বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
#আরব্য_বেদুঈন
#পর্ব_০১
ধূ ধূ করছে মরুভূমি। চারিদিকে চোখ ঘোরালে 'দিকচক্রবালে' কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না। শুধুই বালি আর বালি। আরবের ঊষর মরু। ঊষর কিন্তু সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর। সারাদিন আগুন ঢেলে ক্লান্ত সূর্য অস্ত যাচ্ছে।তার সোনালী রঙ ধরেছে ছোট বড় বালির পাহাড়ের মাথায় মাথায়। উত্তাল তরঙ্গের এক সমুদ্র যেন কোনো যাদুকরের মন্ত্রবলে বালুময় হয়ে গেছে। থেমে গেছে তার গতি। স্তব্ধ শান্ত মুর্তি। এই স্তব্ধতা কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। আঁধি আসবে। আসবে সাইমুন মরুঝড়। নিমেষে পাহাড় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। অন্যখানে আবার তৈরি করবে নতুন বালির পাহাড়। কাল সকালে নতুন সূর্যের কিরণে স্নান করবে নতুন বালুগিরিরাজ।
দূরে উটের সারি চলেছে। চলেছে বণিকের দল। খুব মনোরম দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার শরীরের রক্ত তীব্রবেগে ছুটতে শুরু করেছে। শক্ত হচ্ছে পেশি। বল্লমটা আঁকড়ে ধরে, এক লাফে উঠলাম আমার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে আরো কুড়ি জন। আমরা যত্নে লালিত আদুরে দুলাল নই। আমরা নিষ্ঠুর, মরুচারী দস্যু। এই বালিতেই আমাদের জীবন, বালিতেই মরণ, বালিতেই কবরস্থান, শেষ ঘুম। আমার চোখের এক ইশারায় মরুঝড় তুলে উটের দলকে ঘিরে ফেলল পঁচিশটা ঘোড়া। ঐ উটের সারি থেকে কে গুলি চলাচ্ছে ! কার এত বড় সাহস ! শুরু হল সংঘর্ষ।
দৃশ্য বদলে গেছে।
উটের সারি এখন আমাদের কব্জায়। আমাদের অস্থায়ী আস্তানায় ওদের পিছমোড়া করে বেঁধে, মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। মোট আটজন। ছটা মরদ, দুটো মেয়ে। বনিক শেখ, আর তার বেগম, সঙ্গে বেগমের সুন্দরী পরিচারিকা, আর তিনটে শেখের দেহ রক্ষী। সম্ভ্রান্ত মিশরীয় বণিকের দল। সবকটাকে বালিতে উপুড় করে শুইয়ে বল্লম নিয়ে পাহারা দিচ্ছে আমার অনুচর। বাকিরা ডাকাতির ধন গুছিয়ে রাখছে তাঁবুতে। আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছি কত ফায়দা হল। বাঁশের খুঁটির গায়ে মশাল জ্বলছে। বাকি সব অন্ধকার। যেন চোখের সামনে কালো রঙের দেওয়াল তুলে দিয়েছে কেউ।
হঠাৎ বন্দীদের ওখানে একটা শোরগোল শুনে দৌড়ে গেলাম। শেখের বেগম লুকোনো ছুরি দিয়ে শেখে বাঁধন কেটে দিয়েছে। শেখ দৌড়ে ঘোড়ায় চড়ে পালাচ্ছে....ঘোড়ার খুরের শব্দ লক্ষ করে বল্লম ছুড়লাম। নিষ্ঠুর লক্ষভেদ। ঘোড়াটা ছুটে পালালো। ওর বেগম দৌড়ে গেল, সঙ্গে সহচরী। কেঁদে আছড়ে পড়লো নিস্পন্দ প্রিয়তমের বুকে। ওকে ধরে তুললাম। অদূরেই মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আমার সহচর। হাতের ছুরি দিয়ে নাকাবের বাঁধন কেটে সুন্দরীর মুখ দেখলাম.....
"একি ! আমার কৈশোরের প্রেম মেহের.....! মেহেরুন্নেসা !"
আগেই বলেছিলাম না। মরুঝড় সাইমুন এক পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে আর এক পাহাড় সৃষ্টি করে। আবার কখনো উল্টো ঝড়ে পুরোনো জায়গায় তৈরি হয় নতুন বালির পাহাড়। প্রবল মরুঝড়ে চোখ খোলা রাখাই দায়। দাঁড়ানোও যাচ্ছে না ঠিকমত। একটু আগেই হুকুম দিয়েছি, উট গুলোকে বসে পড়তে। এই রকম মরু ঝড় আমাদের পূর্ব পরিচিত। উটগুলো গোল হয়ে বসে আর তার মাঝখানে মানুষ গুলো। কোনোরকমে ঝড়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে। এটাই এখানকার নিয়ম। পশু, মানুষ সবার চোখ বন্ধ। যেতে আমাদের হবেই নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছে এক শেখ। তার কাছেই কালকে রাতের লুঠের মাল বিক্রি করতে হবে। একটু থিতু হয়ে বসে কাঁধের কাছে যে কাপড়টা ঝুলছিলো, সেটা দিয়ে চোখের ওপর বেঁধে নিলাম। পাতলা কাপড়, চোখ দুটো রক্ষা করবে, আবার মাঝে মাঝে চোখ খুলতেও পারবো। চোখ দুটো খুলে রাখা এখন ভীষন জরুরী। এই সুযোগেই বেইমানি করে দলের লোক..... পিঠপিছে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে দলপতির।
কাল রাতেই শেখের দেহটা বালিতে দফন করে দিতাম। পায়ের ওপর কেঁদে লুটিয়ে পড়েছিলো মেহের।
একটা মরুদ্যানে কবর দিও ওকে.... এ ইচ্ছেটুকু আমার পুরণ করো.........
ওর আকুল আবেদন ফেলতে পারি নি। হাজার হোক একদিন তো ওকে ভালোবেসে ছিলাম। তখন আমার কতোই বা বয়স সতেরো কি আঠেরো। মেহেরুন্নেসা খুব জোর ষোড়শী। আরব দেশের মেয়ে পুরুষের শরীর তৈরী হয় একটু আগেই, আমাদেরও হয়েছিল। মনে তখন নতুন প্রেমের জোয়ার। আমাদের গাঁয়ে ডাকাতরা আসতো প্রায় প্রতি মাসেই নিয়ম করে......... ঊষর বালু প্রান্তরের মাঝখানে ছোট্ট জনপদ। নব্য কিশোরের স্বপ্নে আমি তখন মশগুল। ডাকাতরা এসে ইঁদারা ঘিরে দাঁড়াতো। ওদের ঘোড়ার খুরের শব্দে, গা ঢাকা দিতো জল আনতে আসা গ্রামের মেয়েছেলে গুলো।
সেদিন মেহের গিয়েছিলো ওর বড় দিদিটার সঙ্গে, জলের কলসি নিয়ে। প্রথম গেছিলো তো, তাই পালাতে পারেনি। একটা ডাকাত ছোঁ মেরে ওকে তুলে নিয়েছিলো ঘোড়ায়। সব কটার চোখে তখন সদ্য যৌবনবতী নারী শরীরটাকে ছিঁড়ে খাওয়ার লালসা।
দেখে আমার শরীরের রক্ত গরম হয়ে ফুটতে শুরু করেছে, ঘরের আবডালে লুকিয়ে থাকতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে আক্রমণ করলাম, ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে দিলাম মেহের আর দস্যু দুজনকেই। মোহের দৌড়োলো.... পালিয়ে বাঁচলো........
আমি বাঁচলাম না। একসঙ্গে ছটা দস্যু আমাকে ঘিরে নিলো। ওদের হাতে তলোয়ার, আমার হাত খালি....
"জিন্দা রাখখো.... বেঁধে ফেলো ওকে...."
ওদের সর্দার এ অসম লড়াই দেখছিলো ঘোড়ার পিঠে বসে। ও দেখেছিলো আমার জোশ। তাই মেরে ফেলেনি আমাকে। দস্যুরা আমাকে বেঁধে নিয়ে বস্তার মত তুলে দিলো একটা ঘোড়ার পিঠে। গ্রামের মুখীয়ার শত অনুরোধ উপেক্ষা করে, আমাকে নিয়ে চলে গেল মরুভূমির মধ্যে ওদের আস্তানায়।
তারপর বহু বছর কেটেছে। মরু দস্যুদের কুলি থেকে আজ আমি দস্যু সর্দার। কাল রাতেই বেরহেম ভাবে নিকেশ করেছি মিশরীয় শেখকে। বন্দী করেছি ওর বেগম আর তার সুন্দরী বাঁদীকে। ওর সঙ্গের লোক লস্কর গুলোকে বানিয়েছি আমার গোলাম।
রাতে মশালের আলোয় ওর বেগমের মুখ দেখতে গিয়েছিলাম.....ধারালো ছুরির ফলায় নকাবটা ফালাফালা করতেই বেরিয়ে এলো.... আমার মেহের.....!
মৌজ করার জন্য বাঁদিটাকে আগেই সঁপে দিয়েছি আমার বিশ্বস্ত অনুচর আবু বাখারের হাতে। মেহেরকে নিয়ে এসেছিলাম আমার তাঁবুতে। মনটা খুশ ছিলো, লুঠের মাল এসেছে বহোত। মেহের কাঁদছিলো....
শেখ তোকে বহোত প্যার করতো..... তাইনা..?
হ্যাঁ.... ছোটি বেগম ছিলাম যে....!
আমার থেকেও জ্যাদা....?
তুমি আর প্যার করার সুযোগ পেলে কোথায়.... আমাকে ছোঁয়ার আগেই তো..... গাঁয়ের সবাই বলে তুমি কোতল হয়ে গেছ....!
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ আমার অট্টহাসিতে মরুদিগন্ত কেঁপে উঠল.....! আনপড় গাঁওয়ার লেড়কি..... দিল কা বাত নেহি সমঝি.....?
দস্তুর জানিস তো..... তুই এখন আমার সম্পত্তি....বাঁদিও হতে পারিস..... আবার আমি চাইলে বেগম করেও রেখে দিতে পারি....!
যা ইচ্ছে করো.... কিন্তু একটা রেহেম করো....ওর শরীরটা কোনো মরুদ্যানের পাশে দফন করো...!
কিঁউ......মুর্দে পে ইতনা প্যার..... আমার চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল.... তোর সামনে তোর পুরানা আশিক দাঁড়িয়ে আছে...... আমাকে থোড়াসা প্যার দিতে পারিস না......
যতো খুশি প্যায়ার নিও আমার থেকে.... আগে ওর অন্তেষ্টিটা করতে দাও আমাকে.... দু চোখে জলের ধারা মেহেরের...... আমার মেহের কাঁদছে...... বেরহেম শয়তানের চোখ লবনাক্ত হচ্ছে..... যখন তোমার ভালাটা ওর পিঠ ফেড়ে কলিজা উপড়ে নিয়ে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল..... আমি ওর মুখটা দেখেছিলাম..... ও একটু জল চেয়েছিলো..... পায়নি...... আমি চাইনা.... উসকা রুহ থোড়িসি পানিকে লিয়ে ইঁয়াহা ভটকে.......
খামোশ....... চিৎকার করে উঠলাম..... সহ্য করতে পারছিলাম না....আমার মেহেরের আর্তনাদ.....বুক ফাটা কান্না।
ওকে একটা মরুদ্যানের পাশে দফন করো.....
রাত ফুরিয়ে আসছিলো। একটা উটের পিঠে লটকে দিতে বললাম শেখের মৃতদেহটা। শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটায় চাপ চাপ কালচে রক্ত তখন মাখামাখি.......আরেকটা উটের পিঠে চড়ে বসলাম মেহেরকে নিয়ে আমি..... বিস্তৃত মরুসাগর দিনে যতটা গরম.... শেষ রাতে ততটাই শীতল। ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে ওঠা মেহেরকে জড়িয়ে নিলাম......আমার টগবগ করে ফোটা রক্তের উষ্ণতায়....।
আমার হুকুমে আমার লোকেরা বালি সরিয়ে কবর তৈরি করলো মরুদ্যানের পাশে। অবাক হয়ে দেখছিলো কেউ কেউ....... মুখে প্রশ্ন করার সাহস কারোর নেই..... শেখের দেহটা কবরে নামিয়ে দিলো ওরা। ফুল কোথায়.... ফুল আঁকা কামিজের একটা টুকরো ছিড়ে মেহের শেষ শ্রদ্ধা জানালো.....তারপর...... এক মুঠো বালি ফেলে দিলো ওর মৃত আশিকের কবরে। ঝপাঝপ বেলচা চালিয়ে কাজ শেষ করলো আমার অনুচরেরা।
জলে নেমে গেল মেহের.... ডুব দিয়ে মাথা তুললো। ওর চুল থেকে ছিটকে আসা জল ভিজিয়ে দিলো আমাকে।
কালো মরুভূমির আকাশ দিগন্তে তখন প্রথম লাল।আমরা ফিরে চললাম আমাদের তাঁবু ছাউনির দিকে, আজকেই লুটের মাল বেচতে হবে।
নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করবে আর এক শেখ।
চলবে....
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now