বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
দ্বিতীয় খণ্ড
স্কোরারস্
০৮. লোকটা
১৮৭৫ সালের চৌঠা ফেব্রুয়ারি। দারুণ শীত পড়েছিল, গিলমারটন পর্বতমালার গিরিখাতে জমে রয়েছে রাশি রাশি তুষার। বাষ্পীয় লাঙলের দৌলতে রেললাইন এখনও খোলা রয়েছে। ভারমিসা উপত্যকার মাথার দিকে অবস্থিত কেন্দ্রীয় নগরী ভারমিসা সমতল থেকে স্ট্যাগভিল পর্যন্ত যে-রেললাইনটা ঢালু পাহাড়ের ওপর কয়লাখনি আর লোহার কারখানাকে জুড়ে রেখেছে, সন্ধের ট্রেন টিকিয়ে টিকিয়ে চলেছে সেই লাইনের ওপর দিয়ে। রেললাইনের এখান থেকে গড়িয়ে নেমে গেছে বার্লটন্স ক্রসিং হেল্মডেল আর মার্টনের নির্ভেজাল কৃষি অঞ্চলের দিকে। রেলপথ একটাই অর্থাৎ একটাই রেলগাড়ি যেত সেই লাইন দিয়ে সামনের দিক থেকে আরেকটা ট্রেন এলে এ-ট্রেনকে সরে দাঁড়াতে হবে সাইডিং-এ। সাইডিংয়ের সংখ্যা অসংখ্য। প্রত্যেকটা সাইডিং-এ কয়লা আর লোহার আকর ভরতি ট্রাক দাঁড়িয়ে সারি সারি–দেখলেই বোঝা যায় গুপ্তধনের আকর্ষণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই বিজনতম অঞ্চলে ছুটে এসেছে দলে দলে রুক্ষ কঠোর মানুষ জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত করে তুলেছে ঊষর প্রান্তর।
ঊষরই বটে। সত্যিই খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। প্রথম যে পুরোধা ব্যক্তি এই রুক্ষ বিজন অঞ্চলে পা দিয়েছিল সে কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি বিশ্বের সবচেয়ে সেরা সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা অঞ্চলেও কালো কর্কশ খাড়া এবড়োখেবড়ো পাহাড় আর জঙ্গলের জটায় সমাকীর্ণ ঘোর বিষণ্ণ এই অঞ্চলের তুলনায় একেবারেই মূল্যহীন। মাঝে মাঝে প্রায় দুর্ভেদ্য অরণ্য কালো হয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়ের গায়ে, অনেক উঁচু উলঙ্গ পর্বতমুকুটে জমে রয়েছে সাদা বরফ, চারিদিকে পাহাড় মাথা উঁচিয়ে রয়েছে মেঘমালার দিকে, মাঝখানে পাকানো পেঁচানো সুদীর্ঘ উপত্যকা এঁকেবেঁকে বিস্তৃত দুর হতে দূরে। ছোট্ট রেলগাড়িটা টিকিয়ে টিকিয়ে চলেছে এরই ওপর দিয়ে।
সামনের দিকে যাত্রী গাড়িতে এইমাত্র জ্বালানো হয়েছে তেলের বাতি। কামরাটা লম্বা, নিরাভরণ। বসে আছে বিশ তিরিশজন যাত্রী। এদের অধিকাংশ শ্রমিক। নিম্ন উপত্যকায়, সারাদিন খেটে বাড়ি ফিরছে। জনা-বারোর মুখ কালিঝুলিতে কালো, হাতে সেফটিল্যাম্প নিঃসন্দেহে খনি শ্রমিক। দল বেঁধে বসে তারা ধূমপান করছে, গলা নামিয়ে কথা বলছে এবং মাঝে মাঝে কামরায় অন্য প্রান্তে উপবিষ্ট দু-জন লোকের পানে তাকাচ্ছে–এদের পরনের ইউনিফর্ম আর ব্যাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে পুলিশের লোক। বাকি লোকের মধ্যে কয়েকজন কুলি মেয়ে। দু-একজন যাত্রী স্থানীয় দোকানদারও হতে পারে। এক কোণের একজন যুবা পুরুষ যেন এদের দল ছাড়া। একটু ভালো করে তাকান এর দিকে চেহারাটা দেখবার মতো।
রং তাজা, বয়স বড়োজোর তিরিশ। দুই চক্ষু ধূসর বিশাল। ধূর্ত এবং কৌতুকময় চশমার মধ্যে দিয়ে আশেপাশের লোকদের দিকে তাকানোর সময়ে অনুসন্ধিৎসা ঝিলিক দিয়ে উঠছে সেই চোখে। দেখেই বোঝা যায় যুবাপুরুষ খুবই মিশুক, স্বভাব সাদাসিদে, সবশ্রেণির লোকের বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম। সঙ্গপ্রিয়, পেটপাতলা, প্রখর উপস্থিতবুদ্ধি সম্পন্ন এবং সদা হাস্যময় এক নজরে এইরকমটাই মনে হবে যেকোনো ব্যক্তির। কিন্তু একটু কাছ থেকে খুঁটিয়ে যদি লক্ষ করা যায়, চোয়ালের দৃঢ়তা আর ভয়ানক ঠোঁট টিপুনি দেখেই সতর্ক হতে হবে স্পষ্ট বোঝা যাবে ছিমছাম চেহারার বাদামিচুলো এই তরুণ আইরিশম্যানের অন্তরের গভীরে এমন কিছু বস্তু আছে যা তাকে ভালো বা মন্দ যেকোনো রকমের খ্যাতি এনে দিতে পারে ধরাপৃষ্ঠের যেকোনো সমাজে।
সবচেয়ে কাছের খনি শ্রমিকের সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে গিয়ে কাটছাঁট জবাব শুনে হাল ছেড়ে দিল তরুণ যাত্রী। চুপচাপ থাকা তার স্বভাব নয়–তবুও নীরব থাকতে হল। নিমগ্ন চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল বিলীয়মান দৃশ্যপটের দিকে। দৃশ্যটা খুব সুখাবহ নয়। ঘনায়মান অন্ধকারে পাহাড়ের গা লাল হয়ে উঠেছে চুল্লির আভায়। দু-পাশে স্তুপীকৃত গাদ আর ছাই, মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে কয়লাখনির প্রবেশদ্বার। লাইনের দু-পাশে বিক্ষিপ্ত নোংরা কদর্য কাঠের বাড়ির জটলা। আলো জ্বলছে কিছু কিছু জানলায়। ট্রেন মাঝে মাঝে দাঁড়ালে এইসব বাড়ি থেকেই ময়লা, কালো বাসিন্দারা উঠে ভিড় করছে গাড়িতে। কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অলসতার ধারক ও বাহক যারা, ভারমিসা জেলার লোহা আর কয়লা উপত্যকা তাদের জায়গা নয়। চারদিকেই স্থূলতম-সংগ্রামের কঠোর চিহ্ন এখানকার কাজ রুক্ষ, কর্মীরাও রুক্ষ।
বিষাদ-মাখা ধুধু প্রান্তরের দিকে বিতৃষ্ণা আর কৌতূহল মিশানো চোখে চেয়ে রইল যুবাপুরুষ–চাহনি দেখেই বোঝা গেল এ-দৃশ্য তার চোখে একেবারেই নতুন। মাঝে মাঝে পকেট থেকে একটা ইয়া-বড়ো চিঠি বার করে পড়ে নিয়ে টুকটাক লিখতে লাগল পাশের সাদা অংশে। একেবারে কোমরের পেছন থেকে এমন একটা বস্তু বার করল যা এই ধরনের নরম চেহারার যুবকের কাছে আশা করা যায় না। জিনিসটা একটা বৃহত্তম আকারের নেভি রিভলবার। আলোর দিকে ফেরাতেই আলো ঠিকরে গেল ড্রামের ভেতর পোরা পেতলের কার্তুজের বেড় থেকে, তার মানে রিভলবার গুলিভরা। চট করে গুপ্তপকেটে লুকিয়ে ফেলার আগেই অবশ্য সংলগ্ন বেঞ্চিতে উপবিষ্ট একজন শ্রমিকের নজরে পড়ল হাতিয়ারটা।
বললে, হ্যাল্লো, বন্ধু! আপনি দেখছি তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন।
ঈষৎ বিব্রত হয়ে হাসল যুবা পুরুষ।
বললে, হ্যাঁ। যেখান থেকে আসছি, সেখানে এ-জিনিসের যখন-তখন দরকার পড়ে।
সে-জায়গাটা কোথায় বলবেন?
শিকাগো থেকে আসছি আমি।
এদিকে নতুন?
হ্যাঁ।
এখানেও দেখবেন এর দরকার হবে, বললে শ্রমিক।
আ! তাই নাকি? আগ্রহী মনে হয় যুবাপুরুষকে।
এখানকার কাণ্ডকারখানা কিছুই কি শোনেননি?
অসাধারণ কিছু তো শুনিনি।
সেকী! সারাদেশ তোলপাড় হয়ে গেল এই নিয়ে। আপনিও শুনবেনখন–শিগগিরই কানে আসবে। কী জন্যে এলেন এদিকে?
শুনেছি, কাজ যে করতে চায়, এখানে নাকি তার কাজের অভাব হয় না।
আপনি কি শ্রমিক ইউনিয়নের কেউ?
নিশ্চয়।
তাহলে মনে হয় কাজ পাবেন। বন্ধু-টন্ধু কেউ আছে?
এখনও নেই, তবে করে নেওয়ার ব্যবস্থা জানি।
সেটা আবার কী?
আমি এনসেন্ট অর্ডার অফ ফ্রিম্যান সংস্থার সদস্য। হেন শহর নেই যেখানে এদের শাখা নেই। শাখা থাকা মানেই আমার বন্ধু পাওয়া।
কথাটায় অসাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সঙ্গীর ওপর। এস্ত সন্দিগ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করল কামরার অন্য সবাইয়ের দিকে। খনি শ্রমিকরা এখনও ফিসফাস করছে নিজেদের মধ্যে। পুলিশের লোক দু-জন চুলছে। বেঞ্চি থেকে উঠে এসে তরুণ যাত্রীর পাশে বসে হাত বাড়িয়ে দিল নিজের।
বলল, হাত রাখুন।
হাতে হাত মিলল দু-জনের।
সত্যি বলছেন জানি। তবুও নিশ্চিত হতে চাই।
বলে, ডান হাতটা তুলল ডান ভুরুর সামনে। তরুণ যাত্রীও তৎক্ষণাৎ বাঁ-হাত তুলল বাঁ-ভুরুর সামনে।
অন্ধকার রাত অস্বস্তিকর, বললে শ্রমিক।
পথ যে চেনে না তার কাছে, বললে তরুণ যাত্রী।
ওতেই হবে। আমি ভারমিসা ভ্যালির ৩৪১ নম্বর লজের ব্রাদার স্ক্যানল্যান। এ-তল্লাটে আপনাকে দেখে খুশি হলাম।
ধন্যবাদ। আমি শিকাগোর ২৯ নম্বর লজের ব্রাদার জন ম্যাকমুর্দো। জে. এইচ. স্কট আমাদের বডিমাস্টার। আমার কপাল ভালো, এত তাড়াতাড়ি একজন ব্রাদার পেয়ে গেলাম।
আমরা এখানে অনেক। ভারমিসা ভ্যালিতে অর্ডার যেমন ছড়িয়েছে, এমনটি যুক্তরাষ্ট্রের আর কোথাও দেখতে পাবেন না। তবে আপনার মতো কিছু ছেলের আমাদের দরকার। শ্রমিক ইউনিয়নের এ-রকম একজন কর্মঠ সদস্যের কাজ নেই শিকাগোতে, এটা কিন্তু বুঝতে পারছি না।
কাজের অভাব ছিল না আমার, বললে ম্যাকমুর্দো।
তাহলে চলে এলেন কেন?
পুলিশের লোক দু-জনের দিকে মাথার ইশারা করে হাসল ম্যাকমুর্দো।
বললে, ওরা জানতে পারলে কিন্তু খুশি হত।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ...