেকে যেন কয়লা খনির
মিছিল শুরু হয়েছে।
দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলছে ছয় সারি কেবল্ কার।
সবগুলোই সচল; তিনটেতে চড়ে ডিউটি সেরে ঘরে ফিরছে ক্লান্ত
একদল খনি শ্রমিক, তাদেরই আরেকটা দলকে অপর তিনটে কার
ডিউটি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি কারে বিশ-বাইশজন করে বসে
আছে ওরা।
শ্রমিকদের সবার পরনে একই পরিচ্ছদ। কালো সুতি
কাপড়ের প্যান্ট আর একই রঙের পাতলা কাপড়ের হাফ-হাতা
ফতুয়া। প্রত্যেকের মাথায় ধাতব হেলমেট, পায়ে টায়ার-সোল
জুতো।
কালিঝুলি মাখা ওরকম এক সেট কাপড়চোপড় পরে একদল
শ্রমিকের মাঝখানে বসে আছে রানা, সবার মত ওর সঙ্গেও
কাপড়ের একটা ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। দালিয়ানের পরামর্শ মেনে
নিয়ে এ-সব নানকু শহরের একটা দোকান থেকে কিনেছে ও।
৩৮ মাসুদ রানা-৩৪৮
দোকানটায় শুধু সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসই বিক্রি হয়।
চিনাদের সবারই যে নাক চ্যাপ্টা, এ ধারণা একদম ভুল।
রানার পাশেই এক তরুণকে দেখা গেল, তার নাক টিয়া পাখির
ঠোঁটের সঙ্গে বদলে নেওয়া যাবে। খনিতে কাজ করানোর জন্য
বিভিনড়ব প্রদেশ থেকে লোক আনা হয়, কাজেই তাদের চেহারা
অনেক সময় একদমই মেলে না।
রানার চেহারাও মিলল না। তারা ওকে অন্য কোন প্রদেশের
নতুন শ্রমিক বলে ধরে নিল। তাদের দু’একজনকে দালিয়ার একটা
ফটো দেখাল রানা, জানতে চাইল একে তারা কোথাও দেখেছে
কিনা। মাথা নাড়ল সবাই।
অল্প হলেও, কিছু নারী শ্রমিকও কাজ করে খনিগুলোয়; কেউ
নার্স, খনির বাইরে হসপিটাল তাঁবুতে ডিউটি দেয়; আবার কেউ
রাঁধুনি বা ঝাড়–দারনী।
হোটেল গ্রেটওয়াল ছেড়ে প্রথমবার রানা রাস্তায় নেমেছে রাত
চারটের কিছু পরে। ট্যাক্সি নিয়ে প্রথমেই এয়ারপোর্ট রোডে,
দালিয়াদের ফ্ল্যাটে চলে আসে।
নক করতে হলো না, দরজার কবাট সামান্য ফাঁক দেখে
নিঃশব্দ পায়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল রানা, কোমরে গোঁজা পিস্তলটা
বেরিয়ে এল হাতে। লিভিং রুমের মাঝখানে, কার্পেটের উপর মুখ
থুবড়ে পড়ে রয়েছে ইংরেজি ভাষার লেকচারার চৌচেন ঝাও,
দালিয়ার স্বামী।
জানত পাবে না, তারপরও পালস্ দেখল রানা। দুটো গুলি
করা হয়েছে চৌচেনকে, দুটোই বুকে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে সে।
ফ্ল্যাটটা সার্চ করে কোন ক্লু পেল না, কাজেই রানা বলতে
পারবে না কে বা কারা দায়ী। ফোন লাইন ঠিক আছে দেখে
কালো নকশা ৩৯
পুলিশকে খবরটা জানিয়ে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট থেকে। তার আগে
দেরাজ হাতড়ে পাওয়া দালিয়ার একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো
শার্টের বুক পকেটে ভরে নিয়েছে।
ওখান থেকে আবার নিজের হোটেলে ফিরে গিয়েছিল রানা।
দ্বিতীয়বার সকাল ঠিক ছ’টায় রাস্তায় বেরুবার আগে চেহারা
আরেকবার একটু পাল্টে নিয়েছে। দালিয়ানের ঠিক করে দেওয়া
সময়ের চেয়ে দু’ঘণ্টা আগে রওনা হয়েছে ও।
তিনবার কেবল্ কার বদলাতে হচ্ছে রানাকে। দোআনচি নামে
একটা পরিত্যক্ত খনিতে যাবে ও। চিনা ভাষাটা ভালোই জানা
আছে, কেবল্ কার স্টেশনের শেষ মাথায় পৌঁছে অপারেটরকে
জিজ্ঞেস করতে হবে কোন্ দিকে সেটা।
দালিয়ার ফটোটা কেবল্ কার অপারেটরদেরও দেখাচ্ছে রানা,
ওদের ভাষায় জানতে চাইছে ছবির এই মেয়েটিকে তারা আগে
কখনও দেখেছে কিনা। ইতিমধ্যে দু’জন অপারেটর মাথা নেড়ে
দেখেনি বলে জানিয়ে দিয়েছে।
তিন নম্বর কেবল্ কারের শেষ মাথায়, অর্থাৎ সর্বশেষ স্টেশনে
পৌঁছাল রানা। গোটা এলাকা খাঁ-খাঁ করছে, না আছে বাড়ি-ঘর, না
আছে রাস্তা-ঘাট। আরোহী বলতেও ও একা।
প-্যাটফর্মে নেমে অপারেটরের সামনে দাঁড়াল রানা। এই
একজন ছাড়া চারদিকে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ‘লাল
সালাম, কমরেড। আপনার নাম ফুচু ওয়াঙ। বিয়ে করেছেন
সাতটা। নাতির সংখ্যা একশো দুই। ঠিক?’
দাঁতবিহীন মাঢ়ি বের করে হেসে দিল বুড়ো। তার হাতে
একটা বই দেখা যাচ্ছে, মলাটে লেখাÑমহান দার্শনিক
কনফুসিয়াস-এর বাণী। ‘বুঝেছি, কোন কারণে আমার সহযোগিতা
৪০ মাসুদ রানা-৩৪৮
দরকার আপনার। এটা এদিককার পুরানো কৌশল। আপনি নতুন
মানুষ হলে কী হবে, খোঁজ-খবর রাখেন। আমার নাম শিশু, শিশু
চো। বলুন, আপনার কী উপকারে লাগতে পারি আমি?’
অপারেটরের সামনে দালিয়ার ছবিটা ধরল রানা।
সেটায় একবার চোখ বুলিয়েই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল
বুড়ো শিশু, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল চার-পাঁচশো গজ দূরের
একটা লেকের দিকে। হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার চেহারা।
বলল, ‘মাফ করবেন, কমরেড, আমি এ-সব বিপদের মধ্যে
জড়াতে চাই না।’
‘একটা মেয়ে কদিন হলো নিখোঁজ, লোকমুখে শুনলাম এদিকে
নাকি দেখা গেছে তাকে, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি। এর মধ্যে বিপদ
দেখলেন কোথায়?’
‘এই মাত্র আমি বোবা আর কালা হয়ে গেছি, কমরেড।’ যাত্রী
নেই, কন্ট্রোল প্যানেলের বোতাম টিপে খালি কেবল্ কারটাকে
ফেরত পাঠাচ্ছে সে।
প-াটফর্মের পিছনদিকটায় বিশ ফুট লম্বা একটা ব্যারেল দেখা
যাচ্ছে, ঘ্যারঘ্যার আওয়াজ তুলে ঘুরছে সেটা, তাতে পেঁচানো
ইস্পাতের কেবল্ খুলে যাচ্ছে দ্রুত।
পকেট থেকে ওর এজেন্সির একটা কার্ড বের করে দেখাল
রানা। ‘আমি আসলে একজন প্রাইভেট পুলিশ অফিসার,’ বলল
ও। ‘সরকার আমাকে ক্রাইম ইনভেস্টিগেট করার অনুমতি
দিয়েছে।’
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে হাত তুলে দূরের লেকটা দেখাল
বুড়ো। তারপর রানার মুখের সামনে তিনটে আঙুল খাড়া করল।
‘আগের ট্রিপে তিনজন লোক নেমেছে এখানে। ওই লেকটার
কালো নকশা ৪১
মাইল দুয়েক পুবে একটা পরিত্যক্ত খনি আছে, নাম দোআনচি,
ওটার খোঁজ করছিল।’
মুখের ভিতরটা শুকনো লাগছে রানার। ‘ঠিক বুঝলাম না,’
বলল ও। ‘তাদের সঙ্গে এই ফটোর কী সম্পর্ক?’
কঠিন চোখে রানার দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল
অপারেটর। ‘ওদের কাছেও এরকম একটা ফটো আছে।’
সর্বনাশ! রানার হাতের তালু ঘামছে। ওর আগেই পৌঁছে
গেছে কসাইরা। ‘আমার মত আরও অনেকেই হয়তো খুঁজছে
মেয়েটিকে,’ বলল ও। ‘সেটাকে আপনি বিপদ বলছেন কেন?’
‘ওদেরকে চিনি তো, তাই জানি এরচেয়ে মারাত্মক বিপদ আর
হতে পারে না।’
‘ওদেরকে আপনি চেনেন?’ রানার তথ্য দরকার।
‘একটু ভালো করেই চিনি।’ বুড়ো-শিশু একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলল।
‘কী রকম?’
‘বিগ ব্রাদাররা খুব কৌশলী, সাধারণত গরিব মানুষের ওপর
দয়া-রহম দেখায়, তাদেরকে সব সময় সাহায্য করেÑতারা যাতে
পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা না করে। কিন্তু বিগ ব্রাদার হুন চেননি
গরিব মেরে দুর্নাম কামিয়েছে। তার অত্যাচারের প্রতিবাদ করায়
আমার একমাত্র ভাইপোকে নিজের হাতে খুন করে সে।’
‘আপনি বলতে চাইছেন,’ স্পষ্ট করে জানতে চাইল রানা, ‘ওই
তিনজনের মধ্যে চেননি নিজেও আছে?’
‘নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কীভাবে, বলুন?’
এক মুহূর্ত চিন্তা করল রানা। ‘এই মেয়েটিকে আপনি...’
মাথা নাড়ল বুড়ো কেবল্ কার অপারেটর। ‘তাকে আমি চিনি
৪২ মাসুদ রানা-৩৪৮
না, কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
‘আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। ধন্যবাদ,’ বলল
রানা। ‘তবে যদি আরেকটু উপকার করতেন, হুন চেননির হাত
থেকে নিরীহ একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করতাম আমি।’
‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমি কোন বিপদে জড়াতে
চাই না?’
‘কিন্তু যদি বদলা নেয়ার সুযোগ পান?’
‘কীসের বদলা?’ বুড়োর চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠতে চাইছে।
‘ভাইপো খুন হওয়ার?’
এক মুহূর্ত চিন্তা করল অপারেটর চো। ‘আগে শুনি কী করতে
হবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’
‘আপনাকে তেমন কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই
করব,’ বলল রানা। ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনার কারে
চড়ে এখানে এসেছে লোকগুলো, কারণ আপনার স্টেশন থেকে
পরিত্যক্ত খনি দোআনচি সবচেয়ে কাছে, কাজেই ফিরবেও তারা
আপনার কারে চড়ে, ঠিক?’
মাথা ঘুরিয়ে বাকি দুটো স্টেশনের দিকে তাকাল অপারেটর।
পরস্পরের কাছ থেকে বেশ অনেক দূরে ওগুলো।
দেখাদেখি রানাও তাকাল। এদিকটায় লোকজনের আসাযাওয়া
খুবই কম। প্রায় প্রতিটি কেবল্ কার খালি আসছে,
ফিরছেও খালি। এর কারণ, এদিকের খনিগুলো কয়লাশূন্য হয়ে
গেছে, তাই পরিত্যক্ত।
গোপনে দেখা করার জন্য ভালো জায়গাই বেছেছে দালিয়া,
কিন্তু কেউ একজন বেঈমানী করেছে তার সঙ্গে। সন্দেহ নেই খুব
ঘনিষ্ঠ কেউই হবে সে, যাকে সন্দেহ করার প্রশড়বই ওঠে না।
কালো নকশা ৪৩
‘হ্যাঁ, আমার কারে চড়েই ফিরবে হুন চেননি,’ রানার চিন্তায়
বাধা দিল বুড়ো শিশু।wapsip.com
তার দিকে ফিরল রানা। ‘এবার বলছি কী করতে হবে
আপনাকে। ধরুন, ঘণ্টা দুয়েক পর স্টেশনে ফিরে আসবে
লোকগুলো। ওদেরকে আসতে দেখলে স্টেশন ছেড়ে আরেক দিক
দিয়ে কেটে পড়বেন আপনি।’
‘ব্যস? আর কিছু করতে হবে না?’
‘হবে। আমার সঙ্গে কাপড় বদলাবেন। তারপর আমাকে একটু
দেখিয়ে দেবেন কেবল্ কার কীভাবে অপারেট করতে হয়।’
‘কাছেই আমার বাড়ি, সেখানে অতিরিক্ত এক সেট ইউনিফর্ম
আছে,’ বলল বুড়ো।
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘কে থাকবে, কমরেড, আমি একা মানুষ।’ হঠাৎ চিন্তিত
দেখাল অপারেটরকে। ‘বোঝা যাচ্ছে, আপনি ওদের একটা ব্যবস্থা
করবেন। কিন্তু তারপর? আমার কী হবে? বদলা নেয়ার জন্যে হুন
চেননির লোকেরা এসে আপনাকে পাবে না, পাবে আমাকে।’
‘তারা এসে দেখবে ব্যারেলের পিছনে হাত-পা বেঁধে ফেলে
রাখা হয়েছে আপনাকে, মুখে কাপড় গোঁজা,’ বলল রানা। ‘তা
ছাড়া, দু’জন শিষ্যসহ হুন চেননি দুর্ঘটনায় মারা গেলে এলাকার
কমিউনিস্ট নেতা আর পুলিশ খুশিই হবে, প্রয়োজনে তারাই
প্রোটেকশন দেবে আপনাকে।’
‘বলছেন হাত-পা বাঁধা থাকবে আমার? নাকটা ভাঙা? কাপড়ে
শুকনো রক্ত?’
মাথা নাড়ল রানা। ‘এই বয়সে নাক ভাঙা ঠিক হবে না। তবে
নাকে-মুখে মুরগীর রক্ত মাখা যেতে পারে।’
৪৪ মাসুদ রানা-৩৪৮
‘ঝুঁকিটা মারাত্মক, তবে নিচ্ছি,’ সিদ্ধান্ত নিল অপারেটর।
‘যেন মনে হচ্ছে ঈশ্বরই আপনাকে পাঠিয়েছেন। আসুন,
মেকানিজমটা দেখিয়ে দিই।’
রানা যেমন ধারণা করেছিল, আরও প্রায় এক ঘণ্টা পর বুড়ো
শিশুর কেবল্ কারে চড়েই আসতে দেখা গেল জিজিয়ানা
দালিয়ানকে। নার্স-এর ইউনিফর্ম পরে আছে সে, হাতে ঝুলছে
ফার্স্ট-এইডের একটা ব্যাগ।
প-্যাটফর্মে, অপারেটরের পাশে, একজন খনি শ্রমিককে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তীক্ষè হলো দালিয়ার দৃষ্টি। হালকা ছদ্মবেশ
নিয়ে আছে রানা, তা সত্ত্বেও চিনে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে যেন নার্ভাস
হয়ে পড়ল সে।
কেবল্ কার দাঁড় করাল বুড়ো শিশু।
প-্যাটফর্মে পা দিয়েই ইংরেজিতে জানতে চাইল দালিয়া,
‘মাসুদ ভাই, আপনার তো এখানে থাকার কথা নয়...’
‘জানি,’ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা। ‘কিন্তু আমার যখন
দোআনচিতে পৌঁছানোর কথা, তার দু’আড়াই ঘণ্টা আগেই ওখানে
পৌঁছে গেছে দুই সঙ্গীকে নিয়ে এক বিগ ব্রাদার।’ খপ করে তার
একটা হাত ধরে টান দিল ও। ‘এসো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা
নিরাপদ নয়।’ লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল
ওরা।
‘বিগ ব্রাদার...কে?’ ঢোক গিলে জানতে চাইল দালিয়া।
‘হুন চেননি।’
‘ঈশ্বর!’ শিউরে উঠল দালিয়া। ধাপের উপর দাঁড়িয়ে পড়ল
সে, টলছে। খালি হাত দিয়ে রানার কাঁধ খামচে ধরে তাল
কালো নকশা ৪৫
সামলাল। ‘ওই লোকটাই আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে!’ তারপর
তার খেয়াল হলো। ‘মাসুদ ভাই, হুন চেননি জানল কীভাবে
আপনার সঙ্গে দোআনচিতে দেখা করব আমি?’
রানা ভাবল, দালিয়া বোধহয় এখনও জানে না যে তার স্বামীও
বেঁচে নেই। ‘শান্ত হও, দালিয়া। আগে চলো ফাঁকা জায়গা থেকে
সরে যাই।’
‘এটা শুধু আমরা তিনজন জানি, মাসুদ ভাই! আমি, আপনি
আর আমার দেওর পাওচেন।’
‘এ নিয়ে পরে কথা বললে হয় না, দালিয়া?’
লেকের উল্টোদিকে এক-দেড়শো গজ হাঁটল ওরা, তারপর
একটা পাথুরে টিলাকে পাশ কাটাল। সামনে পড়ল টিনের
একচালা, নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ো শিশুর ঠাঁই।
পকেট থেকে চাবি বের করে এক হাত দিয়েই তালা খুলল
রানা। ছোট একটা ঘরে ঢুকল, এখনও দালিয়ার হাত ছাড়েনি।
‘এখানে শান্ত হয়ে বসো।’ ঘরটার ভিতর একটাই কাঠের
চেয়ার, সেটায় দালিয়াকে বসিয়ে দিয়ে জানালা খুলে বাড়ির
সামনের দিকটায় চোখ বুলাল রানা। ‘এদিকে কাউকে আসতে
দেখলে পিছনের ঘরে চলে যাবে তুমি, কেমন? মানে, কেউ যেন
তোমাকে দেখতে না পায়। খুব বেশি দেরি হবে না আমার, এই
ঘণ্টাখানেক। সদর দরজায় তালা দিয়ে যাচ্ছি...’
হঠাৎ কিছু মনে পড়তে থেমে গেল রানা, তারপর দালিয়ার
সামনে একটা হাত পাতল। ‘যে জিনিস নিয়ে এত কিছু, সেটা
দেখি তো একবার।’
অপ্রতিভ দেখাল দালিয়াকে। ‘ওটা তো আমি আনিনি, মাসুদ
ভাই! আমার দেওর পাওচেনের কাছে রেখে এসেছি।’
৪৬ মাসুদ রানা-৩৪৮
হাতটা ফিরিয়ে নিল রানা। ‘পাওচেন এখন কোথায়,
দালিয়া?’ ওর চেহারা থমথম করছে।
‘তার শ্বশুরবাড়ি, নানকুতে।’
‘সেখানে আর কে আছে?’
‘বউ সহ বাড়ির সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে সে
একা...’
‘হুঁ।’ রানাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি...’
‘মাসুদ ভাই, ওদের সঙ্গে না লেগে কি সমস্যার সমাধান করা
যায় না?’
মাথা নাড়ল রানা। তারপর দালিয়ার কাঁধে একটা হাত রাখল।
‘উত্তর দিচ্ছি, দালিয়া, তার আগে নিজেকে শক্ত করো তুমি,’ ভারী
গলায় বলল ও। ‘তুমি তোমার স্বামীকে হারিয়েছ। আমার ধারণা
দেওরকেও। এখন যদি চেননির একটা ব্যবস্থা করা না যায়,
এরপর আমরা তোমাকেও হারাব।’
রানাকে দু’হাতে খামচে ধরে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল
দালিয়া। ‘চৌচেনকে...চৌচেনকে ওরা মেরে ফেলেছে? হায় ঈশ্বর,
সেজন্যেই ফোনে পাইনি ওকে...’ রানার বুকে মাথা রেখে হু-হু
করে কেঁদে উঠল মেয়েটা।
দু’মিনিট পর টিনের একচালায় তালা দিয়ে কেবল্ কার
স্টেশনে ফিরে এল রানা। ওর পরনে এখন কেবল অপারেটরের
ইউনিফর্ম।
কালো নকশা ৪৭
পাঁচ
প্রায় চলি-শ মিনিট অপেক্ষা করার পর সঙ্গীদের নিয়ে হুন চেননিকে
বাঁক ঘুরে লেকের পাড়ে পৌঁছাতে দেখল রানা। ইতিমধ্যে বুড়ো
শিশুকে স্টেশনের ছাদে তুলে দিয়েছে ও, সেখানে তার কাজ কোন
শব্দ না করে শুয়ে থাকা।
কাছাকাছি আসতে দেখা গেল প্রচণ্ড রেগে আছে চেননি। রক্ত
ভরা স্বচ্ছ বেলুনের মত লাগছে তার লাল মুখটাকে। লোহার সিঁড়ি
বেয়ে প-াটফর্মে ওঠার সময় তার নিঃশ্বাস ফেলার ফোঁস-ফোঁস
আওয়াজ শুনতে পেল রানা। তিনজনের কেউই কথা বলছে না।
প-াটফর্মে উঠেই ছদ্মবেশী রানার দিকে কটমট করে তাকাল
চেননি। ‘এই, ছোকরা! এদিকে আয়। তোর বুড়ো বাপ কোথায়
গেল, ঘণ্টা তিনেক আগে যে ডিউটি দিচ্ছিল?’
কনফুসিয়াসের বইটা বন্ধ করে টুল ছেড়ে দাঁড়াল রানা, দু’পা
এগিয়ে এসে মান্ডারিন ভাষায় বলল, ‘তার শেষ, আমার শুরু।’
‘তুই এখানে কখন থেকে ডিউটি দিচ্ছিস?’
‘তা ঘণ্টা দুয়েক তো হবেই।’
‘কেবল কার থেকে এই মেয়েটাকে নামতে দেখেছিস?’
৪৮ মাসুদ রানা-৩৪৮
দালিয়ার ফটোটা রানার সামনে ধরল চেননি।
মাথা নাড়ল রানা। ‘কোন প্যাসেঞ্জারই তো নেই, খালি কার
আসা-যাওয়া করছে।’
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now