বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
আমাদের বাড়িতে এতদিন পাকা রান্নাঘর ছিল না৷ ছিল বাশ আর পাটখড়ি দিয়ে তৈরি ঝুপড়ির মতো একটা কাচা রান্নাঘর। যেখানে ঝড়-বৃষ্টি এলেই পানির ঝাপটা ঢুকে সবকিছু ভিজিয়ে দিতো৷ সেই ঝুপড়ি রান্নাঘরে বসে বৃষ্টির পানিতে ভিজে ভিজে আমার মা এতদিন আমাদের রান্না করে খাইয়েছেন। মায়ের এই কষ্ট কমানোর জন্যে অনেকদিন ধরে একটা বড় করে পাকা রান্নাঘর দেয়ার ইচ্ছা ছিল৷ আল্লাহ তায়ালার রহমতে খুব সম্প্রতি আমাদের এই ইচ্ছাটি পূর্ণ হয়েছে।
.
আমাদের এই রান্নাঘর দেয়ার জন্যে কাজ করেছেন দুইজন কাঠমিস্ত্রী। এর মাঝে একজন ছিল ষাটোর্ধ্ব বয়সী। উনার নাম আব্দুল আলী৷ আমাদের গ্রামের দুই গ্রাম পরেই উনাদের গ্রাম। আবদুল আলী চাচা এখন কিছুটা নুইয়ে পড়েছেন৷ তবে বয়সের ভারের চেয়ে বেশি নুইয়ে পড়েছেন অভিজ্ঞতার ভারে৷ চুল-দাড়িতে পাক ধরলেও এখানো রয়েছে তীক্ষ্ণ দুটো চোখ, নির্ভুল কাঠের হিসেব-নিকেশ আর সুক্ষ্ম হাতের কাজ৷ উনার কাজের কোনো ত্রুটি খুজে না পেলেও প্রথম প্রথম উনার একটা বিষয় আমাকে খানিকটা বিরক্ত বোধ করাতো৷ কাঠের কাজে অত্যন্ত পারদর্শী হলেও যান্ত্রিক ফোন চালানোয় এখনো রয়ে গেছেন অপটু৷ বাধ্য হয়েই উনি উনার ছোট বাটন ফোনটি নিয়ে এসে আমাকে বলতেন 'মা' লিখে সেইভ করা নাম্বারটায় ফোন ঢুকিয়ে দিতে৷ ফোন দিয়ে দেয়ার পর উনি কথা বলার জন্যে ফোন নিয়ে আড়ালে চলে যেতেন। কিন্তু উনার এই কথা বলার বিষয়টা দিনে একবার দুবার ছিল না। ছিল অন্তত দশবার। প্রথম দুইদিন এমন চলার পর বেশ খানিকটা বিরক্ত বোধ করলাম। কাজ করতে এসেও একজনের সাথে বারবার কিসের এত কথা৷ কোনো ঝামেলা চলছে হয়তো৷ কিছুটা কৌতূহলী হয়েই অপর আরেকজন মিস্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে৷ উনার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম 'মা' লিখে সেইভ করা নাম্বারটা উনার স্ত্রীর৷ (হয়তো উনার ছেলে সেইভ করে দিয়েছিল।) উনার স্ত্রী অনেকদিন যাবত অসুস্থ৷ প্যারালাইজড৷ বিছানায় পড়ে আছেন৷ চলাফেরা করতে পারেন না৷ তাই বারবার ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়।
.
আমার কাছে গল্পের জীবনের চেয়ে মানুষের জীবনের গল্প শুনতে বেশি ভালো লাগে। অর্থবহও মনে হয়। তাই এই আবদুল আলী চাচার কাছ থেকে ধীরে ধীরে কাজ আর খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে উনার জীবনের গল্পটা শোনার চেষ্টা করেছিলাম। উনার স্ত্রী বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ৷ পাকস্থলীতে একটা অপারেশন হয়েছিল৷ এরপর থেকে আর ভারী কাজ করতে পারেননা৷ তবুও সব কিছু ভালই চলছিল। কিন্তু গত বছর হঠাৎ করে ব্রেইন স্ট্রোক করে উনার শরীরের অর্ধেক প্যারালাইজড হয়ে যায়৷ বিছানায় পড়ে ছিলেন দীর্ঘদিন৷ এভাবেই চলছিল চিকিৎসা আর শুশ্রূষা। তবে এখন খানিকটা নড়াচড়া করতে পারেন। বা হাত আর বা পা'টা ব্যবহার করে খাওয়া-দাওয়া আর প্রয়োজনীয় দরকারী কাজ সেরে নিতে পারেন। অল্প অল্প কথাও বলতে পারেন।
.
আলী চাচার দুই ছেলে। বড় ছেলে পেশায় দর্জি৷ শহরে নিজস্ব দোকান রয়েছে। সেখানেই স্ত্রী নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকে৷ ছোট ছেলে সৌদি আরবের প্রবাসী৷ উনার স্ত্রী এখন বাবার বাড়িতে থাকে৷ আব্দুল আলী চাচার বাড়িতে এখন থাকেন শুধু দুই বুড়া-বুড়ি। এই অবস্থায় আলী চাচা সব কিছু বাদ দিয়ে এতদিন শুধু নিজের সহধর্মিণীর দেখাশোনা করছেন৷ ছেলেরা নিয়মিত টাকা পাঠাতো৷ সেই টাকায় দুইজন চলতেন৷ কিন্তু এখন করোনার কারণে ছেলেদের টাকা পাঠানোই ব্যাঘাত ঘটছে৷ কিন্তু অসুস্থতা তো আর অর্থাভাব মানে না। নিয়মিত অন্তত ওষুধের খরচটা চালিয়েই যেতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই দীর্ঘ এগারো মাস পর আবার নিজের পুরোনো পেশায় ফিরে এসেছেন উনি।
.
উনি আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসতেন সকাল সাড়ে সাতটায়৷ কিন্তু এর আগেই উনি অনেক কাজ সম্পন্ন করে আসতেন। কাক ডাকা ভোরে উঠেন। উঠে সকালের নাস্তা বানান । নিজে খান। স্ত্রীকেও খাওয়ান৷ এরপর ওষুধ খাওয়ান৷ সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ হলে স্ত্রীর দুপুরের খাওয়ার জন্যে ভাত-তরকারি রান্না করে রেখে কাজে বের হন৷ কাজে এসেও হয়তো মন পড়ে থাকে স্ত্রীর নিকট৷ তাই বারবার ফোন দিয়ে খাবার আর ওষুধ খাওয়ার খোজ নেন৷ কোনো ঝামেলা হলে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর কাছে ফোন দিয়ে স্ত্রীকে সাহায্য করতে বলেন।
.
বাড়ি খানিকটা দূরে হওয়ায় দুপুরের খাবারটা উনি আমাদের বাড়িতেই খেতেন৷ শেষ বিকেলে যখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে ব্যাগ গোছাতেন তখন আমরা রাতের খাবারটা খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতাম৷ উনি হাসি মুখে আমাদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতেন৷ কারণ উনি বাড়ি গিয়ে রান্না করে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে একসঙ্গে রাতের খাবারটা খাবেন৷
.
আমাদের রান্নাঘরের কাজ শেষ হয়েছে অল্প কিছুদিন হয়েছে৷ এই কয়েকদিনে উনার ঘটনাটা আমাকে বারবার একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে৷ সুখী হতে কি আসলেই টাকা-পয়সা লাগে? বড় চাকুরী, গাড়ি-বাড়ি অথবা সোশ্যাল স্ট্যাটাস লাগে?
হয়তো লাগেনা। এসবের কিছুই লাগেনা৷ লাগে শুধু একটা ভাল মন। যেই মনটা থাকলে একজন দরিদ্র কাঠমিস্ত্রীর স্ত্রীও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মহিলা হয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন৷
.
কাজ শেষ করে যাওয়ার দিন আলী চাচা আমাকে উনাদের বাড়িতে পেয়ারা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আমি অবশ্যই যাবো। তবে পেয়ারা খাওয়ার জন্যে নয়৷ একজন অসম্ভব সৌভাগ্যবতী মহিলাকে দেখার জন্যে৷ যিনি আস্ত একটা পৃথিবী নিজের করে পেয়েছেন।
.
-মাহমুদুল্লাহ বিজয়।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now