বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম, আমি রিয়াজ ভাইয়া কে ভালোবাসি । একেবারে যাকে বলে, উথাল পাথাল ভালোবাসা । ফার্মাকোলজী, প্যাথোলজীর বই বের করলে, বইয়ের ভিতরেও রিয়াজ ভাইয়ার চেহারা ভেসে ওঠে । অথচ আমার মত আপাদমস্তক স্মার্ট একটা মেয়ের, ওনার মত ছেলে কে ভালো লাগার কোন যুক্তি নেই ।
রিয়াজ ভাইয়া পঞ্চম বর্ষের ছাত্র । আমি পড়ি তৃতীয় বর্ষে । আগে ওনাকে চিনতাম না । একদিন লেকচার শেষে আমি আর মিতু গেছি মধু মামার ক্যান্টিনে পুরি আর চা খাবো তাই। একটু পরেই ওয়ার্ডে যেতে হবে । অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি । এমন সময় শুনি কে যেন আমার প্রিয় গান, " আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো, আর আসবো না ফিরে " গাইছে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখতে পেলাম না । ছেলে মেয়ে বেশ কয়েকজন ঘিরে আছে তাকে। এত সুন্দর গলা ! গান শেষ হলে সীমা আপু বললেন, " এই রাত তোমার আমার গা। " সে বাধ্য ছেলের মত আবার গাওয়া আরম্ভ করলো।
মিতু বললো, " উনি রিয়াজ ভাইয়া । মিঠুর বন্ধু । " মিঠু ভাইয়া মিতুর প্রেমিক, পঞ্চম বর্ষে পড়েন। আমি মিতুকে বললাম, " প্লিজ, ভাইয়া কে বলিস, আমার সাথে ওনাকে একটু পরিচয় করে দিতে । " সেদিন ওয়ার্ড এর দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, তাই আর দেরি না করে চা খেয়ে রওনা দিলাম হাসপাতালের পথে । কিন্তু আমার প্রিয় রায়হান স্যারের কোন পড়াই সেদিন আর কানে ঢুকছিল না । সারাক্ষণ কানে গানের সুর ভেসে আসছিল ।
সপ্তাহ খানেক পরে মিঠু ভাইয়া পরিচয় করিয়ে দিলো, রিয়াজ ভাইয়ার সাথে । দেখতে একেবারেই ইমপ্রেসিভ না । কথাও ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারে না । বোঝা যাচ্ছে, কোন মেয়ে তার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছে জেনে, উনি খুব নার্ভাস হয়ে গেছেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এ রকম একটা ছেলে, কি করে এত অসাধারণ গায় !
রিয়াজ ভাইয়ার সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়। ব্যাপারটা বেশ মজার । উনি মাঝে মাঝেই লেডিস হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনভ্যস্ত ভাবে সিগারেট খান। দেখা হয়ে গেলে বলেন, " আরে বৃষ্টি যে ! কেমন আছো ? আমাদের ইয়ারের এক মেয়ের সাথে দেখা করতে আসছিলাম। " আমি জানি, উনি আমার সাথে দেখা করতেই এসেছেন। কিন্তু সাহস করে সেটা বলতে পারেন না। সিগারেট খান না, কিন্তু নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য হোস্টেলের সামনে এসে সিগারেট ধরাণ। আমিও না বোঝার ভান করি । বলি, " ভাইয়া, কল কি দিয়েছেন না আমি দিয়ে দিবো ? " ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বলেন, " না না, কল দিয়েছি। একটু পরেই আসবে । " ওনাকে বিব্রত করার জন্য কখনো বলি না, "কাকে কল দিয়েছেন ? " টুকটাক কথা বলার পরে গেটের ভিতর ঢুকে যাই। দুই একদিন আবার গেটের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি, আমি ঢুকে যাওয়ার পরেই উনি হাটা দিয়েছেন, ওনার হোস্টেলের দিকে !
কিছুদিন পরেই আবিস্কার করি, ওনাকে কিছুদিন না দেখলেই কেমন জানি অস্থির লাগে । মন খারাপ হয়। সে মন খারাপের কথা, কারো সাথে শেয়ার করতে পারি না । বুঝতে পারি, ভালোবেসে ফেলেছি ওনাকে।
সেদিন আমি ক্লাসে যাইনি। হোস্টেলেই ছিলাম। দুপুরের দিকে হোস্টেলের দোতলার বারান্দা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি, উনি দাঁড়িয়ে আছেন গেটে। হঠাৎ মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল । দ্রুত রুমে যেয়ে নীল রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পড়লাম। বেশ সুন্দর করে সাজলাম। তারপর নিচে নেমে এসে গেটের বাইরে যেয়ে দাড়ালাম। উনি আমাকে দেখে এতই অবাক হলেন যে, কথা বলতে ভুলে গেলেন । আমিও ওনাকে দেখি নাই, দেখি নাই ভাব করে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম । একটা রিকশা যখন হোস্টেলের সামনে আসলো, তখন রিকশাওয়ালা কে বললাম, " মামা এক ঘন্টা আপনার রিকশায় ঘুরবো। " রিকশায় ওঠার পরে রিয়াজ ভাইয়া কে ডাক দিলাম। এত বড় বিপদে মনে হয় উনি জীবনে কোনদিন পড়েননি । খুব জড়োসড়ো হয়ে বসলেন রিকশায়।
রিকশা টা মেডিকেল ক্যাম্পাস পার হওয়ার পরে বললাম,
- আপনার গান শোনার জন্য আজ আপনার সাথে ঘুরতে বের হলাম।
- আমি খুব নার্ভাস হয়ে গেলে গান গাইতে পারি না । এখন আমি কোন ভাবেই গান গাইতে পারবো না ।
- খুব পারবেন । লাগলে চোখ বন্ধ করে গান গাইবেন। " একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি " - এই গানটা না শোনানো পর্যন্ত আপনাকে আজ ছাড়বোই না ।
সেদিন রিয়াজ ভাইয়া গানটা শুনিয়েছিলেন। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত ছিল সেটা । হয়তো ওনার জীবনেরও। খুব ইচ্ছা করছিলো, ওনার হাতটা ধরি।
ঐ দিনের পর থেকে রিয়াজ ভাইয়ার নার্ভাসনেস একেবারেই বিদায় নিলো। তারপর থেকেই উনি হোস্টেলে এসে সরাসরি আমাকে কল দেন। সিগারেটও আর খান না। একটা সম্পর্ক তৈরি হলো, ওনার সাথে আমার । উনি বুঝতে পারলেন, আমি ওনাকে ভালোবাসি আর আমিও বুঝতে পারলাম উনি আমাকে ভালোবাসেন। তখনও ওনাকে ভাইয়া ই ডাকি ।
ঠিক তার একমাস পরে রিয়াজ ভাইয়ার মা মারা গেলেন । সুস্থ সবল মানুষটা । ডায়রিয়া হয়েছিল । হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল । রিয়াজ ভাইয়ার বাবাও ডাক্তার । ওনার জানাশোনা ক্লিনিকেই ভর্তি করলেন। পরের দিন বাড়ি ফেরার কথা । অথচ রাতে কার্ডিয়াক এরেষ্ট হয়ে মারা গেলো। কি জানি, ফ্লুইড ওভার লোড হয়েছিল কিনা ।
রিয়াজ ভাইয়াকে যখন ট্রেনে তুলে দিতে যাই, তখন ওনাকে চেনা যাচ্ছিলো না । যেন অন্য কোন জগতের বাসিন্দা ।
দুইমাস পার হয়ে গেল, রিয়াজ ভাইয়া ফিরে এলেন না । মেডিকেল কলেজে সবাই যে যার মত ব্যস্ত । একটা ছেলে দুই মাস ধরে ক্যাম্পাসে নেই, অথচ কারো কোন মাথাব্যথা নেই । ওনার ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিলো। ভাবলাম, এবার আসবে । কিন্তু তাও এলো না । তখন মোবাইলের প্রচলন ছিল না। আমার কাছে ওনার বাড়ির ঠিকানাও ছিল না। সারাক্ষণ চুপিচুপি কাঁদি ওনার জন্য ।
ওনার ইয়ারের সবাই ইন্টার্ন হয়ে গেল । অথচ ওনার দেখা নেই । একদিন মিতু বললো, মিঠু ভাইয়া বলেছে, " রিয়াজের কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে । তাই সে আসছে না । রিয়াজের মা খুব সুন্দরী ছিল এবং সুন্দর গান করতো। তবে উনি খুব নার্ভাস প্রকৃতির মহিলা ছিলেন । হয়তো সামান্য মানসিক সমস্যাও ছিল । রিয়াজ চেহারা আর মেধা পেয়েছিল বাবার কাছ থেকে । গান আর নার্ভাসনেস পেয়েছিল মার কাছ থেকে । মায়ের মৃত্যু সে সহজভাবে নিতে পারে নি । তাছাড়া শহরে তার মায়ের মৃত্যু নিয়েও একটু গুন্জন ছিল । কারণ তার মা মরার মাস খানেক এর ভিতরেই তার বাবা আবার বিয়ে করেছে। যাকে বিয়ে করেছে, তার সাথে তার পূর্ব সম্পর্ক ছিল কিনা, সেটা নিয়েও কানাঘুষা আছে শহরে। "
রিয়াজ ভাইয়ার এরকম সময়ে তার খুব কাছে থাকতে ইচ্ছা করতো আমার । কিন্তু উনি আসলেনই না । এক সময় আমিও পাশ করে গেলাম । সময় আমাদের কে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। আমিও আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম তাকে। এর প্রায় আট বছর পরের ঘটনা । আমার তিন বছরের একটা ছেলে আছে। আমি আমার নিজের মেডিকেল কলেজে গাইনীতে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসাবে কর্মরত আছি । আমার স্বামীও একই মেডিকেলের মেডিসিনের রেজিস্ট্রার । একদিন সকালে দেখি, আমার ইন্টার্ন গুলো হাসাহাসি করছে। কি নিয়ে হাসাহাসি করছে, জিজ্ঞাসা করাতে বললো, নতুন এক ইন্টার্ন জয়েন করেছে। সে নাকি আমারও সিনিয়র । ওদের কে বকা দিয়ে বললাম, " উনি সিনিয়র । সিনিয়র কে সিনয়রের মতোই সম্মান করবা। "
আমাকে অবাক করে দিয়ে রুমে ঢুকলো রিয়াজ ভাইয়া । উনিও খুব অবাক হয়েছেন। সম্ভবত আমাকে ওনার সহকারী রেজিস্ট্রার হিসাবে আশা করেন নাই । যাই হোক, আমি ই ওনার হেজিটেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করলাম। বললাম,
- খুব ভালো হয়েছে, আপনি আবার ফিরে এসেছেন । আপনার মত একজন মেধাবী মানুষ হারিয়ে যাবে, এটা দেশের জন্য একটা অপূরনীয় ক্ষতি ছিল ।
- তোমাকে ঠকিয়েছি আমি ।
- ইচ্ছা করে তো আর ঠকাননি।
- তবুও ।
- থাক সেসব কথা । আমার স্বামী ডা. তৌফিক জানে, আপনি খুব সুন্দর গান করেন । একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। আমার ছেলে কে আর আমার স্বামী কে গান শোনাবেন।
- গান গাওয়া ভুলে গেছি ।
- তাই কি হয় ?
- খুব কষ্ট যখন হতো, তখন কল্পনা করতাম, তুমি নীল শাড়ি পরে আমার সাথে রিকশায় করে ঘুরছো। আর আমি তোমাকে গান শোনাচ্ছি । কিন্তু বাস্তবে চেষ্টা করেও গাইতে পারতাম না ।
কেন জানি, চোখে পানি চলে আসলো । আমি চাই না, আমার চোখের পানি উনি দেখে ফেলুক । মুখটা ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে ফাইলগুলো ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম -
গাইনীতে কিন্তু কোন ফাকি দেওয়া যায় না । এই ফাইল গুলো দেখুন, কিভাবে রোগী রিসিভ করতে হয় এবং ফলো আপ দিতে হয়। A ব্লকের প্রথম পাঁচটা রোগীর ফলো আপ আপনি দিবেন । সকাল আটটায় এসে এই হাজিরা খাতায় সিগনেচার করেই চলে যাবেন ফলো আপ এ। কিছু না বুঝলে নিঃসংকোচে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন ।
উনি বাধ্য ইন্টার্ন এর মত মাথা ঝাকালেন।
Sumona Tanu
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now