বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

সাবধান মিসির আলী

"ছোট গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X সাবধান মিসির আলী----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------- বর্ষণ মুখর একটা সন্ধ্যা। ৭ টা বেজে ৩১ মিনিট। সেই সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। ইউনুস মিয়া তার বাগান বাড়ির পাশে যে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটলা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। জমাট অন্ধকারে একা, মাথার উপর শরিফ মার্কা ছাতা ধরা। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ভয়ে বেচারার মুখ পাংশু হয়ে আছে। গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও ইউনুস মিয়া তার এই বাগান বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগান নাই। কারন এতে তার বড় ভাই ইউসুফের কড়া নিষেধ আছে। ইউসুফ আলো সহ্য করতে পারেন না, তার অন্ধকার খুব প্রিয়। পুকুর ঘাটে দুই পা তুলে ইউসুফ বসে আছে, দুই হাত বুকের সামনে কাঙ্গালের মত ভাঁজ করে ধরা। একটা মাত্র আধ ছেঁড়া লুঙ্গি পরা সে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে। কপাল বেয়ে পানি নামছে সরু ধারায় সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, ইউসুফের মেজাজ অনেক বেশি কড়া। এই যেমন এখন খুব কড়া হয়ে আছে ছোট ভাই ইউনুসের উপর। ইউনুস একটু কেশে আবার বলল “ভাইজান, মিসির আলি নামের এক ভয়ানক বুদ্ধিমান মানুষ আমার বাড়িতে এসেছেন, আমি ভাবতেছি আপনার সমস্যার কথা উনাকে বলব”। ছোট ভাইয়ের উদ্ধত্তে ইউসুফ একটু বিরক্ত হলেন। চোখ তুলে চাইলেন ছোট ভাইয়ের দিকে। বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গেল ইউনুসের। এই অন্ধকারেও বিড়ির আগুনের মত জ্বলছে ইউসুফের চোখ। ইউসুফ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে বললেন, আমার কোন সমস্যা নাই। তুমি ওকে বলতে পার, তবে লাভ নাই। গতবার তো ঐ স্কুল মাস্টারকে বলচিলা। মনে নাই ঐ স্কুলের মাস্টারকে কিভাবে মারছিলাম? বলেই কেনা কেনা কণ্ঠে উচ্চস্বরে হেসে উঠল ইউসুফ। সেই হাসি যেন ইউনুসের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। ইউনুস অতিদ্রুত বলে উঠল, “মিসির আলি সাহেব ভয়ানক বুদ্ধিমান, সে ঐ স্কুল মাস্টারের মত বোকা না, আপনি তার বুদ্ধির সাথে পারবেন না”। ইউসুফ একদলা থু থু ফেলল ঘাটের পাকা ফ্লোরে। তারপর বলল “ও আচ্ছা, তাই নাকি? ঠিক আছে তাকে যেভাবেই হোক এখানে নিয়া আস। দেখা যাক”। বলেই ইউসুফ আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের পানিতে নেমে গেল। হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি, কোমর থেকে গলা- একসময় পুরো শরীর ডুবে গেল পুকুরের কাল জলে। ইউনুস কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুকুরের দিকে তারপর অন্ধকার বাগান বাড়ি থেকে ধিরে ধিরে পা বাড়াল মূল বাড়ির দিকে। ☯ ☯ ২. মিসির আলি সাহেব টিনের তৈরি আধাপাকা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে টিপটিপ করে। মিসির আলী সাহেবের টিপটিপ বৃষ্টিই খুব পছন্দ। টিপটিপ বৃষ্টির দিয়েছেন অলস বৃষ্টি! বয়সের কারনে তার নিজের গতিও একটু মন্থর হয়ে গেছে- আর সেই কারনেই অলস জিনিস ইদানিং কালে ভাল লাগছে তার। লক্ষন ভাল না। গ্রামে গ্রামে এখন বিদ্যুতের ছড়াছড়ি, এই বাড়িতেও বিদ্যুৎ আছে। তবে মিসির আলি সাহেব বারান্দার লাইট অফ করে দিলেন। কারন বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগনা। কই যেন পড়েছেন চাঁদের জ্যোৎস্না দেখতে হয় খোলা মাঠে আর রাতের বৃষ্টি দেখতে হয় অন্ধকারে বসে! মিসির আলী অনেক চেষ্টা করলেন কথাটা কার মনে করতে কিন্তু পারলেন না। স্মৃতি বেঈমানি কারা শুরু করে দিয়েছে। লক্ষন ভাল না। বেতের চেয়ারে দুই পা তুলে বসলেন মিসির আলি। হাতে ধোঁয়া উঠা এক কাপ লাল চা। চায়ে একটু লবন দেওয়া, তবে খেতে ভালই লাগছে তার। মিসির আলি একটা সিগারেট ধরালেন। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর হটাৎ একটা কবিতার দুই লাইন আবৃতি শুরু করলেন “আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দিব মেপে”। এই দুই লাইনই উনি আবৃতি করতে থাকলেন। মিসির আলী এই পুরা কবিতাটা মুখস্থ পারেন, তার স্মৃতি শক্তি ভাল। তবুও কেন তিনি শুধু এই দুই লাইন আবৃতি করছেন তা বুঝতে পারলেন না। এই অজপাঁড়া গাঁয়ে এসেছেন একটা বিয়ের দাওয়াতে, কিন্তু শহরে ফেরার আগেই বৃষ্টি শুরু। রাস্তায় পানি উঠে যাওয়ায় বাস চলাচল বন্ধ, তাই শহরে ফিরতে পারেন নি। বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন। তাদের থাকার বেবস্থা হল প্রতিবেশিদের বাড়িতে। মিসির আলীর দায়িত্ব পড়ল ইউনুস সাহেবের ঘাড়ে। ইউনুস সাহেব একজন অবস্থা সম্পন্ন মানুষ। গঞ্জে বিরাট দোকান পাট আর গ্রামে তো জমিজমার অভাব নাই। সব অবস্থা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে যেমন একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় ইউনুস সাহবও তার বেতিক্রম নন। পঞ্চান্ন বছরের এই লোকটি কখনই মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না! এটা নিজে মিসির আলী একটা লজিক দাঁড় করেছেন। হতে পারে এই লোকটির পুরানো পাপ আছে মনে, তার ভয় হয় তার চোখের দিকে তাকালে সবাই বুঝে ফেলবে যে পাপটা উনিই করেছেন! ইউনুস সাহেবকে নিয়ে এইধরনের চিন্তা করেছেন বলে মিসির আলী একটু লজ্জিত হলেন। ইউনুস লোকটা যথেষ্ট অমায়িক এবং মিশুক। মিসির আলির সিগারেট শেষ হয়ে গেল, তিনি আবার একটা সিগারেট ধরালেন। চায়ের খালি কাপটা মেঝেতে রাখলেন। তারপর ঘড়ি দেখেলেন, রাত ৯ টা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। টিনের চালে শব্দ হচ্ছে অবিরত। ইউনুস সাহেব মিসির সাহেবের ফরমাশ খাটার জন্য পাশের বাড়ির একটা ছেলেকে ডেকে এনেছেন। ছেলের নাম মতিন। তবে মতিন এই মুহূর্তে বারান্দার মাটিতে বিছানা পেতে শোয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে চলে গেল। গ্রামের মানুষ খুব দ্রুত ঘুমাতে পারে। মতিন ঘুমে বিছানায় কাত হয়ে ফোঁস ফোঁস করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমান্ত মানুষের দিকে তাকাতে ভাল লাগে মিসির আলির। কারন সেই সময় মানুষের মুখ থেকে সকল দুশ্চিন্তা সরে গিয়ে স্বর্গীয় আবেশ চলে আসে। মিসির আলি পরম মমতায় তাকালেন মতিনের দিকে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। মিসির আলি ঠিক করলেন ইউনুস সাহেবকে বলে একে মিসির আলি ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে যাবে। তিনি ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন। তবে ছেলেটির পড়াশোনায় আগ্রহ একেবারে কম। গ্রামের স্কুলে যায় মাসে দুই তিন দিন, এখনো সে ক্লাস টু পাশ দিতে পারে নাই। সে গত ৪ বছর ক্লাস টু তে, এটা নিয়ে সে গর্বিত। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়-“কিরে মতিন কোন ক্লাসে পড় তুমি??” মতিন অনেক গর্ব করে উত্তর দেয় “ কেলাশ টু তে পড়ি”!! সে ফেল করবে তবু স্কুল ছাড়বে না, আবার স্কুলে নিয়মিত যাবেও না। এমন সময় ইউনুস সাহেব বারান্দায় ঢুকলেন। লোকটা পুরোপুরি ভিজে গেছেন। মিসির আলী একটু অবাক হলেন কারন ইউনুস সাহবের হাতে একটা প্রায় নতুন ছাতা আছে! তবে মিসির আলি কিছু বললেন না। শুধু চেয়ার থেকে পা নামিয়ে বসলেন। “স্যার, আপনে বসেন, পা নামানোর দরকার নাই”। বললেন ইউনুস সাহেব। মিসির আলি একটু বিব্রত বোধ করলেন, এই বয়সের একজন মানুষ তাকে স্যার বালে ডাকে এটা শুনতেও একটু অন্যরকম লাগে। মিসির আলি মৃদু হেসে বললেন- সমস্যা নেই। আপনি যান, কাপড় চেঞ্জ করেন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ইউনুস সাহেব ভিতরে চলে গেলেন, মিসির আলি আবার পা উঠিয়ে আরাম করে বসলেন। একটা মজার ব্যাপার হল ইউনুস সাহবের এত বড় বাড়িতে শুধু ইউনুস সাহেব একা থাকেন। বিয়ে করেছিলেন তবে বউ বিয়ের দুই মাসের মাথায় চলে যায় আর ফেরত আসেনি, ইউনুস সাহবও বিয়ে করেন নি। পাশের বাড়ি থেকে মতিনের মা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এত বড় বাড়িতে ইউনুস সাহব কিভাবে থাকেন তা ভাবতেই একটু অবাক হলেন মিসির সাহেব। কোথায় যেন একটু অস্বাভাবিকতা আছে একটু। মন বলছে “ সাবধান, মিসির আলি সাবধান”!! ☯☯ ৩। রাত ১০ টা। সামনা সামনি দুইটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন মিসির আলি আর ইউনুস সাহেব। যথারীতি ইউনুস সাহবের চোখ নিচের দিকে। পাশে এখনো মতিন ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। বারান্দায় দুটা পাঁচ টাকা দামের মোম বাতি জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে ধিরে ধিরে। বাতাসে মোমের শিখা তিরতির করে কাঁপছে। বারান্দায় গভির নিস্তব্ধতা ভর করেছে। মিসির আলি একটু অসস্থি বোধ করলেন। শেষে তিনি নিজেই নিরবতা ভংগ করলেন- আপনাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। আমার ভাল লেগেছে। ইউনুস সাহেব চোখ তুলে একটু মিসির সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। বললেন- জী ঠিক বলেছেন স্যার। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল, মিসির আলি সাহেব এবার সত্যি সত্যি অসস্থিতে পড়ে গেলেন। তবে এইবার নিরবতা ভংগ করলেন ইউনুস সাহেব- “স্যার, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি, আপনি অনেক বিজ্ঞলোক এটা আমি জানি। আমার একটা সমস্যা আছে। মিসির আলি এবার নড়ে চড়ে বসলেন, একটা বেনসন ধরালেন তিনি। তারপর বললেন- হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। আমি শুনছি। ইউনুস সাহেব একটা পুরাতন ছবি দিলেন মিসির আলিকে। তিনি ছবিটা নিয়ে মোমের আলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একজন যুবকের সাদাকাল ছবি। চেহারায় কিছুটা কাঠিন্য আছে যা ইউনুস সাহেবের চেহারায় অনুপস্থিত। ইউনুস সাহেব মাটির দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন- এটা আমার বড় ভাইয়ের ছবি। আজ থেকে ঠিক বত্রিশ বছর আগের, তার নাম ইউসুফ। আমার থেকে তিন বছরের বড়। আমাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অসম্ভব মিল ছিল। আমি বয়স তখন বিশ কি একুশ বছর। আমরা দুই ভাই বাপের ব্যাবসা দেখাশোনা করি। বাপের বিরাট কারবার ছিল গঞ্জে। রাতের বেলা আমরা দুই ভাই পালা করে দোকানে থাকি। আমার মা অনেক আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা অনেক সখ করে ঐ পাশের বাগান বাড়িটা করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে আমি, আমার ভাই ইউসুফ, বাবা ছাড়াও একজন অন্য মানুষ থাকতো। তার নাম ছিল মনি, আমার এক খালাত বোন। বাপ মা মরা মেয়ে ছিল সে। তাই আমার বাবা ওকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখেন। ইচ্ছা মনি বড় হলে তাকে বিয়ে দিবেন। মনির তখন প্রায় সতের আঠার বছর। দেখতে অনেক রুপবতি ছিল মনি। মনি সেই ছোট বেলা থেকে আমাদের বাড়িতে মানুষ, আমরা এক সাথে বড় হইচি। বাবা অনেক দেখে একটা ভাল সমন্ধ ঠিক করলেন মনির জন্য। ছেলেও গঞ্জে ব্যাবসা করে। বিয়ে প্রায় ঠিক তখন। সে দিন এমন এক বৃষ্টির রাত। আমি গঞ্জের দোকানে। রাতে ঐখানে থাকব। বাইরে অনেক ঝড়। দোকানে আমি একা থাকি। রাতের বেলা সব কর্মচারীর ছুটি থাকে। গঞ্জ থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ৩ কিলো দূরে। সেই রাতেই মনি আমার বড় ভাই ইউসুফের সাথে পালিয়ে গেল। বুঝলাম ভাইয়ের সাথে মনির মন দেওয়া নেওয়া ছিল অনেক আগ থেকেই। মিসির সাহেব, আপনি কি আমার কথা শুনছেন? মিসির আলি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। কিছু প্রশ্ন এসেছে মনে- এই যেমন, ইউনুস সাহেব বললেন যে তাদের দুই ভাইয়ের মদ্ধে অনেক মিল ছিল তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বড় ভাইয়ের প্রনয়ের কথা তার আগে থেকেই জানার কথা! যাই হোক, মিসির আলি আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন- হু, বলেন আমি শুনছি। মিসির আলির সাড়া পেয়ে ইউনুস সাহেব আবার শুরু করলেন- “আমার বাবা তখন ছেলের জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেলেন, আমার বাবা অতি ভাল মানুষ ছিলেন। ভাই যদি বলত যে ও মনিকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বাবা নির্ধিধায় রাজি হয়ে যেতেন কোন ভুল নাই। বাবা তখন ব্যাবসা বাণিজ্য পুরা ছেড়ে দিলেন। সারাদিন বাগান বাড়িতে থাকেন একা একা। আমি তখন ব্যাবসা চালাই। আমরা অনেক জায়গায় লোক পাঠিয়েছি তাদের খোঁজে কিন্তু ওদের পাইনি কোথাও। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলে গেল। একদিন সন্ধায় বাবা আমাকে বাগান বাড়িতে ডেকে বললেন, “আমি সপ্নে দেখেছি তোর ভাই আর মনি আর এই দুনিয়াতে নাই। ওরা দুজন আমাকে ডাকছে। আমার সময় বুঝি শেষ হয়ে গেলরে বাপ”। বলে কান্নাকাটি শুরু করেলন। আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে দোকানে চলে গেলাম। পরদিন সকালে বাবার মৃত দেহ পাওয়া গেল বাগান বাড়ীর পুকুরে! রাতের বেলা যে কোন কারনে হোক বাবা পুকুরে নেমেছিলেন তারপর আর উঠে আসতে পারেন নি। মিসির আলি এইবার একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না- “কোন থানা পুলিশ হয়েছিল? ইউনুস সাহেব একবার চোখ উঠিয়ে আবার নামিয়ে ফেললেন। বললেন- আসলে তখন তো থানা এত কাছে ছিল না, পুলিশে খবর দিতে অনেক সময় লাগত, তা প্রায় আট দশ ঘণ্টার পথ ছিল সেটা। তাই গ্রামের ইমাম সাহেব সহ আমরা লাশ দাফন করে দেই। জানেন তো মৃত দেহ বেশি সময় মাটির উপরে রাখা ঠিক না, এটা মৃতের আত্মা কষ্ট পায়। মিসির আলি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলেন, বললেন- হুম সেটা জানি। আচ্ছা ঐ ইমাম সাহেব কই আছেন এখন যিনি আপানার বাবাকে দাফন করেছিলেন? ইউনুস সাহেব বললেন- ঐ ইমাম ভিনদেশি মানুষ ছিলেন, ওনার বাড়ি ছিল রংপুর, তিনি একদিন রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে যান, ওনার বাড়ির ঠিকানা আমাদের কারো জানা ছিল না। উনিও আর কোনদিন ফিরত আসেন নি। মিসির আলি বললেন- আচ্ছা খুব ভাল, তারপর? ইউনুস সাহেব বললেন- পরপর আমার তিনজন পরিবারের মানুষকে হারিয়ে আমি একটু বিবাগি হয়ে যাই। ব্যাবসা বাণিজ্য ছেড়ে দেই কর্মচারীদের উপর, আমিও বাবার মত ঐ বাগান বাড়িতে আশ্রয় নেই। সারাদিন সারারাত ওখানেই থাকতাম। আমার খুব মন খারাপ হতো, আমি বাবা বাবা করে কাঁদতাম। এভাবে কত দিন গিয়েছিল জানি না হটাৎ এক গভির রাতে আমি বাগান বাড়ির বারান্দায় বসে ছিলাম। তখন শীত কাল। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা, কুয়াশার কারনে আকাশের চাঁদ দেখা যায় না ঠিক মত। আমি কাঁদছি। হটাৎ দেখি সেই কুয়াশা ভেদ করে একজন মানুষ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। অন্ধকার আর চাঁদের আলোর লুকচুরির কারনে লোকটাকে বুঝা যাচ্ছে না, তবে এটুকু বুঝতেসি লোকটির সারা শরীর পানিতে ভেজা! আমি অবাক হয়ে গেলাম, কারন এ দিকে শীত অনেক বেশি পড়ে আর এই শীতের রাতে কেউ একজন খালি গাঁয়ে মাত্র একটা লুঙ্গি পরে থাকতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করার মত না। আমি বললাম- কে? কে ওখানে? লোকটা জবাব দিল- আমি তোর বড় ভাই ইউসুফ, তুই আমার সাথে আয়। বলে লোকটা উল্টো হাঁটা দিল। আমার মনে তখন অনেক আনন্দ! আজ এত বছর পরে আমার ভাই এসেছে!! ভাইকে পাবার আনন্দে তখনকার অস্বাভাবিক ব্যাপার গুলো চোখে পড়ল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটা ধরলাম ভাইয়ের পিছে পিছে। দেখি আমার ভাইটি বাগান বাড়ির গাছের ফাক দিয়ে আস্তে আস্তে পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। দেখি ভাই আস্তে আস্তে হিম শীতল পানিতে গলা পর্যন্ত নেমে গেল। আমি পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। আমার ভাই তখন আমাকে বলল- “ইউনুস, আমি ফিরা আসছি। আমি বললাম- ভাই এদ্দিন তুমি কই ছিলা? ভাই আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল- “ইউনুস, আমি আর মনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার পরে একটা রাস্তায় আমাদের ডাকাত ধরল। তারপর ওরা আমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিল আর মনিকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। সেই থেকে আমি পানি ছাড়া থাকতে পারি না। আমি এখন থেকে এই পুকুরেই থাকব। আমার তখন ভয়ে হাত পা বরফ হয়ে গেছে। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম- মরে গেছ মানে কি? ভাই একটু খন খনে গলায় বলল- মরে গেছি মানে মারা গেছি। ইন্তেকাল করছি। এইবার বুঝচস? আমার তখন অবস্থা খারাপ। আমি কোনমতে বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকবা। সমস্যা নেই। ভাই হেসে বলল- তুই ভয় পাইস না, আমি তোর কোন ক্ষতি করব না, তুই শুধু আমি যা যা বলি তাই করবি। এই পুরো বাগান বাড়ির পাশে দেওয়াল তুলে দিবি যেন কেউ না আসতে পারে, আর এই পুকুরের পশ্চিম পাশে একটা পাকা ঘাটলা তুলে দিবি। আমি রাতের বেলা ওখানে বসে আরাম করব। আর শোন আমার কথা কাউকে বলবি না যেন, নাহলে তোর ক্ষতি হবে আর যাকে বলবি তাকে আমি মেরে ফেলব আমার নিজের জন্য। মনে থাকে যেন। আমি বললাম ঠিক আছে ভাই। তারপর আমি পুরো বাগান বাড়ির চারপাশে দেওয়াল তুলে উপরে কাচের টুকরা দিয়ে দেই। আর একটা সুন্দর শান বাঁধানো পাকা ঘাটলা তৈরি করে দেই। মিসির আলি এবার একটু নড়ে বসলেন। হুম। খারাপ না। ভাল একটা গল্প। যদিও অনেক ফাক ফোঁকর আছে। তবুও গ্রামের একজন সামান্য ব্যাবসায়ি এত সুনিপুনভাবে গল্প ফাঁদতে পারেন তবে বলতে হবে লোকটির মেধা অনেক! মিসির আলি বললেন- আপনি এই ঘটনা কাউকে বলেছিলেন? ইউনুস সাহেব বললেন- হু, একজনকে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের স্কুলের অঙ্কের মাস্টার, উনি বললেন ঠিক আছে আমি একরাত পুকুর পাড়ে থাকব, পরদিন সকালে অনাকে মৃত অবস্থায় পুকুরের পানিতে ভাসতে দেখা যায়। মিসির আলি বললেন- তো আপনি আমার কাছে আসলে কি চাচ্ছেন? ইউনুস সাহেব একটু কেশে নিলেন। তারপর বললেন- দেখেন মিসির সাহেব, আমি গ্রামে থাকতে পারি কিন্তু আমি বি এ পাশ করেছিলাম সেই সময়ে। আমি দেশি বিদেশি লেখকের অনেক বই পড়ি, সেই সুবাদে আপনারও কয়েকটা বই পড়েছি। আমি জানি আমার ধারনা আমি ঐ পুকুর পাড়ে এক ধরনের হেলুসিনেশান হয়। হটাৎ যেন ইউনুস সাহবের গলা কেঁপে উঠল- আমি চাই আপনি আমার এই রোগের চিকিৎসা করে দিবেন, আমি সুস্থ হতে চাই! মিসির সাহেব কিছু বললেন না। তার মাথায় অনেক কিছু চিন্তা চলছে। তারপর মিসির সাহেব বললেন- ঠিক আছে, আপনি ঘুমান। আমি কাল ঐ বাগান বাড়িটা দেখব আর কাল রাতে আমি ওখানে থাকব। ☯☯৪। পরের দিন মিসির আলির অনেক ব্যাস্ত একটা দিন গেল। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। তবুও উনি সেদিন গ্রামে মসজিদে গেলেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বললেন। গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষের সাথে কথা বললেন। দুপুরে গেলেন থানায়। চেষ্টা করলেন কিছু তথ্য জোগাড় করার। একটা অদ্ভুত তথ্য পেলেন তিনি- বাগান বাড়ির ঘাটলা বানানোর জন্য মাত্র একজন লোক রেখেছিলেন ইউনুস সাহেব! আর ঐ লোকটিও ঘাটলার কাজ পুরোপুরি শেষ হবার আগে মারা পড়ে, তার লাশও পাওয়া যায় ঐ পুকুরের পানিতে! এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেন ইউনুস সাহেব গোপন করলেন বুঝতে পারলেন না মিসির আলি। বিকেলে যখন ইউনুস সাহেবের বাড়ি ফিরলেন তখন মিসির সাহেব পুরা কাক ভেজা হয়ে গেছেন। শরীর গরম হয়ে আসছে। জ্বর জ্বর ভাব। ইউনুস সাহেবও জ্বরে পড়েছেন। প্রায় একশ দুই ডিগ্রির মত। মিসির আলি একটা ফ্লাক্সে কিছু চা আর এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে ইউনুস সাহেবকে বললেন “আমাকে আপনার বাগান বাড়িতে রেখে আসুন, আমি আজ রাতে ওখানে থাকব”। ইউনুস সাহেব মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মূল ফটকে বিশাল লোহার গেট। গেটে এত বড় এক তালা। সেই তালা খুললেন ইউনুস সাহেব। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন গেটের চাবি ইউনুস সাহেবের কোমরে একটা কাল সুতা দিয়ে আটকানো, এবং সেখানে মাত্র একটাই চাবি! বুঝতে পারলেন এই চাবি তিনি এক মিনিটের জন্যও হাত ছাড়া করেন না। মিসির আলিকে বাগান বাড়িতে রেখে ইউনুস সাহেব চলে গেলেন বাড়িতে। যাওয়ার সময় মিসির আলি খেয়াল করলেন ইউনুস সাহেব জ্বরে কাঁপছেন। ☯☯ ৪. রাত আটটা। মিসির আলি পুরা বাগান বাড়ি দেখা শেষ করলেন মাত্র। এত বড় বাগান বাড়িকে পুরা মৃত নগরির মত মনে হচ্ছে। অনেক আগাছা আর শুকনো পাতায় ভরে আছে জায়গাটা। কতগুলো দিন এখানে মানুষের আনাগোনা নেই ভাবতেই একটু বিস্ময় অনুভব করলেন তিনি। আকাশে এখন কাল মেঘের খেলা। এই আসছে এই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশের মেঘ ফুঁড়ে পূর্ণিমার চাঁদ উকি মেরেই আবার লুকিয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি আগে থেকেই একটা ছাতা আর একটা চেয়ার নিয়ে রেখে আসেছিলেন পুকুর পাড়ে, শান বাঁধানো ঘাটলার ঠিক অপরপাশে। মিসির আলি পুকুর পাড়ে গিয়ে চেয়ারে বসলেন। কাঁধের উপর ছাতাটা ফেলে এক কাপ চা নিলেন। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন। বর্ষাকালে চারপাশে বেঙের ডাকে মুখরিত থাকে, তবে এই পুকুরে কোন বেঙ-এর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। অবাক করা বিষয়! ব্যাপারটা কেমন ভৌতিক মনে হল। মৃদু হেসে দিলেন মিসির আলি। তিনি ভূতে ভয় পান না, তবে সাপ খোপে ভয় পান। তাই তিনি মাটি থেকে চেয়ারে পা তুলে নিলেন। শুরু হল অপেক্ষার পালা। তিনি কোন আলো জ্বালাননি। শুধু পকেটে একটা ছোট টর্চ রেখেছেন। ইউনুস সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন মিসির আলি। তিনি একটা সাধারন মানুষিক রোগে ভুগছেন। এই রোগের রুগিরা নিজেদের চারপাশে এক ধরনের আলাদা জগত তৈরি করে নেয়। সে জগতে দ্বিতীয় কোন সত্ত্বার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যে খুন গুলো হয়েছে এই পুকুরে সেগুলো একদিক থেকে দেখলে খুবই সাধারন খুব হতে পারে, এতে কোন রহস্য নাই। যেমন স্কুল মাস্টার খুব সাধারন একজন মানুষ ছিলেন, পরকালে ভয়ানক বিশ্বাস করেন তিনি। এই তথ্যগুলো মাস্টার সাহেবের বাড়ির লোকজন থেকে জেনেছেন মিসির আলি। হয়ত ইউনুস সাহেবের গল্প তার মনে দাগ কাটে, রাতে এই নির্জন বাগান বাড়িতে বেড়াতে এসে তিনি হেলুসিনেশানের জন্য কিছু একটা দেখেন। তারপর পুকুরে লাফিয়ে পড়েন। মাস্টার সাহেব সাঁতার জানতেন না, তাই সহজেই মারা যান। ইউনুস সাহেবের বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন উনি তার উপরে পুত্র শোক। তাছাড়া অনেকদিন একা একা এই নির্জন বাগান বাড়িতে থাকার কারনে উনিও একধরনের মানুষিক সমস্যায় পড়েন। মসজিদের হুজুর হয়ত সত্যি সত্যি দেশের বাড়ি চলে গেছেন। ইউনুস সাহেবের এই রোগ সারাতে হলে প্রথমে প্রমান করতে হবে যে তার ধারনা ভুল, তিনি কোন মৃত ভাইকে দেখেননি। কাল সকালে যখন মিসির আলি অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরবেন তখনই একমাত্র তাকে বিশ্বাস করান যাবে। মিসির আলির এই একটা গুন খুব ভাল, সব সমস্যা আগে সবচাইতে সহজ সমাধান ধরে উনি শুরু করেন। সহজ সমাধান থেকে আস্তে আস্তে জটিলের দিকে যান, এভাবে শুরু করলে কোন পয়েন্ট মিস করবার সম্ভাবনা কম থাকে। রাত অনেক হল। প্রায় একটা বাজে। মিসির আলি বসে থেকে থেকে কোমর ব্যাথা করে ফেলেছেন। তিনি একটু নড়ে বসলেন। বৃষ্টি অবিরাম ঝরছে, টিপ টিপ শব্দে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক চমৎকার শব্দ করছে। মিসির আলি মুগ্ধ হয়ে শুনছেন সেই শব্দ। এমন সময় পুকুরের পানিতে কিছু একটা আলোড়নের শব্দ শোনা গেল, মিসির আলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন পুকুরের দিকে। কই? নাতো কিছু না, হয়ত কোন বড় মাছ শব্দ করেছে। মিসির আলি ভাল করে খেয়াল করলেন। এই তো এই তো কিছু একটা নড়ছে পুকুরের ঠিক মধ্যখানে! অন্ধকারে ভাল বুঝা যাচ্ছে না। জিনিসটা আস্তে আস্তে শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটলার দিকে এগিয়ে আসছে! মিসির আলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না! কেউ একজন মিসির আলির মাথার ভিতর থেকে আর্তনাদ করে চিৎকার করে বলে উঠল- পালাও, মিসির আলি পালাও!! ☯☯ ৫. জিনিসটা যখন বাঁধানো ঘাটে এসে উঠল তখন একটা মানুষের আকার ধারন করল। কিছুটা গুঁজো হয়ে উঠে বসল ঘাটের সিঁড়িতে। তারপর মিসির আলির দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শ্লেষ মিশানো কণ্ঠে ডাকল- মিসির সাহেব আমি এসেছি, আমার নাম ইউসুফ, আমি ইউনুসের বড় ভাই!! মিসির আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীর শান্ত পায়ে ঘাটলার দিকে এগিয়ে গেলেন। ইউসুফ দুই পা ভাঁজ করে কাঙালের মত দুই হাত জড় করে বসল। তার থেকে ঠিক দশ ফুট দূরে বসলেন মিসির আলি। তার চোখে তখনো বিস্ময়। দুজনই বৃষ্টিতে ভিজচ্ছেন। মিসির আলি ইউসুফের দিকে তাকালেন, অন্ধকারে ঠাহর করতে পারলেন না ঠিক মত। তবে যতটুকু দরকার ততটুকু দেখে নিয়েছেন মিসির আলি। লোকটির পরনে শত ছিন্ন একটা লুঙ্গি আর পুরা শরীর খালি। মিসির আলির ও কি হেলুসিনেশা হচ্ছে? তিনি আজ সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছেন-জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তাই হেলুসিনেশান হওয়া স্বাভাবিক, তারমানে তিনিও কি ইউনুস সাহেবের বাবা, সেই রাজমিস্ত্রি আর মাদ্রাসা শিক্ষকের পরিনতি বরন করতে যাচ্ছেন? মিসির আলি মনকে স্থির করলেন। তারপর বললেন- ইউসুফ সাহেব, আপনার কোন অস্তিত্ব নেই, আপনি আমার কল্পনা মাত্র। ইউসুফ ঘোঁত ঘোঁত স্বরে হেসে উঠল- বলল তাহলে আমাকে ছুয়ে দেখেন আপনি! মিসির আলি বললেন- আমার খুব সম্ভব হেলুসিনেশান হচ্ছে, তবুও আমি আপনাকে ছোঁব না। কারন এই সময় মানুষ অনেক কিছু অনুভব করে যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। তবে আমি আমার যুক্তি দিয়ে প্রমান করব আপনি আমার কল্পনা মাত্র। ইউসুফ আবার ঘোঁত ঘোঁত করে হেসে উঠল। একটা হাত নিয়ে ঘাটলার সিঁড়িতে ঘষতে লাগলো। তারপর বলল- জী আপনে শুরু করেন। মিসির আলি বললেন- প্রথমত আমার ধারনা আপনাকে কোন ডাকাত খুন করে নি, আর আপনি কোন রাস্তায় খুন হননি আপনি খুন হয়েছেন এই বাগান বাড়িতে! আমি কি ঠিক বললাম? ইউসুফ কোন কথা বলল না- মনে হল সে শুরুতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেল। তারপর আমার ধারনা- আপনার বাবা নিছক পানিতে পড়ে মারা যান নি বরং তিনি খুন হয়েছেন, সেই সাথে সেই রাজমিস্ত্রি, স্কুলের শিক্ষক এবং সেই হতভাগা মসজিদের ইমাম সবাই এই বাড়িতেই একে একে খুন হয়েছে। ইউসুফ বললেন- হ্যাঁ, আমিই সবাইকে খুন করেছি, আমার বাবা আমার অস্তিত্ব টের পায় তাই তাকে খুন করেছি, মসজিদের ইমাম বুঝতে পারে যে বাবা খুন হয়েছেন তাই ওকেও খুন করেছি, স্কুলের শিক্ষক সেও আমার উপস্থিতি পায় তাই তাকেও আমি সরিয়ে দিয়েছি, আর সেই রাজমিস্ত্রি যে কিনা একসময় বুঝতে পারে যে আমি এই পুকুরেই বাস করি তাই তাকেও খুন করেছি!! যে যে আমার অস্তিত্ব টের পাবে তাদের সবাইকে আমি খুন করব। আমি একা থাকতে চাই, আমি মৃত্যুর পর শান্তিতে থাকতে চাই। মিসির আলি একটু ভয় পেয়ে গেলেন, তবুও প্রকাশ করলেন না। তিনি জানেন শত্রু যদি তার দুর্বলতা টের পায় তাহলে সে মানসিক ভাবে শক্তিশালি হয়ে যাবে। মিসির আলি একটু হেসে বললেন- খুব ভাল, আপনি আপনার বাবাকে খুন করেছেন ভাল কথা, তাহলে আপানার ছোট ভাইকে খুন করেন নি কেন? বরং তাকে আপনি নিজে থেকেই দেখা দিয়েছিলেন। মিসির আলির এই কথার তিরে ইউসুফ একটু অসহায় হয়ে গেল বুঝতে পারলেন মিসির আলি। তিনি হেসে বললেন- আপনি তো তাকে কখনই খুন করতে পারবেন না ইউসুফ সাহেব। কারনটা কি জানেন? ইউসুফ কিছু বলল না, ঠায় মিসির আলির দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটো জ্বলছে ভাটার মত, এক অমানুষিক ক্রোধ চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ইউসুফের। মিসির আলি খুব শান্ত স্বরে এবং দৃঢ় কণ্ঠে বললেন- আপনি ইউনুসকে খুন করতে পারবেন না কারন আপনি আসলেই তার বড় ভাই ইউসুফ নন বরং আপনি ইউনুস! ☯☯ ৬। এই কথার পরে বসা অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে মিসির আলিকে লক্ষ করে উঠে এল ইউসুফের ভূতবেশি ইউনুস সাহেব। যেন মিসির আলিকে ছিঁড়ে খুড়ে খাবেন তিনি। কিন্তু তার আগেই পুকুর পাড়ের চার পাশ থেকে দশ বারটা শক্তিশালী টর্চের আলো নিকষ কাল পুকুর পাঁড়কে ধাধিয়ে দিল। চার পাঁচ জন পুলিশ এসে ইউনুসকে ধরে ফেলল। রাগে ক্রোধে ইউনুস হাত পা ছুঁড়ছে। পুলিশরা তাকে নিয়ে বাগান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ওসি সাহেব মিসির আলির পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন- অনেক ধন্যবাদ স্যার। মিসির আলি বললেন- আমার কি মনে হয় জানেনা ওসি সাহেব- এই শান বাঁধানো ঘাঁটটা ভেঙ্গে কিছুদূর মাটি খুঁড়লেই পেয়ে যাবেন হতভাগ্য ইউসুফ, মনি আর ঐ মসজিদের ইমামের কঙ্কাল। ওসি সাহেব তার অধনস্ত একজন অফিসারকে হুকুম দিলেন- লোক এনে এখনই এই ঘাট ভাঙ্গা শুরু করা হোক। ☯☯ ৭। রাত চারটা বেজে এগার মিনিট। দশ বার জন লোক অনেক উৎসাহের সাথে পাকা ঘাটলা ভাঙ্গা শুরু করল। মিসির আলি আর ওসি সাহেব বাগান বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। ওসি সাহেব একটু ইতস্তত করে বলল- স্যার অনুমতি দিলে একটা সিগারেট ধরাব। মিসির আলি একটু স্মিত হাসলেন, বললেন- ধরাও। সিগারেট ধরাতে ধরাতে ওসি বললেন- স্যার, আমার চাকুরি জীবনে এমন কেস একটাও পাই নাই। আপনি শুরু থেকে একটু যদি খুলে বলতেন। মিসির আলি শুরু করল- ঘটনার শুরু মনি মেয়েটিকে নিয়ে। ইউনুস সাহেব বলেছিলেন মনি মেয়েটা অনেক সুন্দরি ছিল, দুই ভাই ঐ মেয়েটার ভালবাসায় পাগল ছিল বলে আমার ধারনা। আর মেয়েটি বোধহয় বড় ভাই ইউসুফকেই ভালবাসত। তারপর যখন মনির বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তখন ঐ রাতে ইউনুস কোন কারনে বাড়ি দুর্ভাগ্যক্রমে বাড়ি এসেছিল। কিন্তু নিজের ঘরে বড় ভাইকে না দেখে একটা সন্দেহ মাথায় আসে, সে সোজা চলে যায় বাগান বাড়ি। এই বাগান বাড়িতে ঐ সময়েও কেউ থাকতো না। ইউনুস এসে দেখে তার ধারনাই ঠিক। ইউসুফ আর মনি দুজন এই বাগান বাড়িতে গোপনে দেখা করতে এসেছে। ইউনুস বোধহয় ছোট বেলা থেকেই একটু মানসিক ভারসাম্যহীন। সে এই দৃশ্য দেখে আর ঠিক থাকতে পারে নি। দুইজনকেই রাগের মাথায় খুন করে। তারপর লাশ নিয়ে যায় পুকুর পাড়ে। সেখানে গর্ত করে পুঁতে ফেলে সে। তারপর ভোর হবার আগেই দোকানে চলে যায়। যেহেতু গ্রামের রাস্তা আর দোকানে কেউ ছিল না সেই রাতে তাই ইউনুস যে দোকানে ছিল না রাতে এটার প্রমান রইল না কোথাও। সবাই ভাবল ইউসুফ আর মনি পালিয়ে গেছে। মিসির আলি একটু থেমে আবার শুরু করলেন- চিন্তা কর, সেই বয়সের একটা ছেলে একরাতে দুটা খুনের পর লাশ গুম করে ফেলা রাতারাতি! সেই সময়ই তার মধ্যে দ্বৈত সত্ত্বার জন্ম নেয়। এক সত্ত্বায় সে সাধারন ইউনুস আরেক সত্ত্বায় সে ইউসুফ যে কিনা মৃত অবস্থায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। বৃদ্ধ বাবা হয়ত পুকুর পাড়ের ঐ গোপন কবর দেখে ফেলেছিলেন তাই তাকেও খুন করা হয়। ইমাম সাহেব বুঝতে পারেন যে ইউনুসের বাবা সাধারনভাবে মারা যান নাই সেই জন্য তাকেও খুন করে লাশ আগের দুইটা লাশের সাথে পুঁতে ফেলা হয়, এই বার সে একটা বুদ্ধি করে, কবরের উপর একটা পাকা ঘাট তৈরি করে যেন কখনো মাটি সরলেও লাশ বের না হয়ে আসে। এই ব্যাপারে সে যথেষ্ট সতর্কতা নেয়, একজন রাজমিস্ত্রি নিয়গ দেয়। কিন্তু বিধি বাম, রাজ মিস্ত্রি কাজ শেষ করার আগেই ঐ লাশের কংকাল দেখতে পায়। তাই তাকেও খুন করতে হয়। আর তার বউয়ের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছি না। মনে হয় স্বামীর অদ্ভুত আচারনে কিছুটা ভিত হয়ে চলে গেছেন। মিসির আলি থামলেন। আবার এক কাপ চা নিয়ে বসলেন। ওসি সাহেব থেকে থেক খাবি খাচ্ছেন। এমন জঘন্য ঘটনা তিনি কখনই দেখেননি। সব শেষে বললেন- স্যার সব বুঝলাম, তবে একটা জিনিস বুঝতেছি না। হটাৎ সে আপনাকে এর মদ্ধে জড়িয়ে কেন সে নিজের সর্বনাশ করল? মিসির আলি একটু হাসলেন। বললেন- ক্রাইম বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যারা সিরিয়াল কিলার হয়ে থাকে তারা সাধারণত নিজেকে অনেক বুদ্ধিমান মনে করে। যে ভাবে দুনিয়াতে তার মত আর কেউ এত বুদ্ধিমান নাই। তাই সে একটা গেম খেলতে চায়। সেই জন্যই সে স্কুলের ঐ শিক্ষককে ঘটনা বলে। ঠিক একই কারনে আমার সাথে সে এই গেমের আয়োজন করে! অফিসার, আমি এতখন যা বললাম সব লজিক দিয়ে বলেছি, জ্ঞানিরা বলেন “যুক্তিযুক্ত অনুমান বাস্তবাতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী! আশা করি আমার কথার প্রমান পাবে। আমি ঘুমাতে গেলাম কাল সকালে আমার ঢাকার বাস! ☯☯ ৮। মিসির আলি মতিকে নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। মতিকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটার মেধা ভাল, অল্প দিনেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। মিসির আলির দিন আগের মতই চলতে শুরু করল। মিসির আলি শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছেন, বইটার নাম “পাগলা দাশু”। খুব মজা পাচ্ছেন তিনি। থেকে থেকে হেসে উথছেন। এমন সময় মতি একটা চিঠি এনে দিল। মিসির আলি খুললেন- ঐ ওসি সাহেব চিঠি দিয়েছে! স্যার, সালাম জানবেন। আশা করি ভাল আছেন। আমরাও এদিকে ভাল আছি। স্যার, ঐ ঘাটের নিচ থেকে বেশ কয়েকটা কঙ্কাল পেয়েছি আমরা। একটা ঘটনা জানানোর জন্য চিঠিটা লেখা। ইউনুস সাহেব আর নেই। উনাকে কোর্ট বিল্ডিঙে নেওয়ার পরে হটাৎ করে ছয় তালা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আর আগামি মাসে আমার ট্রান্সফার হবে অন্য থানায়। আপনি ভাল থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ইতি, জহির ওসি, শান্তি পুর থানা। মিসির আলি সাহেবের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি চিঠিটা ভাঁজ করে বুকের উপর রেখে শুয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন- আবার একবার যাবেন ঐ শান্তিপুরের বাগান বাড়িতে। একটা রাত কাটাবেন ঐ পুকুর পাড়ে। আত্মা বলে যরি কিছু থেকে থাকে হয়ত ঐ রাতে ইউনুস সাহেবের আত্তার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে! সেক্সপিয়ার বলে গেছেন- “দেয়ার আর মেনি থিংস ইন আর্থ এন্ড হেভেন”!! হটাৎ ঘুমিয়ে পড়লেন মিসির আলি। আর ঘুমানোর সাথে সাথেই একটা স্বপ্ন দেখলেন তিনি! ইউনুসের ভাই ইউসুফ! গভির রাতে সেই শান বাঁধা ঘাটে আধ ছেঁড়া লুঙ্গি পরে ভেজা শরীরে কাঙালের মত দুই হাত জড় করে বসে আছেন


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩০৯ জন


এ জাতীয় গল্প

→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১৪
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১৩
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১২
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৯
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১০
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১১
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৮
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৭
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৬
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৫
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৪
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ৩
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ২
→ সাবধান মিসির আলী পৃষ্টা ১

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • Md.sAiM aRaFAt
    User ৪ বছর পুর্বে
    রিয়েন ভাই,,,আমরা আপনার মধ্য দিয়ে হয়ত বাংলার আরেকজন হুমায়ূন আহমেদকে ফিরে পাব। Genius