বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

মাসুদ রানা - আসছে সাইক্লোন (পার্ট ২) শেষ পর্ব

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X ১০২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ বেলপ্যানে, তোমাল্ডে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে একটা ক্যু করতে যাচ্ছে তারা।’ তারপর যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে বলে গেল রানা। ‘এখন কী হবে?’ রানা থামতে জানতে চাইল ম্যারিয়েটা। ‘দূরত্ব তো প্রতি মুহূর্তে কমছে।’ ‘হেলমটা ধরো একবার, দেখি কী বল্টস্থা করা যায়,’ বলল রানা। ‘এটা ঠিক যে কোন অবস্থাতেই ধরা দেয়া যাবে না। আচ্ছা, তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ, নাকি ব্যাপারটা স্রেফ আমার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল?’ ম্যারিয়েটা হাসল তো না-ই, বরং আরও ¤−ান হয়ে গেল তার চেহারা। ‘হ্যাঁ, লুকাচ্ছি।’ ‘নিশ্চয়ই বলবে না কি লুকাচ্ছ?’ ‘বলব। দাদু কোথায় আছেন, এই তথন্ধা। কাউকে বলতে আমাকে মানা করে গেছেন।’ ‘তিনি জানেন তুমি আমাকে চিঠি লিখেছ, আমি আসছি?’ মাথা ঝাঁকাল ম্যারিয়েটা। ‘একবার বলেছিলাম, মনে রেখেছেন কিনা বলতে পারব না।’ এক মুহূর্ত চিন্তা করে রানা বলল, ‘কাউকে জানাতে মানা যখন করেছেন, নিশ্চয়ই তার সঙ্গত কারণও আছে। আপাতত আমার না জানলেও চলবে কোথায় আছেন তিনি। তবে যেখানেই থাকুন, সেখানে তাঁর নিরাপত্তা আছে তো?’ আরও ¤−ান হয়ে গেল ম্যারিয়েটার চেহারা। ‘আমি ঠিক জানি না।’ ‘হুম।’ গম্ভীর দেখাল রানাকে। হেলম্টা ম্যারিয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে লকার থেকে প্রকাণ্ড একটা তেকোনা পাল বের করল ও। ঝড়টা এখনও এসে পৌঁছায়নি, দমকা বাতাসের মতিগতি বোঝা ভার, অথচ সাগর এখন এত বেশি উত্তাল যে রিফটাকে খুঁজে বের করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লেগে গেল রানার। শেষবার রানা ওটাকে আসছে সাইক্লোন ১০৩ টপকে এসেছে বিভিন্ন আকারের পাল-এর সাহায্যে, তখন প্রবালপ্রাচীরের মাথাগুলো সারফেসের সঙ্গে একই লেভেলে ছিল। এখন, কাছে চলে আসা ঝড়ের প্রভাবে ঢেউগুলো বড় হয়ে ওঠায়, সেগুলো দেখাই যাচ্ছে না। তবে আছে ওগুলো, ওল্ডে নাক বরাবর সামনে, ক্ষুরের মত ধারাল ও বিপজ্জনক। ওগুলোর একটার ঘষা গ্রাসিয়াসের তলা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে চিরে ফেলবে। বাতাসের সাধারণ প্রবাহ রিফ সারির সঙ্গে লম্বালম্বি, অর্থাৎ সমান্তরাল হওয়ায় ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বাধাটা পেরুবার চেষ্টা করবে রানা, তবে সেজন্য এবারও পাল ল্ডকার হবে। সদ্য বের করা বিরাট পাল-এর রশিটা ধরে পিছন দিকে তাকাল রানা। পেট্রল বোট আগের চেয়ে অনেক কাছে চলে এসেছে, মাত্র দুশো গজ পিছনে এখন সেটা। বো থেকে ছিটকে পড়া পানিও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। হুইলহাউসে স্ফাড়ানো মূর্তিটা অবশ্য ঝাপসা। রিফ পঞ্চাশ ফুটেরও কম দূরে। ম্যারিয়েটার দিকে ফিরে অভয় দিয়ে হাসল রানা। সাহস যোগানোর খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হলো না। নাক বরাবর সোজা রিফ-এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে, চোখে-মুখে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস। টিলার-এর বাহু এত জোরে চেপে ধরে আছে, রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে গিঁটগুলো। দু’বছর আগের সেই মেয়েটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু শরীর- স্বাস্থ্যে নয়, মন-মানসিকতায়ও পরিণত হয়ে উঠেছে। আবার রিফ চেক করল রানা। ত্রিশ গজ। ওল্ডেকে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য প্রবালের তৈরি ধারাল হাঙরের স্ফাত অপেক্ষা করছে। ‘সিধে করে ধরে রাখো গ্রাসিয়াসকে!’ গলা চড়িয়ে বলল রানা, তারপর একটা দমকা হাওয়া আসতেই দ্রুত রশি টেনে বড় তেকোনা পালটা তুলে ফেলল মাস্তুলের মাথায়। বিরাট লাল পালটা বিস্ফোরিত হয়ে খুলে গেল। সেই সঙ্গে যেন ১০৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ আকস্মিক কোনও উন্মাদনায় অস্থির হয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটল ওল্ডে ক্যাটামার‌্যান। খোল প্রায় পানি ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। মাস্তুল নত হলো কোনও তীরন্দাজের লংবো-র মত। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, বলতে গেলে কিছুই টের পায়নি, রিফ পার হয়ে এল ওরা। পাল-এর রশি ছেড়ে দিল রানা, মাস্তুল থেকে মুক্ত হচ্ছে পালটা। লাফ দিয়ে ককপিটে ফিরে এল ও, ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি পেট্রল বোটের বো-র দিকে তাকাল। মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য বো ক্যানন-এর আশপাশে স্ফাড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পেল রানা। তারপরেই সংঘর্ষের বিকট আওয়াজ ভেসে এল। বোটের তলা ছিঁড়ে ফেলেছে ধারালো প্রবাল। রানা দেখল গান শিল্ড ছিন্নভিন্ন করে ফেলল সৈনিক ও নাবিকল্ডে। মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে থাকল পেট্রল বোট, তারপর রিফ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা করে নিল, পিছনটা ভেঙে গেছে, বেরিয়ে এসেছে ত্রিশ ফুট বো সেকশন। তারপরই বিকট আওয়াজ শোনা গেল, আগুন ধরে গেছে ফুয়েল ট্যাংকে। ম্যারিয়েটাকে ককপিটের এক কোণে টেনে এনে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখল রানা, ওল্ডে চারপাশে বৃষ্টির মত খসে পড়ল পেট্রল বোটের কিছু এবড়োখেবড়ো টুকরো। ধাওয়া রত বোটের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। এরপর থেকে ঝড়ের প্রচণ্ডতা ক্রমশ বাড়তে শুরু করল। আর বড়জোর বিশ মিনিট, আন্দাজ করল রানা, তারপর ওল্ডে উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সাইক্লোন। ‘ব্যাপারটা শুরু হলে মাস্তুল ভেঙে পড়বে,’ ম্যারিয়েটাকে সাবধান করে দিয়ে বলল রানা। ‘তুমি বরং নীচে চলে যাও।’ ম্যারিয়েটা কিছু বলল না। ওখানেই স্ফাড়িয়ে থাকল সে। আসছে সাইক্লোন ১০৫ ওরা এখন দেখতে পাচ্ছে সামনের সাগরে অসংখ্য গভীর গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলোর পাশেই আকাশ ছোঁয়ার জন্য উঁচু হচ্ছে দৈত্যাকার ঢেউ, সেগুলোর মাথা ভাঙতে ভাঙতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আরও দূরে অনবরত চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ, তার চোখ- ধাঁধানো আলোয় ড্রাগনের টকটকে লাল জিভ বলে মনে হচ্ছে ভাঙা ঢেউয়ের মাথাগুলোকে। তারপর, যেন চোখের পলকে, ওল্ডে মাথার উপর চলে এল সেই মহাদুর্যোগ Ñ ভয়ঙ্কর সাইক্লোন জোসেফিন। ক্যাটামার‌্যানের আশপাশে একের পর এক বাজ পড়তে শুরু করল। গতি হারিয়ে স্থির হয়ে গেল সময়। চারপাশে ঝড়ের তাণ্ডব Ñ কতক্ষণ ধরে চলছে বা আরও কতক্ষণ চলবে, কিছুই বলতে পারবে না রানা। ঢেউগুলো ক্যাটামার‌্যানকে এক টানে মাথায় তুলে নিয়ে নাচছে। মাথাগুলো এত উঁচু, সেগুলোর উপর ওঠার পর মনে হচ্ছে যেন আকাশ ছোঁয়া যাবে। পাশেই গভীর খাদ। একবার এদিকে একবার ওদিকে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হচ্ছে বোট, যেন একটা খেলনা জলযান। এখনও কীভাবে বেঁচে আছে ভেবে অবাক লাগছে রানার। বৃষ্টি যেন জলপ্রপাত, ওল্ডেকে ডেকের সঙ্গে শুইয়ে দিচ্ছে। ভাগ্যিস কোর্স বদলে মাকা নদীর দিকে গ্রাসিয়াসকে চালাবার দায়িত্ব আগেই অটো-পাইলটকে দিয়ে রেখেছিল রানা। তারপর ক্যাটামার‌্যানে উঠে এল সাগর। ম্যারিয়েটাকে ধরতে হয়নি, সেই ডাইভ দিয়ে এসে পড়েছে রানার বুকে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। বোটে চড়াও হয়ে ভেঙে পড়ছে ঢেউগুলো। কাঁচ না থাকায় ককপিটে ঢুকে খোলা সেলুন দিয়ে তীব্র স্রোত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পানি। যেন এখানে থাকতে আর ভাল লাগছে না, দড়িষ্ণা ছিঁড়ে সাগরে নেমে গেল যোডিয়াকটা। মাস্তুলের মাথার দিকটা, ক্রসট্রি-র কাছে, ভেঙে গেল। এক মুহূর্ত পর মেইন সেকশনে ফাটল ধরল, একেবার ১০৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ গোড়ার কাছ থেকে। ম্যারিয়েটার শক্ত বাঁধন থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে রানা। ‘ক্রল করে সেলুনে ঢুকব আমরা,’ তার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল রানা। মাথা ঝাঁকাল ম্যারিয়েটা। রানা ভাবছে, ওল্ডে মত ক্যু-র উদ্যোক্তারাও জোসেফিনের হাতে আগামী চব্বিশ ঘণ্টা বন্দি হয়ে থাকবে। টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে এয়ারপোর্ট। গাছ পড়ে গাড়ি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে হাইওয়ে। ওর একার পক্ষে অভ্যুত্থানটা ব্যর্থ করে ত্থেয়া সম্ভব নয়। মধঞ্জামেরিকার দেশগুলোয় দেখা গেছে ক্যু হলে প্রথমেই সাধারণত মন্ত্রীল্ডেকে এক এক করে খুন করা হয়। রানা জাদুকর নয় যে তাঁল্ডেকে বাঁচাতে পারবে। কে কোথায় আছেন, কিংবা তাঁল্ডে মধ্যে কেউ ক্যু-র সমর্থক কি না, কিছুই জানা নেই ওর। রানা একা শুধু প্রেসিডেন্ট রোকো রামপামকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সম্ভবত বিপজ্ঝাঁচ করতে পেরে, এবং সময় মত কোথাও থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ কোথাও সরে গেছেন তিনি। কলিজার টুকরো নাতনিকে একা রেখে? ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না। ভাবছে ও। আসছে সাইক্লোন ১০৭ আট বিদ্যুচ্চমক ও বজ্র নিয়ে মত্ত মেঘগুলো ওল্ডেকে ছাড়িয়ে উত্তর দিকে চলে গেলেও বাতাসের দাপট তেমন একটা কমেনি। তবে কমে যাবে। রানা জানে, জোসেফিনের সামনের কিনারাটা ওল্ডেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে বলে এখন কিছুক্ষণ ঝড়ের মাঝখানের শান্ত এলাকায় থাকবে ওরা, তারপর আসবে সাইক্লোনের শেষ অংশ। সেটা আবার কতটা কী ক্ষতি করবে কে জানে! ইতিমধ্যেই সাগরের ভাষা বদলে গেছে, ঢেউগুলো আগের চেয়ে বেশ কিছুটা কম শক্তি নিয়ে ছুটে আসছে ক্যাটামার‌্যানের দিকে; ডেকের উপর আর চড়াও হচ্ছে না। মাকা নদীর মোহনায় পৌঁছাবার জনঞ্জাগেই গ্রাসিয়াসের কোর্স বদল করেছিল রানা, ব্রিজ-ডেকে গাছপালার ঘষা লাগার আওয়াজ পেয়ে বুঝল প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ওল্ডেকে রিফ-এর উপর দিয়ে মেইনল্যান্ডের কাছে নিয়ে এসেছে। এটা সেটা ধরে ক্রল করছে রানা, ককপিট সংলগ্ন কম্প্যানিয়নওয়েতে চলে এল। জলপ্রপাতের মত বৃষ্টির মধ্যে দৃষ্টিসীমা একশো ফুটের বেশি নয়। ক্যাটামার‌্যানের চারপাশে ছিন্নভিন্ন ম্যানগ্রোভ, পাতা, ডাল, ঘাসের চাপড়া ও সামুদ্রিক শ্যাওলার স্তূপ অনবরত উথলাচ্ছে। একটা পাম্প চালু করল রানা, ককপিটে জমে থাকা পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। ম্যারিয়েটাকে আগেই সেটিতে বসিয়ে রেখে গেছে, ফিরে ১০৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ এসে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘আমরা সাগর থেকে উঠে এসেছি। ঝড় না থামা পর্যন্ত অ্যাকশনে যেতে পারবে না ওরা।’ উত্তরে কিছু বলল না ম্যারিয়েটা। গ্যালিতে নেমে এসে স্টোভ জ্বালল রানা। প্রেশার কুকারে এক কৌটা টমেটো-সুপ আর ইঞ্চিখানেক পানি ঢালল। পাঁচ মিনিট গরম করার পর দুটো মগে ভরল ধূমায়িত সুপ। ফিরে এসে একটা মগ ধরিয়ে দিল ম্যারিয়েটার হাতে। কয়েকটা চুমুক দিয়ে ম্যারিয়েটা বলল, ‘আপনি আমাকে দ্বীপটায় রেখে এলে এতক্ষণে আমার সলিলসমাধি হয়ে যেত।’ ‘তা কেন, আগেই পেট্রল বোটটা তোমাকে তুলে নিয়ে যেত।’ ‘সেটা বুঝি ডুবে মরার চেয়ে ভাল হত?’ রানার দিকে একটু বাঁকা চোখে তাকাল ম্যারিয়েটা। মাথা নাড়ল রানা। ‘সাইক্লোনেরও কি আই অভ দ্য স্টর্ম আছে?’ জানতে চাইল ম্যারিয়েটা। ‘আছে বইকি,’ বলল রানা। ‘ওটার কাছাকাছিই আছি আমরা। মনে হয় ঘণ্টা খানেকের মত আবহাওয়া শান্ত পাব আমরা। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।’ ম্যারিয়েটাকে বসতে বলে ওর মোটরসাইকেল বিএমডবি−উ-র কাছে চলে এল রানা। কাভারটা সরিয়ে দেখল, ভিতরে এক ফোঁটাও সাগরের পানি ঢোকেনি। প্রথমবারের চেষ্টাতেই স্টার্ট নিল ইঞ্জিন, ঘাড় ফিরিয়ে ম্যারিয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। দশ মিনিট পর ম্যারিয়েটার হাতে মগ ভর্তি ধূমায়িত কফি ধরিয়ে দিল রানা। খানিক পর বলল, ‘প্রেসিডেন্টকে না পেলে ওল্ডে ক্যু সফল হবে না। আমি যদি সময় মত তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারি, মন্ত্রীল্ডে অন্তত কয়েকজনকে বাঁচানো সম্ভব হবে।’ ‘দাদু পাইন রিজ-এ আছেন,’ বিড়বিড় করল ম্যারিয়েটা। আসছে সাইক্লোন ১০৯ শিরস্ফাড়া খাড়া করল রানা। ‘পাইন রিজের কোথায়?’ ‘ওখানে দাদুর একটা কেবিন আছে,’ বলল ম্যারিয়েটা। ‘একটা পরিত্যক্ত কোয়ারির পাশে। বক্তৃতা বা অন্য কিছু লেখার প্রয়োজন হলে ওখানেই তিনি যান...’ চোখ ঘুরিয়ে আরেকদিকে তাকাল সে, যেন নিজের অসহায় ভাব ও দুঃখ রানার কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টায়। ‘বলেছেন তিনি ওখানে আছেন এ-কথা কাউকে বলা আর তাঁকে খুন করা, একই ব্যাপার।’ ‘হুঁ।’ মোটরসাইকেলের ওয়াটারপ্র“ফ পাউচ থেকে বের করা ম্যাপটার ভাঁজ খুলল রানা। ‘তুমি আমাকে দেখাতে পারবে কেবিনটা কোথায়?’ আরও আধ ঘণ্টা পর রানাকে অবাক করে দিয়ে ম্যারিয়েটা জানাল, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দুই কূল প−াবিত হয়ে যাওয়ায় মাকা নদীটাকে প্রথমে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল তার, তবে এখন সে নিশ্চিত তাল্ডে ক্যাটামার‌্যান মাকা নদীরই একটা শাখা ধরে এগোচ্ছে। খুশি হলো রানা। ‘তার মানে পাইন রিজের কাছে চলে এসেছি আমরা।’ তবে ম্যাপে চোখ রেখে দুর্গম এলাকাটার বৈশিষ্ট্যগুলো যখন মনে পড়ল, মনটা দমে গেল ওর। ও যখন প্রথমবার বেলপ্যানে আসে, ওকে নিয়ে এদিকটায় একবার বেড়িয়ে গেছে ম্যারিয়েটা। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের পর কর্কশ ঝোপ, লেগুন ও সরু আখ খেত। জলোচ্ছ্বাসটা ওল্ডেকে আরও দুই কি তিন মাইল ভিতরে নিয়ে যাবে, তার মানে ক্যাটামার‌্যান থেকে নামলেই প্রথম রিজের সামনে পড়বে ও। ওটা পার হলে দেখা যাবে কাঁটাঝোপে ঢাকা ঢেউ খেলানো প্রান্তর। মায়ানল্ডে যুগে চাষবাস হত, লোকজন না থাকায় সেই থেকে অযতেœ ফেলে রাখা হয়েছে। ১১০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ এরপর পাহাড়ী এলাকা। নীচের দিকের ঢালগুলোকে ঢেকে রেখেছে রেইনফরেস্ট। সবচেয়ে বড় পাহাড়ী রিজটা বেলপ্যান ও মাকা নদীর ও তার শাখাগুলোর মাঝখানে বিস্তৃত। বহু বছর হলো, সেই স্প্যানিশ হামলার যুগে, রিজের রেইনফরেস্ট থেকে বল্টসার উদ্দেশে কাঠ সংগ্রহ করা হত। পরে গোটা বনভূমিকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। অভয়ারণেশু পাঁচশো ফুট নীচে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আসা এক আমেরিকান একটা বাড়ি তৈরি করে থাকত। ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ট্যুরিস্টল্ডে পুরানো লগিং রোড ও পাহাড়ী ট্রেইলে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ছিল তার পেশা। কে জানে, লোকটা হয়তো আজও ওখানেই আছে। তবে ট্যুরিস্টরা আসতে এখনও এক মাস বাকি। প্রেসিডেন্টের কেবিন অভয়ারণেশু তিন মাইল ভিতরে। উত্তর- দক্ষিণে বিস্তৃত হাইওয়েটা মাকা নদীর উত্তর পাশ দিয়ে চলে গেছে, ওটা ধরে বারো মাইল এগোবার পর বাঁক ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তায় পড়তে হবে, তারপর পাওয়া যাবে সেই কেবিন। সকাল সাড়ে এগারোটা। মনে মনে একটা হিসাব করে নিল রানা। সাইক্লোনটা আট কি দশ ঘণ্টা টিকবে। ঝড়ের শান্ত মাঝখানটা ওল্ডে কাছাকাছি চলে আসছে। যতটা মনে করা হয়েছিল, মাকা নদীর শাখা ধরে তারচেয়ে অনেক বেশি উত্তরে চলে এসেছে ওরা। ম্যারিয়েটা তাকিয়ে আছে, তৈরি হতে শুরু করল রানা। শটগানের ক্যানভাস ¯ি−ংগুলো অ্যাডজাস্ট করতে হলো, অস্ত্র দুটো যাতে বুকে ও পিঠে ঝুলিয়ে বহন করা যায়। প্রতিটি স্যাডলব্যাগে আট বাক্স করে বাকশট। ছোট্ট, শক্তিশালী বিনকিউলারটা ঢুকল কমব্যাট জ্যাকেটে। আরও সঙ্গে থাকল সোয়া একইঞ্চি চওড়া পার্সেল টেপ, পঞ্চাশ ফুট লাইট লাইন, স্টিল হ্যামার, আধ ডজন স্টিল স্পাইক, স্পেয়ার কমব্যাট জ্যাকেট, গোট দুই জাঙ্গল ট্রাউজার, ব−্যাক কটন রোল-নেক, ব−্যাক আসছে সাইক্লোন ১১১ কটন গ−াভস, সবশেষে ম্যারিয়েটার জন্য ¯−্যাকস ও জাম্পার। রানার থ্রোয়িং-নাইফটা রয়েছে শ্যাময় লেদার পাউচে, সেটা দুই শোল্ডার বে−ডের মাঝখানে রেখে গলায় পরা লাল পুঁতির মালাগুলো অ্যাডজাস্ট করল ও, যাতে পাউচের বাইরে বেরিয়ে থাকা ছুরির হাতল কারও চোখে না পড়ে। দশ ইঞ্চি লম্বা একটা হান্টিং নাইফ নিল ও, নাভির কাছে বেল্টে গোঁজা থাকল সেটা। ওয়ালথার পিস্তলের জন্য তিনটে স্পেয়ার ম্যাগাজিন নিতেও ভুলল না। ‘গ্রাসিয়াসে নিরাপদেই থাকবে তুমি,’ নরম সুরে বলল রানা। ‘একসময় ঝড়টা থেমে যাবে, তখন তীরে নেমে কোথাও আশ্রয় নিয়ো। তবে যেখানে রেখে যাব সেখান থেকে বেশি দূরে কোথাও চলে যেয়ো না, তা হলে ফিরে এসে তোমাকে আমি আর খুঁজে পাব না।’ ‘সতিঞ্জাপনি ফিরবেন তো?’ তিক্ত একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে। ‘আমি অমর নই, ফিরতে নাও পারি। সেক্ষেত্রে সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকোয় চলে যেয়ো।’ মাথা নাড়ল ম্যারিয়েটা। ‘আমি আপনার সঙ্গে থাকছি,’ বলল সে। ‘কারণ আমি আপনাকে বেলপ্যানে ডেকে এনেছি, দাদু নন। তাই আপনার প্রথম দায়িত্ব আমাকে রক্ষা করা, আমাকে ফেলে কোথাও চলে যাওয়া নয়।’ হাসতে গিয়ে বাধা পেল রানা, সাইক্লোনটা হঠাৎ গ্রাসিয়াসকে ডাঙায় তুলে ত্থেয়ায় ছিটকে মোটরসাইকেলের উপর গিয়ে পড়ল ও। ক্যাটামার‌্যানের পিছনটা পাথরে বাড়ি খেয়েছে, বাতাসের আর্তনাদকে ছাপিয়ে উঠল মড়াৎ করে রাডার ভাঙার আওয়াজ। লাফ দিয়ে পোর্টসাইড পাম্পের দিকে ছুটল রানা। খোল থেকে বাকি পানি সরাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল ও, জানে তা না হলে ওই ১১২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ পানির ওজন ক্যাটামার‌্যানটাকে ভেঙে দুই টুকরো করে ফেলতে পারে। ‘আর দয়া করে বলবেন না যে জার্নিটা মেয়েল্ডে জন্যে খুব কঠিন,’ চিৎকার করে বলল ম্যারিয়েটা। সেলুন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। এক মিনিট পর স্টারবোর্ড সাইডের পাম্পটা সচল হওয়ার আওয়াজ পেল রানা। বাতাসের অকস্মাৎ থেমে যাওয়া গোটা পরিবেশে এমন পরিপূর্ণ নীরবতা এনে দিল যে রানা ও ম্যারিয়েটা এক মুহূর্ত নড়তে পারল না। ধাক্কা দিয়ে ল্ডজাটা খুলল রানা। রশি খুলে মোটরবাইকটাকে মুক্ত করল ও, সেলুনের ভিতর থেকে বের করে আনল ককপিটে। তারপর, এতক্ষণে, জমিনের দিকে তাকাল। প্রথমে যেখানে ধাক্কা খেয়েছিল সেই পাথুরে জায়গাটাকে পিছনে ফেলে একটা ঘেসো জমিতে উঠে এসেছে গ্রাসিয়াস। এখনও বৃষ্টি পড়ছে, তবে জলপ্রপাতের মত পুরু হয়ে নয়। প্রকাণ্ড, বৃত্তাকার একটা ঝড়ো মেঘ মাটি থেকে উঠছে বলে মনে হলো, আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে পাক খাচ্ছে। আরেকদিকে দেখা গেল পাহাড়শ্রেণী, নীচের দিকে কালচে-সবুজ রেইন-ফরেস্ট। স্টার্নে গ্যাঙপ−্যাঙ্ক ফেলল রানা, মোটরসাইকেল নিয়ে নেমে এল ক্যাটামার‌্যান থেকে। চোখ তুলে দেখল ওর দিকে দ্বিতীয় শটগানটা বাড়িয়ে ধরেছে ম্যারিয়েটা। সেটা নিয়ে আরেক কাঁধে ঝোলাল ও। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বাইকে চড়ল রানা। ওর পিছনে উঠে বসল ম্যারিয়েটা। চিমনি আকৃতির ঝড়ো মেঘটা যে গতিতে এগোচ্ছে, দশ কি পনের মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড বাতাসের মুখে পড়বে ওরা। তার আগেই রেইনফরেস্টের কোথাও আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে ওল্ডেকে। আসছে সাইক্লোন ১১৩ সাইক্লোনটা পাক খেয়ে পাহাড়শ্রেণীর নীচের দিকে আঘাত করল, রেইনফরেস্টের প্রকাণ্ড গাছগুলোকে মটমট করে ভেঙে, উপড়ে এমনভাবে দিক্বিদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে, ওগুলো যেন সোলার কাঠি। তবে পনেরো কি বিশ মাইল পরিধি নিয়ে ঝড়ের মাঝখানটা এখনও শান্ত Ñ একটা সেফ হেভেন Ñ তার ভিতর দিয়ে উত্তর- দক্ষিণে লম্বা হাইওয়ের দিকে এগোচ্ছে রানা ও ম্যারিয়েটা। পিছন থেকে রানাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ম্যারিয়েটা। এত লাফাচ্ছে দেখে ভয় পেয়েছে, কখন জানি ছিটকে পড়ে যায় মোটরসাইকেল থেকে। তাকে আশ্বস্ত করবার জন্য গলা চড়িয়ে রানা জানাল, হাইওয়েতে উঠছে ওরা। হাইওয়েতে ওঠার পর বাইকের স্পিড তুলল রানা ঘণ্টায় ষাট মাইল, গতি আরও বেশি তুললে হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটায় রাস্তা থেকে নীচের খাদে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। তুমুল বৃষ্টি ও বাতাসের মধ্য দিয়ে চারঘণ্টা একটানা বাইক ছোটাল রানা। বনভূমি থেকে উড়ে আসা গাছপালা রাস্তায় বাধা হয়ে স্ফাড়ানোয় সাত কি আটবার থামতে হয়েছে ওল্ডেকে। কখনও ডালপালা কেটে, কখনও নেমে বাইক ঠেলে পাশ কাটাতে হয়েছে বাধাগুলো। সামনের এলাকাটা কী ধরনের তা মনে পড়ে যাচ্ছে রানার। হাইওয়ের ডানদিকে কয়েকটা পাহাড়ী ঝরনা নীচে নেমে এসে বিশাল জলা তৈরি করেছে, জলার পানি থেকে জন্ম নিয়েছে বিরাট একটা লেগুন। লেগুনের পানি বেড়ে গেলে হাইওয়ে ডুবে যেতে পারে, তাই ওটার তলায় একটা কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। হাইওয়ের বামদিকে আছে একটা নদী ও পাহাড়। নদীটা শুকনো, কারণ ওটার মুখ হাইওয়ে তৈরি করবার সময় উজানেই ঘুরিয়ে ত্থেয়া হয়েছে। ১১৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ হাইওয়ে থেকে ডানপাশে নেমে এসেছে রানা। এখন কালভার্টের ভিতর ঢুকতে যাচ্ছে। কালভার্টের ভিতর পানির গভীরতা এক ফুটের বেশি নয়, বাইক চালাতে রানার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। ওর ইচ্ছে ওপারে পৌঁছে পরিত্যক্ত নদীটা ধরে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাবার জন্য শর্টকাট পথ ধরবে। হাইওয়ে থেকে সরাসরি শুকনো নদীটায় নামা সম্ভব ছিল না, কারণ ঢালটা প্রায় খাড়া। কালভার্ট থেকে হাইওয়ে ও পাহাড়ের মাঝখানে বেরিয়ে এসে একটু অবাক হলো রানা। ফাঁকা জায়গাটা যে এক সময় নদী ছিল, দেখে আজ আর তা বোঝার উপায় নেই, বালি ও পাথরে ঢাকা চর- এর মত পড়ে আছে। দশ মিনিট পর ঝড়ো মেঘটা ছোবল মারতে নেমে আসছে দেখে বাইকের স্পিড কমিয়ে আনল রানা, জানে দ্রুত কোথাও আশ্রয় নিতে হবে এখন। ওল্ডে বাম দিকের মেঘটা আর মাত্র আধ মাইল দূরে। দমকা বাতাস ছুটে এসে কাঁপিয়ে দিল ভারী বাইকটাকে। মাকা নদীর উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে ত্রিশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস। নদীটার শাখাগুলোয় আকস্মিক এই প−াবন পনের ফুট উঁচু। রানা ও ম্যারিয়েটা শুকিয়ে যাওয়া পুরানো যে নদীর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে, সেটাও একসময় মাকা নদীর শাখা ছিল; উজানে তৈরি বাঁধ ভেঙে ফেলে এই নদীতেও ঢুকে পড়েছে বিপুল জলরাশি, দ্রুতগতি ট্রেনের মত সগর্জনে ওল্ডে দিকে ছুটে আসছে সেটা। যত্থি এখনও সেটা জানে না ওরা। রানার হিসাবে পুরানো ও নতুন নদীর মাঝখানে তৈরি বাঁধটা আরও চার মাইল সামনে। কালভার্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর পঞ্চাশ মিনিট পার হয়েছে। আসছে সাইক্লোন ১১৫ কত দূর এল, ক’বার ছিটকে পড়ল, গুণতে ভুলে গেছে রানা। হাইওয়েটা ধনুকের মত বাঁকা হয়ে ওল্ডে কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। নদীর খাড়া পাড় বেয়ে উপরে উঠলে ওল্ডে ডানে পাহাড় দেখা যাবে, তা-ও আধ মাইল দূরে। অনেকক্ষণ ধরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। পরিত্যক্ত নদীতে পানির ক্ষীণ ধারা বইতে শুরু করেছে। অকস্মাৎ ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশ মাইল গতি নিয়ে আঘাত করল দমকা বাতাস। বাইক থেকে ছিটকে পড়ল ম্যারিয়েটা। নদীর তলায় শুয়ে আছে রানা, ওর পায়ের উপর কাত হয়ে পড়ে রয়েছে বিএমডবি−উ। নদীর তলায় পানির গভীরতা ও স্রোত ক্রমশ বাড়ছে। চাপ দিয়ে মাটির সঙ্গে রানাকে পিষে ফেলতে চাইছে প্রচণ্ড বাতাস। ঘাড় ফেরাতে ম্যারিয়েটাকে নদীর উজানে দেখতে পেল রানা, কয়েক গজ দূরে পড়ে আছে, গাছের একটা গুঁড়ির নীচে চাপা পড়েছে ডান হাতটা। রানা টের পেল, সাইক্লোনটা ঘুরে যাচ্ছে, ওটার একটা পাশ এরইমধ্যে নাগাল পেয়ে গেছে ওল্ডে। তবে নদীর অপর পাড় ওল্ডেকে আড়াল দেবে, ভাবল ও। মাত্র কিছুক্ষণ আগেও নদীর পানি সাত ফুট চওড়া ছিল, এখন সেটা ত্রিশ ফুট। কাদাগোলা পানি জোরালো স্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পরদায় মুহূর্তের জন্য একটা ফাঁক তৈরি হতে রানা দেখল ম্যারিয়েটা যেখানে পড়ে আছে তার পিছনের গাছটা প্রায় ডুবে গেছে। চোখ বুজে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল ও, অনেক কষ্টে মোটরবাইকের তলা থেকে বের করল আটকে থাকা বাম পা, তারপর বাইকটাকে উঁচু পারের গায়ে স্ফাড় করাল। বসল সিটে, পা রেখে চাপ দিল স্টার্টার-এ। কোনও সাড়া নেই। আরও দু’বার চেষ্টা করল। ওহ্, খোদা, প্রার্থনা করল রানা, পারে কাঁধ ঠেকিয়ে দম নিচ্ছে। ১১৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ মুহূর্তের জন্য মনে হলো কিছু একটা অনুভব করছে ও, বোধহয় ধরা যায় কি যায় না এমন সূক্ষ্ম ধরনের কোনও কম্পন। স্টার্টার-এ আরও একবার কিক্ করল ও। এবার স্টার্ট নিল ইঞ্জিন। পারের গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, এবার বুঝল সত্যি কিছু একটা অনুভব করেছে। আকস্মিক দমকা বাতাস পারের সঙ্গে চেপে ধরল ওকে। সেটা চলে যাওয়ার পর উজানের দিকে তাকাল, গাছের গুঁড়ির আড়ালে ম্যারিয়েটা যেখানে পড়ে আছে। তাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা। এই মুহূর্তে বাতাসের গর্জন নেই বললেই চলে। ওরা বোধহয় ঘুরতে শুরু করা সাইক্লোন-এর মাঝখানে চলে আসছে আবার। ফার্স্ট গিয়ার দিল রানা, উজানের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে সাবধানে চালাল বাইকটা। গাছের গুঁড়ির কাছে পানির গভীরতা দু’ফুটের কম নয়। ‘মুভ!’ হাত ধরে ম্যারিয়েটাকে স্ফাড় করবার সময় চিৎকার করছে। ‘কুইক...’ ব্যাকসিটে ম্যারিয়েটার ভার অনুভব করা মাত্র ভাটির দিকে বাইকটা ঘুরিয়ে নিল রানা। স্রোতের মাঝখানে সরে এসে পজিশন নিয়েছে, সামনে কোনও বাধা নেই, সেকেন্ড গিয়ার দিয়ে রওনা হলো ফিরতি পথে। মরিয়া হয়ে তীরে উঠে যাওয়ার একটা সুযোগ খুঁজছে রানা। আরও দু’বার বাতাসের ঝাপটা খেয়ে বাইক সহ ছিটকে পড়তে যাচ্ছিল, তবে বাতাসের শক্তি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, সেই গর্জনও আর শোনা যাচ্ছে না। এই সময় আওয়াজটা ওর কানে এল। দূর থেকে ভেসে আসা ভারী, গুরুগম্ভীর একটা শব্দ, যেন একটা ফিল্ডগান গর্জে উঠল। কিন্তু বেলপ্যানে ফিল্ডগান আসবে কোত্থেকে... সামনে, বামদিকে তাকিয়ে উঁচু পার-এ ছোট একটা অগভীর আসছে সাইক্লোন ১১৭ নালা দেখতে পেল রানা। বাইক নিয়ে সেদিকে এগোল, ব্রেক কষল, শরীর মুচড়ে ম্যারিয়েটার দিকে ফিরল, নালাটা দেখিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘উঠে যাও! পালাও!’ বাইক ঘোরাল রানা, কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে প্রায় খাড়া পার-এর া আকৃতির নালাটার দিকে ঘুরল আবার। অর্ধেকটা উঠে গেছে ম্যারিয়েটা। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনদিকে তাকাল সে। তার উদ্দেশে শক্ত মুঠো করা একটা হাত ঠেলে দিল রানা, যেন ওর এই ভঙ্গিটা বাকি পাঁচ ফুট উঠে যেতে সাহায্য করবে তাকে। একইসঙ্গে চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে, যত্থি সন্দেহ আছে কিছুই হয়তো শুনতে পাচ্ছে না সে। পারের চূড়া থেকে এখনও এক ফুট নীচে ম্যারিয়েটার মাথা। নদীর উজানের দিকে তাকাল রানা। অনেক দূরে, আকাশে ঝুলে থাকা মেঘের মত, আসছে ওটা। সগর্জন একটা পাঁচিল। আসছে মৃতুদ্দ ধ্বংস নিয়ে। ক্লাচ ছেড়ে দিল রানা, ফ্রন্ট হুইল লাফিয়ে শূন্যে উঠল, তারপর সামনের পার লক্ষ্য করে ছুটল বাইক, বেলে মাটি খসে তৈরি হয়েছে নালাটা নাক বরাবর সামনে। মুখে আঘাত করল অজস্র ফেনা ও জলকণা, পানির প্রাচীরটা পিছু পিছু আসছে তেড়ে। বাতাসে ওগুলোর তৈরি আলোড়ন ও ঠাণ্ডা ভাব অনুভব করল ও। পারের উঁচু মাথায় প্রায় পৌঁছে গেছে ম্যারিয়েটা। মরিয়া ভাব শক্তি যোগাল রানাকে। পাশ দিয়ে যাবার সময় খপ করে ম্যারিয়েটার কলার চেপে ধরল ও, টান দিয়ে প্রায় শূন্যে তুলে নিয়ে এল উপরে। পানির বিকট গর্জনে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল ওল্ডে। দূরের রাস্তায় বাধা পেয়ে বিস্ফোরিত হলো পানির প্রাচীরটা, একসঙ্গে অনেকগুলো বজ্রপাতের মত আওয়াজ শুনল ওরা, হাইওয়ে ভেঙে উঁচু ১১৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ হলো দু’দিকে। তারপর চওড়া হয়ে গেল নদী, হাইওয়েকে গিলে ফেলেছে। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল রানা ও ম্যারিয়েটা, জলোচ্ছ্বাসের অবিশ্বাস্য শক্তি দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। ঝড়ের মাঝখানে থাকায় দশ কি পনের মিনিট সময় পাবে ওরা, তারই মধ্যে নিরাপদ একটা পথ ধরে রেইনফরেস্টের ভিতর দিয়ে প্রেসিডেন্ট রোকো রামপাম-এর কেবিনে পৌঁছে যেতে হবে। মাথার উপর একের পর এক ঘূর্ণি তুলছে সাইক্লোনটা, ছোবল মেরে ছিন্নভিন্ন করছে রেইনফরেস্টের মাথার সবুজ শামিয়ানা, সৃষ্টি করছে বিরাট আকারের গভীর সব গর্ত। অগভীর নালা ধরে পথ তৈরি করে এগোচ্ছে ওরা, নীচে নুড়ি ও ছোট-বড় পাথর। বাইকের সামনের চাকা অনবরত লাফাচ্ছে। বনভূমির আধো অন্ধকারে লম্বা টানেল তৈরি করেছে হেডলাইটের আলো। তারপর একসময় ঝড় ও বনভূমি প্রায় একই সঙ্গে হালকা হয়ে এল। নালাটা গিয়ে মিশেছে চওড়া একটা নদীতে। নদীর দিকে গেল না ওরা, নালা থেকে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উঠতে হলো ওল্ডেকে। ঢালের মাথা থেকে শুরু হয়েছে ঘাস মোড়া একটা মাঠ। বামপাশে বাঁশ-বাগানের দিকে হাত লম্বা করল ম্যারিয়েটা। কয়েকটা পাইনের আড়ালে বাইক থামিয়ে নামল রানা। আড়ষ্ট হয়ে আছে কাঁধ দুটো, আড়মোড়া ভেঙে শিথিল করে নিল পেশিগুলো। তারপর বুক ও পিঠ থেকে নামাল বন্দুক দুটো। ম্যারিয়েটার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল একটু। এই সময় অপ্রত্যাশিত একটা বাধা। হঠাৎ রানার বুকের কাছে সেঁটে এল ম্যারিয়েটা। ‘রানা,’ বলল সে, মাসুদ ভাই নয়। আবেগে রুদ্ধ কণ্ঠ¯ল্ফ, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। রানার গালে ঠোঁট ঘষল, ব্যাকুলভঙ্গিতে খুঁজে নিয়ে চুমো খেল আসছে সাইক্লোন ১১৯ ওর ঠোঁটে, জড়িয়ে ধরা হাত দুটো ওর পিঠ ও ঘাড়ের মাংস খামচে ধরেছে। ‘তুমি আবার আমাকে বাঁচালে! দু’বছর আগের সেই দিনটা থেকে, তোমাকেই আমি আমার হিরো বলে জেনে এসেছি...’ বুকের আরও কাছে টেনে নিল ওকে রানা। উপলব্ধি করল, এরকম একটা আকুল আহ্বানের জন্য যেন সে অপেক্ষা করছিল। তারপর কেমন করে কী ঘটল বলতে পারবে না দুজনের কেউই। নয় নিজেল্ডে উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল ওরা খানিক পরেই। শটগান দুটোর অ্যাকশন চেক করল রানা, তারপর দুটোর ব্রিচে একটা করে কার্ট্রিজ ঢুকিয়ে গাছপালার ভিতর দিয়ে এগোল। ঘেসো জমিটা তিনশো গজ চওড়া, লম্বায় আরও কিছু বেশি হবে। কেবিনটা স্ফাড়িয়ে আছে মাঠের ঠিক মাঝখানে। শিশুশিল্পীরা ঠিক এ-ধরনের বাড়িই আঁকে Ñ কাঠামোর মাঝখানে একটা ল্ডজা, ল্ডজার সঙ্গে মিল রেখে দু’পাশে দুটো জানালা, ঢালু ছাদ, আকাশের দিকে যেন আঙুল তাক করে আছে চিমনিটা। ছাদ্মা খড় ও পামগাছের পাতা দিয়ে তৈরি, কাঠের তক্তার তৈরি দেয়ালগুলো পালিশ করা। প্রেসিডেন্ট রোকো রামপামের সুনামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সবই খুব সাধারণ। রানা স্ফাড়িয়ে পড়েছে। ১২০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ওর কাঁধ স্পর্শ করল ম্যারিয়েটা। ‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘হয়তো কিছু নয়, তবে ব্যাপারটা রাস্তা পেরুবার মত,’ বলল রানা। ‘আগে দেখে নাও, তা হলে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাবে না।’ ‘আই লাইক দ্যাট।’ প্রথমে কেবিনটা নয়, ওটার চারপাশ দেখতে চাইছে রানা। ব্রেস্ট পকেট থেকে বিনকিউলার বের করে চোখে তুলতেই লাফ দিয়ে সামনে চলে এল পরিত্যক্ত একটা গর্তÑপাথরের খনিমুখ। খনির ওপাশে পাহাড়, পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে উঠে গেছে লগিং ট্র্যাক। পাহাড়ের আরও উপরে ঘন বন। ট্র্যাকটা খালি পড়ে আছে। মাঠের ডান ও বামদিকেও নিচু পাহাড়। চারটে ডুমর গাছ ছায়া দিচ্ছে কেবিনটাকে, ওটার পিছনের উঁচু ঢালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাইন গাছ। কেবিনের পিছনদিকেই, একপাশে, খোলা আরেকটা পাথরের পরিত্যক্ত খনিমুখ দেখা যাচ্ছে। রানা ঠিক বুঝতে পারছে না ইট-বিছানো পথটা কেবিনে পৌঁছে থেমেছে, নাকি খনি পর্যন্ত চলে গেছে। কোথাও কোনও গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। কেবিনের জানালা খোলা, পরদাও একপাশে সরানো। চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে না। দূর থেকে বজ্রপাতের আওয়াজ ভেসে এল। ম্যারিয়েটার দিকে ফিরে রানা জানতে চাইল, ‘ল্যান্ড-রোভারটা কোথায় রাখা হয়, জানো তুমি?’ একটা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল ম্যারিয়েটা। ‘তুমি কি দাদুর কোনও অমঙ্গল আশঙ্কা করছ?’ রানা গম্ভীর। কিছু বলছে না। ‘পেছন দিকে একটা একচালা আছে,’ বিড়বিড় করল ম্যারিয়েটা। ‘সাধরণত ওখানেই রাখেন।’ ম্যারিয়েটাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে গাছপালার ভিতর দিয়ে আসছে সাইক্লোন ১২১ কেবিনের পিছনে, কোয়ারির খোলা মুখের কাছে চলে এল রানা। আবার থেমে বিনকিউলার তুলল চোখে। একচালাটা পরিষ্কার দেখা গেল। প−াস্টিক শিট দিয়ে ঢাকা একগাদা চেরা জ্বালানি কাঠের পাশে স্ফাড়িয়ে রয়েছে নীল রঙের ল্যান্ড-রোভার। গাড়িটার ফ্রন্ট ডোর-এ স্টেনসিল করা রয়েছে প্রেসিডেনশিয়াল আর্মস-এর ছোট একটা শিল্ড। কেবিনের পিছনেও দুটো জানালা, একচালা ও ল্যান্ড-রোভারটা বাধা হয়ে থাকায় জানালাগুলোর ভিতরে দৃষ্টি যাচ্ছে না। পিছনের পরিত্যক্ত খনি যতটা গভীর তারচেয়ে বেশি চওড়া। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ষাট গজ হবে, গভীরতা আশি ফুট। নীচে একটা লেক তৈরি হয়েছে। পাইন গাছের পাঁচিল ও কেবিনের মাঝখানে দুশো গজ খোলা মাঠ, এরমধ্যে কোথাও কোনও আড়াল নেই। কেবিনে প্রেসিডেন্ট আছেন কি না, তিনি প্রতিপক্ষের হাতে বন্দি কি না, কিছুই জানা নেই ওল্ডে। গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই ফাঁকা জায়গাটুকু পেরুতে হবে। রানা সিদ্ধান্ত নিল, প্রথমে ও একা ঢুকবে কেবিনে। ম্যারিয়েটার হাতে সরু একটা কাঠি ধরিয়ে দিয়ে কেবিনের ভিতরটা কী রকম এঁকে দেখাতে বলল ও। সামনের ল্ডজা দিয়ে বড়সড় লিভিং-রুমে ঢুকলেই দেখা যাবে দুটো ল্ডজা। একটা বেডরুমে যাবার জন্য, অপরটা কিচেনের দিকে। বেডরুম থেকে বাথরুমে যাওয়া যায়, আবার কিচেন থেকেও যাওয়া যায়। ম্যারিয়েটার কাছে একটা শটগান রেখে বাইক নিয়ে রওনা হলো রানা, কয়েক মিনিট পর রানার সংকেত পেয়ে পায়ে হেঁটে পিছু নেবে সে। ১২২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ সাবধানে বাইক চালিয়ে একচালার পাশে চলে এল রানা, আসার পথে কিছু নড়তে দেখেনি, কোনও শব্দও পায়নি। কাঠের স্তূপের পাশে বাইকটাকে স্ট্যান্ডে তুলে রাখল ও, তারপর শটগান বাগিয়ে ধরে পিছনের ল্ডজা দিয়ে ঢুকে পড়ল কেবিনের ভিতর। কিচেন খালি। প্যাসেজও খালি। বেডরুমের ভিতর, একটা কাঠের ডেস্কে, একা বসে আছেন প্রেসিডেন্ট রোকো রামপাম। তাঁর পরনে বক্সার শর্টস, পায়ে রাবারের তৈরি স্যান্ডেল, মুখে ছত্রিশ ঘণ্টার পুরানো খোঁচা খোঁচা রুপালি দাড়ি। রানার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবার পর চোখ সরাচ্ছেন না বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তাঁর দৃষ্টিতে না আছে ভয়, না বিস্ময়। ওকে তিনি ভাল করে দেখতে পাচ্ছেন কি না সন্দেহ হলো রানার। সম্ভবত অতিরিক্ত মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাতে ধরা হুইস্কির বোতলটা প্রায় খালি। ব্র্যান্ডির আরেকটা ছোট বোতল রয়েছে ডেস্কের একপাশে, পুরোটাই খালি। তাঁর কাপড়চোপড় মেঝেতে ছড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। বিছানাটা তৈরি করা হয়নি। ল্ডজা খুলে লিভিং-রুমে ঢুকল রানা। কেউ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল ও, গাছপালার দিক থেকে কেবিনের দিকে আসছে না কেউ। বাইরে বেরিয়ে এসে কেবিনটাকে ঘিরে একটা চক্কর দিল, দেখছে মাটিতে কোনও পায়ের দাগ আছে কিনা। নেই। এতক্ষণে ম্যারিয়েটাকে সংকেত দিল ও। প্রেসিডেন্টের বেডরুমে ফিরে এসে রানা বলল, ‘গুড আফটারনুন, সার।’ প্রেসিডেন্ট মুখ তুলে তাকালেন না। হুইস্কির বোতলটার দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। বোতলটা তাঁর নাগালের বাইরে সরিয়ে নিল রানা। ‘আমাকে আসছে সাইক্লোন ১২৩ আপনি চিনতে পারছেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সার?’ রানার দিকে তাকালেন বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। ‘ঠিক মনে পড়ছে না... কে যেন বলছিল ... কার যেন আসার কথা...তুমিই কি সে, মানে তোমারই আসার কথা ছিল?’ মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘আমি মাসুল্ডানা, সার,’ বলল ও। ‘নামটা মনে করতে পারছেন?’ ‘নাহ্।’ ঠোঁট জোড়া শক্ত করে মুড়ে মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট রামপাম। ‘মনে পড়লেই বা কী? যা হবার হয়ে গেছে, এখন আর কারও কিছু করার নেই।’ ‘কি হয়েছে আপনি জানেন, সার?’ হঠাৎ উন্মাল্ডে মত হেসে উঠলেন বৃদ্ধ। ‘বছরের সেরা জোক হতে পারে এটা! আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কী হয়েছে আমি তা জাানি কি না!’ ‘সার, আপনার নাতনি ম্যারিয়েটার কথা আপনি একবারও জানতে চাইলেন না,’ মৃদু অভিযোগের সুরে বলল রানা। ‘মনে পড়ছে না, তাকে একা ফেলে রেখে এসেছেন?’ ‘তারা ওকে কিছুই বলবে না,’ মাথা নেড়ে বললেন রোকো রামপাম। ‘আমি জানি, তারা ওর কোনও ক্ষতিই করবে না।’ ‘আপনি এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে, সার?’ জানতে চাইল রানা। ‘কে তুমি?’ হঠাৎ গলা চড়ালেন প্রেসিডেন্ট। ‘তোমাকে আমার সব কথার জবাব দিতে হবে নাকি?’ ‘আমি মাসুল্ডানা, সার,’ বলল রানা। ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপনার কলেজ জীবনের বন্ধুর কথা মনে পড়ে, রাহাত খান? এখন তিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর- জেনারেল। আমি তাঁর একজন এজেন্ট, এখানে এসেছি ম্যারিয়েটার চিঠি পেয়ে...’ ১২৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘স্টপ ইট, পি−জ!’ হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢাকলেন রোকো রামপাম। ‘আমি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সার।’ ‘ওহ্, গুড গড!’ মাতাল বৃদ্ধ বিব্রত বোধ করছেন। ‘কীভাবে আমি ম্যারিয়েটার সামনে স্ফাড়াব। সব শুনলে ও নিশ্চয়ই আমাকে ঘৃণা করবে ...’ অবিশ্বাস্য একটা সন্দেহ জাগল রানার মনে। তবে মাতাল ও অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষটিকে এখনই ইন্টারোগেট করা সম্ভব নয়। ‘যদি পারেন, মিস্টার রামপাম, শাওয়ার সেরে কাপড়চোপড় পরে বিছানায় শুয়ে পড়–ন। ম্যারিয়েটা আসছে, আমি তাকে বলব আপনি অসুস্থ।’ দুজন মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করল ওরা। তারপর রেডিও অন করে কর্নেল জুডিয়াপ্পা এসকুইটিলার ত্থেয়া নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে জরুরি মেসেজ পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা, আর ম্যারিয়েটা গেল দাদুর জন্য কফি বানাতে। ইতিমধ্যে শুকনো কাপড়চোপড় পরেছে ওরা। এত বড় একটা ঝড় বইছে, রেডিও থেকে শব্দজট ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না। তারপরেও কিছুক্ষণের বল্টধানে দু’বার মেসেজ পাঠাল রানা, আশা করছে ওর মেসেজ অন্তত রিসিভ করছেন কর্নেল, জবাবটা ওর কাছে পৌঁছাক বা না পৌঁছাক। কফির ট্রে নিয়ে কিচেন থেকে ফিরে এসে ম্যারিয়েটা দেখল বাথরুম থেকে শাওয়ার সেরে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন তার দাদু, পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল তার। দাদুর সঙ্গে তার কোনও কথাই হয়নি। ‘কী হয়েছে দাদুর?’ লিভিং-রুমে ঢুকে জানতে চাইল ম্যারিয়েটা, হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। ‘কী রকম অসুস্থ?’ ‘অতিরিক্ত মদ খেয়েছেন,’ বলল রানা। ‘কী বলছ? কেন?’ বিস্মিত হলো ম্যারিয়েটা। ‘দাদু কখনও এক-আধ আউন্সের বেশি খান না।’ রানার হাতে কফির কাপটা আসছে সাইক্লোন ১২৫ ধরিয়ে দিল। সেটা নিয়ে শ্রাগ করল রানা, একটা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখল টেবিলের এক কোণে। ‘বোধহয় খুব বেশি টেনশনে ছিলেন,’ বলে লিভিং-রুম থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই মোটর বাইক থেকে স্যাডেলব্যাগটা নিয়ে ফিরে এল আবার। ব্যাগের সমস্ত জিনিস টেবিলে বের করল রানা। শটগানগুলো লোড করার সময় অনুভব করল ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ম্যারিয়েটা। প্রতিটি ম্যাগাজিনে ছ’টা করে গুলি ভরল ও, তারপর কয়েকটা বিশেষ জায়গায় এক ফোঁটা করে তেল দিল। এর পর ওয়ালথারটার অ্যাকশন পরীক্ষা করল। ঝড়ের চরম পর্যায়টা ওল্ডেকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। শান্ত পায়ে জানালার সামনে এসে স্ফাড়াল রানা, শাটার-এর গায়ে হৃৎপিণ্ড আকৃতির অলঙ্করণে চোখ রেখে বাইরে তাকাল। এলাকার ছবিটা পরিষ্কার ফুটে আছে ওর মনের পরদায়। মিনিট দশেক মাথা ঘামালে সম্ভাব্য একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে ফেলবে ও। টেবিলের কাছে ফিরে এসে ওয়ালথারটা বেল্টে গুঁজল রানা। ‘আমি একটু বেরোব।’ ‘ভয় পাচ্ছ এখানে আমাল্ডে ওপর হামলা হবে?’ জিজ্ঞেস করল ম্যারিয়েটা। ‘হামলা যদি হয়ই, তুমি একা ওল্ডেকে ঠেকাতে পারবে?’ ‘আশা করছি সাহায্য করার জন্যে লোকজন চলে আসবে।’ ‘সাহায্য মানে আমাল্ডে রেডিও মেসেজ পেয়ে কর্নেল জুডিয়াপ্পা আংকেল চলে আসবেন, এই তো?’ সন্দিহান দেখাল ম্যারিয়েটাকে। ‘কিন্তু, রানা, আমরা তো এখনও জানিই না যে মেক্সিকো থেকে তিনি দেশে ফিরেছেন কি না! কিংবা ফিরলেও আমাল্ডে সৈনিকরা এখনও তাঁর কমান্ড মেনে চলবে কি না...’ ‘সৈনশুা সবাই বেঈমানী করবে, এ স্রেফ হতেই পারে না, ১২৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ম্যারিয়েটা,’ জোর দিয়ে বলল রানা। ম্যারিয়েটা কিছু বলল না। তারপর কী ভেবে সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আবার বলল, ‘তবে কর্নেল জুডিয়াপ্পা যদি সাহায্য করতে না-ই আসতে পারেন, আমি আশা করছি তাঁর বদলে আর কেউ চলে আসবে।’ এর কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রানা। প্রত্যয় জাহাঙ্গীরকে একটা দায়িত্ব দিয়ে এসেছে ও, আশা করছে সেটা সে ঠিকমতই পালন করবে। ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হয় পাবলো টিকালা, নয়তো কর্নেল জুডিয়াপ্পা প্রেসিডেন্টকে নিতে চলে আসবে। যে বা যারাই আসুক, রানা চায় সে বা তারা যেন খোলা মাঠ ধরে হেঁটে আসে। আর যেটা জরুরি, নিজেকে তৈরি করবার জন্য কিছুটা সময়। শটগান দুটো প−াস্টিকের ফালি দিয়ে জড়াল রানা, তারপর দুটোই বাম কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একচালার স্টোরেজ চেস্ট থেকে চেইন-স’ বের করে সঙ্গে নিল ও। প্রেসিডেন্টের ল্যান্ড-রোভারটা কাজে লাগানোর ঝোঁক চাপলেও, মাটিতে চাকার দাগ দেখা যাবে ভেবে বাতিল করে দিল চিন্তাটা। এই মুহূর্তে পাইন জঙ্গলের কিনারায় রয়েছে রানা, পাহাড়ি ঢালের উপর। ঝড়ো বাতাসের প্রচণ্ড ঝাপটা অগ্রাহ্য করে চলে এসেছে এখানে। দিনের আলো আর বোধহয় এক ঘণ্টাও পাওয়া যাবে না, তাই সঙ্গে একটা টর্চও রেখেছে ও। বেশ কিছুটা দূরে শটগান দুটো শুইয়ে রেখে চেইন-স’ দিয়ে একের পর এক কাটতে শুরু করল গাছ। বাতাসের গতি-প্রকৃতিই নির্ধারণ করল কাটা গাছগুলো কোন্দিকে পড়বে। খানিক পরপর রাস্তার উপর পনেরো-ষোলোটা গাছ ফেলল ও। আকারে ছোট গাছই ফেলেছে, কারণ পরে রাস্তাটা ওকেই হয়তো আসছে সাইক্লোন ১২৭ পরিষ্কার করতে হবে। এরপর রাস্তার ডান শাখা ধরে একশো গজ হেঁটে এল রানা, এখানেও গাছ ফেলে এমন ব্যারিকেড দিল, দ্রুত সরাতে চাইলে যেন বুলডোজার ল্ডকার হয়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শটগান দুটোর কাছে ফিরে এল রানা, তারপর জঙ্গলের রেখা ধরে বামদিকের একটা নালার কাছে চলে এল, কেবিনের প্রায় উল্টোদিকে। বৃষ্টির পানিতে ভরাট হয়ে আছে নালাটা। ওটার কিনারায়, খানিকটা মাটিতে সেঁধোনো একটা বোল্ডার দেখল ও। মাটি খুঁড়ে আলগা করল ওটাকে, যাতে একটু ধাক্কা দিলেই রিজ-এর মাথা থেকে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বোল্ডারটার কাছাকাছি নিঃসঙ্গ স্ফাড়িয়ে রয়েছে একটা পাইন গাছ, সেটার গোড়ায় একটা শটগান লুকিয়ে রাখল রানা। ওখান থেকে, টর্চের আলোয় পথ দেখে, কোয়ারির সামনের লেকে চলে এল ও। বাতাসের ঝাপটায় দু’বার ছিটকে পড়তে হলো ওকে, দু’বারই আরেকটু হলে খাদে নেমে যেত। চেইন-স’টা এক টন ভারী মনে হচ্ছে। লেকের কিনারায় কয়েকটা গাছ স্ফাড়িয়ে আছে, তারই একটার ভেঙে পড়া ডালের আড়ালে দ্বিতীয় শটগানটা লুকাল রানা। গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিল ও। ল্যান্ড-রোভারের হুডে একটা প্রেশার ল্যাম্প জ্বেলে রেখে এসেছে, কিন্তু বৃষ্টির ভিতর দিয়ে সেটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। হাতঘড়িতে চোখ বুলাল রানা। কেবিন থেকে বেরুবার পর তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল ও। একা নিশ্চয়ই খুব ভয় পাচ্ছে ম্যারিয়েটা। আরও বিশ মিনিট পর পিছনের ল্ডজা দিয়ে কেবিনে ফিরল রানা। কিচেনে ঢুকে ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো ট্রাউজার ও শার্ট পরল ও, তারপর স্টোভে কফির জন্য পানি চড়াল। কিচেন থেকে ১২৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ বেরিয়ে প্রেসিডেন্টের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখল বেডরুম খালি। লিভিং-রুম থেকে ম্যারিয়েটার কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে আসছে। কিচেনে ফিরে এল রানা, তারপর একটা ট্রেতে কফির পট নিয়ে লিভিং-রুমের দিকে এগোল। এ যেন এমন একটা কামরায় ঢুকতে যাওয়া, ল্ডজা খোলার সময় ভাবল ও, যেখানে টেরোরিস্টরা অ্যামবুশ পেতে তোমার জনঞ্জপেক্ষা করছে। টেবিলে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট রোকো রামপাম। নতুন একজোড়া বক্সার শর্টস পরেছেন, গায়ে হলুদ টি-শার্ট। হাতের কাছে হুইস্কির নতুন একটা বোতল দেখা যাচ্ছে। ‘এতক্ষণ লাগল?’ জানতে চাইল ম্যারিয়েটা। ‘কী করছিলে?’ মুখ তুলে তাকালেন প্রেসিডেন্ট, তাঁর চোখের ভাষাই রানাকে বলে দিল ওকে চিনতে পারছেন তিনি। ‘এই বাইরে থেকে একটু হেঁটে এলাম,’ বলল ও। ম্যারিয়েটার হাতে কফি ভর্তি একটা কাপ ধরিয়ে দিয়ে ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। ‘গুড ইভিনিং, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’ তাঁর কনুই ধরে টান দিল রানা। ‘আপনার এখন বিছানায় থাকা উচিত, সার। আসুন, পি−জ...’ তর্ক না করে কিংবা বাধা না দিয়ে রানার সঙ্গে বেডরুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। ‘ওরা কাল সকালে আসবে...’ ‘ইয়েস, সার,’ বলল রানা। ‘শত্র“ কিংবা মিত্র। হয়তো দু’দলই। সেক্ষেত্রে রক্তপাত ঘটবে।’ তাঁর গায়ে চাল্ডটা টেনে দিল ও। ‘আগের মতই অত্যন্ত বিবেচক বলে মনে হচ্ছে তোমাকে আমার। আমি নিশ্চয়ই আশা করতে পারি যে ম্যারিয়েটাকে তুমি দেখবে?’ ‘আমি আপনাল্ডে সবার নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে চাইছি, সার,’ বলল রানা। ‘আমার জন্য কারও আর কিছু করার নেই, ইয়াংম্যান Ñ যা-ই করতে যাবে, আরও জিয়েপার্ডাইযড্ হবে সবকিছু। তবু ধনল্টাদ। আসছে সাইক্লোন ১২৯ তুমি শুধু ম্যারিয়েটাকে বাঁচাও, পি−জ, তা হলে মরেও আমি শান্তি পাব।’ কথা আর না বাড়িয়ে রানা বলল, ‘গুড নাইট, সার।’ কিচেনে আধ ঘণ্টা ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ল্যান্ড-রোভারটা চেক করার জন্য একচালায় বেরিয়ে এল রানা। গান র‌্যাক-টা দুই ফ্রন্ট সিট-এর মাঝখানে, সেখানে খাড়া করে রাখা হয়েছে একটা ডাবল-ব্যারেল টুয়েলভ-গজ শটগান। একটা হ্যাক-স’ পাওয়া গেল স্টোরেজ চেস্ট-এ। কিচেনে ফিরে এসে স্টোভে চড়ানো সাত রকম সবুজ আনাজ- এর পাত্রে আরেকটু পানি ঢালল রানা, তারপর আরেক স্টোভে ইতিমধ্যে সেদ্ধ হয়ে আসা পোলাউ-এর চালে মেশাল ওগুলো। খালি হওয়া স্টোভে চড়াল গলদা চিংড়ির নতুন পাত্র। ছুরি দিয়ে পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, টমেটো, শশা ইত্যাদি কেটে সালাত্থ তৈরি করে ফেলল একগাদা। কাজের ফাঁকে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকাল রানা। বাতাস আছে, আকাশে মেঘও আছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দূরে। প্রেসিডেন্টকেও একবার দেখে এল রানা। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন তিনি। সবশেষে উঁকি দিল লিভিং-রুমে। গালে হাত দিয়ে সেই আগের জায়গায়, সোফাটায় বসে আছে ম্যারিয়েটা, চিন্তিত। চোখাচোখি হতে হাসল রানা, বলল, ‘পাঁচ মিনিট পর ডিনার।’ টেবিলে খাবার সাজানোর পর ম্যারিয়েটা বলল, ‘আমাকে ডাকোনি কেন? এত কিছু একা তুমি করলে কীভাবে?’ ‘সময় পাইনি, তেল-লবণ দিয়ে শুধু সেদ্ধ করে এনেছি,’ বলল রানা। ‘গ্রাসিয়াসে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তোমাকে আমি একদিন রান্না করে খাওয়াব।’ ক্যাটামার‌্যানের কথা ভুলেই গিয়েছিল ও, হঠাৎ মনে ১৩০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ পড়ল সেটা বহু মাইল দূরে পড়ে আছে। ‘মানে ওটাকে যদি কোনওদিন সাগরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি আর কী।’ ডিনার শেষে পে−টগুলো কিচেনে নিয়ে এল রানা। স্টোভে কেটলি চড়িয়ে কিচেন-টেবিলে বসল প্রেসিডেন্টের টুয়েলভ-গজটা নিয়ে, হ্যাক-স’ দিয়ে কেটে ছোট করছে ব্যারেলটা। ল্ডজায় এসে স্ফাড়াল ম্যারিয়েটা। এক মুহূর্ত শুধু তাকিয়ে থাকল। তারপর আঁতকে ওঠার আওয়াজ বেরিয়ে এল তার গলার ভিতর থেকে। ‘ওটা দাদুর প্রিয় বন্দুক!’ ‘তাঁকে আমাল্ডে রক্ষা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘বদ্ধ জায়গার ভেতর ব্যারেল-কাটা শটগানের চেয়ে ভাল অস্ত্র আর হয় না। সাবমেশিন গানের চেয়েও ভয়ঙ্কর অস্ত্র!’ ‘রানা, তুমি কী যেন একটা লুকাচ্ছ আমার কাছে,’ ¤−ান সুরে বলল ম্যারিয়েটা, যেন কী শুনতে হবে ভেবে ভয় পাচ্ছে সে। ‘সময় হলে সবই জানাব তোমাকে,’ ধীরে ধীরে বলল রানা। ‘তার আগে নিজে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিতে চাই।’ মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে হঠাৎ ঘুরে বাথরুমে ঢুকে পড়ল ম্যারিয়েটা, যেন পালিয়ে বাঁচল। বাইরে থেকে গলা চড়িয়ে রানা বলল, ‘এখানেই আছি আমি। কফি হলে ডেকো আমাকে।’ খোলা একটা জানালার সামনে স্ফাড়িয়ে রেডিও অন করল রানা। নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কর্নেল জুডিয়াপ্পাকে ডাকল বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। অগত্যা মেসেজটা আবার পাঠাল রানা: ‘কলম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেল- এর লোকজন পাবলো টিকালার নেতৃত্বে নিকার‌্যাগুয়া থেকে প্রবাসী বেলপ্যানিজ মার্সেনারি নিয়ে বেলপ্যানে ঢুকে পড়েছে, তাল্ডেকে সাহায্য করছে স্থানীয় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য। ম্যারিয়েটাকে নিয়ে পাইন রিজ-এ, প্রেসিডেন্টের কেবিনে পৌঁছেছি আমি। আশঙ্কা করছি আসছে সাইক্লোন ১৩১ এখানে আমাল্ডে ওপর হামলা হবে। আবার বলছি...’ বিপদ ডাকছে ও, মেসেজটা বার তিনেক রিপিট করল রানা। তারপর ম্যারিয়েটার ডাক শুনে কিচেনে চলে এল। কাপে কফি ঢালছে সে। পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলল, বলল, ‘মাসুদ ভাই, তুমি আমাকে সত্যি কথাটা বলছ না।’ ‘এখনও আমি জানি না কোন্টা সত্যি।’ এটা-সেটা আন্দাজ করতে পারছে রানা, নানা রকম সন্দেহ জাগছে মনে, যেগুলো অবিশ্বাস্য। কিন্তু নিñিদ্র প্রমাণসহ পুরো গল্পটা এখনও জানার সুযোগ হয়নি ওর। রানার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে ম্যারিয়েটা। ‘ব্যাপারটা খুব জটিল, ম্যারিয়েটাÑ’ শুরু করল রানা। বড়রা ছোটল্ডে এ-কথাই বলে, ভাবল ও। ‘এখনই তোমার না শুনলেও চলে।’ টেবিলের উপর ওয়ালথারটা খুলল রানা। বুলেটগুলো বের করে পুরানো একটা খবরের কাগজে রাখল, কাজ শুরু করল নিজের ছুরি দিয়ে। আওয়াজ পেয়ে বুঝল, প্রেসিডেন্ট বাথরুমে গেলেন। ওয়ালথার রিলোড করে অপেক্ষায় থাকল প্রেসিডেন্ট কখন বাথরুম থেকে বেরুবেন। বেডরুমে ফিরতে প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করল রানা। ওয়ালথারটা তাঁর বালিশের তলায় গুঁজে দিয়ে বলল, ‘কিছুই বলা যায় না, সার... জাস্ট সাবধানতার জন্যে থাকল এটা।’ এরপর আবার রেডিও অন করল রানা। ঝড়ের মূল অংশটা উত্তরে সরে গেলেও, আকস্মিক দমকা বাতাসের প্রচণ্ড ঝাপটা এখনও পাহাড়ী ঢালগুলোতে আছড়ে পড়ছে, সেই সঙ্গে বয়ে আনছে মুষলধারে তুমুল বর্ষণ। প্রায় ষ্ণে ঘণ্টা হয়ে গেল ছাল্ডে উপর শুধু মাথাটা বের করে ১৩২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ একটা প−াস্টিক শিট-এর নীচে শুয়ে রয়েছে রানা। বৃষ্টি ও বাতাস ওর রক্ত থেকে সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়েছে, বেতস পাতার মত কাঁপছে শরীরটা। রানা চেয়েছিল বৃষ্টি যাতে না থামে। হামলাটা যদি শুরু হয়, হামলাকারীরা আস্থা রাখবে নিজেল্ডে সংখ্যার উপর। বৃষ্টির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার অস্থিরতা তাল্ডেকে দ্রুত হামলা চালাতে প্ররোচিত করতে পারে Ñ খুব বেশি না হলেও, ব্যাপারটা ওর জন্য হয়তো খানিকটা সুবিধে বয়ে আনবে। ভোরের আলো ফোটার আধঘণ্টা আগে থেকে পাহারা দিতে শুরু করেছে রানা। এতক্ষণে ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আইন-এর লোকজনকে আসতে দেখছে ও। সন্দেহ নেই, সেনাবাহিনীর সদস্যল্ডে পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা পুলিশ পাঠিয়েছেন কর্নেল জুডিয়াপ্পা এসকুইটিলা। বিনকিউলার ছাড়াই কাঁচা রাস্তায় বাঁক ঘোরার সময় ল্যান্ড-রোভার দুটোর সামনের ল্ডজায় চঙখওঈঊ সাইন দেখতে পাচ্ছে রানা। আর দশ মিনিটের মধ্যে হালকা ব্যারিকেডের সামনে পৌঁছে যাবে তারা। কাটা গাছগুলো সরাতে পাঁচ মিনিট লাগবে তাল্ডে। আরও পাঁচ মিনিট পর পৌঁছাবে দ্বিতীয় ব্যারিকেডে। ওখানে গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হবে তারা, মাঠ পর্যন্ত বাকি পথটুকু আসতে হবে হেঁটে। কাঁচা পথ থেকে দেখা গেল না, ঢালু ছাদে শরীরটা গড়িয়ে দিয়ে নীচে নামল রানা। কিচেনে ফিরে এসে জ্বেলে রেখে যাওয়া গ্যাস স্টোভ-এর শিখা একটু কমাল, তারপর কেটলি বসাল তাতে। লিভিং-রুমে ঢুকে দেখল ভাঁজ করা হাঁটু বুকের কাছে তুলে সোফায় শুয়ে রয়েছে ম্যারিয়েটা, গায়ের উপর একটা চাল্ড ফেলা। রানা আন্দাজ করল জেগে আছে সে। ‘ভালমানুষরাই জিতেছে। পুলিশ,’ বলল রানা। ‘মিনিট আসছে সাইক্লোন ১৩৩ বিশেকের মধ্যে চলে আসবে এখানে। কেটলিতে পানি গরম হচ্ছে।’ গরম হয়ে থাকা কিচেনে ফিরে এসে পরনের ভিজে কাপড় খুলে ফেলল রানা। আরেক প্রস্থ কাপড় স্টোভের উপর রশিতে ঝুলিয়ে শুকাতে দিয়ে গিয়েছিল, দ্রুত হাতে পরে নিল সেগুলো। কফি বানাবার আগে কার্ট্রজি বেল্ট ঝোলাল কাঁধে, তারপর জ্যাকেটের প্রতিটি পকেটে একটা করে চওড়া টেপ-এর রোল ঢোকাল। কফির পট ও তিনটে কাপ নিয়ে সামনের কামরাটায় ফিরে এল আবার। সোফায় উঠে বসেছে ম্যারিয়েটা। মাথার রাশি রাশি রেশমি চুল এলোমেলো হয়ে আছে দেখে রানার ইচ্ছে হলো চিরুনি চালিয়ে ঠিক করে দেয়। তবে সেরকম কিছু করতে গেলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে নিশ্চিত নয় ও। চোখাচোখি হতে শুধু একটু হাসল। ‘তোমাকে ইউনিকর্ন-এর মত লাগছে,’ বলল রানা। কপাল থেকে চুলের কুণ্ডলী পাকানো গোছাগুলো সরাল ম্যারিয়েটা, তারপর পায়ের কাছে পড়ে থাকা শোল্ডার ব্যাগটা টেনে নিয়ে খুলল। ভিতর থেকে কালচে-খয়েরি চকচকে হেয়ার পিক বের করে তাকাল রানার দিকে। ‘তোমাকে কেউ তাকিয়ে থাকতে বলেনি।’ চুলের পরিচর্যা করতে হলে দুইহাত উপরে তুলতে হবে ওকে। মুচকি হেসে জানালার সামনে চলে এল রানা, শাটার-এর ফুটোয় চোখ রেখে বাইরে তাকাল। দেখল কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে ডেবে থাকা জমিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ল্যান্ড-রোভার দুটো। একটু পরেই ওর কাটা ছোট গাছগুলোর সামনে পড়তে হবে তাল্ডেকে। ‘তুমি বললে ওরা পুলিশ।’ ম্যারিয়েটা আসলে জানতে চাইছে রানার কাঁধে কার্ট্রিজ বেল্ট ঝুলছে কেন। না বোঝার ভান করল রানা। বলল, ‘যাই, মিস্টার ১৩৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ রামপামের ঘুম ভাঙাই।’ দশ রানা খেয়াল করল কফির কাপটা নেওয়ার সময় প্রেসিডেন্টের হাত দুটো কাঁপছে। কালকের কতটুকু কী তাঁর মনে আছে বলা মুশকিল, তাই সাবধান করে ত্থেয়ার সুরে ধীরে ধীরে বলল ও, ‘আমি মাসুল্ডানা, সার, ম্যারিয়েটার চিঠি পেয়ে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে এসেছি।’ চশমার খোঁজে বিছানাটা হাতড়াতে শুরু করলেন প্রেসিডেন্ট। সেটা মেঝেতে খুঁজে পেল রানা, তুলে ধরিয়ে দিল ভদ্রলোকের হাতে। ‘উপত্যকায় পুলিশ আসছে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’ রানা চাইছে মুখ-হাত ধুয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিন ভদ্রলোক। ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এখন আপনি নিরাপদ, তবে তারপরও আমার পিস্তলটা থাকুক আপনার কাছেই। সাবধানের মার নেই, তাই না, সার?’ এক মুহূর্ত বিমূঢ় দেখাল বৃদ্ধকে। তারপর, মনে পড়তে, রানার পিস্তলের খোঁজে বালিশের তলাটা হাতড়াতে শুরু করলেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কী রকম অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাঁকে Ñ বিছানার উপর পা মেলে বসে আছেন, মুখে খোঁচা খোঁচা রুপালি দাড়ি, এক হাতে কাপ- পিরিচ, আরেক হাতে ওয়ালথার। বেসুরো গলায় বললেন, ‘ধনল্টাদ, ইয়াংম্যান। এরইমধ্যে সুস্থ বোধ করছি আমি।’ আসছে সাইক্লোন ১৩৫ রাজনীতিকরা যে-কোন পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নিতে পারেন, ভাবল রানা। সামনের কামরায় ফিরে এল ও। ‘তোমার দাদু সুস্থ বোধ করছেন,’ ম্যারিয়েটাকে বলল। জানালার দিকে পা বাড়িয়ে হাতঘড়ির উপর চোখ বুলাল। পুলিশের গাড়ি আবার দেখতে পাওয়ার সময় হয়েছে। জানালার ফুটো দিয়ে একমিনিট তাকিয়ে থাকার পর অবশেষে একটাকে ঢাল বেয়ে রিজ-এর উপর উঠে আসতে দেখল রানা, ব্যারিকেডের সামনে পৌঁছে স্ফাড়িয়ে পড়ল। দ্বিতীয়টা নিশ্চয়ই প্রথম ব্যারিকেডে আটকা পড়ে আছে এখনও, কিংবা ড্রাইভার হয়তো বাধা টপকাবার কোনও চেষ্টাই করছে না। ল্যান্ড-রোভার থেকে পুলিশল্ডে নামতে দেখছে রানা। চারজন। মুখগুলো দেখা যাচ্ছে না। খাকি ইউনিফর্মের উপর মাথা ঢাকা হালকা সবুজ রঙের রেইনকোট পরে আছে সবাই। তাল্ডে একজন কেবিন লক্ষ্য করে একটা হাত তুলল Ñ সার্জেন্ট হতে পারে, ভাবল রানা। পরস্পরের কাছ থেকে ছড়িয়ে পড়ল তারা, তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল; বৃষ্টি ও বাতাস ঠেলছে তাল্ডেকে, হোঁচট খাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। যে যার হাতের কাল্যাশনিকভ রাইফেল শক্ত করে নাভীর কাছে আড়াআড়ি ভঙ্গিতে ধরে আছে, যেন শিকারে বেরিয়েছে চার বন্ধু। ‘ওরা পৌঁছে গেছে,’ ম্যারিয়েটাকে বলল রানা। তারপর বেডরুমের উদ্দেশে গলা একটু চড়াল: ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সার...’ রাইফেল? তাও আবার কাল্যাশনিকভ? ব্যাপারটা ঠিক যেন বোধগম্য হচ্ছে না রানার। বেলপ্যান পুলিশের কাছে তো রাইফেল থাকে না, থাকে আরও অনেক মারাত্মক অস্ত্র Ñ লাঠি। তারপর ব্যাপারটা খেয়াল করল রানা। লোকগুলোর হাঁটার ভঙ্গি অস্বাভাবিক মন্থর না? হ্যাঁ, ইচ্ছে করে দেরি করছে। ১৩৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ চারজনকে আসতে দেখছে ও, এই মুহূর্তে পরস্পরের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে তারা; সন্দেহ নেই বাকি সবাই পাহাড় থেকে নজর রাখছে কেবিনটার উপর। প্রথম দলের এভাবে দেরি করবার কারণ হলো, দ্বিতীয় দলটাকে পজিশনে পৌঁছাতে সময় ত্থেয়া। ভয় লাগছে না দেখে খুব একটা বিস্মিত নয় রানা। শত্র“কে দেখতে পেলে আসলে ভয় পাওয়ার কিছু থাকে না। এখন শুধু কাজটা ভালভাবে শেষ করার চিন্তা। হয় তুমি জিতবে, নয়তো হারবে Ñ দুটো মাত্র অলটারনেটিভ। ঘাড় ফিরিয়ে ম্যারিয়েটার দিকে তাকাল রানা। ঘুম ভাঙার পর আর বোধহয় নড়েনি। ‘দুঃখিত, ম্যারিয়েটা,’ বলল ও। ‘আমার ভুল হয়েছে। ভালমানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে ওরা আসলে মন্দ লোক।’ টেবিলটা টেনে কামরার মাঝখানে নিয়ে এসে মেঝেতে কাত করল রানা, তারপর ম্যারিয়েটাকে সহ কাউচটা সরিয়ে আনল, ফার্নিচারগুলো যাতে একটা বাধা তৈরি করে। তার পাশে সোফায় ব্যারেল কাটা শটগানটা রাখল ও। মুখের ভাব এতটুকু বদলায়নি। ‘মাথা নামিয়ে রাখো,’ তাকে বলল রানা। ‘নড়াচড়া করবে না। তাকাবে না। যদি দেখো ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে কেউ, গুলি করবে... মানে, যদি চাও আর কী।’ কী চায় সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে। বাতাসের চাপ আছে, গায়ের জোর লাগিয়ে ল্ডজা খুলতে হলো। এগিয়ে থাকা পুলিশটার উদ্দেশে হাত নাড়ল রানা। কেবিনের কাছ থেকে সরে এল, তারা যাতে দেখতে পায় নিরস্ত্র ও। দৌড়াচ্ছে রানা, এঁকেবেঁকে বা মাথা নত করে নয়, আচরণে দিশেহারা ভাব। ঘাস ঢাকা মাঠের উপর দিয়ে জঙ্গলের সবুজ পাঁচিল লক্ষ্য করে ছুটছে ও। লাফিয়ে পার হলো ছোট একটা ঝোপ, রাইফেল গর্জে ওঠার আওয়াজ ঢুকল কানে। গায়ে গুলি লাগার সম্ভাবনা খুবই কম, তবু ইচ্ছে করে পিছলাল, মাটিতে পড়ল কাঁধ দিয়ে, শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল আসছে সাইক্লোন ১৩৭ গাছপালা ও নালাটার নিরাপজ্ঝাড়ালে, যেখানে প্রথম শটগানটা রেখে গেছে। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে শুয়ে থাকল রানা, দম ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। তারপর সিধে হয়ে তলা থেকে ঠেকো সরিয়ে গোল বোল্ডারটা গড়িয়ে দিল ঢালের মাথা থেকে। নালা ধরে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে ওটা। বাতাস ও বৃষ্টির মধেদ্দটার পতনের কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না রানা, ধরে নিল প্রতিপক্ষও কিছু শুনতে পাবে না। মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড ব্যয় করে ভাগ্য পরীক্ষার একটা বল্টস্থা Ñ ঝড়ে এক-আধটা বক পড়লে মন্দ কী। দ্রুত হাতে কেস খুলে পাম্প গান থেকে প−াস্টিকের মোড়ক ছিঁড়ে ফেলল রানা, তারপর পাইনবনের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের আরও উপরদিকে চড়তে শুরু করল। ওর টার্গেট পাহাড়ের উপর পজিশন নেওয়া টিমটা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প−্যানটা তৈরি করেছে রানা, প্রতিটি পদক্ষেপের আগে মাথার ভিতর তার রিহার্সেল করে নিচ্ছে। রানার ধারণা, উপরের টিমটা পাহাড় পেঁচিয়ে উঠে যাওয়া লগিং ট্র্যাক-এর উপরে কোথাও পজিশন নিয়েছে। ওর আশা আপাতত ওখানেই থাকবে তারা, কারণ ট্র্যাকটা থেকে নীচের অনেকটা দেখা যায়, সহজে লাইন অভ ফায়ারও পাওয়া যাবে। জানা কথা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তাল্ডে কাছে রেডিও আছে। একটা ঝুল পাথরের নীচে চলে এসে ট্র্যাকটা ক্রল করে পার হলো রানা, উপরের ট্র্যাক থেকে যাতে কেউ দেখতে না পায় ওকে। বৃত্ত ধরে ঘুরতে শুরু করবে, তবে তার আগে আরও ষাট- সত্তর গজ উপরে উঠতে চাইছে। যে লোকটা ওর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে, প্রথমে তার নাগাল পেতে হবে ওকে, যার সতর্কতা ও প্রস্তুতি সবচেয়ে কম। ১৩৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ বৃষ্টি ও বাতাস ওর পক্ষে, প্রতিটি নড়াচড়া আড়াল করে রেখেছে। পুরানো লুকোচুরি খেলা এটা, বহুবার খেলে দক্ষ হয়ে উঠেছে রানা। ওর শিকার বাঁকের মুখে, একটা পাথরের আড়ালে বসে রয়েছে, ট্র্যাকের দু’দিকেই যাতে নজর রাখা যায়। হাতের অস্ত্র শক্ত করে ধরে আছে কোলের উপর। ওটা একটা কাল্যাশনিকভ, রানাকে দিয়ে স্মাগল করিয়ে আনা। জাঙ্গল হ্যাট পরে আছে লোকটা, কারনিস থেকে রেইনকোটে পানি পড়ছে। জোরাল একটা দমকা বাতাসের অপেক্ষায় থাকল রানা। সেটা পেতেই ক্রল করে দ্রুত এগোল। ‘ওলা, অ্যামিগো!’ ফিসফিস করল রানা। হ্যালো, ফ্রেন্ড! শুনে লোকটার শোল্ডার বে−ড দুটো এমন লাফ দিল, যেন দশ টনি একটা ট্রাক একসঙ্গে টান দিয়েছে ওগুলোকে। ‘কোনও আওয়াজ নয়, এতটুকু নড়াচড়া নয়,’ সাবধান করল রানা। ‘আমার হাতের শটগানটায় ডিয়ারশট লোড করা হয়েছে। যèিুঝি বোকামি করার কথা ভাবছ, তোমার শিরস্ফাড়ার টুকরোগুলো নাভি দিয়ে বের করে èে।’ অস্ত্রটা রাইফেল হলে লোকটা হয়তো লাফ দিয়ে জঙ্গলে ঢোকার ঝুঁকিটা নিত, কিন্তু শটগানের বিরুদ্ধে... নাহ্। ‘আমাকে তোমার মুখটা দেখাও,’ নির্দেশ দিল রানা। ‘ধীরে ধীরে মাথা ঘোরাও, রাইফেল ছেড়ে দিয়ে হাত দুটো আমার চোখের সামনে নিয়ে এসো।’ ল্যাটিন চেহারা, বেলপ্যানিজ বৈশিষ্ট্য পরিষ্কার Ñ যথেষ্ট খাড়া নয় নাক, ঠোঁট একটু মোটা, চোখ গোল, শারীরিক কাঠামো তেমন লম্বা নয়। বয়স হবে ত্রিশ কি বত্রিশ। মার্সেনারি লোকটার চোখে-মুখে কোনও ঘৃণা নেই, ওর মতই একজন প্রফেশনাল। ‘তুমি আর আমি আসলে পিয়ন,’ ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল রানা। ‘মরলে মরুক রুই-কাতলারা, কী বলো? তোমার নাম কী?’ আসছে সাইক্লোন ১৩৯ ‘মিলানদা,’ ফিসফিস করল লোকটা, ঠোঁট নড়ল কি নড়ল না। ‘বেশ,’ বলল রানা। ‘এখন তুমি পাহাড়ের নীচের দিকে তাকাতে পারো। তুমি পুলিশের ইউনিফর্ম পরে আছ কেন?’ ‘আমরা বেশ কজন মার্সেনারি সিভিল ড্রেসে এসেছি। কেন, আপনিই তো আমাল্ডেকে ক্যাটামার‌্যানে তুলে নিলেন, তখন দেখেননি? পুলিশের ড্রেস এখান থেকে সাপ−াই দেয়া হয়েছে আমাল্ডেকে।’ ‘কেন, সৈনিকল্ডে ড্রেস না দিয়ে পুলিশের ড্রেস দেয়া হলো কেন?’ জানতে চাইল রানা। ‘কিছু সৈনিক বাদে, সবাই নাকি পালিয়েছে,’ বলল লোকটা। ‘পালিয়েছে মানে ক্যু-তে যোগ দেয়নি। তারা নাকি কোথাও জড়ো হচ্ছে। বোধহয় এইসব কারণে পুলিশের ড্রেস দেয়া হয়েছে আমাল্ডেকে।’ ‘হুম। ওপরে, এখানে, তোমরা কজন?’ ‘তিনজন।’ ‘পজিশন?’ ইঙ্গিতে তার ডানদিকের ট্র্যাক দেখাল লোকটা। ‘তোমার সবচেয়ে কাছের লোকটা। কী নাম তার?’ ‘আমরা তাকে ফার্নান্দেজ বলি...’ ‘আর তৃতীয় লোকটাকে?’ ‘আলতুন।’ ‘এবার ব্যক্তিগত কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করি,’ বলল রানা। ‘বিয়ে করেছ?’ বিস্মিত হলো মার্সেনারি মিলানদা। ‘করেছি, সিনর।’ ‘ছেলেমেয়ে?’ ‘তিনজন, সিনর,’ জবাব দিল লোকটা। ‘ছয়, চার ও দুই বছর বয়স।’ ১৪০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘আমিও বিয়ে করছি, দুই বাচ্চার বাপ,’ বলল রানা। ‘তুমি যদি সহযোগিতা করো, তোমার সন্তানল্ডে বাবাকে আমি খুন করতে চাই না। কী বলছি বুঝতে পারছ, মিলানদা?’ ‘পারছি, সিনর।’ ‘রেডিও অন করে ফার্নান্দেজকে ডাকো,’ নির্দেশ দিল রানা। ‘বলো তোমার মনে হচ্ছে নীচে কেউ একজন নড়াচড়া করছে। শোনো, কথা বলবে সাবধানে। আমি আসলে খুন করার অজুহাত খুঁজছি।’ ঝমঝম বৃষ্টি ও দমকা বাতাসের মধেঞ্জস্ফুটে কিছু বলে বন্ধুকে সতর্ক করে ত্থেয়া সম্ভব নয়। মেসেজ পাঠানো শেষ হতে লোকটাকে পিছু হটে জঙ্গলে ঢুকতে বলল রানা। ঘাড়ের পাশে প্রচণ্ড একটা রদ্দা মেরে অজ্ঞান করল তাকে, ধরে ফেলল মাটিতে পড়বার আগেই। এক মিনিট লাগল মুখ, পিছমোড়া করে দুই কবজি ও দুই গোড়ালিতে টেপ লাগাতে। তারপর হনহন করে এগোল Ñ মিলানদার পজিশনে পৌঁছাবার বেশ কিছুটা আগেই থামাতে হবে ফার্নান্দোকে, তা না হলে মিলানদার অনুপস্থিতি সতর্ক করে তুলবে তাকে। বাঁক ঘুরতেই নীচের দিকে বৃত্তাকার একটা গর্ত দেখতে পেল রানা, চারপাশ উঁচু হয়ে আছে, প্রকৃতির তৈরি ছোট একটা স্টেডিয়াম বলা যেতে পারে। স্টেডিয়ামের ঠোঁট বরাবর এগিয়েছে লগিং ট্র্যাক, আশি ফুট খাত্থ নীচের ছোট্ট লেক থেকে কোনও গাছপালা ওটাকে আড়াল দিচ্ছে না, কাজেই নিজের অ্যামবুশ থেকে ট্র্যাক-এর উপর দিয়ে নীচের মাঠ ও কেবিনটা দেখতে পাবে রানা। বৃষ্টির মধ্যে কোনও রকমে দেখা যাচ্ছে কেবিনটা। ওদিক থেকে গুলির কোনও শব্দ আসেনি। রানা অবশ্য সেরকম কিছু আশাও করেনি। ফার্নান্দেজ মোটাসোটা ও অলস, যতটা না যোদ্ধা তারচেয়ে বেশি আসছে সাইক্লোন ১৪১ দার্শনিক। সতর্ক টাইপের লোক, মিলানদার মেসেজ পেয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। তাকে রানা পিছন থেকে মারল। ডান হাতের কিনারা দিয়ে ঘাড়ের পাশে জোরালো একটা আঘাত অজ্ঞান করবার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু রেইনকোটের নীচে লেদার জ্যাকেট পরে আছে লোকটা। জ্যাকেটের শক্ত ও পুরু কলারের কিনারা রানার হাতে যেন গেঁথে গেল। ঘুরে রানার দিকে ফেরার সময় ঝাঁকিয়ে মাথাটা পরিষ্কার করে নিল ফার্নান্দেজ। তার গা ঘেঁষে থাকতে হবে রানাকে, তা না হলে গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়। কাছে থাকার বিপত্থ কম নয়, ওজন ও শক্তির দিক থেকে ওর চেয়ে এগিয়ে আছে লোকটা। তার ডান হাঁটুতে লাথি মারল রানা। তৈরি ছিল ফার্নান্দেজ, হাতের রাইফেল সবেগে আঘাত করল ওর পায়ের পিছনদিকের নরম মাংসে। ব্যারেলটা ধরল রানা, সেটাকে নিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় শরীরটাকে মোচড়াল, ওর সমস্ত শক্তি ফার্নান্দোর হাত থেকে টান দিয়ে ছিনিয়ে নিল রাইফেলটা। হিংস্র বাঘের মত তেড়ে এল লোকটা, রানার মাথা লক্ষ্য করে বুট পরা পা চালাল। আবার গড়াল রানা, খুলির পাশে ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেল বুটটা। দুজনের মাঝখানে মাটিতে পড়ে আছে রাইফেল। দশাসই লোকটা লাথি ফসকে যাওয়ায় ভারসাম্য হারাল। সুযোগ বুঝে তার দুই পায়ের মাঝখানে লাথি মারল রানা, ডান পায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল সে, পড়ে যাচ্ছে রানার উপর, গলাটা ধরার জন্য হাতড়াচ্ছে। ভাঁজ করা হাঁটু দুটো এক করে পায়ের পাতা উপর দিকে তুলল রানা, তারপর যেই লোকটা ওগুলোর উপর পড়ল অমনি এক হাতে ওর চুল ধরে টান দিল, সেইসঙ্গে প্রাণপণ শক্তিতে জোড়া পায়ের লাথি চালাল উপর দিকে। ডিগবাজি খেয়ে ট্র্যাকের কিনারা ১৪২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ পার হয়ে গেল লোকটা, গড়িয়ে পড়া পাথরের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল তার আর্তনাদ, আশি ফুট নীচ থেকে ভেসে এল পানি ছলকানোর শব্দ। শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে ট্র্যাকের আরেকদিকে সরে এল রানা, শটগানের খোঁজে হাতড়াচ্ছে। ‘ফ্রিজ, অ্যামিগো।’ আলতুন, ভাবল রানা। লম্বা, রোগা। ছোট আকারের কটা রঙের চোখ রাগে চকচক করছে। রেইনকোট থেকে বৃষ্টি ঝরছে। রাইফেল ধরা হাতটা পাথরের মত স্থির। ‘অস্ত্র ফেলো।’ ফেলল রানা। ‘হাত মাথার পেছনে।’ এই নির্দেশটা খুশি মনে পালন করল রানা। কিনারা থেকে নীচে থুথু ফেলল আলতুন। ‘ওটা ছিল একটা শুয়োরের বাচ্চা, মারা পড়ায় খুশি হয়েছি আমরা। মিলানদা?’ ‘বেঁচে আছে,’ বলল রানা। ‘পাইনবনে।’ ‘তার কাছে নিয়ে চলো আমাকে। সাবধানে হাঁটবে,’ হুঁশিয়ার করল আলতুন। ‘এক মিনিট।’ রাইফেলটা এক হাতে ধরে রেইনকোটের ভিতর থেকে রেডিও বের করে কথা বলল, ‘ব্যাটাকে আমি ধরেছি।’ মাথার উপর হাত তুলে স্ফাড়িয়ে আছে রানা, মনে মনে বলল, ‘এখনই!’ পরমুহূর্তে ডান হাতটা শোল্ডার বে−ডের মাঝখান থেকে উঠে এল ক্ষিপ্রবেগে। রাইফেল ফেলে দিল আলতুন, তার হাত দুটো লাফ দিয়ে গলার দিকে মাত্র অর্ধেক পথ পেরুতে পারল, তার আগেই সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে তার দুই হাঁটু। শ্বাস নেয়ার জন্য ছটফট করছে লোকটা, ধীর ভঙ্গিতে ঢলে পড়ছে সে, কটা রঙের চোখে এখনও আসছে সাইক্লোন ১৪৩ বিস্ময়ের ঘোর লেগে রয়েছে। রক্ত বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে, বার কয়েক খিঁচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল দেহটা। ক্রল করে এগিয়ে গিয়ে নিজের থ্রোয়িং নাইফটা লোকটার গলা থেকে খুলে নিল রানা। শোল্ডার বে−ডের মাঝখানে খাপে ভরে রাখার আগে ফলাটা ভাল করে মুছে নিল ও। রাইফেল দুটো না নিয়ে একটা ঝোপে লুকিয়ে রাখল রানা। নিজের শটগান নিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এল পরিত্যক্ত খনির সামনে, লেকের কিনারায়। এখানে কয়েকটা গাছ স্ফাড়িয়ে আছে, তারই একটার ভেঙে পড়া ডালের আড়ালে দ্বিতীয় শটগানটা লুকিয়ে রেখে গেছে ও। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে স্ফাড়িয়ে থাকল রানা, অপেক্ষা করছে। ওর জানা নেই তারা সবাই আসবে কি না, তবে চাইছে সবাই যেন আসে। আসছে ওরা। ছোট্ট গ্র“প, পরস্পরের কাছাকাছি সবাই। হাতের ভাঁজে রাইফেল, কী এক কৌতুকে গলা ছেড়ে হাসছে। গ্র“পটা কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা। অত্যন্ত ক্লান্ত ও বিরক্ত বোধ করছে, কাজেই নৈতিকতা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না। অপ্রীতিকর হলেও, কাজটা না করলেই নয়। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ও, গুলি করল নিত¤েল্ফ কাছ থেকে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার সময় লাশগুলোর দিকে ভাল করে তাকালও না। দেখল কেবিন থেকে বেরিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে ম্যারিয়েটা, তার পিছু নিয়ে প্রেসিডেন্ট রোকো রামপামকেও আসতে দেখা গেল। একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসল রানা। নিজের পাশে খাড়া করে রাখল শটগানটা। প্রথমে পৌঁছাল ম্যারিয়েটা। হেঁটেই এসেছে, দৌড়ায়নি, তারপরও হাঁপাচ্ছে সে। ‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ১৪৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘গুলির আওয়াজ শুনলাম... তোমাকে লাগেনি তো?’ অভয় দিয়ে ক্ষীণ একটু হাসল রানা। তারপর মুখ তুলতেই দেখতে পেল প্রেসিডেন্টের হাতে ধরা ওয়ালথারের মাজল ওর দিকে তাক করা রয়েছে। এগারো ঘন কালো মেঘে একটা ফাঁক তৈরি হওয়ায় উঁকি দিল সূর্যটা, তবে তা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। বৃষ্টির নিবিড় ধারায় রোদ লাগায় পাহাড়ের উপর লাফিয়ে উঠল সবগুলো উজ্জ্বল রঙ নিয়ে বাঁকা রংধনুটা। প্রেসিডেন্টের তর্জনী পিস্তলের ট্রিগারে, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা, তবে আঙুলের চাপ বাড়ছে না। স্বস্তি বোধ করল রানা, কিন্তু ওর চেহারায় সে ভাব ফুটল না। ‘সতিঞ্জামি দুঃখিত, ইয়াংম্যান,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। ‘ওল্ডে এই ক্যু সমর্থন করতে বাধঞ্জামি। এর অন্যথা হলে ওরা আমার দুই নাতি-নাতনিকে খুন করবে। ম্যারিয়েটা চিঠি লিখে তোমাকে বেলপ্যানে আনিয়েছে, এই অপরাধে এরইমধেদ্দরা পিকোকে কিডন্যাপ করেছে। নিজের আনুগতেশু প্রমাণ দেয়ার জন্য এখন যজ্ঝিামি তোমাকে নিরস্ত না করি, পিকো ও ম্যারিয়েটাকে ওরা মেরে ফেলবে...’ অবিশ্বাস্য দৃশন্ধা ম্যারিয়েটাও দেখছে, শুনতে পাচ্ছে কী বলছেন আসছে সাইক্লোন ১৪৫ তার দাদু। অকস্মাৎ কেউ যেন কষে চড় মেরেছে তাকে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির হয়ে যাওয়ার সেটাই কারণ। অবশ্য পরমুহূর্তেই তার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। রানার পাশ থেকে শটগানটা ছোঁ দিয়ে তুলে নিয়ে সরাসরি দাদুর পেটে তাক করল ম্যারিয়েটা। ‘মাসুদ ভাইকে তুমি যদি গুলি করো, আমিও তোমাকে খুন করব।’ খুব জোরে শ্বাস নিল সে, আরও খাড়া হয়ে গেল শিরস্ফাড়া। ‘সত্যি করব!’ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রেসিডেন্ট, তারপর আপনমনে মাথা নাড়লেন, বিড়বিড় করে কী বললেন শোনা গেল না। তবে ঠোঁট নড়া দেখে রানা বুঝতে পারল কী বললেন তিনি। ধীরে ধীরে ঘুরলেন প্রেসিডেন্ট রামপাম, ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেবিনের দিকে, পিস্তল ধরা হাতটা শরীরের পাশে ঝুলছে। ‘আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করো তুমি,’ ম্যারিয়েটাকে বলল রানা। ‘ওপরের পাইনবনে এক লোককে বেঁধে রেখে এসেছি, নিয়ে আসি তাকে।’ ‘এক মিনিট, মাসুদ ভাই,’ বলল ম্যারিয়েটা। ‘সূর্য পশ্চিমে উঠেছে, এ-ও বিশ্বাস করতে রাজি আছি আমি, কিন্তু দাদু যা বললেন তা কি সত্যি হতে পারে? কলম্বিয়ান ড্রাগ বল্টসায়ীল্ডে হাতে দেশটা তুলে দিচ্ছেন তিনি? রোকো রামপাম, সারা দুনিয়ায় যাঁর মত নির্লোভ আর সৎ মানুষ দ্বিতীয়টি নেই?’ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘তোমার মত আমিও ব্যাপারটা বিশ্বাস করি না। কেন তিনি এই কাজ করেছেন তার নিশ্চয়ই সঙ্গত কোনও কারণ আছে। সেটা হয়তো তাঁকে ইন্টারোগেট করে বের করতে হবে। আমি আসছি।’ ‘কিন্তু... কিন্তু উনি তোমাকে খুন করতে...’ রানাকে মাথা নাড়তে দেখে থেমে গেল ম্যারিয়েটা। ‘উনি কী বললেন শোনোনি? খুন করতে নয়, পিস্তল দেখিয়ে উনি ১৪৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ আমাকে এখান থেকে তাড়াতে চেয়েছিলেন।’ অন্যমনস্ক ম্যারিয়েটা মাথা ঝাঁকাল। মিলানদার শুধু পা থেকে টেপ খুলে নিয়েছে রানা। পাহাড়ী ঢাল বেয়ে আড়ষ্টভঙ্গিতে নেমে আসছে সে, হাত দুটো পিছনে টেপ দিয়ে এক করা। তার পাঁচ-সাত হাত পিছনে রয়েছে রানা। এই মুহূর্তে ওর হাতে রয়েছে দ্বিতীয় শটগানটা, লুকানো জায়গা থেকে বের করে এনেছে। সঙ্গী যোদ্ধাল্ডে লাশগুলোকে পাশ কাটিয়ে এল মিলানদা। ঘাড় ফিরিয়ে লেকের দিকেও একবার তাকাল সে, দেখল ফার্নান্দেজের ঘাড় মটকানো লাশটা পড়ে রয়েছে পানির কিনারায়। ওল্ডে অপেক্ষায় সেই একই জায়গায় স্ফাড়িয়ে রয়েছে ম্যারিয়েটা। আঙুল তাক করে একটা ঝোপের পাশে খানিকটা ঘাস দেখাল রানা। ‘ওখানে বসো, মিলানদা।’ বসল বন্দি মার্সেনারি। ম্যারিয়েটার দিকে তাকাল রানা। ‘একটু দূরে সরে গিয়ে চারপাশে নজর রাখো, আমরা আলাপটা সেরে নিই।’ মাথা ঝাঁকিয়ে ওখান থেকে চলে গেল ম্যারিয়েটা। ‘তুমি প্রবাসী বেলপ্যানিজ মার্সেনারি?’ জানতে চাইল রানা। ‘নিকার‌্যাগুয়ায় যুদ্ধ করো?’ চুপ করে থাকল মিলানদা। ‘সহযোগিতা করো, কথা দিচ্ছি ঠকবে না,’ বলল রানা। রানার চোখে কী যেন খুঁজল মিলানদা। তারপর মাথা ঝাঁকাল, বলল, ‘সি, সিনর।’ ‘এখানে তোমরা কী করছ? বেলপ্যানে?’ ‘আমরা ভাড়াটে যোদ্ধা, সিনর,’ বলল মিলানদা। ‘যে টাকা দেয় আসছে সাইক্লোন ১৪৭ তার হয়ে দুনিয়ার যে-কোনও জায়গায় যুদ্ধ করতে যাই। এখানে আমাল্ডেকে যুদ্ধ করার জন্যে ভাড়া করেছিলেন সিনর পাবলো টিকালা।’ ঘাড় ফিরিয়ে লাশগুলোর দিকে তাকাল সে। ‘কার যু˜ধ, কে প্রতিপক্ষ, ন্যায় কি অন্যায়, এ-সব আমরা খোঁজ নিই না। আমরা মার্কিনিল্ডে হয়ে যুদ্ধ করেছি, আবার ওল্ডে বিরুদ্ধে কলম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেলের পক্ষেও লড়েছি।’ ‘তা বুঝলাম,’ বলল রানা। ‘এখানে তোমরা কাল্ডে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিলে?’ ‘আমাল্ডে লিডার বেনিটো। তার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ পেয়েছি, পালাতে চেষ্টা করলে কিছু মন্ত্রী-মিনিস্টারকে খুন করতে হবে,’ জানাল মিলানদা। ‘বেলপ্যান সেনাবাহিনী সাহায্য করবে। এই ঝামেলা মেটার পর বেলপ্যান সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হবে আমাল্ডেকে।’ ‘কেন, বেলপ্যান সেনাবাহিনীতে কী কাজ তোমাল্ডে?’ জানতে চাইল রানা। ‘কাজ একটাই,’ বলল মিলানদা। ‘কলম্বিয়া থেকে কোকেনের চালান আসবে, সেই চালান যাতে নিরাপদে সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকোয় ঢুকতে পারে তার বল্টস্থা করা। তারপর মেক্সিকান মাফিয়ারা চালানগুলো তুলে দেবে মার্কিন মাফিয়ার হাতে।’ ‘প্রেসিডেন্ট আর তাঁর নাতি-নাতনি সম্পর্কে তোমাল্ডেকে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ দেয়া হয়?’ ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। প্রেসিডেন্টকে গৃহবন্দি করতে বলা হয়েছে। তবে তাঁর গায়ে হাত দেয়া একদম বারণ। কারণ তাঁকে পরে ল্ডকার হবে। তবে, তিনি যজ্ঝিাপনাকে আমাল্ডে হাতে তুলে দিতে না পারেন, তাঁর নাতনিকে অবশ্যই আমরা যেন খুন করি।’ ‘প্রেসিডেন্টকে ব−্যাকমেইল করা হচ্ছিল, তাই না?’ নগণ্য একজন মার্সেনারি এত কিছু জানবে না, তবু টোকা মেরে দেখছে রানা। ১৪৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘তা আমি কী করে বলব, সিনর।’ ‘বেলপ্যান সেনাবাহিনীর কোন্ অফিসার এর সঙ্গে জড়িত, জানো?’ মাথা নাড়ল মিলানদা। ‘বাকি মার্সেনারিরা কোথায়?’ জানতে চাইল রানা। ‘বেনিটো, লাফাজা, বোকা অ্যারেনাস, রডরি...’ ‘বসেল্ডে বস্ আসবেন, তাই তাঁর জনদ্দরা সবাই ল্যা পুনটা ডেল কর্নেল ইংলেস-এ (অর্থাৎ ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্টে) অপেক্ষা করছে।’ ‘হুম। ওই জায়গায়, মানে ঠিক ওখানে কেন অপেক্ষা করছে তারা?’ লাফাজার ত্থেয়া তথন্ধা সত্যি না মিথ্যে যাচাই করতে চাইছে রানা। ‘ওখানেই তো অপেক্ষা করবে, সিনর,’ বলল মিলানদা। ‘কারণ বসেল্ডে বস্ ওই জায়গাটাকেই তো তাঁর হেডকোয়ার্টার বানিয়েছেন।’ ‘সে কে, তুমি জানো।’ ‘খোদার কসম বলছি, সিনর, সত্যিই আমি জানি না,’ বলল মিলানদা। ‘আমাল্ডে দলের কেউই জানে না। তবে যারা আমাল্ডেকে ভাড়া করে এনেছে, তারা হয়তো জানে Ñ এই যেমন ধরেন সিনর পাবলো টিকালা।’ ‘বেশ,’ বলল রানা, মিলানদার কথা অবিশ্বাস করছে না। ‘বসেল্ডে বস্ যেখানে আসবে, মানে, ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট সম্পর্কে আর কী জানো তুমি?’ ‘একজন স্থানীয় মেজরকে আটকে রাখার জনেদ্দখানে নিয়ে আসা হবে বলে শুনেছি, সিনর,’ বলল মিলানদা। ‘স্থানীয় মেজর? কে, নাম কী তার?’ ‘বেলপ্যান প্রেসিডেন্ট রোকো রামপাম-এর নাতি তিনি, সিনর। আসছে সাইক্লোন ১৪৯ তাঁকে নিকার‌্যাগুয়া থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে শুনেছি। নাম... নাম... পিকো রামপাম, সিনর।’ উত্তেজনা বোধ করছে রানা। ওর পরবর্তী গন্তব্য যে ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু যে পিকো রামপামকে উদ্ধার করতে যাবে, তা নয়, বসেল্ডে বস্-এর পরিচয়টাও জানতে হবে ওকে। ‘আমি তোমাকে ছেড়ে দিলে এই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে তুমি?’ ‘ঈশ্বর যদি চান।’ ‘আমরা চলে যাবার সময় তোমার হাত খুলে দিয়ে যাব,’ বলল রানা। ‘সেটা আপনার দয়া, সিনর।’ ‘মন্ত্রী, মেজর পিকো ও সরকারী কর্মকর্তা যাঁল্ডে আটক করা হয়েছে, আমি তাঁল্ডে সবাইকে মুক্ত করতে চাই,’ বলল রানা। ‘ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট, মানে, ওই এস্টেটেই রাখা হয়েছে তাল্ডেকে,’ বলল মিলানদা। ‘তিন মন্ত্রী, পাঁচ সচিব... সব মিলিয়ে বাইশজন। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে এত কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে, তাল্ডে নাগাল পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। আমাল্ডেও সেখানে নামার অনুমতি নেই।’ সে দেখা যাবে, ভাবল রানা। তাকে ধনল্টাদ জানিয়ে বলল, ও যপ্পিরা পড়ে, তারপরও প্রকাশ করবে না তথ্যগুলো কোথায় পেয়েছে। ‘আপনার অনেক দয়া, সিনর...’ আরও মিনিট দশেক তাকে জেরা করল রানা। তবে নতুন আর তেমন কোনও তথ্য পাওয়া গেল না। অবশেষে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে স্ফাড়াল মিলানদা। কাছাকাছি কোথাও ছিল ম্যারিয়েটা, ওল্ডে আলাপ শেষ হয়েছে ১৫০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ বুঝতে পেরে একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। সামনে থাকল মিলানদা, ওরা দুজন তার পিছনে। কেবিনে ফিরছে ওরা। মিলানদাকে একচালার নীচে, ল্যান্ড-রোভারের পাশে ফেলে রেখে ভিতরে ঢুকল ওরা। রানা আবার তার পা দুটোয় টেপ লাগিয়েছে। লিভিং-রুমে মাত্র ঢুকেছে ওরা, প্রেসিডেন্টের বেডরুম থেকে ধাতব একটা আওয়াজ ভেসে এল Ñ ক্লিক্ ¯−াইড টানার শব্দ, তারপর আরেকবার শোনা গেল Ñ ক্লিক্। পরমুহূর্তে কাঠের মেঝেতে নিরেট কিছু ছুঁড়ে মারার শব্দ ভেসে এল। লিভিং-রুম থেকে বেরিয়ে এসে বেড়রুমের ল্ডজা খুলছে রানা, জানে কী দেখতে পাবে ভিতরে। ওর ঠিক পিছনেই রয়েছে ম্যারিয়েটা। মৃদু শব্দে ফোঁপাচ্ছে সে। ডেস্কে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, নিষ্পলক চোখ দুটো দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ। ফোঁপাচ্ছেন না, তবে চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। প্রেসিডেন্টের চেয়ারের পাশে, মেঝেতে পড়ে রয়েছে রানার ওয়ালথার। কার্পেটের উপর একটা বুলেট পড়ে রয়েছে। কাল রাতে এই বুলেট থেকে গান-পাউডার সরিয়ে নিয়েছিল রানা। মেঝে থেকে ওয়ালথারটা নিয়ে ম্যাগাজিন খুলল রানা, অবশিষ্ট আটটা বুলেট বের করল, সেগুলোর বদলে পকেটের বাক্স থেকে নিয়ে রিলোড করল ‘জ্যান্ত’ বুলেট। রানার হাত ধরে ওকে প্যাসেজে বের করে আনল ম্যারিয়েটা। চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘পিস্তলে তুমি বাতিল বুলেট লোড করেছিলে।’ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘তার মানে আমি তোমার প্রাণ বাঁচাইনি,’ বলল ম্যারিয়েটা। ‘ব্যাপারটা কাল রাতেই তুমি জেনেছ।’ আসছে সাইক্লোন ১৫১ ‘সন্দেহ করেছিলাম,’ শুধরে দিল রানা। ‘এই ক্যু-র পেছনে যেই থাকুক, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা ফিগারহেড ল্ডকার তার Ñ সবাই যাকে সৎ বলে জানে, বিশ্বাস করে, ভক্তি করে, যার সুনাম আছে, আছে ব্যক্তিত্ব।’ ম্যারিয়েটার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। ‘কিন্তু এর কী ব্যাখ্যা... আমার èেতুল্য দাদু... কী করে?’ তার কাঁধে হাত রাখল রানা, তারপর কাছে টেনে নিল। ‘শান্ত হও, পি−জ। তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, তবে অবশ্যই জানব আমরা। একটু ধৈর্য ধরো।’ দশ মিনিট পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে ম্যারিয়েটাকে রানা বলল, ‘তোমার দাদুর সঙ্গে কথা বলব আমি।’ হাতঘড়ি দেখল ও। ‘পনের মিনিট।’ ‘আমিও দাদুর পাশে থাকতে চাই।’ শ্রাগ করল রানা। ‘আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে নিজেকে শক্ত করো, কী শুনতে হবে কেউ জানি না আমরা।’ বড় করে শ্বাস নিয়ে ম্যারিয়েটা বলল, ‘আমার এখনও বিশ্বাস, দাদু কোনও অন্যায়-অপরাধ করতে পারেন না।’ প্রেসিডেন্ট ইতিমধেঞ্জনেকটাই সামলে নিয়েছেন নিজেকে। বেডরুমে ওল্ডেকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। তাঁর সামনে একটা গ−াস রাখল ম্যারিয়েটা, তাতে এক কি ষ্ণে আউন্স ব্র্যান্ডি আছে। ‘কীভাবে কী হয়েছে আমার জানা ল্ডকার,’ কোনও ভূমিকা না করে তাঁকে বলল রানা। মাথা ঝাঁকালেন রোকো রামপাম। জানা গেল, চলতি বছরের প্রথমদিকে আধা-সরকারী সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রোকো রামপামকে, তখনই তাঁকে ১৫২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ফাঁদে ফেলা হয়। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, কথাটা সত্যি Ñ ফাঁদ্মা কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডরা পাতলেও, তাল্ডেকে সাহায্য করেছিল খোদ সিআইএ-র একটা অংশ। ওয়াশিংটনের হিলটন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে উঠেছিলেন তিনি। মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর অফিসে মিটিং সেরে নিজের স্যুইটে ফিরে দেখলেন বেডসাইড টেবিলে তাঁর পারিবারিক ফটোগ্রাফটা নেই। যেখানেই যান তিনি, বাঁধানো এই ফটোটা সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকে। তারপর তিনি দেখলেন বড় আকারের কালো একজোড়া স্যামসনাইট সুটকেসের একটা ওয়ার্ড্রোব থেকে বের করে ভ্যালেট- এর বেঞ্চে রাখা হয়েছে, তালা খোলা। সুটকেসটার ডালা খুললেন তিনি। ফটোগ্রাফটা ভিতরে পাওয়া গেল। তিনি দেখলেন সুটকেসের পিছনদিকের লাইনিং চেরা হয়েছে, তার ভিতর থেকে সেলোফেন-এ মোড়া একটা প্যাকেট উঁকি দিচ্ছে। প্যাকেটটা বের করে মুখ খুললেন রোকো রামপাম। দেখা গেল ভিতরে সাদা পাউডার রয়েছে। কোকেন বা হেরোইন জীবনে কখনও দেখেননি তিনি, তা সত্ত্বেও বুঝতে পারলেন ওগুলোর একটাই হবে। ইন্টারকমে হোটেলের ম্যানেজারকে ডাকতে যাবেন প্রেসিডেন্ট, এই সময় কামরার ভিতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কয়েকজন মার্কিন শ্বেতাঙ্গ ও ল্যাটিনো, নিগ্রো দুই ক্যামেরাম্যান সহ। নিজেল্ডে পরিচয় দিল তারা Ñ সিআইএ। বলল, গোপনসূত্রে খবর পেয়েছে তারা বেলপ্যানিজ প্রেসিডেন্ট-এর স্যুইটে প্রচুর পরিমাণে হেরোইন লুকানো আছে, তাই সার্চ করতে এসেছে। পরিচয়-পত্রও দেখাল ওল্ডে কয়েকজন। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যাঙলিতে, সিআইএ হেডকোয়ার্টারে ফোন করলেন প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে তাঁকে জানানো হলো, কথাটা সত্যি, গোপন সূত্রে আসছে সাইক্লোন ১৫৩ একটা খবর পেয়ে বেলপ্যান প্রেসিডেন্টের স্যুইট সার্চ করতে একটা টিমকে পাঠানো হয়েছে। সার্চ করার ল্ডকার হলো না, ভ্যালেট-এর বেঞ্চে খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল সুটকেসটা, ভিতরে হেরোইন ভর্তি প্যাকেট। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে অন্তত একশোটা স্টিল ফটো তুলল ক্যামেরাম্যান। ওল্ডে জোর-জবরদস্তিতে পোজ দিতে হলো প্রেসিডেন্টকে Ñ সুটকেস খুলতে সিআইএ এজেন্টল্ডে বাধা দিচ্ছেন, পিস্তলের মুখে পিছু হটছেন তিনি, জিভে ঠেকিয়ে হেরোইন পরীক্ষা করছেন ইত্যাদি। ভিডিও ক্যামেরা দিয়েও রেকর্ড করা হলো সব। তাঁর পক্ষে কথা বলবার জন্য একজন উকিলকে ডাকতে চাইলেন তিনি, জবাবে বলা হলো এখানে চতুর্থ পক্ষের উপস্থিতি নাকি তাঁর জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবে। প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, চতুর্থ পক্ষ মানে? এর জবাব খানিক পরেই পেলেন তিনি। এবার শুরু হলো স্বীকারোক্তি আদায়। মৌখিক আশ্বাস ত্থেয়া হলো, এই স্বীকারোক্তি নিতান্ত বাধ্য না হলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনওদিনই বল্টহার করা হবে না। এটা তাল্ডে জন্য শুধু একটা বিমা হিসাবে কোনও লকারে তালাবদ্ধ থাকবে। বাধা দিলে এখনই খুন হয়ে যাবেন, সিআইএ এজেন্টল্ডে এই হুমকির মুখে নিজের হাতে স্বীকারোক্তি লিখতে হলো তাঁকে। ওরা যেভাবে বলে দিল সেভাবেই লিখলেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কোকেন ও হেরোইন পাচারের সঙ্গে তিনি জড়িত। এই অবৈধ বল্টসা থেকে আয় করা টাকা তিনি জেনেভার ন্যাশনাল সুইস ব্যাঙ্কে [অ্যাকাউন্ট ন¤ল্ফসহ] জমা রেখেছেন। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ কোটি মার্কিন ডলারের কিছু বেশিই হবে। ব্যাঙ্কে টেলিফোন করার সুযোগ ত্থেয়া হলো রোকো রামপামকে। কোড জানানোর পর ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জবাব দিল, হ্যাঁ, ১৫৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ অত ন¤ল্ফ অ্যাকাউন্টে প্রায় পঞ্চাশ কোটি মার্কিন ডলার জমা আছে। স্বীকারোক্তি আদায় হয়ে যেতেই ক্যামেরাম্যানল্ডে নিয়ে চলে গেল মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা, অর্থাৎ সিআইএ এজেন্টরা। থাকল শুধু তিনজন কলম্বিয়ান। এরাই হলো তৃতীয় পক্ষ, কলম্বিয়ার ড্রাগ লর্ড। প্রেসিডেন্টকে তারা বলল, সিআইএ-র অনেক উঁচুপল্ডে অফিসাররা তাল্ডেকে সাহায্য করছে, সেজন্যই এত বছর ধরে বিপুল টাকা খরচ করেও ইউএস ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বিয়ান ড্রাগের অবৈধ আমদানি বন্ধ করতে পারেনি। যাই হোক, সহজ ভাষায় একটা প্রস্তাব দিল তারা। বেলপ্যানে তারা একটা ক্যু ঘটাবে। এই ক্যু-র প−্যান তৈরি করেছেন বেলপ্যান সেনাবাহিনীর প্রধান কাসমেরো পালমো। অসুস্থ হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে পড়ে আছেন তিনি, এটা আসলে সেনাপ্রধানের অভিনয়। ক্যু সফল হলে পরে রোকো রামপামকেই ক্ষমতায় বসানো হবে। তাঁর নতুন ক্যাবিনেটে কাসমেরো পালমো হবেন ¯ল্ফাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ক্যু ঘটানোর কাজে তাঁকে সাহায্য করছেন আরও কয়েকজন অফিসার, তবে তাল্ডে কারও পরিচয় তাঁর জানা নেই। কেন এই ক্যু, প্রশ্ন করা হলে জবাব ত্থেয়া হলো: যুক্তরাষ্ট্রে হেরোইন ও কোকেন পাচার করার জন্য কলম্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝখানে দুটো ট্র্যানজিট পয়েন্ট ল্ডকার। তার মধ্যে একটা অবশ্যই মেক্সিকো; যথেষ্ট সশস্ত্র পুলিশ ও সৈন্য না থাকায় বেলপ্যানই হতে পারে দ্বিতীয় ট্র্যানজিট পয়েন্ট। কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডরা রেডিওর মাধ্যমে সংকেত দিলে রাজধানী ছেড়ে প্রথমে প্রেসিডেন্ট তাঁর নাতনিকে নিয়ে কি কানাকায় চলে যাবেন। তারপর, তাল্ডে আরও একটা সংকেত পেলে, তিনি একা সরে যাবেন রাজধানী থেকে আরও দূরে, পাইন রিজ-এ। ইতিমধ্যে বেলপ্যান সেনাবাহিনীর কয়েকজন সৈনিকের সাহায্য নিয়ে নিকার‌্যাগুয়া থেকে আসা মার্সেনারিরা কুশু বিরোধিতাকারী মন্ত্রী আসছে সাইক্লোন ১৫৫ ও সরকারী কর্মকর্তাল্ডে আটক করে ল্যা পুনটা ডেল কর্নেল ইংলিস এস্টেটে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে। তারপর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসবেন সেনাপ্রধান কাসমেরো পালমো, কিংবা তাঁকে হয়তো বন্দুকের মুখে বের করে আনা হবে। কোন্টা সত্যি, বলা কঠিন। যাই হোক, তিনি ঘোষণা করবেন কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডল্ডে স্বার্থে সামরিকবাহিনীর একটা অংশের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ত্থেয়া হয়েছে। জনগণকে জানাবেন, বেলপ্যানের নির্বাচিত, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে পাইন রিজ-এ গৃহবন্দি করা হয়েছিল, অনুগত সৈনশুা তাঁকে মুক্ত করে রাজধানীতে আনছে। সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করে বিদ্রোহী সেনাল্ডে ফায়ারিং স্কোয়াড-এ স্ফাড় করানো হবে Ñ আসলে বিচারের নামে প্রহসন করে মেরে ফেলা হবে যে-সব সৈনিক কুশু বিরোধিতা করবে তাল্ডেকে। প্রেসিডেন্টকে বলা হলো, নিরাপত্তার কারণে নিকার‌্যাগুয়া থেকে তার নাতি পিকো রামপাম ও বেলপ্যান থেকে তাঁর নাতনি ম্যারিয়েটা রামপামকে আটক করবে তারা। পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে ত্থেয়া হলো, প্রেসিডেন্ট যদি তাল্ডে সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, নাতি ও নাতনিকে চিরকালের জন্য হারাতে হবে তাঁকে। যা বলবার ছিল বলে মাথা নিচু করে বসে থাকলেন প্রেসিডেন্ট, আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। আসলে উচ্চারণ করবার মত কোনও শব্দ নেই। রানা উপলব্ধি করল, ব্যক্তিগত মর্যাদা ও দুই নাতি-নাতনির জীবন বাঁচাবার তাগিদে মুখ বুজে ওল্ডে প্রতিটি কথায় সায় দিতে হয়েছে প্রেসিডেন্টকে। সিআইএ-র কাছে তাঁর ‘অপরাধ’-এর স্টিল ফটোগ্রাফ, ভিডিও টেপ ও তাঁর নিজের হাতে লেখা স্বীকারোক্তি থাকায় বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, দেশের মানুষ, মিডিয়া কিংবা বিদেশী দূতাবাসগুলোকে ১৫৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ কিছু জানাতে সাহস পাননি তিনি। জানালেই বা কী হত, যার সুইস ব্যাঙ্কে পঞ্চাশ কোটি ডলার জমা আছে, তার কথা কে বিশ্বাস করত? কামরার ভিতর নীরবতা যখন অসহ্য হয়ে উঠল, কিছু বলতে বাধ্য হলো রানা। ও বলতে পারত, যত যা-ই হোক, বহু দূর থেকে এক লোক আপনাল্ডেকে সাহায্য করতে এসেছে জেনেও আপনি তার দিকে পিস্তল তাক করলেন! বলতে পারত, আপনি অপরিণামদর্শী, কাপুরুষ, অযোগ্য। কিন্তু সে-সব কিছু না বলে বলল, ‘কাল আমার এমনকী এ সন্দেহও হয়েছিল যে কুশু প−্যানটা আপনারই করা। সেজন্যেই বুলেট থেকে বারুদ বের করে নিয়ে পিস্তলটা দিয়েছিলাম আপনাকে। যাই হোক, যা করেছেন অসহায় অবস্থাতেই করেছেন, এটুকু আমি বিশ্বাস করি। সেজন্যেই আপনার নিরাপত্তার দিকটা দেখব আমি। যত্থি এ- ও জানি, দু’বছর আগে আপনি সতর্ক হলে এসবের কিছুই ঘটত না।’ প্রেসিডেন্ট এখনও একটা পাথরের মূর্তি। উত্তরে কিছুই তিনি বললেন না। রানার দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে ম্যারিয়েটা রামপাম। বারো পাহাড়শ্রেণীর গোড়া থেকে শুরু হয়ে নদীর ধার ঘেঁষে কাঁচা একটা রাস্তা বেলপ্যান সিটির দিকে চলে গেছে, লগিং ট্র্যাক ও হাইওয়ে তৈরি হওয়ার আগে ওটাই ছিল মাকা নদীর তীর ও উপকূল এলাকা থেকে আসছে সাইক্লোন ১৫৭ রাজধানীতে যাওয়ার একমাত্র পথ। হাইওয়ে তৈরি হওয়ার পর ওটা আর কেউ বল্টহার করে না। তবে রাজধানীর দিক থেকে আসা কমবেশি পঞ্চাশ মাইল রাস্তা পিচ ঢেলে পাকা করা হয়েছিল। ওই পাকা অংশ থেকেই একটা ট্র্যাক বেরিয়েছে, যেটা ধরে ল্যা পুনটা ডেল-এ যাওয়া যায়। জায়গাটা সরু একটা উপত্যকার শেষ মাথায়, পাকা রাস্তা থেকে বিশ মাইল উত্তরে; রাজধানী থেকে চলি−শ মাইল দূরে। হাইওয়ে ভেঙে যাওয়ায় এই কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে চাইছে রানা। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ল্যান্ড-রোভারটা নিয়ে বেরিয়েছে ওরা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দূরত্বটুকু পার হতে তিন ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু পথ থেকে গাছপালা সরাতে এত বেশি সময় লেগে যাচ্ছে, গন্তবেঞ্জাজ আদৌ পৌঁছাতে পারবে কিনা সন্দেহ। রানার প−্যান হলো ল্যান্ড-রোভারে করে রাজধানীতে পাঠাবে ম্যারিয়েটাকে। সরাসরি মেক্সিকান দূতাবাসে গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে তাল্ডে সাহায্য চাইবে সে। জিজ্ঞেস করবে, কর্নেল জুডিয়াপ্পা এসকুইটিলা এখন কোথায়। মেক্সিকো সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কোনও রকম প্রতিশ্র“তি তিনি আদায় করতে পেরেছেন কি? নিজের বল্টহারের জন্য বিএমডবি−উ মোটরসাইকেলটা নিয়ে এসেছে রানা, ল্যান্ড-রোভারের পিছনে তোলা হয়েছে সেটাকে। রানার মনে আছে ভালডেজ লাফাজা গর্ব করে ওকে বলেছিল, এদিক ওদিক থেকে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-মিনিস্টারকে আটক করা হয়েছে, তাল্ডে সবাইকে ল্যা পুনটা ডেল-এ ফায়ারিং স্কোয়াডে স্ফাড় করানো হবে। গর্ব করার সময় কোকেনখোর লোকটার হুঁশ-জ্ঞান ছিল না, নিজের অজান্তে গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিয়ে বসেছে। ওই জায়গা নাকি বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার হেডকোয়ার্টার। এই তথ্য ১৫৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ প্রেসিডেন্ট রামপাম-এর কাছ থেকেও পাওয়া গেছে। মিলানদার মুখ থেকেও এই একই তথ্য পেয়েছে রানা। সে আরও জানিয়েছে, ওখানে নিয়ে এসে আটক করা হবে মেজর পিকো রামপামকেও। রাস্তার উপর পড়ে থাকা গাছগুলোকে চেইন-স’ দিয়ে কেটে প্রথমে ছোট করতে হচ্ছে, ফলে দুজনের হাতেই ফোস্কা পড়ে গেল। কখনও কাদার ভিতরে ডেবে গেল ল্যান্ড-রোভারের চাকা, তুলতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হলো। তবে ফাঁকা ভাল পথও পাওয়া গেল মাঝেমধ্যে। পাঁচ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করবার পর ম্যারিয়েটা জানতে চাইল, ‘তোমার পাকা রাস্তা আর কত দূর?’ ‘আর বেশি না, চার মাইল,’ বলল রানা। দুজনেই জানে সামনের পথে দশ-বারোটা গাছ পড়ে থাকতে পারে, কিংবা হয়তো একটা ব্রিজ ভাঙা থাকতে পারে। লগিং-এর জন্য তৈরি, ট্র্যাকটা লম্বা একটা রিজ-এর পাশ ধরে এগিয়েছে। ট্র্যাকের উপর দিয়ে চলে যাওয়া ঝরনাগুলো ছোট হলেও, ওগুলোর উপর দিয়ে ভারী ট্রাক চলাচল করবে ভেবে মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে, কাজেই না ভাঙারই কথা। আরও মাইলখানেক গাড়ি চালাবার পর ট্র্যাক-এর উপর একটা বোল্ডার দেখতে পেল ম্যারিয়েটা। সেটার পিছনে রয়েছে ধরাশায়ী আরেকটা গাছ। এদিকে দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ কী ভেবে ম্যারিয়েটাকে গাড়ি থামাতে বলল রানা। তারপর মনে করিয়ে দিল, লগিং, অর্থাৎ গাছ কাটার পালা শেষ হওয়ার পর এই ট্র্যাক শুধু প্রেসিডেন্ট রামপাম আর তাঁর অতিথিরা বল্টহার করেন। এখন, রানা যদি কুশু লিডার হত, বিমা হিসাবে কাঁচা ও পাকা রাস্তার কাছাকাছি কোথাও অ্যামবুশ পাতত, ধরাশায়ী কোনও গাছের আড়ালে Ñ কাল্যাশনিকভ নিয়ে দুজন লোকই যথেষ্ট। আসছে সাইক্লোন ১৫৯ কী অভিনয় করতে হবে বলে যাচ্ছে রানা, হুইলে হাত রেখে মন দিয়ে শুনছে ম্যারিয়েটা। অবশেষে নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল সে। তারপর দাদুর কথা ভাবল ম্যারিয়েটা, তাঁকে কেবিনে রেখে আসার সিদ্ধান্তটা দেখা যাচ্ছে ভুল হয়নি। হাইওয়ে ভেঙে যাওয়ায় তাঁর কাছে কেউ পৌঁছাতে চাইলে এই রাস্তা ধরেই আসতে হবে তাকে, পাশ কাটাতে হবে ওল্ডেকে। একটু স্বস্তি বোধ করছে সে। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নীচে নেমে এল রানা। তারপর মোটর বাইক খানিকটা পিছিয়ে আনল, ল্যান্ড-রোভারের পিছনের ল্ডজা যাতে বন্ধ না হয়। সবশেষে ভিতরের আলো নিয়ন্ত্রণ করার প্রেশার সুইচে টেপ লাগাল... ছাল্ডে দুটো স্পটলাইট ও জোড়া হেডল্যাম্প জ্বেলে গাড়ি চালাচ্ছে ম্যারিয়েটা। পিছনের ল্ডজা দোল খাচ্ছে। তীক্ষè একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল গাছটা। ঢালু রাস্তা, স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিল ম্যারিয়েটা, তারপর ব্রেক করল কষে, ফলে পথের উপর আড়াআড়িভাবে স্ফাড়াল ল্যান্ড-রোভার, লেজের দিকটা কিনারার বাইরে ঝুলছে, পিছনের ল্ডজা পুরোপুরি খোলা। দেরি না করে সাইড ডোর খুলে ফেলল ম্যারিয়েটা, সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের আলো জ্বলে উঠল। কেউ তাকিয়ে থাকলে দেখতে পাবে সে একটি মেয়ে, একা। রানা বুদ্ধি দিয়েছে Ñ ভাব দেখাবে তুমি অসহায়, বিপদে পড়েছ। পাহাড়ী ট্র্যাকে বেরিয়ে এসে আতঙ্কে মরে যাচ্ছ। হেডলাইট জ্বেলে রেখে গাড়ি থেকে নামবে, স্পটলাইট তাক করা থাকবে ব্যারিকেড- এর ওপর দিকে। হাতে একটা টর্চ রাখবে। কাউকে দেখতে পেলে ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলবে মুখে, চিৎকার জুড়ে দেবে... রানার নির্দেশ পালন করেই গাড়ি থেকে নীচে নামল ম্যারিয়েটা। ওর কাছে যে কোনও অস্ত্র নেই সেটা বোঝাবার জনঞ্জদৃশ্য ১৬০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ প্রতিপক্ষকে খানিকটা সময় দিল সে, তারপর রেইনকোটটা গায়ে আরেকটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে গাছটার দিকে এগোল, ঘন ঘন ফোঁপাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা গেল গাছটা করাত দিয়ে কেটে পথের উপর ফেলা হয়নি, ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। তবে কি রানার এটা উদ্ভট চিন্তা, কোথাও কোনও অ্যামবুশ নেই? কে জানে, হয়তো আছে, তবে আরও সামনে কোথাও। কারও কোনও সাড়া না পেয়ে রাগে গাছটার একটা ডালে লাথি মারল ম্যারিয়েটা। এগোতে গিয়ে অপর পা সরু ডালে বেধে যাওয়ায় হোঁচট খেল সে, তারপর ধপাস করে পড়ে গেল জমে থাকা কাদাপানির মধ্যে। হেসে উঠল এক লোক। অভিনয় করার প্রয়োজনই হলো না ম্যারিয়েটার। মুখের কাছে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল সে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল লোকটা, পাখি ধরতে আসা বিড়ালের মত নিঃশব্দে। স্পটলাইটের আলোয় চকচক করছে তার রেইনকোট, খাকি সামরিক ইউনিফর্ম, জাঙ্গল বুট। রেইনকোটের মাঝখানটা ফাঁক করে রাইফেলের ব্যারেল বের করল সে। অনড় পড়ে আছে ম্যারিয়েটা। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা তার বুকে আঘাত করছে। ওগুলো বরফের মত ঠাণ্ডা, অনুভব করল ভেজা কাপড়ের নীচে স্তনের বোঁটা আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা দুজন থাকবে, সাবধান করে দিয়েছে রানা। একজন থাকবে পাহাড়ে, ট্র্যাক-এর উপর তার সঙ্গীকে কাভার ত্থেয়ার জন্য। পাহাড়ে থাকা লোকটা রানার প্রথম টার্গেট। তবে ট্র্যাকে স্ফাড়িয়ে কথা বলতে হবে ম্যারিয়েটাকে, সে কী বলছে শোনার জন্য যাতে রানার ওই শিকার কান পাতে। ‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে,’ হড়বড় করে বলল ম্যারিয়েটা। আসছে সাইক্লোন ১৬১ ‘ট্র্যাকের ওপর দিকে। অপর ল্যান্ড-রোভার... ওটায় আমার গ্র্যান্ডফাদার। পি−জ...’ গলা বুজে এল। ঢোক গিলল সে, মুখের ভিতরটা শুকনো লাগছে। ব্যথায় মুখ কুঁচকে রয়েছে রানা। শরীরটা গড়িয়ে দিয়ে ট্র্যাক-এর কিনারা থেকে দশ ফুট নেমে গেছে ও, কিন্তু নামবার সময় ঝড়ে ধরাশায়ী একটা গাছের কাণ্ড থেকে বেরুনো ডালে গুঁতো খেয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল ওর বুকের ভিতর ছোরার ফলা ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ। ব্যথা একটু কমে আসতে পরীক্ষা করে দেখেছে, রক্ত বেরুচ্ছে না। তবে নড়াচড়া করলে ব্যথাটা বাড়ছে। সন্দেহ নেই, না ভাঙলেও, পাঁজরের দু’একটা হাড়ে চিড় ধরেছে। রানাকে কাভার দিচ্ছে ল্যান্ড-রোভারের খোলা ল্ডজা। আশা করা যায় উজ্জ্বল আলোগুলো অ্যামবুশম্যানল্ডে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নিজের চোখ বন্ধ করে রেখেছে ও। খানিকটা কাদা নিয়ে মুখ ও কপালে ঘষল রানা। এই সময় ভেসে এল ম্যারিয়েটার চিৎকার। ব্রেস্ট পকেট থেকে গাঢ় রঙের চশমা বের করে পরল রানা, তারপর চোখ মেলল। ব্যথায় চোখে পানি বেরিয়ে এসেছে, সামনের দৃশন্ধা ঝাপসা লাগল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে পানি মুছে আবার তাকাল রানা। আগের চেয়ে ভাল। ‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট...’ বলতে শুনল ম্যারিয়েটাকে। সামনেটা হাতড়ে মাটিতে গাঁথা শক্ত পাথর পেল রানা, সেটা ধরে উঠে বসবার চেষ্টা করছে। ব্যথায় আবার অন্ধকার দেখল চোখে। তারপরও বসল ও। ক্রল করে ঢালে উঠতে হবে ওকে, তারপর ট্র্যাকের ওপারে পৌঁছাতে হবে। কাদায় আঙুল গেঁথে পতন ঠেকাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে উঠে এল ও ট্র্যাক-এর উপর। ‘তুমি শালী একটা বেশ্যা!’ বলল লোকটা, থোক্ করে একদলা ১৬২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ থুথু ফেলল ম্যারিয়েটার মুখে। ইতোমধ্যে তার গা থেকে রেইনকোটটা খুলে নিয়েছে সে। ম্যারিয়েটা অনুভব করল রাইফেলের ঠাণ্ডা মাজল ঠেকল তার ঊরুতে, স্কার্ট তুলছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল সে। মনে পড়ল রানা তাকে ওর দিকে তাকাতে নিষেধ করে দিয়েছে। ‘বেশ্যা,’ আবার বলল লোকটা। ‘সত্যি কথা বলো, তা না হলে পরপারের টিকিট কাটো।’ রাইফেলের ব্যারেল ডেবে যাচ্ছে ম্যারিয়েটার শরীরে। মার খাওয়া কুকুরছানার মত ফোঁপাচ্ছে সে। ‘ঈশ্বরের দিবিল্টলছি। পি−জ, সিনর, আমি আপনার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাই...’ ‘চাও ভিক্ষা,’ খেঁকিয়ে উঠল লোকটা। সে তার বুটের ডগা দিয়ে গুঁতো মেরে ম্যারিয়েটাকে উপুড় করল, তারপর একটা পা রাখল ওর ঘাড়ের পিছনে, চাপ দিয়ে মুখটাকে নামিয়ে দিল থকথকে কাদায়। কাদার ভিতর দম বন্ধ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে একটা গড়ান দিয়ে চিৎ হলো ম্যারিয়েটা, টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল বুকের কাছে স্কার্টের বোতামগুলো। চোখ দিয়ে যেন মিনতি জানাচ্ছে Ñ নাও আমাকে, যা খুশি করো, শুধু মেরো না... উপুড় হয়ে শুয়ে পাহাড়ের গায়ে কিছু নড়ে কি না দেখছে রানা। ধরাশায়ী গাছটার পিছনে, উঁচু জমিনে, ঝোপের ভিতর থেকে সিধে হলো এক লোক। ও জানত, দুজন লোক থাকবে। সানগ−াস পকেটে রেখে দিল রানা, বুট জোড়া কাদায় ভাল করে গেঁথে সিধে হচ্ছে। রেঞ্জ-এ স্ফাড়ানো পরিষ্কার টার্গেট লোকটা। কোনও ব্যথা অনুভব করছে না রানা, পা দুটো একটু ফাঁক করা, ওয়ালথারটা দু’হাতে ধরা, শরীর পাথরের মত শক্ত ও অনড়। লোকটার বুকে তাক করল। ট্রিগার টেনে দিল ও। প্রতিপক্ষ ঝাঁকি খেয়ে টলে উঠতে আবার। পা এখনও গাঁথা, কোমরের কাছে মোচড় খেল শরীর। যেন লাফ আসছে সাইক্লোন ১৬৩ দিয়ে সাইট-এ চলে এল দ্বিতীয় টার্গেট। প্রথমে তার গান-শোল্ডারে গুলি করল রানা, তারপর ঘুরে যেতেই মাথার পিছনে। লোকটা ধীর, শান্ত ভঙ্গিতে ঢলে পড়ল। এতক্ষণে ঘাড় ফিরিয়ে ম্যারিয়েটার দিকে তাকাল রানা। কাদার উপর বসে রয়েছে সে, অর্ধনগ্ন, কর্দমাক্ত, হাত দিয়ে খামচে ধরে আছে বোতাম ছেঁড়া স্কার্টটা। ঢাল বেয়ে নীচে নামবার সময় গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেলল রানা, ম্যারিয়েটার গায়ে জড়িয়ে দিল সেটা, প্রশংসার ভঙ্গিতে ওর পিঠে দুটো চাপড় দিল। তারপর হাত ধরে টেনে স্ফাড় করাল তাকে, হাঁটিয়ে নিয়ে এল ল্যান্ড-রোভারের কাছে। ম্যারিয়েটাকে নিরাপজ্ঝাশ্রয়ে বসিয়ে রানা বলল, ‘একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমি দেখি চেইন-স’টা কোথায় রেখেছি।’ গাছ কেটে পথ তৈরি করে এগোচ্ছে ওরা। ঠিক পাকা রাস্তায় ওঠার পরেই দেখা গেল সামনের ব্রিজটা ভেঙে পড়ে আছে খরস্রোতা নদীতে। ল্যান্ড-রোভার থামাল রানা। এতক্ষণে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলল ম্যারিয়েটাকে। ‘পিকো ভাই বেলপ্যানে?’ ম্যারিয়েটা আকাশ থেকে পড়ল। ‘আর এই কথাটা তুমি আমার কাছে গোপন করে গেছ?’ ‘সুখবর হলে গোপন করতাম না,’ বলল রানা। ‘তিনি বিদ্রোহী সেনা ও মার্সেনারিল্ডে হাতে বন্দি।’ ‘এখন তা হলে কী হবে?’ দমে গেল ম্যারিয়েটা, অসহায় ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। ‘আমি ওখানে যাচ্ছি,’ বলল রানা। ‘আমাকে জানতে হবে তোমার দাদুকে যারা ব−্যাকমেইল করছে তাল্ডে লিডার লোকটা কে। আমার ওপর ভরসা রাখো, মেজর পিকো সহ যাল্ডেকে ওখানে বন্দি ১৬৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ করা হয়েছে সবাইকে মুক্ত করতে পারব আমি।’ চোখ দুটো ছলছল করছে, রানার ঠোঁটে চুমো খেল ম্যারিয়েটা। ‘আমার সাইক্লোন, আমার হিরো!’ ‘সামনের ব্রিজ ভেঙে গেছে,’ বলল রানা। ‘নদীতে বোল্ডার আছে, ওগুলোয় পা দিয়ে পার হওয়া যাবে, কিন্তু গাড়িটা ফেলে রেখে যেতে হবে এখানে। আমি তোমার কথা ভাবছি।’ ‘আমার কথা আলাদা করে ভাবতে হবে কেন?’ ম্যারিয়েটাকে বিস্মিত দেখাল। ‘আমি তোমার সঙ্গেই তো থাকছি।’ ‘নদীর ওপারে, হ্যাঁ,’ বলল রানা, ‘কিন্তু এস্টেটে নয়। ওখানে আমাকে একা যেতে হবে।’ ‘কেন?’ সত্যি কথাই বলল রানা। ‘জেনেশুনে বিপদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি। তুমি সঙ্গে থাকলে আমার বিপèাড়বে আরও। তা ছাড়া, তুমি আমার কাজে দেরি করিয়ে দেবে।’ এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ম্যারিয়েটা, তারপর জানতে চাইল, ‘তা হলে আমাকে তুমি কী করতে বলো?’ ‘গাড়ি রেখে নদী পার হই,’ বলল রানা। ‘মাইলখানেক হাঁটলেই পাকা রাস্তা থেকে এস্টেটের দিকে চলে যাওয়া ট্র্যাকটা দেখতে পাব আমরা...’ ‘ওদিকের রাস্তা আমার চেনা আছে,’ রানাকে বাধা দিয়ে বলল ম্যারিয়েটা। ‘কী করতে হবে তা-ই বলো।’ ‘সময় হোক, তখন বলব,’ জানাল রানা। ‘এখন চলো নদী পার হই।’ নদী পার হয়ে বাঁকটার কাছে পৌঁছাতে বিশ মিনিট লাগল ওল্ডে। পাকা রাস্তা ছেড়ে ট্র্যাক ধরে ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট এস্টেটে চলে যাবে রানা। এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করছে ও, ম্যারিয়েটা কী করবে। আসছে সাইক্লোন ১৬৫ ‘তুমি জানো এই রোড রাজধানীর দিকে চলে গেছে,’ বলল রানা। ‘হেঁটেই যেতে হবে তোমাকে। গাড়ি পাওয়াটা হবে নেহাতই ভাগেশু ব্যাপার।’ ‘শহরে পৌঁছে কী করব আমি?’ ‘সোজা মেক্সিকো দূতাবাসে ঢুকবে। নিজের পরিচয় দিয়ে যা যা জানো সব বলবে ওল্ডেকে। জানতে চাইবে কর্নেল জুডিয়াপ্পা সম্পর্কে তারা কিছু জানে কি না। তারপর বলবে, এই বিপদ থেকে বেলপ্যানকে বাঁচাবার জন্যে মেক্সিকোর সাহায্য ল্ডকার তোমাল্ডে।’ ‘ঠিক আছে, বুঝেছি,’ বলল ম্যারিয়েটা, যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে। ‘ওঁল্ডে অনেককে চিনি আমি, আমার কথা ওঁরা বিশ্বাস করবেন। আমি ভাবছি তোমার কথা।’ ‘আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না...’ ‘ঠিক আছে ভাবব না,’ প্রায় বেসুরো, কঠিন সুরে বলল ম্যারিয়েটা। ‘তুমি আমার হিরো, এ-কথা শোনার পর থেকে ঠিক একটা কাপুরুষের মত আচরণ করেছ তুমি আমার সঙ্গে, মাসুল্ডানা। আমি প্রমাণ পাবার অপেক্ষায় আছি, তা তুমি নও। কাজেই যা-ই ঘটুক ওখানে, আমার কাছে ফিরে আসতে হবে তোমাকে।’ বলে ঘুরল সে, উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজের পথে পা বাড়াল। তার গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রানা। ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট এস্টেট-এ পৌঁছানোর ট্র্যাকটা উপত্যকার উপর দিয়ে এগিয়েছে। যদি কোনও রোডব−ক থাকে, ভাবল রানা, উপত্যকার নীচে কোথাও থাকার কথা। সেটাকে এড়িয়ে এস্টেট, তথা শত্র“পক্ষের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতে হবে ওকে। তবে সাবধানে। অত্যন্ত ক্লান্ত রানা, আহতও বটে। পাঁজরের ব্যথাটা সারাক্ষণ জানান দিচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক্স-রে করা ল্ডকার। এই অবস্থায় কেউ ধাওয়া করলে সর্বনাশ। ১৬৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ সময়টা গোধূলি। চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে ছোট একটা পাহাড়ের মাথায় উঠল রানা, গাছপালার আড়ালে স্ফাড়িয়ে চোখে বিনকিউলার তুলল। একটু পরেই ব্যারিকেডটা দেখতে পেল ও। যা ভেবেছে ঠিক তা-ই, উপত্যকার নীচে ওটা। দুজন লোক পাহারায় রয়েছে, নীল একটা টয়োটা স্টেশন ওয়্যাগন এস্টেটের চারদিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। রানা নিশ্চিত নয়, তবে ওর মনে হলো না এই লোকগুলোকে ক্যাটামার‌্যান গ্রাসিয়াসে তুলে বেলপ্যান নদীতে নিয়ে এসেছিল ও। এরা সম্ভবত বেলপ্যান সেনাবাহিনীর সদস্য, নিকার‌্যাগুয়া থেকে আসা মার্সেনারি নয়। সবার কাছে রেডিও আছে, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তারা। বিনকিউলার ঘুরিয়ে চারপাশটাও দেখে রাখছে রানা। আশপাশে অন্তত একটা ছোট পাহাড়ের মাথায় পাহারা বসিয়েছে তারা। ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর গা ঢাকা দিয়ে, চোখে বিনকিউলার সেঁটে, রোডব−কসহ গোটা এলাকার বহু দূর পর্যন্ত নজর রাখছে দুই কি তিনজন লোক। রানার সন্দেহ হলো ও যে পাহাড়ে উঠেছে সেখানেও কেউ আছে কি না। ঠিক তখনই মাথার পিছনে ঠাণ্ডা ইস্পাতের স্পর্শ পেল ও, সঙ্গে সঙ্গে শক্ত কাঠ হয়ে গেল সারা শরীর। ‘ফ্রিজ!’ স্থির হয়ে গেল রানা। বোকামির জন্য গাল দিল নিজেকে। ‘হাত তোলো মাথার ওপর,’ নির্দেশ এল। ভাষাটা ল্যাটিন উচ্চারণে ইংরেজি। বিনকিউলারটা কোমরের বেল্টে গুজে রাখার পর নির্দেশ পালন করল রানা। মনে মনে খুশি, ভাবছে Ñ তুমি একা হলে এখনই জাহান্নামে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা। হতাশ হতে হলো, তিনজন তারা। আসছে সাইক্লোন ১৬৭ ওর ধারণাই ঠিক মনে হচ্ছে, লোকগুলো সম্ভবত বেলপ্যান সেনাদলের সদস্য। সবার হাতে কাল্যাশনিকভ রাইফেল, সবগুলোই রানার দিকে তাক করা। ‘ঘোরো!’ নির্দেশ দিল একজন। আরেকজন এগিয়ে এসে সার্চ করল। কোমরের বেল্ট থেকে ওয়ালথারটা বের করে নিলেও, বিনকিউলারে হাত দিল না। ছুরিটা রানা এমন জায়গায় রেখেছে সার্চ করার সময় ওখানে সাধারণত কেউ কিছু খোঁজে না, এই লোকও খুঁজল না। ‘কে তুমি?’ জানতে চাইল প্রহরীল্ডে লিডার, শক্ত-সমর্থ একজন হাবিলদার। ‘আমাকে তোমরা চিনবে না,’ বলল রানা। ‘আমি মাসুল্ডানা।’ ‘এখানে কী করছ?’ ‘তোমরা যা করছ ঠিক তার উল্টোটা,’ বলল রানা, ঠোঁটে শান্ত হাসি। ‘তোমাল্ডে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্যে যারা লড়ছে, আমি তাল্ডেকে সাহায্য করছি।’ ‘এই, ব্যাটা দেখি লেকচার মারে!’ ‘আয়, আগে শালার হাড়গোড় ভেঙে গুঁড়ো করি, তারপর...’ তাকে বাধা দিয়ে আরেকজন বলল, ‘এই, আসল কথাটা বলো, কী মতলবে এখানে আসা হয়েছে শুনি?’ জরুরি একটা তথ্য জানার তাগাদা অনুভব করল রানা। ‘মেজর পিকো রামপাম,’ বলল ও। ‘তোমরা নিশ্চয় চেনো তাকে। আমি তাঁকে মুক্ত করতে এসেছি।’ ‘আরে, এ শালা দেখছি বদ্ধ উন্মাদ!’ হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে পাহাড়ী ঢাল থেকে ব্যারিকেডে নামিয়ে আনা হলো রানাকে। রেডিওতে খবর পেয়ে টয়োটা স্টেশন ওয়্যাগনটা ওল্ডে জনঞ্জপেক্ষা করছিল। সেটায় তুলে ওকে তারা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাচ্ছে। ১৬৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ একটা পর্যায় পর্যন্ত ক্রমশ সরু হয়ে গেছে উপত্যকা, ট্র্যাক-এর শেষ প্রান্ত এঁকেবেঁকে উঠে গিয়ে মিশেছে বালি ও নুড়ি বিছানো বিরাট এক উঠানে, সেটার দু’দিকে একটা করে খোলা গোলাঘর, সামনে ড্রাইস্টোন-এর পাঁচিল। উঠানের একপাশে যান্ত্রিক লাঙল, ট্র্যাক্টর ইত্যাদি জড়ো করা। ছায়া থেকে একজন সেন্ট্রি বেরিয়ে এল, হাতের রাইফেল টয়োটার দিকে তাক করা। এতক্ষণে একজনকে চিনতে পারল রানা। সাগর থেকে যাল্ডেকে নদীতে নিয়ে এসেছিল ও, এ লোকটা তাল্ডেই একজন। কাভারিং ফায়ার ত্থেয়ার জন্য গোলাঘরে নিশ্চয় আরও একজন তৈরি হয়ে আছে, ধারণা করল রানা। টয়োটা থেকে নামানো হলো রানাকে। ‘একে তোমরা কোথায় পেলে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল সেন্ট্রি। ‘লাফাজার হাত ফস্কে পালালেও, এ ব্যাটার তো বোট নিয়ে ঝড়ে ডুবে মরার কথা!’ ‘অত কথা জানি না,’ রানাকে যারা ধরে এনেছে তাল্ডে একজন বলল। ‘এই লোক বলছে, মেজর পিকোকে উদ্ধার করতে এসেছে। নাম মাসুল্ডানা।’ ‘নির্ঘাত পাগল! যে লোক এখনও এখানে পৌঁছায়নি, তাকে কেউ উদ্ধার করতে আসে কীভাবে? ওদিকে নিয়ে যাও ব্যাটাকে,’ হাতের রাইফেল ঝাঁকিয়ে বলল সেন্ট্রি। ‘সিনর বেনিটো কী বলেন দেখো।’ উঠান থেকে পাথুরে ধাপ উঠে গেছে, নীচের লোহার গেটটা চৌকাঠ থেকে খুলে পড়ে আছে একপাশে। বাতাসের তেজ অনেক কম এখন, মেঘও বেশি নয়, ওগুলোর ফাঁকে দু’একটা তারা দেখা যাচ্ছে। তিন সৈনিক রানাকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্ট নামে দালানটা ঘাস ঢাকা একটা টেরেসের পিছন দিকে। ছোট-বড় কয়েকটা পাহাড় ওটার দুই পাশ ও আসছে সাইক্লোন ১৬৯ পিছনটাকে বাতাস থেকে রক্ষা করছে। সাদা চুনকাম করা লম্বা একটা বাংলো, ছাদ্মা লাল করোগেটেড আয়রন দিয়ে তৈরি। সামনের দিকে বাড়িটার পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে ঘেরা-বারান্দা রয়েছে। বারান্দার খুঁটি হিসাবে বল্টহার করা হয়েছে মোটাসোটা নারকেল গাছের কাণ্ড, মসৃণ ও পালিশ করা। ছয় সেট ডাবল ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়। ভিতরে, মাঝামাঝি জায়গায়, খিলান আকৃতির একটা মেহগনি ল্ডজা রয়েছে। জানালার পরদা বানানো হয়েছে চটের মত মোটা কাপড় দিয়ে, ওগুলোর ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে কেরোসিন ল্যাম্পের লালচে আলো। বারান্দায় স্ফাড়িয়ে রয়েছে দুজন লোক, হাতে কাল্যাশনিকভ রাইফেল। এল্ডে দুজনকেও চিনতে পারল রানা, ক্যাটামার‌্যানে তুলে মেইনল্যান্ডে নিয়ে এসেছিল। মার্সেনারি। ‘সিনর বেনিটোকে খবর দাও, বলো, মাসুল্ডানা ধরা পড়েছে,’ রানার পিছন থেকে বলল হাবিলদার। ‘স্ফাড়াও,’ দুজনের একজন নির্দেশ দিল। মেহগনি কাঠের ল্ডজাটা সামান্য একটু ফাঁক করল সে। সরু এক ফালি আলো বেরুল বাইরে। ল্ডজাটা আরও খানিক খুলে বারান্দায় পা রাখল বেনিটো, মার্সেনারিল্ডে লিডার। নিজের পিছনে কবাট বন্ধ করল সে, রানার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাল। ‘মর জ্বালা! তুমি আবার ফিরে এলে কী মনে করে? পোষা কবুতর নাকি!’ ‘স্পাই,’ শুধরে ত্থেয়ার সুরে শান্তকণ্ঠে বলল রানা। ‘শোনো, তোমাল্ডে বস্কে জানাও কুল্ট্যর্থ হয়েছে...’ ‘পাগল হয়ে গেছে নাকি?’ সঙ্গীল্ডে মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল বেনিটো। ‘এ-সব প্রলাপ বকার মানে কী? এখানে শালা এসেছেই বা কী করতে?’ ১৭০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘বলছে মেজর পিকোকে মুক্ত করতে চায়,’ জানাল হাবিলদার। ‘আচ্ছা!’ সকৌতুকে রানার দিকে তাকাল বেনিটো। ‘তাই নাকি? তা একা সেটা কীভাবে সম্ভব?’ ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রেসিডেন্ট রোকো রামপামের আছে,’ গলা চড়িয়ে কথা বলছে রানা, কামরার ভিতরে বস্ বা বসেল্ডে বস্ কেউ থাকলে যাতে শুনতে পায়। ‘সেজন্যেই তাঁকে তোমরা বাঁচিয়ে রেখেছ, লোক পাঠিয়েছ তোমাল্ডে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসার জন্যে। কিন্তু তারা ফিরবে না, বেনিটো... ‘ফিরবে না?’ চমকে উঠল বেনিটো। ‘কেন?’ ‘কারণ পাইন রিজ-এর যুদ্ধে তারা হেরে গেছে, বেনিটো,’ বলল রানা। ‘প্রেসিডেন্টকেও আমরা সরিয়ে ফেলেছি...’ ‘এই, একটা ঘরে আটকে রাখো একে,’ কর্কশসুরে নির্দেশ দিল বেনিটো। ‘শালার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে।’ তেরো চোখ মেলে দেখল কামরাটা অন্ধকার। রানার ঠিক মনে নেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, নাকি খড়ের গাদায় শোয়ার সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। চোখ মেলবার পর বুঝতে পারছে উপুড় হয়ে রয়েছে শরীর, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। শুধু হাত নয়, অনুভব করল পা দুটোও এখন এক করে বাঁধা Ñ তবে আসছে সাইক্লোন ১৭১ মনে করতে পারল না ওগুলো কখন বাঁধা হয়েছে। কামরাটা বাড়ির কোথায়, জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না রানা। কয়েকটা করিডর পার করে এখানে আনা হয়েছে ওকে, অন্ধকারে কিছুই ভাল করে খেয়াল করতে পারেনি। খুবই ক্লান্ত ছিল ও। হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল রানা। না, ল্ডজা খোলার শব্দ হয়নি। কারও নিঃশ্বাসও শুনতে পায়নি, তারপরও ওর ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে ঘরের ভিতর কেউ ঢুকেছে। এ-ধরনের ব্যাপারে ওর এই বিশ্বস্ত বন্ধুটি কখনও ভুল করে না। একটা ¯িপ্রং ক্লিক করে পজিশনে বসল, ছুরির ফলাটা যাতে খুলে যেতে পারে। ঘামছে রানা। মাথার ভিতর ঝড়। কে আসছে? ছুরির ফলা খুলল কেন? কত বড় ছুরি? খস্ খস্। পায়ের আওয়াজ হলো। দম আটকে অপেক্ষা করছে রানা, প্রতিটি পেশি টান টান। অনুভব করছে, অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, তবে খুব কাছে কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলল। রানা ভাবছে, আগন্তুককে কি জানানো উচিত হবে যে জেগে আছে ও? নাকি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকাই ভাল? কে হতে পারে আগন্তুক? কী উদ্দেশ্যে এসেছে? খুন করবে ওকে? লাফাজা? রানার পায়ে বাঁধা রশি খুঁজে নিল শক্ত একটা হাত, ছুরির ফলাটা দু’তিনবার ঘ্যাচ্ ঘ্যাচ্ করে ঘষে কেটে ফেলল ওটা। এক মুহূর্ত পর ওর হাত দুটোও মুক্ত করা হলো। একটা পরিচিত গন্ধ নাকে আসতেই ভুরুজোড়া কুঁচকে গেল রানার। ফিরে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। কোনও শব্দ না করে খুলল ল্ডজা, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধও হলো। কামরার ভিতরে আবার একা হয়ে গেল রানা। হাতের সবগুলো আঙুল বারবার খুলল ও বন্ধ করল, অপেক্ষায় ১৭২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ আছে কখন রক্তচলাচল শুরু হবে। খড়ের উপর বসে হাত দুটো দুই বগলের নীচে ঢোকাল, ব্যথা সহ্য করার জন্য দোল খাচ্ছে। এক সময় সহনীয় হয়ে এল ব্যথাটা। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে বামদিকে এগোচ্ছে। স্পর্শ দিয়ে একটা জানালা অনুভব করল, শাটারগুলো চ্যাপ্টা লোহার বার দিয়ে বন্ধ করা। একটু একটু করে বারটা সরাল রানা, তারপর শাটারগুলো খুলল। উপরে জ্বলজ্বলে তারা দেখা যাচ্ছে। ছায়াগুলোকে নরম করে তুলেছে ভোরের প্রথম আলো। বাইরে অপেক্ষা করছে মুক্তি...কিংবা মৃত্যু। একটু কসরত করে জানালার গোবরাটে উঠল রানা। লাফ ত্থেয়ার আগে মাত্র এক সেকেন্ড ইতস্তত করল। খুলির ভিতর হলুদ মগজ ঠিকই থাকল, চাঁদিতে লোহার কোনও রড পড়ল না। পাঁজরের ব্যথাটা আছে, তাই বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। চিন্তার বিষয়। কেন কেউ মুক্ত করবে ওকে? যে-ই কাজটা করে থাকুক, এটা তার একার সিদ্ধান্ত। যে-কোনও কারণেই হোক রানাকে নিজের পরিচয় জানাতে চায় না। তার মানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে আছে সে, এখনও তা-ই থাকতে চাইছে। ওর কামরাটা খালি, এটা জানাজানি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। তারা ধরে নেবে উপত্যকার নীচে নেমে পালাতে চেষ্টা করবে রানা। কিন্তু পালানো ওর উদ্দেশ্য নয়। ওকে জানতে হবে গোটা ব্যাপারটার পিছনে কার ব্রেন কাজ করেছে, প−্যানটা কার তৈরি, কে সেই উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক। ম্যারিয়েটার কথা মনে পড়ল। কে জানে এই মুহূর্তে কোথায় সে, রাজধানী থেকে কতটা দূরে। সাইক্লোনটার জন্য কাজ করেনি রেডিও, কর্নেল জুডিয়াপ্পার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার সেটাই কারণ। নাকি মেজর পিকোর মত আসছে সাইক্লোন ১৭৩ তাঁকেও কিডন্যাপ করা হয়েছে? কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ড ও মেক্সিকান মাফিয়াল্ডে বিশ্বাস নেই, তারা সব পারে। ছোট একটা লেবু-বাগানে চলে এসেছে রানা। ওগুলো ধরে ধরে উপত্যকা থেকে ঢাল বেয়ে উপর দিকে উঠছে। বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে আছে মাটি, সহজেই আটকাচ্ছে বুট। একটা বেড়া ও গেটের সামনে চলে এল। উপত্যকার পাশে পাহাড়ী ঢাল আরও খাড়া এদিকে। ঢালে প্রচুর পাথর। কিছু কিছু ঝোপও আছে। আরও উপরদিকে শুরু হয়েছে বনভূমি। তবে বেশিদূর দৃষ্টি চলে না, কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ। একটু বাতাসও নেই। উপত্যকা ছেড়ে ঢাল বেয়ে পাহাড়ে উঠছে রানা, উঁচু জায়গা থেকে চারদিকটা ভাল করে দেখতে চায়। তবে কুয়াশা না সরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ওকে। বামদিকে শব্দ হওয়ায় স্থির হয়ে গেল রানা। অপেক্ষা করছে। একটা ঝিঁঝি ডেকে উঠল। আরেকটা। তারপর একসঙ্গে অনেকগুলো। কান একেবারে ঝালাপালা করে ছাড়ল। কুয়াশার আড়াল নিয়ে ভাঙা ডালপালা ও আলগা পাথরে পা ফেলে যতটা পারা যায় সাবধানে এগোচ্ছে রানা। ওকে দেখে দু’একটা পাখি এদিক ওদিক ছুটল। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক তোতা উড়ে গেল। মাটিতে পড়ে থাকা মরা গাছের গায়ে গর্ত করছে নিঃসঙ্গ কাঠঠোকরা। মৃদু বাতাস শুরু হলো। পাহাড়ী ঢাল থেকে সরে যাচ্ছে কুয়াশা, হঠাৎ তৈরি ফাঁকের ভিতর নতুন দিনের প্রথম আলো দেখা গেল। রানার পিছনে ও নীচে লোকজন চেঁচামেচি করছে। ওর অনুপস্থিতি জানাজানি হয়ে গেছে। খালি চোখেই ইংলিশ কর্নেল’স পয়েন্টের বারান্দাটা দেখতে পাচ্ছে রানা। মার্সেনারিল্ডে লিডার বেনিটো রয়েছে ওখানে, দুজন লোককে ১৭৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ উপত্যকার দু’পাশে পাঠাবার আগে হাত নেড়ে নির্দেশ দিচ্ছে। যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও রওনা হলো লোক দুজন, হাঁটার গতি মন্থর। কুয়াশা নেই, চোখে বিনকিউলার তুলে উপত্যকার উপর চোখ বুলাল রানা, গোটা এলাকার ম্যাপ তৈরি করছে মনের পরদায়, প্রয়োজনের সময় যাতে চাইলেই মনে করতে পারে কোথায় কী আছে। প্রথমে লেবু-বাগান সহ বাড়িটা। তারপর গোলাঘর, ট্র্যাক্টর শেডসহ নীচের চওড়া উঠান, যেখান থেকে আঁকাবাঁকা ট্র্যাকটা নেমে গেছে একটা ঘেসো জমিতে, কয়েকটা গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে সেখানে। রানার নীচে ঘেরা ওই জমিটাকে সাগরের বাতাস থেকে আড়াল দিচ্ছে পাহাড়ের গা থেকে বেরুনো বিরাট একটা প্রাচীর। ট্র্যাকটা তীক্ষè বাঁক নিয়ে প্রাচীরের প্রান্তকে ঘুরে এগিয়েছে কলা বাগানের দিকে। গত রাতের ঝড় পুরো বাগানটাকে লণ্ডভণ্ড করে রেখে গেছে। কলা বাগানের পর আরেকটা ঘেসো জমি। সেটার পিছনে, ট্র্যাকটার ডানদিকে, বড় একটা শস্য খেত, আকারে পঞ্চাশ একরের কম নয়। আরও পিছনে গাছের সারি, তারপর আরও অনেক খেত, সেই বহু দূর হাইওয়ের নাগাল পেয়ে গেছে। বেনিটোর পাঠানো লোক দুজন আস্তে-ধীরে উঠছে। তাল্ডেকে নিয়ে চিন্তিত নয় রানা। ঝোপ ও গাছের আড়াল নিয়ে নীচে নামতে নামতে ভাল একটা পজিশন খুঁজছে ও। প্রাচীর-এর প্রান্তে পৌঁছে দেখল বাঁকা হয়ে গেছে ওটা। ঢালটা সবটুকু দেখতে পেতে হলে আড়াল ছেড়ে প্রাচীরের মাথায় উঠে বসতে হবে। ক্রল করে ছোট একটা টিলার চূড়ার দিকে এগোচ্ছে রানা, যেখান থেকে ঢালটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাবে। একটা পাথরের আড়ালে বসে চোখে বিনকিউলার তুলে ঢালটা পরীক্ষা করছে রানা। কোথাও কোনও সেন্ট্রি রাখেনি বেনিটো। রানার আসছে সাইক্লোন ১৭৫ বিশ গজ বামদিকের ঝোপগুলোয় কিছু ফুল ফুটেছে। একটা হামিংবার্ড, লেজসহ তিন ইঞ্চি লম্বা, পিঠের পালক পান্না সবুজ, এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে Ñ লম্বা ঠোঁট দিয়ে মধু খাবার সময় ভেসে থাকছে শূন্যে। টিকালার কথা মনে এল ওর। দশ মিনিট পর দূরে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল চোখে। আরও পাঁচ মিনিট পার হতে বড়সড় আমেরিকান ফোর-হুইল-ড্রাইভ স্টেশন ওয়্যাগন-এর আকৃতিটা চেনা গেল। ওটার পিছু নিয়ে আসছে একজোড়া ল্যান্ড-রোভার, ওগুলোর পিছনে তিনটে আর্মি ট্রাক। কনভয়টা ধীর গতিতে উপত্যকার ঢাল বেয়ে উঠে আসছে। এক পর্যায়ে কলা বাগানের পিছনে হারিয়ে গেল ওটা। পাঁচ মিনিট পর আবার উদয় হলো শুধু স্টেশন ওয়্যাগন। কনভয়ের বাকি গাড়ি রয়ে গেছে কলাবাগানের ভিতর কোথাও। ট্র্যাক বেয়ে অলস ভঙ্গিতে উঠছে স্টেশন ওয়্যাগন, হুইল ধরে ড্রাইভিং সিটে বসে রয়েছেন কর্নেল এসকুইটিলা জুডিয়াপ্পা। চোখে বিনকিউলার থাকায় রানা পরিষ্কার দেখতে পেল স্ফাত দিয়ে একটা চুরুট কামড়ে ধরে আছেন কর্নেল জুডিয়াপ্পা। তাঁর পাশের সিটে বসে রয়েছে ম্যারিয়েটা। চোদ্দো পাথরের আড়াল থেকে সরে এসে নীচে নামতে শুরু করল রানা, ১৭৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ চাইছে বাড়িটা থেকে ওকে যেন কেউ দেখতে না পায়। আর এক মিনিটের মধ্যে স্টেশন ওয়্যাগনের ছাèাধা সৃষ্টি করবে, ফলে রানাকে তখন দেখতে পাবেন না কর্নেল জুডিয়াপ্পা। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে রানা নিজের বিপদ না ডেকে আনে। ত্রিশ ফুট নীচে ফুলে আছে পাহাড়ের গা। একটা ঝুল পাথর। সেটার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা রাইফেলের ব্যারেলটা চিনতে পারল রানা। খুব বেশি হলে ষাট সেকেন্ড সময় আছে ওর হাতে, তার মধ্যেই কিছু একটা করতে হবে। নামবার গতি না কমিয়ে ডানদিকে একটু সরল, ও যাতে সরাসরি ঝুল-পাথরটার উপরে থাকে। ওর ডান বুটের নীচে আলগা হয়ে গেল ছোট একটা পাথর, সেই সঙ্গে পিছলে গেল পা-ও। নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করল রানা। পতন ঠেকানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে ঝুল-পাথরটার কিনারা থেকে শরীরটাকে নেমে যেতে দিল ও। ভাঙা পাঁজরের কথা মনে পড়ে গেছে, ওখানে আবার চোট পেলে মরেই যাবে। রানার সরাসরি সামনের পথে সিধে হলো লাফাজা। লোকটা লাফাজা না হয়ে যায়ই না। কাঁধ দিয়ে তাকে ধাক্কা দিল রানা, ছোট গর্ত মত যে জায়গাটায় লুকিয়েছিল সেখান প্রায় হিঁচড়ে বের করে আনল। রাইফেলটা ছুটে গেল তার হাত থেকে। বেশ খানিক নীচে একটা পাথরে বাড়ি খেয়ে সেটার বাঁট ভেঙে যেতে দেখল রানা। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে ওরা, সারাক্ষণ পিছলাচ্ছে, কখনও খসে পড়ছে নীচে। লাফাজার হাতে পিস্তল দেখল রানা, একটু বাঁকা করে ধরে আছে। খপ করে সেটার ব্যারেল ধরে ফেলল ও, ধরে এমনভাবে ঝুলে থাকল যেন ওটা ছাড়া দুনিয়ার কোনও কিছুই রক্ষা করতে পারবে না ওকে। আসছে সাইক্লোন ১৭৭ পিস্তলটা দুজনেই শক্ত করে ধরেছে, তবে ট্রিগার রয়েছে লাফাজার হাতে। পিছলে নেমে যাচ্ছে দুজন, তারই মধেব্ধস্তাধস্তি শুরু হলো, কে কার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে ওটা। সামনে একটা ঝোপ পড়ল। নিজের পতন ঠেকাবার জন্য সেটা ধরে ঝুলে পড়ল লাফাজা। রানা থামছে না, আগের মতই নেমে যাচ্ছে পিছলে। নিজের পতন ঠেকাবার জনল্টাধ্য হয়ে ওকে ছেড়ে দিল লাফাজা, হাতছাড়া করতে হলো পিস্তলটাও। আরও কিছুদূর পিছলে ছোট্ট একটা ডোবায় জমে ওঠা পানিতে নেমে এল রানা। আড়াআড়িভাবে পড়ল রানা ডোবায়, চারদিকে পানি ছলকাল, ক্রল করে উঠে এসে সিধে হচ্ছে। একটু টলে ওঠায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম করলেও, পার্ক করা স্টেশন ওয়্যাগনের বনেট ধরে সামলে নিল নিজেকে। ম্যারিয়েটার বিস্ফারিত চোখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছে রানা। বেঞ্চ সিট থেকে ঝুঁকে ল্ডজা খুলে দিলেন কর্নেল জুডিয়াপ্পা। এক হাতে ধরে ম্যারিয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিলেন, তারপর নামিয়ে দিলেন রাস্তায়; তারপর অপর হাতের পিস্তলটা তার মাথায় তাক করলেন, বাম হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে রেখেছেন। ম্যারিয়েটার চোখে তাকাল রানা, তার ব্যথা ঘুসির মত আঘাত করল ওকে। মাসুদ ভাইকে হতাশ করার ব্যথা ওটা। রানা জানে ও-ই জিতবে। ডাইভ দেবে ও, হাতের পিস্তল তাক করা, ওর প্রথম গুলি জুডিয়াপ্পার বুকে লাগবে, দ্বিতীয়টা বেরিয়ে যাবে খুলি ফুটো করে। ম্যারিয়েটা মারা যাবে, কিন্তু রানা যা-ই করুক না কেন মারা সে যাবেই। জুডিয়াপ্পার আর কোনও কাজে লাগবে না ম্যারিয়েটা; তা ছাড়া, অনেক কিছু জেনে ফেলেছে সে। ১৭৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘পিস্তল ফেলো!’ হুকুম করল কর্নেল জুডিয়াপ্পা, স্ফাতের ফাঁকে ধরা চুরুট নড়ল কি নড়ল না। মেয়েটার চোখের পাতার নীচের কোণে বড় হতে শুরু করা পানির ফোটায় রোদ লাগল। গভীর কালো দীঘিতে রানার জন্য বেদনা জমে আছে। ভালবাসা, ভাবল রানা। মেয়েরা কী বোকা, তাই না, তা না হলে বোঝে না কেন কাকে ভালবাসতে নেই! ও যেমন প্রথম থেকেই জানে, ওর যে পেশা, সেখানে সত্যিকার ভালবাসার কোনও স্থান নেই। ওর ডাইভটা হবে ডানদিকে, জুডিয়াপ্পার পিস্তল আর ওর মাঝখানে ম্যারিয়েটার মাথা থাকায় কাভার পাওয়া যাবে। তবে আরও একটা প−্যান তৈরি হয়ে আছে রানার মগজে, কিছু অঙ্ক ও কিছু অনুমানের উপর নির্ভর করে... এখনই! নিজেকে নির্দেশ দিল রানা। ম্যারিয়েটার চোখে চোখ রেখে হাসল ও, তারপর ছেড়ে দিল লাফাজার পিস্তল। ব্যারেলটা নুড়ি পাথরে পড়ল, নীরব পরিবেশে ধাতব আওয়াজটা খুব জোরাল শোনাল কানে। কর্নেল জুডিয়াপ্পার কণ্ঠ¯ল্ফ কর্কশ হলেও, বিজয়ের উল−াসও চাপা থাকছে না। ‘এমন রোমান্টিক গর্দভ খুব কমই দেখা যায়, মিস্টার রানা!’ বলল সে। ‘অনভিজ্ঞ এক মেয়ের চিঠি পেয়ে একটা দেশের সেনাবাহিনী, কলম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেল, মার্কিন ও মেক্সিকান মাফিয়ার বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করতে চলে এলে?’ অভিশপ্ত কোকেন অ্যাডিক্ট নিজের আনন্দ-উল−াস ধরে রাখতে না পেরে খ্যাক্ খ্যাক্ করে হেসে উঠল: ‘হেই, বিগ বস্! আপনিই মা- বাপ, বিগ বস্! এই অধম লাফাজাকে আপনি অনুমতি দেবেন, বিগ সার? ওই শালার নেড়ি কুত্তাটাকে এখনই খুন করি?’ ওল্ডে উপরদিকে, পাহাড়ী ঢালে স্ফাড়িয়ে থাকা নিকার‌্যাগুয়ান মার্সেনারির দিকে চট করে একবার তাকাল জুডিয়াপ্পা, ঠোঁটে হাসি নিয়ে। ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, ওকে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম।’ আসছে সাইক্লোন ১৭৯ এখনও ম্যারিয়েটার চোখে চোখ রেখে হাসছে রানা। ঢাল বেয়ে নামছে লাফাজা, ওকে পাশ কাটাল। ইচ্ছে করলে তাকে ধরতে পারত ও, একটা কাভার তৈরি করা সম্ভব হলে পালাবার হয়তো উপায় বেরিয়ে আসত। কিন্তু না, একটা প−্যান ধরে কাজ করছে রানা। পিস্তলটা রানা ট্র্যাক-এর উপরে ফেলেছে। খানিকটা নীচে নেমে এসে সেটা কুড়িয়ে নিল লাফাজা। সিধে হলো সে, অস্ত্রটা রানার দিকে তাক করল। নিঃশব্দ হাসিটা মুখে ধরে রেখে জুডিয়াপ্পার দিকে তাকাল রানা। ‘বুঝলাম, টাকা কামাবার সাধ হয়েছে তোমার, তাই দেশটাকে তুলে দিচ্ছ কলম্বিয়ান ড্রাগ বল্টসায়ী আর মাফিয়াল্ডে হাতে। কিন্তু মেক্সিকোয় কী করছিলে তুমি?’ মাথা নাড়ল রানা। ‘নিশ্চয়ই তুমি মেক্সিকান সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইতে যাওনি?’ ‘পাগল নাকি!’ হেসে উঠল বসেল্ডে বস্, ক্যু-র নায়ক কর্নেল এসকুইটিলা জুডিয়াপ্পা। ‘আমি গিয়েছিলাম মেক্সিকান মাাফিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে। ওল্ডে মাধ্যমেই তো যুক্তরাষ্ট্রে কোকেনের চালান পাঠানো হবে।’ রানার মুখের হাসি এতটুকু ¤−ান হচ্ছে না, ম্যারিয়েটাকে বোঝাতে চাইছে সাহসের কোনও অভাব নেই ওর, ওর মত তাকেও সাহসের পরিচয় দিতে হবে। আর বেশি দেরি নেই। এক মিনিট, দুই মিনিট Ñ ব্যস, সব মিটে যাবে। তবে খেলাটা ঠিক মত খেলতে হবে। ‘বুদ্ধি আছে তোমার,’ জুডিয়াপ্পাকে বলল রানা। ‘তবে এটাকে আসলে কুবুদ্ধি বলে। আর কুবুদ্ধির ফল কখনও ভাল হয় না।’ স্ফাতে চুরুট নিয়েই হাসল জুডিয়াপ্পা। ‘পরাজিত নায়কের ফিলসফি শুনতে ভাল লাগছে না।’ রানার পিছনে সরে গেছে লাফাজা। ‘ও হে, নেড়ি কুত্তা!’ খিক্ খিক্ করে হাসল সে। ‘তুমি যèিামদিকে একটু সরে যাও, তা হলে হয়তো সু›ল্ডী লেডির প্যান্টে তোমার রক্ত লাগে না।’ ১৮০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ তার ইচ্ছে পূরণ করল রানা Ñ বাম দিকে দুই পা সরল। হাসো, মনে করিয়ে দিল নিজেকে। ‘শুভ কাজে দেরি কেন, বিগ বস্?’ মিনতির সুরে আবেদন জানাল লাফাজা। তার কুৎসিত হাসির আওয়াজ পাথরে লেগে প্রতিধ্বনি তুলছে। ‘আপনি অনুমতি দিলে এখনই শালার বেটা শালাকে উড়িয়ে দিই...’ ‘তোমার যখন ইচ্ছে ওড়াও, যাও!’ একটু অধৈর্য সুরে বলল কর্নেল জুডিয়াপ্পা। ‘কোথাকার কে মাসুল্ডানা, ওই ব্যাটাকে দিয়ে ঘোড়ার ডিম কী কাজ হবে আমার,’ বলল সে, পিস্তল ধরা হাতটা নিচু করল। ‘হ্যাঁ, করো গুলি।’ রানার হাসি কেমন যেন বদলে গেল। সেটা লক্ষ করে এক পলকে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল কর্নেল জুডিয়াপ্পা। মুখটা হাঁ হয়ে যাওয়ায় খসে পড়ল চুরুটটা। এই সময় গুলি করল লাফাজা। জুডিয়াপ্পার কপালের ঠিক মাঝখানে লাল একটা গর্ত তৈরি হলো। ব্যালে ডান্স-এর ক্লাসে আসা শিক্ষানবিসের মত পাক খেতে গিয়ে পড়ে গেল সে। লাফ দিয়ে ম্যারিয়েটার কাছে পৌঁছাল রানা, এক ধাক্কায় ডোবায় ফেলে দিল তাকে। তার পিছু নিয়ে ডাইভ দিল নিজেও। পড়ল গিয়ে ওর পাশে। ওল্ডে দিকে মুখ করে ডোবায় লাফ দিল লাফাজাও, তবে কয়েক মিটার দূরে। লাফ ত্থেয়ার আগে জুডিয়াপ্পার পিস্তলটা তুলে আনতে ভোলেনি। ছুঁড়ল সেটা, খপ করে লুফে নিল রানা। জুডিয়াপ্পা পড়ে গেছে এক মিনিটও হয়নি, দেখা গেল কলাবাগানের ওদিক থেকে বেরিয়ে ট্র্যাক ধরে ছুটে আসছে একটা আর্মি ট্রাক। রেঞ্জের অনেক বাইরে, তারপরও স্টেশন ওয়্যাগনের চারপাশে এলোপাথাড়ি রাইফেলের গুলি ছুঁড়তে শুরু করল বিদ্রোহী সৈনশুা। আসছে সাইক্লোন ১৮১ এই সময় উল্টোদিকের পাহাড়চূড়া টপকে বিকট গর্জন তুলে ছুটে এল একটা হেলিকপ্টার, সরাসরি রানা ও ম্যারিয়েটার মাথার উপর শূন্যে স্থির হলো। পরমুহূর্তে ঝপ করে ওটার কন্ট্রোল কেবিন থেকে খসে পড়ল একটা রশির মই। মইটার শেষ ধাপে একটা বাস্কেট বাঁধা রয়েছে। বাস্কেটটা রানার নাগালের মধ্যে নেমে এল। উঁকি দিয়ে তাকাতে ওটার ভিতরে একটা ওয়াকি-টকি দেখতে পেল রানা। এক সেকেন্ড ইতস্তত করে সেটা তুলল ও, তারপর বোতামে চাপ দিয়ে মুখের সামনে আনল। ‘মাসুল্ডানা স্পিকিং।’ ‘মাসুদ ভাই, আমি প্রত্যয়,’ স্পিকার থেকে ভেসে এল রানা এজেন্সির মেক্সিকো সিটি শাখার প্রধান প্রত্যয় জাহাঙ্গীরের যান্ত্রিক কণ্ঠ¯ল্ফ। ‘রিপোর্ট করো,’ নির্দেশ দিল রানা। ‘আমাল্ডে মূল দলটা সড়কপথে আসছে, মাসুদ ভাই, পৌঁছাতে একটু সময় নেবে। তবে কপ্টারে আমাল্ডে সঙ্গে রাইফেল ও গ্রেনেড আছে, আপনি হুকুম দিলে আমরা লড়াই শুরু করতে পারি। কিন্তু কে শত্র“, কে মিত্র কিছুই বুঝতে পারছি না।’ ‘কনভয়টাকে ট্র্যাকের ওপর থামিয়ে দাও,’ নির্দেশ দিল রানা। ‘কয়েকজন বাদে সবাই এখানে শত্র“। তবে বিদ্রোহী সৈনদ্দ মার্সেনারি, দু’দলকেই আত্মসমর্পণের সুযোগ দেবে।’ ‘জী, মাসুদ ভাই।’ ‘সড়কপথে বাকি সবাই চলে এলে প্রথমে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করবে বিদ্রোহী সৈন্যল্ডে সঙ্গে মেজর পিকো নামে কোনও ব›িজ্ঝাছে কি না। যে-কোনও মূল্যে তাঁকে বাঁচাতে হবে।’ ‘জী, মাসুদ ভাই। আর এদিকে, মাসুদ ভাই?’ জানতে চাইল প্রত্যয়। ‘বাড়িটায়?’ ‘এদিকের কয়েকজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে,’ ১৮২ মাসুল্ডানা-৩৬৬ বলল রানা। ‘উইশ ইউ গুড লাক, প্রত্যয়।’ ‘আমিও আপনার সাফল্য দেখতে চাই, মাসুদ ভাই। ধনল্টাদ।’ রশির মই আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে, নাক ঘুরিয়ে কলাবাগানের দিকে ছুটছে প্রত্যয়ের হেলিকপ্টার। ট্র্যাক ধরে যে আর্মি ট্রাকটা আসছিল সেটার সৈনশুা এবার টার্গেট করল হেলিকপ্টারকে। হামলার ধরনটা চোখে দেখা যায়নি, তবে ফলাফল দেখে বোঝা গেল হেলিকপ্টার থেকে সম্ভবত গ্রেনেড লঞ্চার বল্টহার করা হয়েছে। বিকট আওয়াজের সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো ট্রাকটা। এরপর কলাবাগানের দিকে ছুটল রানা এজেন্সির কপ্টার। বাড়ি থেকে নেমে আসা ট্র্যাকটার উপর নজর রাখছে লাফাজা। মার্সেনারির চোখ থেকে নেশার ঘোর ঘোর ভাব সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে, তার জায়গায় পেশাদারি ঠাণ্ডা দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে সেখানে। নিজের ট্রেনিং-এর অভিজ্ঞতা থেকে এই দৃষ্টি চিনতে পারছে রানা। আর মানসম্মত ট্রেনিংই লাফাজাকে ডোবায় পজিশন নিতে বলেছে, যেখান থেকে ওরা দুজন পরস্পরকে কাভার দিতে পারবে। ম্যারিয়েটাকে নিয়ে ডোবার আরেকটু গভীরে নেমে গেল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাবার জন্য মাথা তুলতে যাচ্ছে ম্যারিয়েটা, দেখতে পেয়ে মানা করল ও। ‘নিচু হয়ে থাকো। তুমি ঠিক আছ তো?’ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ম্যারিয়েটা, চোখে পানি। ‘ঠিক তো অবশ্যই আছেন তিনি,’ রানার প্রশ্ন শুনে কৌতুক বোধ করছে লাফাজা। তার চোখে ঘোর লাগা পাগলাটে ভাবটা আবার ফিরে এল, ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো নেশাখোরের মত। সত্যি দারুণ, মনে মনে স্বীকার করতে হলো রানাকে, অভিনয় করে লোকটা। কিন্তু কে সে? আসছে সাইক্লোন ১৮৩ ‘কার লোক আপনি?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘মেজর পিকো রামপাম, অ্যামিগো।’ মুখে সমীহভরা হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ‘তিনি বললেন Ñ ‘‘বললে বিশ্বাস করবে, লাফাজা? আমার বোনের চিঠি পেয়ে সেই বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছেন এক ভদ্রলোক! একা বেলপ্যানে যাচ্ছেন, একটা সম্ভাব্য ক্যু ঠেকাবার জন্যে! তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে সাহায্য করার জন্যে কাউকে পাঠাব। কাকে পাঠানো যায় বলো তো?’’ আমি বললাম, সেক্ষেত্রে আমার চেয়ে উপযুক্ত লোক আর আপনি পাবেন না। কেন? কারণ, একদল লোক এরই মধ্যে বেলপ্যানে যুদ্ধ করতে যাবার জন্যে ভাড়া করেছে আমাকে...’ ‘ধস্তাধস্তির সময় আপনার গায়ের গন্ধে টের পেয়েছি, আমার হাত-পায়ের রশি আপনিই...’ অমায়িক হেসে মাথা ঝাঁকাল লাফাজা। অনেকটা আপনমনেই শুরু করল রানা, ‘নদীর তীর থেকে আমার পালাতে পারাটাও...’ ‘না, অ্যাক্সিডেন্ট বা আমার অসর্তকতা ছিল না।’ হাসিটা এখনও লেগে আছে লাফাজার মুখে। ‘কিছু মনে করবেন না, সিনর, অভিনয়ের খাতিরে কত মন্দ কথা বলতে বাধ্য হয়েছি আমি। নিজেকে আপনার কঠিন শত্র“ প্রমাণ করতে না পারলে আপনাকে খুন করার দায়িত্ব দেবে না ওরা আমাকে, এই চিন্তা থেকে...’ ‘অসংখব্ধনল্টাদ, সিনর লাফাজা। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’ এরপর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল রানা। ‘পিকো রামপামের কোনও খবর জানেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। কাঁধ ঝাঁকাল লাফাজা। ‘মেজরকে এখানে নিয়ে আসা হবে, তার অপেক্ষায় আছি,’ বলল সে। ‘তখন হয়তো আপনার সাহায্য ল্ডকার হবে আমার। ভুলে যাননি তো, অ্যামিগো, আমার কাছে আপনার একটা দেনা আছে?’ ১৮৪ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘একটা নয়, দুটো,’ বলল রানা। ‘ওহ্-হো, আরেকটা কথা। পিস্তলটা আমি কিন্তু কেড়ে নিইনি, আপনি ছেড়ে ত্থেয়ায় আমার হাতে চলে আসে। আরেকবার ধনল্টাদ, সিনর লাফাজা।’ ‘মাই পে−জার, সিনর।’ রোদ লাগতে চোখ সরু করল লাফাজা। ‘আমি আপনার জন্যে তৈরি ছিলাম, সিনর, তবে ভাবিনি নিজেই এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবেন এখানে।’ ওল্ডে নীচে ট্র্যাকটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, গাছাপালার ভিতর নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। সেদিকে একটা গুলি করল ও, যতটা না লাগাবার জন্য, তারচেয়ে বেশি নিরুৎসাহিত করার জন্য। নিজের পিস্তল থেকে ম্যাগাজিন বের করে ফেলল লাফাজা। রানাকে ছয়টা আঙুল দেখাল সে। জুডিয়াপ্পার পিস্তলে, রানার কাছে রয়েছে সাতটা বুলেট। সংখ্যায় যে কিছু আসে যায়, তা নয়। ডোবায় থাকলে পাহাড়ের যে-কোনও একটা পাশ থেকে নেমে এসে ওল্ডেকে ঘায়েল করবে মার্সেনারিরা। আর যদি ডোবা থেকে ওঠে, কলা বাগান থেকে গুলি করবে বিদ্রোহী সৈনশুা। লাফাজাকে রানা বলল, ‘আপনি ডানদিকটা সামলাবেন, আমি বামদিক, ঠিক আছে? ম্যারিয়েটাকে সরিয়ে দিই।’ মাথা ঝাঁকাল লাফাজা। ম্যারিয়েটার হাত ছুঁলো রানা। ‘শোনো, স্টেশন ওয়্যাগনের পেট্রল ট্যাংকে আগুন দিতে যাচ্ছি আমরা,’ তাকে বলল ও। ‘ওটা বিস্ফোরিত হলেই খেতের দিকে রওনা হবে তুমি। হেঁটে নয়, ক্রল করে। পারবে না?’ মাথা ঝাঁকাল ম্যারিয়েটা। ‘ওখানে পৌঁছে নড়াচড়া করবে না, যতটা পারো লুকিয়ে রাখবে নিজেকে।’ ম্যারিয়েটার জবাবের অপেক্ষায় না থেকে স্টেশন ওয়্যাগনের দিকে পিস্তল তুলল রানা, দুটো গুলি করল রিয়ার সাইডপ্যানেলে। আসছে সাইক্লোন ১৮৫ টান দিয়ে নিজের শার্টের আস্তিন ছিঁড়ল লাফাজা, সেটাকে ওর সেই বিখ্যাত ছোরা দিয়ে কয়েকটা ফালি বানিয়ে একটা পাথরের চারদিকে জড়িয়ে রানার হাতে দিল। ‘রেডি,’ ম্যারিয়েটাকে বলল রানা। লাইটার জ্বালল লাফাজা, শিখাটা সদ্য তৈরি বান্ডিলের নীচে ধরল। আগুনটা ভাল মত লাগতেই সেটা স্টেশন ওয়্যাগনের দিকে ছুঁড়ে দিল রানা। তারপর তিনজনই ওরা ডোবার আরও নীচে নামল। মুহূর্তের জনশুানার মনে হলো, টার্গেট মিস করেছে ও। কিন্তু তারপরই পেট্রল ট্যাংক বিস্ফোরিত হলো। মাথা তুলেই চেঁচিয়ে উঠল রানা, ‘গো!’ মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে পানি থেকে উঠে গেল ম্যারিয়েটা, ক্রল করে দূরে সরে যাচ্ছে। ম্যারিয়েটা কতদূর গেল দেখবার সময় নেই ওল্ডে, কারণ ডোবার আরেকদিকে সরে এসে পারে উঠে পড়েছে রানা, শরীরটাকে গড়িয়ে দিয়ে ট্র্যাক পার হলো, তারপর ঝপাৎ করে পড়ল উল্টোদিকের ডোবায়। বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। রানার পিছু নিয়ে পৌঁছে গেল লাফাজা, ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল সে। তার সঙ্গে থাকার জনল্টাধ্য হয়ে এগোতে হলো রানাকে। সরু ডোবা ধরে দুশো গজ যেতে হবে। পাথরে ঘষা খেয়ে হাঁটু ও কনুই ছিলে যাচ্ছে। অর্ধেক পথও যেতে পারেনি, রক্তাক্ত হয়ে উঠল শরীর। রানা তবু তো কমব্যাট জ্যাকেট পরে আছে, লাফাজার পরনে আস্তিন ছেঁড়া শুধু একটা সুতি শার্ট। রানাকে কাছ থেকে ত্রিশ গজ ডাইনে রয়েছে লাফাজা। আর বিশ গজ এগোতে পারলেই গাছপালার আড়াল পাওয়া যাবে। এই সময় পরিচিত একটা গলা ভেসে এল গাছগুলোর ওদিক থেকে। ‘জলদি, সিনর!’ ঘাড় ফিরিয়ে আরেক দিকে তাকাল রানা, দেখল আর দশ গজ ১৮৬ মাসুল্ডানা-৩৬৬ এগোতে পারলেই গাছপালার ভিতর হারিয়ে যাবে লাফাজা। তারপর ওখান থেকে শটকার্ট পথ ধরে পৌঁছে যাবে কলাবাগানে। ‘আমার দিকে হেঁটে এসো, সিনর,’ আবার বলল রডরি। ইতস্তত করছে রানা। ‘জলদি, সিনর!’ তাগাদা দিল রডরি। ‘উঠে এসো! দৌড়াও!’ একটা রাইফেল গর্জে উঠল, বাতাসের আলোড়ন অনুভব করে রানা বুঝল, বেঁচে আছে স্রেফ ভাগ্যগুণে। ডোবা ছেড়ে উঠতে যাবে, পা পিছলে পড়ে গেল। ‘ক্রল, সিনর, ক্রল!’ রডরির গলায় রাজেশু উদ্বেগ। কারণটা কী? রানা তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল বলে? নাকি রানাকে বিমা হিসাবে দেখছে সে? রডরির পজিশনটা ভাল করে পিন-পয়েন্ট করল রানা। বিশ গজ সামনে, ট্র্যাক-এর পাশেই, গাছপালার কিনারায়। বাগানটার কোণ ঘুরতে পারলে পাহাড়ী ঢালে পজিশন নেওয়া মার্সেনারিল্ডে চোখের আড়ালে চলে যাবে ও। কিন্তু ডোবা থেকে ওঠা মাত্র প্রাচীরের মাথা থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে ওকে, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে ওখানে। ডোবা থেকে না উঠে, অগভীর পানিতে ক্রল করে আরও দশ গজের মত এগোল রানা। তারপর রডরিকে বলল, ‘আমাকে কাভারিং ফায়ার দাও।’ ফায়ার শুরু হতেই ডোবা থেকে উঠে এল রানা, তারপর ট্র্যাক- এর উপর গড়িয়ে দিল শরীরটা, শুনতে পেল কাকে যেন অভিশাপ দিচ্ছে রডরি। একটু আগেই রাইফেলের গর্জনকে ছাপিয়ে শোনা গেছে পিস্তলের জোরালো দুটো আওয়াজ। ক্রল করে এগিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে থাকা কয়েকটা পাইনগাছের আড়ালে আশ্রয় নিল রানা। নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ তুলতেই সামনে পাবলো টিকালাকে দেখল ও। ‘পিস্তল ফেলে মাথার ওপর হাত তোলো মাসুল্ডানা!’ আসছে সাইক্লোন ১৮৭ লোকটার হাতে একটা .৪৫ রিভলভার রয়েছে। রোগাটে ও বিপজ্জনক, গাছগুলোর ফাঁকে চোখ রেখে ওকে খোঁজার সময় সাপের মত দুলছে যেন সে। আরও চারটে গুলি আছে তার রিভলভারে। পিস্তলটা হাত থেকে ছেড়ে দিল রানা। রানাকে বাগে পেয়ে ঠোঁট মুড়ে হাসল সে। উঠে বসবার ইঙ্গিত করল রিভলভার দিয়ে। নড়াচড়ার মধেঞ্জাড়ষ্ট ভাব, অনেক কষ্ট করে বসল রানা, হাত দুটো মাথার পিছনে, চোখে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার করুণ মিনতি। টিকালা অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে তার নাক ঝাড়ল নতুন একটা রুমালে। বেগুনি চোখের পাতা উঁচু হতে ঠাণ্ডা চোখ বেরিয়ে পড়ল। হাসিটা চওড়া হলো। খুনের মজাটা উপভোগ করার জন্য রিভলভারটা ধীরে ধীরে তুলছে সে। একটা ট্রাক-এর ডিজেল ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ল্যাটিনো লোকটা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য মনোযোগ হারাল। তারপর ফায়ার করল সে। দু’বার। প্রথম বুলেট কয়েক ইঞ্চি দূরে লাগল, খানিকটা কাদা ছিটিয়ে দিল রানার জাঙ্গল বুটে। দ্বিতীয় বুলেট ঢুকল ওর নিজের দুই পায়ের মাঝখানের ভেজা মাটিতে। রিভলভারটা পড়ে গেল হাত থেকে। তার হাঁটু ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে টিকালার, শরীরটা কাত হয়ে একটা গাছের গায়ে পড়ল, এক হাতে গাছের কাণ্ডটাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে, আরেক হাত তার গলায় গাঁথা থ্রোয়িং নাইফ-এর চ্যাপ্টা হাতলটা আঁকড়ে ধরেছে। হাঁটু ভেঙে গেল, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ট্রাকের ইঞ্জিন গর্জাচ্ছে, বাগানের ভিতর দিয়ে সেটাকে ছুটিয়ে আনছে ড্রাইভার। অকস্মাৎ চারদিক কেঁপে উঠল বিরতিহীন গুলির শব্দে। নিজের ছুরিটা সংগ্রহ করল রানা, তারপর রডরিকে খুঁজে বের করল। কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে গানম্যান, ফেনা মেশানো রক্ত দেখা যাচ্ছে তার ঠোঁটে। টিকালা তার পিঠে গুলি করেছে। জোর করে রানার হাতে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল সে, নিভে আসা চোখে ১৮৮ মাসুল্ডানা-৩৬৬ আকুতি। নিজের রক্তে কাঠি ডুবিয়ে পাঁচটা ক্রসচিহ্ন এঁকেছে সে, ওগুলোর মাঝখানে একটা ু, একটা ঁ ও একটা ই লিখেছে। ‘ইউনাইটেড ব্যাংক, জুরিখ?’ কথা বলতে চেষ্টা করল রডরি, কিন্তু মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসায় দুর্বোধঞ্জাওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। তার ফুসফুস থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে সে তার চোখ দিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করল Ñ নিজের নয়, মরিয়া হয়ে উপকার করতে চাইছে পরিবারের। তিনটে ছেলে, তিনটে মেয়ে। ‘আমি দেখব তারা যেন এই ন¤ল্ফটা পায়,’ কথা দিল রানা। কলাগাছগুলোকে চ্যাপ্টা করে দিয়ে রানার বাঁদিক থেকে ছুটে এল ট্রাকটা, বাগানের কোণে পৌঁছে বাঁক ঘুরল। স্ফাড়াবার ঝুঁকি নিল রানা, ফলে ওকে দেখতে পেল লাফাজা। ট্রাক ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে এখন আরও একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জেট ইঞ্জিনের গুঞ্জন, হেলিকপ্টারের রোটর অনবরত কট-কট করে বাতাস কাটছে। ট্রাকের ল্ডজা আঁকড়ে ধরে ক্যাবে উঠে পড়ল রানা। ‘আপনি দেখছি বদ্ধ একটা উন্মাদ!’ পরমুহূর্তে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল ও। ট্রাকটা লাফাজাই চালাচ্ছে বটে, তবে তার ওপাশে বসে রয়েছে মেজর পিকো রামপাম। ‘উন্মাজ্ঝামি নই,’ সহাসেল্টলল লাফাজা। ‘সড়কপথ ধরে আপনার এজেন্সির লোকজন পৌঁছে গেছে, বিদ্রোহী সৈন্যল্ডে হাত থেকে তারাই মেজর পিকোকে উদ্ধার করে ট্রাকটায় তুলে দিল।’ চোখাচোখি হতে হাসল পিকো। ‘কর্নেল জুডিয়াপ্পাকে খুন হতে দেখার পর আমাল্ডে বিদ্রোহী সৈনশুা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বেশিরভাগই পালিয়ে পাহাড়ে চলে গেছে। পালাবার সময় ফাঁকা গুলি করেছে ওরা, এতক্ষণ তারই আওয়াজ পাচ্ছিলাম আমরা।’ ‘হাই, সিনর ক্যাপিটানো,’ একগাল হাসি নিয়ে ডাকল ওকে লাফাজা। ‘নেড়ি কুত্তা বলায় যল্ডিাগ করে থাকেন, পি−জ, আপনি আসছে সাইক্লোন ১৮৯ আমাকে নেংটি ইঁদুর বা শুয়োর বলে প্রতিশোধ নিন, তবু মনে ক্ষোভ পুষে রাখবেন না, পি−জ।’ আধঘণ্টা পর। রোল্ডে মধ্যে একটা ট্রাকের রানিং-বোর্ডে বসে রয়েছে রানা। ওর পাশে স্ফাড়িয়ে রয়েছে ম্যারিয়েটা। কাছাকাছি রয়েছে দুজন, তবে কেউ কাউকে ছোঁয়নি, এমনকী পরস্পরকে দেখছেও না। হেলিকপ্টারের ক্রুরা ট্রাকের কাছ থেকে সামান্য দূরে স্ফাড়িয়ে রয়েছে, নিজেল্ডে মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছে তারা। ইতিমধ্যে বিদ্রোহী সেনারা বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। তবে মার্সেনারি যারা পাহাড়ে পালিয়েছিল তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যেককে গুলি করে মারা হয়েছে। ‘সত্যি দুঃখিত,’ বলল ম্যারিয়েটা। ‘হাঁটতে হাঁটতে যখন মনে হলো আর পারব না, এবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলব, ঠিক তখন দেখি একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। ওরা আমাকে লিফট অফার করল। বললাম, আমাকে মেক্সিকান দূতাবাসে পৌঁছে দিলেই হবে।’ ‘কিন্তু ওরা তোমাকে নিয়ে গেল কর্নেল জুডিয়াপ্পার কাছে?’ মাথা ঝাঁকাল ম্যারিয়েটা। ‘এখন আর ব্যাপারটার কোনও গুরুত্ব নেই।’ এস্টেটের নিরাপত্তার দিকটা নিñিদ্র করে বন্দিল্ডে সবাইকে মুক্ত করবার পর আবার রানার সামনে ফিরে এল প্রত্যয় জাহাঙ্গীর। ‘মাসুদ ভাই, মেক্সিকো সিটিতে আপনি আমাকে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কর্নেল জুডিয়াপ্পার ওপর নজর রাখতে হবে। তা রাখতে গিয়ে দেখলাম লোকটা মাফিয়ার সঙ্গে বেআইনী বল্টসার ব্যাপারে চুক্তি করতে যাচ্ছে। সেই থেকে তার পিছু আর ছাড়িনি আমরা। তবে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল প্রথমে ঝড়টার জন্যে, তারপর মিস্টার প্রেসিডেন্টের জন্যে...’ ‘এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট কোত্থেকে এলেন?’ ১৯০ মাসুল্ডানা-৩৬৬ ‘প্রায় সত্তর বছর বয়স, অথচ সাঁতরে নদী পেরিয়েছেন, ঝড়ের পিছু নিয়ে পাহাড় টপকে বিশ মাইল হেঁটেছেন, অবশেষে রাজধানীতে পৌঁছে নক করেছেন মেক্সিকো দূতাবাসের ল্ডজায়...’ রানা শুনতে পেল ফোত্ ফোত্ করে নাক টানছে ম্যারিয়েটা। তার কাঁধে একটা হাত রাখল ও। বলল, ‘তোমাকে তো আসল কথাটাই বলা হয়নি।’ ‘কী কথা?’ ‘তোমার ভাই লাফাজার সঙ্গে রাজধানীতে ফিরে গেছেন...’ ‘অসম্ভব!’ বাধা দিল ম্যারিয়েটা। ‘তোমার কোনও ধারণা নেই পিকো ভাই কী রকম ভালবাসেন আমাকে। আমার সঙ্গে দেখা না করে কোথাও তিনি যাবেন না।’ ‘আসলে আমারই ভুল হয়েছে,’ শান্তসুরে বলল রানা। ‘মেজর পিকো নিজের ইচ্ছেয় যাননি, সৈনিকরা তাঁকে একরকম জোর করেই নিয়ে গেল।’ ‘কেন?’ শিরস্ফাড়া খাড়া করল ম্যারিয়েটা। ‘কোথায় ছিলে তুমি? যাবার সময় শে−াগানও তো দিচ্ছিল তারা।’ ‘কী শে−াগান?’ ‘ওরা আসলে মেজর পিকোকে নির্বাচনে স্ফাড় করাতে চাইছে, তাঁকে ওরা বেলপ্যান-এর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চায়...’ হেসে ফেলল ম্যারিয়েটা। ‘ও, বুঝেছি, তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। পিকো ভাইয়ার বয়স কত যে প্রেসিডেন্ট হবেন?’ ‘প্রেডিডেন্ট হতে বয়স লাগে না,’ বলল রানা। হেলিকপ্টারের দিকে এগোল সবাইকে নিয়ে। ‘এবার চলো, তোমাকে বেলপ্যান সিটিতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাব আমরা।’ মুহূর্তে আঁধার হয়ে গেল ম্যারিয়েটার মুখ। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকাল রানার মুখের দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ‘তুমি চলে যাবে, রানা?’ আসছে সাইক্লোন ১৯১ ‘যেতে তো হবেই। নইলে পিট্টি লাগাবে আমার বুড়ো বস্। অনেকদিন ধরে ফাঁকি দিয়েছি অফিসের কাজে। এখানকার কাজ তো শেষ, এবার ফিরব।’ ‘আর দেখা হবে কোনদিন?’ বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ম্যারিয়েটা। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে কাছে টানল রানা, নিচু গলায় বলল, ‘শীঘ্রিই আসব আমি আবার, ম্যারি। তোমার টানে।’ ***


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৭৭০ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now