বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
ভাতের বলগ ফুটছে। বড়্ বড়্ বড়্ বড়্ শব্দ হচ্ছে। ধোঁয়া উড়ছে। চাল ফোটার ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। বশীর মিয়ার স্ত্রী ভাত বাড়ছেন। শানকি ভরা ভাত নিয়ে বসেছেন বশীর মিয়া। পাশে বসেছে তার মেয়ে আর ছোট ছেলে। বশীর মিয়ার ছেলে-মেয়ে হাত চেটেপুটে ভাত খেল। বশীর মিয়া হাত ধুয়ে লুঙ্গিতে হাত মুছলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে পিছনে ফিরে দেখেন মেয়েটি মুখে কাপড় চেপে দাঁড়িয়ে আছে আর ছেলেটি মুখ হা করে আকাশ দেখছে। আজকে একটু বেশি আগে আগে বের হতে পারলে বশীর মিয়ার জন্য ভাল হয়। হরতালের দিনে খ্যাপের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। তার উপর এই দিনটিতেই ভিআইপি সড়ক দিয়ে কোনো বাধা ছাড়াই যাওয়া যায়, কোনো পুলিশ তেড়ে আসে না। বশীর মিয়া শ্বাস ফেলতে ফেলতে ভাবছেন তিনি টাকা না আনতে পারলে এদের সবার কী অবস্থা হবে? সেইসাথে আফসোস, আজ যদি বড় ছেলেটি থাকত? তাহলে টাকা কামাবার জন্যে এত অস্থির হতে হত না। আজ পুরোদিনের জন্যে মালিকের কাছ থেকে রিকশা ভাড়া নেবেন। সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ফায়দা নিতে হবে।
রিকশার মালিক কুদ্দুস আলি বশীর মিয়াকে দেখে হেসে উঠলেন, “আজতো তোমগোরই দিন।” বশীর মিয়া রিকশা বের করতে করতে বলেন, “ঐ কথা কইয়েন না কুদ্দুস ভাই। সারাদিনের শেষে আপনারে দিতে হইব একশ চল্লিশ টাকা। সারাদিন খাইটা কিচ্ছু পাইনা। চাউলের কেজি চল্লিশ টাকা হইতেছে।” সেই সাথে আরেকটু যোগ করলেন,“আইজ যদি বড় পুলাডা বাঁইচা থাকত...” বশীর মিয়া শ্বাস ফেলেন, কুদ্দুস আলি অন্যদিকে ঘুরে গেছেন।
হরতালের দিন একটা সুবিধা যে রাস্তা ফাঁকা থাকে হন্হন্ করে প্যাডেল মারা যায়। বেশ কম সময়ের মধ্যেই বশীর মিয়া রিকশা নিয়ে শাহবাগে চলে এলেন। রাস্তার কোণাতে রিকশার জটলা বেঁধে আছে, আজ নিশ্চিন্তে এই জটলার মাঝে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বশীর মিয়ার মনে পড়ে খ্যাপ মারার একেবারে যুঁত সময়ে একবার এই মোড়ে রিকশা রাখাতে ট্রাফিক পুলিশ চোখা কাঞ্চি দিয়ে চাকা ফুটা করে দিয়েছিল। রিকশা টেনে টেনে আনতে হয়েছে ফকিরাপুলের মোড় পর্যন্ত। চাকার লিক সাড়াতে লাগছে ত্রিশ টাকা আর অন্যদিকে খ্যাপ মারার সময় পার হয়ে গেছে। সারা দিনে আয় হয়েছে একশ তিন টাকা, এর মধ্যে চাকা সারাতে গেছে ত্রিশ টাকা আর মালিককে ভাড়া দিতে হয়েছে সত্তর টাকা। দুই টাকা বাকিতে কেনা পাঁচ টাকার মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছিল বাড়ির পাঁচ জন মানুষ তখন বড় ছেলেটাও বেঁচে ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়েছে। আগে হরতালের দিনে মিছিল দেখলেই রিকশা নিয়ে দৌড়াতে হত। এখন পিকেটাররা রিকশার উপর খুব রাগ ঝাড়ে না, বেশি রাগ হলে কখনও কখনও সিএনজি ড্রাইভারকে আগুনে পুড়িয়ে দেয় বা এই জাতীয় কিছু করে। তবে হরতালের দিনে রিকশা চালাবার ভয় কম। তবুও বশীর মিয়ার বুক ধড়ফড় করে, রক্তে কেমন ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি লাগে। শীতকালে একবার কী একটা কারণে হরতাল হচ্ছে আর ঐদিকে তার বড় ছেলে নিউমোনিয়ায় ভুগতে ভুগতে একবারে কাহিল অবস্থা। বশীর মিয়ার পুরানো গরম কাপড় কেনা লাগবেই। আল্লাহর নাম নিয়ে তিনি রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন। কপালে থাকলে কী করবেন? পড়বি তো পড়, পুলিশের ধাওয়া খাওয়া পিকেটারদের মধ্যে পড়লেন। পিকেটারদের মধ্যে কাউকে কাউকে পুলিশ মওকা পেয়ে বেদম পিটিয়েছে দু’একজনের পায়ে ফ্র্যাকচার, কারো মাথা ফেটে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। পিকেটাররাও খ্যাপা। আর তাদের সব রাগ ঝড়ল বশীর মিয়ার রিকশার উপর। হুডের প্লাস্টিক ছিঁড়ল, একটা চাকা দুমড়িয়ে দিল। সেই রিকশা সারাতেও সব মিলিয়ে লাগল আশ’টশ’ পাঁচচল্লিশ টাকা। হাত পা ধরে কুদ্দুস আলিকে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা শোধ করেছেন। বাসায় এসে দেখেন বড় ছেলের মুখ কেমন নীলচে হয়ে গেছে। থড় থড় করে কাঁপছে জানালার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। বশীর মিয়া ছেলেকে বুকে জাপটে ধরে ছিলেন, আর তার স্ত্রী ছেলের পা মালিশ করছে শরীরটা গরম করার জন্য আর ছেলে অঁ, অঁ আওয়াজ করছে, শা শা করে শ্বাস নিচ্ছে আর শরীর তাপড়াচ্ছে। বশীর মিয়া একটু পর টের পেলেন তার বুকে আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে কিন্তু ছেলেটি আর আওয়াজ করছে না।
অকস্মাৎ একটা ডাকে বশীর মিয়ার আনমনা ভাব কেটে গেল। চশমা পরা মাঝ বয়সী একজন খ্যাপ পেয়েছেন। আজকে মজা ভিআইপি রাস্তা দিয়েও যেতে পারবেন, প্যাডেলও জোরে মারা যাবে। রিকশা শেরাটন হোটেল পার হচ্ছে। বশীর মিয়া দেখেন সামনে বাম দিকে সানগ্লাস চোখে লম্বা একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেন। বশীর মিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছেন, রিকশার গতি কমাচ্ছেন। কী সুন্দর চেহারা আর পুলিশ অফিসারকে ঐ পোশাকে দারুণ মানাইছে! হঠাৎ মনে হল আজ বড় ছেলেটা বেঁচে থাকলে এই বয়সই হতো। মনে মনে বললেন, “হায়রে! তারে যদি পুলিশ অফিসার বানাইতে পারতাম।”
বশীর মিয়া পুলিশ অফিসারকে পার হয়ে আবার পিছন ফিরে দেখেন। ঐ পুলিশ অফিসার তার দিকে হাতে ইশারা করেন। বশীর মিয়ার চোখের কোণে পানি জমে যায়, আহা! পুলিশ অফিসার যদি তাকে ‘আব্বা’ ডাক দেন। এই সব ভাবতে ভাবতে তিনি ব্রেক চাপতে ভুলে যান। রিকশা চলতে থাকে।
ভীষণ হুঙ্কারে গালি দিয়ে পুলিশ অফিসার তাকে থামতে বলেন। বশীর মিয়া সম্বিত ফিরে পান। জোরে ব্রেক কষেন। প্যাসেঞ্জার এগিয়ে তার গায়ের সাথে ধাক্কা খান। “ডাকি শুনতে পাইস না?” বলে পুলিশ অফিসার বাবা-মা তুলে গালি দেয়। বশীর মিয়ার বুক ধড়ফড় করে, গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন বিরাট ভুল করে ফেলেছেন। “স্যার মাফ কইরা দ্যান, গরীব মানুষ, আর করুম না”, বলে তিনি পুলিশ অফিসারের পায়ে ধরেন। প্যাসেঞ্জারও ভদ্রভাবে পুলিশ অফিসারকে বুঝাবার চেষ্টা করেন। পুলিশ অফিসার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বশীর মিয়া আবার রিকশায় উঠে প্যাডেলে পা রাখেন। প্যাডেল চাপা মাত্র বশীর মিয়া “আ” করে চিৎকার করে উঠেন। পিঠ আর কাঁধের মধ্যে প্রচণ্ড একটা লাঠির বাড়ি পড়েছে। পুলিশ অফিসার বাড়ি দিয়ে নির্বিকারভাবে উল্টা দিকে হাঁটা আরম্ভ করলেন।
বশীর মিয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, তিনি গামছা দিয়ে চোখ মুছছেন। পিছন ফিরে প্যাসেঞ্জারকে বলছেন,“বাপের বয়সী হইয়া পায়ে হাত দিলাম” ভেউ ভেউ করে কান্না আরম্ভ করলেন। মাথা কেমন চক্কর খাচ্ছে, সামনের কিচ্ছু চোখে দেখতে পারছেন না, নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। আবার বললেন, “বাপের বয়সী হইয়া পায়ে হাত দিলাম”। ব্যথা আরও তীব্র হয়ে উঠছে, পিঠের মধ্যে মারাত্মক ধাক্কা অনুভূত হচ্ছে। বশীর মিয়ার পা দুইটা আর চলছে না। তিনি থেমে গেলেন, রিকশা থেকে নামলেন, রাস্তায় শুয়ে পড়লেন। চারপাশে লোক জড়ো হয়ে গেছে, এদের মধ্যে একজন তার মুখে পানি দিচ্ছেন। বশীর মিয়ার গলা শুকিয়ে গেছে। প্যাসেঞ্জার সাহেব তাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে চলে গেছেন।
বশীর মিয়া খুব আস্তে আস্তে রিকশা টানছেন, শরীরে এক দানাও জোর নাই। একটু টানেন আবার একটু জিরান। রিকশা চালাচ্ছেনও ঘুরা পথ দিয়ে, ভিআইপি রাস্তা দিয়ে না। ঘরে ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়। কুদ্দুস আলির কাছে রিকশা জমা দেন আর সারাদিনে পাওয়া পঞ্চাশ টাকাটি তুলে দেন। হাত পা ধরে বলেন যে বাকি নব্বই টাকা কালকে শোধ করবেন।
সারারাত বশীর মিয়া বিছানায় ছটফট করেন, কয়েকবার বমি হয়। মাঝে মাঝে বলছেন, “বাপের বয়সী হইয়া পায়ে ধরলাম।” রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যথাও বাড়তে থাকে। ভোররাতের দিকে চোখে একটু ঘুম ধরে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন। আবার চোখ ভিজে যায়। বলেন, “বাপরে বয়সী হইয়া পায়ে ধরলাম।” ভেজা চোখে ঝাপসা দেখতে পান বড় ছেলে বসে আছে। সামনে ধোঁয়া উড়ছে। সামনে শানকি। শানকি ভরা সাদা সাদা ভাত। গপগপ্ করে সে ভাত খাচ্ছে।
আলো বাড়তে থাকে। ঘরের ভিতরে আলো ঢুকে পড়ে। ধীরে ধীরে চারপাশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বশীর মিয়া আস্তে আস্তে চোখ মেলেন। দেখেন আকাশকে পিছে ফেলে বসে আছে তার মেয়ে ও ছোট ছেলে। শানকিতে এক মুঠো চিড়া পানিতে ভিজিয়ে বশীর মিয়ার সামনে রেখেছেন। বশীর মিয়ার পেট খিদাতে চিন চিন করছে। তার ছেলে ও মেয়ের মুখ দেখে তিনি বুঝতে পারছেন তাদেরও পেট খিদাতে ব্যথা করছে। বশীর মিয়া ঘরের জানালার বাইরের আকাশ দেখিয়ে বলেন, “তোগো বড় ভাই ওই আসমানে বইসা আছে। আল্লাহ্য় তারে বেহস্তে রাখছে। কাল রাতে খোয়াবে দেখছি সে বেহেস্তে বইসা শানকি ভইরা ভাত খাইতাসে।”
একটু সকাল হতেই তিনি ঘর থেকে বের হন। কুদ্দুস আলির কাছ থেকে রিকশা নেন। আজ সারাক্ষণ মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরছে বাড়তি নব্বই টাকা শোধ করতে হবে।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now