বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ত্রাতিনা – প্রথম পর্ব(1.03)

"সাইন্স ফিকশন" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান ★mAhIrA★ (০ পয়েন্ট)

X ১.০৩ রায়ীনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশযানের চেয়ারটিতে বেল্ট দিয়ে তাকে এমনভাবে বেঁধে রাখা আছে যে, সে নিচের দিকে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে নীল আকাশ, সেখানে সাদা মেঘ। সে পৃথিবীটিকে আর কখনো দেখতে পাবে না, এই নীল আকাশ আর সাদা মেঘও কখনো দেখতে পাবে না। কিন্তু সে এই ধরনের ভাবালুতাকে তার চিন্তার মাঝে স্থান দিল না। মাথার ভেতর থেকে সব ধরনের চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সে তার মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। রায়ীনা সামনের প্যানেলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কোয়াকম্পের সুইচ অন করল। জ্বালানি পরীক্ষা করল। কারগো বে’তে রাখা নিউক্লিয়ার বোমাটির নিয়ন্ত্রণ শেষবারের মতো দেখে নিল। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ পরীক্ষা করল, বায়ু নিরোধক সিল পরীক্ষা করল। যোগাযোগ মডিউল চালু করল। তারপর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে কথা বলল, “আমি প্রস্তুত।” রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পায়, “চমৎকার রায়ীনা। তোমার মিশন সফল হোক। আমরা কাউন্ট ডাউন শুরু করছি।” “করো।” প্রায় সাথে সাথেই আলোর ঝলকানির সাথে সাথে সে কাউন্ট ডাউন শুনতে পায়। ভরাট পুরুষ কণ্ঠে কোনো একজন গুনতে শুরু করেছে, “দশ, নয়, আট…।” রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি এবং তারপর একটা কম্পন অনুভব করে। তার মহাকাশযানটিকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিশাল ক্ল্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে দুই পাশে সরে যাচ্ছে। রায়ীনা টের পেলো, তার ইঞ্জিনটি চালু হতে শুরু ত্রাতিনা করেছে। এক ধরনের ধাতব গুঞ্জন শুরু হয়েছে। “সাত…ছয়…পাঁচ…চার…” পানি দিয়ে সিক্ত করে রাখা কংক্রিটের বেস থেকে ইঞ্জিনের উত্তাপে সাদা জলীয় বাষ্প চারদিক ঢেকে ফেলছে। “তিন….দুই….এক…” রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। রায়ীনা বাইরে তাকালো, মহাকাশযানটা ওপরে উঠতে শুরু করেছে। রায়ীনা তার সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে তার সিটের সাথে চেপে ধরবে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে বের হওয়ার সময় সব মহাকাশচারীদের এই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। ট্রিটন রকেটের শক্তিশালী ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করে তার ইলন শাটলকে মহাকাশে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। গতি বাড়তে শুরু করার সাথে সাথে রায়ীনা অনুভব করল, অদৃশ্য একটা শক্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, মনে হয় চোখের সামনে একটা লাল পদা থরথর করে কাঁপছে। রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সমস্ত শরীরকে টান টান করে রাখে। সে বুঝতে পারছে, তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি কিছু চিন্তা করতে পারছে না। রায়ীনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। প্রতিবার মহাকাশ অভিযানে তাকে এই অদৃশ্য শক্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সে জানে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীকে ঘিরে একটা কক্ষপথে ঢুকে যাবে। তখন হঠাৎ করে তার বুকের ওপর ভেসে থাকা জগদ্দল পাথরটি সরে যাবে। ইলন শাটলের ভেতর পুরোপুরি ভরশূন্য হয়ে সে ভেসে বেড়াবে। রায়ীনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে এবং প্রায় হঠাৎ করেই তার মনে হয় তার বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য শক্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হয় হালকা এবং ভরশূন্য। রায়ীনা তার সিট বেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর ভেসে ভেসে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো, নিচে নীল পৃথিবী। পৃথিবীটি কী সুন্দর, এটি মনে হয় শুধু মহাকাশে এলেই সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যায়। রায়ীনা জানালাটিতে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে এসে ভিডিও স্ক্রীনটা চালু করল। সাথে সাথেই প্লিক্সি নেটওয়ার্কে সে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার দেখতে পায়। কমান্ডার লী বড় একটা স্ক্রীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনাকে দেখতে পেয়ে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, “চমৎকার ট্র্যাজেক্টরি। তুমি কক্ষপথে পৌঁছে গেছ।” রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।” কমান্ডার লী বলল, “গ্রহকণাটা এখনো এগারো ঘন্টার পথ।” রায়ীনা বলল, “বুঝতে পারছি।” “প্রোগ্রাম লোড করা আছে। পৃথিবীটা একবার ঘুরে এসে ঠিক জায়গায় এলে তোমার রকেট চালু হবে।” রায়ীনা একটু হাসল। বলল, “মহাকাশে ওপরে নিচে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু এই মিশনটা অন্যরকম।” “হ্যাঁ, অন্যরকম।” “প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান।” “যদি সময় থাকতো, তাহলে তোমাকে পৃথিবী কয়েকবার ঘুরিয়ে এনে ছেড়ে দিতাম। এখন একবারে এক্সেলেরেট করতে হবে-কষ্ট বেশি হবে।” রায়ীনা হাসল। বলল, “আমার কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি জড় পদার্থের মতন, আমার কষ্ট হয় না।” রায়ীনা কন্ট্রোল প্যানেলটাতে ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেকে ভাসিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসে। জানালার হ্যাঁন্ডেলটা ধরে সে আবার নিচে পৃথিবীর দিকে তাকালো। নীল পৃথিবীটা ঘিরে সাদা মেঘ, অর্ধেক পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মাঝে সেও পৃথিবীর অন্ধকার ছায়ার মাঝে ঢুকে যাবে। তখন পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখা যাবে। বড় বড় শহরগুলোতে স্ফটিকের মতো আলো জ্বলজ্বল করছে, মহাকাশ থেকে কী অপূর্ব দেখায়। রায়ীনা ঘড়ির দিকে তাকালো। পুরো পৃথিবীটা ঘুরে আসতে নব্বই মিনিটের মতো সময় নেয়। যার অর্থ, আর দশ মিনিটের মাঝেই সে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে গ্রহকণার দিকে ছুটে যাবে। তার এখন মহাকাশচারীর সিটে বসা দরকার। তা না হলে একটু পরেই কর্কশ এলার্ম বাজতে শুরু করবে। রায়ীনা ভেসে ভেসে তার সিটে গিয়ে বসল। দুই পাশ থেকে স্ট্র্যাপ এসে তাকে সিটের সাথে বেঁধে নেয়। সে হাত বাড়িয়ে কোয়াকম্পের সুইচটি অন করে দিল। এখন থেকে সে সরাসরি কোয়াকম্পের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়। রায়ীনা আবার কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেল। কমান্ডার নিচু গলায় ডাকল, “রায়ীনা।” “বল।” “তুমি প্রস্তুত?” “হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।” “তোমার সাথে আমরা যোগাযোগ রাখব, কিন্তু এখন থেকে তোমার মহাকাশযানের দায়িত্ব তোমার।” “আমি জানি।” “আমরা অপেক্ষা করব। শুধু তুমি ডাকলে আমরা সাড়া দেব। আমরা নিজে থেকে তোমার সাথে আর কথা বলব না।” “ঠিক আছে কমান্ডার। মিশনের এই পর্যায়ে এটাই হচ্ছে প্রোটোকল।” “তাহলে বিদায় রায়ীনা।” “বিদায়।” অভ্যাস মতো আবার দেখা হবে” বলতে গিয়ে রায়ীনা থেমে গেল। আবার দেখা হবে না। পৃথিবীর কারো সাথে আর দেখা হবে না। . রায়ীনা প্রথমে একটা গর্জন শুনতে পেলো। তারপর তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। প্রায় সাথে সাথেই রায়ীনার মনে হলো, একটা ভারী পাথর বুঝি তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। সে দাঁত দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই অদৃশ্য চাপটা সহনীয় হয়ে যাবে। হলোও তাই, রায়ীনা তখন সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলো। জানালার কাছে এসে সে নিচের দিকে তাকালো। দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসবে। এই প্রথমবার পৃথিবীর জন্যে সে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার ত্রাতিনার কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে সে কী করছে? যে শহরটি থেকে সে এসেছে, সেটি এখন পৃথিবীর উল্টোপিঠে। সেখানে এখন গভীর রাত। ত্রাতিনা কী তার জন্যে কাঁদছে? কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে? নাকি এখনো জেগে আছে? নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে সে কী ভয় পাচ্ছে? রায়ীনা জোর করে তার মাথা থেকে ভাবনাটা সরিয়ে দিল। তার এখন আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। সে পৃথিবীকে রক্ষা করার মিশনে এসেছে। তার এখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যাকুল হবার সময় নেই। ঘণ্টা দুয়েক পর হঠাৎ এলার্ম বেজে উঠল। রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কোয়াকম্প জানাচ্ছে, তার ইলন শাটলের জ্বালানি বিপজ্জনক মাত্রায় কমে আসছে। পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে যেতে হলে তার জ্বালানি হিসেব করে খরচ করতে হবে। রায়ীনাকে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে না। তাকে তার জ্বালানি বাঁচিয়ে রাখতেও হবে না। কোয়াকম্প সেটি জানে না! রায়ীনা এলার্মটি স্পর্শ করে বন্ধ করে মনিটরের দিকে তাকালো। সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন তাকে খুব সাবধানে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গ্রহকণাটির পাশাপাশি তাকে যেতে হবে এবং খুব সাবধানে গ্রহকণাটির ওপর নামতে হবে। কাজটি সহজ হবে না। কারণ গ্রহকণাটির আকার খুবই বিচিত্র এবং সেটি আরো বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়ীনাকে এখন আর পৃথিবীর তথ্য ব্যবহার করতে হবে না, সে নিজেই তার ইলন শাটল থেকে গ্রহকণাটির বিচিত্র গতিটাকে বিশ্লেষণ করতে পারবে। কোয়াকম্প তাকে সাহায্য করবে। রায়ীনা আবার মহাকাশচারীর সিটে গিয়ে বসল। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে নিরাপত্তা বন্ধনী আবার তাকে সিটের সাথে আটকে ফেলল। রায়ীনা তখন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে, কন্ট্রোল প্যানেলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে। গ্রহকণাটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কী বিচিত্র এই গ্রহকণাটি! একটি গ্রহকণার আকার যদি কুৎসিত হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে এটাকে কুৎসিত বলা যেতো। শুধু কুৎসিত নয়, অশুভ এবং বিপজ্জনক। রায়ীনাকে তার ইলন শাটলের বেগ কমাতে কমাতে গ্রহকণাটির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক যখন গ্ৰহকণাটির পাশে পৌঁছাবে, তখন গ্রহকণাটির তুলনায় তাকে স্থির হয়ে যেতে হবে। কোয়াকম্প তার অনেকখানিই করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কাজটি তার নিজের হাতে করতে হবে। দেখতে দেখতে সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি চলে এলো। ইলন শাটলটির থেকে দূরত্ব এখন পাঁচ শ’ মিটার থেকে কম। এখান থেকে জানালা দিয়ে খালি চোখেই রায়ীনা দেখতে পেল গ্রহকণাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখে মনে হয়, সেটি বুঝি মহাকাশে স্থির হয়ে আছে। আসলে সেটি স্থির নয়, সেটি অচিন্ত্যনীয় বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে যদি গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করতে না পারে, তাহলে এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে। রায়ীনা কোয়াকম্পকে গ্রহকণাটির বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে থাকার গতিটি বিশ্লেষণ করতে দিয়ে ধীরে ধীরে ইলন শাটলটিকে সেটির কাছাকাছি নিতে থাকে। একশ মিটারের কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। কোয়াকম্প গতিপথটি বিশ্লেষণ করে মনিটরে দেখাচ্ছে এবং সেদিকে তাকিয়ে রায়ীনা চমকে উঠল। একটা গ্রহকণার গতিপথ এরকম হতে পারে না। গ্রহকণার সেন্টার অফ এ্যাভেটি ইলন শাটলের তুলনায় স্থির থাকতে হবে। কিন্তু এটি স্থির নয়, এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। এটি কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়। রায়ীনা ভুরু কুঁচকে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে সে কীভাবে অবিশ্বাস করবে? কোয়াকম্পের বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণার ওপর নামা প্রায় অসম্ভব। শেষ মুহূর্তে গ্রহকণাটির একটা অংশ ঘুরপাক খেতে খেতে ইলন শাটলকে আঘাত করে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে উড়ে যাবে! রায়ীনা আবার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনিটরটির বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণাটি একটি নিরীহ গ্রহকণা নয়। হয়তো এর ভেতরে অবরুদ্ধ গ্যাস আছে। সেই গ্যাস হয়তো এর ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে এসে গ্রহকণাটাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। কিংবা এটি– রায়ীনা তার মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। এরকম নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে একটা গ্রহকণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকে, তাহলে এটি যা হতে পারে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনার কথা রায়ীনা তার মাথায় আনতে চায় না। রায়ীনা এখন কোয়াকম্পের ওপর নির্ভর না করে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে ইলন শাটলকে গ্রহকণাটির ওপর নামিয়ে আনবে। তারপর ইলন শাটলে রাখা নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে গ্রহকণাটিকে ভস্মীভূত করে দেবে। ইলন শাটলকে নামানোর জন্যে রায়ীনা গ্রহকণার ওপর একটা জায়গা বেছে নেয়। জায়গাটি মসৃণ নয়। খানিকটা এবড়োথেবড়ো, কিন্তু আশেপাশে বড় কোনো উঁচুনিচু জায়গা নেই। রায়ীনা খুব সাবধানে ইলন শাটলকে নামাতে থাকে। গ্রহকণাটি যখন হঠাৎ ঘুরে যায় কিংবা নড়ে যায়, রায়ীনাও তখন ইলন শাটলকে ঘুরিয়ে নেয়, নড়িয়ে নেয়। উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকা কোনো অংশ হঠাৎ করে ঘুরে ইলন শাটলের দিকে ছুটে এলে রায়ীনাকেও দ্রুত সরে যেতে হয়। এর আগে ইলন শাটলকে কেউ এইভাবে ব্যবহার করেনি, করার প্রয়োজন হয়নি। রায়ীনা এক সময়ে তার ইলন শাটলের শক্তিশালী ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখতে পায়। ইঞ্জিনের উত্তপ্ত গ্যাস গ্রহকণায় আঘাত করে ধুলোবালি উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। হঠাৎ গ্রহকণাটি জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে ওঠে। উঁচু হয়ে থাকা একটা অংশের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবার আগেই রায়ীনা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নেমে গ্রহকণাটির ওপর আক্ষরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা একটা প্রচণ্ড সংঘর্ষ অনুভব করে, পুরো শাটলটি কেঁপে ওঠে, যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে যায়। ইলন শাটলের ভেতর বিপদ সংকেতের তীব্র এলার্ম বাজতে থাকে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে রায়ীনা সিট ভেঙে বের হয়ে নিচে ছিটকে পড়েছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ভাসতে ভাসতে জানালার পাশে দাঁড়াল। সে গ্রহকণাটির ওপর নামতে পেরেছে। সংঘর্ষে ইলন শাটলের কতোটুকু ক্ষতি হয়েছে, সে জানে না। সেটি নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। তার আগে। ইলন শাটলটিকে এই গ্রহকণার সাথে যুক্ত করে নিতে হবে। রায়ীনা কাঁপা হাতে একটা সুইচ স্পর্শ করে। সাথে সাথে যেন এক ধরনের গুঞ্জন শুনতে পায়। ইলন শাটলের নিচ থেকে অতিকায় স্কু বের হয়ে গ্রহকণার মাঝে গেঁথে যেতে শুরু করেছে। এখন শুধু তার নিউক্লিয়ার বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে চালু করে দিতে হবে। রায়ীনা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ভেসে ভেসে ইলন শাটলের পিছনে যায়। সুইচ টিপে পিছনের গোল দরজাটি খুলতেই থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি চোখে পড়ল। একশ কিলোটনের একটি বোমার আকার এতো ছোট হতে পারে, নিজের চোখে দেখেও রায়ীনার বিশ্বাস হয় না। রায়ীনা বোমাটার পিছনে সুইচ প্যানেল খুলে সেখানে বোতামটি স্পর্শ করে। সাথে সাথে একটা নীল আলো ঝলসে ওঠে। ছোট চতুষ্কোণ একটা জায়গায় রায়ীনা তার চোখ রাখল। সেখানে তার রেটিনা স্ক্যান করা হলো এবং সাথে সাথে স্ক্রীনে একটা ছোট কী বোর্ড স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রায়ীনা কাঁপা হাতে ষোলটি সংখ্যা প্রবেশ করানোর সাথে সাথে কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে থাকে। মনিটরে একটা লেখা ভেসে ওঠে, “এই বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। দশ মিনিটের ভেতর এটি বিস্ফোরিত হবে।” রায়ীনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল। সে পৃথিবীটাকে রক্ষা করতে পেরেছে। পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে। তার আদরের ত্রাতিনাকে রক্ষা করতে পেরেছে। রায়ীনা ভেসে ভেসে কন্ট্রোল ঘরে ফিরে আসে। তাকে এখন দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। দশ মিনিট অনেক সময়। এই দশ মিনিট সময় সে কেমন করে কাটাবে? রায়ীনা তার সিটে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর প্রায় হঠাৎ করেই ঠিক করল, সে গ্রহকণাটিতে নামবে। যে কোনো হিসেবে কাজটি অনেক বিপজ্জনক। কিন্তু যখন দশ মিনিটেরও কম সময়ে একশ কিলোটনের একটা থামো নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যাবে, তখন বিপজ্জনক আর নিরাপদ অবস্থার কোনো অর্থ নেই। রায়ীনা ইলন শাটলের দরজা খুলে একটা লাফ দিয়ে নিচে নেমে এলো। গ্রহকণার সাথে ধাক্কা খেয়ে সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল। কোনোভাবে একটা সুচালো পাথরকে ধরে সে নিজেকে থামাল এবং কোনোভাবে নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত সে যখন নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারল, তখন হঠাৎ করে সে অত্যন্ত বিচিত্র একটা জিনিস লক্ষ্য করল। গ্রহকণাটি থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, এর ভেতরে একটা শক্তিশালী ইঞ্জিন কাজ করছে। কী আশ্চর্য! সে যে চিন্তাটি জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, সেই চিন্তাটিই সঠিক। এটি একটি গ্রহকণা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাওয়া বিশাল একটি মহাকাশযান। রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারছিল না, কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল। তারপর নিচু গলায় ডাকল, “কমান্ডার।” প্রায় সাথে সাথে রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেলো।”বল রায়ীনা।” “থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি আর সাত মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ডের মাঝে বিস্ফোরিত হবে।” কমান্ডার লী বলল, “আমরা জানি। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। পৃথিবীর মানুষ হয়তো কখনোই জানতে পারবে না তুমি কেমন করে তাদের রক্ষা করেছ।” “তার প্রয়োজনও নেই কমান্ডার।” রায়ীনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “আমি অন্য একটি কারণে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।” “বল রায়ীনা।” “আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে কথা বলতে চাই। সর্বোচ্চ গোপন চ্যানেলে।” কমান্ডার লী এক মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল। তারপর বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি গোপন চ্যানেল চালু করেছি। তোমার কথা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পারবে না। বল তুমি কী বলতে চাও।” “কমান্ডার লী, আমরা সবাই যেটাকে একটি গ্রহকণা ভেবে আসছি, সেটি আসলে গ্রহকণা নয়।” কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এটা কী?” “এটা একটা মহাকাশযান। আমি এর উপর দাঁড়িয়ে আছি এবং এর ইঞ্জিনের কম্পন অনুভব করছি।” “কী বলছ তুমি?” “আমি কোনো প্রস্তুতি ছাড়া নেমে এসেছি। তাই ভিডিও চ্যানেলটি চালু করতে পারিনি, তাই তোমাকে দেখাতে পারছি না।” “তুমি বল, তোমার কথা শুনেই আমি বুঝে নেবার চেষ্টা করছি।” রায়ীনা অনেকটা ধারাবর্ণনা দেওয়ার মতো করে বলল, “আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই জায়গাটা মোটামুটি সমতল, একটু সামনে অনেকগুলো উঁচু নিচু পাথর। আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। কারণ— “কারণ কী?” “কারণ আমার মনে হচ্ছে ওদিক দিয়ে একটু আলো বের হয়ে আসছে।” “আলো?” “হ্যাঁ। নীলাভ আলো। সম্ভবত ওটা এই মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুম।” কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “কন্ট্রোল রুম?” রায়ীনা একটা বড় পাথর ধরে সামনে এগিয়ে যায়। সাবধানে নিচে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার অনুমান সঠিক। একটা চতুষ্কোণ গর্ত থেকে আলো বের হচ্ছে। এটা সম্ভবত ভেতরে ঢোকার দরজা।” কমান্ডার লী কোনো কথা বলল না। রায়ীনা বলল, “আমি নিচে নামছি।” “নামো। কী দেখো আমাকে জানাও।” “জানাব।” রায়ীনা চতুষ্কোণ ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। একটা সুড়ঙ্গের মতো জায়গা। রায়ীনা হেঁটে যেতেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেল। সে বড় একটা হলঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের কারুকার্য। সেগুলো নড়ছে এবং আকার পরিবর্তন করছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো অংশ আলোকিত হয়ে উঠছে। হঠাৎ রায়ীনার মাথাটা ঘুরে উঠল। শুনতে পেল কমান্ডার লী তাকে ডাকছে, “রায়ীনা। রায়ীনা, তুমি কোথায়?” রায়ীনা কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। বলল, “আমি সম্ভবত কন্ট্রোল রুমে। চারপাশে যেগুলো দেখছি সেগুলো সম্ভবত যন্ত্রপাতি, যদিও দেখতে একেবারে অন্যরকম।” “কোনো এলিয়েন? কোনো প্রাণী?” রায়ীনা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিছনে কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে। রায়ীনা ঘুরে দাঁড়ালো, এবং সাথে সাথে একটা আর্ত শব্দ করল। রায়ীনা হতবাক হয়ে দেখল, ঘরটার মাঝামাঝি ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা! তার মেয়ে ত্রাতিনা। কমান্ডার লী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রায়ীনা? তুমি কী দেখছ?” “হ্যালুসিনেশান। এই মহাকাশযানের প্রাণী আমাকে নিয়ে খেলছে।” “কেন? তুমি কী দেখছ?” “আমার মেয়ে ত্রাতিনা।” কমান্ডার লী চিৎকার করে বলল, “তোমার মেয়ে ত্রাতিনা?” “হ্যাঁ। একটু আগে আমার মাথা ঘুরে উঠেছিল। তখন নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্ক থেকে তথ্য নিয়েছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে ত্রাতিনাকে তৈরি করেছে। অবিকল ত্রাতিনা।” “কী বলছ তুমি?” “হ্যাঁ কমান্ডার লী। আমি ত্রাতিনাকে একটু আদর করি? আমি জানি এটা হ্যলুসিনেশান। আমি জানি এটি সত্যি নয়, কিন্তু তবু আমি একটু আদর করি ত্রাতিনাকে?” কমান্ডার লী কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একশ কিলোটন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গেল। গল্প লিখেছেন : মুহম্মদ জাফর ইকবাল


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৩৩ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now