গোয়েন্দার ভালোবাসা

X বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে আলিফ । ‘কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি_’ ব্যাস ! শেষ । আর কিছু নেই লেখা । বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি ? বেশি নাকি কম ? ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও । তারপর পাশে বসা নীলাভের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয় । ‘গুতাস ক্যারে ?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে নীলাভ । ‘আরে কান্ডটা দ্যাখ !’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা । ‘কোথায় পাইলি ?’ ‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল । কলম রাখি যে পকেটে ।’ ‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো ।’ ‘আরে তুই বের করতে পারবি না ?’ ‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই ।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে নীলাভ । বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে । আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ । আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও । ‘কিছু পেলি ?’ ‘হুম !’ মাথা তুলে নীলাভ । ‘কিন্তু আগে বলুম না । তুইও দেখ । তারপর একলগে ।’ আলিফও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে – এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন এজাজ স্যার । ইনি ইংরেজী পড়ান । সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে । কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস । লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট । এজাজ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন । নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে আলিফ কাগজটার ওপর । হাতে আতশী কাচ । পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে রিচি আর শিমু । ‘উমম...’ মাথা তোলে এবার আলিফ । ‘যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা । তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি ... ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম ... কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে ...উহু,থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়...আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ । অ্যাম আই রাইট ?’ ‘সাবাশ !’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় নীলাভ । ‘প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি ! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার । সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে । মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া । আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে ।’ নীলাভ কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত । একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া বিল্লাদের মোবাইলটা বের করতে নীলাভের লাগে সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা । আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট । কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি । প্রথম কয়েক সপ্তাহ ওর নিকনেইম ‘ভোটকা’ হয়ে গেলেও কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখে । এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করে ও । সমাধানের হার শতভাগ । সেই নীলাভের পাশে বসে আরিফের ব্যাগে অপরিচিত নোট লেখে যাবে কোন একজন – নীলাভের ভাষায় – ‘মাইয়া’ – আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা – এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা । কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় আলিফ । ‘কোন মেয়ের লেখা – আর তাও সেটা পালটে ?? এগুলো কিভাবে বললি ?’ ‘খেয়াল করলে তুইও পারতি ।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে – এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় নীলাভ । ‘হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয় । লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত । ওগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো গোছানো ধরণ আছে । ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া । আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর – হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে – অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে । শিওর !’ এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায় । ‘সাবাশ দোস্ত !’ নীলাভের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও । ‘বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’ ‘চমৎকার !!’ এজাজ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল । ‘ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের ! কি মোহাব্বত ! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন ।’ ‘ওহ শিট !’ বিড় বিড় করে আলিফ । হেসে কুটি কুটি হয় রিচি আর শিমু । ✭ কলেজ থেকে বের হয়ে নীলাভের হাতে কাগজটা তুলে দেয় আলিফ । ‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ । পরে কাজে লাগতে পারে ।’ ‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত ।’ ‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার ।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ । ‘ওই যে রিচি চলে এসেছে । যা তুই । কাল দেখা হবে ।’ হতাশায় মাথা নাড়ায় নীলাভ । নীলাভের বাসা একদিকে আর আরিফের আরেকদিকে । ওদের পাশের বাসায় থাকে রিচি । কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয় । বাসে উঠে পাশাপাশি বসে ওরা । এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না রিচি । ‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা ।’ ‘কই না তো !’ আপত্তি করার চেষ্টা করে আলিফ । ‘কি ছিল রে ? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি ? বেনামী ?’ মজা পায় রিচি ওকে বিব্রত হতে দেখে । ‘এক রকম । লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল ।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় আলিফ । তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে । ‘তুই জানলি কি করে ? তোর কাজ এইটা ??’ চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় রিচির । ‘জানব কি করে ? গেস করেছি । যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি । তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে শিমুর সাথে বেরিয়ে যাই আমি ।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে ।’ ‘মানে কি !! কি হবে আমার ?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন আলিফ । ‘দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না ? প্রেম হবে তোর ।’ ‘শোন !’ জোর গলায় বলে আলিফ, ‘যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই – এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না । আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী । হুহ !’ ‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় রিচি । ‘যেই না উনার সাহস । আর চায় সাহসী প্রেমিকা !’ রিচিকে কিল দেয় আলিফ । ‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে ।’ অভিমানী গলায় বলে ও । আরেকটা কিল দেয় আলিফ । বাস ছুটে চলে ।    পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে আলিফ । ‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন ?’ বিরক্ত হয় নীলাভ । ‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না !’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার আলিফ । ‘এইটা দ্যাখ !’ বেশ বড় একটা খাম । তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি । সেটা বড় কথা না । চিঠিটা রক্তে লেখা । ‘আলিফ , এতদিন ধরে পাশে রেখেছ । বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবো নি কোনদিন । জানি আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায় । কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর । ভালোবাসি তোমায় এতটা । মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না । তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না । বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব – আমি ভালোবেসে যাব তোমায় – আজীবন ।’ ‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম !’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে নীলাভ । মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায় । ‘নাম নেই ।’ চোখ তোলে আলিফ। ‘কে হতে পারে ।! কে ?? জানাটা দরকার । এত পাগলামী কেন করবে ?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ‘মাননীয় স্পীকার !!’ ‘হ !’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় নীলাভ । ‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস ? আমাকে জানা । ’ চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে নীলাভ । তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে । ‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব !’ ‘বসে আছিস কেন ? করে আন !’ তাড়া দেয় আলিফ । ‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা ?’ ঝাড়ি মারে ওকে নীলাভ । হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয় । ‘তয় – এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে ।’ ‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার ।’ ‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না । হইয়া গেছিলাম । এখন নাই আর ।’ বলে নীলাভ গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় আলিফকে । আবার বলে তারপর, ‘ঠিকানা নাই – কথা সত্য । কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায় । শুইকা দেখ !’ আরিফের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও । ‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না ।’ নাক মুখ কোঁচকায় আলিফ । ‘তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিলে বসে থাক !’ অক্ষরে অক্ষরে আরিফের নির্দেশ পালন করে নীলাভ । নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক । তারপর মুখ তোলে । ‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি । তুই শুইকা দেখ ।’ ‘মরলেও না !’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় আলিফ । হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় নীলাভ । শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম – হাত বাড়ায় আলিফ । একমিনিট পর মাথা তোলে । ‘গন্ধটা আমার পরিচিত । দোস্ত – কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি ?’ ‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম !’ গ্যারান্টী চায় নীলাভ । ‘না করব না । বল ?’ ‘আমার তো রিচিরে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে ।’ ‘আরে নাহ ।’ আপত্তি জানায় আলিফ নিজেই । ‘কাল ওকে চার্জ করেছিলাম । কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায় । আজও আমার সন্দেহ যায় নি – তাই খেয়াল করেছি – সবার আগে ও আর শিমু বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে ।’ ‘আরে বলদা রে !’ আরিফের বুদ্ধির প্রশংসা করে নীলাভ । ‘এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই – আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে ! ’ ‘হুম ...’ টোকা দেয় আলিফ টেবিলে, ‘লাফিয়ে না ঢুকলেও – আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে ...’ হঠাৎ নীলাভের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায় । ফিসফিস করে বলে, ‘আলিফ, দ্যাখ !! রিচির ডান হাতের দিকে তাকা !’ তাকিয়ে চমকে যায় আলিফ । রিচির ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে । হাত কেটে গেছে ? নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লেখেছে ও ? ✭ ‘আজ পারলে রিচিরে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত ।’ সাজেশান দেয় নীলাভ ওকে । ‘মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব । হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান ?’ ‘হুঁ ।’ সায় দেয় আলিফ । ‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু ? এভিডেন্স তো ।’ ‘না । ওটা আমার কাছেই থাকুক ।’ ‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না । যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার ।’ ‘আচ্ছা ।’ আরিফের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত। দেখে সন্তুষ্ট হয় নীলাভ । ছেলে রিচিকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর । বাসে উঠে ওই ব্যাপারে রিচিকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ আলিফ । ‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে ?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে । ‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে । কাটাকাটি পারি না তো !’ হাই চেপে বলে মেয়েটা ।  ‘ওহ ।’ কি বলবে ভেবে পায় না আলিফ । ‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে ।’ চোখ বোজে ও । ‘আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু ।’ রিচির চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে আলিফ । কিন্তু কিসের কি ! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম ! ‘স্বাভাবিক । সারা রাত কেটেছ হাত ।’ মনে মনে বলে আলিফ । ‘গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই । ’ মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর । বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে । দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা । আলতো করে রিচির ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে আরিফের কাঁধে । সরাতে গিয়েও সরায় না ও । খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর । ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় আরিফের । মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে ।    পরদিন সকাল । লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে রিচি আর আলিফ । আজ যা কথা বলার বলে ফেলতে চায় আলিফ ওকে । নীলাভকেও আসতে বলেছে । কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে । অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য । “যতই স্থুল হবে তুমি - গতিবেগ ততই কমবে তোমার” – নীতিতে বিশ্বাসী আলিফ ; নীলাভের দেরীকে গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে আসে । ‘রিচি, – তোর সাথে কিছু কথা ছিল ।’ ‘আমারও ।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে রিচি আজ । নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না আলিফ । সন্দেহ ভুল হলে ; অর্থাৎ রিচি ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে । আলিফ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে – নিজের কাছে আর লুকাতে পারে নি ও । গতকাল বাসেই অনুভূতিটা বুকে একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল । ভাগ্যিস – ঘুমাচ্ছিল রিচি । নাহলে কেলেংকারী হয়ে যেত ! ‘বল তাহলে ।’ রিচিকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় আলিফ । ‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয় ।’ শ্রাবণের মেঘ জমে রিচির মুখে । ‘আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না ।’ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আলিফ । ‘তোকে ভালোবাসি আমি, আলিফ !’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে রিচির গাল বেয়ে । ‘অ্যাই বোকা মেয়ে ! কাঁদছিস কেন ?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় আলিফ । ‘তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি । কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও । দেখ তো কি রকম গাধা আমি !’ চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে রিচি । এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে নীলাভ । রিচির কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও । বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে । গোয়েন্দা নীলাভের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ । ‘তুই একটা পাগলি, রিচি !’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে আলিফ । ‘আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি । নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায় । তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লেখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস ! এরপর যদি আর ...’ রিচির মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় আলিফ । ‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি ? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি ?’ ‘তুই লেখিস নি বলতে চাস -’ এক সেকেন্ড ভাবে আলিফ । ‘তাই তো ! আমি আগে কেন বুঝি নি ?? ‘স্বস্তি’ লেখা ছিল চিঠিতে । ’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা । “তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না” লাইনটা দেখায় রিচিকে ও। ‘কলম দিয়ে ‘স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে । কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লেখবে না । প্যাঁচ দেখেছ ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে । এইটা এই মোটকুর কাজ । নির্ঘাত !! ’ একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও নীলাভের দিকে । ‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে ?’ হাহাকার করে ওঠে নীলাভ । ‘দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাংখা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট ।’ ‘দাঁড়া বলিস না ।’ হাত তুলে ওর দিকে আলিফ । ‘আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা । আর লেখাইছিস তোর বড়বোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা । আর রক্ত ... উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আন্টির কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস । আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না । খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ । অ্যাম আই রাইট ?’ ‘পুরাই ।’ মাথা নাড়ায় নীলাভ । ওর মা একজন বায়োলজিস্ট । ‘ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া মা কাজ করতাছিল । ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে । দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও । নিয়া আইতে চাইলাম । দিয়া দিল । তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা ।’ ‘ইয়াহ !’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় আলিফ । ‘এইটা আট নম্বর ।’ ‘দাঁড়া দাঁড়া!’ ধরে ফেলে রিচি, ‘কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না আলিফ ? তারপর নীলাভকে দিয়ে বলাইছিলি ? হুম – ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই –’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ রিচি আলিফকে । তবে ওই একমুহূর্তই । ‘তুই একটা ইবলিশ রে !’ কিল দেয় রিচি আলিফকে এবার । ‘তোর মাথা ।’ এড়িয়ে যাতে চায় আলিফ । আবার কিল দেয় ওকে রিচি । এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক । একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে নীলাভ । বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি ।