বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

একটি সোনার দুল

"ছোট গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Äråðhå Ìßñå† (০ পয়েন্ট)

X একটি সোনার দুল —আনোয়ারা সৈয়দ হক এরকম হবার কথা ছিল না, কিন্তু কখন যে মানুষের কী হবে, তা কি কেউ বলতে পারে? নইলে আজ যখন হানুফা বেগম বাজারে যাচ্ছিল তার ছোট ছেলেটির হাত ধরে, তখনো সে ভাবেনি তার কপালে এই নতিজা লেখা আছে। হানুফা বেগমের বাজার খুব সংক্ষিপ্ত ছিল। শাশুড়ির বায়না অনুযায়ী কিছু চুঁইঝাল আর ছোট মাছ। চুঁইঝাল এই এলাকায় বেশ প্রসিদ্ধ একটা খাবার। খাবার বলাটা হয়তো ঠিক নয়, তবে তরকারি রান্না করতে গেলে চুঁইঝাল দিয়ে রান্না করলে তরকারির বেশ স্বাদ হয়। এর আগে অনেকবার সে বাজারে গেছে এবং চুঁইঝাল কিনে এনেছে। হানুফা অবশ্য এই এলাকার মেয়ে নয়। তার বাড়ি বরিশাল সদরে। কিন্তু মইদুল মিয়াকে বিয়ের পর বিগত প্রায় সাত বছর ধরে সে এই এলাকার অধিবাসী হয়েছে। মইদুল মিয়া নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল বলে প্রথম প্রথম শাশুড়ির অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে তাকে, এরপর হানুফার কোলে ছেলে এলে এই বৈরিতা দূর হয়েছে ধীরে ধীরে। এখন তো হানুফা বলতে তার শাশুড়ি অজ্ঞান। এই এলাকায় অনেক বাড়ির মেয়েরা নিজেরা বাজার করে। বাজার কাছেই। অনেক বড় বাড়ির মহিলারাও আজকাল বাজারে ঢুকে নিজের পছন্দমাফিক মাছ, তরকারি বা মাংস কিনে নিয়ে যায়। অনেক বাড়ির পুরুষেরা সকাল ৮টার আগেই কাজে চলে যায়। সবদিন তাদের পক্ষে বাজার করে রেখে যাওয়া সম্ভব হয় না। এলাকায় বেশ কয়েকটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে বাজারঘাট করার প্রতিও পুরুষদের সমর্থন আছে। অথবা সমর্থন না থাকলেও মনে হয় পরিবেশের চাপে তারা এটা মেনে নিয়েছে। তবে সপ্তাহের বড় বাজার এখনো পুরুষদের হাতে। তারা সপ্তাহান্তে নিজেরা বাজারে গিয়ে ইচ্ছেমতো বাজারঘাট করে। তখন তাদের সঙ্গে স্ত্রীরা থাকে না। থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বাজারের পছন্দ-অপছন্দ সবই পুরুষের মনমেজাজ অনুযায়ী। তাদের নিজস্ব খাবারের রুচি অনুযায়ী। হানুফা আজ সকাল করেই রওনা হয়েছিল বাজারের দিকে। মইদুল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির কেয়ারটেকার। সুতরাং সে সকালেই কাজে রওনা হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ির কথা অনুযায়ী চুঁই, ছোট মাছ আর হানুফার ইচ্ছে অনুযায়ী সজনের খাড়া এক গোছা, কিছু পেঁয়াজ মরিচ আর তেল মশলা। ব্যস, বাজার শেষ। বাচ্চা ছেলেটির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রওনা হয়েছিল হানুফা। তেলিপাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল রাস্তার মাঝে ম্যানহোল খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। আরেকটু হলে খোলা ম্যানহোলে পা হড়কে পড়ে যেত সে। সামলে উঠে সে ছেলের হাত ধরে বলল, দেখলিরে সইদুল, কতবড় একখান গর্ত? আরেট্টু হলি আমরা তো পা হড়কেই পড়তাম! সইদুলের বয়স পাঁচ বছর। সে কথা বলে কম। আঙুল চোষে বেশি। মায়ের কথা শুনে সইদুল মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে বলে উঠল, আমরা না, আমি! আমি তো সেই কখুন ধরে দেখছি গর্তের মুখি চাতাল নেই! – অ্যাই দুষ্ট, তো আমারে বলিসনি ক্যান? রাগ করে বলে উঠল হানুফা। আর বলতে বলতে ম্যানহোলের কাছে গিয়ে সে ঝুঁকে তাকিয়ে দেখল ভেতরে কতখানি গর্ত দেখা যায়! ঝুঁকে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে মাথার ঘোমটা খুলে গেল তার। আর টুক করে একটা শব্দ হলো। আর হানুফা, হাই আল্লা, বলে কানে হাত দিয়ে দেখল তার ঝোলানো কানের দুলের একটা টুকুস করে সেই ম্যানহোলের গর্তে পড়ে গেল চোখের নিমেষে। – হায়, হায়, ও সইদুল, কী হলো রে, কী সব্বোনাশ হলো রে বাজান, বলে উঠল হানুফা। এই কানের দুল তার শাশুড়ির দেওয়া। হারালে খবর আছে! তার মুখে সর্বনাশের কথা শুনে তেলিপাড়ার মোকসেদ মিয়া দৌড়ে এলো। – ও ভাবি, হলোডা কী? – ভাইরে, আমার কানের দুলডা – – কী হয়েছে কানের দুলির? জিজ্ঞেস করল মোকসেদ। – কানের দুলডা আমার পইড়ে গেছে পাগাড়ে, ভাই। বলে উঠল হানুফা। তার গলায় আর্তি ফুটে উঠল। – কুথায় পড়ল? কোনখানে পড়ল, এই হানুফা? এবার মোকসেদের সঙ্গে সঙ্গে মিজানুর মোল্লা দৌড়ে এলো। সেও তখন চটের থলি হাতে বাজারে যাচ্ছিল। – উই যে ওইখানে। আঙুল নিচু করে দেখাল হানুফা। সকলেই এরপর তাকিয়ে দেখল। একরাশ পাগাড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। কানের দুলটা ভারী ছিল। আধা ভরি না হলেও তার কাছাকাছি। আর ভারী ছিল বলেই না টুপ করে কান থেকে খুলে পড়ে গেল। এখন কী হবে? হানুফা একবার ভাবল স্বামী মইদুলকে সে মোবাইল করে জানায়। কিন্তু তার স্বামী কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে, অসময়ে ফোন করলে সে অনেক সময় রেগে যায়। সুতরাং তাকে এই দুঃসংবাদ দিয়ে ব্যতিব্যস্ত না করে নিজে নিজেই দুল উদ্ধারে সচেষ্ট হলো হানুফা। করুণ চোখে সে একবার মোকসেদ আরেকবার মিজানুর মোল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, একখান লম্বা লাঠি হলি পরি দুলডা খুঁজে দেখতাম, ভাইজান। – এই যে লাঠি। পাড়ার কিছু লোকজন ইতোমধ্যে জড়ো হয়েছিল, তাদেরই একজন দয়া করে একটা বাঁশের চটা এনে দিলো মিজানুরের হাতে। বাজারের ব্যাগ একপাশে ফেলে রেখে মিজানুর মোল্লা ম্যানহোলের গর্তে পা ঝুলিয়ে বসে বাঁশের চটা দিয়ে খুঁজতে লাগল কানের দুল। একবার এদিকে খুঁজল, একবার ওদিকে। তারপর চতুর্দিকে। কিন্তু কোথাও দুল খুঁজে পেল না। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে উঠল, ও মিজানুর মিয়া, এই ভাবে কাদা খুঁড়লি কি দুল খুঁজে পাবানে? তুমি যে রকমভাবে খুঁজতিছো, তাতে করে সারাদিন লেইগে যাবেনে খুঁজে বার করতি। – তো কীভাবে খোঁজবো, কও? মিজানুর বক্তার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল। দৃশ্যতই সে একটু বিরক্ত হয়েছে। এমনিতে পাগাড়ের কাদা ঘাঁটার জন্যে বাতাসেও এখন পচা কাদার গন্ধ ভেসে উঠছে। অনেকেরই নাক জ্বালা করছে। তবু অনেকেই ঝুঁকে তাকিয়ে দেখছে পাগাড়ের ভেতরে। অনেকে একধ্যানে তাকিয়ে দেখছে। ওই কি কোথাও চিকচিক করে উঠল? ওই কি একটা বস্তু নড়ে উঠল কাদার গহিন গহ্বরে? আরেকটা দুল এতক্ষণ কানেই ঝুলছিল হানুফার, একটু আগে সচেতন হয়ে সে অন্য কান থেকে দুলটা খুলে হাতের পয়সার ব্যাগে ভরেছে। হানুফার মাথায় এখন নানা চিন্তা খেলা করতে লাগল। তার চোখের সামনে যেভাবে কাদা ঘাঁটা হচ্ছে তাতে করে দুলটা যে তার সারা জীবনের জন্যেই হারিয়ে গেল এমন একটা ভয় এখন শুরু হয়েছে মনে। অথচ দুলটা টুপ করে কাদায় পড়ে গেলেও বেশি গভীরে যে যায়নি, এটা সে তখনই বুঝতে পেরেছিল। যদি ওদের কারো কাছে সাহায্য না নিয়ে হানুফা নিজে নিজে বাঁশের চটা দিয়ে দুলটা উদ্ধার করার চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো এতক্ষণে সে উদ্ধার করে ফেলত। কিন্তু এখন পানি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তাই যদি হয় আর স্বামী মইদুল যদি শোনে যে কারো প্ররোচনা ছাড়াই সে নিজে ইচ্ছে করে ম্যানহোলের গভীরতা কতখানি পরিমাপ করার জন্যে মাথা ঝুঁকিয়েছিল, আর তার ফলে আজ এই সর্বনাশ, তাহলে হানুফার কপালে দুর্গতি আছে। তখন আর নিজে শখ করে একদিন হানুফাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে এনেছিল সে-কথা খেয়াল থাকবে না। ঘরের টঙে ঝুলিয়ে ফেলবে সে আজ হানুফাকে। রাত বা দিন তখন সব সমান। বাঁশের চটা দিয়ে কাদা ঘাঁটতে ঘাঁটতে পরিশ্রান্ত হয়ে উঠল মিজানুর মোল্লা। অথচ কাজটা ফেলে রেখে হাত ঝাড়া দিয়ে ব্যাগ হাতে বাজার করতে যাবে, এ-চিন্তাও তার মাথায় এলো না। যেন হানুফা বেগমের কানের দুল উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আজ আর নাওয়া-খাওয়া নেই, এমনি মনে হতে লাগল তার। অথচ এরকম হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সত্যি বলতে হানুফা বেগম তার কে? মোকসেদ মিয়া একসময় মিজানুর মোল্লার হাত থেকে বাঁশের চটা তুলে নিয়ে নিজেই খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিলো। মিজানুর তার ঝুলন্ত পা তুলে নিল ওপরে। এবার পা ঝুলিয়ে বসল মোকসেদ মিয়া। মোকসেদ মিয়া বুদ্ধিমান। সে আরেকটা বাঁশের লাঠি জোগাড় করে দুটো লাঠির সাহায্যে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দিলো। তার কেন যেন ধারণা হলো এভাবে সে দুলটা খুঁজে পাবেই। এতবড় একটা সোনার দুল নইলে যাবে কোথায়? এরপর ধীরে ধীরে লাঠি দুটো গভীরে যেতে লাগল। গভীরে, আরো গভীরে। যেন এর কোনো তল নেই! অথচ এই নর্দমা এত গভীর তো নয়। এখনো পরিষ্কার করার সময় নিচের সিমেন্টে চোখ পড়ে। তির তির করে সেখানে পানি বয়ে যায়। অথচ সেই চেনা নর্দমাই এখন অচেনা! আরে, আশ্চর্য! অনেকক্ষণ কাদা ঘাঁটাঘাঁটির পর মোকসেদ মিয়া ক্ষান্ত দিলে আবার শুরু করল মিজানুর। তবে এবার আর বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করল না সে। একটু পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে লুঙির মালকোচা ঝাড়া দিয়ে খুলে হাতে ব্যাগ তুলে রওনা দিলো বাজারের দিকে। নইলে ওদিকে বেলা হয়ে যায়। মোকসেদ মিয়া কোথাও কাজ করে না। তার বাড়ির সামনেই চালডালের দোকান। দোকানে তার ছেলে বসে আছে। মিজানুর মোল্লা রণে ভঙ্গ দিলে তাই সে দ্বিগুণ উৎসাহী হয়ে আবার খুঁজতে শুরু করল দুল। এসব কাজের একটা নেশা আছে। জেদও আছে। আর সেটা হলো, আরে, চোখের সামনে দিয়ে জিনিসটা পালাবে কোথায়? তাকে ধরা দিতেই হবে। মানুষের চোখের সামনে জিনিস অদৃশ্য, তাও এরকম দিনে দুপুরে, সহ্য করা মুশকিল। মন মানতে চায় না। তাছাড়া যেখানে দুলটা পড়েছে, সেটা তো ওই চোখেই দেখা যায়। সেখানে এত লুকোচুরি কীসের? অস্থাবর বস্তুরও কি মন আছে? তারও কি কখনো অনীহা এসে যায় মানুষের সংসারে? মাথার ওপরে সূর্য উঠে আসছে। ধীরে ধীরে। যেন তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। যে কাজ রোজই করতে হয় তাতে আবার তাড়াহুড়ো কীসের? কিন্তু হানুফার তাড়াহুড়ো পড়ে গেল। সেই কখন সে বাজার করবে বলে বাসা ছেড়ে বেরিয়েছে। এদিকে তার ছেলের চোখে ঘুম এসে গেছে। মায়ের কোলে চেপে বসেছে সে এখন। মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে সে ঘুমোচ্ছে। তার মুখে পোরা আছে বুড়ো আঙুল। এই আঙুল মুখে ছাড়া তার ঘুম হয় না। হানুফা হঠাৎ করে মোকসেদ মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমি বাজারে যাইগে, ভাইজান। কপালি থাকলি পরে এতক্ষুণ জিনিসটে পেয়ে যাতাম, বোঝলেন? কপালে নেই। হারায়ে গেছে। যাকগে, আল্লা যা করে। আপনি আর এত কষ্ট করবেন না, যান, আপনার দুকানে ফিরে যান। এ-কথা বলার পেছনে হানুফার আরো একটা কারণ ছিল। আর তা হলো, সে বাজার করতে গেলে যদি দুলটা মোকসেদ মিয়া খুঁজে পেয়ে গাপ করে দেয়, তার চেয়ে সোনার দুলটা পাগাড়ে পড়ে থাকাই ভালো! কিন্তু মোকসেদ মিয়া তার কথার ভাঁজ বুঝতে পারল বলে মনে হলো না। সে তার কোনো কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে ম্যানহোলে পা ঝুলিয়ে একমনে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। হানুফা আর কী করে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বিমর্ষ মনে সে রওনা দিলো বাজারে। বাজার থেকে ফেরার পথে সে দেখল পাগাড় ঘাঁটাঘাঁটি তখনো চলছে। মিজানুর মোল্লা নেই। মোকসেদ মিয়াও আর নেই। তাদের বদলে অচেনা আরো কয়েকজন ম্যানহোলটাকে ঘিরে বসে আছে। একটা বাচ্চা ছেলেকে এবার ম্যানহোলের হাবড়ের ভেতরে নামানো হয়েছে। সে লুঙি মালকোচা মেরে ম্যানহোলের কাদায় নেমে পড়েছে খালি পায়ে। কাদার ভেতরে খালি পা নেড়ে নেড়ে সে দেখছে কোথাও দুলটার উদ্দেশ পাওয়া যায় কী না। হানুফা কিছুক্ষণ যেন হতভম্ব হয়ে তাদের কাণ্ডকারখানা দেখল। তারপর, দুলডা পালি পরে আমারে খবর দিয়েন, কথাটা বলে সে রওনা দিলো বাড়ির দিকে। ভাবল, রান্নাবান্না শেষে, শাশুড়িকে খাইয়ে এবং বিশ্রামে পাঠিয়ে সে আবার একবার এসে দেখে যাবে। বলা যায় না, দুলটা খুঁজে পাওয়াও যেতে পারে। জলজ্যান্ত একটা জিনিস এভাবে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাওয়া কোনোমতেই যেন গ্রহণ করা যায় না। ওদিকে যারা দুল খুঁজছে, তাদের ভেতরে বচসা বেধে গেছে। মুরুব্বি গোছের একজন বলছে, এতক্ষুণ যখন মিয়ারা পাইলে না, তখুন ইডা আর পাওয়া যাবে নানে। কারণ মনে রাখবা এই যে ময়লা যাওয়ার স্যুয়ারেজ, এও দক্ষিণা চায়! কী সে দক্ষিণা? সেইডা হলো, দান। হানুফা বেগমের কানের দুল এই দান হিসেবে গ্রহণ করিছে স্যুয়ারেজ। রাতদিন মানুষির গু-মুত পার করতি করতি তারও একটা দাবি আছে এলাকাবাসীর কাছে! প্রতিদান ছাড়া এ-দুনিয়ার কোনো কিছু ঠিকমতন চলে না। চলতি পারে না। এইসব অনেক গভীর কথা তুমরা বুঝবা নানে। এর জন্যি বুদ্ধি খরচ করা লাগে। কেন, দেখ না, আমাগের বুড়ি পুকুর পেত্যেক বছর একখান কইরে মানুষ বলি চায়? ক্যান চায়? তার কারণ সারা বছর ধইরে তার মানুষ সেবার একখান দক্ষিণা। এইবার, এই তো সেদিন, রহিমুদ্দির তেরো বছরের ছেলেডারে বুড়ি পুকুর নিয়ে গেল না? ঠেকাতি পারিল কেউ? না। মনে রাখবা, বিনা দক্ষিণায় আল্লাও খুশি না! তারেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পইড়ে তার গুণগান করতি হয়। – এইডা আপনি কি ক’ন চাচা, তা’লি আমাগের মা-বাবার কথাও কি আপনি বলতি চান এইরকম কিছু না দিলি পরে তারাও আমাদের দেখপে নানে? ক্ষুব্ধ হয়ে একজন তরুণ প্রতিবাদ করে উঠল। তরুণের প্রতিবাদে গুঞ্জন উঠল পরিবেশে। অনেকেই তরুণের কথার সমর্থক তাতে বোঝা গেল। মুরুব্বি গম্ভীর হয়ে বলল, শোনো মিয়ারা, প্রতিদান বাবা-মাও চায়। কীভাবে? ওই যে তুমাগের রাতদিন বলে, ভালো হও, ভালো হও, লেখাপড়া করো, সৎপথে থাকো, সৎপথে উপার্জন করো। যদি তুমি তাগের কথার প্রতিবাদ করে কও, আমার যা ইচ্ছে, আমি তাই করবোনে, তো তাগের মুখির দিকে তাকায়ে দেখো দিনি একবার! তাহলি বুঝতি পারবা, প্রতিদান কারে বলে! ছেলেমেয়ের ভালো হওয়ার প্রতিশ্রুতি হতিছে গে তাগের ভালোবাসার প্রতিদান। কোনো বাবা-মা যদি জানে তার ছেলে বড় হয়ে খুনি হবে, জোচ্চোর হবে, ঠগবাজ হবে, জেল খাটবে, সন্ত্রাসী হবে, তালি দেখবোনে ক’জন বাবা-মা তাগের ন্যাগাবানি করে! মুরুব্বির কথায় একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা নেমে এলো পরিবেশে। দু-একজন অন্যমনস্ক হয়ে নাক খুঁটতে শুরু করল। মুরুব্বি হঠাৎ ম্যানহোলে নেমে যাওয়া ছোকরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এবার তুমরা ক্ষ্যান্ত দাও দিনি, অনেক তো হলো। ও দুল আর পাওয়া যাবে নানে। কিন্তু মুরুব্বির এই উপদেশে যেন ফল হলো বিপরীত। আবার মহাউৎসাহে খোঁজা শুরু হলো। মুরুব্বির সব উপদেশ মানতে হবে নাকি? দুলখানার দাম কত সে কি জানে? বাড়ি ফিরে গিয়েও হানুফা বেগমের কাজে মন লাগে না। কোনোরকমে সে ঘর-সংসারের কাজ সারে। দ্রুত হাতে রান্নাবান্না সারে, ছেলেকে গোসল করায়, নিজে গোসল সারে, শাশুড়ির সেবাযত্ন করে, তাকে খেতে দেয়। একবার শুধু হানুফার শাশুড়ি মুখে বলল, আজ তোর বাজার থে ফিরতি এত দেরি হলো ক্যান রে, হানুফা? উত্তরে হানুফা বলল, বাজারে বান্দর খেলা হচ্ছিল, আপনের নাতি সেই খেলা না দেইখে কি বাড়িত আসপেনে, মা? মায়ের এরকম কাঁচা মিথ্যা বলা শুনে সইদুল প্রতিবাদ করে বলল, আমি বান্দর খেলা দেখিনি! তো উত্তরে ছেলের পিঠে কিল মেরে হানুফা বলল, ফের আমার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার জন্যি কাল বায়না ধরিস! তখন বুঝবি মজা। দুপুরে সবকিছু শেষে হানুফা একবার ভাবল একবার বাজারের পথে গিয়ে দেখে আসবে নাকি। কী জানি হয়তো দুলটা কেউ পেয়েও যেতে পারে। আর পেয়ে গেলে হয়তো ব্যাপারটা গোপন করে ফেলতে পারে। হাজার হোক সোনার গহনা বলে কথা। মানুষকে বিশ^াস নেই। তাছাড়া এখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হানুফার হাতের ভেতরে কিছু নেই। হানুফার হারিয়ে যাওয়া কানের দুল খোঁজার জন্যে এখন পাড়ার মানুষেরা মাঠে নেমে পড়েছে। তাদের হাতেই নির্ভর করছে হানুফার দুল তারা খুঁজবে কি খুঁজবে না। এক্ষেত্রে হানুফার আর বলার কিছু নেই। এমনকি দুলটা খুঁজে পেলেও তাতে হানুফার আর কোনো দাবি আছে কি না, সে বিষয়েও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে তার মনে। এইসব জিনিস কিছুক্ষণের ভেতরেই কেমন করে জানি হাত ফসকে অন্যদিকে চলে যায়! হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে কখন যেন হানুফা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল তার কানের দুলটা তখনো পাগাড়ে পড়ে আছে। পাগাড়ের কাদার উপচে ওঠা ঢেউয়ে দুলটা এক একবার চিকচিক করে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব। আবার ডুবে যাচ্ছে কাদায়। যেন কাদায় ডোবার আগে হানুফার দিকে তাকিয়ে বলছে, এই তো আমি। আমারে খুঁইজে পাতিছো না কী রকম? ঘুম ভাঙল তার মইদুলের ডাকে। ও বউ, সন্ধেবেলা এত ঘুমোস ক্যানে? জিজ্ঞেস করল মইদুল। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে হানুফা তাকিয়ে দেখল ঘর অন্ধকার। আর সে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার মনে হলো মাথার ভেতরে নানারকম জটিল চিন্তায় ঘুম আরো বেশি গাঢ় হয়ে নেমে এসেছিল চোখের পাতায়। হানুফা লক্ষ করে দেখেছে, যখনই তার মাথার ভেতরে কিছু জটিল চিন্তা-ভাবনার উদয় হয়, তখুনি তার চোখে ঘুম নেমে আসে। এরকম কেন হয় হানুফা জানে না। তবে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে তার মাথাটা ফুরফুরে মনে হলো। মইদুল বলল, আমারে কিছু খেতে দে। কারখানা থেকে বাড়িতে ফিরেই মইদুল ভাত খায়। সারাজীবন খেয়ে এসেছে। দুপুরেও সে একবার ভাত খায়। তবে প্রায় সে হোটেলেই খাওয়া সেরে নেয়। তাদের ফ্যাক্টরির কাছেই একটা গরিবি হোটেল আছে। সেখানে প্রচুর ভাত, অঢেল ডাল আর কুচো মাছের চচ্চড়ি এখনো বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। শুধু ভাত ডাল খেলেও পেট ভরে। কারখানার শ্রমিকদের জন্যেই মূলত এই হোটেল। তবে বাড়ির মতো রান্না হয় না। হানুফার হাতের রান্নার সঙ্গে তুলনীয় নয়। হানুফা সামান্য তেল মশলা আর আনাজপাতি দিয়ে সুন্দর রান্না করতে পারে। স্বামীর ভাত খাওয়া শেষ হলে হানুফা ভাবে তার কানের দুল হারানোর সংবাদটা সে দেবে কি দেবে না। অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীকে কথাটা না বলাই সংগত মনে করল। বরং তার কাছে যে জমানো টাকা আছে সেটা দিয়ে আরেকটা কানের দুল তৈরি করে নিতে পারবে। সোনার দোকানের কারিগর তার মামা লাগে। তার কাছ থেকেই সে গোপনে তার হারানো কানের দুলের একটা নকল তৈরি করে নিতে পারবে। কথাটা ভেবে তার মনে কিছুটা স্বস্তি হলো। এখন সমস্যা হচ্ছে, তার ছেলে সইদুল। সে না আবার তার বাবার কাছে কথাটা বলে ফেলে। তখন একটা সমস্যা হতে পারে। এই ভয়ে হানুফা ছেলেকে নিজের কাছে ডেকে নিল। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় হানুফার দিকে তাকিয়ে মইদুল বলল, তরে সেই বিকেল থেইকে কেমন য্যান ছনমনে দেখতিছি, কিছু হয়েছে নাকি? – না, না, কী হবে, কিছু না। সঙ্গে সঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল হানুফা। বলার সময় সতর্ক চোখে নিজের ছেলের অবস্থান একবার তাকিয়ে দেখে নিল। ঘরের এক কোণে ছোট একটা চৌকিতে সইদুল ঘুমিয়ে থাকে। সেদিন ঘুমোনোর আগে যে যেন অযথা মোড়ামুড়ি করছিল। একবার তার বাবাকে যেন বলতেও গিয়েছিল কিছু। বাবা, রাস্তার গর্তের ভিতরে মা’র কানের দুল, কিন্তু এ পর্যন্ত বলার পরে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে সহসা আবার আঙুল চুষতে শুরু করেছিল। কথাটা আর বলা হয়নি। মইদুলও ছেলের কথা মন দিয়ে শোনেনি। তারপর তো রাত হলো। মইদুল বিছানায় উঠে আড়ামোড়া খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু হানুফার চোখে ঘুম এলো না। সে অন্ধকারে একভাবে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই প্রথম যেন তার বুকের ভেতরে দুল হারানোর শোক উথলে উঠল। এতক্ষণ যেন দুশ্চিন্তায় সে শোক করতেও পারেনি ঠিকমতো। এবার সে নিশঃব্দে কাঁদতে লাগল। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। আজকের রাতটা তেলিপাড়ার বিশেষ এক রাত। যেন এরকম রাত আর কোনোদিন এ-পাড়ায় আসেনি। ভবিষ্যতে আসবে কি না, তাও এ-মুহূর্তে জানা যাচ্ছে না। এই রাত তেলিপাড়ার নির্ঘুম এক রাত। এমনকি তিনটে তেল ভাঙানো আড়তেও মানুষেরা এখন পর্যন্ত মেশিন চালায়নি! অথচ তারা জেগে আছে। তারা সক্রিয় আছে। এর ভেতরেই আকাশ ঝেঁপে নেমেছে এক চাঁদের আলো। ছোট ছোট কারখানা, ছাপরা ঘর, তেলের আড়ত, একটা-দুটো দালানকোঠা, একটা বৃষ্টি শিরীষ গাছ, যে-গাছে বসে কুরকাল পাখি করুণ স্বরে মাছদের ডাকে, তার ডাকে বিগলিত হয়ে বর্ষার নালা থেকে মাছ ভেসে উঠলে মুহূর্তে সে মাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; সবকিছু একটা যেন স্বপ্নের ঘোরের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা ভাদ্র মাস, কখনো বা দিনের বেলা শঙ্খচিল আসে উড়তে উড়তে, কখনো বা হিজল গাছের ফাঁকে চাঁদ উঁকি মারে সন্ধেবেলা, কখনো বা ধেনো জমির বিলের পাশ দিয়ে গন্ধভাদালির ঝোপে খেলা করে ফিঙে, তবে এসব এখন বাতুল। প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার এখন সময় নয়। এখন আকাশ ঝেঁপে নেমে এসেছে চাঁদের আলো। আর সেই আলোয় মুখ ব্যাদান করে পড়ে আছে তেলিপাড়ার ম্যানহোল। ম্যানহোলের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঢিবি সমান কাদা-হাবড় আর ঘোলা কালো পানি। তার ভেতরে নানা প্রকারের বাতিল সব জিনিস। কাচের টুকরো, ওষুধের খোল, প্লাস্টিকের ঢাকনা, মাটির চাড়ি, প্লাস্টিকের ব্যাগ, ছেঁড়া জুতো, ভাঙা চিরুনি, আরো অজানা-অচেনা কিছু। চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বস্তুগুলো। কেউ কেউ নাকে হাত দিয়ে রেখেছে, তবু স্থান ত্যাগ করছে না! এখন রাতের বেলা চাঁদের আলোয় মায়াবী ছায়ার মতন দেখাচ্ছে মানুষগুলোকে। তারা নীরবে আপনমনে কাজ করে চলেছে। কাদা হাবড়ে খুঁজে চলেছে হানুফা বেগমের কানের দুল। ভাদ্রমাসের গরমে তাদের শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে। মাঝেসাঝে কালো কালো ছায়া ছায়া সেই শরীরগুলো যেন ক্রমশ লম্বা হয়ে উঠেছে। লম্বা আর শিরিঙ্গে। তাদের কালো শরীরে চাঁদের আলো পিছলে পিছলে পড়ছে। তাদের কেউ কেউ, এখনো, এই গভীর রাতে কাদার ভেতরে নেমে খুঁজে চলেছে হানুফা বেগমের কানের দুল। সোনার একটি দুল কি হারাতে পারে? অসম্ভব!


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ১০৪ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now