বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
-কী হলো রমেশ?
-জ্বি কর্তা তেমন কিছু না, টায়ার পাঙ্কচার!
রমেশের কথা শুনে মনে হলো না এটা কোনো সমস্যা। কিন্তু প্রফেসর সুভাষ পাল জানেন এই মুহূর্তে এটা কত বড় সমস্যা! বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, এখনো বাকি লম্বা রাস্তা। পথটাও এমন জনমানবহীন, এখানে টায়ার সারানোর দোকান তো দূর, সাধারণ মানুষেরও দেখা মেলা ভার। কী ঝক্কি সামনে অপেক্ষা করছে এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন সুভাষ।
-স্যার, একদম চিন্তা করবেন না! পথ কিন্তু বেশি না, ঘন্টা দুই হাঁটলে পৌঁছান যাবে
ড. শেঠির এসিস্টেন্ট নজরুল যেন ড্রাইভার রমেশের চেয়ে এককাঠি সরেস! দুই ঘন্টার রাস্তাকে রাস্তাই মনে করছে না! কিন্তু বিকল্প কিছুও তো সামনে নেই। অগত্যা রমেশকে গাড়িতে ছেড়ে দুজন হেঁটে যাওয়া শুরু করল।
-স্যার, একটা গল্প শুনবেন?
-জ্বি না! গল্প আমার বিশেষ পছন্দের না
-আহা! শুনুনই না। এতটা পথ চুপচাপ গেলে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাবেন। গল্প শুনলে দেখবেন মুহূর্তটা দারুণ কেটে যাবে
সুভাষ বিরক্তমুখে নজরুলের দিকে একবার তাকাল
-বলো! কী গল্প বলবে? ভূত-প্রেত, ডাইনী…
-ছি ছি, আপনি বিজ্ঞানের মানুষ, আপনাকে বলব ভূত-প্রেতের গল্প! আপনাকে বরং একটা প্রাণীর গল্প বলি। আজব প্রাণী। গল্প অবশ্য না, রিয়েল লাইফ ঘটনা।
-রিয়েল লাইফ? জানো তো নজরুল, বেশিরভাগ রহস্যগল্পকে ‘সত্য ঘটনা’ বলে উল্লেখ করা হয়। গল্পকার, এমনকি শ্রোতাও জানে এটা নিছক গল্প। তারপরও বলতে এবং শুনতে পছন্দ করে তারা। কারণ অসম্ভব কিছু বাস্তবে ঘটলে কেমন লাগবে এই ফিলটা মানুষকে সবসময়ই আকৃষ্ট করে।
-জ্বি না স্যার, এটা আসলেই সত্যি ঘটনা! এটা আমাদের স্যার, মানে শেঠি স্যারের গল্প
-শেঠি স্যারের নিজের গল্প?
-জ্বি! বছর পাঁচেক আগের কথা। স্যার এই বাগানবাড়িটা সবে কিনেছেন। বাড়ি তৈরিই ছিল। তবে কেউ ওটাতে থাকত না।
-দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি বলছ পাঁচ বছর আগের কথা। অথচ তুমি এখানে এসেছ দু’বছর। তার মানে ঘটনা তোমার নিজের না, কারো কাছে শুনেছ। রাইট?
-জ্বি স্যার, সত্য! আমি নিজে দেখি নাই। তবে স্বয়ং শেঠি স্যার আমাকে বলেছেন। স্যার নিশ্চয়ই মিথ্যা বলবেন না!
-শেঠি স্যার নিজে বলে থাকলে ঠিক আছে। নইলে বানোয়াট গল্প আমার একেবারেই পছন্দ না। ওকে, গো অ্যাহেড!
-যা বলছিলাম। বাড়ি কেনা হয়েছে, কিন্তু স্যার তখন ভয়ানক ব্যস্ত। নিজে একবার এসে যে দেখে যাবেন সেই সময় পান না।
তো এভাবে ছ’মাস পার হয়েছে। স্যার ঠিক করলেন কিছু দিনের জন্যে ছুটি নেবেন। খুব স্ট্রেসড অবস্থা। ছুটিতে অন্য কোথাও না গিয়ে বাগানবাড়িতে যাওয়া মনস্থির করলেন। এক জুনিয়র কলিগকে সাথে নিয়ে চলে এলেন বাগানবাড়ি।
বাড়িসহ পুরো জায়গাটা স্যারের ভীষণ মনে ধরল। তিনি একদিনের জায়গায় সাত দিন কাটিয়ে দিলেন।
যাবার দিন সকালে দ্বিতীয় তলার মাচায়, মানে সিলিংয়ের ফাঁকা জায়গাটায় গেছেন কয়েকটা জিনিস রাখতে। নেমে আসবেন, এমন সময় অন্ধকারে কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগল। হাতে নিয়ে মনে হলো গোলগাল এবং কিছুটা লম্বা একটা কিছু। প্রথমে ভাবলেন পাথর। কিন্তু ওই সাইজের পাথর অত হালকা তো হবে না! তিনি কৌতুহলবশত জিনিসটা নিয়ে নিচে নামলেন।
কালচে ছাই রংয়ের বস্তু। ভালভাবে পরখ করে বুঝলেন ডিম! কিন্তু কীসের ডিম যে অত বড়?
সহকর্মী বলল কিউই পাখির ডিম হতে পারে! কিন্তু স্যার কথাটা উড়িয়ে দিলেন। এখানে কিউই আসবে কোত্থেকে! কৌতূহল থেকে ঠিক করলেন এটা ফুটিয়ে বাচ্চা বের করবেন। তখন বোঝা যাবে কোন প্রাণীর ডিম। তবে হ্যাচারিতে নিয়ে গেলে অহেতুক লোক জানাজানি হবে। তাই বাড়িতেই ইনকিউবেটরের ব্যবস্থা করলেন।
যথাসময়ে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুলো। কিন্তু বোঝা গেল না জিনিসটা আসলে কী। পাখির মতো ছোট্ট একটু লেজ আছে বটে, কিন্তু ডানা নেই। পাখি না প্রাণী? ধন্দ্বে পরে গেলেন। মনস্থির করলেন একটু বড় হলে প্রাণীবিদের সাথে আলাপ করে দেখবেন এটা কী।
স্যারের দুই সপ্তাহের ছুটি গিয়ে ঠেকল ছয় মাসে। এর মধ্যে প্রাণীটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। যত বড় হচ্ছে তত বিকটদর্শন হচ্ছে। প্রাণীবিদ ২/৩ বন্ধুকে ছবি তুলে পাঠালেন, কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না। তবে এটার চেহারা আর আওয়াজ থেকে অনুমান করা যায় এটা হিংস্র কোনো প্রাণী হবে। সেটা যে হবে স্যার তার প্রমাণ পেলেন হাতেনাতে।
একদিন গভীর রাতে স্যারের ঘুম ভাঙল কুকুরের আর্ত চিৎকারে। তড়িঘড়ি করে বাইরে এসে দেখলেন ভয়ানক দৃশ্য। কুকুরের ঘাড় কামড়ে ধরে রেখেছে প্রাণীটা। রক্তারক্তি অবস্থা!
প্রাণীটাকে একটা খাঁচায় রাখা হতো। মাঝরাতে খাঁচার শিক ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। আসলে বড় হওয়ার সাথে সাথে খোরাক বাড়ছিল। দিনে সাপ্লাই দেয়া মাংসে ক্ষুধা মিটছে না। কিন্তু এত খাবারের জোগান আসবে কোত্থেকে? স্যার চিন্তায় পড়ে গেলেন।
একবার ভাবলেন বনের প্রাণীকে বনে ছেড়ে আসবেন। কিন্তু এখনই যে হিংস্র! আরো বড় যখন হবে, গায়ে পায়ে শক্তি বাড়বে, সাথে হিংস্রতাও। তখন যদি কোন কারণে লোকালয়ে চলে আসে তাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে! এই চিন্তায় স্যার ঠিক করলেন এটাকে খামার বাড়িতেই রেখে দেবেন।
মোটা শিক দিয়ে বড় একটা খাঁচা বানানো হলো। এরপর থেকে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা প্রাণীটাকে খাঁচায় রাখা হতো। দেখভালের জন্যে একজন লোক নিযুক্ত করে স্যার শহরে ফিরে গেলেন। কিন্তু পরদিনই ওনাকে খামারবাড়ি আসতে হলো।
কর্মচারী লোকটা ছিল বেশ ইয়াং। প্রাণীটাকে খাবার খাওয়ানোর সময় খাঁচার কাছাকাছি ছিল হাতটা। ব্যস, আর যায় কোথায়! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটার হাত কামড়ে ধরে প্রাণীটা। ছেলেটা প্রাণে বেঁচে গেলেও কবজি থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্যার ওকে বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দিয়ে মুখ বন্ধ করলেন। হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। শক্ত করে বলে দিলেন প্রাণীটার ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলতে।
ঘটনাটার পর থেকে প্রাণীটার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা দেখা দিল। নরমালি ওটাকে মুরগী খেতে দেয়া হয়। কিন্তু দুর্ঘটনাটার পর থেকে সামনে মুরগী দিলে সে শুঁকে মুখ ফিরিয়ে নিত। খাঁচার কাছাকাছি কেউ গেলে তার মধ্যে অস্থির ভাব দেখা যেত। অস্থির হয়ে খাঁচার ভেতরে পায়চারী করত আর লোকটাকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে দেখত। স্যার বুঝলেন প্রাণীটা শুধু মাংসাশীই নয়, নরমাংসভোজী! প্রথমবার মানুষের মাংসের স্বাদ পাওয়ার পর সে তার আত্মপরিচয় আবিষ্কার করেছে। এখন থেকে সে মানুষকে আক্রমণ করতে সদা তৎপর থাকবে নিশ্চিত।
দানবটাকে শেষ করতে হবে! আর কোনো পথ নেই। স্যার দুজনকে নিযুক্ত করলেন কাজটায়। তবে ছোটবেলা থেকে পেলেপুষে বড় করেছে, তাই স্যারের নিজের পক্ষে হত্যাদৃশ্য দেখা সম্ভব না। তিনি খামারবাড়ি ত্যাগ করলেন। ইতিমধ্যে ওনার বদলির আদেশ এসেছে। এদিকের সব ফেলে তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলেন। কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, খামারবাড়িতে আর আসেন নি।
এক নাগাড়ে অনেক্ষণ কথা বলে নজরুল থামল।
-তারপর?
-তারপর আমার গল্প ফুরালো নটে গাছটি মুড়ালো!
সুভাষ বিরক্ত চোখে নজরুলের দিকে তাকাল। নজরুল সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসলো।
-স্যার, দেখেছেন গল্পের ম্যাজিক! ঘন্টাখানেক হাটলেন, অথচ এ নিয়ে আপনার মধ্যে কোনো কমপ্লেইন নেই! গল্প ছাড়া যদি হাটতাম তাহলে এতক্ষণে আমার মুণ্ডুপাত করতেন!
নজরুল ঠিকই বলেছে। এতটা পথ এক নাগাড়ে কখনো হাঁটে নি সে। অথচ গল্পে এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিল যে পথের দিকে খেয়ালই ছিল না তার। অবশ্য এটার ক্রেডিট ফুললি গো’স টু নজরুল! ছেলেটার গল্প বলার সহজাত গুণ আছে, শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।
-স্যার, অর্ধেক রাস্তা তো পেরিয়ে এসেছি। এবার আসুন বাকিটা আরেকটা গল্পে পার করি। কী বলেন?
-জো আপকা মর্জি!
-না না স্যার, আপনার মর্জি না থাকলে আমি শুধু শুধু কেন বকবক করি!
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তুমি গল্প শোনাও। আমার শুনতে ভাল লাগছে!
-ঠিক আছে। এবারের গল্পও শেঠি স্যারকে নিয়ে।
একটু আগে বলেছি, স্যার নতুন কর্মস্থলে গিয়ে কাজে এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পরেন যে আর খামারবাড়ি যাওয়ার সময় বের করতে পারেন নি। তো কী নিয়ে ব্যস্ত হলেন এবারের গল্প সেটা নিয়ে।
আগেই বলে নিই, স্যারের বদলি কিন্তু কোনো রুটিন ট্রান্সফার ছিল না। স্যারকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।
সেসময়টায় শহরে সুইসাইড অনেক বেড়ে গেছিল। যাকে বলে সুইসাইডের মহামারি!
সুভাষ নজরুলের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। মহামারি কথাটা তার মনঃপুত হয় নি।
-জ্বি জ্বি আত্মহত্যারও মহামারি হয়! ইতিহাসে এর অসংখ্য নজির আছে।
-যেমন?
-গত ৯০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের পুলিশদের মধ্যে সুইসাইড প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছিল।
আসলে কখনো কখনো সমস্যাগ্রস্ত একজন ব্যক্তি সুইসাইডের মাধ্যমে একই অবস্থায় থাকা বাকিদের সমস্যা উত্তরণের পথ দেখিয়ে যায়। আর সেই পথ ধরে আরো মানুষ সুইসাইড করে। এটাই সুইসাইড এপিডেমিক বা আত্মহত্যার মহামারি।
যেমন ধরুন প্রেমে ব্যর্থতা- সাইকোলজিস্টদের একাংশের মতে শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রেমে ব্যর্থদের মধ্যে সুইসাইড প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
আর আমাদের দেশেই দেখুন না, প্রতি বছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করায় বা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না না পারায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বিগত বছরে কেন বেড়েছে? কারণ মিডিয়ায় এসব নিউজ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে, আর ব্যর্থ শিক্ষার্থীরা সুইসাইডকে খারাপ রেজাল্টের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করছে।
-তার মানে তুমি বলতে চাও পত্রপত্রিকায় নিউজ ছাপা না হলে সুইসাইড কমে যাবে?
-আমার বলায় কী আসে যায় স্যার! তবে এটা যে কাজে দেয় তা শেঠি স্যারের ঘটনা থেকে বুঝেছি
-শেঠি স্যারের ঘটনা?
-জ্বি, সেটাই তো বলছিলাম! মাঝে সুইসাইড মহামারি এসে বাগড়া বাধাল।
তো ঘটনায় ফিরে যাই।
শহরে দুই/তিন বছরে আত্মহত্যার হার অনেক বেড়ে গেছিল। প্রশাসনিক তৎপরতার মাধ্যমে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
সুইসাইডের তিনটা হটস্পট সনাক্ত হয়েছিল।
গোল্ডেন গ্রেট ব্রিজ- যার নিচে খরস্রোতা নদী; একবার কেউ নিচে পড়লে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা অলমোস্ট জিরো!
সল্ট স্প্রিং ব্রিজ- জলপ্রপাতের ওপরে এই সেতু থেকে কেউ ঝাঁপ দিলে কোথায় গিয়ে ভেসে উঠবে বলা মুশকিল- এতটাই তীব্র এর জলপ্রবাহ।
তৃতীয়টা হলো স্টিপ ক্লিফ- এই চূড়া থেকে খাঁদের নিচটা দেখতেও হিম্মত লাগে! বুঝতেই পারছেন এখান থেকে নিচে পড়লে কী অবস্থা হবে।
স্টিপ ক্লিফকে রেস্ট্রিকটেড এরিয়া ঘোষণা করে সিল করে দেয়া হলো। সল্ট স্প্রিং ব্রিজ বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট। আর গোল্ডেন গ্রেট ব্রিজ পুরোদস্তুর যান চলাচল সেতু; তাই এই দুটোকে পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। জায়গা দুটোয় চব্বিশ ঘন্টা টহল বসানো হলো।
প্রশাসনিক উদ্যোগগুলোর ফলাফল হলো মিশ্র। শুরুতে কাজে দিলেও কিছুদিন পর আবারো সুইসাইড কেস আসতে লাগল। কেউ কেউ টহলকারীদের চোখ এড়িয়ে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে। আবার কেউ ভিন্ন উপায় নিচ্ছে। কেউ বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছে, কেউ বিষ খাচ্ছে, কেউ গলায় দড়ি দিচ্ছে। মোটকথা আত্মহত্যাপ্রবণতা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না।
এই সুইসাইড প্রবণতা কমানোর স্পেশাল টাস্ক দিয়ে শেঠি স্যারকে শহরের পাঠানো হলো। প্রশাসনিক উদ্যোগ কাজ করছে না বিধায় তখন প্রয়োজন হয়েছিল নগরবাসীদের মনস্তত্ব পর্যালোচনা এবং সে আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। কারণ সুইসাইডের মতো স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার ট্যাকল করতে প্রয়োজন অন্তর্নিহিত কারণ উদ্ঘাটন, সাইকোলজি এনালাইসিস যার মধ্যে সবচেয়ে জরুরী।
স্যার দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ ক্ষমতাবলে কিছু প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করলেন।
ক. গোল্ডেন গেট, সল্ট স্প্রিং ব্রিজের ওপর পায়ে হেঁটে চলাচল নিষিদ্ধ।
খ. পদচারীর পাশাপাশি সাইকেল, মোটর বাইক, অর্থাৎ যেটাতে সাধারণত একক আরোহী চলাচল করে এবং সুযোগ বুঝে সাইকেল বা বাইক রেখে টুপ করে লাফ দিতে পারে, সেগুলোও করতে পারবে না।
গ. সেতু দুটোর ওপর কোনো বাহন থামতে পারবে না। থামলেই মামলা, জরিমানা!
ঘ. একটি হটলাইন চালু করা হলো। কারো মধ্যে সুইসাইডের নূন্যতম লক্ষণ দেখলেই নম্বরটিতে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়ে বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হলো
ঙ. সুইসাইড নিয়ে কোনো ধরণের নিউজ করা যাবে না!
স্যার নিজে ঝানু মনস্তত্ববিদ; আরো জন বিশেক সাইকোলজিস্ট-সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়ে একটা স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন করলেন। বিগত তিন বছরের নথি পর্যালোচনা করে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে পেলেন।
যেমন- আত্মহত্যার কারণঃ গুরুত্বের ক্রমানুসারে- অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা ও বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ও প্রিয় বিচ্ছেদ, হতাশা ও বিষণ্ণতা, খারাপ রেজাল্ট, অতিশাসন।
আত্মহত্যাকারীদের বয়সঃ মূলত টিনেজ এবং ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে সুইসাইড প্রবণতা বেশি। টিনেজদের ক্ষেত্রে কারণ বলাই বাহুল্য। ষাটোর্ধ্বদের ফাইন্ডিংস বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মূলত চাকুরিজীবী, যারা সম্প্রতি অবসরে গেছেন, স্ত্রী আগেই মারা গেছে, সন্তানরা খোঁজ নেয় না বা গুরুতর রোগ যা নিরাময় হচ্ছে না- এদের মধ্যে সুইসাইড প্রবণতা বেশি।
এই ফাইন্ডিংস বেশ কাজে এলো। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে জানানো হলো সরকারের বিশেষ সেবা প্রকল্প ‘মনের জানালা’র কথা। হতাশ ব্যক্তি, যাদের কথা শোনার কেউ নেই বা যারা বিষণ্ণতায় ভুগছে, তারা বিনামূল্য এই সেবা নিতে পারবে। আর পরিবারের সদস্য বা বন্ধু বা পরিচিত কারো মধ্যে সুইসাইড প্রবণতা দেখলে হেল্পলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে টিম সরাসরি যোগাযোগ বা প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রেসকিউ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
সাইকোলজিস্ট এবং সাইকিয়াট্রিস্টদের নিয়ে দুটো দল করা হলো। একটা দলের কাজ শুধু কথা শোনা, আর অন্য দল প্রয়োজনীয় সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট দেবে।
দুটো দলই যদি ব্যর্থ হয় তো কেস সরাসরি ডিল করবেন ড. শেঠি।
স্যারের উদ্যোগ অল্প সময়েই সফলতার মুখ দেখল; ছয় মাসের মধ্যে শহরে সুইসাইডের হার অনেক কমে গেল। এই সফলতা স্যারকে রীতিমত সেলিব্রেটি বানিয়ে দিল। মিডিয়ায় প্রচুর লেখালেখি হলো; স্যারের সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ল। স্যার অবশ্য সবসময় ক্রেডিট দিয়েছেন তার টিমকে।
যখন সবকিছু ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল তখন সামনে এলো আরেক রহস্য। আগেরবারের চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটা। কারণ আগেরবারের ঘটনাগুলোর কারণ মোটামুটি সামনেই ছিল। ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহজে নেয়া গেছে। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো!
দুই বছরে সুইসাইড কেস প্রায় শূন্য; কিন্তু এই দু’বছরে অনেক বেড়ে গেছে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা। মিসিং কেস রিপোর্টিং বিরতি দিয়ে দিয়ে হচ্ছিল বিধায় ব্যাপারটা প্রথমে ধরা যায় নি। তাছাড়া মিসিং কেস রিপোর্ট করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি ফিরে এলে সেটা থানায় ইনফর্ম করাকে দায়িত্ব মনে করে না কেউ। ফলে মিসিং কেস নিয়ে থানায় মাথাব্যথা একটু কমই থাকে। কিন্তু এবারের বিষয়টার গুরুত্ব প্রথম অনুভব করেন পুলিশ স্টেশনে সম্প্রতি বদলি হয়ে আসা সিআই সুব্রত। পুরনো নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দু’বছরে মিসিং কেস রিপোর্ট হয়েছে ৭৯ জনের। এর মধ্যে এখনো নিখোঁজ ৪৭ জন! সংখ্যাটা গেল এক বছরে ৩৩, গেল ছয় মাসে ২১। অর্থাৎ, ক্রমশই বাড়ছে।
বিষয়টি মিডিয়ার নজরে না এনে গোপন তদন্তে নামল সিআই। সিক্রেট মিশন, জানত শুধু তার ইনচার্জ।
গভীর রহস্য! যত রহস্যের জাল ছাড়ায় ততই যেন নতুন জালে আটকা পড়ে! কেস টু কেস ইনভেস্টিগেশন করে বেশিরভাগ কেসের সাথে একটা কমন প্লট খুঁজে পেল সিআই- নিখোঁজ ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই হতাশ, বিষণ্ণ ছিল। বয়সের কোনো বাছবিচার ছিল না। আর নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে তারা প্রত্যেকেই শরণাপন্ন হয়েছিল ‘মনের জানালার’! কখনো নিজ উদ্যোগে, কখনো হেল্প লাইনের মারফৎ।
-বলো কী! সুইসাইড কেস থেকে মিসিং কেস!
সুভাষ হতভম্ব। ঘটনা এভাবে মোড় নেবে তা সে চিন্তাও করে নি।
একটা রিসার্চ ওয়ার্কের অংশ হিসেবে ড. শেঠির হেল্প তিনি বহুবার বহুভাবে নিয়েছেন। অমায়িক আর সহযোগী মনোভাবের এই প্রফেসরের সহায়তা তাকে গবেষণাকাজে অনেক সাহায্য করেছে। দেশে এসে তাই ড. শেঠির সাথে সাক্ষাতের জন্য সে মুখিয়ে আছে। লোকটা বিগত কয়েক বছরে একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। চাকুরি ছাড়ার পর বাগানবাড়িতে পার্মানেন্টলি শিফট হয়েছেন। মানুষের সাথে সচরাচর সাক্ষ্যাত করেন না। তবে সুভাষের সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজি হয়েছেন।
ড. শেঠির ব্যাপারে টুকটাক জানাশোনা ছিল তার। চাকুরি থেকে ইস্তফা দেয়ার কথা জানতেন। কিন্তু এর পেছনে এমন রহস্যঘেরা কিছু আছে বলে তার কল্পনাতেও ছিল না।
-জ্বি মিসিং কেস! কিন্তু সিআই শুধু যোগসূত্রই বের করতে পারল, রহস্যভেদ করতে পারল না। যেহেতু লিংকটা স্যারদের প্রজেক্টের সাথে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই পুরো টিম জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে। স্যারসহ সবাইই তাতে পুরোপুরি কো-অপারেট করেছিলও। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় নি। কারণ প্রত্যেকেই সাইকোলজিস্ট সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথে কনসাল্টেশন শেষে যার যার গন্তব্যে ফিরে গেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ, তাদের হারিয়ে যাবার সাথে 'মনের জানালা'র কারো সরাসরি যোগাযোগ পাওয়া গেল না।
গল্পের এই অংশে এসে নজরুল থামল। অনেক্ষণ কোনো কথা বলল না। গা ছমছমে অন্ধকার জঙ্গলে এক অদ্ভুত নৈশব্দ গ্রাস করল চারধার। গল্পের সুর কেটে গেছে। সুভাষ আর চুপ থাকতে পারল না।
-কী হলো তারপর? রহস্যভেদ কী করা গেছিল?
-উঁহু!
এক কথায় দায়সারা উত্তর! আবারো নীরবতা।
-আচ্ছা নজরুল, তুমি শেঠি স্যারের সাথে আছ কবে থেকে?
কী একটা ভেবে প্রশ্নটা করল সুভাষ। কিন্তু নজরুল উত্তর দিল না।
-আমরা এসে গেছি আমাদের গন্তব্যে!
সুভাষ বুঝে পেল না নজরুল কেন তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেল। তবে ইচ্ছে করেই যে এড়িয়ে গেল তা পরিষ্কার বোঝা গেছে!
দুজন এসে থামল বিশাল এক গেটের সামনে। গেটে লোহার ভারী দরজা। বিশাল এলাকার পুরোটা ঘেরা কারাগারের মতো উঁচু দেয়ালে।
-স্যারের মহল একটু ভেতরে। যাওয়ার আগে আসুন এদিকটা একটু ঘুরে দেখাই।
সুন্দর ছিমছাম একটা জায়গা। বিচিত্র সব গাছগাছালিতে ভরা। আছে জীবজন্তু আর পাখির খাঁচাও। সবগুলো দেখে শেষে এসে থামল একটা ফাঁকা এক দিক খোলা কক্ষে। অদ্ভুত কক্ষ, দরজা জানালা কিছু নেই। তবে বসার সুন্দর জায়গা আছে। দুজন আরাম করে বসল।
-স্যার, জানতে চাইছিলেন আমি শেঠি স্যারের সাথে কবে থেকে আছি। অনেক বছরই তো হয়ে গেল! আপনাকে বলেছিলাম, স্যার বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যাওয়ার আগে এই জায়গাটার দেখভালের জন্যে একজনকে নিযুক্ত করে গেছিলেন; সেই লোকটা স্যার আমি!
নজরুল শালের আড়াল থেকে ডান হাতটা সুভাষের সামনে তুলে দেখাল। কব্জিসহ হাতের বাকিটা নেই! সুভাষ একটু যেন চমকাল।
-কথাটা তুমি তখন বল নি কেন?
নজরুল মুচকি মুচকি হাসছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর মুখ খুলল।
-আসেন স্যার, আপনাকে দ্বিতীয় গল্পের শেষটা বলি।
-কিন্তু তুমি তো বলেছিলে কেসটা অমীমাংসিত!
-অমীমাংসিতই। তবে এর একটা ‘টেইল এন্ড’ আছে! সব পরিবেশে তো আর সব গল্প বলা যায় না স্যার! এই গল্পটা বসে বলার গল্প।
সুভাষ এক বিচিত্র অনুভূতি বোধ করছে। সেই সাথে একটু ভয় ভয়ও করছে তার। নজরুল নিজের মতো বলে চলেছে।
-সিআই স্যারের ইনভেস্টিগেশনে আরো কয়েকট বিষয় উঠে এসেছিল।
যে মানুষগুলো মিসিং ছিল তাদের একটা বড় অংশ ‘মনের জানালা’র সেবা নিতে এসেছিল- এটা বলেছি। তবে যেটা বলি নি তা হলো এদের সবাইই শেষ কনসাল্ট করেছে শেঠি স্যারের সাথে। মানে এদের ব্যাপারে জুনিয়র লেভেলের সাইকোলজিস্ট-সাইকিয়াট্রিস্টটা হাল ছেড়ে দিয়েছিল বলে তারা শেঠি স্যারের কাছে রেফার্ড হয়েছিল।
তাদের মধ্যে আরেকটা মিল- প্রত্যেকেই পরিবার থেকে দূরে থাকত। কেউ মেসে বা নির্জন এপার্টমেন্টে স্ত্রী-সন্তান ছাড়া; কারো পরিবারে কেউই নেই। অর্থাৎ, তারা যে মিসিং এই বিষয়টি জানাজানি হতে অনেক সময় লেগেছিল।
মিলগুলো একদিকেই নির্দেশ করছে- ঘটনার পেছনে হাত ড. শেঠির!
কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এরকম স্বনামধন্য কাউকে তো গ্রেপ্তার করা যায় না। আগেই বলেছি স্যার ততদিনে সেলিব্রেটি!
তবে সিআই সুব্রতও হাল ছাড়তে নারাজ। রহস্যভেদে মরীয়া হয়ে তিনি শেষমেশ একটা ফন্দি আঁটলেন; নিজেই পেশেন্ট সেজে শরণাপন্ন হলেন ‘মনের জানালা’র। জুনিয়র লেভেল কনসালটেন্ট তাকে রেফার করল ড. শেঠির কাছে। এটাই তো চাইছিলেন মি. সুব্রত! কিন্তু তিনি জানতেন না কী ভয়ানক জালে সেধে ধরে দিলেন!
-তোমরা তাকে কী করেছেন? কী পরিণত হয়েছিল তার?
-বাকি সবার যে পরিণতি হয়েছিল! হা হা হা!
নজরুল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে টিপল দেয়ালের একটা বাটন। মুহূর্তে একটা লোহার গরাদ দেয়া দরজা সশব্দে নেমে এলো নিচে, সুভাষ আর তার মাঝে।
-সুভাষ বাবু, এবার নিজের পরিচয়টা দিয়ে দিন! আপনি যে কোনো রিসার্চার না তা আমি জানি!
-কীভাবে জানেন?
-প্রথমত গত তিন মাসে আপনার সাথে ওনার একটা ই-মেইলও আদান প্রদান হয় নি। আপনি বলেছেন স্যার আপনাকে মেইলে এখানে আসার ইনভাইটেশন দিয়েছেন। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না!
আর দ্বিতীয়ত আপনার হাত বলছে না আপনি সফট কোনো কাজ করেন! বরং আপনি কোনো বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত। পুলিশের লোক? কেন এসেছেন এখানে? মিসিং পিপলের রহস্য উদ্ধারে? না সিআই সুব্রতের অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করতে?
-যদি বলি দুটোই!
-পারবেন না!
-অ্যাঁ!
-তাদের কাউকেই উদ্ধার করতে পারবেন না
-কেন?
-কারণ তাদের কেউই আর এগজিস্ট করে না!
-কী বলছেন আপনি!
-সবই যেহেতু জেনেছেন, আসেন শেষটাও জানেন!
সুব্রতর শেষ পরিণতি সেই উপায়েই হয়েছে, যে উপায়ে হয়েছিল শহরের বাকি সব মিসিং ব্যাক্তিদের।
আগেই বলে রাখি, যদিও সবার মৃত্যুর পেছনে ড. শেঠির হাত ছিল, কিন্তু সবটা জানলে তাকে আপনি সিরিয়াল কিলার বলতে পারবেন না!
স্যারের কাছে আসা সবাইই যে মারা পড়েছিল তাও না। স্যার তার কাছে রেফার্ড ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ব্যাপারে কনভিন্স করতে একদমই কার্পন্য করতেন না। কিন্তু এতসবের পরও যদি কেউ সুইসাইডের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তো তাকে সেই সুযোগটা করে দিতেন স্যার নিজে!
স্যারের ফিলসফি খুব সিম্পল! পৃথিবীতে একজন মানুষ এমনি এমনি আসে নি, তার কিছু দায়িত্ব আছে এই পৃথিবীর জন্যে কিছু হলেও করার। হুট করে লাফিয়ে পড়ে, বিষ খেয়ে বা দড়িতে ঝুলে পড়লে না হয় নিজের উপকার, না অন্যের। স্যার তাই এমন ব্যবস্থা করতেন যাতে কারো মৃত্যুতে নিজের না হোক, অন্তত সামান্য একটু উপকার অন্য কারো হয়।
‘মনের জানালা’র ওয়ার্ক স্ট্রেশন ছাড়াও স্যারের একটা ব্যক্তিগত গোপন চেম্বার ছিল। মনের জানালা থেকে ডিসচার্জ করার পর সংশ্লিষ্ট সুইসাইডাল ব্যাক্তিকে পরদিন সেই চেম্বারে যোগাযোগ করতে বলতেন। তাকে বলতেন একটা লেথাল ইনজেকশন দিয়ে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু দেবেন। কিন্তু আসলে সেটা লেথাল ইঞ্জেকশন ছিল না, ছিল চেতনানাশক ইঞ্জেকশন! ইঞ্জেকশন পুশ করার পর ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত সে।
যখন ঘুম ভাঙত তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করত একটা নির্জন সেলে! একটু পর তার দিকে এগিয়ে আসত একটা কুৎসিত হিংস্র প্রাণী। যেটার কথা প্রথম গল্পে বলেছি। একটা অপার্থিব আতঙ্কে বীভৎস চিৎকার গলা দিয়ে বেরোতে বেরোতে থেমে যেত লোকটার নাড়ির স্পন্দন। জগতের একটা প্রাণীর ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটানোর মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিত সে। মৃত্যু পুরোপুরি বিফলে যেত না, কী বলেন!
সুভাষ এক দৃষ্টিতে নজরুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। খাঁচার দরজা নামার সাথে সাথে ভেতর থেকে ভয়াল প্রাণীটার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাচ্ছিল। সেই গর্জন এখনো থামে নি।
-বেচারা সুব্রত, রহস্যভেদ করতে এসে বীভৎস জন্তুর সামনে পড়ে কতই না কাকুতি মিনতি করছিল! নিজের পরিচয় সে নিজে থেকে দিয়েছিল, কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। যেমনটা হবে না আপনার! সুব্রতর মৃত্যুরহস্য ভেদ করতে এসে…
-সুব্রত না, আমি এসেছি ড. শেঠির মৃত্যুরহস্য ভেদ করতে!
বলতে বলতে বুট জুতোর ভেতর থেকে ছোট্ট গানটা বের করে কিছু বুঝে ওটার আগে শ্যুট করল নজরুলের বাঁ পায়ে। পড়ে গিয়ে নজরুল আবার মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে খাঁচা ধরে এগিয়ে গেল দ্বিতীয় বাটনটা প্রেস করতে। ওটা চাপলে খুলে যাবে সুভাষ আর ভেতরের প্রাণীটার মধ্যকার গেট। কিন্তু পারল না, সুভাষের গান থেকে দ্বিতীয় বুলেট গিয়ে বিঁধল তার ডান পায়ে। ধরাম করে মেঝেতে পড়ে গেল সে। সুভাষ দ্রুত বাটন টিপে খাঁচার দরজা তুলে দিল। গান ঠেকাল নজরুলের মাথায়।
-গল্পের বাকি অংশ আমার থেকে শোন; সাথে পরিণতিও! যখন সুব্রত মিসিং হলো তখন তৎপর হলো পুলিশ বাহিনী। কেস এলো আমার কাছে। ড. শেঠি স্যারকে ছ’মাস ফলো করেছি, কিন্তু কিচ্ছু পাই নি। অথচ মিসিং কেস ঘটেই চলেছে। তখন মনে পড়ল ট্রেনিংয়ে শেখা থিওরির কথা- ‘ব্লাইন্ড স্পট’! আচ্ছা, ড. শেঠির ওপর ফোকাস করতে গিয়ে অন্য কাউকে মিস করে যাচ্ছি না তো! এই চিন্তা মাথায় আসতেই ‘মনের জানালা’র প্রত্যেক সদস্যকে আলাদাভাবে ফলো করতে শুরু করলাম আমরা একটা টিম। আর তাতে বেরিয়ে এলো আরেকজনের ইনভলভমেন্ট- ডা. শ্রী নিভাস!
তুই যেই সিক্রেট চেম্বারের কথা বলেছিস সেটা ড. শেঠি নয়, চালাত ডা. নিভাস! তোর এই বাগানবাড়িতে জয়েন করার আগে যে সহকারীকে নিয়ে ড. শেঠি এখানে এসেছিল সে ডা. নিভাস-ই! লেথাল ইঞ্জেকশনের কথা বলে অ্যানেসথেসিয়া দেয়া আর বাগানবাড়িতে পাঠানোর নেপথ্যেও ছিল ডা. নিভাস। সব সে করেছে ড. শেঠির নামে। থার্ড ডিগ্রিতে সবকিছু সে স্বীকারও করেছে। সাথে তোর ইনভলভমেন্ট! তবে দুই জানতিস না ডা. শ্রী নিভাসের কুকীর্তি। আর সেও জানে না তোর কুকীর্তি, যা তুই ড. শেঠির সাথে করেছিস! ভালোই ভালোই বল ড. শেঠিকে কী করেছিস? নইলে ৩য় বুলেট তোর মাথা ভেদ করবে।
নজরুল গোঙাতে গোঙাতে সবকিছু খুলে বলল-
মিসিং লোকগুলোর শেষ পরিণতি ড. শেঠিও জানতেন না। কিন্তু যখন থেকে মিসিং কেস নিয়ে মি. সুব্রতর তৎপরতা শুরু হলো আর মনের জানালার সবাইকে সে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল তখন ড. শেঠিরও সন্দেহ হতে থাকে।
তারই পেশেন্ট, যে কিনা আত্মহত্যা করবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তারা সুইসাইড না করে মিসিং হচ্ছে কেন? ডেডবডিই বা কেন মিলছে না?
শেষমেশ তার ইনভেস্টিগেশন তাকে পৌঁছে দিল নিজের বাগানবাড়ি পর্যন্ত। তিনি প্রাণীটাকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। ওটা এখনো বেঁচে আছে! তাহলে দুজনকে যে প্রাণীটাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা ওটাকে মারে নি! আর নজরুলকে তো তিনি বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; সে কেন ফিরে এলো শেঠিকে না জানিয়ে?
ড. শেঠি যা অনুমান করেছিলেন তা সত্যি প্রমাণ হলো। শহরে ফিরে যাবার নাম করে তিনি বাগানবাড়ি থেকে বেরোলেন বটে, কিন্তু গোপনে ফিরে এলেন। মাচার মধ্যে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
রাত দশটা মতো হবে; একটা কাভার্ড ভ্যানের চাকার আওয়াজ পাওয়া গেল। ড. শেঠি একটা কালো শাল পরে বেরিয়ে এলেন। গায়ের কালো রং আর কালো রঙয়ের শালে তিনি অন্ধকারে প্রায় মিশে গেলেন। কাভার্ড ভ্যানটা থেমেছে প্রাণীটার খাঁচার সামনে। ভ্যান থেকে এক অচেতন তরুণকে নজরুল আর ড্রাইভার ধরাধরি করে নিচে নামাল। ড্রাইভার আর কেউ না, ডা. শ্রী নিভাস!
ড. শেঠি ছেলেটাকে দেখে চিনলেন। এ তো সেই ছেলে সর্বশেষ যাকে তিনি কাউন্সেলিং করেছিলেন! ছেলেটাকে কোনভাবেই তিনি সুইসাইড না করার ব্যাপারে মানাতে পারছিলেন না।
নজরুল আর ডা. নিভাস অচেতন তরুণটাকে প্রাণীটার খাঁচায় ঢোকাতে যাবে; ড. শেঠি তাদের হাতেনাতে ধরলেন। কল করে পুলিশে খবর দিতে যাবেন, নজরুল পিছন থেকে লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। যখন জ্ঞান ফেরে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন জন্তুটার খাঁচায়। ডা. শ্রী নিভাস ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। নইলে প্রিয় স্যারকে দানবটার হাতে এভাবে ছেড়ে দিতে অবশ্যই বাধা দিত সে।
নিজের হাতে জন্ম থেকে বড় হওয়ার রাক্ষস প্রাণীটা মুহূর্তে তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেলো; আর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করল নজরুল! এক অদ্ভূত পৈশাচিক আনন্দ, যা সে প্রতিটা মানুষের শেষ পরিণতিতে পেয়েছে।
ড. শেঠি যাদের প্রাণীটাকে হত্যার দায়িত্ব দিয়েছিল তাদের দিয়েই নজরুলের এক্সপেরিমেন্ট শুরু। ড. শেঠির নাম করে একাজে অন্তরালে থেকে তাকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে ডা. নিভাস। প্রাণীটার ওপর তার মায়া জন্মে গেছিল। নিজের হাতে যার জন্ম তাকে মারে কী করে! কিন্তু বাঁচিয়ে রাখলেই শুধু হবে না, খেতেও তো দিতে হবে নরমাংসখাদকটাকে। সেই ব্যবস্থাই ডা. নিভাস করেছে মনের জানালার মাধ্যমে।
নজরুলের কেস অবশ্য পুরোপুরি ভিন্ন! একটা প্রাণীর উদরপূর্তি তৃপ্তি নয়, বরং তার কাছে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা মানুষের মর্মভেদী আর্তনাদ ছিল এই মানুষরূপী দানবটার তীব্র আনন্দের কারণ। অথচ নিজের হাতটাই কিনা গেছে ওর পেটে!
নজরুলের পেছনে আরেকটা বুলেটও অপচয় করা যৌক্তিক মনে হলো না ইন্সপেক্টর সুভাষের। তাকে টেনেহিচড়ে নিয়ে গেল জন্তুতার খাঁচার ভেতর। বোতাম টিপে খাঁচার দরজা খুলে দিল। চোখে ধিকিধিকি আগুনজ্বলা প্রাণীটা মানুষের রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এলো। সুভাষের চোখের সামনে খুবলে খুবলে খেলো নজরুলকে।
হাতের চেটোতে চোখের জল মুছে প্রাণীটাকে শ্যুট করল সুভাষ। পরপর চারটা বুলেট প্রাণীটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল প্রাণীটা; অবশ শরীরে ধূলায় ধপ করে বসে পড়ল সুভাষ।
ইন্সপেক্টর সুভাষ নয়, এই মুহূর্তে সে সহোদরের শোকে মুহ্যমান এক মানুষ। ইন্সপেক্টর সুব্রত পালের আপন ছোট ভাই সুভাষ পাল, ভাইয়ের অন্তর্ধান রহস্যের জাল খুলতে যে ভাইয়ের পুলিশ স্টেশনে বদলি নিয়ে এসেছে।
অপরাধী ধরতে নিজে টোপ হয়ে 'মনের জানালা'ইয় যাওয়ার আগে সুব্রত সবকিছু জানিয়ে গেছিল আপন ভাইকে। হয়ত নিজের পরিণতি আঁচ করতে পেরেছিল। বীরপুরুষ সে, নিজে ব্যর্থ হলেও একটা রাস্তা দেখিয়ে গেছে, আর সেই পথ ধরে অপরাধের শিকড় টেনে বের করেছে সুভাষ।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now