বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

রক্তাক্ত বাংলা

"যুদ্ধের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X "রক্তাক্ত বাংলা" . . উঠোনে পাতানো জলচৌকিতে বসে কথা বলতে থাকা ঐ লোকটির দিকে বার বার ফিরে তাকাচ্ছে রাবেয়া। কারন লোকটি হল রাবেয়ার হবু স্বামী। যার সাথে অনেক দিন আগেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে আছে রাবেয়ার। কিন্তু এলাকার পরিস্থিতি তেমন সুবিধার নয় বলেই বিয়েটা এখনও লটকে আছে। রাবেয়া হল মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। সেই ছোট্ট বেলাতেই তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে মাস্টার মশাই নিজেই কোলে পিঠে করে বড় করে রাবেয়াকে। যাইহোক, রাবেয়া পানির পাত্রটা উঠোনে তাদের কাছে রেখে এসে আবারও ঘরে চলে গেল। তারপর ঘরের জানালা খুলে উঠোনের দিকে উকি মেরে তাকিয়ে রইল রাবেয়া। প্রথম যেদিন লোকটির সাথে কথা হয়েছিল সেদিন মনের ভিতর কেমন একটা লজ্জা কাজ করছিল রাবেয়ার। কিন্তু এই ক'দিনের কথা বার্তার পর সে নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছে। তবুও লোকটির মুখের দিকে তাকালে কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে তার। হয়ত এরকম অনুভূতি কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রত্যেকটা নারীর জীবনেই আসে। ঠিক যেন রাবেয়ার জীবনেও এসেছে সেই সময়টা। সেও মনে মনে একটা ছোট্ট সুখের সংসার সাঁজিয়েছে অচেনা অজানা ঐ লোকটাকে ঘীরে। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়, রাবেয়ারও খুব পছন্দ তাকে। আর শিক্ষিত ছেলে বলেই মাস্টার মশাই তার মেয়েকে এই লোকটির সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। তাছাড়া অনেক বয়স হয়েছে তার। কখন কি হয়ে যায় তা বলা বড় মুশকিল। তাই তো শুভ কাজটা খুব শিঘ্রই সেরে ফেলতে চেয়েছিল মাস্টার মশাই। কিন্তু দেশের যা অবস্থা তাতে কিছুই করা সম্ভব হল না। . যাইহোক, হঠাৎ মাস্টার মশাই রাবেয়াকে ডাকলেন। তারপর রাবেয়া কাছে আসলে তাকে বলল, --মা তোরা কথা বল আমি একটু পুকুর ঘাট থেকে আসছি। --আচ্ছা বাবা সাবধাণে যেও। --হুম... . তারপর মাস্টার মশাই চলে গেলেন। ঐদিকে উঠোনে বসে আছে রাবেয়া ও আসাদ। হ্যা তার নাম আসাদ। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে খোলা উঠোনে পাতানো জলচৌকিতে মুখোমুখি বসে আছে তারা। রাবেয়া মাথা নিচু করে আছে তার সামনে। আসাদের পরিবারে তেমন কেউ নেই। আসাদ শহর থেকে পড়ালেখা করে আবারও গ্রামেই ফিরে এসেছেন নিজের পৈতৃক ভিটে বাড়িতে। রাবেয়াও অন্য আর দশটা গ্রাম্য মেয়ের মত নয়! অনেক চঞ্চল, চটপটে আর শিক্ষিতা মেয়ে। এজন্যই খুব সহজে আসাদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সে। তবুও বিয়ের আগে এভাবে আসাদের সামনে যেতে কেমন একটা লজ্জা কাজ করছিল তার। কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে সব কিছু নিয়ে একটা আন্ডাস্ট্যান্ডিং হওয়া দোষের কিছু নয়। তাই টুকটাক কথা বার্তার প্রচলণ তখন থেকেই শুরু হয় তাদের মধ্যে। যদিও এটা সেই একাত্তরের দেশ স্বাধীনের পূর্ব মূহুর্তের কথা! তখনকার গ্রাম্য মেয়েরা পর পুরুষ দেখলে আচলে মুখ লুকিয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু তাদের বিয়ে ঠিক হওয়াতে তারা মোটামুটি কথা বার্তা আর দেখা সাক্ষাত করতো। আসলে দেশের অবস্থা ততটা ভাল নয় বলেই এই বিয়েটা এখনও ঝুলে আছে। যা হোক, হঠাৎ আসাদ বলে উঠল- . --বাবা কি কিছু বলছে? --নাহ তো! কোন ব্যাপারে? --আমি যুদ্ধে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে, সেই ব্যাপারে..... . মুক্তিযুদ্ধের কথাটি শুনেই হঠাৎ কেঁপে উঠল রাবেয়া। এবার সে মাথা উঁচু করে আসাদের মুখের দিকে তাকালো। আসাদ খেয়াল করল রাবেয়ার চোখ জোড়া কেমন যেন আতঙ্কে ছেয়ে গেছে। ভয়ে যেন হ্রাস করে ফেলছিল রাবেয়াকে। হাসি খুশি ভরা মুখটা নিমিষেই কেমন যেন মলিন হয়ে গেল তার। আসাদ রাবেয়ার হাতে হাত রাখলেন। তাকে অভয় দিয়ে হাত জোড়া চেপে ধরে বললেন, --দেশের যা অবস্থা তাতে মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে আর কোন উপায় নেই। তুমি ভয় পেও না। দেখো আমার কিচ্ছু হবে না। শুধু দোয়া করিও আর তুমিও খুব সাবধাণে থেকো। . রাবেয়া কোন কথা বলল না। শুধু টলমলে চোখ জোড়া আসাদের দিকে নিক্ষেপ করল আর মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরল। আসাদ খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে এই ইঙ্গিতের মানে কি! কিন্তু তার কিছুই করার নেই, যেতে যে তাকে হবেই! দেশকে যে স্বাধীন করতেই হবে ঐ পাকিস্তানিদের হাত থেকে। তাই আসাদ একদম তৈরী হয়েই এসেছে। চাদরে ঢাকা অস্ত্রটাও সাথে করে নিয়েই বেরিয়েছে সে। কিন্তু এখানে এসেছে রাবেয়াকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু আর বেশিক্ষন হয়ত থাকা যাবেনা। কারন, এলাকায় রাজাকারের প্রভাব বেড়ে গেছে। তারা দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই আসাদ তরিঘরি করে রাবেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিতে লাগল। . নিত্য দিনের মত রাবেয়াকে ঘরের ভিতর রেখে বাহিরে থেকে দরজায় তালা মারা হল। যেন বাহিরে থেকে কেউ দেখলে বুঝতে না পারে যে, ভিতরে কোন মানুষ আছে। হ্যা দেশে যুদ্ধ লাগার পর থেকেই মাস্টার মশাই তার মেয়েকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখে। চঞ্চল চটপটে ভরা যৌবনা মেয়েটিকে থাকতে হয় গৃহবন্দি হয়ে। কারন, বলা তো যায়না কখন রাজাকারের বদ নজর পরে আর সাথে সাথে মিলিটারিরা এসে মেয়ের স্বতীত্বের উপর ঝাপিয়ে পরে। প্রতিটা দিন আর প্রতিটা মূহুর্ত তাদেরকে খুব সতর্ক হয়ে চলতে হয়। তাই রাবেয়াও ঘর থেকে কোথাও বের হয়না কারও চোখে পরার ভয়ে। এভাবেই গৃহবন্দি হয়ে একের পর এক কেটে যাচ্ছে রাবেয়ার দিন। তবুও মনের গহীনে আসাদকে ঘীরে অনেক স্বপ্ন জমিয়েছে সে। কিন্তু খুব ভয় হয়। আল্লাহ না করুক, যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে তো আশা ভরসা আর স্বপ্ন সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে তার। . যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে কাজল কালো চোখ দুটি ভিজে গেল তা আর খেয়াল নেই রাবেয়ার। আজ রাবেয়া খুব সেঁজেছিল। চোখে কাজল, মাথায় খোপা! হাতে চুড়ি, পরনে শাড়ী! গলায় মালা, পায়ে নূপুর! অবশ্য আহাময়ী কোন সাঁজ নয়, কিন্তু চেহারায় একটা অন্যরকম মায়াবী ছাপ রয়েছে তার। রাবেয়া জানালার কপাট ধরে আসাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আসাদও জানার বাহিরে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রাবেয়ার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে। আসাদ তার একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে আবারও চেপে ধরল। এভাবে কিছুক্ষন একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই উভয়ের চোখ জোড়া যেন ভিজে যাচ্ছিল। আসাদের মোটেও ইচ্ছা করছিল না রাবেয়ার নরম হাতখানা ছেড়ে দিতে। কিন্তু তার যে আর সময় নেই। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্বেও আস্তে আস্তে রাবেয়ার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল আসাদ। তারপর আবারও রাবেয়াকে সাবধানে থাকার আহব্বান জানিয়ে আসাদ এবার পিছে ফিরে চলে যেতে লাগল। ঐদিকে রাবেয়া এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল আসাদের গমন পথের দিকে। আসাদ চলতি পথে বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল রাবেয়ার দিকে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেল আসাদ। তারপর রাবেয়াও নিত্য দিনের মত বদ্ধ ঘরের জানালাটাও বন্ধ করে দিল। . সেদিনের মত এভাবেই কেটে গেল দিনটি। কিন্তু তারপর থেকেই চারিদিকে শুরু হল যুদ্ধের সেই ভয়ংকর গোলাগুলির গর্জন। একাত্তরের এই স্বসস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য অসংখ্য বাঙ্গালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছে। মা- বোনেরা হারিয়েছে ইজ্জত। পাকিস্তানি মিলিটারিদের এই হানাহানি আর মারামারি একাধারে লেগে ছিল দীর্ঘ নয়টি মাস। যার প্রতিটি মূহুর্ত ছিল চরম ভয়াবহ ও হৃদহর্ষক। চারিদিক কম্পিত হচ্ছে বুক ফাটা আর্তনাদে। আপন জন হারানোর বেদনায় হাহাকার করে উঠল সমস্ত বাঙ্গালি। পিতা হারাল কেউ, সন্তান হারাল কেউ! কেউ বা হারাল স্বতীত্ব। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হল বাংলায় স্বাধীনতার স্বার্বভৌমত্ব। ঠিক সেরকমই একটি ভয়াবহ মূহুর্ত এসে রাবেয়ার জীবনেও উপস্থিত হয়েছে। সময়টা ছিল একাত্তরের সেই কালো রাতের ঘটনা! যখন তার জীবনের সব কিছু নষ্ট করে দিয়েছিল ঐ পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীরা। হারিয়ে যায় জীবনের স্বপ্ন, আশা, ভরসা সহ মূল্যবাণ সব কিছু। . নিত্য দিনের বাহিরের দিক থেকে দরজায় তালা দেয়া ছিল মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে। আর বৃদ্ধ মাস্টার মশাই কখনও উঠোনে পাতানো জলচৌকিতে আবার কখনও বা বারান্দায় রাত্রি যাপন করতো। প্রতিদিনের মত সেদিনও ঠিক উঠোনের এসে গা এলিয়ে দিল সারাদিনের ক্লান্ত মাস্টার মশাই। কিন্তু মাঝ রাতে হঠাৎ কারও আগমনের শব্দ শুনে তরিঘরি করে ঘুম থেকে উঠলেন তিনি। দেখলেন প্রায় পাঁচ/সাত জন মিলিটারি এসে উঠোনে দাঁড়ালেন। সাথে দুজন দাড়ি টুপি ওয়ালা রাজাকার সদস্য। তাদের মধ্যে একজন মিলিটারি হঠাৎ মাস্টার মশাইকে জিজ্ঞাস করলেন- "মাস্টার সাহাব তুমহারা লারকি কাহা হ্যায়?" কিন্তু মাস্টার মশাই কিছু বলার আগেই একজন রাজাকার বলে উঠলেন- "আইয়্যে বাবুজি ইধার মে আইয়্যে, এ ঘরপে মিলেগি ও লারকি"। কথাটি বলেই ঐ রাজাকার মিলিটারিদেরকে মাস্টার মশাইয়ের ঘরের দরজার কাছে নিয়ে গেল। ঐদিকে মাস্টার মশাই কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজন মিলিটারি তাদের অস্ত্রের আঘাতে ঘরের তালা ভাঙ্গতে শুরু করল। মাস্টার মশাই দৌড়ে এসে মিলিটারিদের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলনা। কারন, ঐ রাজাকাররা মিলিটারিদেরকে আগেই বলে দিয়েছে তার মেয়েকে ঘরের ভিতরে তালা মেরে লুকিয়ে রাখা হয়। তাই মিলিটারিরা বৃদ্ধ মাস্টার মশাইকে সজোড়ে লাথি মেরে উঠোনের উপর ফেলে দিলেন। . ঐ মূহুর্তে মিলিটারিদের মাথায় তীব্র ভাবে নারী লালসা কাজ করছিল। তাই দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে ঝাপিয়ে পরল রাবেয়ার পুষ্ট দেহের উপর। তারা একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছিল অমানুষিক নির্যাতন। ঐ মূহুর্তে রাবেয়াও কষ্টে আত্নচিৎকার দিতে লাগল কিন্তু কোন লাভ হল না। পাষান্ড ঐ নরপিচাশেরা শেষ পর্যন্ত রেহাই দেয়নি রাবেয়াকেও। ঐদিকে বাহিরে থেকে মাস্টার মশাইও চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল আর করুন কন্ঠে বলতে লাগল "তোমরা আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও" . কিন্তু কে শুনে কার কথা! মাস্টার মশাইয়ের এই বুক ফাটা চিৎকার কারো কার্ণপাত হল না। হঠাৎ একটা গুলির শব্দে মিলিটারিরা চিরদিনের মত বন্ধ করে দিল মাস্টার মশাইয়ের এই আত্নচিৎকার। চারিদিক হয়ে গেল স্তব্ধ। মাস্টার মশাইয়ের রক্ত মাখা দেহটাকে উঠোনের মাঝে ছুরে ফেলে দিল তারা। তারপর মনের আয়েশ মিটিয়ে একের পর এক তাদের যৌন ক্ষুধা মিটাতে লাগল রাবেয়ার উপর দিয়ে। ঐদিকে রাবেয়াও অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগল। তারও বুক ফাটা আর্তনাদ ঐ নরপিচাশদের কানে পৌছাল না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল রাবেয়া। কোন রকম দেহের মধ্যে প্রাণটা ঝুলে থাকা অর্ধনগ্ন রাবেয়াকে বিছানার উপরেই ফেলে রেখে চলে গেল ঐ হিংস্র নরপশু মিলিটারিরা। অতঃপর ভোর হলো! গাছে গাছে পাখিরা কিচিরমিচির করতে লাগল! সকালের রুপালী সূর্য উদিত হলো! আর রাবেয়ারও জ্ঞান ফিরে এলো। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রনায় নিস্তেজ দেহখানা বিছানার উপরেই ছটফট করতে লাগল। . এভাবেই সকাল পেরিয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাস্টার মশাইয়ের মৃত দেহ খানা উঠোনের উপরেই রক্তাক্ত অবস্থায় পরে রইল। ঠিক এমন সময় হাপাতে হাপাতে দৌড়ে আসল আসাদ। কিন্তু কি লাভ তাতে? উঠোনে পরে থাকা মৃত দেহখানি কোলে নিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল সে। হঠাৎ তার মনে পরল মাস্টার মশাইয়ের সেই কথাটি, "বাবা তুমি আমার মেয়েকে দেখে রেখো"। দ্রুত আসাদ ঘরের দিকে দৃষ্টি ফিরালো। পাগলের মত ছুটে গেল ঘরের দিকে। ঘরের তালা ভাঙ্গা ছিল ঠিকই কিন্তু ভিতর থেকে দরজা লাগানো। আসাদ জানালা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটাও ভিতর থেকে লাগানো। এবার আসাদ জোড়েই চিৎকার দিয়ে উঠল আর করুন কন্ঠে রাবেয়ার নাম ধরে ডাকতে লাগল। দরজাটা খুলতে বলল রাবেয়াকে। একটি বার তার মুখ্খানি দেখার অনুরোধ জানালো আসাদ। কিন্তু কোন লাভ হলনা। কিছুক্ষন পর ভিতর থেকে রাবেয়ার গুনগুন কাঁন্নার আওয়াজ ভেসে উঠল। রাবেয়া হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল, --এই কলঙ্কিত মুখ তোমাকে দেখাতে পারবো না! যদি এই ইজ্জতের বদলা নিতে পারো, যদি এই হত্যার বিচার করতে পারো, যদি এই দেশকে স্বাধীন করতে পারো তবে সেদিন এসো, আমি দরজা খুলে দিব! নয়ত আর কোন দিন এই মুখ দেখতে চেও না। . চারিদিকে এত অত্যাচার, এত যন্ত্রনা, এত রক্তপাত! নাহ আর সহ্য করতে পারছিল না আসাদ। তার বুকে ভর করল এক অদম্য শক্তি। আপন জন হারানোর বেদনা আর চারিদিকে রক্তের বন্যা। সব কিছু মিলিয়ে তার মস্তিষ্ক আরও তীব্র বেগে গর্জে উঠল। সে অস্ত্র হাতে ছুটে গেল যুদ্ধের খোলা ময়দানে। স্বসস্ত্র যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরল পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে। যাকে বলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ! হ্যা হ্যা এই সেই মুক্তিযুদ্ধ! যে যুদ্ধের কথা পৃথিবীর বুকে চির স্বরণীয় হয়ে অনন্তকাল বেঁচে আছে। যে যুদ্ধে লাখো বাঙ্গালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। মা-বোনেরা হারিয়েছে ইজ্জত। রাবেয়ার মত অসংখ্য যুবতিরা ঐ নরপিচাশের হাতে হয়েছে যৌনাচারের স্বীকার। মাস্টার মশাইয়ের মত লাখো বাঙ্গালি অকারনে হারিয়েছে প্রাণ। মাঠে ঘাটে বনে জঙ্গলে অজস্র মুক্তিসেনা দেশের জন্য হয়েছে শহীদ। এই সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ! এই সেই বেদনা ভরাক্রান্ত সময়! এই সেই সংগ্রাম! এই সেই কৃষক, শ্রমিক ও তরুন মুক্তিযুদ্ধের জাগ্রত জয় ধ্বণি! যখন আসাদের মত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পরেছিল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে। যারা দীর্ঘ নয়টি মাস একের পর এক স্বসস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে অনেক প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছে এদেশের স্বাধীনতার স্বার্বভৌমত্ব। এই সেই বুক ফাটা আর্তনাদ! এই সেই কষ্টের হাহাকার! এই সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধো! আর এই সেই রক্তাক্ত বাংলা! . দীর্ঘ নয় মাস স্বসস্ত্র যুদ্ধের পর অনেক কষ্টে ফিরে এল এদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু ফিরে এল না অজস্র মুক্তিসেনা। যারা দেশের জন্য প্রাণ বলি দিয়েছে তারা আর ফিরে আসবে না, কখনই না! ঠিক তেমনি ভাবে আসাদও আর ফিরে এল না। আসাদ এই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। হয়ত শহীদ হয়ে আসাদের মত মুক্তিযোদ্ধারা পরোপারের ঠিকানায় খুব সুখেই আছে। কিন্তু রাবেয়ার মত মেয়েদের জীবনে নেমে এল চরম দূর্গতি। দেশ স্বাধীনের আজ প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। সবাই যে যার মত সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কলঙ্কের দাগ ঘুচলো না রাবেয়ার। সমাজের কাছে রাবেয়া আজ হয়ে উঠেছে ঘৃনিত আর কলঙ্কিত নারী হিসেবে। কারন, রাবেয়া একজন গর্ভবতী নারী। তার গর্ভে পাকিস্তানিদের রক্ত। রাবেয়া অনেক কষ্ট আর ত্যাগের পরেও তার গর্ভের ঐ নিষ্পাপ নবজাতককে পৃথিবীর মুখ দেখাতে চায়। এজন্য সমাজের মানুষের কাছে শত লাঞ্চনার স্বীকার হওয়ার পরেও সে তার গর্ভের বাচ্চাটি নষ্ট করেনি। . হঠাৎ একদিন মাঝ রাতে রাবেয়ার প্রসব যন্ত্রনা শুরু হয়। নাহ সেদিনও কেউ ছিলনা তার পাশে। অসহ্য যন্ত্রনা দাঁত চেপে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নিয়ে অবশেষে তার কোল জুড়ে আগমন হয় এক নিষ্পাপ নবজাতক সন্তানের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এত কষ্টের পরেও অবশেষে রাবেয়ার কোল জুড়ে এলো এক নিষ্পাপ মৃত সন্তান। হায় রে যন্ত্রনা! হায় রে লাঞ্চনা! হায় রে কষ্ট! সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটল আজ। কারন, গর্ভে থাকা অবস্থাতেই নিষ্পাপ বাচ্চাটি হয়ত বুঝতে পেরেছিল যে, দুনিয়ার বুকে চিরকাল তাকে পিতৃ পরিচয়হীন ভাবে বাঁচে হবে। তখনকার যন্ত্রনাটা হয়ত আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হতো। আর বাচ্চাটি হয়ত সেই কষ্টের ভার বহন করতে পারবেনা বলে গর্ভেই মরে গিয়েছে। অবশ্য এক হিসেবে ভালই হয়েছে। কারন, পৃথিবীর মানুষেরা তাকে এমনিতেও বাঁচতে দিতো না। প্রতিনিয়ত পিতৃ পরিচয়হীন এক জরোজ সন্তান হিসেবে পরিচয় পেতো হতো তাকে। যা হয়ত এখনকার চেয়ে আরও লক্ষ কোটি গুন বেশি যন্ত্রনাদায়ক হতো। তাই সে মরে গিয়েই হয়ত বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠ ভাবে বাঁচতে পারছে না রাবেয়ার মত মেয়েরা। এই সমাজ তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। এই সমাজের প্রতিটি মানুষ তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। . হায় রে মুক্তিযুদ্ধো! হায় রে স্বাধীনতা! এত কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে বাস করেও আজ রাবেয়ার মত অসংখ্য নারী পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। একদিন যারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি ছোট্ট সুখের সংসার সাঁজানোর, কিন্তু আজ তারাই এই পৃথিবীর বুকে হয়ে গেল অতি জঘন্য ও ঘৃনার পাত্র। তাদেরকেই এদেশের নিষ্ঠুর মানুষেরা প্রতিনিয়ত ঘৃনার চোখে দেখে। প্রতিটি মূহুর্ত তাদেরকে চরম অপমান আর লাঞ্চনা নিয়ে বাঁতে হয়। এটাই কি ছিল তবে এদেশের স্বাধীনতা? এজন্যই কি দিয়েয়েছিল লাখো প্রাণ বিসর্জন? এই কি ছিল তবে এত রক্ত ক্ষয়ের কারন? এই কি ছিল তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রধাণ উদ্দেশ্য? . জানা নেই! না না এর উত্তর কাহারই জানা নেই! জাতি আজ বাকরুদ্ধ! আজ তার বলিবার ভাষা নেই। কিছু করিবারও সাধ্য নেই। হায়ে রে স্বাধীনতা! হায় রে মুক্তিযুদ্ধো! হায় রে রক্তপাত! হায়ে রে রক্তাক্ত বাংলা! → → লেখাঃ মেহেদী হাসান শুভ


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৪৬ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now