বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
চন্দনগড়ে আজ কদিন ধরেই থমথমে উত্তেজনা, কিসের একটা চাপা ভয় চারদিকে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই উত্তরের হাট বন্ধ করে দিচ্ছে মহাজনেরা। ঝাউতলার যাত্রাপালা আর বসছে না, বাচ্চারা রাতে আর কাঁদছে না, সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে চ্যাংড়া বখাটেরা। কী ব্যাপার? ব্যাপার হলো গুজব রটেছে তেপান্তরের ওই পার থেকে (যেখানে কেউ যায়নি, কিন্তু সেটা যে আছে, তা সবাই জানে) আজদাহা নেমে এসেছে এই পারে!
আজদাহা কী? আজদাহা হলো বিরাট এক সাপ, যার বড় বড় ঠান্ডা লেবুর মতো সবুজাভ চোখ, কটকটে তীক্ষ্ণ তিমি মাছের কাঁটার মতো দাঁত। নিশ্বাস যেখানে পড়ে, সেখানে গর্ত হয়ে যায়, গর্ত সঙ্গে সঙ্গে ভরে ওঠে পাতালের কালো পানিতে আর তাতে ঘুরতে থাকে ছোট ছোট কুমিরের মতো কাঁটাল মাছ।
আজদাহা এক শ বছর ঘুমিয়ে থাকে আর ঘুম ভাঙলেই হাভাতের মতো চারদিক গিলতে গিলতে নাকি ছুটে আসে। আশপাশে যা পায় তার আর বাছবিচার করে না, হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, খরগোশ, মোষ, মূষিক, খড়ের গাদা, চালের নাড়া, তালগাছ, শালগাছ, আমগাছ, জামগাছ; সোজা কথা, সব গিলতে গিলতে বড় বড় লেবুরঙা দুই চোখ খুলে সে আসছে, এদিক–ওদিক নিশ্বাস ফেলে ফেলে বিষম গর্ত করে করে চারদিক ফুটিফাটা। ও হ্যাঁ, তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারের কথাই তো বলা হয়নি, সেটা হলো—মানুষ। মানুষ যদি পায়, তবে নাকি সে সবকিছু ফেলে তার পেছনে ছোটে। তেপান্তরের এই পারে (যেখানে মানুষেরা থাকে আরকি) মোটামুটি সব রাজ্যের মানুষ নাকি ইতিমধ্যে আজদাহার পেটে চলে গেছে, এমন খবরই সেদিন চন্দনগড়ের রাজপথ ধরে ছুটে আসতে আসতে রাজা গদাধরের প্রধান চর বিটকেল বর্গি চিৎকার করে বলছিলেন। সেই থেকে রাজ্যের আর কারও জানতে বাকি নেই যে আজদাহা চলে এল বলে।পরের ঘটনায় যাওয়ার আগে রাজা গদাধরের কথা একটু বলতে হয়। নামে গদাধর হলেও গদাটদা তিনি খুবই ভয় পান। সারা দিন নিজের কামরায় ঘাপটি মেরে শুয়ে–বসে থাকেন আর চার বেলা ভূরিভোজ করেন। রাজ্যের যে অবস্থা, তাতে যে এ রকম বিলাসব্যসন করাটা খুব ভালো ব্যাপার, তা নয়। কোনোরকম রাজকার্য না করে করে আর খাজনা-(ঘুষ) ইত্যাদি না তুলে তুলে রাজকোষও তেপান্তরের মাঠ। এদিক–ওদিক থেকে ধারদেনা করে করে চালাচ্ছেন, এই করতে করতে ইদানীং অন্য রাজ্যের রাজারা ধারও দিতে চাইছে না। আর অন্যদিকে অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির বলে রাজার আজ পর্যন্ত কোনো রানিও হয়নি। বিয়ের পয়গাম হয়, আয়োজন হয়, কিন্তু মূল অনুষ্ঠানে বরের খবর নেই। না, তিনি নাকি নিজের কামরায় বসে বসে আখ চিবাচ্ছেন, এ রকম একাধিক চেষ্টা (তেপান্তরের) মাঠে মারা যাওয়ার পর প্রধান উজির সুগম্ভীর ভদ্র হাল ছেড়েছেন। ওদিকে ভূশণ্ডির রাজা গোগন্ডগোল হুমকি দিয়েছেন, তার পাওনা ফেরত দিতে না পারলে অচিরেই চন্দনগড় সে দখল নিতে আসবে। কারণ, এদ্দিনে যা ধার দিয়েছেন, তা দিয়ে নাকি দুটি চন্দনগড় সব মানুষসুদ্ধ কেনা সম্ভব। যা–ই হোক, এই সবকিছুর পরও জনগণের প্রবল অপ্রিয় হলেও চন্দনগড়ে তার প্রতিপক্ষরা তার চেয়েও কেবলাকান্ত বলে সবাই অগত্যা তাকেই মেনে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলছেন। বরং রাজা অন্যমনস্ক বলে মাঝেমধ্যেই ভ্যাট–ট্যাক্স ফাঁকি মেরে অনেকে বেশ ভালোই আছেন বলা যায়।
তো এই রকম জোড়াতালি দিয়ে দিয়ে তা–ও চলেই যাচ্ছিল, এর মধ্যে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই চলে এল আজদাহা। যাকে কেউ দেখেনি, কিন্তু আজন্ম শুনে আসছে যখন, আছে তো বটেই। দাদা–পরদাদা থেকে শুনে আসা জলজ্যান্ত গল্প সব, প্রাচীন পুঁথিতে কাঁচা হাতে কিছু আঁকিয়ে বড় করে এঁকেও রেখেছে তার ছবি, একেবারে ভিরমি কাটার মতো ছবি বটে। তাই কদিন ধরে সবাই একটু তবদা মেরে আছে।দাদা–পরদাদা থেকে শুনে আসা জলজ্যান্ত গল্প সব, প্রাচীন পুঁথিতে কাঁচা হাতে কিছু আঁকিয়ে বড় করে এঁকেও রেখেছে তার ছবি, একেবারে ভিরমি কাটার মতো ছবি বটে।
কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো আর চলবে না, কিছু একটা করতে হবে। উজির সুগম্ভীর ভদ্র শেষে থাকতে না পেরে রাজা গদাধরের কামরায় এলেন। রাজা তখন নিবিষ্ট মনে একটা ঢাউস সাইজের তালমিছরির টুকরা মনোযোগ দিয়ে চাটছেন। আবেশে চোখ প্রায় ঢুলু ঢুলু, এমন সময় সুগম্ভীর তার জলদগম্ভীর গলায় বললেন,
‘রাজামশাই!’
‘কে? কে?’ আচমকা আওয়াজ শুনে হাত থেকে মিছরির তাল পড়ে গেল মাটিতে, সঙ্গে সঙ্গেই রাজার খাসভৃত্য কুড়াই সেটা কুড়িয়ে আবার পাতে তুলে রাখল।
গলা খাঁকারি দিয়ে সুগম্ভীর বললেন, ‘জি আমি, বলছিলাম কিছু একটা করতে হয় এবারে।’
‘কী বিষয়ে?’
‘আজদাহা।’
‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা কী করা যায়?’
আবার গলা খাঁকারি দিয়ে খাসভৃত্যের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলেন উজির। রাজা সেটা দেখতে পেয়ে হাতের ইশারা করলেন, ভৃত্য কুড়াই সঙ্গে সঙ্গে কামরা ত্যাগ করল। গলা নামিয়ে কাছে এসে উজির বললেন,
‘রাজামশাই, মার্সেনারি ভাড়া করুন।’
‘মারছে কী?’
‘মার্সেনারি, মানে ভাড়াটে পালোয়ান। সে আপনার হয়ে আজদাহা মেরে দেবে।’
‘কেন মেরে দেবে?’
‘আপনি তাকে লোভ দেখাবেন, মেরে দিলে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা।’
‘আরে, আমার তো রানিই নেই, রাজকন্যা কোত্থেকে আসবে? আর রাজ্যও তো যায় যায়।’
‘তাহলে অন্য কোনো একটা চাপা মারতে হবে। আমাদের যে রাজকোষ খালি, তা তো আর সেই ভিনদেশি পালোয়ান জানবে না। শর্ত থাকবে, সে আজদাহাকে মারতে গিয়ে মরে গেলে আমরা তার একটা মূর্তি বানাব রাজদ্বারে আর বেঁচে গেলে রাজকোষ।’
‘মরে গেলে তো মনে হচ্ছে ব্যাটার লাভ বেশি হবে। রাজদ্বারে মূর্তি সোজা কথা নয়। আর অর্ধেক রাজত্ব দিলে তো ঋণের অর্ধেক তাকেই দিতে হবে।’
‘এগজ্যাক্টলি, আমার মতে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিন। যে আজদাহাকে মারতে পারবে, অর্ধেক রাজত্ব আর ওই ইয়ে, না, রাজকন্যা হচ্ছে না। যা–ই হোক, ম্যানেজ করতে হবে একভাবে। কী নেজ?’
‘ম্যানেজ, মানে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। শেষে ছোট করে একটা * শর্ত প্রযোজ্য–টাইপ কিছুও জুড়ে দেব। ঠিক আছে, তাহলে ওই কথাই রইল, আমি এলান তৈরি করে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নিচ্ছি।’
‘ফিং কী?’
‘আরে ধুরো, সব বোঝার দরকার নেই, আপনি মিছরি খান।’এই বলে উজির সুগম্ভীর বের হয়ে চন্দনগড়জুড়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন যে যে আজদাহাকে মেরে আসতে পারবে, সে পাবে চন্দনগড়ের অর্ধেক রাজত্ব ও আরও অনেক ‘আকর্ষণীয়’ পুরস্কার। কিন্তু ঢেঁড়া পেটানোর পর দেখা গেল, চন্দনগড়ের অর্ধের রাজত্ব নিয়ে কারও তেমন কোনো উৎসাহ নেই। আকর্ষণীয় পুরস্কারেও কেউ খুব একটা আগ্রহী না। প্ল্যান মাঠে মারা যাচ্ছে আর ওদিকে শোনা যাচ্ছে, আজদাহা নাকি খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। উপায়ান্তর না দেখে উজির সুগম্ভীর আরও গম্ভীর হয়ে এই সব ঢেঁড়া–ট্যাড়া বাদ দিয়ে সরাসরি পালোয়ান ধরে আনার জন্য চারদিকে লোক পাঠালেন। একের পর এক ভাড়াটে পালোয়ান এল, তেপান্তরের দিকে গেল, কিন্তু আর ফিরে এল না।
মুচড়া খান (প্রতিপক্ষকে খালি হাতে মুচড়ে দেন), কটকটি সিং (অত্যন্ত কটকটে মেজাজ), মুগুর মালি (বাগানের মালি, বাগানে বাঘ এসে পড়ায় মুগুরপেটা করে সেটাকে তাড়ান, তাই মুগুর মালি), তলোয়ার খাঁ (তলোয়ারে সিদ্ধহস্ত), চাবিলাল (এর বিশেষত্ব ভালোমতো জানার আগেই তিনি আজদাহার খোঁজে চলে যান, আর ফিরে আসেননি)। এ রকম একের পর এক পালোয়ান এল আর গেল, কিন্তু কেউ ফিরে এল না। এদিকে চন্দনগড় মোটামুটি খালি হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে উজির আদেশ দিলেন,
‘আলিশান খাঁকে খবর দাও, বলো যে সে রাজি হলে পুরো রাজত্ব!’
আলিশান খাঁ গোটা সপ্তভূমির সবচেয়ে নামজাদা পালোয়ান। শোনা যায়, খালি হাতে নাকি হাতি নিয়ে লোফালুফি করেন প্রতি সকালে। এক চুমুকে পুকুরের সব পানি খেয়ে ফেলেন (মাছসহ)। আস্ত সুপারিগাছ দিয়ে দাঁত খোঁচান। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো তাকে কেউ কখনো দেখেনি! তিনি নাকি থাকেন ভয়াল আন্ধারপোঁতা জঙ্গলে, কেউ যদি তার সাহায্য চায়, তবে আন্ধারপোঁতা জঙ্গলের যে আলিশান বটগাছটা আছে, তার নিচে একটা কাগজে নিজের সমস্যার কথা লিখে রেখে আসতে হবে। সমস্যাটা গুরুতর হলে তিনি সেটা সমাধান করে দেবেন। তবে বিনিময়ে কী চাই, সেটা উনি তখনই না বলে সময়মতো চেয়ে নেবেন। উজির সুগম্ভীরের লোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আন্ধারপোঁতার পাকুড়তলায় কোনোমতে চিঠিটা রেখেই ছুট! আদৌ কাজ হলো কি না, তা দেখার সময় নেই, সাহসও নেই কারও। উজির কে, তা বলাও হলো না।চিঠি পৌঁছে দেওয়ার পর এবার শুরু হলো অপেক্ষার পালা, ওদিকে চন্দনগড়ের আশপাশে মাঝেমধ্যেই অদ্ভুত সব গর্জন শোনা যাচ্ছে, সবাই মোটামুটি নিশ্চিত আজদাহা চলে এসেছে, আর সময় নেই। যারা এখনো ছিল, তারাও এবার দলে দলে চন্দনগড় ছাড়া শুরু করল। উজির সুগম্ভীর রাজা গদাধরসহ পালানোর জন্য জুড়ি গাড়ি পেছনের দরজায় বেঁধে রেখেছেন। আর একদিন অপেক্ষা করবেন, এর মধ্যে আলিশান খাঁ চলে এলে তো হলো, তিনি যদি আজদাহাকে মারতে পারেন, তবে তো রাজ্য তারই। আর যদি তিনি না আসেন, তাহলেও রাজ্য চলেই গেল। দেখা যাক, আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা শুধু।আন্ধারপোঁতা জঙ্গল।
ভোর হচ্ছে। পুবের আকাশে লালচে–কমলা রং ধরেছে। একগাদা পাখি ক্যাঁচরম্যাচর শুরু করেছে, তা–ও সেই আঁধার থাকতেই। জঙ্গলের প্রবেশপথের ঠিক সামনেই এক বিরাট অবয়ব। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে ছোটখাটো একটা পাহাড় না হলেও টিলা, কিন্তু নড়ে উঠতেই বোঝা গেল, এটা কোনো একটা প্রাণী। প্রাণীটার মাথাটা যেন বিরাট এক পাথুরে টিলা, কুতকুতে চোখ, সারা গায়ে ঝলমলে কালচে আঁশ। মাথার যেখানে কান থাকার কথা, সেখান থেকে হঠাৎ পাখির ডানার মতো কানকো ধরনের কিছু একটা বের হয়েছে। হেমন্তের সকালে নিশ্বাসে যেন ধোঁয়া ফুঁড়ে বের হচ্ছে থেকে থেকে। এই সেই আজদাহা! বিরাট এক নাগসর্প, আদতেই বিরাট বপু। মোটামুটি কয়েক রাজ্যের প্রাণিকুল খেয়ে সাবড়ে এই জঙ্গলের কাছে একটু বিশ্রামে থেমেছে সে, হুট করে আর কিছু করার ইচ্ছা নেই। দেখা যাক, চাই কি এখানেই পরের এক শ বছরের জন্য ঘুমটা শুরু করা যেতে পারে। গত কদিন বেশ কিছু হুমদোহুমদো পালোয়ান–টাইপ মানুষ খেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। আজ একটা দারুণ ঘুম দেওয়ার তোড়জোড় করছে সে, এমন সময় হঠাৎ দূর থেকে কাউকে আসতে দেখা গেল। সাদা আলখাল্লা পরা টিংটিঙে এক লোক। দেখে হাসি পেল আজদাহার, এত এত পালোয়ান এর পর এ আবার কে? একে তো খেয়েও সুখ হবে না।
কাছে আসতেই দেখা গেল, গেরুয়া বরন আলখাল্লা পরা এক সন্ত-সাধু, হাতে একটা একতারা নিয়ে স্মিতমুখে এদিক–ওদিক দেখতে দেখতে আসছে।
আজদাহাকে সে যেন চোখেও দেখেনি।
আর থাকতে না পেরে কৌতুক চোখে তাকিয়ে আজদাহা হালকা গলা খাঁকারি দিল, ‘এহেম!’
‘আরে, তুমি আবার কে?’ বলে উঠল সাধু বা গায়ক লোকটা।
‘আমি আজদাহা, সপ্তভূমির সর্বোচ্চ খাদক। এক শ বছর ঘুমিয়ে থাকি। জেগে উঠে খাই এক শ হাতি, দুই শ মোষ, চার শ হরিণ, ছয় শ…’
‘আরে আরে, থামো থামো। তুমি দেখি কথা কইতে পারো, আজব কিসিমের প্রাণী! তা এত ঘুমাওই–বা ক্যান আর এত খাওই–বা ক্যান?’
আজদাহা একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘কারণ, এটাই আমার কাজ।’
‘খালি খান আর ঘুমান? এই কইরা জীবন কাটাইবা? দুনিয়ার আর কিছু দেখবা না? শুনবা না?’
‘দুনিয়ার আর কিসের কথা হচ্ছে?’ অবাক আজদাহা।
‘এই ধরো ফুল, এই ধরো মেঘ, এই ধরো একটা ব্যাঙ চুপ কইরা বইসা রইল নদীর পাড়ে। বা ধরো শিল্পকলা, যাত্রাপালা, নাচ, গান, আঁকিবুঁকি। তা গানটান জানো কিছু?’
আজদাহা তো হতবাক। ‘গান? এ আবার কী? পান খায় শুনেছি, জান যায় শুনেছি, বান ডাকে তা–ও জানি, কিন্তু গান? এ আবার কী?’
‘গান কী?’ আজদাহা শুধায়।
‘শোনার জিনিস, শুনবা নাকি?’
‘ব্যথা পাব না তো?’
‘আরে না না, পাইলেও কইলজার মধ্যে পাইতে পারো।’
আজদাহা শুনে ভয় পেয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তাকে আশ্বস্ত করে,
‘আরে না না, এই ব্যথা সেই ব্যথা না। শোনো তাইলে।’
বলে একতারায় টুংটাং শুরু করে গায়ক বা সাধু। এরপর ভরা গলায় ধরল গান, সেই গান শুনে আজদাহার প্রাণ আকুলি–বিকুলি। চোখে পানি ছলাৎ ছলাৎ, প্রাণে পানি ছলাৎ ছলাৎ। কলজেতে সেই ব্যথা চিন চিন। গান শেষে ছলছল লেবুর মতো সবুজ চোখ একেবারে বরফের মতো সাদা বানিয়ে মুখ তুলে সাধু বা গায়ক লোকটাকে বলল,
‘কী শোনালে ভাই, এ তো যাকে বলে একেবারে যা তা লেভেলের। বলো, তোমার জন্য কী করতে পারি আমি?’তবে বিনিময়ে কী চাই, সেটা উনি তখনই না বলে সময়মতো চেয়ে নেবেন। উজির সুগম্ভীরের লোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আন্ধারপোঁতার পাকুড়তলায় কোনোমতে চিঠিটা রেখেই ছুট!
‘তোমার ভালো লাগছে, এ–ই আমার পাওনা।’
‘তারপরও বলো, কী চাই তোমার।’
‘একটা করতে পারো, যত নিরপরাধ প্রাণীকে খাইছ, তাদের ফিরায়ে দাও। প্যাটের জন্য যা খাইছ ঠিক আছে, জিবের জন্য যা খাইছ, তা ফেরত দাও। তুমি তো তন্ত্রমন্ত্র জানো, চাইলেই পারবা।’
আজদাহা চুপ।
‘কী হইল?’
‘ইয়ে মানে হজম হয়ে গেছে। আর মন্ত্র একটা ছিল মনে হয়, সেই এক শ বছর আগে মুখস্থ করছিলাম, ভুলে গেছি।’
‘আইচ্ছা বাদ দাও। যারা গেছে গেছে, আইজ আর কাইল। মন্ত্রটন্ত্র লাগব না। এইবার কী করবা?’
‘আরও গান শোনাও আমাকে।’
‘না, আইজ আর না, আমারে ওই বেলা ফিরতে হবে। একটা শো আছে নিমপোতার মাঠে।’
‘আমিও যাব।’ করুণ চোখে তাকিয়ে বলে নাগসর্প আজদাহা।
‘আমি ঠিক করছি, এখন থেকে গান গাইব, তুমি শেখাবে আমাকে? এই এক শ বছর পরপর এই একই জিনিস আর ভালো লাগে না।’
‘গান শিখবা?’
‘হুঁ।’
‘আইচ্ছা, লও যাই, তয় ঘাসপাতা খাইতে হবে কিন্তু। মানুষ, ইন্দুর–বান্দর সব বাদ।’
আজদাহা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। এতগুলো জন্তু–জানোয়ার (ও মানুষ) হজম করে বেচারা একটু অফ খেয়ে আছে।
আজদাহা বশ–পর্ব কেমন গেল, এ নিয়ে রাতে সভা বসেছে রাজা গদাধরের কামরায়। আলিশান খাঁর পোষা কবুতর এসে একটা চিরকুট দিয়ে গেছে উজির সুগম্ভীরকে। তা নিয়ে তিনি আর রাজার কামরায়—
‘এই পালোয়ানও মারা গেছে?’
‘যাক, মূর্তি–টুর্তি বানানো লাগবে না। রাজদ্বারে মূর্তিতে সয়লাব। আর রাজত্ব?’
‘চায় না।’
‘পাগল নাকি?’
‘তা–ই তো মনে হয় অথবা বেশি বুদ্ধি।’
‘সেকি! তাহলে...তাহলে তো পুরা...’
‘হ্যাঁ, পুরা লোন আপনাকেই টানতে হবে।’ একটু থেমে যোগ করেন উজির, ‘ইন্টারেস্টসহ।’
রাজা আবার মুষড়ে পড়ে সজোরে তালমিছরি চুষতে শুরু করেন। সুগম্ভীর বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘ইমোশনাল ইটিং।’
আর আজদাহা? সে আর সেই নাম না–জানা বাউল (নাকি আলিশান খাঁ?) নাকি আজকাল সপ্তভূমির বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে শো করে বেড়াচ্ছে, আগে থেকে বুকিং না দিলে নাকি শোতে ঢোকার উপায় থাকে না।
এই গল্পটার লেখক আমি না
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now