বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
-কী হলো খোকা, কী এত ভাবিস?
রানা সেই তখন থেকে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না। মায়ের কথায় তার মধ্যে ভাবান্তর পর্যন্ত নেই! মা এবার একটু অস্থির হয়ে উঠলেন, একটু ভয়ও পেলেন বুঝি। রানাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আগের প্রশ্নটারই পুনরাবৃত্তি করলেন
-কী হলো খোকা…? ইস, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোর! দাঁড়া, তোর বাবাকে ডেকে আনি…
-তুমি ডাকলেই কি আব্বু আসবে?
যৌক্তিক প্রশ্ন!
রানা হলো পাড়ার বখাটেদের লিডার। অ্যান্টি-গ্রুপের হাতে রামধোলাই খেয়ে মাথা ফাটিয়েছে সে। এলাকার ‘ছোট ভাইয়েরা’ হসপিটাল থেকে সেলাই-ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাসায় ছেড়ে গেছে।
অকর্মার ঢেঁকি ম্যাট্রিক ফেল ছেলেটার অকর্ম-কুকর্ম রোজকার ব্যাপার। এর নালিশ, ওর নালিশ শুনে শুনে বাবা হয়রান। এমন ছেলে জন্মানোর চেয়ে না জন্মানোই ভালো! এ ছেলে যেন কেবল মায়ের! কথায় কথায় মাকে শাসায়- “তোমার ছেলে….!” অথচ ওর তো হওয়ার কথা ছিল বাবার ছেলে…
হয় নি, তো কী? ছেলে তো, ছেলে-ই! শেষমেশ বাবা-মায়েরই মানিক; যত যা কিছুই করুক, বাবা মা আগলে না রাখলে কার কাছে যাবে?
-কী যা তা বলছিস? আসবে না কেন? তোরই তো বাবা…
-মা, আমি যদি ছেলে না হয়ে তোমার আরেকটা মেয়ে হতাম তাহলে কি আমার জ্বর হয়েছে শুনলে আব্বু আসত?
মা কী রিপ্লাই দেবে বুঝে উঠতে না পেরে ছেলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। নীরবতা ভাঙলো মা-ই
-বাপ রে, কতবার বলছি তুই এইসব ভাবিস না! তুই আমাদের ছেলে। ছেলে হয়ে জন্মাইছিস, মেয়ে হইলে কী হইতো না হইতো এইসব ক্যান ভাবতে বসিস বাপ?
-তুমিও তো আমার কথার উত্তর দাও না! কিন্তু নানীর কাছে শুনছি, আমি ছেলে না হইলে আব্বু তোমারে ঘর থেকে বাইর করে দিত!
ছেলের মুখে কথাগুলো মা আর নিতে পারল না, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
-মা, কষ্ট পাইলা?
-হুম!
-আমারে মাফ কইরা দ্যাও! কিন্তু কথাগুলা কি মিথ্যা, বল?
-বাপ রে, কী হইলে কী হইত সেইটার চাইতে বড় কথা হইল কী হইছে সেইটা। যেইটা হয় নাই সেইটা হইলে কী হইত সেটা ভাইবা কী লাভ বাবা? দুইটা জিনিস তো আর একসাথে হয় না…
-হয় তো! এই যেমন, এখন আমার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। তুমি আমারে নিয়া মহা পেরেশানিতে আছ। কিন্তু এমনও তো হইতে পারত, তুমি আমারে নিয়া নানা বাড়ি যাইতেছ… ট্রেনে কইরা…
মা আবারো ডুকরে কেঁদে উঠল। ছেলের হাত তার হাতের মুঠোয়। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতেছে ছেলেটা। ডাক্তার ডাকা জরুরি। মা তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তাল সামলাতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়ল। চোখজোড়া আপনাতে বন্ধ হয়ে এলো।
……………………………………………
ঠান্ডায় গা হাত-পা জমে যাচ্ছে, অথচ মেয়ের খবরই নেই! বেহুঁশের মতো ঘুমোচ্ছে। পাশেই কম্বল ভাঁজ করে রাখা, একটু খুলে যে গায়ে জড়িয়ে নেবে…!
ট্রেনের দুলুনিতে হঠাৎ কেন জানি রানু বেগমের ঘুমটা ভেঙে গেছিল। কী মনে করে উপরের বার্থে উঁকি দিয়ে মেয়ের অবস্থা দেখল। গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। হাতটা ধরে রানুর মনে হলো ঠান্ডায় যেন জমে গেছে!
সংসারের সবকিছুর দিকে, সবার দিকে রানির অনেক খেয়াল। খেয়াল নেই শুধু নিজের দিকে!
নানীর অসুখের খবর জেনে রানিই মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। মা জানে তিনটা দিন একসাথে ছুটি নিতে মেয়েকে কতকিছু ম্যানেজ করতে হয়। হয়ত বসের অনেক কথা শুনতে হয়েছে মেয়ের। বেসরকারি চাকুরি কিনা। সেটাও আবার পার্ট-টাইম, অনার্স পড়ার পাশাপাশি।
আরো চারটা বোন তো রানির আছে, তাহলে রানিকেই সবসময় কেন সংসারের সবকিছু দেখতে হয়?
প্রশ্নটা যৌক্তিক বটে! কিন্তু এর উত্তর রানি কখনোই দেয় নি, দেবেও না কখনো। মায়ের সম্মান তার কাছে সবকিছুর আগে।
হয়ত বাবার সম্মানটাও সে অবচেতনে ভাবে। না থাকুক পাশে, না করুক আদর; মেয়ে তো, বাবার প্রতি আলাদা টান তো থাকবেই! নইলে যে লোকটা….
সংসার, পড়ালেখা আর চাকুরি, সেই সাথে সমাজের বাঁকা দৃষ্টি আর পথের অনিশ্চয়তা-নিরাপত্তাহীনতা। সবটা সামলাতে সামলাতে মেয়েটা কখনো সখনো হাঁপিয়ে ওঠে।
-ইস, আমি যদি তোমার একটা ছেলে হতাম…!
-আবার এই কথা! খবরদার যদি আবার বলিস….! তুই আমার ছেলের থেকে কম কীসে? শোন মা, তুই আমার মেয়ে, তুইই আমার ছেলে…
রোজকেরে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মা আলগোছে মেয়ের গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিল। রানির কখন ঘুম ভেঙে গেছে মা খেয়ালই করে নি। মায়ের হাতটা আলতো করে ধরল। মা পিছন ফিরলেন।
-কী রে, ঘুম ভেঙে গেল যে?
-তুমি এত কষ্ট করে উঠতে গেলে কেন মা?
মা কিছু বলল না, মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
এমন সময় হঠাৎ ট্রেন তুমুল বেগে কাঁপতে লাগল। ট্রেনভর্তি মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠল, আতঙ্কে হৈ চৈ জুড়ে দিল। কেউ কেউ আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগল জোরে জোরে। মায়ের মুখেও গভীর আতঙ্কের ছাপ। কিন্তু মেয়ের মুখটা একদম প্রশান্ত; টেনশনের লেশমাত্রও নেই।
-মা রে, ট্রেন ব্রেক ফেল করেছে!
মা কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলল। মেয়ের মুখে অভয়দানের হাসি।
-মা, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? ভয় পেও না, আমি তোমার পাশে আছি তো! চোখ বন্ধ করো…
মা ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করল।
………………………………………………
চোখ মেলতে প্রচণ্ড আলোয় চোখজোড়া ঝাঁঝিয়ে গেল রানি বেগমের। আলো চোখ সয়ে নিতে সবকিছু ঠিকঠাক। সামনে রানার মুখ। প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও মুখটা কী কোমল আর হাসি হাসি!
-কী হয়েছে মা?
-মাথাটা একটু চক্কর দিয়ে উঠল বাবা! আর তারপর…
-তারপর কী মা? ট্রেন, অন্ধকার রাত, আমার ‘না হওয়া’ বোন… এই সবই তো, না? বল বল, এগুলা না….?
-কী আজেবাজে বকিস বাবা! এখানে ট্রেন আসবে কোত্থেকে? আর ‘না হওয়া বোন’… বাপ রে, এইটা আর কখনো বলিস না। তুই আমার সাত রাজার ধন… চার মেয়ের পর তুই আমার কোলজুড়ে এসেছিস। ‘না হওয়া’ বলতে কিছু নাই রে! তুই হইছিস, এইটাই সত্যি!
-কিন্তু না হইলে কী হইত মা?
ছেলের মুখে সেই এক কথা। রানু কুড়ি বছর আগের সেই দিনটার কথা ভুলে যেতে চায়, পুরোপুরি ভুলে যেতে চায়। কিন্তু ঘুরেফিরে আসে বারংবার।
-হতচ্ছাড়ি মেয়েছেলে! এইবারও মাইয়া জন্ম দিছস! মাইনসের ঘরে ঘরে ছাওয়াল জন্মায়, আর আমার ঘর ভরছে মাইয়া দিয়া..!
-আল্লায় দিসে, আমি কী করতাম!
রানু কাঁদতে থাকে। তাতে জমির উদ্দিনের মেজাজ আরো চড়ে যায়।
-আল্লায় দিসে! আল্লায় কী আর কাউরে দেখে না, খালি তরেই দেখে? তরেই মাইয়া দিতে অইব?
জমির উদ্দিনের চিৎকার চেঁচামেচিতে রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল।
-আল্লার ওয়াস্তে আপনি চুপ করেন! মাইনসে শুনব…
-মাইনসে শুনলে শুনব! কান খুইলা শুইনা রাখ, এইবারই শ্যাস! এর পরও যদি ছেলে দিতে না পারস তাইলে তর আর আমার ঘর করন লাগব না, বুঝছস!
ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকা অবলা স্ত্রী আর তাদের ফুটফুটে নবাগতা মেয়েকে ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে জমির উদ্দিন।
সেদিনের পর থেকে রানু কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্কে ডাকতে থাকে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে চোখের পানি ফেলে আল্লাহ্র কাছে একটাই চাওয়া পেশ করত- একটা ছেলে সন্তান! নইলে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
হতে পারে আল্লাহ্ রানুর দোয়া কবুল করে একটা ছেলে উপহার দিয়েছেন, যে ছেলে টিনেজ বয়স পেরোনের আগেই নানান কুকর্ম করে বাবা-মায়ের মাথা হেট করে দিয়েছে…
কিংবা আল্লাহ্ রানুকে এর চেয়েও বড় ‘উপহার’ দিয়েছেন- একটি সুযোগ্য কন্যা! যার কাছে পরিবারের সম্মান আর দায়িত্ববোধই সবার আগে। যে চরম সংকট মুহুর্তেও প্রিয়জনের পাশে থাকে এই ভরসা দিয়ে- “ভয় পেও না, আমি তোমার পাশে আছি...!
……………………………………………
ধপ করে একটা শব্দ…. জমির উদ্দিন ঘুম থেকে ধরমরিয়ে উঠল। রানু বেগম মেঝেতে পড়ে আছে। মাথার চক্করটা যে কেন এত হরদম হচ্ছে!
স্ত্রীকে সযত্নে মেঝে থেকে বিছানায় উঠিয়ে বসালো। যাক, চোট খুব একটা লাগে নি!
পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীর ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে দুয়েকবার পড়ে যাওয়ার পরপরই জমির উদ্দিন বিছানার চতুর্ধারে পুরু কার্পেট বসিয়ে দিয়েছে যাতে পড়লে বেশি চোট না পায়।
গ্লাসভর্তি পানি এনে নিজের হাতে যত্ন করে স্ত্রীকে পান করালো। অসুস্থ স্ত্রীর সেবাযত্নের কমতি তিনি রাখেন নি। বাসায় রানি বেগমকে দেখভালের জন্যে ফুলটাইম দুজন মহিলা রেখেছেন। এরপরও যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন স্ত্রীর যত্ন নিজের হাতে করেন।
চার মেয়ের সবাইকেই তিনি সযত্নে বড় করেছেন। সবাইই যে যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। স্বামী-সন্তান নিয়ে ওরা সকলেই সুখে আছে। দুনিয়ের বুকে একটা যেন স্বর্গ ওদের। তবে আসল স্বর্গে আছে তো ওনার পঞ্চম সন্তান, পৃথিবীর আলো দেখার পরক্ষণেই যে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে!
গেল কুড়িটা বছর পঙ্গু স্ত্রীকে আগলে রেখেছে জমির উদ্দিন। তার অসহায়ত্বের পেছনে তারও যে দায় আছে!
আর রানু বেগম…? সে জানেই না মৃত সন্তান ছেলে ছিল না মেয়ে। কল্পনার জগতে কখনো সে এক দামাল ছেলের প্রশ্রয়দাত্রী জননী, কখনো সংসার আগলে রাখা লক্ষ্মী মেয়ের মা।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now