বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

দ্য কেস অব দ্য মিসিং মূল লেখক:আগাথা ক্রিস্টির

"রহস্য" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান আবিরুল ইসলাম আবির(guest) (০ পয়েন্ট)

X বিচিত্র এক সমস্যা নিয়ে হাজির হলো মিস ভায়োলেট মার্শ। আগের দিন চিঠি লিখে দেখা করার অনুমতি নিয়েছে বিখ্যাত গোয়েন্দা এবং আমার বন্ধু এরকুল পোয়ারোর কাছ থেকে। ঠিক ১১টায় দেখা করবে বলে কথা দিয়েছে পোয়ারো। আমিও পোয়ারোর সঙ্গে বসে আছি। আমার নাম হেস্টিংস। পোয়ারো আমাকে তার সহকারী বানিয়েছে। ঠিক সময়ে এসেছে মিস মার্শ। সুন্দরী। বয়স কম। ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক। চেহারা আর হাবভাবই বলে দিচ্ছে স্বাধীনচেতা। তথাকথিত এসব ‘আধুনিকা’দের পছন্দ করি না আমি, আর সে যদি সুন্দরী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কাজেই মেয়েটিকে দেখে তেমন খুশি হতে পারলাম না। ‘আমার কেসটা একটু অদ্ভুত, মসিয়ে পোয়ারো,’ একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল মিস মার্শ। ‘শুরু থেকেই বলি, কী বলেন?’ ‘আপনার যেভাবে ইচ্ছে, মাদমোয়াজেল*।’ ‘আমি এক এতিম। ডেভনশায়ারের এক সাধারণ কৃষক ছিল আমার দাদা। ছোট্ট তার খামার, খুব গরিব ছিল। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে, মানে আমার চাচা অ্যান্ড্রু, কিশোর বয়সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। পাড়ি জমিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। রক্তে চাষের নেশা, লেখাপড়া করেনি। ওখানে গিয়ে এক চাষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। নিজের বুদ্ধি আর পরিশ্রমের জোরে টাকাপয়সা কামিয়েছিল অনেক, ধনী হয়ে উঠেছিল চাষাবাদ করেই। তার ছোট ভাই আমার বাপ, চাষবাসের দিকে নজরই ছিল না। লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী হয়ে উঠল। সামান্য লেখাপড়া শিখে একটা ফার্মে কেরানির চাকরি নিল। বিয়ে করল তারই মতো দরিদ্র এক আর্টিস্টের মেয়েকে। আমার ছয় বছর বয়সে মারা গেল বাবা, চৌদ্দ বছর বয়সে মা। এই সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এল চাচা। ডেভনশায়ারে, নিজের জন্মস্থানে একটা বাড়ি কিনল। নাম রাখল ক্র্যাবট্রি ম্যানর। বিয়েথা করেনি, সন্তানসন্ততি নেই। আমাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল চাচা। নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতে লাগল।’ থেমে দম নিল মিস মার্শ। আবার শুরু করল, ‘ক্র্যাবট্রি ম্যানর, শুনলে প্রাসাদ বা দুর্গটুর্গ গোছের কিছু বলে মনে হয়। আসলে ওটা একটা ফার্ম হাউস। চাচার রক্তে মিশে আছে চাষের নেশা। টাকা আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে আধুনিক চাষাবাদে মন দিল চাচা। চাষের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগল। আমার প্রতি বড় সদয় ছিল চাচা, তবে মেয়েমানুষকে গড়ে তোলার ব্যাপারে তার নিজস্ব একটা মতামত ছিল। তার ধারণা, মেয়েরা লেখাপড়া শিখে কী করবে? তার চেয়ে ঘরের কাজ, রান্নাবান্না, ডেইরির কাজকর্ম শেখাটাই বেশি জরুরি। শুধু মেয়েরাই না, পুরুষদের ব্যাপারেও তার মতামত একই রকম। প্রায়ই বলত, বইয়ের বিদ্যা শিখে কোনো লাভ নেই। হাতেকলমে শেখাটাই আসল শেখা। আপনাদের বিরক্তি লাগছে?’ ‘বলে যান মাদমোয়াজেল,’ বলল পোয়ারো। ‘হ্যাঁ, মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ঘোর বিরোধী ছিলেন চাচা। ফলে আমার স্কুলে আসা-যাওয়াটাকে মোটেও ভালো চোখে দেখলেন না। স্কলারশিপ নিয়ে পাস করলাম, গোল বাধল যখন গার্টেনে যেতে চাইলাম আরও লেখাপড়া করতে। তুমুল তর্কবিতর্ক হলো, শেষ পর্যন্ত আমিই জিতলাম। মায়ের জমানো সামান্য যা সম্বল ছিল, তাই নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলাম বাড়ি থেকে, হাল ছেড়ে দিলেন চাচা। আর তর্ক করলেন না। এটা নয় বছর আগের ঘটনা। তারপর চাচার টাকায় হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম। বিএসসিতে ভালো রেজাল্টই করলাম। খবর শুনে কোনো রকম মন্তব্যই করলেন না চাচা। আগেই বলেছি, পুঁথিগত বিদ্যার কোনো দামই নেই তাঁর কাছে। আমি হোস্টেলেই রয়ে গেলাম। পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি তখনো। চাচার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল।’ এরপর কী বলেন শোনার অপেক্ষায় আছি। ‘এখানে কেন এসেছি, বলছি এবার,’ বলল মিস মার্শ। ‘মাস খানেক আগে আমার চাচা মারা গেছেন। একটা আজব উইল লিখে রেখে গেছেন। ক্র্যাবট্রি ম্যানরসহ তাঁর বিরাট সম্পত্তির মালিক হব আমি। তবে এক শর্তে। তাঁর লিখে যাওয়া উইলটা ক্র্যাবট্রি ম্যানরেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। চাচার মৃত্যুর পর এক বছরের মধ্যে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে ওটা। নইলে সব সম্পত্তি দান হিসেবে পাবে স্থানীয় হাসপাতাল। উকিলকে সে রকম নির্দেশই দেওয়া আছে।’ ‘আপনার প্রতি খুব সদয় ব্যবহার করেননি আপনার চাচা,’ মন্তব্য করল পোয়ারো। ‘আমি কিন্তু সেভাবে দেখছি না ব্যাপারটাকে। চাচার ইচ্ছেয় চলিনি আমি, নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি বরাবর। এটুকু সদয় যে হয়েছেন, সেটাই বেশি। অন্তত একটা সুযোগ তো দিয়েছেন আমাকে।’ ‘কোনো উকিলকে দিয়ে উইলটা লেখানো হয়েছে?’ ‘না। ছাপানো উইল-ফর্মে নিজের হাতে লিখেছেন চাচা। দুজন সাক্ষীকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছেন ফর্মে।’ ‘যত দূর জানি, এ ধরনের উইলকে আদালত ইচ্ছে করলে বাতিল করতে পারে। এক বছর পর আদালতে প্রতিবাদ জানাতে পারেন আপনি।’ ‘ও ধরনের কোনো কিছুতেই যাব না আমি।’ ‘তার মানে ব্যাপারটাকে চাচার বিরুদ্ধে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন?’ ‘ঠিক ধরেছেন।’ ‘কিন্তু এই উইলের ব্যাপারটা জানলেন কী করে?’ চিন্তিত দেখাচ্ছে পোয়ারোকে। ‘নিশ্চয় আপনার নামে চিঠি লিখে রেখে গেছেন আপনার চাচা, আর বছর খানেক চলার মতো টাকা?’ ‘হ্যাঁ। আপনি জানলেন কী করে?’ ‘অনুমান।’ ‘বুঝতে পারছি, ঠিক জায়গাতেই এসেছি, মসিয়ে পোয়ারো। অনুমানেই অনেক কিছু বুঝে ফেলার ক্ষমতা আপনার আছে।’ ‘ঠিকই বলেছেন।’ ‘আমাকে সাহায্য করবেন তো, মসিয়ে পোয়ারো?’ ‘করব। চমত্কার কেস। মগজের ধূসর কোষগুলোকে খাটাতে ভালোই লাগবে। তো, মাদমোয়াজেল, আপনি খোঁজাখুঁজি করেননি?’ ‘করেছি। চাচার তীক্ষ বুদ্ধির ওপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার, তবু চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হয়েছি এবং সেটাই স্বাভাবিক।’ ‘আপনাকে লিখে রেখে যাওয়া চিঠিটা আছে সঙ্গে? দেখাতে পারেন?’ হাতব্যাগ খুলে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে টেবিলে রেখে ঠেলে দিল মিস মার্শ। মন দিয়ে চিঠিটা পড়ল পোয়ারো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তিন বছর আগে লেখা। মার্চের ২৫ তারিখ। বেলা ১১টা। কাজ অনেকখানি কমে গেল আমার। চিঠি পড়েই বোঝা যাচ্ছে, ওই দিনই লেখা হয়েছে উইলটাও, সম্ভবত এই চিঠির আধা ঘণ্টা পরেই। ভালো এক সমস্যা নিয়ে এসেছেন মিস মার্শ। প্রচুর বুদ্ধির খেলা আছে। আনন্দই পাব কাজটা করে। আপনার চাচা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সন্দেহ নেই, তবে এরকুল পোয়ারোর ধূসর কোষগুলোর সঙ্গে তার তুলনা চলে না।’ আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার সহকারী। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। ওকে নিয়ে আজ রাতেই যাব ক্র্যাবট্রি ম্যানরে। কে কে আছে ও বাড়িতে?’ ‘বেকার ও তার স্ত্রী। বাড়ি দেখাশোনা করে। ব্যস, ওই দুজনই। আর কেউ নেই।’ সেদিন রাতেই ক্র্যাবট্রি ম্যানরে পৌঁছালাম আমরা। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বেকার দম্পতি। মিস মার্শের কাছ থেকে খবর পেয়েছে আমরা যাব। হাসিখুশি মাঝবয়সী এক দম্পতি। লম্বা, রোগাটে মিস্টার বেকার। বেগম তার ঠিক উল্টো। বেঁটে, মোটা। মুখে ডেভনশায়ারসুলভ প্রশান্তি। সারাটা দিনই প্রায় ট্রেনে কেটেছে। তারপর স্টেশন থেকে আট মাইল ঘোড়ার গাড়িতে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ক্ষুধার্তও। মুরগির রোস্ট, আপেল পাই আর প্রচুর ডেভনশায়ার-মাখন দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে সঙ্গে সঙ্গে শুতে গেলাম। ঝরঝরে শরীর নিয়ে ঘুম ভাঙল সকালে। নাশতা সারলাম মিসেস বেকারের তৈরি চমত্কার খাবার দিয়ে। তারপর শুরু হলো আসল কাজ। মিস্টার বেকার আমাদের সাজানো-গোছানো একটা ঘর দেখিয়ে দিল। মিস্টার অ্যান্ড্রু মার্শের শোয়ার ঘর ছিল এটা। সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। একদিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক টেবিল। চকচকে পলিশ করা। পরিপাটি করে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে কাগজপত্রের স্তূপ। টেবিলের সামনে রয়েছে বড় আর্ম-চেয়ার, চামড়ায় মোড়া গদি। উল্টো দিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে একটা লম্বা সোফা, ছিট কাপড়ের আচ্ছাদন দেওয়া। জানালায়ও একই কাপড়ের পর্দা। রং মলিন হয়ে এসেছে। সবকিছুই কেমন পুরোনো ধাঁচের। ‘এ ঘরে,’ খুদে সাইজের বিশেষ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল পোয়ারো, ‘এ ঘর থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। পুরো বাড়িটাই তো ঘুরলাম। আমার মনে হচ্ছে, এই ঘরটাতেই আছে যা খুঁজছি। কিন্তু কোথায়? ওই কাগজপত্রের স্তূপে নেই, এটা শিয়োর। ওখানে থাকলে পেয়ে যেত মিস মার্শ। তাহলে? কোথায়? এক কাজ করা যাক। আগে কিছু আলাপ-আলোচনা করে নিই। বেল বাজাও, ডাকো বেকারকে।’ বেল বাজালাম। বেকারের আসার অপেক্ষা করছি। পায়চারি শুরু করল পোয়ারো। তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখছে ঘরের জিনিসপত্র। আপন মনে বিড়বিড় করছে, ‘গোছানো স্বভাবের লোক। কেমন সাজিয়ে রেখেছে কাগজগুলো, ড্রয়ারের প্রতিটি চাবি ওপর থেকে পরপর ঝুলিয়ে রেখেছে। কোনটা কোন ড্রয়ারের চাবি অনুমান করা যায় সহজেই। দেয়ালে বসানো কেবিনেটের চাবিগুলোও রাখা হয়েছে একই কায়দায়। কেবিনেটের ভেতরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চিনামাটির জিনিসপত্র। নাহ্, হতাশই করল দেখছি। দেখে খটকা লাগে এমন কিছুই...’ হঠাত্ থেমে গেল পোয়ারো। বিরাট টেবিলের এক পাশের একটা ড্রয়ারের তালায় ঢোকানো আছে একটা চাবি। ময়লা ছোট একটা খাম আটকানো আছে চাবিটার সঙ্গে। এগিয়ে গিয়ে দ্রুত হাতে চাবিটা খুলে আনল পোয়ারো। মুখ খোলা খামের এক জায়গায় লেখা আছে: এই ড্রয়ারের চাবি। হাতের লেখা খুব খারাপ। কোনোরকমে পড়া যায়। খামের ভেতরে কোনো কাগজপত্র নেই।’ ‘এই ড্রয়ারে নেই উইলটা,’ ভুরু কুঁচকে বলল পোয়ারো। ‘তাহলে এভাবে চিহ্নিত করে রাখত না।’ এই সময় দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল বেকার। ‘দয়া করে আপনার ম্যাডামকে ডাকবেন?’ অনুরোধ করল পোয়ারো। ‘কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাই।’ চলে গেল বেকার। শিগগির ফিরে এল স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। অ্যাপ্রনে হাত মুছছে মিসেস। হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ। কী উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে এসেছি আমরা, অল্প কথায় জানিয়ে দিল পোয়ারো। বেকার দম্পতির সাহায্য দরকার, জানাল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল দম্পতি। ‘এই সম্পত্তি মিসেস মার্শেরই পাওয়া উচিত,’ রায় দিয়ে ফেলল মিসেস বেকার। ‘টাকা জোগাড়ের অনেক উপায় আছে হাসপাতালের। মিস্টার মার্শের টাকা না পেলেও চলবে।’ একের পর এক প্রশ্ন করে গেল পোয়ারো। হ্যাঁ, উইলটা দেখেছে বেকার দম্পতি। পড়েছে। ফর্ম এনে দিয়েছিল বেকারই। সাক্ষী হিসেবে দুজনেই সই দিয়েছে উইলে। ‘কখন সই দিয়েছেন? তখন কয়টা বাজে?’ জানতে চাইল পোয়ারো। মাথা চুলকাল বেকার। মনে করার চেষ্টা করছে। ‘আমি বলতে পারব। চুলায় দুধের পাতিল বসিয়েছি তখন।’ স্বামীর দিকে তাকাল মিসেস। ‘কেন, তুমি মনে করতে পারছ না? সই দিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি দুধ পুড়ে গেছে। পোড়া গন্ধ। ঢং ঢং করে ১১টা বাজল ঘড়িতে। পরিষ্কার মনে আছে আমার।’ ‘দিন না রাত?’ জানতে চাইল পোয়ারো। ‘দিন।’ ‘তারপর?’ ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল মালিক। গাঁয়ের কেমিস্টের দোকানে। টাকা বাকি পড়েছিল, ওটা শোধ করতে।’ পোয়ারো কী বুঝল কে জানে, আমি কোনো আশার আলো দেখতে পেলাম না। কী যেন ভাবল পোয়ারো। চাবিতে আটকানো খামের লেখাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হাতের লেখা আপনার মালিকের?’ ‘হ্যাঁ, স্যার,’ জবাব দিল বেকার। ‘আচ্ছা, গত তিন বছরে মিস মার্শ ছাড়া আর কে কে এসেছিল এ বাড়িতে?’ ‘কেউ না।’ ‘কেউ না?’ ‘না।’ ‘জিমের কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি,’ স্বামীকে মনে করিয়ে দিল মিসেস। ‘জিম?’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল পোয়ারো। ‘রাজমিস্ত্রি।’ আড়াই বছর আগে এসেছিল জিম, জানাল মিসেস বেকার। বাড়িতে ছোটখাটো কয়েকটা মেরামতের কাজ করেছিল। কী মেরামত, বলতে পারব না। মালিকের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাজ করেছিল। সে সময় ঘরে তার সঙ্গে ছিল মালিক। মালিকের পড়ার ঘরেও কাজ করেছে জিম। তা-ও দরজা বন্ধ করে। কোন কোম্পানিতে কাজ করে জিম, বলতে পারল না মিসেস বেকার। তবে তার ধারণা, প্লাইমাউথের কোনো একটা হাউস বিল্ডিং কোম্পানি হবে।’ ‘কাজ এগোচ্ছে, হেস্টিংস,’ আমাকে বলল পোয়ারো। বেকার দম্পতি বেরিয়ে গেলে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো, প্লাইমাউথে। জিমকে খুঁজে বের করতে হবে। ম্যানরের কোন কোন জায়গা মেরামত করেছে সে, মনে করতে পারবে হয়তো।’ বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। কোন কোম্পানিতে কাজ করে জিম, জানা গেল। জিমকেও পাওয়া গেল। ক্র্যাবট্রি ম্যানরে কোথায় কোথায় মেরামত করেছে সে, বলতে পারল। পড়ার ঘরের ফায়ার প্লেস ঠিক করেছে, এটার ওপরই জোর দিল জিম। মনে থাকার কারণ, একটা অদ্ভুত কাজ করিয়েছেন তাকে দিয়ে অ্যান্ড্রু মার্শ। ভালো ফায়ার প্লেসের ওপরের দিকের এক জায়গায় দুটো ইট খুলতে বলেছেন। জিম ইট খোলার পর বেরিয়ে যেতে বলেছেন কয়েক মিনিটের জন্য। মিনিট খানেক পর ফিরে এসে ইট দুটো আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে জিম। যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে বসানোর চেষ্টা করেছে। তবু ভালো করে লক্ষ করলে, ইট দুটো খোলা হয়েছিল বোঝা যাবেই। আর কিছু জানার নেই। আবার ক্র্যাবট্রি ম্যানরে ফিরে এলাম। কোন ইট দুটো খোলা হয়েছিল, ভালোমতো একবার পরীক্ষা করেই বের করে ফেলল পোয়ারো। এবার ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে কাজে লাগলাম আমি। বেশি কষ্ট করতে হলো না। খুলে আনলাম ইট দুটো। ভেতরে ছোট একটা ফোকর। আমার আগেই ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দিল পোয়ারো। কয়েক মুহূর্ত খোঁজাখুঁজি করল। পাল্টে যাচ্ছে মুখের ভাব। ধীরে ধীরে বের করে আনল হাতটা। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল হাতের দিকে। কালিঝুলি আর কাগজ পোড়া ছাই লেগে আছে হাতে। দুই আঙুলে টিপে ধরে রেখেছে ছোট এক টুকরো কাগজ। চারধারে পোড়া। বেকার দম্পতির সই আছে কাগজটাতে। ব্যস, ওটুকুই। উইলের বাকি অংশটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হতাশ হয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল পোয়ারো। ‘কেউ ধ্বংস করে ফেলেছে কাগজটা!’ তিক্ত শোনাল তার গলা। বললাম, ‘ফায়ার প্লেসের আগুনে পুড়েছে হয়তো।’ ‘ইট-সিমেন্টের গাঁথুনির ভেতর আগুন ঢুকল কী করে? আমাদের আগেই কেউ হাত দিয়েছিল ওখানটায়। কাগজটা বের করে পুড়িয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে উইলটা। কে?’ ‘বেকার দম্পতি?’ ‘মনে হয় না। সম্পত্তিটা হাসপাতাল পেয়ে গেলে ওদের কোনো লাভই নেই। বরং ভালো চাকরিটা হারাবে দুজনে। বাড়ি দেখাশোনার জন্য নিশ্চয় ওদের রাখবে না হাসপাতাল।’ ‘তাহলে হয়তো বুড়ো অ্যান্ড্রুই কোনো কারণে মত পাল্টে ফেলেছিল। বের করে নিয়ে পুড়িয়েছে কাগজটা।’ হাঁটুতে লেগে থাকা সিমেন্টের গুঁড়ো সাবধানে ঝাড়ল পোয়ারো। ‘হতে পারে।’ উঠে দাঁড়াল। ‘যে-ই পুড়িয়ে থাকুক, এখানে আর কিছু করার নেই আমাদের। চলো, যাই।’ ক্র্যাবট্রি ম্যানর থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা গাড়ি ডেকে চড়ে বসলাম। স্টেশনের দিকে চলল গাড়ি। চুপ হয়ে গেছে পোয়ারো। ভাবসাব দেখেই বুঝতে পারছি, সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ওর মনে কিছু একটা খটকা রয়ে গেছে, কিন্তু সেটা বলল না আমাকে। লন্ডনের ট্রেন ধরলাম। ছুটে চলল ট্রেন। পোয়ারো চুপ। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। টনটন স্টেশনে গাড়ি থামল। সবে ছাড়ার বাঁশি বাজিয়েছে গার্ড, লাফিয়ে উঠল পোয়ারো। চেঁচিয়ে উঠল তীক্ষ স্বরে, ‘হেস্টিংস, জলদি নামো! জলদি নামো গাড়ি থেকে!’ বলতে বলতেই ছুটে গিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ও। আমিও নামলাম। নাকের সামনে দিয়ে ঘট্-ঘটাং আওয়াজ তুলে ছুটে চলে গেল ট্রেনের কামরাগুলো। হঠাত্ এই কাজটা কেন করল পোয়ারো, বুঝতে পারছি না। রাগই লাগছে। কিন্তু আমার দিকে খেয়ালই নেই যেন পোয়ারোর। আপন মনে মাথা দোলাতে দোলাতে বিড়বিড় করছে, ‘ইশ্, আমি একটা গাধা! মস্ত গাধা! আরেকবার ভোগাল আমাকে ধূসর কোষগুলো!’ ‘কী বলছ তুমি, কিছুই বুঝতে পারছি না!’ আমার কথায় কান দিল না পোয়ারো। বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, ‘কেমিস্টের কথা কেন যে ভুলে গেলাম! ধূর্ত অ্যান্ড্রুকে আন্ডার-এস্টিমেট করাটা মোটেও উচিত হয়নি। আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল...’ ‘কী বোঝা উচিত ছিল?’ ‘গোলমালটা কালিতে...’ বলতে বলতেই থেমে গেল পোয়ারো। এতক্ষণে যেন খেয়াল করল, ওর পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ‘হেস্টিংস, আবার ডেভনশায়ারে ফিরে যেতে হবে আমাদের। উইলটা কোথায় আছে, জানি এখন।’ কিন্তু ডেভনশায়ারে আবার ফিরে যাওয়াটা এত সহজ হলো না। একটা ধীরগতির ট্রেন ধরে একজিটারে পৌঁছালাম আমরা। সেখানে কোনোমতে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে ক্র্যাবট্রি ম্যানরে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে বেকার দম্পতির ঘুম ভাঙালাম। অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। কিন্তু কারও দিকেই নজর দিল না পোয়ারো, গটমট করে হেঁটে সোজা গিয়ে ঢুকল স্টাডিতে। ডেস্কের তলায় ঢোকানো চাবিটা খুলে এনে খামটা ছড়াল পোয়ারো। হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। উইলের ফরম ছোট কাগজ নয়, ছোট্ট ওই খামে ওটা আছে আশা করছে কী করে সে? খুব সাবধানে খামের আঠা ছাড়াল পোয়ারো, চারকোনা কাগজটা টেবিলে বিছিয়ে হাত দিয়ে চেপে চেপে যতটা সম্ভব সমান করে নিল। তারপর আগুন জ্বেলে শিখার ওপর ধরল ওটা। ধীরে ধীরে অক্ষর ফুটতে শুরু করল কাগজে। ‘দেখলে তো!’ আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পোয়ারো। খুব কম লিখে ভাইঝিকে তার বিশাল সম্পত্তি দিয়ে গেছেন মিস্টার অ্যান্ড্রু মার্শ। তারিখ: ২৫ মার্চ, দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট। উইলের সাক্ষী জনৈক আলবার্ট পাইক আর তার স্ত্রী জেসি পাইক। ‘ব্যাপারটা আইনসম্মত?’ বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম। ‘যদ্দূর জানি, অদৃশ্য কালিতে সাধারণ কাগজে উইল লেখাটা বেআইনি নয়। লেখা স্পষ্ট, সাক্ষীর সই স্পষ্ট, আদালত নাকচ করে দিতে পারবে না। কিন্তু যা-ই বলো, চালাক ছিল লোকটা। পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল, তার ভাইঝি কোন কোন জায়গায় খুঁজবে। সেসব জায়গায় রাখেনি। আর আমি হাঁদারাম ঠিক ওই সব জায়গায়ই খুঁজেছি। দুটো উইল ফরম নিয়ে চাকরদের দিয়ে দুবার সই করিয়েছেন মিস্টার মার্শ, বুঝিয়েছেন, ওগুলোতেই উইল লিখেছেন। তারপর খামের আঠা খুলে তার ভেতরের দিকে উইল লিখে লেখা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর নিজের সইয়ের নিচে কোনো ছুতো করে আবার কাজের লোকদের সই নিয়েছেন।’ ‘ওই খামের উল্টো পিঠে উইল লেখা হয়েছে, কিছুতেই বুঝতে পারত না মিস মার্শ,’ আমি বললাম। ‘তার মানে তার চাচাই জিতেছেন ধরে নেওয়া যায়।’ ‘না, হেস্টিংস, মিস মার্শ জিতেছে। লেখাপড়া করেছিল বলেই একজন গোয়েন্দা ডেকে এনে উইল খোঁজানোর বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। বুঝতে পেরেছিল, কাজটা যে করতে পারবে তাকেই দেওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনার কথা বেশির ভাগ মানুষই ভাবে না। মিস মার্শ প্রমাণ করে দিয়েছে, এই বিরাট সম্পত্তি ঠিকমতোই দেখেশুনে রাখতে পারবে।’ ভাবলাম, মিস্টার এরকুল পোয়ারের মতো দুঁদে গোয়েন্দাকে ডেকে আনবে তাঁর ভাইঝি, যদি জানতেন মিস্টার অ্যান্ড্রু, তাহলে উইলটা কোথায় লুকাতেন? * মাদমোয়াজেল: ফ্রান্সে অবিবাহিত নারীদের সম্মান দেখিয়ে মাদমোয়াজেল ডাকা হয়।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫৪৩ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now