বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ভাষার_জন্য

"যুদ্ধের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষে লেখা। ভাষা শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করছি।) ভাষার_জন্য *লেখকঃ মোঃ শাহরিয়ার রিবাত ১৯৪৭ সাল, দেশভাগ। প্রায় এক মিলিয়ান এর থেকেও বেশী মানুষের মত দুই বন্ধুও তাদের পরিবার নিয়ে বর্ডার পার হয়ে পাকিস্তানের সীমান্তে আসল। সুলায়মান আর রশিদ। সুলায়মানের সাথে ওর স্কুল পড়ুয়া ছেলে, রশিদের সাথে তার মাত্র স্কুলে ভর্তি হওয়া বাচ্চা মেয়েটা আর মেয়েটার মা। নতুন দেশ, নতুন জায়গা, সবকিছু নতুন, এডজাস্ট হতে হতে ভালোই সময় লেগে যাবে তা ভালোমতোই বুঝতে পারে দুইজন। কিন্তু টাকাপয়সা তেমন কিছু নেই সাথে। রশিদ যাও কিছু এনেছে সাথে তাও সেটাতে নিজেরাই ঠিকমত চলতে পারবে কি না সন্দেহ হয়। এভাবে দিন কতক পার করে দিয়ে একদিন সুলায়মান এসে রশিদের হাত ধরে বলে, “রশিদ, আমি বর্ডারের ওপারে যাচ্ছি। দেখি আগের জায়গা-কিছু যদি থাকে তা থেকে কিছু পাওয়া যায় কি না।“ রশিদ ভীত কন্ঠে বলে, “কিন্তু বর্ডারের ওপারে গিয়ে যদি আর না ফিরিস? অনেকেই শুনেছি ওপারে গিয়ে আর ফেরত আসেনি।” সুলায়মান হালকা হেসে উত্তর দেয়, “আরে ধুর, ওসব উড়ো কথা। কিচ্ছু হবে না আমার। পারলে তোরও কিছু নিয়ে আসব।“ একটু হেসে রশিদের ঘাড় চাপড়ায়। “আর যদি নাই ফিরি, তাহলে আমার এই মা মরা ছেলেটাকে দেখিস“, একথা বলে বলে চলে যায় সুলায়মান ওপারে। সেই যে যায়, আর ফেরে না। নিজের বন্ধুকে মাটিটাও দিতে পারে না, দুঃখ রশিদের। পেট চালাতে হবে, চারজনের সংসার। রশিদ যোগ দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারিতে। ওর বউ পাকিস্তানী, তাই শ্বশুরের সাহায্যে মিলিটারিতে সৈনিক হিসেবে ঢুকতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। বরং মিলিটারিতে ঢোকার পর ওদের জীবনে স্বচ্ছন্দ আসে। যদিও সুলায়মানের উঠতি বয়সী ছেলে রাজু সেটা কখনোই ভালো চোখে দেখে না। রাজুর কথা মতে, রশিদ একজন জাত বাঙ্গালী হয়েও কেন পাকিস্তানের মিলিটারিতে যোগ দিল? সে কি দেখছে না পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের সাথে কেমন অবিচার ও অনাচার শুরু করেছে? কলেজপড়ুয়া হলেও রাজু এসব বিষয়ে খুব ভালো খবর রাখে। তাই নিজের ছেলের মত করে রাজুকে বড় করে তুললেও এইসব বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যেই রশিদের আর রাজুর কথা কাটাকাটি হত। একসময় রাজু কলেজ ছেড়ে ভার্সিটি ভর্তি হয়। ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই রশিদদের বাসা ছেড়ে ভার্সিটির হলে ওঠে সে। যাওয়ার আগে পরিবারের সবার কাছে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গিয়েছিল ঠিকই, যদিও রশিদের সাথে কথা বলার সময় তার মুখটা কালো হয়ে যায়। যাওয়ার আগে শেষবারের মত রশিদকে রিকুয়েস্ট করে যায় মিলিটারি ছেড়ে বাঙ্গালীদের রাজনীতিতে ঢুকতে। রশিদ শুধু হেসে যায়, আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় রাজু যে কাঁদছিল তা পেছন থেকে ঠিকই টের পেয়েছিল সবাই। ---- রাজু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। দ্বিতীয় বর্ষে উঠল কয়দিন আগে। রশিদ আংকেলের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। বাসা ছাড়ার পর প্রথম প্রথম বেশ কয়েক মাস টাকা পাঠাত রশিদ আংকেল, কিন্তু এখন তা আর পারে না। কারণটাও জানা আছে রাজুর, মিলিটারির কেউ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত কারোর সাথে কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ কিচ্ছু রাখতে পারবে না। রাজুর খুব বেশি সমস্যা হয় না। সে তার দিনকাল চালিয়ে নিচ্ছে ভালমতোই। ছাত্র-রাজনীতিতে ঢুকেছে সেই প্রথম বর্ষেই, তাছাড়াও অন্যান্য টুকিটাকি কাজ কারবার করে দিন ভালোই যাচ্ছিল তার। কিন্তু সমস্যা হল, কিছুদিন যাবত একটা কথা শুনা যাচ্ছে সিনিয়র ভাইদের মধ্যে যে পশ্চিম পাকিস্তান নাকি উর্দুকে রাস্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা করছে। আরো খোঁজখবর নিতে হবে এ ব্যাপারে ভাবল রাজু। আরো কিছুদিন পেরিয়ে গেল। একসময় সিনিয়রদের কাছ থেকে শোনা সেই রিউমারটা সত্যি হল। পশ্চিম পাকিস্তান অফিসিয়ালি ঘোষণা দিয়ার প্ল্যান করছে যে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করা হবে। ঢাকা ভার্সিটির হলের প্রতিটা ঘরের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ল। প্রায় প্রতিদিনই হলগুলোর কমন্রুমেই সবাই ভিড় করে থাকল ভোরবেলা পর্যন্ত। সেই ক্ষোভ শুধু ঢাকা ভার্সিটির হলেই না, পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল। বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় এবং আন্দোলন আবারও চাঙ্গা হয়। রাজু পরিষদের অন্যতম সদস্য। দিনকাল বেশ ব্যাস্ততা আর ছোটাছুটির মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ৫২ সাল চলে আসে। এদিকে ইয়ার ড্রপ যায় তার, কিন্তু সেদিকে বিশেষ খেয়াল দেয়ার সময় কই? ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন নতুনভাবে সংগঠিত হয় এবং সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ঘোষণা করেন : “উর্দুই এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যের পর সারাদেশে শুরু হয় প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ আর মিছিল। গড়ে ওঠে ব্যাপক গণআন্দোলন। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ তারিখে পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু এবং উর্দু হরফে বাংলা লিখনে প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হচ্ছে বলে যে উক্তি করেন, তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়। ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ জানুয়ারি ছাত্ররা প্রতীক ধর্মঘট পালন করে এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। রাজুর ব্যাস্ততা আরো বেড়ে যায়। মাঝে একদিন কোথায় যেন রশিদ আংকেলের সাথে দেখা হয়। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু হঠাত করেই অনেকটা পালিয়ে যায় কি যেন দেখে। পরে আর দেখা হয়নি। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির ডাকে এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে সেদিন ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকায় প্রায় দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল বের হয়। রাজু ওইদিন যেতে পারেনি। জ্বর বাঁধিয়ে একা ক্যাম্পাসে পড়ে থাকে একা একা। বেশ কয়েক সপ্তাহ জ্বরে পড়ে থাকে রাজু বিছানায়। এরপর যেদিন জ্বর ছাড়ে, ততদিনে সে সংগঠনে তার অবস্থান হারিয়েছে, হারিয়েছে অনেক সুযোগ অনেক নামি রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বদের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ। কিন্তু সব মেনে নেয় রাজু। জরুরি অবস্থা, সময় নষ্ট করার মত সময় কারোর নেই। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। রাতের বেলা অনেক দিন পর আজ ক্যাম্পাসের হল ছেড়ে ঘুরতে বেরিয়েছে রাজু। হয়ত আরো কিছু খোঁজখবর নেয়ার ধান্ধাও ঘুরছে মাথায়। হল থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগুতেই হঠাত কে যেন পেছন থেকে ওকে জাপটে ধরে ওর মুখ চেপে ধরল। টেনে নিয়ে গেল অন্ধকারে। পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠ বলে উঠল, “রাজু, বাবা আমার, কাল-পরশুর মধ্যেই পাকিস্তান সরকার ঢাকাসহ সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করবে। আমাকে ফিল্ডে থাকতে হবে। বাবা, প্লিজ আগামী কয়দিন হলের থেকে বের হস না। তোর বাপের কসম।“ রাজু বুঝতে পারে কে। কোন মতে মুখের থেকে রশিদ আংকেলের হাত সরিয়ে বলে, “আংকেল, সবাই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। ওসব ধারাটারাতে কিচ্ছু হবে না। কেউ আটকাতে পারবে না। আর আমার বাবার কসম দিচ্ছেন? হলফ করে বলতে পারি, আমার বাবা আত্মা আমাকে দেখে খুশিই হচ্ছেন। “ রশিদ নিঃস্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত পার করল। এরপর বলল, “কিন্তু আমি তোর বাপকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি তোকে রক্ষা করব, তোকে আগলে রাখব।“ রাজু হেসে বলল, “আংকেল, একটা রিকুয়েস্ট রইল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে, পুলিশ রেইড চালাবে আমাদের ওপর, আমি জানি। ওই সময় যদি আমাকে মরতেই হয়, তবে সে মৃত্যুটা যেন আপনার হাতেই হয়।“ রশিদ কিচ্ছু না বলে দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে। রাজু পেছন থেকে দেখতে পায় রশিদ আংকেল কাঁদছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে গভীর রাতে ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) পুকুরপারে ১১ ছাত্রনেতা এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। চরম উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারির রাত অতিবাহিত হয়। সারা ঢাকা শহরে থমথমে পরিবেশ। রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। সব জায়গায় একটাই কথা, একটাই আলোচনা, একুশে ফেব্রুয়ারি কি হবে? ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে, কি হবে না? রাজু দুরের থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শোনে আর হাসে। যা হবার হবে। এ আন্দোলন হওয়াটাই জরুরি। রাজু কোন ব্যাপারে কারোর কাছেই মুখ খোলে না। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, এদিনে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করায় ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এক কথায় এদিনটি ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ ও চরম পর্যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি খুব ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ভোর থেকেই দু’একজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ছাত্রদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। রাজুর দলটা ছোট। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড আর ব্যানার নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছে ওরা রাস্তা দিয়ে। হঠাত সামনে মিলিটারি ব্যারিয়ার, সবাইই সশস্ত্র। মিছিলও থমকে যায় কিছুক্ষন। হঠাত রাজু এগিয়ে যায় সামনে। হাতের প্ল্যাকার্ডটা উচিয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।“ ওর চিৎকারে সামনের বন্দুকধারীদের একজনের হাত কেঁপে ওঠে। রশিদের বন্দুকের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে রাজু। মিছিল সহসাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ওদিক থেকে তুমুল বেগে গোলাগুলি চলতে থাকে। ওদের বিপরীত দিকের রাস্তায় মরে পড়ে থাকে সালাম, বরকত ও জব্বারের লাশ। আর এদিকের রাস্তা রাজুর রক্তে লাল হয়, সাথে মিশে থাকে আরো কত নাম না জানা রাজুর রক্ত। রশিদ খালি বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখে। মারা গেছে তার প্রিয় বন্ধুর ছেলে রাজু, তারই গুলিতে, যাকে নিজের ছেলের মত করে মানুষ করেছিল এতকাল।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২১৮ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now