বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
(তৃতীয় পর্ব)
লিখেছেনঃ সানজিদা সুলতানা সুমা
বৃদ্ধ বয়সে সারাদিন খাটুনি খেটে সুজানা সত্তিই
ক্লান্ত। তাই দুপুরের খাবার শেষেই ও বিছানায় শুয়ে
পড়লো। ওদিকে আরিফের ঘরে বসে থাকতে
থাকতে বিরক্তি এসে গেছে। ও বীচটা ঘুরে
দেখতে বেরিয়ে গেল। বীচের মৃদুমন্দ বাতাস
আরিফের মনটাকে ফুরফুরে করে তুললো। সময়
জ্ঞান হারিয়ে ও কেবল হাটু পানিতে নেমে ও
সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। সুজানা
কেবল শুয়েই ছিলো। একটুও ঘুমায়নি। যৌবনের
সাথে সাথে ঘুমটাও চলে গেছে ওর। বিছানায়
শুয়ে থেকে খানিক্ষণ এপাশ ওপাশ করছিলো ও।
কিন্তু একদল মানুষের আর্তনাদ শুনে ও তড়াক
করে উঠে বসলো। " ডাক্তার আমার পায়ের
ব্যাথাটা এখনো সারে নি। আমার আরো মরিফিন
দরকার। আর একটা ডোজ। প্লীজ।" "ব্যাথায় আমি
মারা যাচ্ছি ডাক্তার। আমার পেটে একটা বুলেট
ঢুকেছিলো। তারপর থেকেই এ ব্যাথা সারছে না।
আমায় ওই ঔষধটা একটু দিন না প্লীজ।" "শালা
ডাক্তারের বাচ্চা। এই পোল্যান্ডের জন্যে যুদ্ধ
করতে যেয়ে দুহাত হারিয়েছি আমি, আর তুই বলিস
কিনা আমায় ঔষধ দিবি না! ঔষধ না দিলে তোকে
আজ মেরেই ফেলবো।" সুজানা সবিষ্ময়ে
বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসব শব্দের উৎস
সন্ধানে এগিয়ে যায়! শব্দটা ড্রয়িংরুম থেকেই
আসছে। পা টিপেটিপে ও ড্রয়িংরুমের দিকে
এগিয়ে যায়। কাছাকাছি আসতেই ওর মনে হলো
শব্দটা যেন ড্রয়িংরুমের ছাদ থেকে আসছে। ও
রুমের দরজা খুলে ভেতরে উকি দিতেই সকল
শব্দ থেমে গেলো! এবার ও সত্যি সত্যি ভয়
পেতে শুরু করেছে! এসব কি হচ্ছে এ ঘরে!
রাত বিরাতে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে, আবার
দিনের আলোয় আহতদের আর্তনাদ শুনা যায়! ও
ভয়ার্ত কন্ঠে আরিফকে ডাক দেয়! "আরিফ!
আরিফ? কোথায় তুই? ঊত্তর দিচ্ছিস না কেন? কি
হয়েছে তোর? আরিফ!" আরিফের কোন
সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার সুজানা সত্যি সত্যিই ভয়
পেয়ে যায়। "আরিফফফফফফ,,,,," বলে ভয়ার্ত
এক চিৎকার করে ও মূর্ছা যায়। আরিফ তখন ভাটার
টানে আটকে পড়া একটা বড় গলদা চিংড়ি ধরতে
ব্যাস্ত! ও ভাবছে আজ ডিনারে চিংড়িটা ফ্রাই করে
সুজানাকে এক দারুন সারপ্রাইজ দিবে। বাচ্চাদের
মতো কাদায় মাখামাখি হয়ে চিংড়িটা ধরিতে যেয়ে
আরিফ কাহিল হয়ে গেলো। অবশেষে যখন ও
চিংড়িটা নিয়ে বাড়ি ফিরলো তখন শেষ বিকালটা ঘনিয়ে
এসেছে। বাড়ির দরজা খুলতেই ও সুজানাকে
ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে
থাকতে দেখলো! আরিফ ওর মাথাটা কোলে
নিয়ে ওকে ডাকতে লাগলো। আরিফ: "সুজানা
সুজানা! তুই ঠিক আছিস তো?" সুজানা ধীরে
ধীরে চোখ মেলে নিজেকে আরিফের
বাহুডোরে নিরাপদে শুয়ে থাকতে দেখলো!
কিন্তু পাজিটা ছিলো কোথায় এতক্ষণ? সুজানা: "তুই
কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ। তোকে কত ডাক
ডেকেছি? কানে খাটো হয়ে গেছিস না কি
এখন? " আরিফ: "কানে খাটো হতে যাবো
কেন? আমি তো বাহিরে গিয়েছিলাম। বাড়ি থাকলে
তো তোর ডাক শুনবো! কিন্তু ডাকছিলি কেন?
আর তোর শরীর খারাপ করেছে বুঝি?" সুজানা:
"আরিফ, এ ঘরে সত্যিই বড় ধরনের কোন ঘাপলা
আছে। ওয়ারশোয় এমন একটা বাড়ি এত কম দামে
কল্পনাও করা যায় না। দেখ ওরা এ বাড়িটা এত সহজেই
বিক্রি করে দিলো! কিন্তু কেন? এমনকি ওরা
দামাদামিও করতে চায় নি। আমরা যা বলেছি তাতেই
দিয়ে দিয়েছে! " সুজানা খুব সিরিয়াস কিছু না হলে
আরিফকে নাম ধরে ডাকে না। সাধারণত বুড়ো কিংবা
হাদা ডাকতেই ও বেশী অভ্যস্ত। সুজানার মুখে
নিজের নাম শুনে আরিফ কান খাড়া করে! এই বুড়িটা
কিসের ঘাপলা খুজছে! আরিফ: "কেনার আগে
আমি নিজে ও আরো দুজন উকিল দিয়ে বাড়ির
কাগজপত্র চেক করিয়েছি। কোনই ঘাপলা নেই।
অন্তত দলিল পত্র তাই বলে। ঘাপলা যদি থেকেই
থাকে তো তোর মাথায়ই আছে। ওটা ঝেড়ে
ফেলে দে।" সুজানা: "আমি সেটা বলছি না। কেন
জানি মনে হচ্ছে এ বাড়িটা হউন্টেড টাইপের।
এখানে রাতে আমার ভাল ঘুম হয় না। আর দিনে
ঘুমালেও আজব সব শব্দ শুনতে পাই।" ওহ, এই
কথা। বুড়ি তবে ভয় পেয়েছে। আরিফ ভয়
দেখানোর সুযোগটা দু হাতে লুফে নেয়।
আরিফ: "হা রে সুজানা। অনেক বছর আগে এ
ঘরে একদিন এক জোড়া খুন হয়েছিলো। খুনি ও
আক্রান্তদের আত্মা আজো এ ঘরে ঘুরে
বেড়ায়।" সুজানা: "ককক্কি বলছিস এসব? এ ঘটনা
জেনেও তুই ঘরটা কিনলি কেন?" আরিফ:
"তোকে ভয় দেখিয়ে মারতে চেয়েছিলাম
যে।" আরিফের চোখে মুখে মিটিমিটি হাসি
দেখে সুজানা বুঝে যায় ও ছলনা করছে। মিথ্যা
বলে সুজানাকে ভয় দেখাতে চায় ও। আরিফ তার
কথায় পাত্তা দিচ্ছে না দেখে সুজানার খুব হতাশ
লাগে। এই বুড়োটার সাথে ঘর বাধাকেই ওর
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে মেনে
নেয়। সারাটি জীবন আরিফ ওকে খেপিয়ে
এসেছে। জীবনের শেষ বেলাতেও ওকে
নিয়ে তামাশা করেই যাচ্ছে। আর সহ্য হয় না সুজানার।
রাগে দুঃখে চোখ থেকে এক ফোটা পানি
ঝরে ওর। সুজানার চোখে পানি দেখেই আরিফ
বুঝে যায় ব্যাপারটা সিরিয়াস দিকে মোড় নিয়েছে।
এটা আর মোটেও হাস্যকর কিছু নয়। বুড়িটা
সত্যিসত্যিই ভয় পেয়েছে। ও সুজানাকে বুকে
জড়িয়ে ধরে বলে "কাদিস না লক্ষিটি। আর
তোকে একলা ঘরে ফেলে যাবো না।" সুজানার
অভিমান এত সহজে যেতে চায় না। ও আরিফের
বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়
কিন্তু শক্তিতে বুড়োর সাথে কুলাতে পারে না।
ঠিক তখনই সুজানার ফোনটা বেজে উঠে। আরিফ
এবার ওকে ছেড়ে দেয়। সুজানা উঠে যেয়ে
ফোনটা রিসিভ করে। ওদের ছেলেটা ফোন
করেছে। ছেলেটার ফোন ওদের দুজনের
মাঝে গোমট বাধা অভিমানটা ভেঙে দেয়।
অনেকক্ষণ কথা বলে রেখে দেওয়ার ঠিক আগ
মুহুর্তে ছেলেটা ওদের বলে, "রুকন চাচা
এসেছিলেন তোমাদের খোঁজে। তাকে
তোমাদের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি। উনি আজ রাতেই
রওনা হয়ে যাবেন মনে হয়। একটু কষ্ট করে তার
জন্যে ভালো কিছু রেঁধে রেখো মা।" সুজানা
বিষ্মিত হয়! এ মুহুর্তে ও রুকনের আগমনটা ঠিক
মতো মেনে নিতে পারছে না। জীবনের
সূচনালগ্ন থেকেই আরিফের সাথে পরিচয় হলেও
রুকনের সাথে পরিচয় হয় কলেজ জীবনে।
কলেজ জীবনেও সুজানা আর আরিফ সারাক্ষণ
স্বভাব সুলভ খুনসুটি আর ঝগড়ায় মেতে থাকতো।
সেবার কলেজের কোন এক পরীক্ষায় সুজানা
আরফের থেকে ঢের কম মার্ক
পেয়েছিলো। সুজানার মনে হলো এর
পেছনে আরিফেরই দোষ। সে ওকে তার
ভালো নোট গুলি দেয়নি। একাএকা পড়ে ও
ভালো রিজাল্ট করেছে আর সুজানা সারাক্ষণ ওর
সাথে প্রেম করে পাল্টি খেয়েছে। তারপর
আর কি! শুরু হলো দুজনের মাঝে তুমোল
ঝগড়া। শেষমেশ আরিফের সাথে ঝগড়ায় পরাজয়
মেনে নিয়েই সুজানা ওর কাছ থেকে উঠে
আসে। সেদিন একাএকা একটা গাছের নীচে
বসে নিরবে কাঁদছিলো সুজানা। তখনই পরিচয় হয়
রুকনের সাথে। ছেলেটা হুট করে কোথা
থেকে এসে ওকে বলে "কাঁদছো কেনো
দেবী, আমি আছি না। আমি বেঁচে থাকতে
তোমায় এভাবে কাঁদতে দেবো না দেবী।"
ওর কথা শুনে শত দুঃখের মাঝেও সুজানার মুখে হাসি
ফুটেছিলো। রুকনের কথায় যেনো জাদু আছে।
কেবল কথা দিয়েই ও সহজেই সুজানার মন
থেকে সকল দুঃখ কষ্ট সরিয়ে দিতো। প্রচুর
হাসাতে পারতো রুকন। আড্ডায় ওর জুড়ি মেলা ভার।
ধীরে ধীরে রাত জেগে ওর সাথে
ফোনে কথা বলাটা সুজানার একটা অভ্যাসে পরিণত
হয়। ওর জন্যে সুজানার মনে কখনো প্রেম
জমেনি। সুজানার সবটুকু প্রেমই কেবল আরিফের
জন্যেই বরাদ্দ ছিলো। তবুও ও রুকনের সাথে
কথা বলতো শুধুমাত্র ওর হাস্যরসাত্মক কথাগুলি
শোনার জন্যে। রুকনের কন্ঠস্বর শোনামাত্র
ওর প্রাণ খুলে হাসি আসতো। কিন্তু রুকন ব্যাপারটা
সিরিয়াসলি নিয়েছিলো। ও মনেমনে সুজানাকে
ভালবেসে ফেলে। একদিন ও সুজানাকে এক
প্রেমপত্র পাঠায় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওটা
আরিফের হাতে পড়ে। আরিফ বিগড়ে যেয়ে
ওকে আচ্ছা মতো ধোলাই দিয়ে হাসপাতালে
পাঠায়। খবর পেয়ে সুজানা আরিফকে খুব বকা ঝকা
করে। আরিফ নিজের ভুল বুঝতে পারে। অতপর
ও সুজানাকে নিয়ে দুদিন পরেই রুকনকে
দেখতে হাসপাতালে যায়। রুকন তার স্বভাবসুলভ হাসি
ঠাট্টা দিয়ে আরিফকেও সহজে আপন করে নেয়।
এরপর থেকে ওরা তিনজন ভাল বন্ধু হয়ে যায়।
কলেজ জীবন শেষে আরিফ ভর্তি হয়
পশুডাক্তারিতে, ওদিকে সুজানা ফার্মাকোলজি
পড়তে থাকে। রুকনের চান্স হয় ইলেক্ট্রিকাল
ইঞ্জিনিয়ারিং এ। এভাবেই তিন বন্ধু তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে
আলাদা হয়ে যায়। শিক্ষাজীবন শেষে আরিফ আর
সুজানা বিয়ে করে। ওদিকে রুকন একাই থেকে
যায়। তারপর হঠাৎ এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ওদের
সাথে আবার রুকনের দেখা হয়। ও এখনো
ব্যাচেলর আছে জেনে সুজানার ভেতর এক
অপরাধবোধ জমে। রুকনের একাকীত্বের
জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হয়। এই
অপরাধবোধ থেকেই ও রুকনের জন্যে
পাত্রী দেখতে শুরু করে ও। পেয়েও যায়
একজন কে। দৃপ্তি। ওদের ভার্সিটিরই মেয়ে।
সুজানা থেকে এক বছরের জুনিয়র। আরিফ আবার
মার দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রুকনকে বিয়েতে রাজি
করায়। ওদিকে সুজানা দৃপ্তির পরিবারকে ম্যানেজ
করে। তারপর ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হয়। তার
এক বছরের মধ্যেই আরিফ আর সুজানার এক
জোড়া জমজ ছেলে মেয়ে হয়। আরিফ ওদের
নিয়ে উন্নতবিশ্বে বসবাসের পরিকল্পনা করতে
থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই আরিফ আর সুজানা
তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে পোল্যান্ডে পাড়ি
জমায়। রুকন আর দৃপ্তি তখনো পেছনে পড়ে
থাকে। পোল্যান্ডে আসার পর প্রথম ক বছর
রুকনের সাথে ফোনে যোগাযোগ হত
ওদের। কিন্তু কালের আবর্তে বাচ্চাকাচ্চাদের
জ্বালায় ওদের বন্ধত্ব দ্রুতই বিস্মৃতির অতলে
হারিয়ে যায়। আজ প্রায় দশ বছর রুকনের সাথে
একটা কথাও হয় নি। ও কি এখনো মানুষকে হাসাতে
পারে? সেই ফুর্তিবাজ রুকন কি এতদিনে বুড়িয়ে
গেছে? আর সেই মুখচোরা লাজুক দৃপ্তিটাই বা
কেমন আছে? এসব ভাবতে ভাবতে সুজানার
চোখের কোনে ফের জল জমে। জীবনটা
খুব দ্রুতই ফুরিয়ে গেছে। জীবনটা আরেকটু
দীর্ঘায়িত করলে কি এমন ক্ষতি হতো?
বার্ধক্যের প্রতি প্রচন্ড অভিমান হয় সুজানার। আরিফ
এসবের কিছুই বুঝতে পারে না। সুজানার চোখে
জল দেখে ও কেবল বুড়িটার চুলে হাত বুলিয়ে
সান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে।
(চলবে)
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now