বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন
বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

তালেতে বেতাল

"জীবনের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান মাজহারুল মোর্শেদ(guest) (০ পয়েন্ট)

X লেখকের নাম- মাজহারুল মোর্শেদ গল্পের নাম- তালেতে বেতাল সঙ্গীতে ধারাবহিক গতি যেমন লয়, তেমনি লয়ের ছন্দোবদ্ধ মাত্রার সমষ্টি হলো তাল। প্রকৃতির সৃষ্টি জগতের জীববৈচিত্র কিংবা বস্তুজগতের অস্তিত্বে রয়েছে ছন্দময়তা। একটা নর্দিষ্টি সময়ের মধ্যে ঘটে চলেছে তার দৈনন্দিন ছন্দবদ্ধ গতিময়তা। আর সেকারণেই পৃথিবীটা এতো সুন্দর, শৃঙ্খলাবব্ধ, এতো মনোরম। বিশাল মহাকাশে সৃষ্টি জগতের প্রত্যেকটি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ সমান দূরত্বে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেস্ব কক্ষপথে সমান তালে আদি হতে অদ্যবধি কেবলই ঘুরছে। তাদের মাঝে এতোটুকু নিয়োম ভাঙ্গার প্রবণতা নেই, এতোটুকু ব্যত্যয়ও ঘটে না। জীবজগতে ঠিক তাই শিকারী মাংসাশী প্রণিরা বাজপাখি খায়, বাজপাখি সাপ খায়, সাপ ব্যাঙ খায়, ব্যাঙ পোকামাকড় খায় এভাবে প্রকৃতির নিয়োমে সবকিছুর মাঝে সমান তালে ভারসাম্য বজায় থাকে। রেলগাড়ির ছন্দময় গতিতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু এর চলার গতি ছন্দ হারিয়ে ফেললে অর্থাৎ গাড়ি ব্রেক হয়ে গেলে আমরা চমকে উঠি কারণ তখন চলার ছন্দ পতন ঘটে। তাই তাল শুধু সঙ্গীতে নয়, মানব জীবন চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে এর উপস্থিতি অপরিসীম বিদ্যমান, যার নুন্যতম বচ্যিুতি আমাদরে পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের গতি ছিটকে পড়ে স্বাভাবিক চলার পথ হতে। ফলে জীবনে নেমে আসে অসহনীয় জ্বালা-যন্ত্রণা, দুঃখ-বেদনা। বিয়ের পর দাম্পত্য জীবন সবাই চায়, সবাই সুখি হতে চায়। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসেব সব সময় মেলে না। এর সমীকরণটা বেশ জটিল। দুই যোগ দুই যেমন চার হয় তেমনি আবার এক-কে চারবার যোক করলেও একই ফলাফল হয়। শুধু সমীকরণের ভিন্নতা। সংসার জীবনে এমন সমীকরণের জটিলতায় পরে, সমীকরণের হিসেব মেলাতে না পেরে কতোজনাই না বিবাগী হয়ে ঘর ছাড়ে, সন্নাসী হয়ে পথে পথে ঘোরে। তীব্র ভালোবাসা এবং প্রবল আবেগের বশবর্তী হয়ে একসময় ঘর বেঁধেছিল বন্ধু আকাশ ও নদী। আকাশ ও নদী মিলনান্তক শব্দদ্বয় যদিও কাব্যিক অর্থ বহন করে কিন্তু বাস্তবতায় এটি দৃষ্টান্ত রেখেছিল। বিশাল আকাশের নিচে নদীও বেশ ভালোই ছিল। আকাশের অমীয় ধারায় বর্ষণে নদীর বুক ভরে যায়, নদীর দু’কূল ছাঁপিয়ে উছলে ওঠে ভালোবাসার ঢেউ। এক মুহুর্তেও জন্যও নদী আকাশকে ছাড়া থাকতে পারে না। আকাশ অফিসে গেলে মনে হয় সে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যতোক্ষণ না সে বাসায় ফেরে। আজ আকাশের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে সে অস্থিও হয়ে পড়ে। হ্যালো! হ্যালো! আরে ধ্যাৎ, এবারও লাইনটা বুঝি কেটে গেল। উহঃ কি বিরক্তিকর অবস্থা। ইদানিং মোবাইল কোম্পানী গুলো এতো বাজে সার্র্ভিস দিচ্ছে যা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়া যায় না। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার লোভ তাদের পেয়ে বসেছে। যতোনা ফ্রিকুয়েন্সি তার চেয়ে তিন গুন সিম বাজারে বিক্রি করে বসে আছে। গ্রাহকরা কথা বলতে পাক আর না পাক এ নিয়ে তাদের কোন মাথা নেই। তবুও মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এপাশ ওপাশ পায়চারি করছে আর ভাবছে আকাশতো কখনো এমন করেনা একটু সময় পেলেই সে বাসায় চলে আসে, আর বাহিরে আড্ডা মারার লোক যে সে নয় এটা আমার চেয়ে আর ভালো কে বা জানবে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল চুলোয় মাংস বসিয়ে দেয়া হয়েছে রান্নার জন্য এক দৌড় দিয়ে গেলো কিচেনে কিন্তু তার আগেই সে মাংস আর খাওয়ার উপযোগী নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কি হচ্ছে এসব, কেন এমন হচ্ছে? একটা জরুরী কাজ আছে বলে কিছু একটা মুখে না দিয়েই তারাহুরো করে বেড়িয়ে গেলো আকাশ, বলে গেলো এখনি ফিরে এসে খাবে। কিন্তু এখন যে দুপুর গড়িয়ে গেল তবুও ফেরার কোন নাম নেই। বাড়ির উঠোনে বকুল গাছটায় একটা বৃদ্ধকাক এসে তারস্বরে ডাকছে। নদীর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ছোট বেলায় দাদিমার কাছে সে শুনেছে কাকের নাকি একটা প্রখর অনুভুতি শক্তি আছে যা দিয়ে সে কারো বিপদ আপদ হলে আগে থেকেই টের পায়। তার কর্তব্য পালনে মানুষের বড়ি গিয়ে এভাবে ডেকে ডেকে বিপদের কথা জানিয়ে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো এই কাকটি তার খুব পরিচিত, বয়স বাড়লে যেমন মানুষের মাথায় টাক পড়ে যায় সেরকম কাকটির মাথায় মনে হয় টাক পড়ে গেছে দেখতে অনেকটা তাই মনে হয়। সে প্রায়ই বাড়িতে এসে এটা সেটা খেয়ে যায়। একটা অজানা আতঙ্কে নদীর বুকের ভেতরটা ধক্ ধক্ করে ওঠে। সে ড্রইংরুমে গিয়ে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দেয় তার পর সোজা সুজি ফ্যানের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। টেবিলের উপড়ে পড়ে থাকা খবরের কাগজে বড়করে ছাপা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মটরসাইকেল আরহী গুরুতর আহত। আসঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবরের কাগজটি যে গত রাতেই ছাপানো হয়েছে এ কথা ভাবার অবকাশ তার নেই। প্রচণ্ড আবেগে সে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে। এমন সময় গেইটে কলিং বেল বেজে ওঠে, এক দৌড় দিয়ে সে গেইটে চলে যায়। গেইট খুলে দেখে আকাশ অমনি তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নদীর আচরণে হতবম্ভ হয়ে যায়। হঠাৎ কি হলো তার কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? কোন রকমে তাকে একটু সরিয়ে নিয়ে আকাশ জিজ্ঞাসা করে নদী? কি হয়েছে তোমার? কোন দুর্ঘটনা ঘটেনিতো? না কিছু হয়নি। তবে বোকার মতো এমন করলে কেন? আমার জায়গায় যদি তুমি থাকতে তবে তুমিও তাই করতে। আরে বাবা, তা না হয় করতাম কিন্তু তোমার কি হয়েছে সেটা তো বল? বলছিতো কিছু হয়নি, এমনিতেই তোমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাই। তুমি ছাড়া আমি ভীষণ একাকিত্ব বোধকরি, তুমি অফিসে গেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাইনা, আমার চারিদিকে কেবল শূন্যতা বিরাজ করে, কিছুই ভালো লাগে না। তোমার কোন কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে একবারও কি ভেবে দেখেছ? কেন যে লর্ড বেন্টিং আইন করে সহমরন প্রথাটিকে বাতিল করে দিলো কে জানে। আচ্ছা ! তাহলে এই হলো আসল ঘটনার মূল প্রাদিপাদ্য বিষয়। তোমাকে ছেড়ে আমিতো স্বর্গেও যেতে রাজি নই, আর পৃথিবী ছেড়ে যাওয়াতো দূরের কথা। ভালো করে দেখতো, কতোবার তোমার ফোনে কল দিয়েছি? তুমি যখন রিসিপ করছ না স্বাভাবিক কারণে আমার ভেতর অজানা উৎকণ্ঠার উদ্রেক হবেই। আমার বুকের ভেতর যে কি আগুন জ্বলছিল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আরে বাবা, বলছিতো ফোনটা সাইলেণ্ট হয়ে ছিলো তাই টের পাই নি এ নিয়ে এতো টেনশন করার কি আছে বলো? তাছাড়া যেহেতু আমি চাকরি করি, অফিসে কতো রকমের সমস্যা থাকে, একটু আধটু দেরি হতেই পারে। প্রতিদিন কি আর সময় মেইনটাইন করা সম্ভব বলো? মনটাকে একটু শক্ত কর নদী, এতো নার্ভাস হলে সংসার করবে কিভাবে? আকাশ আমি চাইনা তোমার অর্থ সম্পদ, গাড়ি বাড়ি, আমি চাই শুধু তুমি আমার পাশে থাকো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে কি-যে ঘটে গেলো সেটা কেউ জানেনা। হঠাত একসময় নদী শুকিয়ে যায়, জলশূন্য হয়ে পড়ে তার বুক। সবুজহীন শূন্যতা, চারিদিকে উত্তপ্ত ধুধু বালুচর। বাস্তবেও যেন এর প্রভাবটা একটু বেশি জঠিল হয়ে পড়ে। একে অপরের মাঝে আগের মতো দক্ষিণা বাতাস বহে না। ঠুনকো একটা বিষয় নিয়ে মান অভিমানের তিব্রতা বেড়েই চলে। প্রথমে হোটেলে খাওয়া, আলাদা বিছানায় শোয়া, তারপর আলাদা রুম, এমনকি দিনের পর দিন বাড়িতে না ফেরা। নানান অভিযোগের পাহাড় জমে একে অন্যের প্রতি। হাজার চেষ্টা করেও আর তাদেরকে এক ঘরে করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে সিদ্ধান্ত গড়িয়ে যায় ভাঙা-গড়ার দিকে। ফলে বিবাহবিচ্ছেদের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত চলে আসে ভাগ্যে। কিন্তু মন ভাঙা বা সংসার ভাঙা কোনটিও একজন বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় যেমন দুঃখ আছে তেমনই দু’টি জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো করুণ পরিণতিও আছে। মাঝেমধ্যে এমন কিছু ভাঙা-গড়ার করুণ পরিণতি তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। পত্রিকার পাতা থেকে সামাজিক গণমাধ্যম কোথাও বাদ যায় না। তবে ঝগড়া বিবাদ করেই হোক বা ভদ্রভাবেই হোক, বিচ্ছেদের যে ক্ষত সেটাতো কখনো শুকাবার নয়। কারণে অকারণে, সময়ে অসময়ে সেটা দকদকে হয়ে উঠবেই। যা বয়ে বেড়াতে হবে যতোদিন মৃত্যু না আসে। সেটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয় তাদের মাঝে থাকা ভবিষ্যত সম্ভানাময় সন্তানটির জন্য। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সেই কোমলমতি সন্তানের ওপর। বিচ্ছেদের পর সেই ভাগ্যাহত সন্তানের মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যায়। তার শৈশব কৈশোর কাটতে থাকে এক যন্ত্রণাদগ্ধ সময়ের মাঝে। কতোটা মানসিক-শারীরিক চাপ পড়ে তার উপর সেটা ভাবতেও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেরা ভালো থাকার এজেন্ডা নিয়ে আলাদা হয়ে সন্তানের জীবন নরকসম যন্ত্রণায় ঠেলে দেওয়ার মতো অমানবিক কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। বিয়ে মানে প্রেম-ভালোবাসা, সম্মান, দায়িত্বসহ শান্তিপূর্ণভাবে দু'টি হৃদয়ের একসাথে থাকার সামাজিক চুক্তি। ধর্মীয় মতে বিয়েটা সৃষ্টিকর্তার এক অপরিসীম নেয়ামত। যাহোক আকাশ ও নদীর ক্ষেত্রে যে অভিযোগগুলো পাওয়া যায় তা হলো পারিবারিক কলহ, মানসিক নির্যাতন, উদাসীনতা, প্রেম ভালোবাসায় ঘাটতি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, পারস্পারিক অবিশ্বাস ইত্যাদি। কিন্তু উভয়পক্ষের পরিবারও এর জন্য কম দায়ি ছিলো না। শেষ পরিণতি হলো আকাশ ও নদীর মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান সেটার সেতুবন্ধন হিসেবে মিলনের প্রতিক স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে তাদের সন্তানটি। এখন আর আকাশে মেঘ নেই, বৃষ্টিও হয়না তাই নদীর বুকেও পানি নেই ধুধু বালুচর। কোথাও কোন সবুজের চিহ্ন নেই। চারিদিকে শুধুই শূন্যতা, শুধুই হাহাকার। বিবাহবিচ্ছেদ একটি সামাজিক ব্যাধী যা ক্যানসারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ থেকে পরিত্রাণ সকলের কাম্য হওয়া উচিত। এবার ফিরে আসি আসল কথায়, মেঘে মেঘে বেলা অনেক বেড়ে যায়। শীতের প্রকোপে উঠোনে হাসনাহেনার পাতা ঝরে যায়, বসন্তে আবার নতুন পাতা গজায়, ফুলে ফুলে ভরে য়ায়। শ্রাবণে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসে নদীর দু’কূল ভরে থইথই পানিতে। কিন্তু আগের মতো আর জানালা হয়না খোলা, আসে না দক্ষিণা বাতাস। আকাশ সেই যে ঘর ছাড়া হলো-আর ফিরে এলো না। জীবনের প্রয়োজনে নদী একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। সোনার টুকরো ছেলেটিও মা-বাবার অযত্ন অবহেলায় সারাদিন একা বাড়িতে কেমন ঝিমিয়ে থাকে। রাতে অফিস থেকে মা ফিরে এলে তার আঁচলের তলে মুখ লুকিয়ে নীববে কাঁদে। নদী টের পেয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। চাকরি না করলে মুখে ভাতই বা জুটবে কি করে। মা-বাবার অমতে পালিয়ে এসে আকাশকে বিয়ে করে, এখন আর তাদের কাছে ফিরে যাবে কোন মুখে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে-বাবা আমি না আসা পর্যন্ত তুমি গেটের বাইরে যেয়োনা। ছোট্ট একটা ছেলে কি এমন বয়স তার হয়তো তিন-চার বছর হবে। কাজের বুয়া একসময় এসে রান্না-বান্না করে ছেলেকে গোসল করে দিয়ে চলে যায়। তারপর আবারো একাকী প্রহর। সারাদিন টিভিতে একই কার্টুন আর কতো দেখে? নিস্পাপ শিশুটিও মানষিকভাবে ভেঙে পড়ে। একদিন প্রচণ্ড জ্বরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। নদী অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে তার ছেলে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এখন সে অসুস্থ ছেলেকে সময় দেবে না চাকরি করবে। সব মিলে একটা নরকীয় যন্ত্রণর মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে নদী। নিঃসঙ্গতা তাকে এতাটা বাজে ভাবে চাঁপিয়ে বসে যে, সে আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলে। তবুও সে একদিন পড়ন্ত বিকেলে আকাসের অফিসে যায়। আকাশের কলিগ উর্মি নামের যে মেয়েটিকে নিয়ে আজ তার এ দুর্দশা রিসিপসনে গিয়ে তারই দেখা মেলে। নদীর পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে কিলবিল করতে থাকে হাইপাওয়ার এসির মধ্যেও সে রীতিমত ঘামতে থাকে। প্রথমে উর্মিই কথা বলে-ম্যাডাম আসেন, এখানে বসেন। আপনাকে চা দিতে বলি? না থাক, চা খেতে ইচ্ছে করছে না। প্রচণ্ড অনিচ্ছার সত্বেও নদী বলে আপনার স্যার কি অফিসে আছেন? না-ম্যাডাম, স্যার তো অনেকদিন আগেই রেজিকনেশন লেটার দিয়ে চলে গেছেন, আপনাকে বলেন নি সে কথা? নদীর বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। সে আর স্বাভাবিক থাকতে পাচ্ছে না, মাথাটা কেমন বনবন করে ঘুরছে। ডাইনী মেয়েটাকে সে এক মুহুর্ত সহ্য করতে পাচ্ছে না। তারপরেও আকাশের চাকরি ছাড়ার বিষয়টি জানা খুব জরুরি। এখানে আর কাউকেও সে চেনে না, জানে না। কার কাছেই বা জানতে চাবে। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার স্যার হঠাৎ করে চাকরি ছাড়লো কেন? আরে বাহ! সেটা আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আপনার সাথে স্যারের কথা হয়নি? না –মানে আমি তাকে ঠিক ওভাবে কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। সে তো অনেদিন আগের কথা ম্যাডাম, তা প্রায় চার-পাঁচ মাসতো হয়েই গেলো। আর স্যারের কিছু পাওনাও ছিলো, ম্যানেজার স্যার তার সাথে অনেক জোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্ত ফোনের সুইস অফ, হোয়াটস এ্যাপস, ফেইসবুক আইডি সবই ইনএ্যাকটিভ। নদী আর স্থির থাকতে পাচ্ছেনা। একটা অজানা আতঙ্ক এসে তাকে এতোটাই চেঁপে বসেছে যে, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের জল আর কোন ভাবেই বাধা মানছে না। তারপরেও একটু স্বাভাবিক হয়ে সে বললো- আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার স্যার কি নতুন কোন চাকরিতে জয়েন্ট করেছে? এবার ভদ্র মহিলা না হেসে পারলেন না- তা আমি কেমন করে জানবো-ম্যাডাম, আমিতো ছ’মাসের ট্রেনিং এ দেশের বাইরে ছিলাম। এসে দেখি স্যারের টেবিলে অন্য একজন অফিস্যার। পরে একদিন ম্যানেজার স্যারের মুখে শুনলাম তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ম্যাডাম, চা এসে গেছে, চাটা নিন খেতে খেতে কথা বলি। আচ্ছা উর্মি ম্যাডাম, চাকরি ছাড়ার পর আপনার স্যারের সাথে কোন দিনই দেখা হয়নি? আরে বাহ! আপনি আমার নামও জেনে গেছেন দেখছি। আপনার স্যারের মুখে শুনেছি। আপনাকে নিয়ে স্যার অনেক গল্প করতেন। তাই না কি? আমি বিদেশে চলে যাওয়ার পর স্যার চাকরিটা ছেড়েছেন, কাজেই আর দেখা হয়নি। তবে অনাধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়লেও আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা না করে পাচ্ছি না ম্যাডাম। সেটা হলো- স্যার কি বাড়িতে থাকেন না? মানে আপনার সাথে- না, মানে বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের মধ্যে বনি-বনা তেমন হচ্ছিল না। মান অভিমানে অনেকটা মনমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছে, তাই। কিন্তু কেন? স্যারতো খুব ঠাÐা প্রকৃতির মানুষছিলেন, অফিসে কোন দিনই কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছেন এমনটি কখনো শুনিনি। অফিস আর সংসার তো এক জিনিস নয় ম্যাডাম। অফিসের বাইরে যে বিশাল একটা জগত থাকে, সংসারটা তারই একটা অংশ। যেখানে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। কথাগুলো বলতে বলতে নদী খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এবার আর কোন ভাবেই নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। উর্মিও একটু ভ্যাবাচ্যাকার মধ্যে পড়ে গেলো, তাকে সান্তনা দিয়ে বলে, স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন আর আপনি তার জীবন সঙ্গী তাই আপনাকে আপু বলেই সম্বোধন করলাম, মনে কিছু নিবেন না আপু। আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, যদি কখনো আপনার উপকারে আসতে পারি তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। আর এই প্যাকেটে স্যারের পাওনা বাবদ কিছু টাকা আছে, স্যারতো নেই তাই আপনাকে দেয়া হলো। বাসায় ফিরে দেখে শূন্য বাড়ি, শূন্য ঘর, শূন্য বিছানা। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, ডুকরে ডুকরে কান্না আসে। কি থেকে কি হয়ে গেলো, সামান্য একটু ভুলে আজ তার গোটা জীবনটা তছনছ হয়ে গেলো। বেঁচে থাকাটাই এখন অনর্থক, যন্ত্রণাময়। যে উর্মিকে নিয়ে সে আকাশকে সন্দেহ করতো, দিনের পর দিন কথা বলতো না, সে কি খেয়েছে, কি খায়নি কোন দিন জিজ্ঞসাও করতো না। সে আলাদা ঘরে ঘুমিয়েছে কোন দিন তার পাশেও যেতো না। স্ত্রী হিসেবে সে কোন দিন তার দায়িত্ব পালন করেনি। আজ সেই উর্মি তার বোনের মতো পাশে দাঁড়ালো। এখন নিজেই তার নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। এতোটা জঘন্য কাজ যে করতে পারে তার জন্য এমন শাস্তিতো প্রাপ্য। এখন কেঁদে কি হবে? তার উচিৎ আত্মহত্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করা। কিন্তু না, আকাশ যেখানেই থাকুক, আর যতো দূরেই থাকুক না কেন, তাকে সে ফিরিয়ে আনবেই, প্রয়োজনে তার হাত পা ধরে হলেও তাকে ফিরে আনতেই হবে। নদী ড্রইং রুমে যেয়ে আকাশের লেখা “তৃষিত তিমির” নামে উপন্যাসের বইটি হাতে নিয়ে আলতো করে একটা চুমু দেয় তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদে। দেখ আকাশ, আজ তুমি নেই, কিন্তু তোমার সাগর আছে, তোমার নীলিমায় নীল আকাশ, তৃষিত তিমির আছে। সব স্মৃতি কি মুছে ফেলতে পেরেছ? পার নাই। তুমি আছ, তোমার সন্তান সাগরও আছে আমার আমার বুকের ভেতর, আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, আমার দৃষ্টির সীমানাজুড়ে। আমি তোমাকে পালিয়ে যেতে দেব না আকাশ। অফিস থেকে ফিরে জামা কাপড় ছেড়ে পূরোন অভ্যাসমত রিমোট হতে নিয়ে পাওয়ার বাটনে চাঁপ দিয়ে টেলিভিশন অন করতেই পর্দায় গেয়ে ওঠে তালাত মাহমুদ- আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, মনে পড়ে মোরে প্রিয়--- চাঁদ হয়ে রবো আকাশেরও গায় বাতায়নো খুলে দিও---- পাওয়ার বাটন চেঁপে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে গলাছেড়ে কান্না শুরু করলো। একা বাড়ি শুন্য ঘর এখানে গলা ছেড়ে কাঁদলেও শোনার কেউ নেই। এমনকি মরে পড়ে থাকলেও দু’চার দিনের আগে কেউ জানতে পারবে বলে মনে হয় না। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে সেটা সে নিজেও জানে না। দিনের আলো ফুটে উঠলে বাড়ির উঠোনের বকুল গাছের ডালে একটা অনাহারী কাক এসে তারস্বরে ডাকে। কাকের ডাকে নদীর ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু মাথাটা কোনভাবেই বালিশ থেকে উঠতে চাচ্ছে না। এদিকে আবার অফিস যেতে হবে। কাল রাতেও কিছু খাওয়া হয়নি পেট ক্ষুধায় চিনচিন করছে। রান্না ঘরও যেতে ইচ্ছে করছে না। একবার মনে হলো অফিসে যাওয়ার পথে দোকান থেকে একটা কিছু মুখে দিয়ে নেবে। কিন্তু এতো কিছুর পরও তো তাকে উঠতেই হবে বিছানা ছেড়ে। বাথরুম থেকে গোসল সেরে অফিসে যাওয়ার জন্য কাপড় খুঁজতে যেয়ে তার প্রিয় সন্তান সাগরের পরা সার্ট হাতে চলে আসে, অমনি দু’চোখ জলে ভিজে যায়। অনেকটা অযাচিত ভাবেই তার বুকের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে-হে আমার সৃষ্টিকর্তা আর কতো দুঃখ দিলে, আর কতোটা কষ্ট দিলে আমার প্রয়শ্চিত্ত হবে। স্বামী-সন্তান সবই তো কেড়ে নিলে, তবে আমাকে কেন বেঁচে রাখলে? আর কতোটা শাস্তি পেলে তুমি আমার অপরাধ ক্ষমিবে। আমাকে একটু স্বস্তি দাও, একটু শান্তি দাও, নইলে মৃত্যু দাও। আমি আর সইতে পাচ্ছিনা।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৬ জন


এ জাতীয় গল্প

→ তালেতে বেতাল

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now