বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ফেরাউনের গুপ্ত ধন5

"রহস্য" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান MD: Naim Islam (০ পয়েন্ট)

X সেখানকার অবস্থা জানার জন্য এবং শক্ৰদের পরিকল্পনা ও পরবর্তী পদক্ষেপের আগাম সংবাদ জানার জন্য সুলতান আইয়ুবী তিনজন ঝানু গোয়েন্দা প্রেরণ করে ছিলেন। তাদের কাজ ছিল আক্রার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সংগ্রহ করে নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌছানো। এদের কমান্ডার ছিল ইমরান নামে এক নিভীক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দা। এই গোয়েন্দাকে আলী বিন সুফিয়ানই বাছাই করে পাঠিয়েছিল। এই তিনজন খুব সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আক্রাতে পৌছল। সুলতান আইয়ুবী সুবাক দূর্গ ও শহর জয় করায় সেখানকার অসংখ্য খৃস্টান ও ইহুদী আক্রাতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা ক্রাকের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এই দূর্গ ও শহর যখন জয় করে নিল, তখন সেখান থেকেও ইহুদী খৃস্টানরা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে গেল। এই দুটি বিজিত শহর ও দূর্গের আশপাশের এলাকা থেকেই ইহুদী ও খৃস্টানরা পালিয়ে গিয়েছিল। সৈন্যদের মধ্যেও সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের লোক ছিল। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশে তাদের মধ্য থেকে কিছু গোয়েন্দা খৃস্টানদের ছদ্মবেশ নিয়ে খৃস্টান এলাকায় চলে গেল। এর মধ্যে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হল, তারা যেন আক্রা থেকে শক্ৰদের যুদ্ধ প্ৰস্তৃতির সংবাদ সংগ্রহ করে কায়রোতে পাঠায়। তাদের বলা হলো, খৃস্টান ও ক্রুসেডদের সকল গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং প্রয়ােজনীয় তথ্য জরুরীভাবে পাঠানাের ব্যবস্থা করবে। অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত ওসব অঞ্চলে মুসলিম শক্তি ও সৈন্যরা এগিয়ে গেলে সেখানকার জনগণের মধ্যে তার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং ওই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় এসব ব্যাপারেও তাদের রিপোর্ট করতে বলা হল। গোয়েন্দা তিনজন বাস্তুহারা খৃস্টানদের ছদ্মবেশে আক্রাতে প্রবেশ করলো। সে সময় প্রতিদিনই বাস্তুহারা খৃস্টান ও ইহুদীরা লাইন ধরে আক্রাতে প্ৰবেশ করছিল। তাদের চেহারায় ছিল নিরাশা ও হতাশার ছাপ। এসব উদ্বাস্তু আশ্রয় প্রাথীদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আয় উপার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। দু’বেলা ঠিকমত খাবারও কোন সংস্থান ছিল না। ইমরান ও তার দুই সখী খৃষ্টান সেজে সেখানে আশ্রয় প্রাথী হলো। তিনজনই খুব চালাক, সতর্ক ও শিক্ষিত ছিল। ইমরান সোজা বড় পাদ্রীর কাছে চলে গেল। সে তার বাড়ি এমন এলাকায় বললো, যে এলাকা মুসলমানদের অধিকারে চলে গেছে। নিজেকে সে বিপন্ন ও অসহায় বলে প্ৰকাশ করলো। খৃষ্ট ধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পাগল হিসাবে জাহির করলো নিজেকে। সে পাদ্রীর সামনে কেঁদে কেঁদে বললো, তার বিবি বাচ্চারা সবাই মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। তার এখন আর কোন-পিছু টান নেই। বিবি বাচ্চার জন্য পেরেশানী নেই। সে বলল, বাকি জীবন গির্জার সেবায় কাটিয়ে মরতে চাই।” তোমার নাম কি?” পাদ্রী প্রশ্ন করল। সে তার নাম বললো, জন গিন্থার। গিজায় থাকতে হলে যিশুর পুত্র হয়ে থাকতে হবে। দুনিয়ার প্রতি কোন টান থাকলে তো চলবে না।” “আমি তো চিরকালই দেওয়ানা হয়ে জীবন কাটিয়েছি। দুনিয়ার প্রতি আমার কোন লোভ কোন কালেই ছিল না। বিবি বাচ্চাদের খোঁজ খবরও নিতাম না। সব সময়। এ জন্য আমার বিবি ও শিশুরা কাদাকাটি করত, আর অভিযোগ করে বলতো, আমি নাকি কোন কাজকর্ম করি না। শুধু আত্মার শান্তির জন্য ছুটে বেড়াই। একবার এ জন্য আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম। আমাদের এলাকায় এক মৌলভী সাহেব ছিলেন। আমার দেওয়ানা হালত দেখে বললেন, “জন, খোদা তো মসজিদে থাকে, তুমি কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?” তার কথাবার্তা শুনে খোদাকে পাওয়ার জন্য আমি তো প্ৰায় ইসলাম গ্রহণই করে ফেলেছিলাম।” ইমরান পাদ্রী সাহেবকে আরো বললে, “আমার বিশ্বাস আমার স্ত্রী ও সন্তানরা মুসলমানদের হাতে নিহত হওয়ায়, খোদা তাদেরকে তার শান্তির আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। কারন আমি এমন অপদার্থ স্বামী ও বাবা ছিলাম, তাদের কোন রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারতাম না। খোদাই আমার পরিবারের দেখাশোনা করতেন। আমার সন্তানরা মাকে ছাড়া থাকতে পারতো না। আমি তাদের সম্পর্কে গাফেল ছিলাম বলে ওদের মা-ই ছিল ওদের একমাত্র আশ্রয়। জন গিন্থার কেদে কেটে পাদ্রীকে বলল, মুসলমানরা আমার বিবি ও সন্তানদের হত্যা না করলে আমি হয়তো ইসলাম কবুল করেই ফেলতাম। তারা কেবল তাদেরই হত্যা করেনি আমার উপরেও অনেক অত্যাচার করেছে। এখন আমি জানি, এই খুনীদের অন্তরে খোদা থাকতে পারে না। মুসলমানদের অন্তরে খোদা নেই, আছে অন্য কোথাও, আছে এই গির্জায়।’ ইমরান সহসা পাদ্রীর কাধে হাত দিয়ে তাকে ঝাকুনী দিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘পবিত্র বাবা! আমাকে বলো, আমি তো পাগল হয়ে যাইনি? বলাে, আমি এখন সত্যকে চিনেছি, ঠিক বুঝেছি, বলো, নাহলে আমি আমার জীবন নিজের হাতেই শেষ করে দেবো। আমি পরকালে খোদাকে বলবো, তুমি পথপ্রদর্শক ছিলে না, শুধু ধর্মের নামে ঢং করেছো, লোকদের ধোকা দিয়েছো!” তার মানসিক অবস্থা দেখে ক্রুসেডের মহান রক্ষক চমকে উঠলেন। তিনি ইমরানের মাথায় হাত রেখে বললেন, “হে আমার বিপন্ন সন্তান! খোদা তোমার বুকের মধ্যেই আছেন। তিনি তোমাকে খোদার বেটার পুজারীদের মধ্যেই রাখবেন। তুমি খৃষ্টান, জন গিন্থর, তুমি এই ধর্মেই, এই সুরতেই খোদাকে পাবে। তুমি যাও, প্রতিদিন সকালে আমার সাথে দেখা করবে। আমি তোমাকে তোমার অন্তরের খোদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।” “আমি আর কোথাও যাব না মুকাদাস বাপ!” ইমরান বললো, “আমার কোন বাড়ী নেই। দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে আপনার কাছে রাখুন!! আমি আপনার ও খোদার বেটার এই গির্জার এমন খেদমত করবো, যেমন আর কেউ করেনি।’ ইমরান ও তার সাথীরা খৃষ্টান ও ক্রুসেডদের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই এই দুরূহ অভিযানে বেরিয়েছিল। সে জন্য খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কেও তাদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষা ও জ্ঞান দান করা হয়েছিল। গির্জার আদব, উপাসনার পদ্ধতি এসবের শুধু প্রশিক্ষণই দেয়া হয়নি বরং বারবার অভিনয় এবং রিহার্সালও দেয়া হয়েছিল। ইমরান এমন নিপূণভাবে সেই শিক্ষা কাজে লাগােল যে, প্রধান পাদ্রী ও তার সাগরেদ দল তার আদবের পরাকাষ্ঠা দেখে তাকে আনন্দের সাথেই গির্জার মধ্যে থাকার অনুমতি দিয়ে দিল। ইমরান পদ্রীর খেদমতে নিজেকে এমনভাবে নিবেদন করলো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই পাস্ত্রী তাকে খাস চাকর বানিয়ে নিল। তার বুদ্ধি ও সরলতা পাদ্রীর মন জয় করে নিয়েছিল। পাদ্রী মনে মনে স্বীকার করল, এই ছেলে অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং তার ওপর ধর্মের ভূত ভালভাবেই চেপে বসেছে। অতএব তাকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। পাদ্রী সাহেব তাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য তার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিলেন। ইমরানের এক সাখী এক খৃস্টান বণিকের কাছে গিয়ে। নিজেকে ক্রাক থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরিচয় দিল। সেখানে তার সমস্ত পরিবার মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। সে তার বেদনা ভরা কাহিনী এমন করুণ ভাবে বর্ণনা করলে যে, খৃষ্টান বণিক সদয় হয়ে তাকে তার কর্মচারী বানিয়ে নিলো। সে ছিল সুদানী মুসলমান, নাম রহিম হাংগুরা। ইমরানের মতই সেও ছিল বুদ্ধিমান, সাহসী ও সুশ্ৰী যুবক। সে এ বণিকের এখানে চাকরী নিল, কারণ সে দেখেছে, এখানে ক্রুসেডদের সৈন্য ও অফিসাররা নিয়মিত আসা যাওয়া করে। এই বণিক সৈন্যদের খাদ্যশস্যও সরবরাহ করে। কিছুদিন পর বণিক তার কাজে ও বিশ্বস্ততায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে গৃহ কাজেও লাগাতে শুরু করলো। রহিম বণিকের কাছে তার নাম বলল, ইলিমোর। সে বণিকের পরিবারের সবার সাথেই অত্যন্ত ভাল ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলল। অচিরেই সবাই তার ব্যাপারে খুবই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল। সে বণিকের স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেদের কাছে এমন করুণ ভঙ্গিতে তার ধ্বংসের কাহিনী বর্ণনা করতো, যা শুনে ওদের চোখে অশ্রু এসে যেতো ! রহিম তাদের বলেছে, “আমার বাড়ীও এই বাড়ীর মতই ছিল। এমনি সাজানো গোছানো বাড়ী। এরকমই জৌলুসময় ছিল বাড়ীর আসবাবপত্র। আমার উন্নত জাতের দামী ঘোড়াও ছিল। বণিকের মেয়ে আলিসাকে রহিম একদিন বলল, “তোমার মত দেখতে আমার এক বােন ছিল, তোমাকে দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে যায়। , সে আক্ষেপ করে আরো ৰলল, “একদিন আমার বাড়ীর চাকর তার ফাইফরমাশ খাটতো আমাদের কাজকর্ম করত। আর আজ কপাল দােষে আমি তোমাদের বাড়িতে কাজ করে খাই। অথচ এমনও দিন ছিল, ক্ষুধার্তা লোকদের আমি বিনা কাজেই খাবার দিতাম।’ বণিকের যুবতী মেয়ে এই সুশ্রী যুবকের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়লো। সে তার বোনের সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করতো। রহিম বলতাে, ‘সে প্রায় তোমার মতই দেখতে ছিল। যদি সে মরে যেত তবে কোন দুঃখ ছিল না আমার। আমার আসসোস মুসলমানরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমি জানি না, এখন তার কি অবস্থা! হয়ত তুমি বুঝতে পারবে।’ তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা কর নি? কেমন করে করবাে? তেমন কোন সুযোগ তো ছিলনা! তবে তার পর থেকে প্রতিদিনই তাকে উদ্ধারের কথা মনে হয়েছে আমার। আজও আমি চিন্তা করি, তাকে মুসলমানের হাত থেকে কেমন করে উদ্ধার করা যায়।” ‘সত্যি খুবই দু:খজনক।” সমবেদনা ঝরে পড়ে আলিসার কণ্ঠ থেকে। ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাবো। ইচ্ছে করে আবার সেখানে ছুটে যাই, যেখানে আমি আমার প্রাণপ্রিয় বোনকে ফেলে এসেছি। বোনকে হয়তো আর পাব না, কিন্তু তার জন্য মরতে তো পারব। তার কথা মনে হলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।” তার এ ধরনের কথা ও তার বেতাল অবস্থা দেখে মা ও বেটি তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এমন মায়াময় যুবকের চেহারায় সে কি বেদনার ছাপ! যৌবন বয়সেই এত বড় আঘাত পেয়ে দিন দিন সে আরো মনমরা হয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা বলছে, যদি তার দুঃখ লাঘব না হয়, তবে সে পাগল হয়ে যাবে বা আত্মহত্যা করবে। আলিসা বণিকের অবিবাহিত যুবতী মেয়ে। সে এই যুবকের ব্যথা বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করে। এমন কি যখন রহিম যখন বাইরে যায় তখন আলিসাও কোন বাহানা করে বাইরে চলে যায়। সে রহিমকে রাস্তায় পাকড়াও করে বলে, “বাবাকে বলে তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে এসো। সে রহিমের সাথে কথা বলে আবেগমথিত স্বরে। ভাবে, যদি এতে তার দুঃখ কিছুটা হালকা হয়। মা বণিককে বলে, “এই ছেলেটির দিকে একটু খেয়াল রেখো।’ রহিমের শরীর স্বাস্থ্য ও চেহারায় একটা আভিজাত্য ছিল। দেখলেই বুঝা যায়, কোন উচ্চ বংশের সচ্ছল পরিবারের ছেলে সে। রহিম অনেক কসরত করে এমন চালচলন আয়ত্ব করেছিল। সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন আদব কায়দা ও ভদ্রতা শেখা তার প্রশিক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কষ্ট করে শেখা বিদ্যা আজ কাজে লাগল। তার অভিনয় ও ভাষার মাধুর্যে সহজেই মুগ্ধ হয়ে যেত যে কোন লোক। তিন চার দিন পর। সেদিন সে বণিকের পাশে বসেছিল। এমন সময় তার আরেক সঙ্গী গোয়েন্দা রেজাউল জাউওয়াকে দেখলো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রহিম তার কাছে গেল এবং তার সাথে চলতে চলতে অনেক কথা হলো। সে তাকে জিজ্ঞেস করলে, “তুমি কি করো’। “এখনও কোন ঠিকান্ত হয়ে উঠেনি, বলল রেজাউল। রেজাউল একজন অশ্ব বিশেষজ্ঞ ছিল। সে ঘোড়া পালন ও পরিচর্যায় যেমন পারদর্শী ছিল তেমনি চৌকস অশ্বারোহী হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল পরিচিত মহলে। রহিম তাকে বণিকের কাছে নিয়ে এলো ! সে তার নাম বলল ফ্রান্সিস। বণিককে সে জানাল, ‘এই খৃস্টান যুবক ক্রাকে সব কিছু হারিয়ে এখন বিপন্ন, সর্বহারা। একেও কোথাও একটা চাকরী দিয়ে দেন।” “কিন্তু ওকে কি কাজে লাগাবো?” বলল বণিক। রহিম বললো, “সে ঘোড়া লালন পালনের কাজ ভাল জানে। ” কোথাও ঘোড়ার রাখাল হিসাবে কাজ জুটিয়ে দিতে পারলে হয়।” বণিক বললে, “ঠিক আছে, আমার কাছে বড় বড় ফৌজি অফিসাররা আসে, দেখি তাদের ওখানে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি কিনা !’ দুতিন দিন পর। বণিকের মধ্যস্থতায় রেজাউল ফৌজি আস্তাবলে চাকুরী পেয়ে গেল। এখানে বিশেষ করে ফৌজি অফিসারদের ঘোড়াগুলোই থাকে। বণিকের কাছে সবসময় সামরিক অফিসাররা কেন আসা যাওয়া করত। অল্প সময়ের মধ্যেই এর কারণ আবিষ্কার করে ফেলল রহিম। সে জানতে পারলো, এই বণিক একজন ঝানু ব্যবসায়ী। সাধারণ, সওদাপাতি ছাড়াও তার কিছু গোপন ব্যবসা আছে। এই বণিক গোপনে এসব সামরিক অফিসারদের মদ ও মেয়ে সাপ্লাই করে। এ কারণে সব বড় বড় সামরিক অফিসাররা ছিল তার হাতের মুঠোয়। রহিম বণিককে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতো। কথায় কথায় সে তাদের অভিশাপ দিত এবং আশা প্ৰকাশ করতো, একদিন ক্রুসেড বাহিনী সমস্ত আরব ও মিশরের উপরে আধিপত্য বিস্তার করবে। তার কথায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার চরম ঘূণা ও ক্ষোভ থাকতো। ক্রুসেড বাহিনী যেন একজন মুসলমানকেও খাঁচিয়ে না রাখে সে জন্য সুযোগ পেলেই অফিসারদের কাছে আবেদন করত। কখনও কখনও সে এত বেশী অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে উঠতো যা বলার মত নয়। সে লাগামহীনভাবে বিড়বিড় করে বলতো, আমি আক্রার মুসলমানদের রক্ত পান করব। বণিক তাকে সান্তুনা দিয়ে বলতো, তুমি শান্ত হও। ক্রুসেড বাহিনী তোমার আশা পূরণ করে দেবে।’ সে ক্রুসেড বাহিনীর সেইসব সামরিক অফিসারদের গালমন্দ করত, যারা আক্রায় আরাম আয়েশে বসে আছে। সে মুসলমানদের হত্যা করার পরিকল্পনা করতো এবং পরিকল্পনা ও নকশা তৈয়ারী করত, যা দেখে বণিক চমৎকৃত হয়ে যেতো। বণিক সামরিক বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতো। মাঝে মাঝে রহিমের উদ্ভট ও নিত্যনতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা দেখে তা সংশোধন করে দিত। তার পরিকল্পনায় কোথায় কি ভুলত্রুটি আছে ধরিয়ে দিত। এই সব কথার ফাঁকে এমন অনেক সামরিক গোপন বিষয়ও বেরিয়ে আসতো, যে বিষয়গুলো সামরিক অফিসার ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়। দিন দিন আলিসা তার প্রতি বুকে পড়ে। রহিম শুরু থেকেই তাকে তার দায়িত্ব পালনের অন্যতম হাতিয়ার ধরে রেখেছিল। ” কিন্তু আলিসার হৃদয় উজাড় করা প্রেম রহিমের অন্তরেও ভালবাসার সৃষ্টি করে। রহিম সিদ্ধান্ত নেয়, দায়িত্ব পালন করে। দেশে ফেরার সময় সে আলিসাকেও তার সঙ্গে কায়রো নিয়ে যাবে। তাকে মুসলমান বানিয়ে তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। কিন্তু তাদের কারো জানা ছিল না ক্রুসেড বাহিনীর একজন বর অফিসার তাদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রেখে চলেছে। রেজাউল জাওয়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ছিল। আস্তাবলে এক বড় অফিসারের ঘোড়া প্রতিপালনের দায়িত্ব পেল সে। সেই অফিসার অনুভব করলো, রেজাউল কোন সাধারণ সহিস বা রাখাল নয়, বরং ছেলেটি তার চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধিমান। যখন অফিসার আস্তাবলে আসে সে তখন তাকে জিজ্ঞেস করে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে কখন আপনারা পরাজিত করবেন?” . আবার হয়তো কখনো জিজ্ঞেস করে, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যে, এমন কি গুণ আছে যা ক্রুসেড বাহিনীর নেই? কেন ক্রুসেড বাহিনী মুসলমানদের শেষ করতে পারছে না?” একদিন সে অফিসারকে এমন কিছু কথা বলে, যাতে অফিসার নিঃসন্দেহ হয়ে যায়, এ লোক একজন সমর বিশারদ না হলেও কোন মতেই তাকে একজন সহিস বলা যায় না। সহিসের মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে না। সেই অফিসার তাকে বললো, “তুমি কে? তোমার পেশা তো সহিস হতে পারে না।” আপনাকে কে বলেছি, আমার পেশা সহিস?” রেজাউল বললে, “আমি ক্রাকে ঘোড়ার মালিক ছিলাম। আমি যদিও সৈন্য বিভাগে ছিলাম না, তবে আমার দুই ঘোড়া যুদ্ধে গিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমি ঘোড়ার মালিক এখন আস্তাবলের সহিস। এতে আমার কোন দুঃখ নেই। যে আমার এই দুৰ্গতির জন্য দায়ী আপনি যদি সেই সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করতে পারেন তবে আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। বাকি জীবন আপনার জুতা পালিশ করে কাটিয়ে দেব।” “সুলতান আইয়ুবীর ভাগ্যে পরাজয় লিখা হয়ে গেছে ফ্রান্সিস!’ অফিসার রেজাউলকে বললো। ” “কিন্তু কেমন করে?” রেজাউল বললো, “যদি আপনারা ক্রাক ও সুবাকের উপর আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের অবরোধ করে তাদের পরাজিত করার কথা ভেবে থাকেন তবে ভুল করবেন। মুসলমানরা আমাদের অবরোধ করে যেভাবে জয়ী হয়েছে সেরূপ করে আপনারা যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারবেন না। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গী যুদ্ধের উস্তাদ! তারা আমাদের সৈন্যদেরকে কেল্লা থেকে অনেক দূরেই বাধা দেয়ার ব্যবস্থা করবে। যদি এমন কোন আক্রমণ করা যায়, যা সুলতান আইয়ুবীর ধারণা ও কল্পনার বাইরে, তবেই সাফল্যের আশা করা যায়। তখন দেখা যাবে, আইয়ুবী ও জঙ্গী কেল্লাতেই বসে আছে আর আপনারা মিশরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন।” তাই হবে!’ অফিসার একটু অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললো, ‘সমুদ্রে কোন দূর্গ থাকে না, মিশরের সমুদ্র তীরেও কোন দূর্গ নেই। অতএব আইয়ুবী জানার আগেই আমরা মিশরের উপরে খৃস্টীয় শাসন কায়েম করবো। এভাবেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়! তারপর রেজাউল ঐ অফিসারের কাছ থেকে গোপনে ও কৌশলে আরও অনেক তথ্য আদায় করে নেয়। শক্ররা তাদের যুদ্ধের গােপনীয়তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলে বেড়ায় না। সতর্ক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দারা ইশারা ইঙ্গিত থেকেই অনেক বিষয় বুঝে নেয়। নিজের বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগিয়ে এমন সব গোপন তথ্য উদ্ধার করে, যুদ্ধের ময়দানে যার মূল্য অনেক। রহিম ও রেজাউল প্রতি রোববার সকালেই গির্জায় যেতো। এবং ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ করতো। ওখানেই তারা ইমরানের কাছে তাদের গত সপ্তাহের কাজের রিপোর্ট দিত। রহিম ইমরানকে বললো, বণিকের মেয়ে আলিসা আমাকে প্ৰচণ্ড ভালবেসে ফেলেছে।” ইমরান বললো, “তার ভালবাসায় আঘাত দেবে না। আবার এ ভালবাসার খবর পরিবারে জানাজানি হযে গেলে কি প্ৰতিক্রিয়া হবে তা না বুঝে এ প্রেমের কথা প্রকাশও হতে দেবে না। দিলে তোমাকে ওরা ওদের বাড়ী থেকে বের করে দিতে পারে। রহিম প্ৰেম করো আর যা-ই করো, সব সময় মনে রেখো তুমি একজন গোয়েন্দা অসাবধানে তুমি আবার তার ভালবাসায় তলিয়ে যেও না।” কিন্তু রহিম আলিসার যৌবন ও সৌন্দর্য্যে প্রায় তলিয়েই যাচ্ছে। আলিসা তাকে এ কথাও বলে দিয়েছে, তাদের বিয়ে শুধু তখনই সম্ভব, যদি সে বাড়ী ও আক্রা শহর থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারে। কেননা তার বাবা কোন এক সামরিক অফিসারের সাথে সম্পর্ক করার তালে আছে। এ অবস্থার কথা অবশ্য রহিম ইমরানকে জানায়নি। অল্প দিনেই ইমরান পাদ্রী সাহেবের একান্ত আপন ও ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠল। সে এমন নৈকট্য লাভ করল যে, সে পাদ্রীর একজন গোপন পরামর্শদাতা হয়ে গেল। পাদ্রীকে সে যে সব প্রশ্ন করতো, তার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকতো। পাদ্রী সাহেব তার জানার আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যেতেন। পাদ্রী অবসর সময়েও তাকে ধমীয় পাঠ দান করতেন। তিনি ইমরানের মনে এই কথা বদ্ধমূল করতে চেষ্টা করতেন যে, খৃষ্টীয় মতবাদের দায়িত্ব হলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্ৰান্ত পর্যন্ত ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। এ উদ্দেশ্য নিয়েই ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। আর এ জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন তাই ব্যবহার করা হবে। প্ৰয়োজনে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হবে। তাদেরকে যে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের খৃস্টীয় ধর্মে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদি তারা খৃস্টধর্ম গ্ৰহণ না করে তবে তাদেরকে ইসলামের আদর্শ থেকে সরাতে হবে। মুসলমানদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারলেও এ উদ্দেশ্য সফল হয়। এর জন্য প্রথম কাজ হলো নিজেদের নারীদেরকে এ পথে এগিয়ে দেয়া !” এই নারীরা মুসলিম নারী সমাজকে পথে নামাবে। যুবতী নারীদের লেলিয়ে দিতে হবে মুসলমান যুবক, শাসক, সমাজপতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে। এই নারীরা তাদের সকল মহৎ কার্যকলাপ ও শুভ উদ্যোগ বানচাল এবং ধ্বংস করে দেবে। পাদ্রী ইমরানকে জানাল ইহুদিরাও মুসলমানদের শত্রু। তারাও তাদের নারী সমাজকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য ইহুদি নারীদের এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে। মুসলমানদের মুসলিম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিতে হবে। দৈহিকভাবে সম্ভব না হলে এভাবেই মুসলমানদেরকে মানসিকভাবে দুনিয়া থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। এজন্যে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, তাই করতে হবে। এ পদ্ধতি খারাপ, নাজায়েজ, উৎপীড়নমূলক, লজ্জাজনক এ ধরনের কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। ইমরান পাদ্রীর কাছে এসব কথা শুনত এবং আর এমন ভাব দেখাত যে এতে সে খুবই খুশি। সুযোগ পেলেই সে এ কাজে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫৫৩ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now