বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
"শত্রু শেষ, যুদ্ধও শেষ, এখন থেকে শুরু
হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।"- কমান্ডার যখন
এই কথাটা বললেন আমি তখন বিশ্বজয়ের
খুশীতে আকাশের দিকে তাকালাম।
সূর্যটা তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।
আমার মনে হলো সূর্যটা আজ কিছুতেই
ডুবতে চাইছেনা। বহুযুগের লালিত স্বপ্ন,
কোটি বাঙালীর প্রাণের চাওয়া, আজকের
এই বিজয়ের আনন্দ সূর্যটাও আমাদের
সাথে ভাগ করে নিতে চাইছে। এ বিজয়
প্রতিটা বাঙালীর জন্য যে কতটা আনন্দের,
কত ত্যাগ, রক্ত আর জীবনের
বিনিময়ে অর্জিত সে কথা যেমন ইশ্বর
জানেন, জানে প্রতিটা বাঙালী আর
জানে পশ্চিম আকাশে ডুবতে বসা ঐ রক্তিম
সূর্যটাও। স্রষ্টার বিধানের কাছে নিজের
ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডুবে যাবার আগে তাই
সূর্যটা ওর সব রক্তিম আলো উজাড়
করে দিয়ে গেল চিরসবুজ এই বাঙলার বুকে।
সূর্যের রক্তিম আলো আর চিরসবুজ বাঙলার
কথা ভাবতেই আমার লাল-সবুজের এক
পতাকার কথা মনে পড়লো। যে পতাকার জন্য
আমরা এতদিন অধীর অপেক্ষায় ছিলাম।
যে পতাকার জন্য আমাদের
মধ্যে অনেকে জীবন দিয়েছে,
অনেকে সম্ভ্রম দিয়েছে। যার কাছে দেবার
মতো যা ছিল সবাই সবটা উজাড়
করে দিয়েছে। কেউ কোনা কৃপণতা করেনি।
আজ মা-বাবা, আর আমার ছোট বোন মায়ার
কথা খুব মনে পড়ছে, সেই
সাথে মনে পড়ছে নীলুর কথা। নীলু, আমার
ভালবাসা, আমার সব স্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য
একটা অংশ। চৈত্রের এক
মায়ামাখা বিকেলে নীলুর হাতে হাত
রেখে কথা দিয়েছিলাম ওর জন্য
একটা স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে তবেই
বাড়ী ফিরবো।
আজ আমার হাতে যুদ্ধে জয়
করা একটা স্বাধীন দেশের পতাকা আছে।
বাবা-মা, মায়া আর
নীলুকে নিয়ে সুখে কাটাবার
মতো একটা জীবনও আছে। তবে আর
অপেক্ষা কিসের? আমি এখনই বাড়ী যাবো।
কতদিন পরে দেখা হবে সবার সাথে। কত
কথা জমে আছে বলার জন্য।
আমি কমান্ডারের কাছে অস্ত্র জমা দিলাম।
দলের সবার সাথে জড়িয়ে নিলাম আমার
বুকটাকে। গত আট মাস
আমরা একসাথে ছিলাম রণাঙনে। কত রক্ত,
কত যন্ত্রণা সহ্য করেছে আমাদের এই বুক।
আজকে খুব মনে পড়ছে শরীফ ভাই, আজমল ভাই,
শুভঙ্কর দা, রফিক, আসলাম আর আরিফকে।
আরিফ। আরিফ হোসেন শান্ত। আমার
সবচাইতে ভালো বন্ধু। সেই ক্লাস
থ্রি থেকে আমরা একসাথে পড়েছি।
বাড়ীতে কাউকে কিছু না জানিয়ে দুজনেই
একসাথে যুদ্ধে এসেছিলাম।
আজকে একা ফিরবো ভাবতেই চোখটা কটমট
করে উঠলো। আরিফের কথা জিজ্ঞেস
করলে কী জবাব দেবো আছিয়া খালা আর
নীলুকে? কীভাবে বলবো আরিফের না ফেরার
দেশে যাওয়ার গল্পটা? কোন মায়ের
কাছে তার ছেলের মৃত্যুর কথা বলা পৃথিবীর
কষ্টকর কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। হিংসার
শাস্তি স্বরুপ এই কষ্টটুকু আমার করতেই
হবে। খুব কাছের কোনা বন্ধু নিজের
চেয়ে সবকিছুতে ভালো হলে মনে একপ্রকার
হিংসা জন্ম নেয়। আরিফের উপরও আমার
এমন একপ্রকার হিংসা আছে। পরীক্ষায়
কখনোই ওর চেয়ে বেশী নম্বর না পাওয়ার
হিংসা, কখনোই ওর মতো ভালো ফুটবল
খেলতে না পারার হিংসা আর যুদ্ধের সময়
ওর মতো শত্রুর গুলি মাথায় বিঁধিয়ে শহীদ
না হতে পারার হিংসা। হিংসা নাকি পতন
আনে। অন্য যে কোন কারনে আমার পতন হলেও
হতে পারে। কিন্তু এই হিংসার
কারনে আমার পতন হবেনা কারন এ
হিংসা যে ভালবাসার হিংসা।
একদিকে বিজয়ের আনন্দ আর অন্যদিকে বন্ধু-
স্বজন হারানোর বেদনা। এমনই এক মিশ্র
পরিস্থিতির মধ্যে আমি বাড়ীর
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার
তাড়াহুড়ো দেখে কমান্ডার
এবং সহযোদ্ধারা সবাই হাসলো। আমিও
হাসলাম, এ হাসির কোন অর্থ নেই। শুধুই
হাসির উত্তরে হাসা।
আমি হাটছি, আমার কপালে ভাজ
করে বাঁধা লাল সবুজের পতাকা। আজ
আমি কোনা যোদ্ধা নই, আজ আমি কারো শত্রুও
নই। আজ থেকে আবার আমি শুধুই আমার মা-
বাবার ছেলে, মায়ার দাদাভাই, আর নীলুর
ভালবাসার মানুষ।
আমি যখন গ্রামে পৌছালাম তখন ভর দুপুর।
এই শীতের দুপুরেও আমার খুব গরম লাগছে।
আমি মসজিদের পুকুর ঘাটে বসলাম। পুকুরের
পানিতে সূর্যের
প্রতিচ্ছবি দেখে আমি উপরের
দিকে তাকালাম। সূর্যের আলোটা এতটাই
তীক্ষ্ণ যে আমি বেশীক্ষণ
তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কাল নিয়মের
বাইরে যেতে পারেনি তাই আজ নিয়মের
মধ্যে থেকেই
জ্বলজ্বলে আলো ছড়াচ্ছে সূর্যটা। ওর সমস্ত
আলো দিয়ে দুর করছে সব অন্ধকার, ওর তাপ
দিয়ে শুকিয়ে দিচ্ছে বাঙালীর চোখের জল
আর রক্তের দাগ। পুড়িয়ে দিচ্ছে সব দুঃখঃ-
বেদনা, কষ্ট-যন্ত্রণা।
আমাদের গ্রামের মসজিদে জোহরের আজান
হচ্ছে। আমি শুনছি আর ভাবছি আমাদের
হুজুরের খালি গলার আজানের আওয়াজ
এতো দুর পর্যন্ত আসছে কিভাবে?
আমি মসজিদের সামনে এগিয়ে গেলাম।
আজান দিচ্ছেন আমাদের নুরুন্নবী ভাই।
আমি ওখানে আর দাঁড়ালাম না।
এগিয়ে চললাম বাড়ীর দিকে।
গ্রামটা অনেক পাল্টে গেছে, সবকিছুই
এলোমেলো। পথে দেখা হল সফুরা খালা,
আজমত চাচা, মান্নান চাচা আর হাবিবের
সাথে।
-চাচা কেমন আছেন? এই দেখেন
পতাকা নিয়া আসছি। স্বাধীন দেশের
পতাকা। বাংলাদেশের পতাকা।
আজমত চাচা কিছুই বললেন না। সফুরা খালা,
মান্নান চাচাও কিছু বললেন না।
আমি হাবিবকে বললাম- কিরে হাবিব
পতাকা নিবি? হাবিব হ্যা সূচক
মাথা নাড়লো। আমি বললাম-
তোকে বিকালে দেবো। সবার আগে এই
পতাকা দেবো মা'কে, তারপর নীলুকে। চল
আগে বাড়ী যাই, কতদিন সবাইকে দেখিনা।
আমি হাবিবের হাত ধরে হাটছি।
সফুরা খালা, আজমত চাচা আর মান্নান
চাচাও আমাদের পিছু পিছু আসছেন।
আমাদের ঘরের সব দরজাগুলো খোলা।
আমাদের কালো রঙের দুধের গাভীটা নেই,
উঠোনজুড়ে ঘুরতে থাকা হাঁস-মুরগী গুলোও
নেই। আমি মা'কে ডাকলাম,
মায়াকে ডাকলাম কেউ আসলো না ঘরের
ভেতর থেকে। আমি ঘরে ঢুকলাম। ঘরে কেউ
নেই।
আমি বাইরে বেরিয়ে সফুরা খালাকে বললাম
- খালা ঘরের সবাই কোথায় গেছে?
সফুরা খালা কিছুই বলছেন না।
উনি কাঁদছেন। এটা শুধু কান্না নয়,
এটা আর্তনাদ। ওনার কান্না দেখে আমারও
খুব কান্না পাচ্ছে। মান্নান
চাচা এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত
রাখলেন। তারপর শোনালেন সেদিনের সেই
বর্বরতার কথা।
আমরা যুদ্ধে গেছি জেনে আমাদের
পরিবারের ওপর চালানো অমানুষিক
নির্যাতনের কথা, মা-বাবার মৃত্যুর কথা।
মায়া, নীলু আর সবুজ ভাইয়ের বৌকে অবিরাম
ধর্ষণ করে স্কুল মাঠে উলঙ্গ ঝুলিয়ে রাখার
কথা। গ্রামের অনেক মানুষের জীবন, সম্পদ
আর সম্ভ্রম হারানোর কথা।
সবাই কাঁদছেন। আমারও খুব
কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
আমি কাঁদতে পারছিনা। চোখের সামনে এত
অস্ত্র, এত রক্ত, এত মৃত্যু
দেখতে দেখতে কেমন যেন পাথর
হয়ে গেছে মনটা। আমার
ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। যে পতাকার জন্য,
যে স্বাধীনতার জন্য এত যুদ্ধ, এত সংগ্রাম,
এত ত্যাগ সেই স্বাধীনতা আজ আমার
কাছে পরাধীনতার চেয়েও ভয়ংকর।
হাবিবকে নিয়ে আমি আরিফের মা'র
কাছে গেলাম। সম্ভ্রম
হারিয়ে মারা যাওয়া এক মেয়ের "পাগল"
মায়ের কাছে তার শহীদ হওয়া ছেলের খবর
জানাতে আর সাহস পেলাম না। আমার
এতোদিনের স্বপ্নের
পতাকা আমি তুলে দিলাম হাবিবের হাতে।
ওদের জন্যই এই পতাকা, ওদের জন্যই থাক
এই স্বাধীনতা। আমরা যারা যুদ্ধ
করেছি আমাদের জন্য যুদ্ধের ঐ স্মৃতিটুকুই
জমানো থাকুক মনের ভেতর।
আমি অজানা গন্তব্যের দিকে পা বাড়ানোর
আগে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের
দিকে তাকিয়ে আমার নিজেকে সত্যিকারের
মুক্ত মানুষ মনে হলো। আমি একজন এতোটাই
মুক্ত মানুষ যার কোনো পিছুটান নেই।
আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।
এমনকি নিজেকে খুন ও করতে পারি!
নিজেকে খুন করার কথাটা ভাবতেই আমার
কেমন যেন ভয় লাগলো। অন্যকে খুন
করতে সাহস লাগে। সে সাহস আমার আছে।
গত আট মাসে আমি অনেক
মানষরুপী পশুকে মেরেছি। কিন্তু
নিজেকে খুন করার মতো একটু সাহসও আমার
নেই। আমি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম-
তাহলে আমি এখন কী করবো?
আমার ভেতর মানুষটা উত্তর
দিলো -"তুমি আবার যুদ্ধ করো। নিজের জন্য,
অন্যদের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য।"
আমি বললাম- আমি যে খুব ক্লান্ত, আমার আর
যুদ্ধ করার শক্তি নেই। এই যুদ্ধ জয়
করে আমি নিজের কাছেই হেরে গেছি।
যে নিজের কাছেই হেরে যায়
সে অন্যকে হারাবে কীভাবে?
-"সব যুদ্ধ জয়-পরাজয়ের জন্য নয়, কিছু যুদ্ধ
স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্যও করতে হয়।
যে যুদ্ধ জয়ের পরেও নিজেকে পরাধীন
মনে করে তার যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না।
যে স্বার্থপর তার কখনোই মুক্তি আসেনা।"
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now