বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

আঁখি এবং আমরা ক'জন (১৯)

"ছোটদের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান TARiN (০ পয়েন্ট)

X মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন আমরা কাদের বক্স নামে ভয়ংকর নিষ্ঠুর একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর কথা জানতে পারলাম আমি সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কী করবি?” সুজন শুকনো মুখে বলল, “জানি না। তুই বল কী করব?” আমি মাথা চুলকালাম, বললাম”বড়দের বলতে হবে। নিশাত আপু আর জাবেদ চাচাকে।” সুজন বলল, “আমি বলতে পারব না। তুই বল।” “আমি কী বলব?” ”যেটা হয়েছে সেটাই বলবি।” “তুই বুঝতে পেরেছিস আমরা কী করেছি? মিলিটারি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে যাদের ধরার চেষ্টা করছে আমরা তাদেরকে সাহায্য করেছি। আমরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আমাদের গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছি!” সুজন শুকনো মুখে বলল, “তার মানে আমরাও এখন অপরাধী? পুলিশ এখন আমাদের ধরবে।” আমি মাথা নাড়লাম, “মনে হয়।” সুজন বলল, “কিন্তু আমরা তো ইচ্ছে করে করিনি। বুড়ো বদমাইশটাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।” “সেটা পুলিশকে বলে দেখ তারা কী বলে! তারা আমাদের বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের গাড়ি চেক করবে না বুড়োটা সেটা জানে, সেই জন্যেই বুড়োটা তার টুকরিগুলো আমাদের গাড়িতে তুলেছে। কেউ যেন দেখতে না পায় সেই জন্যে ঠেলে ঠেলে সিটের নিচে রেখেছে। চেকআপ করার আগে নেমে গেছে। আমাদের পুলিশকে বলা উচিত ছিল একজন লোকের সবজির টুকরি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা চেক করে দেখেন।” সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস।” “এখন বলে কী লাভ?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আর তুই কেন খামোখা সবজির টুকরি ঘটতে গেলি? সবজির টুকরি থেকে তুই যদি এই গ্রেনেডগুলো খুঁজে বের না করতি তা হলে আমরা কোনোদিন জানতেও পারতাম না যে এর ভেতরে এগুলো আছে। আমরা ভাবতাম আমরা একজন বুড়ো মানুষকে সাহায্য করেছি। সেটা চিন্তা করে খুশি থাকতাম!” সুজন বলল”এখন সেটা বলে লাভ নেই। কী করবি তাড়াতাড়ি ঠিক কর সবাই না হলে সন্দেহ করবে।” মামুন বাথরুমে ঢুকেছে, আমি অন্যদের বলেছি আমরা নিচ থেকে আমাদের রুমগুলোর ছবি তুলব, সেই জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুজনের সাথে কথা বলছি, সুজনের পিঠে তার ব্যাকপেক সেটার ভিতরে দুইটা তাজা গ্রেনেড। আমি বললাম, “যাই করি আর না করি সবার আগে এই গ্রেনেড দুইটা তোর ব্যাকপেক থেকে বের করে এখানে কোথাও রাখ।” সুজন গ্রেনেড দুটি বের করল। গাঢ় সবুজ রংয়ের উপরে খাঁজকাটা। ঠিক সিনেমাতে যেরকম দেখেছি। সুজন একটা রিং ধরে বলল, “এই রিংগুলো কী? টান দিলে কী হবে?” আরেকটু হলে সুজন সত্যি সত্যি টান দিয়ে পিনটা খুলে ফেলত, আমি থামালাম, “সর্বনাশ! পিন খুললেই সাত সেকেন্ড পরে গ্রেনেড ফেটে যায় জানিস না? সবাইকে মারবি না কি?” সুজন জানত না। আমরা সবাই যেরকম একশ রকম বই পড়ি একশ রকম জিনিস জানি, সুজন সেইরকম না। সে বই পড়ে কম কিন্তু একশ রকম দুষ্টুমি জানে। তার দুষ্টুমির ফল হচ্ছে এই দুইটা গ্রেনেড। আমরা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে গ্রেনেড দুটি রেখে কয়েকটা শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে ফেলে বের হয়ে এলাম। আমাদের ঘরের বারান্দায় রিতু আর শান্তা দাঁড়িয়ে নিচে আমাদের দেখে বলল, “তোরা ওখানে কী করছিস?” আমি বললাম, “ছবি তুলছি। তোরা দাঁড়া, তোদেরও একটা ছবি তুলি।” রিতু আর শান্তা দুজন দুজনকে ধরে একটা নেকু নেকু ভঙ্গিতে দাঁড়াল, আমি একটা ছবি তুলোম। ছবি তুলে আমরা আমাদের রুমের দিকে আগালাম। আমি এখনো বুঝতে পারছি না বিষয়টা অন্য সবাইকে বলা ঠিক হবে কি না। আমাদের মাঝে রিতুর বুদ্ধি বিবেচনা সবচেয়ে বেশি, ব্যাপারটা তার সাথে আলোচনা করতে পারলে হত, কিন্তু কীভাবে আলোচনা করব বুঝতে পারছিলাম না। রিতুকে আলাদাভাবে পাওয়া দরকার কিন্তু সে সারাক্ষণই অন্যদের সাথে কথা বলছে, গল্পগুজব করছে। এক হতে পারে শুধু রিতুকে না বলে সবাইকে ব্যাপারটা খুলে বলি। শান্তা অল্পতেই ঘাবড়ে যায়, পুরোটা জানলে ভয় পেতে পারে। আঁখিকে এখন জানানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। সে আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে আর আমরা অস্ত্র চোরাচালানির দলের সাথে গোলমাল শুরু করেছি এই কথাগুলো তাকে বলব কেমন করে? এই মানুষগুলো যখন ফিরে গিয়ে দেখবে তাদের টুকরিতে দুইটা গ্রেনেড কম তখন কি আর সেই দুইটা গ্রেনেডের জন্যে ফিরে আসবে না? আর যখন বুঝতে পারবে আমরা জেনে গেছি তখন কি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলবে না আমরা কোথায়? ভয়ে দুশ্চিন্তায় আমার পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার অবস্থা। আমরা জাবেদ চাচাকে খুঁজে পেলাম না। নিশাত আপু বললেন শহরে গিয়েছেন, আমরা রাঙামাটি কীভাবে কোন পথে যাব সেসব ব্যাপারে খোঁজ নিতে। রাতে খাবার সময়ে থাকবেন। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমি আর সুজন তখন ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অন্যেরা বসে বসে টুয়েন্টি ফোর খেলছে আমরা তাদের সাথে খেলতেও পারি না, আবার কিছু না করে বসেও থাকতে পারি না। শেষ পর্যন্ত জাবেদ চাচার সাথে দেখা হল। আমি বললাম, “জাবেদ চাচা, আপনার সাথে আমাদের একটু কথা বলতে হবে।” জাবেদ চাচা খুব কম কথা বলেন, তারপরেও হাসি হাসি মুখে বললেন, “তোমাদের সাথেও আমার কথা বলতে হবে।” “আমাদেরটা খুবই জরুরি।” জাবেদ চাচার মুখের হাসিটা আরো বড় হল, “আমারটাও খুবই জরুরি।” “আগে আমাদেরটা বলি?” “বলবে? বল।” আমরা যখন বলতে শুরু করলাম ঠিক তখন নিশাত আপু ঘরে ঢুকলেন, খাওয়া-দাওয়া হোটেল বিল এই সব নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তাই আমাদের আর বলা হল না। জাবেদ চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে কথা বলি?” আমরা আর কী করব? মাথা নেড়ে রাজি হয়ে চলে এলাম। রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি। আজকে চাইনিজ খাবার, দেখে জিবে পানি এসে যাবার কথা কিন্তু আমার আর সুজনের ভেতরে এতো অশান্তি যে শান্তি মতো খেতে পারব এরকম মনে হচ্ছে না। খাওয়া যখন প্রায় মাঝামাঝি তখন নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা এলেন। জাবেদ চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের খবর কী? সবাই ভালো?” আমি আর সুজন চুপ করে রইলাম, অন্যেরা মাথা নেড়ে কেউ বলল, “ভালো।” কেউ বলল, “খুবই ভালো” কেউ বলল, “ফাটাফাটি” কেউ বলল, “সুপার ডুপার।” জাবেদ চাচা বললেন, “একেক জায়গায় আমরা দুই রাত করে থাকব। কাজেই বান্দরবানে এটা শেষ রাত। কাল দুপুরে আমরা রাঙামাটি রওনা দিব।” আমি আর সুজন আবার চুপ করে থাকলাম, অন্যেরা আনন্দের মতো শব্দ করল। জাবেদ চাচা বললেন, “আজকে আমি শহরে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়েছে, সে বলেছে এখন বান্দরবান খুবই গরম একটা জায়গা।” “গরম?” মামুন বলল, “আমাদের তো সেরকম গরম লাগছে না!” “এটা অন্য রকম গরম।” “কী রকম গরম?” “আর্মসের বিশাল একটা চালান এসেছে এই এলাকায়, পুলিশ মিলিটারি ধরার চেষ্টা করছে।” আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। রিতু বলল, “মনে নাই পুলিশ মিলিটারি ব্যারিকেড দিয়ে সব গাড়ি চেক করছে?” মামুন জিজ্ঞেস করল, “কী রকম আর্মস?” “একে ফরটি সেভেন। গ্রেনেড।” “গ্রেনেড?” “হ্যাঁ গ্রেনেড।” “সর্বনাশ।” রিতু জানতে চাইল, “কারা করে?” “মানুষটার নাম হচ্ছে কাদের। কাদের বক্স। অসম্ভব নিষ্ঠুর একটা মানুষ। কোনো মায়া দয়া নাই। তার একটা বড় দল আছে, পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। পাহাড়ে থাকে, কোথায় থাকে কেউ জানে না।” আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। সুজন তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “মায়া দয়া নাই মানে? কী করে?” “খুন জখম। নিজের দলের মানুষও যদি একটু উনিশ-বিশ করে তা হলে গুলি করে মেরে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেয়।” “কী সাংঘাতিক!” আঁখি বলল, “কাদের বক্স যদি খুব সাংঘাতিকও হয় আমাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমরা তো কাদের বক্সের দলের মানুষ না। আমরা তো তার আর্মসের ব্যবসারও কোনো ক্ষতি করছি না।” আমি বুঝতে পারলাম আমাদের এখন আসল কথাটা বলার সময় হয়েছে। যেই মুখ খুলেছি ঠিক তখন শুনলাম ধুপধাপ শব্দ করে কারা যেন দৌড়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই অনেকগুলো মানুষ ছুটে এলো, তাদের সবার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চেহারা দেখা না যায়, সবার হাতে ভয়ংকর এক ধরনের রাইফেল যেগুলো শুধুমাত্র ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায়। মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। ডাইনিং রুমে যারা খাচ্ছিল তারা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। তখন রাইফেল হাতে একজন বলল, “খবরদার! কোনো শব্দ না।” সাথে সাথে সবাই চুপ করে গেল। আঁখি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?” আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছিল না, কোনোমতে ফিসফিস করে বললাম, “মুখ বাঁধা অনেকগুলো মানুষ, হাতে বন্দুক, ভিতরে এসে ঢুকেছে।” “এরা কারা?” “জানি না। মনে হয় ডাকাত।” “সর্বনাশ!” মুখ বেঁধে রাখা যে মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকেছে তারা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, তখন একজন চিৎকার করে বলল, “সবগুলো এইখানে।” রিসোর্টের ভিতরে যারা ছোটাছুটি করছিল তারা তখন ডাইনিং রুমের দিকে আসতে থাকে। এরা কার খোঁজে এসেছে, কাকে পেয়ে গেছে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। শুধু আমি আর সুজন বুঝে গিয়েছি। তাই মানুষগুলো আমাদের টেবিলে এসে যখন খপ করে আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে টেবিল থেকে বের করে নিয়ে আসে তখন সবাই অবাক হয়ে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। শুধু আমি আর সুজন অবাক হলাম না, চিৎকারও করলাম না। জাবেদ চাচা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?” পিছনে যে মানুষটা ছিল সে রাইফেলটা তুলে তার পিছনটা দিয়ে জাবেদ চাচার বুকে প্রচণ্ড জোরে মেরে বসল। জাবেদ চাচা যন্ত্রণায় একটা শব্দ করে নিচে পড়ে গেলেন। মানুষটা রাইফেলটা জাবেদ চাচার দিকে তাক করে বলল, “আর একটা টু শব্দ করবে তো শেষ করে দেব।” জাবেদ চাচা আর শব্দ করলেন না, মনে হল তার শব্দ করার ক্ষমতাও নেই। গামছায় মুখ বাঁধা একজন মানুষ হাতের রাইফেলটা সবার দিকে তাক করে বলল, “কেউ যদি নড়াচড়া করেছ, চিল্লাচিল্লি করেছ তা হলে শেষ।” কেউ এতোটুকু শব্দ করল না। তখন ছয়জন মানুষ আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম লোকগুলো হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাদের সোজা করে নেয়। আমরা এতো ভয় পেয়েছি যে চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত নেই। মানুষগুলো আমাদের নিয়ে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় দুটো চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ধাক্কা দিয়ে একটা চান্দের গাড়িতে তুলে দেয়, আমরা ভালো করে ওঠার আগেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। ড্রাইভার পাহাড়ি রাস্তায় ঝড়ের বেগে গাড়িটা চালিয়ে নিতে থাকে। পিছন থেকে দ্বিতীয় গাড়িটাও এর পিছনে পিছনে আসতে থাকে। কে একজন বলল, “চোখ বেঁধে দে সবগুলোর।” আমরা অন্ধকারে টের পেলাম মানুষগুলো গামছা দিয়ে আমাদের চোখ বেঁধে দিচ্ছে। এতোক্ষণ আবছা আলোতে চারিদিক দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে আমরা ভালো করে কিছু বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। চান্দের গাড়ির মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে আছি, ঝাঁকুনিতে ঠিক করে বসেও থাকতে পারছি না, তার মাঝে শুনলাম, শান্তা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কী হচ্ছে এখানে! আমাদের কে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?” আমি বললাম, “মনে হয় কাদের বক্সের দল।” রিতু নিচু গলায় বলল, “কাদের বক্সের দল? কাদের বক্সের দল আমাদের ধরবে কেন?” সুজন বলল, “কারণ আছে।” “কী কারণ?” আমি কারণটা বলতে যাচ্ছিলাম তখন একটা মানুষ হুংকার দিল, “খবরদার একটা শব্দ করবি না। খুন করে ফেলব মুখ খুললে।” আমরা তখন চুপ করে গেলাম। ভয়ে আমরা কেউ ঠিকভাবে চিন্তাও করতে পারছিলাম না। কী হচ্ছে, আমাদের কোথায় নিচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে গাড়িতে বসে থাকি। একসময় হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। আমরা শুনলাম মানুষগুলো চাপা গলায় কথা বলছে। তারপর টের পেলাম আমাদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। চোখ বাঁধা, কিছু দেখতে পাচ্ছি না তার মাঝে আমরা একজন একজন করে হাঁটতে লাগলাম। কে সামনে কে পিছনে বুঝতে পারছি না। একজন আরেকজনকে ধরে হাঁটছি। অন্ধকারে পা পিছলে যাচ্ছিল, এক দুইবার হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেলাম। কোনো একজন লোক তখন আমাদের গালাগাল করে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। মনে হল নিচে নামছি, নামছি তো নামছিই আর থামাথামি নেই। শেষ পর্যন্ত একসময় থামলাম। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনছি, তার মানে কোনো একটা নদীর কাছে এসেছি। ধাক্কা দিয়ে আমাদের কোনো একটা নৌকায় তুলে দিল তারপর নৌকাটা ছেড়ে দিল। আমরা নিঃশব্দে নৌকায় বসে রইলাম। মনে হল ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বসে রয়েছি কোনোদিন বুঝি আর নৌকা থামবে না। শেষ পর্যন্ত নৌকা থামল, একজন জিজ্ঞেস করল, “কয়টা বাজে?” অন্যজন উত্তর দিল”সাড়ে আটটা” তখন আমরা বুঝতে পারলাম আসলে সময় খুব বেশি পার হয়নি। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে বুঝি অনন্তকাল। নৌকা থেকে নামার পর আমরা উপরে উঠতে থাকি। একজনের পিছু আরেকজন, কে সামনে কে পিছনে বুঝতেও পারছি না। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই আমাদের কেউ না কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল তখন মানুষগুলো আমাদের গালাগাল করতে করতে টেনে তুলছিল। বোঝা যাচ্ছিল আমাদের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টেনে নিচ্ছে, গাছের পাতা ডাল আমাদের হাতে পায়ে মুখে লেগে যাচ্ছে, হাত-পা কেটেকুটে যাচ্ছে কিন্তু এখন সেগুলো নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমরা থামলাম, মনে হল কোনো একটা বাসার সামনে দাঁড়িয়েছি। দরজায় কেউ একজন ধাক্কা দিল, ভিতর থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “কে?” আমাদের সাথে যারা ছিল তারা বলল, “আমরা। ছেলেমেয়েগুলো ধরে এনেছি।” খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। আমাদের পিছনে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। আমরা টের পেলাম ভিতরে আরো অনেক মানুষ বসে আছে, সেখানে কেমন যেন ঝাঁঝালো বোটকা একটা গন্ধ। ভারী গলায় কে যেন বলল, “চোখ খুলে দে।” লোকগুলো আমাদের চোখ খুলে দিল এবং এই প্রথম আমরা পিটপিট করে তাকালাম। ছোট একটা কাঠের ঘর। এক পাশে একটা কাঠের টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে একজন একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। টেবিলের এক কোনায় একটা হ্যারিকেন দপদপ করে জ্বলছে। অন্য পাশে একটা লম্বা বেঞ্চ, সেখানে কয়েকজন বসে আছে। যে মানুষগুলো আমাদের ধরে এনেছে তারা এখন তাদের মুখে বাঁধা গামছা খুলে ফেলেছে। হ্যারিকেনের অল্প আলোতে সবাইকে কেমন যেন ভয়ানক দেখাচ্ছে। চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা টেবিল থেকে কালোমতোন কী একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে তার পাশে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার কপালে ধরল। আমরা চমকে উঠে দেখলাম কালোমলতান জিনিসটা হচ্ছে একটা রিভলবার আর যে মানুষটার কপালে ধরেছে তাকেও আমরা চিনে ফেললাম। এটি হচ্ছে সেই বুড়ো মানুষটি যে আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলে দিয়েছিল। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না বলে আমরা প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন দেখতে পেলাম তার হাত দুটো পিছন থেকে বাঁধা। আমাদের কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই কাদের বক্স। কী ভয়ংকর! লোকটার চেহারা দেখলেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে। ভয়ংকর চেহারার মানুষটা বুড়ো মানুষটার কপালে রিভলবারটা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এখন দেখা যাক তুমি সত্যি কথা বলেছ না মিথ্যা কথা বলেছ।” বুড়ো মানুষটা বলল, “আমি সত্যি কথা বলেছি। কাদের ভাই। আপনি ছেলেমেয়েগুলোরে জিজ্ঞেস করেন।” “সেই জন্যেই তো ওদের ধরে আনলাম। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু দলের মাঝে বেইমানি সহ্য করতে পারি না। আমার জানা দরকার বুড়ো তুমি বেইমানি করেছ কি না!” “করি নাই।” “যদি দেখি তুমি করেছ তা হলে এখানেই শেষ। ঠিক আছে?” বুড়ো মানুষটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ঠিক আছে কাদের ভাই।” “এই পোলাপানের মুখের কথার ওপর নির্ভর করছে তোমার জীবন।” বুড়ো মানুষটি কোনো কথা না বলে কেমন যেন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কাদের বক্স এইবার ভালো করে আমাদের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তোমাদের মাঝে না কি একজন অন্ধ! কই আমার কাছে তো কাউরেই অন্ধ কানা মনে হচ্ছে না।” আমাদের কিছু বলার আগেই কমবয়সী একজন হাত দিয়ে রিতুকে দেখিয়ে বলল, “ওস্তাদ। ডানদিকের মেয়েটা অন্ধ।” “তুই কেমন করে জানিস?” “আমি হোটেলে দেখেছি।” রিতু কিছু বলল না। আঁখিও কিছু বলল না। কাজটা ভালো হল কিনা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমরাও চুপ করে রইলাম। কাদের বক্স বলল, “ঠিক আছে কানাবিবি তুমি ডানদিকে সরে যাও।” রিতু ডান দিকে সরে গেল, চোখে দেখতে না পেলে মানুষ যেভাবে সরে যায় অনেকটা সেভাবে। কাদের বক্স এবারে আমাদের পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা বাকি পাঁচজন এবারে আমাকে একটা সত্যি কথা বল। খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না।” কাদের বক্স তখন বুড়ো মানুষটাকে দেখিয়ে বলল, “তোমরা কী এই বুড়োটাকে আগে দেখেছ?” আমরা মাথা নাড়লাম। ”কখন দেখেছ?” সুজন বলল, “আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলেছিল।” “ঐ সবজির টুকরিতে কী ছিল?” আমি বললাম”গ্রেনেড।” আমার কথা শুনে আমাদের অন্য সবাই ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। তারা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। কাদের বক্স সন্তুষ্টির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তার ভাব দেখে মনে হল আমরা যে ব্যাপারটা জানি সেটা জেনে সে খুশি হয়েছে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “এখন তোমরা আমাকে বল, তোমরা কি ঐ টুকরি থেকে গ্রেনেড সরিয়েছ?” সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সরিয়েছি।” বুড়ো মানুষটা হাতবাঁধা অবস্থায় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বলল, “বলেছি না আমি? বলেছি না?” কাদের বক্স গম্ভীর মুখে বলল, “এতো লাফিও না বুড়া মিয়া। এখন আমার শেষ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটার উত্তরের উপর নির্ভর করছে তোমার মাথার ভিতর দিয়ে গুলি যাবে না কি যাবে না।” কাদের বক্স আমাদের দিকে তাকাল, তারপর মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কয়টা গ্রেনেড সরিয়েছ?” বুড়ো মানুষটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সে ভয় পাওয়া চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি সুজনের দিকে তাকালাম তারপর কাদের বক্সের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দুইটা।” বুড়ো মানুষটা আনন্দে চিৎকার করে উঠে বলল, “দেখেছেন কাদের ভাই? দেখেছেন? আমি গ্রেনেড সরাই নাই। এই পাজি বদমাইশ ছেলেমেয়েগুলো সরিয়েছে।” কাদের বক্স কিছুক্ষণ বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বুড়ার হাতের বাঁধন খুলে দে।” একজন এসে তার বাঁধন খুলে দেয় এবং সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে বলে, “কাদের ভাই, আপনি একটু অনুমতি দেন আমি পাজি ছেলেমেয়েগুলোকে পিটিয়ে লাশ করে দেই।” কাদের বক্স বলল, “তার অনেক সময় পাবে বুড়া।” তারপর ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, “গ্রেনেড দুইটা এখন কোথায় আছে?” আমরা কোনো কথা বললাম না, তখন কাদের বক্স ধমক দিয়ে উঠল, “কোথায় আছে?” “আমাদের রুমের পিছনে ফেলে দিয়েছি।” কাদের বক্স আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। হুংকার দিয়ে বলল, “রুমের পিছনে কোথায়?” “বড় বড় দুইটা গাছ আছে, তার সাথে ঝোঁপ। সেই ঝোঁপের নিচে।” কাদের বক্স একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চান্দু। তোর উপর দায়িত্ব, গ্রেনেড দুইটা খুঁজে বের করে নিয়ে আসবি।” চান্দু নামের মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে”স্তাদ।” এতোক্ষণ আমি আর সুজন ছাড়া আমাদের আর কেউ কথা বলে নাই। এবারে রিতু কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, “এখন কি আমরা যেতে পারি?” কাদের বক্স বলল, “কী বললে?” “আপনাদের যেসব প্রশ্ন ছিল তার সবগুলোর উত্তর তো জেনে গেছেন। এখন আমাদের কি ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন?” কাদের বক্স কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হা হা করে হাসতে শুরু করল। কাদের বক্সের হাসি দেখে অন্যেরাও হাসতে শুরু করে, যেন তারা খুব মজার কথা শুনেছে। হাসতে হাসতে কাদের বক্সের চোখে পানি চলে আসে। একসময় সে হাসি থামায়, তারপর টেনে টেনে বলে, “শুনো কানা মেয়ে। পৃথিবীতে দুইটা জিনিসের ব্যবসায় মুনাফা সবচেয়ে বেশি। একটা হচ্ছে অস্ত্র আরেকটা হচ্ছে মানুষ! আমি অস্ত্রের ব্যবসাও করি মানুষের ব্যবসাও করি। ছেড়ে দেবার জন্যে তোমাদের আমি ধরে আনি নাই! তোমাদের বিক্রি করা হবে। বুঝেছ? রেঙ্গুনের মার্কেটে!” ভয়ে আতঙ্কে আমাদের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৩৪ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now