বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

কার ছবি পার্ট ২

"ফ্যান্টাসি" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Ridiyah Ridhi (০ পয়েন্ট)

X একজন সকাল ন'টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত, আরেকজন চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত যে পিয়নটি কাজ করে তার নাম মোতালেব। আর বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত যে ডিউটি করে তার নাম মালেক মালেক আজ সন্ধ্যার পর পরই চলে গেছে। তার খুব পেট ব্যথা করছিল। মোতালেব এবং মালেকও এই লাইব্রেরিতে কাজ করছে বিশ পঁচিশ বছর ধরে। তোফায়েল স্যারকে তারাও খুব ভালো করে চেনে। মালেক থাকলে হাবিব সাহেবের এখন খুবই সুবিধা হতো। তাকে দেখিয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যেত যে ওই মানুষটা তোফায়েল স্যারই কি না। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? চার বছর আগে মারা যাওয়া লোক রাত পৌনে দশটার দিকে লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ছেন! হাবিব সাহেব মুক্তিযোদ্ধা। খুবই সাহসী মানুষ। ভূত প্রেত ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর কোনও বিশ্বাস নেই, ভয়ও নেই। ছেলেবেলা থেকেই রাত বিরাতে চলাফেরা করা মানুষ। একটু ডানপিটে ধরনেরই ছিলেন। যুবক বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করলেন সেই ন'টা মাস তো বনে বাদাড়ে, পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে কোথায় কোথায় না থেকেছেন, কোথায় কোথায় না চলাফেরা করেছেন। ডর ভয় কাকে বলে জানতেনই না। তখন অবশ্য রক্ত টগবগ করে ফুটেছিল স্বাধীনতার জন্য। পাকিস্তানি বদমাসগুলোকে ধ্বংস করার জন্য। ভূত প্রেতের কথা ভাববার সময় কোথায়! তাছাড়া ষাট বছরের এই দীর্ঘজীবনে কোনও ভৌতিক অভিজ্ঞতাও নেই তাঁর। লাইব্রেরি থেকে রাত দশটার পর একা একা হেঁটে বাড়ি ফেরেন। এখান থেকে ভাগ্নির বাড়ি বেশ দূর। দেড় কিলোমিটারের মতো। পথে নির্জন জংলা মতো কিছুটা জায়গা আছে। মাঠের ধারে আছে বহুকালের পুরনো একটা বটগাছ। অনেকে বলে ওই বটগাছে তেনাদের আস্তানা। পাশের বিশাল মাঠে ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাতে কেউ কেউ নাকি তেনাদেরকে চলাফেরা করতেও দেখেছে, ফুটবলও খেলতে দেখছে। হাবিব সাহেব বহুরাত ফেরার সময় ভেবেছেন, আহা যদি সত্যি সত্যি কোনও রাতে তেনাদের কাউকে তিনি দেখতে পেতেন তাহলে ভালো রকমের একটা অভিজ্ঞতা হতো। হলো না। কোনও রাতেই সেরকম কোনও অভিজ্ঞতা হলো না। সকালবেলা নাশতা করে বাড়ি থেকে বেরোন। হাতে থাকে ছোট্ট একটাটিফিন কেরিয়ার। চম্পা দুপুরের ভাতটা টিফিন কেরিয়ারে দিয়ে দেয়। রাতের খাবার খান বাড়ি ফিরে। সুতরাং ফেরার সময় তাঁর সঙ্গী শূন্য একখানা টিফিন কেরিয়ার। ওই জিনিস হাতে নিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুটা পথ পেরিয়ে বটতলা আর বিশাল মাঠের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা। চারদিকে শুধুই নির্জনতা। তারপরও কই কোনওদিন তো কিছু দেখলেন না? আজকের ব্যাপারটা কী? তোফায়েল স্যার...। মানে চার বছর আগে মারা যাওয়া মানুষটাকে ওই তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব সময় যে টেবিলে বসে পড়তেন সেই টেবিলটাতে বসেই, ঠিক সব সময়কার ভঙ্গিতেই পড়ছেন। হাবিব সাহেব এখন কী করেন? তিনি খুবই সময় মেনে চলা মানুষ। কাটায় কাটায় সকাল দশটায় লাইব্রেরিতে এসে ঢোকেন। মোতালেব আসে ন'টায়। এসে লাইব্রেরি খুলে ঝাড়ু দেয়, টেবিল চেয়ারগুলো মোছে। বুক সেলফগুলো মোছে। হাবিব সাহেব দশটায় এসে ঢোকার আগেই হাতের কাজ শেষ করে ফেলে সে। রাতেরবেলাও কাটায় কাটায় দশটায় লাইব্রেরি বন্ধ করে মালেক। হাবিব সাহেবের সঙ্গে পিয়নরাও সময় মেনে চলতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। এখন দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। পাঁচ মিনিট পর আজ লাইব্রেরি বন্ধ করতে হবে হাবিব সাহেবকেই। অর্থাৎ মালেকের কাজটা করতে হবে তাঁকে। এই ফাঁকে তিনি কি একটু ওই টেবিলটার সামনে যাবেন। গিয়ে কি দেখবেন ব্যাপারটা কী? মানুষটা যে তোফায়েল স্যার তাতে কোনও সন্দেহ নেই ৷ একটু কথা বলে বোঝার চেষ্টা করবেন নাকি ব্যাপারটা কী? চার বছর আগে মরে গিয়ে কেমন করে ফিরে এলেন তিনি! হাবিব সাহেবের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা কাজ হলো। ওই যে কয়েকটা মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলেন তিনি, সেই ফাঁকে চোখ সরে গিয়েছিল তোফায়েল স্যারের টেবিল থেকে, ওইটুকু সময়ের মধ্যে দেখা গেল তোফায়েল স্যার তাঁর টেবিলের ওদিককার দরজা দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। হাবিব সাহেব কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তারপর ছুটে গেলেন ওদিকটায়। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে এলেন। এসে দেখেন কোথাওকেউ নেই! মুহূর্তে কোথায়, কোনদিকে চলে গেছেন তোফায়েল স্যার। লাইব্রেরিটা বিঘাখানেক জমির ওপর। চারদিকে খোলা জমি, মাঝখানে একতলা লম্বা মতন দালান। দুদিক দিয়ে ঢোকার দুটো গেট। গেট পেরুলেই রাস্তা। রাস্তাটা নির্জন, খা খা করছে। কিন্তু এইমাত্র যে মানুষটা বেরুলেন তিনি কোথাও নেই। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেছেন! হাবিব সাহেব ভালো রকম একটা ধন্দের মধ্যে পড়লেন। ব্যাপারটা কী? তোফায়েল স্যারকে পরিষ্কার বই পড়তে দেখলেন। যে মুহূর্তে ভাবলেন তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন সেই মুহূর্তেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলেন! মিনিট খানেক ওদিকটায় দাঁড়িয়ে রইলেন হাবিব সাহেব। তারপর পিছন দিককার দরজা বন্ধ করে তোফায়েল স্যার যে টেবিলে বসে পড়ছিলেন সেই টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে আবার একটা ধাক্কা খেলেন। এই তো বইটা খোলা পড়ে আছে। তোফায়েল স্যারের প্রিয় বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ প্রায় প্রতিদিনই একবার না একবার হাতে নিতেন তিনি। আজও ‘সঞ্চয়িতা' টাই পড়ে আছে টেবিলে। তিনি পড়ছিলেন ‘দিনের শেষে' কবিতাটি। আর বেশি কিছু ভাবতে পারলেন না হাবিব সাহেব । দশটা বেজে কয়েক মিনিট হয়ে গেছে। টিফিন কেরিয়ার হাতে নিয়ে লাইব্রেরি বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন। দুজন পিয়ন আর তাঁর কাছে একসেট করে চাবি আছে। এই তিনজনের যে কেউ যে কোনও সময় এসে লাইব্রেরি খুলতে পারে, বন্ধ করতে পারে। চাবির গোছা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন হাবিব সাহেব। তাঁর চোখে তখন ওই একই দৃশ্য । তোফায়েল স্যার বই পড়তে পড়তে হঠাৎ বই রেখে বেরিয়ে গেলেন। চারবছর আগে মরে যাওয়া মানুষকে বই পড়তে দেখলেন তিনি, বেরিয়ে যেতে দেখলেন। নিজে ছুটেও গেলেন পিছু পিছু। তারপর মানুষটা আর কোথাও নেই! এমন কি হয়? হতে পারে? বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে তোফায়েল স্যারের কথা ভাবতে লাগলেন হাবিব সাহেব। ছোট্ট এই মফশ্বল শহরের সবাই তাঁকে স্যার ডাকতো। খুবই সম্মানীয় লোক, খুবই নামকরা লোক। সরকারি কলেজের প্রিন্সিপালছিলেন। রিটায়ারম্যান্টের পরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন। যখন কলেজের প্রিন্সিপাল তখনও যেমন, রিটায়ারম্যান্টের পরও ঠিক একই সময়ে লাইব্রেরিতে আসতেন। কলেজের ভিতরই ছিল তাঁর কোয়ার্টার। লাইব্রেরি থেকে কুড়ি পঁচিশ মিনিটের পথ। হাবিব সাহেবের মতো এতটা পথ তিনি হেঁটে আসতেন। লম্বা চওড়া, দশাসই মানুষ। বড় বড় পা ফেলে হাঁটতেন। হাঁটার জন্য নরম এক ধরনের পামসু পরতেন। সন্ধ্যা ছটা সাড়ে ছটার দিকে। লাইব্রেরিতে এসে ঢুকতেন, আটটা সাড়ে আটটার দিকে চলে যেতেন। ওই টেবিলটাতেই বসতেন। বসে নানা রকমের বই পড়তেন। দর্শন মনোবিজ্ঞান সাহিত্য ইতিহাস। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা'টা একবার ধরতেনই। একটা কবিতা অন্তত পড়তেন প্রতিদিন। তোফায়েল স্যারের মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। স্যারের বয়স তখন মন্দ হয়নি। চুয়াত্তোর। চুয়াত্তোর বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি। যদিও তাঁর মতো স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আরও কিছু বছর বেঁচে থাকতে পারতেন। স্যারের জানাজায় শরিক হয়েছিল শহরের বহুমানুষ। আত্মীয় স্বজন ছাত্র ছাত্রীরা তো ছিলই, স্যারের বন্ধুবান্ধব এবং সাধারণ মানুষ মিলে দেড় দুহাজার মানুষ। শহরের বড় কবরস্থানটায় বাঁধানো কবর তোফায়েল স্যারের আর সেই মানুষকে কিনা চারবছর পর এই কিছুক্ষণ আগে লাইব্রেরির টেবিলে বসে পড়তে দেখলেন হাবিব সাহেব। সব মিলিয়ে মিনিট দশেক হয়তো পড়েছেন স্যার। 'সঞ্চয়িতা'টাও পাওয়া গেল টেবিলে। মৃত্যুচিন্তা নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের শেষে' কবিতাটি পড়ছিলেন তিনি। এ কী করে সম্ভব? পুরোটা পথ তোফায়েল স্যারের কথা ভাবতে ভাবতে এলেন হাবিব সাহেব । বাড়ি ফিরে চম্পাকে দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই বলেন তিনি। চম্পার স্বভাব হচ্ছে মামাকে খেতে দিয়ে নিজে সামনে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করা। আজও করছিল। হাবিব সাহেব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টুকটাক কথা বললেন। মালেকের পেটব্যথা ছিল, সে আগেভাগে ছুটি নিয়ে চলে গেছে বলে তাঁকেই আজ লাইব্রেরি বন্ধ করতে হয়েছে, এসবও বললেন। শুধু ওই অতবড় ঘটনাটাই চেপে গেলেন। কেন, কে জানে?রাতেরবেলা ভালো ঘুম হলো না হাবিব সাহেবের। এক দুঘণ্টা পর পরই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল আর ঘুম ভাঙার পর পরই মনে পড়ছিল তোফায়েল স্যারের কথা। চোখের ওপর পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন লাইব্রেরিতে বসে খুবই মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন তিনি। সকালবেলা টিফিন কেরিয়ার হাতে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় হাবিব সাহেব ভাবলেন আজও যদি তোফায়েল স্যারকে দেখতে পান তাহলে ভালোই হবে। মালেক থাকবে সঙ্গে। দুজনে মিলে দেখলে অবিশ্বাসের আর কোনও কারণ থাকবে না। একজন মানুষের চোখ ভুল করতে পারে, দুজনের চোখ তো আর একসঙ্গে ভুল করবে না। লাইব্রেরিতে পৌছে হাবিব সাহেব দেখেন প্রতিদিনকার মতো মোতালেব লাইব্রেরি খুলে তার কাজ সবই সেরে রেখেছে। জানালা দরজা খুলে দেয়ার ফলে আলো হাওয়ার বেশ একটা মনোরম পরিবেশ লাইব্রেরিতে । লাইব্রেরির যে জিনিসটা সবচাইতে ভালো লাগে হাবিব সাহেবের তাহলো পুরনো বইয়ের গন্ধ এই গন্ধে শরীর কেমন চনমন করে ওঠে তাঁর। আজও সেই অনুভূতি হলো। লাইব্রেরিতে ঢোকার পর প্রতিদিনই মোতালেব তাঁকে এককাপ চা দেয় । আজও দিয়েছে। সেই চায়ে চুমুক দিয়ে হাবিব সাহেব ভাবলেন, তোফায়েল স্যারের ব্যাপারটা নিয়ে মোতালেবের সঙ্গে একটু কথা বলবেন নাকি! তারপর কী মনে করে আর বললেন না। না থাক। মোতালেব একটু বাচাল টাইপের লোক। কথা বেশি বলে। একবার ওরকম একটা বিষয় পেলে ওই নিয়ে কথা বলতে বলতে হাবিব সাহেবের কানের পোকা খসিয়ে ফেলবে। লাইব্রেরিতে একজন দুজন করে পাঠক ঢুকছে। এই পাঠকরা খবরের কাগজের পাঠক। সকালবেলার কাগজ কিনে পড়বার সামর্থ্য নেই এমন কিছু মানুষ আছে । মোতালেব হয়তো তাদের কারও কারও সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে। আরে জানেন নাকি, হাবিব স্যারে তো কাইল রাইতে তোফায়েল স্যাররে ওই টেবিলে বইসা বই পড়তে দেখছে। চাইর বচ্ছর আগে মইরা যাওয়া মানুষ ফিরত আইছে বইয়ের টানে। বোঝেন কারবার! তারপর সবাই মিলে হাসাহাসি করবে। না দরকার নেই মোতালেবকে কিছু বলার। বলতে হলে মালেককে বলবেন। মালেক ধীর স্থির গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩০৩ জন


এ জাতীয় গল্প

→ কার ছবি ( পার্ট ১ )

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now