বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

পদ্মা নদীর মাঝি (৭)

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান TARiN (০ পয়েন্ট)

X মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভোরে আগে ঘুম ভাঙিল হোসেনের। কুবেরকে সেই ডাকিয়া তুলিল, চোখ মেলিয়াই কুবেরেব কেন যে হঠাৎ এক অকারণ ত্রাসে মন ভবিযা গেল! কী হইয়াছে? বিপদ কীসের? হ, কাল রাত্রে সে হোসেন মিয়ার পয়সা চুরি করিযাছিল। একদফা চোখ মিটমিট করিয়া আশ্বস্ত হইল। হোসেন মিয়াকে খাতির করিয়া বলিল, যান নাকি মিয়া বাই? খিদায় কাতব হইছেন সন্দ করি,–রাইতে কিছু খান ত নাই। এক কাম করেন, দুইগোটা আম খাইয়া যান। প্রত্যুষে ঘুম ভাঙা মুখেও হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে পারে। খাওনের কথা থোও কুবির বাই। বাড়িত গিয়া খামু। একটা প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া বিড়ি ধরাইযা হোসেন উঠিল। ঘুমন্ত গোপির দিকে এক নজর চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাইয়ার বয়স কত, কুবির বাই? নয় সন্দ কইরা থুইছি। বিয়া দিবা না মাইয়ার? হ। দিমু, কেরমে কেরমে দিমু। পকেট হইতে হোসেন ব্যাগটা বাহির করিয়া খুলিল। দেখিয় পাংশু হইয়া গেল কুবেরের মুখ। কিন্তু না, টাকা পয়সা গুনিয়া দেখিবার জন্য হোসেন ব্যাগ বাহির করে না। একটা সিকি বাছিয়া লইয়া সে কুবেরের হাতে দিল। বলিল, বাচ্চাগো খাবার কিনা দিয়ো কুবির বাই। বলিয়া ব্যাগটা আবার পকেটে রাখিয়া দিল। কুবের আত্মসংবরণ করিল তৎক্ষণাৎ যে বিপদ ঘটিল না তার জন্য আর কেন বুক কাঁপিবে, মুখ শুকনো দেখাইবে। খুশিতে বেসামাল হইয়া সে জিজ্ঞাসাই করিয়া বসিল, ব্যাগটা নতুন দেখি? মেলায় কিনছেন বুঝি কাইল? হোসেন বলিল, হ। কথা কহিতে কহিতে দুজনে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন বৃষ্টি নাই কিন্তু মেঘে মেঘে প্রভাতের রূপ অস্বাভাবিক থমথমে। হোসেন একরার মুখ তুলিয়া আকাশের দিকে তাকাইল। ইয়া আল্লা, নামানো আকাশের তলে কী দীনা এই পৃথিবী! ভিজিয়া চুপসিয়া চারিদিকে সকাতর হইয়া আছে। হোসেনের মনের কোণে একটু স্বাভাবিক কবিত্ব ছিল, জীবনে ভিন্ন অবস্থায় পড়িলে হয়তো সে কয়েকটি গীতিকা রচনা করিত, তার মধ্যে দুটি একটি মুখে মুখে প্রচার হইয়া স্থান পাইত শতাব্দীর সঞ্চিত গ্রাম্যগীতিকার অমর অলিখিত কাব্যে-মাঠেঘাটে, মশালের আলোয় আলোকিত উঠানে গীত হইয়া হইয়া ভনিতায় হোসেনের নাম দূর দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িত, লোকে বলিত হোসেন ফকির, চল কেতুপুরে দেওয়ান ফকির হোসেন ছাহাবের দরগায় চেরাগ জ্বালি। হোসেন বুঝি কুবেরকে একেবারে ভুলিয়া যায়। অনেক দিন আগে, কুবেরের মতো ছেঁড়া কাপড় পরিয়া আধপেটা খাইয়া জলে কাদায় সে যখন দিন কাটাইত, সকাল সন্ধ্যায় তখন মনে তাহার ভাসিয়া আসিত গানের চরণ। ফুটা চালার নীচে ময়লা চাটাইয়ের বিছানায় উদরে উপবাস লইয়া তেমনই ভাবে কাল রাতটা কাটাইয়া আজ আবার হোসেনের মনে গান ভাসিয়া আসিতেছে। কুবের, গাহান বাইন্ধবার পার? আমি পারতাম না। আমাগোর যুগইলা পারে। মুখে মুখে ছড়া বাইন্ধ্যা দেয়। আমি বাইন্ধবার পারি। কন কী মিয়া বাই? হোসেন এখন লাজুক। সে এদিক ওদিক তাকায়। ঘনঘন দাড়িতে হাত বুলাইয়া কুবেরের কাছেই অপরাধীর মতো হাসে। লোকটার আদি-অন্ত পাওয়া ভার। তারপর হোসেন বলে, বাঁধমু, শুনবা? কুবের বলে, কন মিয়া বাই, কন। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হোসেন সুর করিয়া বলিতে আরম্ভ করে : আঁধার রাইতে আশমান জমিন ফারাক কইরা থোও বোনধু, কত ঘুমাইবা। বাঁয়ে বিবি ডাইনে পোলা আকাল ফসল রোও মিয়া, কত ঘুমাইবা। মানের পাতে রাইতের পানি হইল রুপার কুপি, উঠা দেখবা না। আলা করেন ঘরেব চালা কেডা চুপি চুপি, দিশা রাখবা না। তোমার লাইগা হাওর দিয়া বাইয়া চেরাগ নাও দিল-জাগানি আলেন যিনি, মিয়া, চিরা-মেঘের বাদাম তুইলা বন্ধু কনে যাও? জিগায় তারে খাঁচার চিড়িয়া। নিদ্‌ ভাঙে না, দিল জাগে না, বিবির বুকের শির, পাড়ি দিবার সময় গেল, মাঝি তবু থির— মাঝি কত ঘুমাইবা। কুবের অভিভূত হইয়া বলিল, মুখে মুখে বানাইলেন মিয়া বাই? খুশ হলি না পারি কী?   হোসেন মিয়া আর দাঁড়াইল না। দুপুর বেলা ঘরের চালের জন্য শণ আনিতে গিয়া কুবের শুনিল, সে বিদেশ গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে কেহ জানে না। কিন্তু হোসেন মিয়ার কথা কখনও বেঠিক হয় না। কুবেরের জন্য শণ সে রাখিয়া গিয়াছে। গোপির বয়স এগারো, কুবের মেয়ের বয়স একবছর ভাড়ায় আর একবছর হাতে রাখিয়া বলে নয়। ন বছর বয়সে যে মেয়ের এগারো বছরের বাড় বিয়ের বাজারে তার দাম আছে। গণেশের শালা যুগল সম্প্রতি পাশের গ্রাম হইতে বোনের তত্ত্ব লইবার ছলে আসা যাওয়া শুরু করিয়াছে। সোজাসুজি কথা সে এখনও পাড়ে নাই, আলাপ আলোচনার মাঝখানে বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করিয়া কুবের কী রকম দর হাঁকিবে জানিবার চেষ্টা করিয়াছে। স্পষ্ট করিয়া কুবেরও এখন পর্যন্ত কিছু বলে নাই। কথা উঠিলে বহুক্ষণ ধরিয়া মেয়ের প্রশংসা কীর্তন করিয়া শুধু একটু আভাস দিয়াছে দুকুড়ি তিনকুড়ি টাকার। বুদ্ধি থাকে যুগল আন্দাজ করিয়া নিক। গণেশের আত্মীয় বলিয়া টাকার বিষয়ে কুবের তাহাকে খাতির করিবে না। যুগল সম্ভবত তাহা টের পাইয়াছে, তাই ইলিশ মাছের মরশুমটা শেষ হইবার প্রতীক্ষায় আছে। হাতে তখন কী রকম টাকা জমে দেখিয়া কথা পাড়িবে। কুবের বোঝে না কী! সকলেব গোপন মতলব সে চোখের পলকে আঁচ করিয়া ফ্যালে। মানুষ মন্দ নয যুগল। এতকাল অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাই বত্ৰিশ বছর বয়স অবধি বিবাহ করিতে পারে নাই; নিজের চেষ্টায় এখন সে অবস্থা ভালো করিয়াছে। উন্নতির জন্য তাহার প্রশংসনীয় প্রযাসের কথা কাহারও অবিদিত নয়। দুটি একটি করিয়া কতকাল ধরিয়া কতকষ্টে সে কিছু টাকা জমাইয়াছিল, তারপর গণেশের কাছে বোনের বিবাহ দিয়া পাইয়াছিল তেইশ টাকা। সকলে ভাবিয়াছিল, এবার যুগল বিবাহ কলিবে, বিবাহের জন্য ছাড়া অত কষ্টে টাকা জমায় কে? কিন্তু যুগল তা করে নাই। সমস্ত জমানো টাকা দিয়া একটা বড়ো নৌকা কিনিয়া সকলকে সে অবাক করিযা দিয়াছিল। দুশো টাকা সে নৌকাব দাম, সুতরাং টাকা সে কম জমায় নাই। ইচ্ছা করিলে ওই টাকায় সে তিন তিনটা বিবাহ করিতে পারিত। অন্তত একটা বিবাহ করিয়া বাকি টাকায় একটা ছোটোখাটো নৌকা কিনিতে কোনো বাধাই ছিল না। তার বদলে উপার্জনের এই স্থায়ী উপায়ের জন্য সমস্ত পুঁজি ভাঙিয়া সে যে সুবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার পরিচয দিয়াছিল তার তারিফ করিতেই হয়। দ্যাখো, একবছরে যুগলের ভাঙা ঘর নূতন হইযাছে, শীর্ণ দেহে মাংস লাগিয়াছে, বিবাহের জন্য টাকাও সে আবার জমাইয়া ফেলিতে পারিয়াছে কিনা কে জানে! জাহাজঘাটে অতবড়ো নৌকার না চাহিতে ভাড়া হয়। রেলে ও জাহাজঘাটে আসিয়া কত মানুষ ও মাল কত গ্রামে যায়, এক একটি বাণিজ্য দ্রব্যের মরশুমের সময় কত মহাজন গ্রামে গ্রামে দাদন-দেওয়া মাল সংগ্রহের জন্য চড়া দরে অসংখ্য নৌকা ভাড়া নেয়। আর শুধু ভাড়া তো নয়। উপরি আয়ও কী কম! ধানের বোঝাই লইয়া একদিনের পথ পাড়ি দিবার সময় দশ-বিশ সের ধান নৌকার গোপন ফাঁকে ফোকরে লুকাইয়া ফেলিবার সুযোগ মেলে ঢের। কেবল ধান নয়, কলাই, মটর, হলুদ, লংকা প্রভৃতি কত কী জিনিস বছর ভরিয়া যুগল অমন কত আনিয়াছে। উন্নতি সে আরও করিবে। কারণ, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো বিষয়ে তাহার এতটুকু শিথিলতা আসে নাই। এখনও সে আগের মতোই কৃপণ। আকুরটাকুরের মাঝি সমাজে আজ সে একজন মাতব্বর লোক। একদিন সেই যে গ্রামের মোড়ল হইয়া দাঁড়াইবে কেহ তাহাতে সন্দেহ করে না। মালার ইচ্ছা বিবাহটা তাড়াতাড়ি চুকিয়া যায় গোপির। এত বয়স হইল আর কতকাল বয়স ভাড়াইয়া মেয়েকে কুবের ঘরে রাখিবে? লোকে যে ইতিমধ্যেই নিন্দা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। স্বামীকে মালা তাগিদ দিয়া বলে, আগে, যুগইলা নি কিছু কয়? কুবের তাহাকে চোখ ঠারিয়া বলে, কয় না? কী কয়? তা শুইনা তর কাম কী? মাইয়ালোক চুপ মাইরা থাক। পোলা বিয়ানের লাইগা পিরথিমিতে আইছস বিয়া পোলা যত পারস–রাও করস কেরে? মালা রাগে বইকী! গাও জ্বালাইনা কথা দেহি খইর পারা ফোটে, মায় নি মুখে মধু দিছিল আঁতুড়ে? গোসা হইলে মারুম গোপির মা। মারবা নাকি? আগে মার, মার—না যদি মার লখার মাথা খাইবা। কুবের ঝিমাইতে ঝিমাইতে নিদ্রাকাতর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হ, ছেলে কোলে রোগা বউটিকে তাহার রাজরানির মতো দেখাইতেছে বটে। কে জানে রাজরানি দেখিতে কেমন? ছেলেটাও যেন ফরসাই হইয়াছে মনে হয়, এমনি বয়সে লখা আর চণ্ডী যেমন তামাটে লাল রঙের ছিল সে রকম নয়। আঁতুড়ে যতদিন ছিল কুবের বিশ্বাস করে নাই, এখন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়াছে যে ছেলেটা সত্যসত্যই খুব ফরসা হইবে। মালার রং কালো নয, তামাটে—মাঝে মাঝে তাহাকে বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতো ফরসাই দেখিয়া বসে। জেলেপাড়ার কোনো স্ত্রীলোকের গায়ে এমন চামড়া নাই। একটা পা যদি ওর হাঁটুর কাছ হইতে দুমড়াইয়া বাঁকিয়া না যাইত, কুবেবের ঘরে ও পায়ের ধূলা ঝাড়িতেও আসিত না। কিন্তু মালার চেয়েও ছেলেটার রং যেন ঢের বেশি ফরসা হইয়াছে। আরও কিছু বড়ো হইলে বিবর্ণ হইয়া আসিয়া শেষ পর্যন্ত রং হযতো ওর মালার মতোই দাঁড়াইবে। তাই যেন দাঁড়ায়। কুবের তাই চায়। যতই সে শান্ত ও সুবিবেচক হোক, মাঝে মাঝে লোকের বিশ্রী ইঙ্গিতে গা জ্বালা করে বইকী, মালার দিকে চাহিয়া কখনও মনে ঘনাইযা আসে বইকী একটা বিতৃষ্ণা মেশানো ব্যথিত ক্ৰোধ। কুবেরের দৃষ্টি আরও ঘোলাটে হইয়া আসে। এখন, শ্রাবণের এই প্রথম সপ্তাহে আকাশে মেঘের এক মুহুর্তের বিশ্রাম নাই। পরপর কয়রাত্রি অবিরত জলে ভিজিয়া কুবের আবার জ্বর বোধ করিতেছে।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৫২ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now