বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং (১ম পর্ব)
X
"হ্যারি পটার" সিরিজ থেকে,
হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন
লেখিকাঃ জে. কে. রাওলিং
???? প্রকাশকের কথা
এক বিস্ময়কর সৃষ্টির নাম হ্যারি পটার। যে শিশু আজ ভুবন বিখ্যাত, যে শিশু মাতিয়ে তুলেছে পৃখিবীর তাবৎ শিশু-কিশোরকে তার নাম হ্যারি পটার। বাবা মা হারা ১০ বছরের এই অনাথ শিশুটিই ব্রিটিশ লেখিকা জে. কে. রাওলিংয়ের কলমে হয়ে ওঠে অনন্য সাধারণ। হ্যারি পটার সিরিজে জে কে রাওলিং এ পর্যন্ত ৭টি বই লিখেছেন। হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন এই সিরিজের প্রথম বই।
বইয়ের কাহিনী শুরু এক ভাগ্যবিড়ম্বিত শিশুকে নিয়ে। নাম হ্যারি পটার। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর হ্যাগ্রিড নামে এক জাদুকর তাকে দিয়ে যান, ৪ নাম্বার প্রিভেট ড্রাইভে। সেটা ছিল তার আঙ্কল ও আন্টের বাসা। অদ্ভুত স্বভাবের এই দম্পতি হ্যারিকে গ্রহণ করলেও আদর যত্ন করতেন না। হ্যারির ঘুমানোর জন্য কোন ঘর ছিল না। সে থাকতো সিঁড়ির নিচে একটা কাবার্ডে। তাকে নতুন কোন পোশাক দেয়া হতো না। ডাডলির পরিত্যক্ত, পুরনো কাপড় পরেই তাকে থাকতে হতো। তদুপরি সুযোগ পেলেই খালাত ভাই ডাডলি তাকে মারধর করত। সেখানে হ্যারির জীবন ছিল দুর্বিষহ। কিন্তু কিছুই করার নেই। এরই মধ্যে হোগার্টস নামের এক জাদুবিদ্যার স্কুল থেকে চিঠি আসতে থাকে। কিন্তু তার আঙ্কল ও আন্ট কেউই তাকে সেসব চিঠি দেন না। এরপর একদিন হ্যাগ্রিড সত্যি সত্যিই তাকে স্কুলে নিয়ে যান এবং তার কাছে তার বাবা-মার মৃত্যুর ঘটনা এবং ডার্সলি দম্পতির অপকীর্তি ফাঁস করে দেন।
এরপর হোগার্টস জাদুর স্কুলে গিয়ে হ্যারি মজার সব কাণ্ড করতে থাকে। প্রতিপক্ষ কোন খেলায়ই তাকে হারাতে পারে না, ষড়যন্ত্র করলেও সফল হয় না। এই স্কুলেই হ্যারি পেয়ে যায় তার বন্ধু রন ও হারমিওনকে। এই দুই সাথীকে নিয়ে হ্যারি প্রতিটি খেলায় জয়ী হয়। সর্বত্র তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
এ বইয়ে রাওলিং শিশু-কিশোরদের অন্তর্জগতে যে সব অসম্ভব ও অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি হয় তার কথা যেমন বলেছেন তেমনি সেই কল্পনার ওপর ভর করে তাদের নিয়ে গেছেন জাদু বাস্তবতার আশ্চর্য জগতে। শিশু-কিশোররা রূপকথা শুনতে ভালবাসে। রাওলিং তাদের সেই রূপকথা শুনিয়েছেন। তার এ রূপকথার মধ্যে জীবন বাস্তবতার নির্মম নিষ্ঠুর চিত্র আছে, আছে মাতৃহৃদয়ের চিরন্তন স্নেহশীলতা ও মমত্ববোধ।
জে. কে. রাওলিং নিজের বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন: সত্যিই আমি ভাগ্যবান মানুষ নই। আমার প্রথম জীবনটা কেটেছে নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে। রাওলিংয়ের আক্ষেপ, তার পরম আনন্দের খবরটি তার মা শুনে যেতে পারলেন না। ১৯৯৩ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মেয়ের লেখালেখি সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। তবে রাওলিংয়ের মা ছিলেন একজন সত্যিকার বই প্রেমিক। তিনি যদি দেখে যেতেন তার মেয়ের লেখা বই মাত্র তিন কপি বিক্রি হয়েছে তাহলেও খুশি হতেন। না, রাওলিংয়ের বই তিন কপি চলেনি, চলেছে ২০ কোটি কপিরও বেশি।
হ্যারি পটার নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতি হলেও বাংলা ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ এটাই প্রথম। এর আগে কলকাতা থেকে নকল হ্যারি পটার প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আইনবলে তা বন্ধ হয়ে গেছে। লেখক জে. কে. রাওলিংয়ের লিটারারি এজেন্ট-এর সঙ্গে দীর্ঘ দুবছর যোগাযোগ করে আমরা এ গ্রন্থ বাংলায় ভাষান্তর করার অনুমতি পেয়েছি। বিদেশে বাংলাদেশের দুর্নাম আছে, এখানকার প্রকাশকরা বিনা অনুমতিতে বিদেশী বই প্রকাশ করছে। আমরা এই দুর্নাম ঘুচাতে চাই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়েই বিদেশী বইয়ের ভাষান্তর এখানে প্রকাশিত হোক। আবার বাংলাদেশের বইও আইনানুগভাবে বিদেশে ভাষান্তর হোক। এ ব্যাপারে দেশের সহযোগী প্রকাশক ও লেখকদেরও সহযোগিতা কাম্য।
এই বইটি অনুবাদ করেছেন সোহরাব হাসান ও শেহাবউদ্দিন আহমদ। অনুবাদ কাজে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ মোশাররফ হোসেন। তাদের সবার প্রতি জানাই কৃতজ্ঞ।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ
পরিচিতি
হ্যারি পটার : এই বইয়ের প্রধান চরিত্র। জাদুকর লিলি ও জেমস পটারের ছেলে।
ডাডলি : হ্যারি পটারের খালাতো ভাই।
ডার্সলি : ভার্নন ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা পেতুনিয়ার স্বামী ও ডাডলির বাবা। বইতে হ্যারির আঙ্কল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পেতুনিয়া : পেতুনিয়া ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা। ডাডলির মা। বইতে আন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভোলডেমর্ট : হ্যারির বাবা-মার হত্যাকারী। ইউ নো হু নামে পরিচিত।
আলবাস ডাম্বলডোর : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ।
ম্যাকগোনাগল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের উপ-অধ্যক্ষ।
হ্যাগ্রিড : হোগার্টসের চাবির রক্ষক ও গেমকিপার, হ্যারির সুহৃদ।
মাগল : জাদুবিদ্যায় অবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ।
কিডিচ : ফুটবলের মত এক প্রকার জাদুনির্ভর খেলা।
স্নেইপ : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কুইরেল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
স্প্রাউট : জাদু বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিষয়ক অধ্যাপক।
হেডউইগ : হ্যারির পেঁচা, চিঠিপত্রের বাহক।
গ্রিফিল্ডর : হোগার্টস জাদু বিদ্যালয়ের গ্রিফিল্ডর হাউজ। ছাত্রাবাস।
স্ক্যাবাস : রনের ইঁদুর।
রন উইসলি : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।
হারমিওন গ্রেঞ্জার : হ্যারির বান্ধবী হোগার্টসের ছাত্র।
নেভিল লংবটম : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।
ম্যালফয় : হ্যারির সহপাঠী, প্রথম বর্ষের ছাত্র স্লিদারিন হাউজের আবাসিক ছাত্র ও হ্যারির প্রতিদ্বন্দ্বী।
ক্রেব : ম্যালফয়ের বন্ধু।
গ্রিংগটস : জাদুকরদের ব্যাংক।
ইউ-নো–হু : ভোলডেমর্ট, হ্যারির মা–বাবার হত্যাকারী।
ফ্লাফি : পরশমণির পাহারাদার তিনমাথা বিশিষ্ট কুকুর
ফ্লামেল, নিকোলাস : পরশমণির স্রষ্টা।
পিভস : জাদু বিদ্যালয় পালিত ভূত।
ফিলচ : হোগার্টসের কেয়ারটেকার।
ডেইলী প্রফেট : জাদুকরদের সংবাদপত্র।
ডায়াগন এলি : জাদুকরদের বিশেষ বাজার, যেখানে জাদুর উপকরণ পাওয়া যায়।
নিষিদ্ধ বন : হোগার্টের চারপাশের বন। ইউনিকর্ন ও রহস্যময় জন্তুদের বাস। হোগার্টের সীমার বাইরে।
গ্যালিওন্স : জাদুকরদের টাকা। পটার তার অভিভাবকদের কাছ থেকে এক পাত্র গ্যালিওনস পেয়েছিল।
গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র্যাভেন ক্ল, স্লিদারিন : হোগার্টের চারটি ছাত্রাবাস। যা, চার প্রতিষ্ঠাতার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
হোগার্ট স্কুল অফ উইচক্রাফট এন্ড উইজারি : জাদুবিদ্যার আবাসিক স্কুল, যেখানে হ্যারি ও তার বন্ধুরা বিভিন্ন জাদু শিখেছে। স্কুলের মূলমন্ত্র হলো, কখনও ঘুমন্ত ড্রাগনকে কাতুকুতু দিও না।
অদৃশ্য পোশাক : রূপালী ছাই রঙের পোশাক, যা পড়লে অদৃশ্য হওয়া যায়।
জাদু মন্ত্রণালয় : জাদুকরদের বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জাদুকর আর জাদুকরীদের বিষয় গোপন রাখার দায়িত্ব এই মন্ত্রণালয়ের।
এরিসেডের আয়না : এই আয়নায় মানুষের সব চাইতে বড় ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
নিম্বাস ২০০০ : জোরে উড়ে যাওয়া এবং সাংঘাতিক জাদুর ঝাড়ু, যা হ্যারিকে কিডিচে সোনার বল খোঁজায় দারুন পারদর্শী করেছিল।
প্লাটফর্ম পৌনে-দশ : লন্ডনের কিংস ক্রস জাদুর প্লাটফর্ম (যা, সাধারণের কাছে অদৃশ্য), যেখান থেকে হোগার্টের ছাত্রছাত্রীরা হোগার্ট এক্সপ্রেসে চড়ে।
বাছাই টুপি : জাদুকরদের লম্বা-চ্যাপ্টা টুপি। যা, ছাত্ররা কোন্ ছাত্রাবাসে থাকবে তা চিহ্নিত করে। টুপিগুলো গান করতে পারে আর তাদের অনুভূতিও আছে।
০১. প্রথম অধ্যায় : সেই ছেলেটি
জায়গার নাম প্রিভেট ড্রাইভ। বাড়ি নম্বর চার। সেখানে বসবাস করেন ডার্সলি দম্পতি। এ দম্পতি গর্ব করে বলেন যে তারা খুবই স্বাভাবিক মানুষ। তারা কোনো অলৌকিক ঘটনা বা ভূত–প্রেত জাতীয় কিছুতে বিশ্বাস করেন না। এগুলো তাদের কাছে অর্থহীন। মি. ডার্সলি হলেন গ্রুনিংস নামের একটি ড্রিল কোম্পানির পরিচালক। তিনি দেখতে বেশ লম্বা এবং মোটা। তার বিশাল গোঁফ। তবে তার ঘাড় নেই বললেই চলে। অপরদিকে তার স্ত্রী মিসেস ডার্সলি একটু হালকা–পাতলা। চুল বাদামি। তাঁর ঘাড়টা অস্বাভাবিক লম্বা। এটি তার খুব কাজে লাগে। তিনি লম্বা ঘাড় বাঁকিয়ে বাগানের খোঁজ–খবর করেন। পাড়া প্রতিবেশীরা কে কী করছে তা জানতে গোয়েন্দাগিরি করেন। ডার্সলি দম্পতির একমাত্র ছেলে। নাম ডাডলি। তাঁরা বলেন-এমন ছেলে হাজারে একটা মেলে।
ডার্সলি পরিবার যা চান তার সবই পান। কি তাদের একটি গোপন বিষয় আছে। তারা চান না এই বিষয়টা কেউ জানুক। তারা প্রতি মুহূর্তেই ভয়ে ভয়ে থাকেন তাদের ওই গোপন বিষয়টা বুঝি কেউ জেনে ফেলল।
পটার পরিবারের ব্যাপারে তারা বরাবরই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মিসেস পটার হচ্ছেন মিসেস ডার্সলির বোন। তবে দীর্ঘদিন তাদের দেখা–সাক্ষাৎ ছিল না। মিসেস ডার্সলি এমন ভাব দেখাতেন যেন তার কোন বোনই নেই। কারণ তাঁর বোন এবং তার নিষ্কর্মা স্বামীর সাথে মিসেস ডার্সলি বা তার স্বামীর বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। পটার পরিবারের কেউ যদি তাদের বাড়িতে এসে পড়ে তাহলে পাড়া–প্রতিবেশী কী বলবে-এ নিয়ে মিসেস ডার্সলি ভয়ে ভয়েই থাকতেন।
ডার্সলি পরিবার জানতেন যে পটার দম্পতির একটা ছোট্ট ছেলে আছে। তারা কখনোই এই ছেলেটাকে দেখেননি। এই ছোট ছেলেটির কারণে ডার্সলি পরিবার নিজেদেরকে পটার পরিবার থেকে দূরে রাখতেন। তারা চান নি যে তাঁদের ছেলে ডাডলি পটার পরিবারের ছেলেটির সাথে মেলামেশা করে।
আমাদের গল্পের সূচনা মঙ্গলবারে। দিনটি ছিল মেঘলা। এই মেঘলা দিনে কখনোই মনে হয়নি ওইদিনই কিছুক্ষণ পর দেশে অদ্ভুত বা রহস্যজনক কিছু ঘটবে। মি. ডার্সলি গুন গুন করছিলেন এবং কাজে যাওয়ার জন্য তাঁর বিরক্তিকর কাজ টাইটা বাঁধছিলেন। তাঁদের পুত্র ডাডলি ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করছিল। মিসেস ডার্সলি গল্প থামিয়ে বেশ কসরৎ করে চিৎকাররত ডাডলিকে একটি উঁচু চেয়ারে বসালেন।
সে সময় তারা কেউই লক্ষ্য করেননি যে একটি বাদামী রঙের পেঁচা তার পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তাদের ঘরের জানালায় এসে বসেছে।
সকাল সাড়ে আটটায় মিস্টার ডার্সলি অফিসে যাওয়ার আগে তাঁর ব্রিফকেস হাতে নিয়ে মিসেস ডার্সলির চিবুকে চুমো দিলেন। একই সঙ্গে পুত্র ডাডলিকে তিনি বিদায়ী চুমো দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ডাডলি তখন খাচ্ছিল আর এদিক সেদিকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারছিল। পুত্রকে হাই বলেই মি. ডার্সলি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এরপর গাড়িতে চড়ে সোজা অফিসের দিকে রওনা হলেন।
মি. ডার্সলির কাছে আজ সব কিছু যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। তিনি গাড়ি থেকে দেখতে পেলেন রাস্তায় একটি বিড়াল মানচিত্র পড়ছে। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না তিনি সত্যিই কী দেখছেন। তিনি তার মাথা বাঁকালেন; কিন্তু একই দৃশ্য। প্রিভেট ড্রাইভের কোণায় আরও একটি বিড়াল দাঁড়িয়ে আছে। এবার কোন মানচিত্র নেই। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না, ঠিক কী ঘটছে।
এটা কী ভোজবাজি। ডার্সলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি চোখ কচলিয়ে বিড়ালটার দিকে তাকালেন। বিড়ালটাও তার দিকে তাকাল। ডার্সলির গাড়ি তখন সামনে এগুচ্ছে। তিনি যখনই গাড়ির আয়নায় চোখ রাখছেন তখনই বিড়ালটাকে দেখছেন। বিড়ালটা রাস্তার ফলক দেখছে, প্রিভেট ড্রাইভ নং–। কিন্তু বিড়ালের তো পড়ার কথা নয়, মানচিত্র দেখার ও কথা নয়। কোন ঘোরের মধ্যে আছেন কিনা তা বোঝার জন্য মি. ডার্সলি শরীরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়াল বিষয়টাকে মাথা থেকে তাড়ালেন। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা। ড্রিলের বড় অর্ডাটা আজ আর পাওয়ার কথা।
মি. ডার্সলির মগজ থেকে আবার ড্রিলের চিন্তুা উধাও। তিনি গাড়ি থেকে রাস্তায় দেখলেন লোকজন অদ্ভুত ঢোলা পোশাক পরে পায়চারি করছে। চারদিকে সকালের যানজট। কাউকে অদ্ভুত পোশাক পরতে দেখলে ডার্সলি খুব বিরক্ত হন। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে তিনি বাইরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকজনদের দেখতে লাগলেন। লক্ষ্য করলেন, তাদের মধ্যে কেউই বয়সে তরুণ নয়। এতে তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সড়ক যানজট মুক্ত হল। অবশেষে অফিসে পৌঁছলেন, অফিসে পৌঁছা মাত্রই তার মাথায় ড্রিলের চিন্তা ফিরে এল।
মি. ডার্সলি সব সময় জানালার দিকে পেছন ফিরে বসেন। তার অফিস দশ তলায়। যদি তিনি সেখানে না বসতেন তাহলে ড্রিলের প্রতি মনোযোগ দেয়া আরও কঠিন হতো। তিনি যদিও কোন পেঁচা দেখতে পেলেন না; কিন্তু পথের লোকজন দিনের আলোয় পেঁচা দেখছিল। তারা হা করে উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জীবনে কখনো রাতের বেলায়ও পেঁচা দেখেনি। অথচ ডার্সলি নিজে খাঁটি পেঁচামুক্ত একটি সকাল কাটালেন। অফিসে একে একে পাঁচজনকে বকা–ঝকা করলেন।
এরপর ডার্সলি কয়েকটা জরুরি ফোন করলেন। আরও খানিকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। মধ্যাহ্নভোজের আগ পর্যন্ত তার মনমেজাজ খুবই ফুরফুরে ছিল। তিনি ভাবলেন, হাত–পা ছড়াবার জন্য একটু হেঁটে আসা দরকার। তিনি বেকারি থেকে মিষ্টি রুটি কেনার জন্য পথে নামলেন। অদ্ভুত পোশাকের লোকদের কথা তিনি তখন ভুলে গেলেন। বেকারির সামনে কয়েকজনকে অদ্ভুত পোশাকে দেখে তার আবার তাদের কথা মনে পড়ল। তিনি কড়া দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। তাঁর রাগের কারণ তিনি বুঝতে পারলেন না, তবে তাদের দেখে বিরক্ত হলেন। লোকগুলো উত্তেজিত স্বরে কানাকানি করছিল। মনে হল তারা পটারের কথা বলছে।
মিস্টার ডার্সলির কানে ভেসে এলো–পটাররা, হ্যাঁ ঠিক…, এটাই আমি শুনেছি।
হ্যাঁ, তাদের ছেলে, হ্যারি–
এসব কথা শুনে মিস্টার ডার্সলি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভয় তাকে গ্রাস করল। যারা ফিস ফিস করছিল তিনি তাদের দিকে তাকালেন। একবার ভাবলেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন। পরে ভাবলেন, জিজ্ঞেস না করাই ভাল।
মিস্টার ডার্সলি রাস্তা পার হলেন এবং দ্রুতবেগে অফিসের দিকে ছুটলেন। অফিসে ঢুকেই সচিবকে বললেন তাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে।
তিনি টেলিফোন হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করার জন্য ডায়াল ঘোরালেন। পরমুহূর্তেই মত পালটে রিসিভার রেখে দিলেন। এরপর গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবলেন এসব চিন্তা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। পটার তো বিশেষ কোন নাম নয়। অনেক লোকের নামই পার হতে পারে এবং হ্যারি নামে তাদের ছেলে থাকতে পারে। তার নাম পটার না হয়ে হার্ভে বা হ্যারল্ডও হতে পারত। কিন্তু ছেলেটিকে তিনি এখন পর্যন্ত দেখেননি। এসব কথা জানিয়ে মিসেস ডার্সলিকে ভয় পাইয়ে দেবার কোন কারণ নেই। তার বোনের নাম উচ্চারণ করলেই মিসেস ডার্সলি ঘাবড়ে যান। এজন্য তিনি স্ত্রীকে দোষ দিচ্ছেন না, তার জায়গায় হলে হয়তো তিনিও তাই করতেন।
বিকেলে তিনি কাজে আর মনোযোগ দিতে পারলেন না। পাঁচটায় যখন অফিস থেকে বের হলেন তখনও চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অফিস থেকে বেরোবার সময় দরজার বাইরে একটা লোকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল। লোকটা প্রায় মাটিতেই পড়ে যাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে মিস্টার ডার্সলি বললেন—দুঃখিত।
কয়েক সেকেন্ড পর মিস্টার ডার্সলি খেয়াল করলেন যে লোকটা বেগুনি রঙের আলখেল্লা পরেছে। মাটিতে প্রায় পড়ে গেলেও লোকটাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না। বরং তার মুখে স্মিত হাসির রেখা। বলল–স্যার, দুঃখিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কোন কিছুই আজ আমাকে বিচলিত করতে পারবে না। আনন্দ করুন। ফুর্তি করুন। অবশেষে ইউ-নো-হু বিদায় নিয়েছে। আপনার মতো জাদুতে অবিশ্বাসী মাগলদেরও আজ আনন্দ করা উচিত, এই শুভদিনে। শুভদিন।
বৃদ্ধ লোকটা রাস্তার মাঝখানে মিস্টার ডার্সলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরে ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটতে থাকল।
মিস্টার ডার্সলি অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। এক অদ্ভুত লোক তাঁকে রাস্তায় বুকে জড়িয়ে ধরেছে। লোকটা তাকে আবার মাগলও বলেছে। সবকিছু তার কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। তিনি দ্রুতবেগে গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। ভাবলেন হয়তো এই সবকিছুই কল্পনা। তবে তাই বা হয় কি করে! তিনি তো এসব আজগুবি কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। গাড়ি নিয়ে চার নম্বর বাড়িতে প্রবেশ করতে প্রথমেই বিড়ালটা তার নজরে পড়ল। বিড়ালটা ছিল বাগানের দেয়ালের ওপর বসা। ডার্সলি নিশ্চিত যে এটাকেই তিনি সকালে দেখেছিলেন। এর চোখের চারদিকে একই চিহ্ন। বিড়ালটা দেখেও তার কোন ভাবান্তর হলো না।
হিস–বিড়ালটার উদ্দেশে তিনি জোরে শব্দ করলেন। নড়ল না।
বরং তার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। তিনি ভাবলেন এটা তো বিড়ালের স্বাভাবিক আচরণ নয়। আবার ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময়ও ডার্সলি ভাবলেন এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তার কিছুই স্ত্রীকে বলবেন না।
সুন্দর স্বাভাবিকভাবেই মিসেস ডার্সলির দিনটা কাটল। রাতে খাবার সময় তিনি স্বামীকে প্রতিবেশিনী ও তার কন্যার ঝগড়ার আদ্যপান্ত বললেন। ডার্সলি যে একটা নতুন শব্দ শিখেছে তাও তিনি উল্লেখ করলেন। মিস্টার ডার্সলি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। ডাডলি যখন ঘুমিয়ে পড়ল সন্ধ্যার শেষ খবর শোনার জন্য তখন তিনি বসার ঘরে গেলেন।
খবরে শোনা গেল–পাখি বিশারদগণ লক্ষ্য করেছেন যে পেঁচা আজ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। পেঁচা রাতের পাখি। দিনের আলোয় একে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু আজ সকালেই অনেক পেঁচা উড়তে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা পেঁচার আচরণের আকস্মিক পরিবর্তনের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। সংবাদ পাঠক হাসতে হাসতে পেঁচককূলের এ আচরণকে গভীর রহস্যময় বলে উল্লেখ করলেন–আবহাওয়াবিদরা জানালেন, আমরা এ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আজ পেঁচা এখানেই শুধু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তাই নয়, কেন্ট, ইয়র্কশায়ার ও ডান্ডি থেকেও দর্শকরা ফোন করে একই খবর জানিয়েছেন।
আবহাওয়ার খবরে বলা হলো–আজ অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। দূরদূরান্ত থেকে ফোনে শ্রোতারা আমাদের জানিয়েছেন যে, গতকাল বৃষ্টির পরিবর্তে তারকা গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। লোকজন আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করেছে। অবশ্য আজকের রাতেও বৃষ্টি হবে। মিস্টার ডার্সলি তার আরাম কেদারায় শক্ত হয়ে বসলেন এবং ভাবলেন সারা ব্রিটেনেই তারকা গোলা বর্ষিত হচ্ছে। রাতের পেঁচা কেন দিনে উড়ে বেড়াচ্ছে? সর্বত্রই কি অদ্ভুত আলখেল্লা পরা রহস্যময় লোক? পটারকে নিয়ে ফিসফিসানি…?
দু কাপ চা নিয়ে মিসেস ডার্সলি বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। চায়ে মোটেই স্বাদ হয়নি। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন স্ত্রীকে কিছু বলা দরকার।
তিনি তার গলা পরিষ্কার করে সংকোচের সাথে শুরু করলেন—
পেতুনিয়া–প্রিয়তমা–তুমি কি ইদানিং তোমার বোনের কোন খবর টবর পেয়েছে।
তিনি যেমনটা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনি তার স্ত্রী ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন। ডার্সলি দম্পতি বোঝাতে চাইতেন, মিসেস ডার্সলির কোন বোন নেই। তারা কখনো এ বিষয়ে আলোচনা করতেন না।
না, হঠাৎ এ কথা কেন? মিসেস ডার্সলি রাগতস্বরে প্রশ্ন করলেন।
মিস্টার ডার্সলি আমতা আমতা করে বললেন–আজকাল খুব আজগুবি খবর শোনা যাচ্ছে।–পেঁচা–তারকা–গোলাগুলি এবং আজ শহরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোককে দেখলাম।
কথার মাঝখানে থামিয়ে মিসেস ডার্সলি বললেন, তা-ই!
মিসেস ডার্সলি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন, পটার সম্পর্কে যেসব কথা আজকে শুনেছেন তা স্ত্রীকে বলবেন কিনা, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। তারপর খুবই হালকাভাবে বললেন তাদের ছেলেটা ডাডলির বয়সি হবে না?
মিসেস ডার্সলি শুকনো কণ্ঠে জবাব দিলেন, আমার মনে হয় তা-ই।
তার নাম কি? হাওয়ার্ড না কি যেন?
তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর, তাহলে বলব নাম, হ্যারি। অনেকেই এ নাম রাখে।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। মিস্টার ডার্সলি উত্তর দিলেন। তার বুক কাঁপছিলো, এই নামটিই তো তিনি শুনেছেন। আমি তোমার সাথে একমত।
ওপরের তলায় ওঠার সময় মিস্টার ডার্সলি এ বিষয়ে আর কোন কথা বললেন না। মিসেস ডার্সলি যখন স্নানের ঘরে, মিস্টার ডার্সলি তখন শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের বাগানের দিকে তাকালেন। বিড়ালটা তখনও সেখানে আছে। বিড়ালটা প্রিভেট ড্রাইভের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যে মনে হচ্ছে বিড়ালটা কোন কিছুর প্রতীক্ষা করছে। এসব কি তার কল্পনা? নাকি এর সাথে পটারদের কোন যোগসূত্র আছে?
সত্যি যদি যোগসূত্র থাকে তার ঝামেলাটা কিভাবে মোকাবিলা করবে সে কথা তিনি ভাবতেও পারছেন না।
ডার্সলি দম্পতি ঘুমুতে গেলেন। মিসেস ডার্সলি শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু মিস্টার ডার্সলির সহজে ঘুম এলো না। না ঘুমিয়ে তিনি আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলেন। তিনি নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন এবং ভাবলেন যে, আজকের অদ্ভুত ঘটনাগুলোর সঙ্গে পটারদের যদি কোন যোগসূত্র থেকেও থাকে তাহলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের কিছুতেই তাঁর কাছে বা তার স্ত্রীর কাছে আসার কোন কারণ নেই। তিনি এবং তার স্ত্রী পটারদের সম্পর্কে কী ধারণা রাখেন তা তাদের জানা আছে। পটাররা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
কিন্তু তার ধারণা সঠিক ছিল না।
মিস্টার ডার্সলি ক্রমশঃ অস্বস্তিকর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও বাইরে দেয়ালের ওপর বিড়ালটার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম ছিল না। বিড়ালটা মূর্তির মত বসেছিল। তার নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোণায়। পরের রাস্তায় গাড়ির দরজায় সজোরে শব্দ হওয়া কিংবা দুটো পেঁচা এসে না বসা পর্যন্ত সে নড়ল না। প্রকৃতপক্ষে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বিড়ালটা দেয়ালের ওপর বসেছিল।
বিড়ালটা যেখানে বসেছিল তার কাছাকাছি হঠাৎ একজন লোককে দেখা গেল। লোকটা এমনভাবে উদয় হলো যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। বিড়ালটা লেজ নাড়াল এবং তার চোখ ছোট হয়ে এল।
প্রিভেট ড্রাইভে এ ধরনের লোক এর আগে কখনো দেখা যায়নি। লোকটা দেখতে লম্বা ও পাতলা। রূপোলি চুল ও দাঁড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে লোকটা বৃদ্ধ। তার লম্বা চুল ও দাঁড়ি তার কোমর পর্যন্ত ঠেকেছে। লোকটা লম্বা ও ঢোলা পোশাক পরেছেন। তার গোলাপি রঙের পোশাক এত লম্বা যে মাটি স্পর্শ করছিল। তার চোখ ছিল হালকা ও উজ্জ্বল। চশমার ভেতর দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। তার নাক বেশ লম্বা, আর একটু খাদা ধরনের। তার নাক দেখে মনে হয় এটা অন্তুতঃ দুবার ভেঙেছে। এই লোকটির নাম আলবাস ডাম্বলডোর। তিনি তার আলখেল্লার বিভিন্ন পকেটে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজছিলেন।
মনে হয় ডাম্বলডোর বুঝতে পারেন নি, তিনি যে সড়কে এসেছেন সেখানে তার নাম থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত প্রতিটা জিনিসই অবাঞ্ছিত।
তিনি বুঝতে পারলেন যে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ বিড়ালটার দিকে তার দৃষ্টি পড়ে, বিড়ালটা সড়কের অপরদিক থেকে তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটাকে দেখে তিনি খুব মজা পেলেন। তিনি মনে মনে হাসলেনও, বিড়বিড় করে বললেন–আমার জানা উচিত ছিল।
ডাম্বলডোর তার জামার পকেটে যা খুঁজছিলেন এবার হাত দিয়ে তা পেলেন, একটা রূপোর সিগারেট লাইটার। তিনি লাইটারে মৃদু চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার কাছের বাতিটা নিভে গেল। এভাবে তিনি মোট বারো বার লাইটারে চাপ দিলেন। রাস্তার সব বাতি নিভে গেল। অবশিষ্ট আলো বলতে ছিল বিড়ালটার দুটি চোখ। গোল কুতকুতে চোখের মিসেস ডার্সলি বা অন্য কেউ যদি তখন বাইরে তাকাতেন তাহলেও নিচের ফুটপাথে অন্ধকারে কি ঘটছে তা তারা দেখতে পেতেন না। লাইটারটা পকেটে ভরে এরপর ডাম্বলডোর রাস্তার শেষপ্রান্তে চার নম্বরে এসে বিড়ালটার পাশে দেয়ালের ওপর বসলেন।
বিড়ালটার দিকে না তাকিয়ে ডাম্বলডোর বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, অবাক কাণ্ড আপনি এখানে?
এরপর তিনি বিড়ালটার দিকে স্মিত হাস্যে তাকালেন। কিন্তু এ কি? বিড়ালের কোন নাম নিশানা নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রাশভারি এক মহিলা। তার চোখে চারকোণা চশমা। এমন চৌকো চারকোণা চিহ্ন বিড়ালের চোখের চারপাশেও ছিল। তার গায়ে সবুজ পান্না রঙের আলখেল্লা। তার কালো চুল ঝুটি বাঁধা। চেহারায় একটু বিধ্বস্ত ভাব।
মহিলা প্রশ্ন করলেন–আমি এখানে আছি-এটা আপনি কী করে জানলেন?
ডিয়ার প্রফেসর, আমি কখনো কোন বিড়ালকে এত শক্তভাবে বসে থাকতে দেখিনি।
ম্যাকগোনাগল বললেন, আপনিও যদি সারাদিন ইটের দেয়ালের ওপরে বসে থাকতেন তাহলে আপনাকেও এতটা শক্ত থাকতে হত।
সারাদিন? তাহলে আপনি কখন আনন্দ করলেন? আমি এখানে আসার পথে এক ডজন ভোজ ও পার্টি দেখে এসেছি।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ঘৃণাসূচক নাক সিঁটকালেন। হ্যাঁ, সবাই উৎসবই তো করবে। অধৈর্য কণ্ঠে তিনি বললেন। আপনি বলেছিলেন তাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। কিন্তু তারা সতর্ক হলো না। হ্যাঁ, এমন কিছু যে ঘটছে মাগলরাও তা বুঝতে পেরেছে। এটা তাদের নজরে এসেছে।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ডার্সলি পরিবারের অন্ধকার শোবার ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। তারপর তিনি মন্তব্য করলেন–পেঁচার ঝাঁক, তারকা গোলা… এগুলো আমি শুনেছি। তারা একেবারে বোকা নয়, তাদের চোখে কিছু না কিছু ধরা পড়বেই। তারকা গোলা গিয়ে পড়ল কেন্টে। আমি বাজি ধরতে পারি এগুলি ডিডালুস ডিগলের কাজ। কখনো তার বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না।
তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ডাম্বলডোর নম্রস্বরে বললেন গত এগারো বছরে উৎসব করার মতো কোন সুযোগ আমরা পাইনি।
আমি সেটা জানি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খানিকটা রেগেই জবাব দিলেন। তবে এটা মাথা গরম করার কোন বিষয় নয়। সবাই একেবারেই অসতর্ক ছিল, এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় বের হওয়া, তাও মাগলদের পোশাক না পরে, গুজব ছড়ানো।
তিনি ডাম্বলডোরের দিকে তীব্র তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। তার ধারণা ছিল ডাম্বলডোর তাকে কিছু বলবেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। তাই ম্যাকগোনাগল বলে চললেন–খুবই ভালো হত যদি ওইদিন ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যেত। মাগলরা আমাদের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আমার মনে হয় ডাম্বলডোর, সে সত্যি সত্যিই চলে গেছে।
আমারও তা-ই মনে হয় সে চলে গেছে– ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তারপর একটু থেমে বললেন আপনাকে কি শরবতি লেবু দেব?
কী? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
শরবতি লেবু। এটা মাগলদের প্রিয়। আমিও খুব পছন্দ করি।
না, ধন্যবাদ–ম্যাকগোনাগল শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন। তিনি মনে করেন না এটা শরবতি লেবু খাওয়ার সময়। একটু থেমে বললেন–আমি যেমন বলি, যদি ইউ-নো-হু চলে গিয়েও থাকে।
প্রিয় অধ্যাপক, আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তির উচিত তাকে নাম ধরে ডাকা। ইউ-নো-হু কি কোন নাম হলো। আমি গত এগারো বছর ধরে সবাইকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে তাকে তার আসল নাম ধরেই ডাকা উচিত। তার আসল নাম ভোলডেমর্ট। ডাম্বলডোর বললেন।
অধ্যাপক, ম্যাকগোনাগল কুণ্ঠিত হলেন। ডাম্বলডোর দুটি শরবতি লেবুর খোসা ছাড়িয়ে খেলেও ম্যাকগোনাগল সে দিকে তাকালেন না। আপনি যদি ইউ–নো–হু বলতে থাকেন তাহলে সবকিছুতে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। আমি ভলডেমর্ট-এর নাম বলতে ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখি না।
কিন্তু এতে কোন কাজ হয়নি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন কিছুটা ক্লান্তি আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আপনি অন্যদের থেকে ভিন্ন। সবাই জানে একমাত্র আপনিই জানেন। ইউ–নো–সরি–ভলডেমর্ট ভয় পেয়েছিলেন।
আপনি আমার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলছেন। ডাম্বলডোর শান্তভাবে জবাব দিলেন ভলডেমর্টের এমন ক্ষমতা ছিল যা আমার কোনদিনই হবে না।
কারণ আপনি খুব ভাল… এত মহৎ যে সে ক্ষমতা আপনি ব্যবহার করেন না।
এটা ভাগ্যের কথা যে-এখন সব অন্ধকার। খুবই লজ্জা পাচ্ছি আপনার কথায়, মাদাম পমফ্রে আমার কান ঢাকা টুপির প্রশংসা করার পর এত লজ্জা আমি আর কখনো পাইনি।
ম্যাকগোনাগল ডাম্বলডোরের দিকে শানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন গুজব যেভাবে ছড়াচ্ছে তার সামনে পেঁচারা কিছুই নয়। আপনি কি জানেন–সবাই কী বলাবলি করছে? তারা বলছে–সে কোথায় গেছে? গেছে কোথায়?
মনে হল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এখন ডাম্বলডোরকে বলতে চান কেন তিনি সারাদিন বিড়ালের ছদ্মবেশে কনকনে শীতের মধ্যে দেয়ালের ওপর বসেছিলেন। সবাই যা বলাবলি করছিল তিনি তা বিশ্বাস করবেন না। যতক্ষণ না ডাম্বলডোর সেটাকে সত্য বলেন। ডাম্বলডোর কিন্তু কোন কথা না বলে আরেকটা শরবতি লেবু মুখে তুললেন।
তারা বলছিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন, গতরাতে ভোলডেমর্ট গডরিকস হলোতে গিয়েছিলেন পটারদের সন্ধানে। গুজব ছড়ানো হয়েছে যে লিলি এবং জেমস পটার মৃত।
ডাম্বলডোর তার মাথা নত করলেন এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
লিলি আর জেমস মারা গেছে-একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না …ওহ! আলবাস
ডাম্বলডোর কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধ মৃদু স্পর্শ করে ভারি কণ্ঠে বললেন আমি জানি, আমি জানি। আপনার কাছে খবরটা কত বেদনাদায়ক।
কম্পিত কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন-এটাই শেষ নয়। তারা বলছিল যে, সে পটারের ছেলে হ্যারি পটারকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। কেন হয়নি তা কেউ বলতে পারছে না। যখন হ্যারি পটারকে হত্যা করা গেল না তখনই ভোলডেমর্টের ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেল। এই কারণেই সে চলে গেছে।
ডাম্বলডোর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
এটা-এটা কি সত্য? ম্যাকগোনাগল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন। সে তো সবাইকে হত্যা করেছে। কেবল এই ছোট্ট ছেলেটাকে হত্যা করতে পারেনি? এটা সত্যিই বিস্ময়কর। হ্যারি যে বেঁচে গেল-এটা সত্যিই অভাবনীয়।
আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। ম্যাকগোনাগল বললেন হয়তো সত্যটা কখনোই জানতে পারবো না।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা রুমাল বের করে তার চশমার ভেতর দিয়ে চোখ মুছলেন। ডাম্বলডোর পকেট থেকে সোনালী ঘড়ি বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। ঘড়িটা আবার পকেটে রেখে বললেন–হ্যাগ্রিড দেরি করছে। সে নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছিল যে আমি এখানে থাকব।
হ্যাঁ ম্যাকগোনাল জবাব দিলেন–আমি জানি, আপনি আমাকে বলবেন না–আপনি এখানে কেন এসেছেন।
আমি হ্যারিকে তার আঙ্কল ও আন্টের কাছে দিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছি। হ্যারির আত্নীয়ের মধ্যে এখন তো মাত্র তারাই আছেন।
যারা এখানে থাকে আপনি নিশ্চয়ই তাদের কথা বলছেন না? চার নাম্বার বাড়ি দেখিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–ডাম্বলডোর, আপনি যা ভাবছেন তা করা ঠিক হবে না। আমি সারাদিন ধরে তাদের লক্ষ্য করছি। ওরা দুজন আমাদের মত নয়। ওদের একটা ছেলে আছে। সে তো আজকে সারা পথ ওর মাকে লাথি মেরেছে আর চিৎকার করেছে মিষ্টির জন্য। হ্যারি পটার এখানে আসবে এবং থাকবে ভাবাও যায় না।
এটাই তার জন্য উপযুক্ত স্থান। ডাম্বলডোর বললেন যখন হ্যারি বড় হবে তখন তার আঙ্কল–আন্ট তাকে সব ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন। আমি তাদেরকে একটা চিঠি দিয়েছি।
চিঠি? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আপনি কি সত্যিই মনে করেন একটা চিঠিই সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট? এই লোকগুলো কোনদিনই হ্যারি পটারকে বুঝতে পারবে না। তবে একদিন সে কিংবদন্তী হবেই।
আজকের দিনটাকেই যদি হ্যারি পটারের দিন বলে ঘোষণা করা হয় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না। ভবিষ্যতে হ্যারিকে নিয়ে যে বই লেখা হবে তা পৃথিবীর প্রতিটি শিশু পড়বে।
আপনি ঠিকই বলেছেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। ডাম্বলডোর বললেন। একটা ছেলে হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কিন্তু বিখ্যাত হয়েছে-একটা ছোট ছেলেকে মাথা খারাপ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ছেলেটাকে এখানে কীভাবে আনবেন? তারপর তিনি ডাম্বলডোরের আলখেল্লার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, মনে হল তিনি হ্যারিকে তার পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন।
হ্যাগ্রিড তাকে নিয়ে আসছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।
এমন একটা কঠিন বিষয়ে হ্যাগ্রিডের ওপর আস্থা রাখা কি ঠিক হবে? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।
হ্যাগ্রিডের ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।
আমি তাকে অবিশ্বাস করি না– অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। তবে সে তো ভুলও করতে পারে।
কিছু সময় নীরবে কাটল। তারপর বাইরে মোটর বাইকের শব্দ শোনা গেল। মোটর বাইক থেকে হ্যাগ্রিড নামলেন। মোটর বাইকটা অনেক বড় হলেও হ্যাগ্রিডের জন্য এটা নস্যি মাত্র। হ্যাগ্রিড এমনিতে যথেষ্ট লম্বা। সাধারণ লোকের তুলনায় পাঁচগুণ মোটা। কালো ঝাকড়া চুল। দাঁড়িতে তার সারা মুখ ঢেকে গেছে। তার হাত ডাস্টবিনের ঢাকনির মত চওড়া। বুটপরা অবস্থায় তার পা দেখলে মনে হবে শিশু ডলফিন। তার বাহু দেখলে মনে হবে কয়েকটা কম্বলের বাণ্ডিল।
অবশেষে তুমি এসেছো! আশ্বস্ত হয়ে ডাম্বলডোর হ্যাগ্রিডের কাছে জানতে চাইলেন–যাক! তুমি এই মোটর বাইক কোথায় পেলে?
অধ্যাপক ডাম্বলডোর, আমি এটা ধার করেছি। হ্যাগ্রিড বাইক থেকে নামতে নামতে জবাব দিলেন–ইয়াং সিরিয়াস ব্ল্যাক এটা আমাকে ধার দিয়েছে।
কোন অসুবিধে হয়নি তো? ডাম্বলডোর জানতে চাইলেন।
না, কোন অসুবিধে হয়নি। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। মাগলদের কিছু করার সুযোগ না দিয়েই আমি ছেলেটাকে বের করে নিয়ে এসেছি। ব্রিস্টলে এসে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ডাম্বলডোর এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কাছে এসে ঝুঁকে কম্বলের পুঁটলিটাকে দেখলেন। কম্বলটা সরাতেই দেখা গেল–ভেতরে একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে। কালো চুল। কপালের ওপর বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আঁকাবাঁকা একটা কাটা দাগ।
এটাই কি সেই দাগ?–ম্যাকগোনাগল প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সারাজীবন তাকে এই দাগ বয়ে বেড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু করতে পারেন না ডাম্বলডোর? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।
পারলেও আমি কিছু করব না–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। কারণ এই দাগগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। আমারও বাঁ পায়ের হাঁটুতে কাটা দাগ আছে, যা দেখতে অবিকল লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের ম্যাপের মতো। হ্যাগ্রিড, বাচ্চাটাকে দাও। এখন আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।
হ্যারিকে কোলে নিয়ে ডাম্বলডোর ডার্সলিদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন।
আমি কি এখন বিদায় নিতে পারি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।
হ্যাগ্রিড তার দাঁড়িভরা মুখ নিয়ে হ্যারিকে চুমো খেলেন। তারপর বিকট শব্দ করে আহত কুকুরের মত দ্রুতগতিতে সরে গেলেন।
ম্যাকগোনাগল তাকে হুঁশিয়ার করলেন—শ্শ্। চুপ। মাগলরা জেগে যাবে।
হ্যাগ্রিড একটা বড় রুমাল বের করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–লিলি আর জেমস জীবিত নেই, এ সত্যটাই আমি মানতে পারছি না। হ্যারি মাগলদের সাথে কিভাবে থাকবে–সেটা ভেবেই আমি চিন্তিত।
আসলেই এটা খুব দুঃখজনক। ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাগ্রিড আপনি শক্ত হোন। নতুবা অন্যরা আমাদের দেখে ফেলবে।
ডাম্বলডোর বাগানের দেয়াল টপকে বাড়ির সামনের দরোজার দিকে অগ্রসর হলেন। নিজের আলখেল্লার ভেতর থেকে একটি চিঠি বের করে তিনি হ্যারির গায়ে জড়ানো কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। হ্যারিকে কম্বলসহ দরোজার সামনে রেখে ডাম্বলডোর ফিরে এলেন আগের জায়গায়, সঙ্গী দুজনের কাছে।
পুরো এক মিনিট তারা তিনজন দাঁড়িয়ে কম্বলের পুটলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাগ্রিডের কাধ নড়ে উঠল, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তার চোখের পাতা পিট পিট করলেন আর ডাম্বলডোরের চোখে যে জ্যোতি সব সময় দেখা যেত, তা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।
ডাম্বলডোর বললেন-এখানে দাঁড়িয়ে থাকার তো কোন মানে হয় না। আমরা ফিরে গিয়ে উৎসবে যোগ দিতে পারি।
ঠিক বলেছেন, হ্যাগ্রিভ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন আমি বরং বাইক নিয়ে বিদায় হই। শুভরাত্রি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, শুভ রাত্রি অধ্যাপক ডাম্বলডোর।
চোখ মুছতে মুছতে হ্যাগ্রিড তার মোটরবাইকে উঠলেন। আর বিকট আওয়াজ করে বাইক ছুটে চলল।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, আবার দেখা হবে আশা করি–ডাম্বলডোর বললেন।
জবাবে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নাক দিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। ডাম্বলডোর রাস্তার দিকে রওনা হলেন। লাইটারের সাহায্যে রাস্তার আলোগুলো আবার জ্বেলে দিলেন। বারটা বাতিই জ্বলে উঠলো, কমলা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সড়ক, এমন পরিস্কার সব কিছু দেখা যাচ্ছিল যে কোন বিড়ালের বাচ্চাও যদি সড়কের শেষপ্রান্তে দৌড়ে যেত পরিষ্কার তা দেখা যেত। দূর থেকে তারা দেখতে পেল চার নাম্বার বাড়ির সিঁড়িতে কম্বলের পুটলিটা। তারপর গুডলাক হ্যারি বলে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন।
প্রিভেট ড্রাইভের ঝোঁপঝাড়ু তখন বাতাসে দুলছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল শিগগিরই আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা ঘটবে।
কম্বলের ভেতর হ্যারি পটার নড়ছে, কিন্তু তার ঘুম ভাঙেনি।
হ্যারির একটা হাত সেই চিঠির ওপর ছিল, যেটা ডাম্বলডোর তার কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যারি জানতেও পারল না যে, সে অসাধারণ, সে বিখ্যাত এবং কিছুক্ষণ পর মিসেস ডার্সলি তাকে ঘুম থেকে জাগাবেন।
ভোরবেলা দরোজা খুলেই মিসেস ডার্সলি চিৎকার করে উঠলেন। দুধের বোতল নেয়ার জন্য তিনি দরোজা খুলেছিলেন। কম্বল জড়ানো শিশুটাকে তিনি দুহাতে কোলে তুলে নিলেন। তার পুত্র ডাডলির সাথে হ্যারি আশ্রয় পেল। তিনি জানতেও পারলেন না দেশের সর্বত্র লোকজন মিলিত হয়ে গোপন সভায় হাতের গ্লাস উঁচু করে ফিসফিসে গলায় বলছে হ্যারি পটারের উদ্দেশ্যে, যে ছেলেটা বেঁচে আছে।
???? কাঁচের খাঁচার অন্তর্ধান
হ্যারি পটারকে যেদিন ডার্সলিরা কোলে তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন থেকে দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটে গেছে। তবে প্রিভেট ড্রাইভে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
সূর্য আগের মতোই পূর্বদিকে উঠছে আর পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে যেদিন মিসেস ডার্সলি তার দরোজার সামনে থেকে হ্যারি পটারকে কুড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যে রাতে মি. ডার্সলি পেঁচা সম্পর্কে দুঃখজনক খবর শুনেছিলেন। সবই আগের মত চলছে, শুধু দেয়ালে ঝুলানো তাদের ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় কত বছর পার হয়ে গেছে।
ডাডলিও আর এখন শিশু নয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। মেলা দেখতে যাচ্ছে। বাবার সাথে কম্পিউটারে গেমস খেলছে। ঘরে ঢুকে কিছুতেই বোঝা যাবে না এখানে ডাডলির কোন এক সঙ্গী আছে বা আর কেউ এখানে থাকে! হ্যারি পটার তখনও ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে ঘুমোতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়ার কর্কশ কণ্ঠ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। তার উচ্চ কণ্ঠ দিনের নীরবতা ভঙ্গ করল
এখনি উঠে পড়। এখুনি।
হ্যারি উঠে পড়ল।
তার আন্ট দরোজা ধাক্কাচ্ছেন।
হ্যারি, ওঠো বলে আন্ট পেতুনিয়া চিৎকার করছেন।
হ্যারি বুঝতে পারল তার আন্ট রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলার ওপর কড়াই বসানো হচ্ছে।
পাশ ফিরে হ্যারি স্বপ্নের কথা ভাবছিল। একটু আগেই সে একটা মজার স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নে দেখছিল যে একটা উড়ন্ত মোটর বাইকে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্ট পেতুনিয়া দরোজার কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করলেন–হ্যারি তুমি কি উঠেছ?
উঠেছি। হ্যারি জবাব দিল।
তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। আন্ট হ্যারিকে নির্দেশ দিলেন–তুমি শূকরের মাংসের দিকে খেয়াল রেখো। দেখো সবকিছু যেন পুড়ে না যায়। আমি চাই আজ ডাডলির জন্মদিনে সব কিছু নিখুঁত হোক।
হ্যারি বিড় বিড় করে কী যেন বলল।
আন্ট তাকে প্রশ্ন করলেন–হ্যারি, তুমি কি কিছু বলছিলে?
হ্যারি জবাব দিল–না, কিছু নাতো।
ডাডলির জন্মদিনের কথা তো সে ভুলে যেতে পারে না। হ্যারি বিছানা থেকে উঠে মোজা খুঁজতে লাগল। বিছানার নিচেই সে এক জোড়া মোজা পেল। মোজার ওপর থেকে একটি মাকড়সাকে তাড়িয়ে দিয়ে হ্যারি মোজা দুটি পরল। হ্যারি মাকড়সাকে ভয় পায় না কারণ কাবার্ডে অনেক মাকড়সা। আর সিঁড়ির নিচের ঘুপচির এই কাবার্ডেই হ্যারিকে ঘুমোতে হয়।
জামা পরে হ্যারি নিচে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। ডাডলির জন্মদিনের উপহারগুলোর জন্য টেবিলটাই দেখা যাচ্ছে না। জন্মদিনে ডাডলি তার পছন্দের সব জিনিসই পেয়েছে বলে মনে হলো। সে নতুন কম্পিউটার পেয়েছে, আরেকটা টেলিভিশন পেয়েছে, রেসের বাইক পেয়েছে।
ডাডলি কেন রেসের বাইক চেয়েছে এটা হ্যারির কাছে রহস্যই রয়ে গেল। কাউকে সাইকেল দিয়ে ধাক্কা মারার জন্য হলে ঠিক আছে। ডাডলি খুব মোটা এবং ব্যায়াম সে একেবারেই পছন্দ করে না। অবশ্য কাউকে ঘুষি মারা সেটা অন্য কথা–বিশেষ করে হ্যারিকে। এই ব্যায়ামটাই সে সব সময় করে থাকে। তবে হ্যারিকে বাগে পাওয়া সহজ ছিল না।
হ্যারি কিন্তু গায়ে–গতরে তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। তার শরীর রোগা পাতলা। ডাডলির বড় জামা–কাপড়ে তাকে আরো বেশি রোগা দেখায়। আকারে–আয়তনে ডাডলি ছিল তার চার গুণ। হ্যারির মুখ পাতলা, হাঁটু গোল, চুল কালো আর চোখ উজ্জ্বল সবুজ। চোখে গোল কাঁচের চশমা। চশমায় অনেক সেলোটেপের টুকরো, কারণ ডাডলি প্রায়ই তার নাকে ঘুসি মেরে চশমা ভাঙতো। নিজের চেহারার যে জিনিসটা হ্যারির ভালো লাগে তা হলো তার কপালের চিকন দাগ। ঝিলিক মারা বিদ্যুতের মতো আঁকাবাঁকা।
তার কপালে এই দাগ কেন-এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আন্ট পেতুনিয়া জবাব দেন–যখন মোটর দুর্ঘটনায় তোমার বাবা–মা দুজনই মারা যান তখন থেকেই তোমার কপালে এই দাগ। এর বাইরে তুমি আমাকে আর কোন প্রশ্ন করো না।
হ্যারি জানে, ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকতে হলে-এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
হ্যারি যখন কড়াই-এ শূকরের মাংস উল্টাচ্ছিলো ঠিক তখনই আঙ্কল ভার্নন রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন।
চুল আঁচড়াওনি কেন? তিনি হ্যারির কাছে যেন কৈফিয়ত চাইলেন।
আঙ্কল ভার্নন সপ্তাহে একদিন পত্রিকার শিরোনামের ওপর চোখ বোলান এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করেন–হ্যারির এখনই চুল কাটা দরকার। কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। হ্যারির চুল যথারীতি বাড়তেই থাকে।
হ্যারি যখন ডিম ভাজছিল ঠিক তখনই ডাডলি এবং তার মা রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। ডাডলির চেহারার সাথে আঙ্কল ভার্ননের অনেক মিল আছে। ডাডলির মা বলেন, ডাডলির চেহারা শিশু এ্যাঞ্জেলদের মতো। আর হ্যারির কাছে মনে হয় ডাডলি পরচুলা পরা একটা শূকর।
টেবিলের ওপর ডিম ও শূকরের মাংস রাখতে হ্যারিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। কারণ টেবিলে তেমন জায়গা নেই। আর ডাডলি তখন তার উপহারগুলো গুনছে।
উপহার গুনতে গুনতে ডাডলির মন একটু দমে গেল।
ডাডলি মন্তব্য করল–ছত্রিশটা, তার মানে গতবারের জন্মদিনের তুলনায় দুটি কম।
আন্ট বললেন-এর সাথে মার্জ আন্ট আর আমার উপহার যোগ কর। এবার গুণে দেখো কত হয়?
ঠিক আছে। তাহলে সাইত্রিশটা হলো –ডাডলির জবাবের মধ্যে ভীষণ ক্রোধের গন্ধ পেয়ে আন্ট পেতুনিয়া বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আমরা আজ যখন বাইরে যাবো তখন তোমাকে আরো দুটা উপহার কিনে দেব।
ডাডলি মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবল। তারপর বলল–ঠিক আছে। তাহলে আমার উপহারের সংখ্যা হবে ত্রিশ।
আন্ট পেতুনিয়া কথা শেষ করলেন–লক্ষ্মীসোনা, সংখ্যা হবে ত্রিশ নয়, বেশি। ঊনচল্লিশ। আহ ডাডলি চেয়ারে বসে সবচে কাছের প্যাকেটটা হাতে তুলে বললো, তাহলে ঠিক আছে।
আঙ্কল ভার্নন মৃদু হাসলেন।
বাবার মতোই ডাডলি তার প্রাপ্যটা চাচ্ছে। এই বলে আঙ্কল ভার্নন ডাডলির চুলে আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন। ঠিক এই সময় ফোন বেজে উঠল। আন্ট পেতুনিয়া ফোন ধরতে চলে গেলেন। হ্যারি আর আঙ্কল ভার্নন দেখলেন ডাডলি তার উপহার সামগ্রীর মোড়ক খুলছে। ডাডলি একটা রেসিং বাইক পেয়েছে। পেয়েছে একটা সিনে–ক্যামেরা। কম্পিউটারের ১৬টা নতুন খেলা, একটা ভিডিও রেকর্ডার। ডাডলি মোড়ক খুলে সোনালি হাতঘড়িটা বের করল। এই সময় আন্ট পেতুনিয়া হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। তাকে ক্রুদ্ধ ও চিন্তিত মনে হল।
তিনি বললেন–দুঃসংবাদ, ভার্নন। মিসেস ফিগের পা ভেঙে গেছে। তিনি ওকে নিতে পারবেন না। এই বলে তিনি হ্যারির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
ডাডলির চেহারায় অপ্রত্যাশিত আতঙ্ক দেখা গেল। হ্যারি অবশ্য হাফ ছেড়ে বাঁচল। প্রতি বছর ডাডলির জন্মদিনে তার বাবা–মা তাকে এবং এক বন্ধুকে নিয়ে সারাদিনের জন্য বাইরে যান। এ্যাডভেঞ্চার পার্ক, হামবার্গার বার বা সিনেমায়। প্রতি বছরই হ্যারিকে ফিগের কাছে রেখে যেতেন তাঁরা। ফিগ হচ্ছেন একজন উন্মাদ বৃদ্ধা, তিনি দুটো রাস্তার পরেই থাকেন। হ্যারি মিসেস ফিগকে একদমই পছন্দ করে না।
তাহলে এখন কি হবে? আন্ট পেতুনিয়া কথাগুলো বলে হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হল মিসেস ফিগের পা ভাঙার জন্য হ্যারিই দায়ী। ভার্নন বললেন–মার্জকে ফোন করা যেতে পারে।
বোকার মতো কথা বলো না ভার্নন। সে হ্যারিকে একেবারেই পছন্দ করে না–মিসেস ডার্সলির জবাব।
হ্যারির সামনেই ডার্সলি পরিবারে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ ধরনের কথাবার্তা হতো। যেন হ্যারি ধারে–কাছেও নেই বা তারা যখন হ্যারি সম্পর্কে এমন অবজ্ঞার সুরে কথা বলতেন যে মনে হতো, তার এখানে কোন উপস্থিতিই নেই।
হ্যারি মনে মনে আশা করছিল একা থাকলে সে টেলিভিশনে তার খুশিমতো অনুষ্ঠান দেখতে এবং ডাডলির কম্পিউটার রুমেও যেতে পারবে।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানে হ্যারি বলল–আমাকে তোমরা বাড়িতে রেখে যেতে পারো। আমি টিভি দেখে সময় কাটাব।
আন্ট পেতুনিয়া হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো যেন এইমাত্র তিনি তেতো কিছু মুখে দিয়েছেন।
তিনি মন্তব্য করলেন–ঘরে ফিরে দেখা যাবে সব তছনছ হয়ে গেছে।
আমি বাড়ির কোন কিছুর ক্ষতি করব না। হ্যারি বলল। কিন্তু কেউই তার কথা কানে তুললেন না।
আন্ট পেতুনিয়া বললেন–চলো চিড়িয়াখানায় যাই। এক গাড়িতে বসিয়ে রাখা যাবে।
গাড়িটা নতুন। নতুন গাড়িতে ও একা থাকতে পারবে না।
ডাডলি কাঁদতে শুরু করল। আসলে কাঁদা নয়। কাঁদার অভিনয়। ডাডলি জানে কাঁদলেই সে যা চায় তাই পায়।
দুষ্ট ছেলে এভাবে কাঁদে না। তার মা বললেন, তোমার মা কখনোই চাইবে না যে সে তোমার জীবনের এই দিনটা নষ্ট করে দিক।
আমি চাই না, একদম চাই না সে আমাদের সঙ্গে যাক। ডাডলি বলল–সে সবকিছু নষ্ট করে দেয়। এই বলে সে হ্যারির দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল।
ঠিক তখনই দরোজায় বেল বেজে উল। আন্ট পেতুনিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওহ ঈশ্বর, তারা এসেছে। কিছুক্ষণ পর মাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ডাডলির ঘনিষ্টতম বন্ধু পায়ার্স পলকিস। ডাডলির কান্না থেমে গেল। পায়ার্সের চেহারাটা যেন অনেকটা ইঁদুরের মতো। পায়ার্স পলকিস ডাডলির মজার বন্ধু। ডাডলি যখন লোকজনকে আঘাত করে তখন সে তাদের হাত পেছনে আধমোড়া করে বেঁধে ফেলে।
আধঘণ্টা পরেই হ্যারি গিয়ে বসল ডার্সলিদের গাড়িতে। হ্যারি ভাবতেও পারেনি তার এমন সৌভাগ্য হবে। গাড়িতে ডাডলি এবং পায়ার্সও আছে। তারা সকলেই যাবে চিড়িয়াখানায়।
আঙ্কল ভার্নন তারিকে সতর্ক করে দিলেন–সাবধান। কোনপ্রকার গগুগোল করবে না। গণ্ডগোল করলেই বড়দিন পর্যন্ত তোমাকে কাবার্ডে কাটাতে হবে।
সত্যি বলছি। আমি কোন রকম গণ্ডগোল করব না। হ্যারি আশ্বাস দিল।
আঙ্কল ভার্ননের মতো কেউই হ্যারির কথা বিশ্বাস করল না।
হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অঘটন ঘটে। এর আগেও হ্যারি তাদের বিরক্ত করেছে।
সমস্যা হলো হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। তাকে নিয়ে ডার্সলি পরিবার মোটেই খুশি নন।
একবার সেলুন থেকে চুল কেটে হ্যারি বাড়িতে ফিরে আসতে আসতেই তার চুল আগের মত হয়ে যায়। আন্ট পেতুনিয়া দেখতে পান তার মাথার চুল আগের মতোই। যেন চুল কাটাই হয়নি। এতে তিনি বিরক্ত হলেন এবং রান্নাঘর থেকে কাঁচি এনে হ্যারির মাখা মুড়িয়ে দিলেন। কেবল কপালের দাগ ঢেকে রাখার জন্য সামনের দিকে কিছু রেখে দেয়া হলো। ডাডলি তাকে দেখে হাসছিল। সারারাত তার ঘুম হলো না। সে স্কুলের কথা ভাবছিল। সকালে উঠে দেখে হ্যারির মাথাভর্তি চুল, আন্ট কেটে দেয়ার আগে যে অবস্থা ছিল। এ কারণে আন্ট তাকে সাত দিন কার্ডের মধ্যে আটকে রাখলেন। যদিও হ্যারি বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যে সে এর কারণ জানে না।
আরেকদিন আন্ট পেতুনিয়া ডাডলির একটা পুরনো ঢোলা জাম্পারের ভেতর হ্যারিকে ঢুকানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যতই তিনি হ্যারির মাথা ঢুকাতে চান ততই জাম্পারের মুখটা ছোট হয়ে আসে। আন্ট পেতুনিয়া ভাবলেন, হয়তো ধোয়ার পর ছোট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত জাম্পারে হ্যারির মাথা ঢুকে এবং হ্যারি শাস্তি থেকে রেহাই পায়।
আরেকবার হ্যারি ভীষণ বিপদে পড়েছিল। তাকে একদিন স্কুল ভবনের ছাদে পাওয়া গেল। আসলে ছাদে সে স্বেচ্ছায় ওঠেনি। ডাডলির দুষ্টু বন্ধুরাই হ্যারিকে তাড়া করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী ডার্সলি দম্পতিকে একটা চিঠি লিখে জানান যে, হ্যারি স্কুলের ছাদে উঠেছে। হ্যারি রান্নাঘরের বাইরে বড় শিম গাছের পেছনে লাফ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। হ্যারির ধারণা বাতাস তাকে উড়িয়ে এত ওপরে তুলেছে।
কিন্তু আজ কোন গোলমাল হলো না। তার স্কুল, কাপ বোর্ড অথবা মিসেস ফিগ-এর বাঁধাকপির গন্ধভরা রুম থেকে ডাডলি ও পায়ার্স-এর সঙ্গে দিন কাটানো ভাল।
গাড়ি চালাতে চালাতে আঙ্কল ভার্নন আন্ট পেতুনিয়ার কাছে অভিযোগ করছিলেন। তিনি অভিযোগ করতে পছন্দ করেন। সচরাচর তার অভিযোগ হলো : কর্মরত লোকজন, হ্যারি, ব্যাংক, এরপর কাউন্সিল আবার হ্যারি বিষয়ক। আজ সকালে অভিযোগ হলো মোটরবাইক বিষয়ক।
…মোটরবাইক ক্ষেপাটে ও তরুণ মস্তানের মতো গর্জন করে চলে। একথা তিনি বললেন, যখন পাশ দিয়ে একটা মোটরবাইক অতিক্রম কর চলে গেল।
আমি মোটরবাইক নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। হ্যারির হঠাৎ মনে পড়ল। সে বলল, মোটরবাইকটি উড়ছিল।
আরেকটু হলেই ভার্ননের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ত। তিনি ডানদিকে ঘুরে হ্যারির দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকালেন। তার মুখ তখন বৃহদাকার মূলার মত। বললেন মোটরবাইক উড়তে পারে না!
ডাডলি ও পায়ার্স হাসছিল।
আমি জানি এটি উড়তে পারে না। হ্যারি বলল, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম।
এরপরই হ্যারি ভাবল, কিছু না বললেই ভাল হতো। সে কথা বলুক এটা ডার্সলি পরিবারের কেউ চায় না। তারা তাকে ঘৃণা করে। স্বপ্ন হোক বা কার্টুন হোক তাতে কিছু আসে যায় না। তারা মনে করবে এটা নিশ্চয়ই হ্যারির ভয়ঙ্কর কোন ব্যাপার।
দিনটি ছিল রোদ ঝলমলে শনিবার, ছুটির দিন। চিড়িয়াখানায় প্রচণ্ড ভিড়। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক পরিবার এসেছে। ডার্সলি দম্পতি ডাডলি ও পায়ার্সের জন্য বড় সাইজের চকোলেট আইসক্রিম কিনে দিলেন। হ্যারিকে আড়াল করার আগেই যখন ভ্যানে বসা লাস্যময়ী মহিলা হ্যারির জন্য কি কেনা হবে জানতে চান, তখন একটি সস্তা লেমন আইস কিনে দেন। হ্যারি মনে মনে ভাবল, তাও মন্দ নয়।
দীর্ঘদিন পর হ্যারির একটা সুন্দর সকাল কাটল। ডাডলি এবং পিয়ার্স থেকে একটু ব্যবধান রেখেই হ্যারি হাঁটাহাঁটি করল। চিড়িয়াখানার রেস্তোরাঁয় তারা খাওয়া–দাওয়া সারল। দুপুরে খাবারের পর তারা সাপজাতীয় প্রাণীদের ঘর দেখতে গেল। ঘরটা ছিল খুব ঠান্ডা ও অন্ধকার। তবে দেয়ালের পাশের জানালাগুলোতে আলো জ্বালানো ছিল। ঘরে ছিল টিকটিকি, সাপ ও অনান্য সরীসৃপ। বিশাল আকারের বিষধর কোবরা, এমনকি মানুষকে পিষে মেরে ফেলতে পারে এমন মোটা একটি অজগর।
একটা বিশাল সাপ ঘুমিয়ে ছিল। ডাডলি ওর বাবাকে ফিস ফিস করে বলল–ওটাকে জাগাও।
আঙ্কল ভার্নন কাঁচে টোকা দিলেন, কিন্তু কোন কাজ হলো না। সাপটা একটুও নড়ল না। কিছুক্ষণ পর সাপটা মাথা তুলল। মনে হলো সাপটা হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারি সাপটাকে লক্ষ্য করল এবং আর কেউ সাপটাকে লক্ষ্য করছে কিনা এটাও দেখে নিল। না আর কেউ লক্ষ্য করছে
সাপটা তার মাখা আঙ্কল ভার্নন ও ডাডলির দিকে বাড়াল। চোখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। তারপর হ্যারির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতে চাইল আমি তো সব সময় এরকমই ব্যবহার পেয়ে থাকি।
আমি তা জানি। হ্যারি বিড় বিড় করে বলল।
সাপটি জোরে জোরে মাথা নাড়াচ্ছে।
তুমি কোথা থেকে এসেছো?–হ্যারি জানতে চাইল।
সাপ লেজ দিয়ে কাঁচের গায়ের লেখা দেখাল–বোয়া কনসট্রিকটর, ব্রাজিল।
জায়গাটা কি বেশ ভালো? হ্যারি প্রশ্ন করল। সাপটা লেজ দিয়ে আবার গ্লাসের ওপর লেখা দেখাল। হ্যারি পড়তে পারল। এই সাপটাকে এই চিড়িয়াখানায় বড় করা হয়েছে।
হ্যারি বলল–তাহলে তুমি কখনও ব্রাজিল দেখনি? সাপ মাথা নেড়ে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি সজোরে চিৎকার করে উঠল ডাডলি। মিস্টার ডার্সলি। শিগগির এদিকে এসো। অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা দেখে যাও।
সবাই দৌড়ে এলো। ডাডলি সুযোগ পেয়ে হ্যারির পাঁজরে একটি ঘুষি বসিয়ে দিল।
হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে গেল। এরপর যা ঘটল তা আরো আশ্চর্যজনক। ডাডলি এবং পায়ার্স যখন কাঁচের দিকে তাকাল তখন তারা উডয়ে ওরে বাপরে বলে মাটিতে ছিটকে পড়ল।
হ্যারি বসে হাপাতে লাগল। একটু পর হ্যারি তাকিয়ে দেখে কাঁচের খাঁচাটা নেই। সাপটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সরীসৃপ ভবনে হৈচৈ ও শোরগোল পড়ে গেল। যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল। সাপটা যখন হ্যারির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন হ্যারি সাপের কণ্ঠে শুনল–আমি ব্রাজিল থেকে এসেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
সরীসৃপ ভবনের কীপার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
চিড়িয়াখানার পরিচালক আন্ট পেতুনিয়াকে এক কাপ মিষ্টি চা তৈরি করে খাওয়ালেন। তিনি বারবার তার কাছে মাফ চাইলেন।
সরীসৃপ ভবন থেকে পায়ার্সের বের হয়ে না আসা পর্যন্ত আঙ্কল ভের্নন অপেক্ষা করলেন।
সাপটা কারো কোন ক্ষতি করেনি। হ্যারির পায়ের পাশ দিয়ে সামনের দিকে চলে গেছে। কোন অঘটন ঘটেনি। তারা সবাই ভার্নন আঙ্কলের গাড়িতে উঠে পড়ল।
ডাডলি বলল–আরেকটু হলে সাপটা আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিত।
পায়ার্স বলল–আমাকে তো পাকে পাকে সাপটা জড়িয়ে ধরেছিল। আর সাপটা হ্যারির সাথে কথা বলেছিল। তাইনা হ্যারি?
আঙ্কল ভার্নন বারবার হ্যারির দিকে তাকালেন। তিনি হ্যারির ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। রাগে আঙ্কল ভার্ননের মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছিল না। তারপরও আদেশ দিলেন, যাও কাবার্ডে যাও… তোমার জন্য কোন খাবার নেই।
বাড়িতে ফিরে আঙ্কল ভার্নন একটি চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন। আন্ট পেতুনিয়া ব্রান্ডি আনতে ছুটলেন।
হ্যারির ঠাঁই হলো অন্ধকার কাবার্ডে। সে ভাবছিল, তার যদি একটা ঘড়ি থাকত। ঘড়ি না থাকায় সে সময় জানতে পারল না। ডার্সলি পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা এটা তো সে বুঝতে পারছিল না। তারা না ঘুমোলে সে রান্নাঘরে যাবার কথা ভাবতেও পারে না।
প্রায় দশ বছর হ্যারি ডার্সলি পরিবারের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে। দশটা বছর খুব বিরক্তিকর ও কষ্টকর সময়। ছোটবেলার কথা, তার যতদূর মনে পড়ে, তার বাবা–মা যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তখনকার কথা। যে গাড়িতে ওর বাবা–মা দুর্ঘটনায় মারা যান, সেখানে সেও ছিল কিন্তু সে সময়ের কোন কথাই তার স্মরণ নেই।
কাবার্ডে যখন সে দীর্ঘক্ষণ তার অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে, তখন এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল। এক তীব্র সবুজ আলোক রশ্মি দেখে সে কপালের কাটা দাগে ব্যথা অনুভব করে। কপালের ব্যথা থেকে সে দুর্ঘটনার কথা মনে করতে পারে। কিন্তু সবুজ আলো? ওটা কোথা থেকে আসে? বাবা–মার কথা একেবারেই তার স্মরণে নেই। তার বাবা–মা সম্পর্কে কোন কথা হ্যারির আঙ্কল বা আন্ট তার সাথে বলতেন না। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করাও হ্যারির জন্য বারণ ছিল। এই বাসায় তার বাবা–মার কোন ছবিও নেই।
হ্যারির বয়স যখন আরো কম ছিল তখন সে প্রায়ই স্বপ্ন দেখত, একজন অচেনা আত্নীয় এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। তার একমাত্র পরিচিত বলতে এই ডার্সলি পরিবার।
একবার আন্টের সাথে দোকানে কেনাকাটার সময় একজন লোক এসে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে তাকে চেনে কিনা। এ প্রশ্ন শুনে কোন কিছু না কিনেই আন্ট পেতুনিয়া দোকান থেকে বাইরে চলে এলেন।
একবার এক অচেনা মহিলা চলন্ত বাস থেকে হ্যারিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলো। মহিলার গায়ে সবুজ পোশাক। চেহারাটা একটু বুনো ধরনের। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো–হ্যারি যখনই তাদের সাথে কথা বলতে চাইতো তারা অদৃশ্য হয়ে যেত। স্কুলে হ্যারির কোন বন্ধু ছিল না। সবাই জানতো এই ঢোলা জামা ও ভাঙা চমশা–পরা হ্যারি পটারকে ডাডলি এবং তার দুষ্টু বন্ধুরা কেউই পছন্দ করে না।
কেউ হ্যারির সাথে মিশতো না, কারণ ডাডলিকে চটাবার মতো সাহস কারোরই ছিল না।
???? যে চিঠি কেউই লেখেনি
ব্রাজিলিয়ান বোয়া সাপটা বের হয়ে যাওয়ার কারণে হ্যারিকে দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।
শাস্তিভোগের পর যখন সে কাবার্ড থেকে মুক্তি পেল তখন গরমের ছুটি চলছে। এরই মধ্যে ডাডলি তার নতুন সিনেমা ক্যামেরাটা ভেঙে ফেলেছে। নষ্ট করেছে রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেন। তাছাড়া মিসেস ফিগ যখন ক্রাচে ভর করে প্রিভেট ড্রাইভের রাস্তা পার হচ্ছিলেন তখন ডাডলি তার রেইসিং সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়।
স্কুল ছুটি থাকায় হ্যারির বেশ ভালো লাগছে। তবে ডাডলির সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচার থেকে কোন মুক্তি নেই। তারা প্রতিদিন এই বাসায় বেড়াতে আসে। পায়ার্স, ডেনিস, ম্যালকম এবং গর্ডন এরা সবাই নির্বোধ। ডাডলি ছিল এই নির্বোধদের দলপতি। তাদের প্রধান খেলা ছিল হ্যারির ওপর নির্যাতন চালানো।
এই কারণে হ্যারি ইচ্ছে করেই বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে কাটাতো। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। শিগগিরই ছুটি শেষ হয়ে যাবে। সেপ্টেম্বর মাসে হ্যারি সেকেন্ডারি স্কুলে যাবে। তখনই সে প্রথমবারের মতো ডাডলির হাত থেকে ছাড়া পাবে। ডাডলি ভর্তি হবে আঙ্কল ভার্ননের পুরনো স্কুলে। পায়ার্সও সেখানে ভর্তি হবে। হ্যারি ভর্তি হবে স্টোনওয়াল হাই-এ।
ডাডলি হ্যারিকে বললো–স্টোনওয়ালে কি হয় জানিস? প্রথমদিনই তোদের মাথা টয়লেটে ঢুকিয়ে রাখবে। একবার ওপর তলায় গিয়ে প্র্যাকটিস করে দেখ কেমন লাগে?
না, ধন্যবাদ। হ্যারি জবাব দিল। এই খারাপ টয়লেটে মাথা ঢোকাবার মতো নোংরা আর কিছু হতে পারে না। এই বলে হ্যারি দৌড়ে পালিয়ে গেল যাতে ডাডলি তাকে দিয়ে এ ধরনের প্র্যাকটিস না করাতে পারে।
জুলাই মাস। স্কুলের ইউনিফর্ম কেনার জন্য আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে নিয়ে লন্ডন গেলেন। হ্যারিকে রেখে গেলেন মিসেস ফিগের কাছে। তার অবস্থা তখন এত খারাপ ছিল না। জানা গেল তিনি তার পোষা বিড়ালের একটাকে ডিঙোতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এক পা ভেঙে ফেলেছেন। এর পর থেকে বিড়ালের প্রতি তার ভালোবাসার ঘাটতি পড়েছে। তিনি হ্যারিকে টিভি দেখতে দিলেন এবং বছরের পর বছর রেখে দেয়া কিছু বাসি চকোলেট কেকও খেতে দিলেন।
ওইদিন সন্ধ্যায় বসার ঘরে ডাডলি তার নতুন ইউনিফর্ম পরে হেঁটে দেখালো সবাইকে। স্মেলটিং স্কুলের মেরুন রঙের নিকার বোকার ইউনিফর্ম। হাতে একটা লাঠি। অপরকে পেটাবার জন্য। অবশ্যই শিক্ষকের দৃষ্টি এড়িয়ে। এটা পরবর্তী জীবনের জন্য ভাল ট্রেনিং বলে মনে করা হয়।
আঙ্কল ভার্নন ডাডলিকে নতুন ইউনিফর্মে দেখে খুব খুশি। তিনি খুশি হয়ে বললেন–আজ আমার জীবনে একটি পরম গর্বের দিন।
ডাডলিকে দেখে আন্টের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি বললেন–আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, ডাডলি এত বড় হয়ে গেছে। এসব কথায় হ্যারির হাসি পাচ্ছিল। সে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলো।
পরদিন সকালে হ্যারি নাশতার জন্য রান্নাঘরে গেলে একটা বিশ্রী গন্ধ পেল। রান্নাঘরটা ছিল বড়সড়। সেখানেই খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে ওখানে রাখা একটা বড় গামলা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। হ্যারি উঁকি দিয়ে দেখল যে বড় গামলায় ময়লা কাপড় পানিতে ভেজানো।
সে আন্ট পেতুনিয়াকে জিজ্ঞেস করল-এগুলো কি?
আন্ট ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিরেট কণ্ঠে বললেন-এগুলো তোমার স্কুলের ইউনিফর্ম।
হ্যারি মন্তব্য করল–আমি বুঝতে পারিনি যে এগুলো এত ভেজা হবে।
আন্ট বললেন–বোকার মতো কথা বলো না। আমি তোমার জন্য ডাডলির কিছু পুরনো কাপড় রঙ করে দিয়েছি। শেষ হলে দেখবে তোমাকে ঠিকই মানাচ্ছে।
হ্যারির মনে সন্দেহ দেখা দিলেও সে কোন প্রশ্ন করল না। ওই পোশাকে স্টোনওয়াল স্কুলে তাকে প্রথম দিন কেমন দেখাবে। তাকে দেখে মনে হবে সে হাতির চামড়ার পোশাক পরেছে।
ডাডলি এবং আঙ্কল ভার্নন ঘরে ঢুকে নাক কুঁচকালেন–কারণ হ্যারির ইউনিফর্ম থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন পত্রিকার পাতা খুললেন আর ডাডলি লাঠি দিয়ে টেবিল পেটাতে লাগল।
বাইরে ডাকবাক্সে পড়ার শব্দ শোনা গেল।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–ডাডলি যাও তো, চিঠিগুলো নিয়ে এসো।
হ্যারি যাক না। ডাডলি বলল।
হ্যারি, যাও তো চিঠিগুলো নিয়ে এসো আঙ্কল ভার্নন বললেন।
ডাডলি, ওকে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারো তো। আঙ্কল ভার্নন বললেন।
লাঠি তোলার আগেই হ্যারি উঠে ডাক বাক্সের দিকে রওনা দিলো।
হ্যারি গিয়ে দেখল পাপোসের ওপর তিনটা চিঠি পড়ে আছে। একটা পোস্টকার্ড এসেছে আঙ্কল ভার্ননের বোন মার্জের কাছ থেকে। তিনি আইলসঅউইটে ছুটি কাটাচ্ছেন। দ্বিতীয় চিঠি একটি বাদামী খামের ভেতর। কোন বিল থাকতে পারে এতে। তৃতীয় চিঠিতে লেখা–হ্যারির জন্য চিঠি, নিজের চিঠিটি হ্যারি হাতে তুলে নিল। তার বুক ধড়পড় করতে লাগল। তাকে তো এ পর্যন্ত কেউ চিঠি লেখেনি। তার কোন বন্ধু–বান্ধব বা আত্নীয়স্বজনও নেই। তাহলে কে লিখতে পারে? চিঠির খামে হ্যারির নাম লেখা। চিঠি যে হ্যারিকে লেখা এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই।
মি. এইচ. পটার
সিঁড়ির নিচের কাবার্ড
৪, প্রিভেট ড্রাইভ
লিটল হুইংগিং
সারে
চামড়ার মতো শক্ত হলুদ খামে সবুজ অক্ষরে লেখা ঠিকানাটা। ওপরে কোন ডাকটিকেট নেই। হ্যারি খামটা উল্টেপাল্টে দেখল। তার বুক কাঁপছিল। হ্যারি দেখল, খামের ওপর কতগুলো রঙিন ছাপ–সিংহ, ঈগল আর সাপের। চারদিকে বড় অক্ষরে ইংরেজি এইচ লেখা আছে।
রান্নাঘর থেকে আঙ্কল ভার্নন চিৎকার করলেন হ্যারি, জলদি এসো। ওখানে তুমি কী করছ। তুমি কি পত্ৰবোমা পরীক্ষা করছ?
নিজের রসিকতায় আঙ্কল ভার্নন নিজেই হাসলেন।
হ্যারি রান্নাঘরে আঙ্কল ভার্ননের হাতে দুটো চিঠি দিল। তারপর তার নিজের চিঠি খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আঙ্কল ভার্নন চিঠিটা খুলে দেখলেন এবং বিরক্তির সাথে পোস্টকার্ডটি দেখলেন। আন্ট পেতুনিয়াকে বললেন, শুনছ, মার্জ নাকি অসুস্থ। কী এক ঝামেলা।
ঠিক এই সময় ডাডলি দৌড়ে এসে বলল–বাবা, হ্যারি যেন কিছু পেয়েছে।
হ্যারি চিঠিটার ভাঁজ খুলতে যাচ্ছিল। এই চিঠিটার কাগজটিও খামের মত শক্ত। চিঠি খোলার আগেই আঙ্কল ভার্নন এসে হ্যারির হাত থেকে চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন।
এ চিঠি তো আমার। এই বলে হ্যারি চিঠি ফেরত নেয়ার চেষ্টা করল।
তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে। আঙ্কল ভার্নন ঠাট্টা করে বললেন। হাতে ধরা চিঠিটা তিনি বার বার পরখ করে দেখলেন। তারপর পড়তে শুরু করলেন। তার মুখের রঙ ট্রাফিক লাইটের মতো বদলাতে লাগল। লাল থেকে সবুজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখের রঙ হয়ে গেল ধূসর শাদা। অনেকটা পুরনো পরিজের মতো।
তিনি চিৎকার করে উঠলেন–পে–পে–পে–তুনিয়া।
ডাডলি চিঠিটা পড়ার জন্য হাতে নেয়ার চেষ্টা করল। নাগালের বাইরে থাকায় সে ধরতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়া চিঠিটা পড়লেন। প্রথম লাইন পড়েই তার ভিরমি খাবার জোগাড়। তিনি চিৎকার করে উঠলেন–ভার্নন, ওহ মাই গুডনেস, ভার্নন?
আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পরস্পরের দিকে তাকালেন। ঘরে যে ডাডলি আছে তা তারা ভুলেই গেলেন। তবে ডাডলি এ পরিবারে কখনোই অবহেলিত নয়। সে তার লাঠি দিয়ে তাঁর বাবার মাথায় মৃদু টোকা দিল। তারপর চিৎকার করে বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই।
হ্যারি বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই। কারণ আমাকে লেখা।
তোমরা দুজনই ঘর থেকে বেরোও। আঙ্কল ভার্নন ডাডলি ও হ্যারিকে ধমক দিলেন। অবশেষে হ্যারি আর ডাডলিকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়ার পর তিনি নিজেই দড়াম করে রান্নাঘরের দরোজাটা বন্ধ করে দিলেন।
আন্ট পেতুনিয়া বললেন–ভার্নন দেখো তো, চিঠিতে কি ঠিকানা লেখা আছে। হ্যারি কোথায় ঘুমায় এটা তারা জানল কী করে? তোমার কি মনে হয় না, তারা আমাদের বাসার ওপর নজরদারি করছে?
নজরদারি?…তার মানে গোয়েন্দাগিরি। তুমি বলতে চাইছ কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।
তাহলে আমরা কী করব ভার্নন? আমরা কী লিখে দেব–আমরা এ ধরনের কিছু আশা করিনা।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমরা বিষয়টা আমলে আনব না। ওরা যাতে কোন উত্তর না পায়, সেটাই ভালো হবে।
কিন্তু….
আমি ঘরে এসব ঘটতে দেব না, পেতুনিয়া। আঙ্কল ভার্নন বললেন আমরা যখন ওকে ঘরে এনেছিলাম তখনই কি আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি–তার মগজে যা কিছু খারাপ আছে সব ঝেটিয়ে বিদেয় করব!
ওইদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আঙ্কল ভার্নন এমন এক কাজ করলেন যা তিনি জীবনেও করেননি। তিনি কাবার্ডে হ্যারিকে দেখতে গেলেন।
হ্যারি তাকে প্রশ্ন করল, আমার চিঠি কোথায়? কে আমাকে চিঠি লিখেছে?
আঙ্কল ভার্নন বললেন–ভুল করে খামে তোমার ঠিকানা লেখা হয়েছিল। আমি সেই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলেছি।
খামে ভুল ঠিকানা লেখা হয়নি। হ্যারি দৃঢ়তার সাথে বলল-এমনকি ওখানে আমার কাবার্ডের ঠিকানাও ছিল।
চুপ। আর কোন কথা নয়। আঙ্কল ভার্নন ভীষণ জোরে ধমক দিলেন। তার ধমকের শব্দে সিলিং থেকে কয়েকটি মাকড়সা নিচে পড়ে গেল।
ধমকের পর পরিবেশ সহজ করার জন্য তিনি হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার চেহারার কাঠিন্য কিছুতেই দূর হলো না।
হ্যাঁ, হ্যারি। আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমি আর তোমার আন্ট ভাবছিলাম–যেহেতু তুমি বড় হয়েছে সেহেতু তোমাকে আর কাবার্ডে রাখা হবে না। তুমি ডাডলির দ্বিতীয় শোবার ঘরে চলে যাও।
কেন? হ্যারি প্রশ্ন করে বসল।
কোন প্রশ্ন করা যাবে না। আঙ্কল কড়া ভাষায় বললেন–তোমার মালামাল ওপরে নিয়ে যাও।
ডার্সলি পরিবার যে বাড়িতে থাকে সেখানে চারটা কক্ষ। একটায় থাকেন আঙ্কল আর আন্ট, দ্বিতীয় কক্ষটি অতিথিদের জন্য পৃথক করে রাখা হয়েছে, আরেকটাতে থাকে ডাডলি। সর্বশেষ ঘরটা সব থেকে ছোট, এখানে ডাডলির সব খেলনার জিনিসে ভরা। ডাডলির শয়নকক্ষে এগুলোর স্থান সংকুলান হয় না।
অন্যদিকে হ্যারির জিনিসপত্র এত কম যে কাবার্ড থেকে মালামাল নিয়ে সে একবারেই উপরে উঠে গেল।
হ্যারি বিছানায় বসে চারদিকে তাকাল। ঘরের প্রায় সব জিনিসই ভাঙা।
মাত্র এক মাসের পুরনো সিনেমা ক্যামেরাটি ভাঙা, ভাঙা টেলিভিশনও, এছাড়া আছে পাখির একটি বড় খাঁচা, যেটায় কাকাতুয়া থাকত। এছাড়াও আছে ভাঙা এয়ারগান। র্যাকগুলোতে অসংখ্য বই। বই গুলো দেখেই বোঝা যায় যে এখনও কেউ স্পর্শ করেনি। নিচ থেকে ডাডলির বিরক্তির কথা শোনা যাচ্ছিল মা, আমি চাই না সে ওই ঘরে থাকুক। সে এখানে থাকতে পারবে না। ঘরটা আমার, ঘরটা আমার লাগবে।
হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগল, গতকাল হলেও ওপরতলার ঘরে আসার জন্য হ্যারি সম্ভব সব ধরনের চেষ্টাই চালাত। আর আজ তার কাছে কাবার্ডই বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ কাবার্ডের ঠিকানাতেই তার চিঠিটা এসেছে।
***
পরদিন সকালে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কিন্তু ডাডলির রাগ আর ছটফটানি দেখে কে? সে বাবাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল। মাকে লাথি মারল। তার ছোট খরগোশটা ছুঁড়ে ফেলল। হ্যারি ঘর ছাড়েনি। আঙ্কল আর আন্ট গম্ভীর মুখে পরস্পরের দিকে তাকালেন।
পরদিন যখন ডাকপিয়ন এলো তখন আঙ্কল ভার্নন হ্যারিকে নয়, নরম স্বরে ডাডলিকে বললেন–বাবা যাও তো! চিঠিগুলো নিয়ে এসো। ডাডলি তার লৌহদণ্ডে দুম দাম শব্দ করতে করতে হল ঘর পার হয়ে চিঠি আনতে দরোজার দিকে গেল।
সেখান থেকেই ডাডলি চিৎকার করে উঠল, আবার একটা চিঠি এসেছে। ঠিকানা লেখা আছে–
মি, এইচ পটার
স্মলেস্ট বেডরুম
৪ প্রিভেট ড্রাইভ
আর্তনাদ করে উঠলেন আঙ্কল ভার্নন এবং চেয়ার থেকে উঠে হল রুমের দিকে ছুটলেন। হ্যারি তার পেছনে পেছনে ছুটলো। চিঠিটা হাতে নেয়ার জন্য ডাডলিকে মাটিতে ফেলে দিলেন ভার্নন। এদিকে হ্যারি পেছন থেকে তার গলা ধরে ঝুলে পড়ার কারণে চিঠিগুলো ডাডলির কাছ থেকে কেড়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। প্রত্যেকের গায়েই লোহার রডটা আঘাত করেছে। একটা বিভ্রান্তিকর এলোমেলো পরিস্থিতির পর পর–আঙ্কল ভার্নন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং হ্যারিকে লেখা চিঠিখানা খামচে ধরলেন।
আঙ্কল ভার্নন নির্দেশ দিলেন–হ্যারি তোমার কাবার্ডে… মানে তোমার শোবার ঘরে যাও…. আর ডাডলি তুমিও এখান থেকে ভাগো।
হ্যারি তার নতুন শোবার ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। হ্যারি নিশ্চিত হল–তাকে যিনি চিঠি দিয়েছেন তিনি জেনেছেন হ্যারির ঘর বদল হয়েছে এবং হ্যারি আগের চিঠিটা পায়নি। তিনি নিশ্চয়ই আবার চিঠি লিখবেন। এবার তাকে চিঠিটা পেতেই হবে। হ্যারি একটা পরিকল্পনার কথা ভাবতে লাগল। সে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখল।
পরদিন সকাল ৬টায় ভাঙা ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠল। ভোরের আলো তখনও ঘরে প্রবেশ করেনি। হ্যারি অ্যালার্ম বন্ধ করে চুপি চুপি জামা পরে নিল। ডার্সলি পরিবারের কাউকেই সে জাগাবে না। কোন বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। হল ঘর পার হয়ে সে দরোজার কাছে গেল। তার ইচ্ছে ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোনায় দাঁড়ানো যাতে ডাক পিয়ন আসা মাত্রই সে চিঠি তার হাতে নিতে পারে! দরোজার কাছাকাছি পা দিতেই…
হঠাৎ আ–র–র–র—
হ্যারি লাফ দিয়ে উঠল। আরে পাপোসের ওপরে কি যেন! আরে এ যে জীবন্ত প্রাণী।
হ্যারির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। এ কী, এ যে আঙ্কল ভার্নন। তিনি দরোজার গোড়ায় একটি স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়ে আছেন। হ্যারি এমন কিছু একটা করবে তার মনে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আঙ্কল ভার্নন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা হ্যারিকে বকাঝকা করলেন। তারপর হুকুম দিলেন চা বানাবার জন্য। হ্যারিকে রান্নাঘরে ঢুকতে হল। চা নিয়ে এসেই হ্যারি দেখে যে ডাকপিয়ন এসে গেছে এবং চিঠিগুলো আঙ্কল ভার্ননের কোলে। হ্যারি লক্ষ্য করল তিনটা চিঠিই সবুজ কালি দিয়ে লেখা।
হ্যারি বলল–আমার চিঠি কোথায়?
এর মধ্যে আঙ্কল ভার্নন সব চিঠির খাম খুলে ফেলেছেন।
তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে? আঙ্কল ভার্নন প্রশ্ন করলেন। তোমাকে কেউই চিঠি লিখবে না। আঙ্কল ভার্নন আবার বললেন–ওই চিঠিতে ভুল করে তোমার নাম লেখা হয়েছিল।
আমার চিঠি কোথায়? হ্যারি প্রশ্ন করল। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আঙ্কল ভার্নন হ্যারির সামনেই সবগুলো চিঠি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।
তিনি সেদিন আর অফিসে গেলেন না। সারাদিন বাসায় কাটালেন। ডাকবাক্সটাতে এমনভাবে পেরেক ঠুকে দিলেন যাতে এখানে কেউ চিঠি ফেলতে না পারে।
ভালোই হলো। আন্ট পেতুনিয়া মন্তব্য করলেন-এখন তারা আর চিঠি দিতে পারবে না। চিঠি দিতে হলে তাদেরকে ওপরে উঠতে হবে।
আঙ্কল ভার্নন ততটা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। তিনি বললেন-এসব লোক আমাদের মত নয়। সব সময়ই এরা নতুন নতুন ফন্দি–ফিকির বের করতে জানে।
***
শুক্রবারে হ্যারির নামে কম করে হলেও বারোটা চিঠি এলো।
ডাকবাক্সে ফেলা সম্ভব হয়নি বলে চিঠিগুলি এবার দরোজার নিচের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু চিঠি বাথরুমের জানালা দিয়েও ভেতরে ফেলা হয়েছে। আঙ্কল ভার্নন এদিনও অফিসে গেলেন না। বাসাতেই কাটালেন। তিনি হাতুড়ি, পেরেক আর ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে দরোজা ও জানালার সবগুলো ফাঁক বন্ধ করলেন।
শনিবারে আরো বড়ো অঘটন ঘটল। হ্যারির নামে চব্বিশটা চিঠি এলো। চিঠিগুলো দুডজন ডিমের বাক্সের ভেতর পাঠানো হয়েছিল। ডেইরির লোকেরা কিছু বুঝতে না পেরেই শয়নকক্ষের জানালা দিয়ে ডিমগুলোর সাথে চিঠিগুলো আন্ট পেতুনিয়ার কাছে দিয়েছিল। ক্ষিপ্ত হয়ে আঙ্কল ভার্নন ডাকঘর আর ডেইরিতে বার বার ফোন করলেন। আর আন্ট পেতুনিয়া চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ফুড মিক্সচারে দিয়ে নষ্ট করে ফেললেন।
ডাডলি বিস্ময়ের সাথে হ্যারিকে প্রশ্ন করল–তোমার সাথে কথা বলার জন্য কে এমন উতলা হল?
***
রোববার সকালে আঙ্কল ভার্নন নাশতার টেবিলে বসলেন। তিনি পরিশ্রান্ত। তবে তাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল।
তিনি বললেন–আজ রোববার, ছুটির দিন। আজ আর কোন চিঠি আসবে না।
কিন্তু হঠাৎ রান্নাঘরের চিমনিতে শব্দ শোনা গেল। কিছু যেন গড় গড় করে চিমনি বেয়ে নিচে পড়ছে। তিনি যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। উনুনের চিমনি দিয়ে তিরিশ চল্লিশটা চিঠি বুলেটের মত বেরিয়ে এল। ডার্সলি পরিবারের সবাই অবাক। আর চিঠিগুলো ধরার জন্য হ্যারি লাফ দিল।
বের হও! এখান থেকে বের হও!
আঙ্কল ভার্নন হ্যারির কোমর জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তাকে রান্নাঘর থেকে হল ঘরে ছুঁড়ে ফেললেন। আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বাইরে চলে গেল। আঙ্কল ভার্নন দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। চিঠিগুলো দেয়াল এবং মেঝেতে এসে পড়েছে-এ শব্দ তাদের কানে আসছিল। রাগে ক্ষোভে টান দিয়ে গোঁফ ছিঁড়তে ছিঁড়তে আঙ্কল ভার্নন বললেন–তোমাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তোমরা তোমাদের গুটি কয়েক জামা–কাপড় নিয়ে নিচে নেমে আসবে। আমরা এখান থেকে চলে যাব। এই বিষয়ে আর কোন কথা নয়।
আঙ্কল ভার্ননের অর্ধেক গোঁফ উড়ে যাওয়ায় তাকে খুবই ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। তাই কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করতে সাহস করল না। সবাই গিয়ে গাড়িতে বসল। ডাডলি পেছনে বসে ফুঁসছিলো। কারণ সে তার টেলিভিশন, ভিডিও আর কম্পিউটার সাথে নেয়ার জন্য প্যাক করছিলো। আঙ্কল ভার্নন তার মাথার চারদিক চেপে তাকে জোর করে উঠিয়ে দেন।
গাড়ি চলছে তো চলছেই। আন্ট পেতুনিয়ারও সাহস হলো না প্রশ্ন করে, গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন একটু পর পরই ডানদিকে বামদিকে কঠিন মোড় নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
খাওয়া–দাওয়ার জন্যও গাড়ি কোথাও থামল না। সন্ধ্যা হতেই ডাডলির বিলাপ শোনা যেতে লাগল। তার জীবনে কোন দিন এত খারাপ যায়নি। সে খুবই ক্ষুধার্ত। সে টেলিভিশনের পাঁচটা প্রোগ্রাম মিস করেছে যা সে দেখতে চেয়েছিল। তাকে এত খেসারত দিতে হবে জানলে সে গাড়িতেই উঠত না। অবশেষে আঙ্কল ভার্নন এক শহরতলীতে এসে একটা হোটেলের সামনে তার গাড়ি থামালেন। একটা ঘরে দুটো নোংরা বিছানায় হ্যারি আর ডাডলিকে খাকতে হল। ডাডলি বিছানায় পড়েই নাক ডাকা শুরু করল। হ্যারির চোখে কোন ঘুম নেই। হ্যারি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চলন্ত গাড়িগুলোর আলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
পরদিন সকালের নাশতায় তারা খেলো বাসি কর্নফ্লেক ও টোস্টের সাথে টিনের টমেটো। নাশতা খাবার পর পরই হোটেলের মালিক তাদের টেবিলে এলেন।
তিনি বললেন-এক্সকিউস মি, আপনাদের মধ্যে হ্যারি পটার কে? তাঁর নামে ফ্রন্ট ডেসকে একশ চিঠি এসেছে।
হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা একটা চিঠি তাদের সামনে তুলে ধরলেন। সবুজ কালিতে লেখা–
মি. এইচ. পটার
কক্ষ নং–১৭
রেইলভিউ হোটেল
ককওয়ার্থ
চিঠিটা নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল। হ্যারির হাতটি আঙ্কল ভার্নন সরিয়ে দিলেন। হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা বিস্মিত হলেন। আঙ্কল ভার্নন উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে বললেন–চলুন। আমি চিঠিগুলো নেব।
***
কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আন্ট পেতুনিয়া ভয়ে ভয়ে বললেন–ঘরে ফিরে গেলে কি ভালো হত না?
কিন্তু আঙ্কল ভার্নন তার কথায় কান দিলেন না। তিনি যে ঠিক কী চাইছেন তা অন্য কেউ জানে না। তিনি গাড়ি চালিয়ে একটি গভীর বনে প্রবেশ করলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। চারদিকে তাকালেন। মাথা নাড়লেন। আবার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। এ রকম ঘটনা আরো একাধিকবার ঘটল।
ডাডলি বলে উঠল–বাবার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
সমুদ্র উপকূলের কাছে এসে আঙ্কল ভার্নন গাড়ি পার্ক করলেন। সবাইকে গাড়ির ভেতর বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেলেন। বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাড়ির ছাদেও বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল।
ডাডলি তার মাকে বলল–আজ সোমবার। আজ রাতে টিভিতে দ্য গ্রেট হামবেটেসি আছে। আমি যদি টিভি আছে এমন স্থানে থাকতে পারতাম।
সোমবার হ্যারিকে কষ্ট করে মনে করতে হয় না, আজকে কি বার। কোনদিন সোমবার তা জানার জন্য ডাডলির ওপর নির্ভর করা যায়, কারণ সোমবারের টিভির প্রিয় এই প্রোগ্রামের জন্য দিন গুনতে থাকে সে। আগামীকাল মঙ্গলবার। আগামীকাল হ্যারির একাদশ জন্মদিন। অবশ্য এ বাড়িতে হ্যারির জন্মদিনের কোন গুরুত্ত্ব নেই। গত জন্মদিনে সে ডার্সলি পরিবার থেকে পেয়েছিল একটি কোট হ্যাঙার এবং আঙ্কল ভার্ননের এক জোড়া পুরনো মোজা। প্রতিদিনই তো বয়স এগারো থাকে না।
আঙ্কল ভার্নন ফিরে এলেন। মুখে ঈষৎ হাসি। হাতে লম্বা ও সরু একটা প্যাকেট।
কী কিনেছো? আন্ট পেতুনিয়া জানতে চাইলেন। তিনি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন–চমৎকার একটা জায়গা পেয়েছি। সবাই গাড়ি থেকে নামো।
গাড়ির বাইরে খুব ঠাণ্ডা। আঙ্কল ভার্নন যে জায়গাটা দেখালেন সেটা একটা শিলাময় ছোট দ্বীপ। এর মাঝখানে পুরনো একটা ছোট বাড়ি। এ বাড়িতে যে কোন টেলিভিশন নেই–তা হলফ করেই বলা যায়।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে আজ রাতে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বীপটাতে যাবার জন্য এই ভদ্রলোক আমাদেরকে তার নৌকাটা ধার দিয়েছেন।
ফোকলা মুখের এক বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে একটা নৌকা দেখিয়ে তাদের সেদিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তার মুখে কপট হাসি।
আমার কাছে এখনো কিছু খাবার আছে। সবাই নৌকায় ওঠো। আঙ্কল ভার্ননের নির্দেশ।
নৌকাতে হিমেল হাওয়া। সাথে বৃষ্টি। সবাই ঠাণ্ডায় অস্থির। মনে হলো কয়েক ঘণ্টা যাত্রার পর তারা দ্বীপে পৌঁছল। আঙ্কল ভার্নন তাদেরকে একটি ভাঙা বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
বাড়ির ভেতরটা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। ঘরের ভেতরে সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ। ফায়ার প্রেস স্যাঁতসেঁতে, কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের বাতাসের শো শো শব্দ। বাড়িতে মাত্র দুটো কক্ষ।
আঙ্কল ভার্ননের খাবার ভাণ্ডারে যা ছিল তা হল মাত্র এক প্যাকেট মচমচে বিস্কুট ও এক হালি কলা।
তিনি ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে কোন কাঠ নেই, একেবারেই খালি।
আঙ্কল ভার্নন আনন্দের সাথে মন্তব্য করলেন–যাক, এখানে কোন চিঠি আসবে না। তিনি নিশ্চিত যে এই ঝড়ের রাতে কেউ তাদের কাছে আসতে পারবে না। রাত নামলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মোতাবেক ঝড় শুরু হলো। সমুদ্রের তরঙ্গ দেয়ালে ছিটকে পড়ছে। বাইরের ঝড়ো বাতাস জরাজীর্ণ ও নোংরা জানালায় আঘাত করছে।
আন্ট পেতুনিয়া একটা পোকায়–কাটা সোফার ওপর কম্বল বিছিয়ে ডাডলির শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পাশের কক্ষে চলে গেলেন। হ্যারি মেঝের ওপর একটা ছেঁড়া পাতলা কম্বল বিছিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঝড়ের বেগও বাড়তে লাগল। হ্যারি ঘুমোতে পারল না। একটু আরাম পাবার জন্য এপিঠ–ওপিঠ করছে। পেট খিদেয় চো চো করছে। অপরদিকে ডাডলি নিশ্চিন্তে নাক ডাকছে। তার হাতঘড়ির আলো একটু পর পর ঠিকরে পড়ছে। অন্ধকারে ঘড়ির আলো থেকে হ্যারি বুঝতে পারল আর দশ মিনিটের ভেতর তার বয়স এগারো পূর্ণ হবে। ডাডলি ভাবছিল পত্রলেখক এখন কোথায়।
পাঁচ মিনিট পর হ্যারি বাইরে যেন কিসের আওয়াজ শুনল। তার ভয় হচ্ছিল–ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়বে না তো? ছাদ ভেঙে পড়লে সে অবশ্য আরো বেশি উষ্ণতা উপভোগ করতে পারত।
আর চার মিনিট বাকি–হয়তো বা প্রিভেট ড্রাইভে এত চিঠি আসবে যে সারা বাড়ি চিঠিতে ভরে যাবে। সেখান থেকে যেভাবেই হোক অন্ততঃ একটা চিঠি চুরি করতে হবে। তিন মিনিট বাকি।
সমুদ্রের ঢেউ কি এ বাড়ির ওপর আছড়ে পড়ছে।
এখনও দু মিনিট বাকি।
অদ্ভুত শব্দ। সাগরে শিলাখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে?
আর একটা মিনিট।… তিরিশ সেকেন্ড… কুড়ি সেকেন্ড…. দশ,.. নয়… বিরক্ত করার জন্য হলেও ডাডলিকে জাগাবে কি?
তিন… দুই… এক… বুম। বুম।
হঠাৎ বিকট আওয়াজ।
গোটা দ্বীপটা কেঁপে উঠল, হ্যারির দরোজায় কে যেন খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ছে। কে যেন ভেতরে আসতে চায়।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now