বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

কোথাও কেউ নেই (২৩)

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান TARiN (০ পয়েন্ট)

X ২৩. বাকেরের বড় ভাই হাসান সাহেব বাকেরের বড় ভাই হাসান সাহেব ফাইন্যান্সের জয়েন্ট সেক্রেটারি লোকটি শান্ত প্রকৃতির। কখনো কোনো ব্যাপারে সামান্যতম উত্তেজনাও তার আচার-ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। অফিস শেষে সরাসরি বাসায় ফেরেন। দোতলা থেকে পারতপক্ষে নিচে নামেন না। মাঝে মাঝে বারান্দায় গম্ভীর মুখে বসে থাকেন। আজও তেমনি বসে ছিলেন। আজ তার মুখ শুধু গভীর নয় কিছুটা বিষগ্নও। বারান্দায় বসে থাকলে সাধারণত তার হাতে খবরের কাগজ কিংবা কোনো ম্যাগাজিন থাকে। আজ তাও নেই। তার ফর্সা গাল কিঞ্চিৎ লাল হয়ে আছে। আজ তাদের একটি নাটক দেখতে যাবার কথা। তিনি কিছুক্ষণ আগে সেলিনাকে জানিয়ে এসেছেন, তিনি যাবেন না। সেলিনা ব্লাউজ ইন্ত্রি করছিলেন। নাটকে যেতে হবে এই উপলক্ষেই শাড়ির রঙ মিলিয়ে ব্লাউজটি আজই কেনা হয়েছে। রঙ মিলছিল না। বহু ঝামেলা করে পাওয়া গেছে। তিনি কিছুক্ষণ আগেই ব্লাউজ ধুয়েছেন। ভেজা কাপড়টি এখন ইন্ত্রি করে করে শুকান হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে নাটকেই যাওয়া হবে না। তার স্বভাব-চরিত্র হাসান সাহেবের মত নয়। তিনি অল্পতেই রাগেন। আজও রাগলেন। রাগ প্রকাশ না করে বললেন, কেন যাবে না? হাসান সাহেব বিরস মুখে বললেন, যেতে ইচ্ছা করছে না। কেন ইচ্ছা করছে না। সকালেও তো বললে যাবে। আমি ইয়াসিনকে পাঠিয়ে টিকিট আনালাম। দুপুরে টেলিফোন জিজ্ঞেসও করলাম। তখনো বললে যাবে। শরীরটা ভাল লাগছে না। আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। আমার কাছে তো তোমার শরীর ভালই মনে হচ্ছে। হাসান সাহেব কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় চলে গেলেন। কাজের মেয়েটি চা নিয়ে এল। অন্য সময় সেলিনা চা নিয়ে আসতেন। তিনি চায়ে বেশি চিনি খান। কাজের মেয়েটির সেই আন্দাজ নেই। চায়ে চুমুক দিয়ে তাঁর মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। আজ অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে। সামান্য ঝামেলা নয় বড় রকমের ঝামেলা। এক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। সামরিকান্স সরকারের মন্ত্রী, এদের মেজাজ উঁচু তারে বাধা থাকে, সারাক্ষণই মনে করে তাদের যোগ্য সম্মান দেয়া হচ্ছে না। এই মন্ত্রীটি পান খেতে খেতে হাসান সাহেবের ঘরে ঢুকেই বললেন, এগারটার সময় আপনাকে দেখা করতে বলেছিলাম। হাসান সাহেব বিনীত ভাবে বললেন, আমি স্যার গিয়েছিলাম। আপনি ব্যস্ত ছিলেন। কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। ব্যস্ত তো থাকবই। এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে বসে ঠাণ্ডা বাতাস খাবার জন্যে তো মন্ত্রী হই নাই। অপেক্ষা করতে পারলেন না? আধঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। আধঘণ্টা অপেক্ষা করেই আপনার মাথায় ব্যথা হয়ে গেল। নিজের ঘরে তো বসেই থাকেন। কাজকর্ম তো কিছু করেন না। হাসান সাহেব শীতল গলায় বললেন, কাজকর্ম প্রসঙ্গে আপনি যা বলছেন তার জনো প্রয়োজনীয় তথ্য কি স্যার আপনার আছে? তথ্য? আপনি তথ্য কপচাচ্ছেন আমার সাথে। একজন মন্ত্রীকে আপনি কি মনে করেন? মন্ত্রীকে মন্ত্রীই মনে করি এর বেশি কিছু মনে করি না। আপনারা সিএসপি রা মিলে দেশটাকে নষ্ট করেছেন। এটা জানেন? না। স্যার আমার জানা ছিল না। দেশের কমন মানুষ আপনাদের ধারে কাছে যেতে পারে না। নিজেদেরকে আপনার একজন লাট-বেলাটি ভাবেন। আপনি এসব কি বলছেন? একজন মন্ত্রী আপনাকে কল দিয়েছে আপনি দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারেন না? আপনি কি জানেন চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর আমি আপনার চাকরি খেতে পারি? স্যার এটা আমার জানা ছিল না। মন্ত্রী কোনো কথা না বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল। ডেপুটি সেক্রেটারি। আমিনুল ইসলাম বললেন, আপনি স্যার চলে যান, ক্ষমা চেয়ে আসুন। ক্ষমা চাইলেই এরা পানি হয়ে যায়। হাসান সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ক্ষমা চাওয়ার মত কিছু হয়নি। সময় খারাপ স্যার। তা খারাপ। ঝামেলা টামেলা হতে পারে। আগে হোক। তারপর দেখা যাবে। বাকি সময়টায় অফিসের কোনো কাজে তার মন বসেনি। এখনো বসছে না। বারান্দায় বসে থেকে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সেলিনার সঙ্গে গল্পটল্প করলে ভাল লাগত। সেলিনার মেয়েলি গল্প শুনতে তার খারাপ লাগে না। সেলিনা আসবে না। তাকে রাগিয়ে দিয়েছেন। হাসান সাহেবের মনে হল নাটক দেখতে না যাওয়াটা অন্যায় হচ্ছে। আগে থেকে প্রোগ্রাম করা। প্রোগ্রাম ঠিক রাখা উচিত। জীবনযাত্ৰা ওলট-পালট করে ফেলবার মত কিছু হয়নি। তিনি সেলিনার ঘরে ঢুকলেন। হালকা গলায় বললেন, চল নাটক দেখে আসি। এখনো নিশ্চয়ই সময় আছে। তোমার শরীর সেরে গেল? হুঁ সেরেছে। এখন ভালই লাগছে। সাতটার সময় শুরু হবার কথা না? সাড়ে ছটা বাজে। আধঘণ্টা আছে এখনো। চট করে তৈরি হয়ে নাও। পারবে না? সেলিনা হাসিমুখে বললেন, পারব। তুমি কি ভাব দুতিন ঘণ্টা লাগিয়ে আমি সাজগোজ করি? সেলিনার মুখে রাগের চিহ্নও নেই। তার এই গুণটি হাসান সাহাবের খুব পছন্দ। রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। হাসান সাহেবের মনে হল তাদের দু’একটা ছেলেমেয়ে থাকলে মোটামুটি একটি সুখের সংসার হত। সেটা কখনো সম্ভব হবে না। বাকের জলিল মিয়ার চায্যের স্টলের বাইরে টুল পেতে বসে ছিল। ভাই এবং ভাবীকে আসতে দেখে সে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। যাতে চোখে না পড়ে। চোখে চোখ পড়লেই দেড় টাকা দামের সিগারেটটা ফেলে দিতে হবে। ভাইয়া হয়ত হাত ইশারা করে ডাকবে। কাছে গেলেই গম্ভীর মুখে বাণী-টানী দিবে। এরচে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকাই ভাল। সেলিনা বললেন, তোমার মাস্তান ভাইকে দেখেছ? হুঁ। সেও আমাদের দেখেছে, এখন এ রকম ভান করছে যেন দেখতে পায়নি। এটাই স্বাভাবিক। বাবার সঙ্গে আমার যখন দেখা হত। আমিও এ রকমই করতাম না। না। দেখার ভান করতাম। তোমার ভাই তোমার মতই হয়েছে, তাই বলতে চাও? হাসান সাহেব কোন কথা বললেন না। রাস্তার মোড়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কোথাও যাবার তাড়া থাকলে কখনো রিকশা পাওয়া যায় না। সেলিনা বললেন, তোমার গাড়ি কেনার কী হল? টাকা কোথায়? প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নেবে বলেছিলে? ব্যাংকেও তো কিছু আছে। দেখি। দেখাদেখি না। রোজ এমন রিকশা করে ঘোরাঘুরি করতে ভাল লাগে না। হাসান সাহেব চুপ করে রইলেন। একটা খালি রিকশা দ্রুতগতিতে আসছে। এর তাড়া দেখে মনে হয় না। এ থামবে। কিন্তু হাসান সাহেবকে অবাক করে দিয়ে রিকশা থামল। রিকশাওয়ালা গম্ভীর গলায় বলয়, উঠেন। আমরা বেলি রোডে যাব। যাবে তুমি? যেখানে কন হেইখানে যামু। আমারে পাঠাইছে বাকের ভাই। উঠেন। সারাপথ দু’জন কোনো কথা বললেন না। রিকশাওয়ালা অনবরত কথা বলে গেল। দশ টাকা সের চাইল কেমনে চলুম কন দেহি। ছয়জন খানেওয়ালা। বড় মাইয়ার বিয়া দেওন দরকার। ক্যামনে দিমুকন? রিকশার জমা হইছে আফনের চল্লিশ টাকা। টায়ার ফাটলে হেই খরচ আমার, শিক ভাঙলেও আমার। আহন কন দেহি ভাইজান ক্যামনে চলি? আপনে বিচার-বিবেচনা কইরা কন। হাসান সাহেব বিচার-বিবেচনা করে কিছুই বললেন না। পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যা ভাড়া তার ওপর গোটা পাঁচেক টাকা দিতে হবে বকশিস। লম্বা দুঃখের পাঁচালী শুনবার এটা হবে খেসারত। কিন্তু রিকশাওয়ালা কোন পয়সাই নিল না। চোখ কপালে তুলে বলল, না না ভাড়া দেওনের দরকার নাই। বাকের ভাই পাঠাইছে। সেলিনা তিক্ত গলায় বললেন, আর সাধাসাধি করতে হবে না। তোমার বিখ্যাত ভাই পাঠিয়েছে পয়সা সে নেবে কেন? দেরি হচ্ছে চলে আস। ঘণ্টা দিয়ে দিয়েছে। শুরুটা মিস করতে চাই না। বাকের সন্ধ্যা পর্যন্ত জলিল মিয়ার দোকানে বসে রইল। তার সঙ্গে আছে মাখন এবং কুদ্দুস। দু’জনই গাঁজা টেনে এসেছে। বিকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাখন কিছু-একটা নিয়ে চিস্তিত। সে কিছু বলছে না। কিন্তু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বলবে। সে দেরি করছে। কারণ তার বক্তব্য বাকেরের পছন্দ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। গাজা টেনে আসার কারণে কুন্দুসের গলা শুকিয়ে আছে। সে কিছুক্ষণ পর পর খুথু ফেলবার চেষ্টা করছে। থুথু আসছে না। জলিল মিয়া দোকানের কাজকর্মের ফাঁকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। এই টেবিলে। দিন দশেক আগে কোন রকম কারণ ছাড়াই কুদ্দুস এবং মাখনের মধ্যে এই চায়ের দোকানেই ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল। চারটা কাপ এবং দু’টা গ্লাস ভেঙেছে। একটা চেয়ারের পায়া ভেঙেছে। আজও লেগে যেতে পারে। তবে ভরসার কথা হচ্ছে বাকের ভাই আছে। তার সামনে এরা কিছু করতে সাহস পাবে না। জলিল মিয়া দাঁত বের করে বলল, বাকের ভাই, চা দিতে কাই? বাকের কিছু বলল না। মাখন বলল, সিগারেট আনান জলিল মিয়া। জলিল বিরসমুখে পাঁচটা টাকা বের করে সিগারেট আনতে পাঠাল। মাখন বলল, বাকের ভাই একটা কথা ছিল। কি কথা? প্রাইভেট কথা। বলে ফোল। মাখন গলা নিচু করে ফেলল। কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল, ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। সিদ্দিক সাহেবের রিকোয়েস্ট। ব্যাপারটা কি? ভাড়াটে উঠে না। ধানাই-পানাই করছে। এখন বলছে, উঠব না মামলা করে উঠাও। শালা, মামলার ভয় দেখায়। সিদ্দিক ভাই খুব রেগেছেন। আমাকে বললেন, তোমরা থাকতে এই অপমান! বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, এর মধ্যে অপমানের কী আছে? মামলা করতে বলছে মামলা করুক। বাকের ভাই, ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। আমরা থাকতে মামলা-মকদ্দমা কি? শালাকে একটু কড়াকে দিলে কালই বাসা ছেড়ে দিবে। সিদ্দিক সাহেবের কাছ থেকে কত নিয়েছিস? টাকা-পয়সার কোন ব্যাপার না। খাতিরে কাজটা করে দিচ্ছি। আর কি। খুব পিতলা খাতির জন্মাচ্ছিস ব্যাপারটা কি? ব্যাপার কিছু না। ব্যাপার আবার কি? উঠিয়ে দেই শালাকে। কি বলেন বাকের ভাই? বাকের কিছু বলল না। মনে মনে খুশিই হল। একটা কাজ করবার আগে এরা তাকে জিজ্ঞেস করছে। মান্যগণ্য করছে। তবে সিদ্দিক সাহেবের ব্যাপারটার বোঝা যাচ্ছে না। তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে যাচ্ছে। কয়েক’দিন আগে রাস্তায় দেখা হল এমন ভাব করল যে চিনতে পারছে না। কুদ্দুস বহু কষ্টে একদলা থুথু ফেলে বলল, পাঁচটা টাকা দেন বাকের ভাই। পকেট খালি। বাকের দশ টাকার নোট দিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। এখন বাজছে আটটা। সাধারণত আটটার দিকে কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িতে লোকজন আসে। আজও আসবে হয়ত। কারা আসছে লক্ষ্য রাখা দরকার। গেটের কাছে জোবেদ আলি দাঁড়িয়ে আছে। বাকেরকে দেখে সে আড়ালে সরে গোল বাকের উঁচু গলায় ডাকল, এই যে ভাই আছেন কেমন? ভাল। ঘর অন্ধকার কেন? লোকজন নাই? দাওয়াতে গেছে। দাওয়াত কোথায়? জানি না কোথায়? এত সব জিজ্ঞেস করেন কেন? এক পাড়ায় থাকি। খুঁজে-খবর নিতে হয়। নেন সিগারেট নেন। বাকের সিগারেটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে এল। জোবেদ আলি বলল–আমি সিগারেট খাই না। কথাটা সত্যি নয়। উটের মত মুখের এই লোকটিকে দেখেছি খেতে। ভাম কোথাকার! মাঝে-মধ্যে সিগারেট টানতে দেখি। জোবেদ আলি গম্ভীর হয়ে গেল। বাকের তার গভীর মুখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, মেয়েরা ভর্তি হয়েছে কলেজে? কি বললেন? মেয়েরা কলেজে ভর্তি হয়নি? আপনি বলছিলেন ভর্তি হবে। জানি না কিছু। বোধ হয় হয়নি। কোথাও তো যেতে-টোতে দেখি না। আচ্ছা ভাই যাই, বিরক্ত করলাম। খাবেন একটা সিগারেট? না। বাকের চলে গেল রিহার্সেল দেখতে। নাটকের নাম রাতের পাখিরা। নাম শুনেই মনে হচ্ছে বাজে মাল। টিপু সুলতানটা নামালে হয়, তা না। সামাজিক নাটক। টিপু সুলতানে অনেক শেখার জিনিস ছিল। দেখলে মনটা অন্য রকম হয়। তা না রুন্দিামাল রাতের পাখি। বাকেরকে দেখে একটা সাড়া পড়ে গেল। বাকের ভাইকে বসতে দে। চায়ের কথা বলে আয়। নাটকটির পরিচালকের নাম বদরুল আলম। বয়স চল্লিশেরর মতো। এই পাড়ায় যে কটি নাটক হয়েছে তার প্রতিটিতে সে পাগল কিংবা পাগলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে। এই একটি অভিনয় সে নিখুঁত করে। রাতের পাখিরা সে একটা চরিত্র আছে যে শুধু অমাবস্যার রাতে পাগল হয়ে যায়। পাগল হলেই পাগলামির ফাঁকে ফাঁকে সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে। উচ্চমার্গের ফিলসফি। বদরুল আলম নাটক বন্ধ রেখে বাকেরের কাছে এসে দাঁড়াল। গলা নামিয়ে বলল, আপনার সাথে একটা কথা ছিল। একটু বাইরে আসুন বাকের ভাই। কি ব্যাপার? জামান সাহেব আমাকে বলেছেন নাটক-ফাটক বাদ দিতে। কেন? তার দোকানের বিকিকিনির নাকি অসুবিধা হয়। অসুবিধা কি? আপনি ছাড়াও তো আরেকজন কর্মচারী আছে। এটাই একটু বলে দেবেন। দেব বলে দেব। নাটক হচ্ছে কেমন? ভাল। এক নম্বর; ফাসিক্লাস জিনিস হবে বাকের ভাই। বদরুল আলমের চোখ চকচক করতে লাগল। নাটকের ব্যাপারে তার উৎসাহ সীমাহীন। আসুন বাকের ভাই, রিহার্সেল দেখুন। থার্ড সিনটা দেখাই আপনাকে। মারাত্মক সিন। না চলে যাই। চলে গেলে হবে না। থার্ড সিনটা দেখতেই হবে। থার্ড সিনে দরিদ্র স্কুল মাস্টার বাড়ি ফিরে দেখে তার ছোট মেয়ে মারা যাচ্ছে। সে ছুটে যায় ডাক্তারের খোঁজে। ডাক্তার একজনকে পাওযা যায়। কিন্তু সে ভিজিটের টাকা না নিয়ে যেতে রাজি না। মাস্টার বহু কাকুতি-মিনতি করল কোন লাভ হল না। সে আবার ফিরে গেল। ঘরে। চিৎকার করে বলল, কোথায় আমার নয়নের মণি। কেউ জবাব দিল না। কারণ নয়নের মণি মারা গেছে। মাস্টার চেঁচিয়ে বলতে লাগল? হায় টাকা, হায় রে টাকা। বাকের মুগ্ধ হয়ে গেল। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। গলা ভার ভার হয়ে গেল। দুঃখের সিন দেখলেই তার এ রকম হয়। চোখে পানি এসে যায়। নাটক দেখতে দেখতে তার ইচ্ছা! করছিল থাবড়া দিয়ে ডাক্তার হারামজাদাটার দাঁত ফেলে দিতো। শুয়োরের বাচ্চা। মানুষ মারা যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নাই। টাকা আর টাকা। দেশটার হচ্ছে কি? সে আবার কম্পাউন্ড ওয়ালা বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। বাড়ি অন্ধকার। শুধু সিঁড়ির বাতি জ্বলছে। এরা কখন ফেরে লক্ষ্য রাখা দরকার। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। মাথা ধরেছে। বাকের ভাই! বাকের চমকে তাকাল। ইউনুস মিয়া। সিগারেটের টাকা পায় বোধ হয়। নানান দিকে বাকি পরে গেছে। কি খবর ইউনুস মিয়া? সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে একজন ভাড়াটে যে থাকে তার জিনিসপত্র সব টেনে তুলে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। আমি কি করব? সিদ্দিক সাহেব। আর তার ভাড়াটে মামলার। তা তো ঠিকই। বাচ্চারা কান্নাটি করছে দেখে মনটা খারাপ হল। কথা কথায় মন খারাপ হলে সংসার চলে না। এই জিনিসটা মনে রাখবেন। আর শোনেন, আপনি টাকা-পয়সা কিছু পান নাকি? জি। সামনের মাসে দিব। এখন একটু অসুবিধা আছে। জি আচ্ছা ঐটা কোন ব্যাপার না। যখন ইচ্ছা দিবেন। বাকের ঘরের দিকে রওনা হল। রাত নটার মতো বাজে। খেয়ে-দোয়ে শুয়ে পড়তে হবে। শরীরটা জুত লাগছে না। আরেকটু দেরি কবে গেলে ভাল হত ভাই-ভাবীরা খেয়ে শুয়ে পড়ত। কারো মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকত না। এখন যাওয়া মানেই ভাবীর সামনে পড়ে যাওয়া। যদি তাদের খাওয়া না হয়ে থাকে তাহলে এক সঙ্গে খেতে হবে; ভাইয়া বসবে ঠিক তার সামনের চেয়ারটায়। একটি কথাও বলবে না। একবার তাকাবেও না। নিজেকে মনে হবে চোরের মত। গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইবে না। বারবার পানি খেতে হবে। বাকেরদের বাড়ির সামনের বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। বাকেরকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। বাকের তাকে চিনতে পারল না। ত্রিশ-পযত্ৰিশ বছরের রোগা কিছু মেয়েরা আসে প্রাযাই। যাদের মুখ দেখলেই মনে হয় এরা বাড়িতে প্রচুর ঝগড়া করে কর্কশ গলায় ছেলে।পুলেদের ধমকায। এবং এদের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। আপনি বাকের সাহেব? জি। আমি আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। কি ব্যাপার? আপনার ছেলেরা আমার ঘর থেকে জিনিসপত্র টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। আমার বড় মেয়েটার একশ তিন জ্বর। এদের বাবা বাসায্য নেই দেশের বাড়িতে গেছে। আপনি সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে থাকেন? জি। দুমাসের ভাড়া বাকি পড়েছে। ওব বাবা টাকার জন্যেই দেশের বাড়িতে গেছে। এর মধ্যে এই অবস্থা। চলুন যাই। দেখি কি ব্যাপার। আসুন আমার সাথে; কাঁদবেন না। কাঁদার কিছু নেই। আমি মাখন হারামজাদার দাঁত ভেঙে ফেলব। ভদ্রমহিলা এবার শব্দ করেই কাঁদতে লাগলেন। বাকের লক্ষ্য করল এঁর পায়ে স্যান্ডেল নেই। ঝামেলা শুরু হওয়া মাত্র ছুটে এসেছেন। বাকেরের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। সিদ্দিক সাহেবের বাসার সামনে বেশ কিছু লোকজন। ঘরের জিনিসপত্র সব বাইরে এন রাখা হয়েছে। অসুস্থ মেয়েটা একটা চেয়ারে চোখ বড় বড় করে বসে আছে। তার ছোট ভাইটা বসে আছে একটা ট্রাঙ্কের ওপর। ছোট ভাইটা নিঃশব্দে কাঁদছে। বাকের উঠোনে দাঁড়িয়ে শীতল গলায় ডাকল মাখনা। মাখন ভেতরে ছিল। অবাক হয়ে বের হয়ে এল। বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, মেয়েটা অসুস্থ। ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এর মধ্যে তুই নিজিসপত্র বের করে ফেললি? মাখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিক সাহেব তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নিচে নেমে এলেন। হড়বড় করে বললেন, দুই মাসের ভাড়া বাকি। আমি বলেছি দিতে হবে না। শুধু বাড়িটা ছেড়ে দাও। তাও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। জিনিসপত্র তো রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে না। বারান্দায় থাকবে। পাহারা থাকবে। ঘরটা শুধু তালা দিয়ে দিব। এদের পৌঁছে দিব এদের আত্মীয় বাড়ি; গাড়ি করে পৌঁছে দিব। আমি নিজের মুখে বলেছি। এই কথা। বাকের তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ। বাকের থমথমে গলায় বলল, মাখনা জিনিসপত্র ভেতরে নিয়ে যা। সিদ্দিক সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, জিনিসপুত্র ভেতরে নিবে মানে; মাগের মুলুক নাকি? সিদ্দিক সাহেব, সাবধানে কথা বলুন। সাবধানে কথা বলব মানে? ভূঁড়ি নামিয়ে ফেলব। একটা কিছু বেতাল হয় যদি লাশ পড়ে যাবে। আমার নাম বাকের। মাখনা, জিনিসপত্র ঢোকা। অতি দ্রুত জিনিসপত্র ভেতরে ঢুকে গেল। যারা দাঁড়িয়ে ছিল সবাই হাত লাগাল। মাখন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিল। বাকের এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা চড় বসাল। এই জাতীয় কাজকর্ম সে ছেড়েই দিয়েছিল। আবার শুরু করতে হল। কিছু কিছু জিনিস আছে যা একবার ধরলে কখনো ছাড়া যায় না। আঠার মত গায়ে লেগে থাকে। সিদ্দিক সাহেব হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাখন নিজেও তাকিয়ে আছে। শুধু কুদ্দুসকে দেখা যাচ্ছে ছোটোছুটি করে আলনা-টালনা ভেতরে নিয়ে যেতে। সিদ্দিক সাহেব মৃদু গলায় বললেন, বাকের আমার সঙ্গে ভেতরে আসা। কথা আছে। বাকের ফিরেও তাকাল না। অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। যেন কিছুই হয়নি। হাসান সাহেবদের ফিরতে বেশ রাত হল। দুজনে মিলে বাইরে খেয়ে নিলেন। অনেক’দিন পর তারা বাইরে খেতে এসেছেন। ইদানীং দুজনে একসঙ্গে তেমন কোথাও যান না। সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সেলিনার ধারণা এটা হয়েছে তার জন্যে। সংসারে শিশু না থাকলে সবাই দূরে দূরে চলে যায়। এটাই নিয়ম। সংসারে শিশু না আসার দায়িত্ব সেলিনার একার। বিয়ের পর পর টিউমারের কারণে তার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হাসান সাহেব এখন পর্যন্ত বলেননি, একটা বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ভাল হত। সেলিনার ধারণা এক’দিন না এক’দিন সে এই প্রসঙ্গ তুলবেই। কে জানে হয়ত আজই তুলবে। সেলিনা বললেন, কথা বলছি না কেন? কি ভািবছ? হাসান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, চাকরি ছেড়ে দিলে কেমন হয় সেলিনা? সেলিনা অবাক হয়ে তাকালেন। জাকরি ছাড়ার কথা বলছ কেন? হাসান সাহেব কিছু বললেন না। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তোকানোর এই ভঙ্গিটি সেলিনার চেনা। এর মানে হচ্ছে তিনি আর কিছুই বলবেন না। এই প্রসঙ্গে তো নয়ই। সেলিনা প্রসঙ্গ বদলালেন, নাটক কেমন লাগল? ভাল। কার অভিনয় সবচে ভাল লেগেছে? সবাই ভাল। তবু স্পেসিফিক্যালি দু’একজনের নাম বল। হাসান সাহেব। আবার ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তার মানে নাটকের কিছুই তার মাথায় ঢোকেনি। অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে ভেবেছেন. ব্যাপারটা কি? সেলিনার উদ্বেগের সীমা রইল না।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ১৭৯ জন


এ জাতীয় গল্প

→ কোথাও কেউ নেই (২৩)

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now