বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
সক্কালবেলাতেই নীলুর বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে গেল। মাসের একুশ তারিখ ধারে কাছে কোনো পেমেন্ট নেই। বাবা তিনদিনের জন্য মেয়ের বাড়িতে গেছে বারুইপুর–মহা টিকরমবাজ লোক–সাউথ শিয়ালদায় গাড়িতে তুলে দিয়ে নীলু যখন প্রণাম করল তখন হাসি-হাসি মুখে বুড়ো নতুন সিগারেটের প্যাকেটের সিলোফেন ছিড়ছে। তিনদিন মায়ের আওতার বাইরে থাকবে বলে বুঝি ওই প্রসন্নতা–ভেবেছিল নীলু। গাড়ি ছাড়বার পর হঠাৎ খেয়াল হল, তিনদিনের বাজার খরচ রেখে গেছে তো! সেই সন্দেহ কাল সারা বিকেল খচখচ করেছে। আজ সকালেই মশারির মধ্যে আধখানা ঢুকে তাকে ঠেলে তুলল মা–বাজার যাবি না, ও নীলু?
তখনই বোঝা গেল বুড়ো চাক্কি রেখে যায়নি। কাল নাকি টাকা তুলতে রানাকে পাঠিয়েছিল কিন্তু দস্তখত মেলেনি বলে উইথড্রয়াল ফর্ম ফেরত দিয়েছে পোস্টাপিস। কিন্তু নীলু জানে পুরোটা টিকরমবাজি। বুড়ো আগে ছিল রেলের গার্ড, রিটায়ার করার পর একটা মুদির দোকান দিয়েছিল–অনভিজ্ঞ লোক, তার ওপর দোকান ভেঙে খেতো–ফলে দোকান গেল উঠো এখন তিন রোজগেরে ছেলের টাকা নিয়ে পোেস্ট-অফিসে রাখে আর প্রতি সপ্তাহে খরচ তোলে। প্রতিদিন বাজারের থলি দশমেসে পেটের মতো ফুলে না থাকলে বুড়োর মন ভজে না। মাসের শেষ দিকে টাকা ফুরোলেই টিকরমবাজি শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে যে লোক টাকা তুলছে তার নাকি দস্তখত মেলে না!
নীলু হাসে। সে কখনো বুড়োর ওপর রাগ করে না বাবা তার দিকে আড়ে আড়ে চায় মাসের শেষ দিকটা। ঝাঁক দেওয়ার নানা চেষ্টা করে। নীলুর সঙ্গে বাবার একটা লুকোচুরির খেলা চলতে থাকো।
বাঙালের খাওয়া তার ওপর পুঁটিয়ারির নাড়মামা, মামী, ছেলে, ছেলের বৌ–চারটে বাইরের লোক নিমন্ত্রিত, ঘরের লোক বারোজন–নীলু নিজে, মা, ছটা ভাই, দুটো ধুমসী বোন, বিধবা মাখনী পিসি, বাবার জ্যাঠতুতো ভাই, আইবুড়ো নিবারণ কাকা–বিশ চাকির নীচে বাজার নামে?
রবিবার বাজার নামিয়ে রেখে নীলু একটু পাড়ায় বেরোয়। কদিন ধরেই পোগো ঘুরছে পিছন পিছন। তার কোমরে নানা আকৃতির সাতটা ছুরি। ছুরিগুলো তার মায়ের পুরোনো শাড়ির পাড় ছিঁড়ে তাই দিয়ে জড়িয়ে সযত্নে শার্টের তলায় গুঁজে রাখে পোগো পাড়ার লোক বলে, পোগো দিনে সাতটা মার্ডার করে। নিতান্ত এলেবেলে লোকও পোগোকে যেতে দেখলে হেঁকে ডাক পাড়ে–কী পোগোবাবু, আজ কটা মার্ডার হল? পোগো হুম হাম করে চলে যায়।
পরশু দিন পোগোর মেজোবৌদি জানালা দিয়ে নীলুকে ডেকে বলেছিল–পোগো যে তোমাকে মার্ডার করতে চায়, নীলু, খবর রাখো?
তাই বটে। নীলুর মনে পড়ল, কয়েকদিন যাবৎ সে অফিসে যাওয়ার সময়ে লক্ষ্য করেছে পোগো নিঃশব্দে আসছে পিছনে পিছনে বাস-স্টপ পর্যন্ত আসে। নীলু কখনো ফিরে তাকালে পোগো উধ্বমুখে আকাশ দেখে আর বিড়বিড় করে গাল দেয়।
আজ বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে যাওয়ায় নীলুর মেজাজ ভাল ছিল না। নবীনের মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতে বসে সিগারেট ফুঁকছিল পোগো। নীলুকে দেখেই আকাশে তাকাল না-দেখার ভান করে কিছুদূর গিয়েই নীলু টের পেল পোগো পিছু নিয়েছে।
নীলু ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে পোগো উল্টোবাগে ঘুরে হাঁটতে লাগল এগিয়ে গিয়ে তার পাছায় ডান পায়ের একটা লাথি কষাল নীলু–শালা, বদের হাঁড়ি।
কাঁই শব্দ করে ঘুরে দাঁড়ায় পোগো। জিভ আর প্যালেটের কোনো দোষ আছে পোগোর, এখনও জিভের আড় ভাঙেনি। ছত্রিশ বছরের শরীর তিন বছর বয়সী মগজ নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। গরম খেয়ে বলল-খুব ঠাবহান, নীলু, বলে ডিট্টি খুব ঠাবহান
–ফের! কষাব আর একটা?
পোগো থিতিয়ে যায়। শার্টের ভিতরে লুকোনো হাত ছুরি বের করবার প্রাক্কালের ভঙ্গিতে রেখে বলে–একডিন ফুটে ডাবি ঠালা
নীলু আর একবার ডান পা তুলতেই পোগো পিছিয়ে যায়। বিড়বিড় করতে করতে কারখানার পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে।
সেই কবে থেকে মার্ডারের স্বপ্ন দেখে পোগো সাত-আটখানা ছুরি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতে যায়। পাছে নিজের ছুরি ফুটে ও নিজে মরে–সেই ভয়ে ও ঘুমোলে ওর মা এসে হাতড়ে হাতড়ে ছুরিগুলো সরিয়ে নেয়। মার্ডারের বড় শখ পোগোরা সারাদিন সে লোককে কত মার্ডারের গল্প করে! কলকাতায় হাঙ্গামা লাগলে ছাদে উঠে দুহাত তুলে লাফায়। মার্ডারের গল্প যখন শোনে। তখন নিথর হয়ে যায়।
নীলু গতবার গ্রীষ্মে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে একটা ভোজালি কিনেছিল। তাই সেই শখের ভোজালিটা দিনসাতেক আগে একদিনের জন্য ধার নিয়েছিল পোগো। ফেরত দেওয়ার সময়ে চাপা গলায় বলেছিল–ভয় নেই, ভাল করে ঢুয়ে ডিয়েছি।
–কী ধুয়েছিস? জিজ্ঞেস করেছিল নীলু।
অর্থপূর্ণ হেসেছিল পোগো, উত্তর দেয়নি। তোমরা বুঝে নাও কী ধুয়েছি। সেদিনও একটা লাথি কষিয়েছিল নীলু–শালার শয়তানী বুদ্ধি দেখা ধুয়ে দিয়েছি–কী ধুয়েছিস আব্বে পোগোর বাচ্চা?
সেই থেকেই বোধহয় নীলুকে মার্ডার করার জন্য ঘুরছে পোগো। তার লিস্টে নীলু ছাড়া আরও অনেকের নাম আছে যাদের সে মার্ডার করতে চায়।
আজ সকালে বৃটিশকে খুঁজছে নীলু কাল বৃটিশ জিতেছে। দুশো সত্তর কি আশি টাকা। সেই নিয়ে খিচাং হয়ে গেল কাল!
গলির মুখ আটকে খুদে প্যান্ডেল বেঁধে বাচ্চচাদের ক্লাবের রজত জয়ন্তী হচ্ছিল কাল সন্ধেবেলায়। পাড়ার মেয়ে-বৌ, বাচ্চারা ভিড় করেছিল খুব সেই ফাংশন যখন জমজমাট, তখন বড় রাস্তায় ট্যাক্সি থামিয়ে বৃটিশ নামল টলতে টলতে ঢুকল গলিতে, দু বগলে বাংলার বোতল সঙ্গে ছটকু। পাড়ায় পা দিয়ে ফাংশনের ভিড় দেখে নিজেকে জাহির করার জন্য দুহাত ওপরে তুলে হাঁকাড় ছেড়েছিল বৃটিশ–ঈ-ঈ-ঈদ কা চাঁ-আ-আ-দ! বগল থেকে দুটো বোতল পড়ে গিয়ে ফট-ফটাস করে ভাঙলা হুড়দৌড় লেগে গিয়েছিল বাচ্চচাদের ফাংশনে পাঁচ বছরের টুমিরানি তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কাঠবেড়ালী, কাঠবেড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও…’ বলে দুলতে দুলতে থেমে ভ্যাঁ করার জন্য হাঁ করেছিল মাত্র। সেই সময়ে নীলু, জগু, জাপান এসে দুটোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হরতুনের চায়ের দোকানো নীলু বৃটিশের মাথায় জল ঢালে আর জাপান। পিছন থেকে হাঁটুর গুঁতো দিয়ে জিজ্ঞেস করে–কত জিতেছিস? প্রথমে বৃটিশ চেঁচিয়ে বলেছিল–আব্বে, পঞ্চা-আ-শ হা-জা-আর। জাপান আরও দুবার হাঁটু চালাতেই সেটা নেমে দাঁড়াল দু হাজারো সেটাও বিশ্বাস হল না কারও। পাড়ার বুকি বিশুর কাছ থেকে সবাই জেনেছে, ঈদ কা চাঁদ হট ফেবারিট ছিল। আরও কয়েকবার ঝাঁকাড় খেয়ে সত্যি কথা বলল বৃটিশ–তিনশো, মাইরি বলছি বিশ্বাস করা পকেট সার্চ করে শদুয়ের মতো পাওয়া গিয়েছিল।
আজ সকালে তাই বৃটিশকে খুঁজছে নীলু। মাসের একুশ তারিখ বৃটিশের কাছে ত্রিশ টাকা পাওনা। গত শীতে দর্জির দোকান থেকে বৃটিশের টেরিকটনের প্যান্টটা ছাড়িয়ে দিয়েছিল নীলু এতদিন চায়নি। গতকাল নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু মাতালের কাছ থেকে নেওয়া উচিত নয় বলে নেয়নি। আজ দেখা হলে চেয়ে নেবে।
চায়ের দোকানে বৃটিশকে পাওয়া গেল না। ভি. আই. পি. রোডের মাঝখানে যে সবুজ ঘাসের চত্বরে বসে তারা আড্ডা মারে, সেখানেও না। ফুলবাগানের মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেখল নীলু। কোথাও নেই। কাল রাতে নীলু বেশিক্ষণ ছিল না হরতুনের দোকানো জাপান, জগু ওরা বৃটিশকে ঘিরে বসেছিল। বহুকাল তারা এমন মানুষ দেখেনি যার পকেটে ফালতু দুশো টাকা। জাপান মুখ চোখাচ্ছিল। কে জানে রাতে আবার ওরা ট্যাক্সি ধরে ধর্মতলার দিকে গিয়েছিল কিনা! গিয়ে থাকলে ওরা এখনও বিছানা নিয়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে উঠবে বৃটিশের বাড়িতে আজকাল আর যায় না নীলু বৃটিশের মা আর দাদার সন্দেহ ওকে নষ্ট করেছে নীলুই। নইলে নীলু গিয়ে বৃটিশকে টেনে তুলত বিছানা থেকে, বলত,–না-হকের পয়সা পেয়েছিস, হিস্যা চাই না, আমার হকেরটা দিয়ে দেয়।
নাঃ আবার ভেবে দেখল নীলু। দুশো টাকা–মাত্র দুশো টাকার আয়ু এ বাজারে কতক্ষণ? কাল যদি ওরা সেকেন্ড টাইম গিয়ে থাকে ধর্মতলায় তবে বৃটিশের পকেটে এখন হপ্তার খরচও নেই।
মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় নীলু ভাবে, বিশ চাক্কি যদি ঝাঁক হয়েই গেল তবে কীভাবে বাড়ির লোকজনের ওপর একটা মৃদু প্রতিশোধ নেওয়া যায়!
অমনি শোভন আর তার বৌ বল্লরীর কথা মনে পড়ে গেল তারা শোভন কাজ করে কাস্টমসে। তিনবারে তিনটি বিলিতি টেরিলিনের শার্ট তাকে দিয়েছে শোভন, আর দিয়েছে সস্তার একটা ঘড়ি। তার ভদ্রলোক বন্ধুদের মধ্যে শোভন একজন–যাকে বাড়িতে ডাকা যায়। কতবার ভেবেছে নীলু শোভন, বল্লরী আর ওদের দুটো কচি মেয়েকে এক দুপুরের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসবে, খাইয়ে দেবে ভাল করে খেয়ালই থাকে না এসব কথা।
মাত্র তিন স্টপ দূরে থাকে শোভনা মাত্র সকাল ন’টা বাজে। আজ ছুটির দিন, বল্লরী নিশ্চয়ই রান্না চাপিয়ে ফেলেনি! উনুনে আঁচ দিয়ে চা-ফা, লুচি-ফুচি হচ্ছে এখনো। দুপুরে খাওয়ার কথা। বলার পক্ষে খুব বেশি দেরি বোধহয় হয়নি এখনো।
ছত্রিশ নম্বর বাসটা থামতেই উঠে পড়ল নীলু।
উঠেই বুঝতে পারে, বাসটা দখল করে আছে দশ বারোজন ছেলে-ছোকরা। পরনে শার্ট পায়জামা, কিংবা সরু প্যান্ট। বয়স ষোলোর এদিক ওদিক তাদের হাসির শব্দ থুথু ফেলার আগের গলাখাঁকারির–খ্যা-অ্যা-অ্যা-র মতো শোনাচ্ছিল। লেডিজ সিটে দু-তিনজন মেয়েছেলে। বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। দু-চারজন ভদ্রলোক ঘাড় সটান করে পাথরের মতো সামনের শূন্যতার দিকে চেয়ে আছে। ছোকরারা নিজেদের মধ্যেই চেঁচিয়ে কথা বলছে। উল্টো-পাল্টা কথা, গানের কলি। কন্ডাক্টর দুজন দুদরজায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাড়া চাইবার সাহস নেই!
তবু ছোকরাদের একজন দলের পরমেশ নামে আর একজনকে ডেকে বলছে–পরমেশ, আমাদের ভাড়াটা দিলি না?
–কত করে?
–আমাদের হাফ-টিকিটা পাঁচ পয়সা করে দিয়ে দে।
–এই যে কন্ডাক্টরদাদা, পাঁচ পয়সার টিকিট আছে তো! বারোখানা দিন।
পিছনের কন্ডাক্টর রোগা, লম্বা, ফর্সা না-কামানো কয়েক দিনের দাড়ি থুতনিতে জমে আছে। এবড়োখেবড়ো গজিয়েছে গোঁফ। তাতে তাকে বিষণ্ণ দেখায়। সে তবু একটু হাসল ছোকরাদের কথায়। অসহায় হাসিটি।
নীলু বসার জায়গা পায়নি। কন্ডাক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে সে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।
বাইরে কোথাও পরিবার পরিকল্পনার হোর্ডিং দেখে জানালার পাশে বসা একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলল–লাল ত্রিভুজটা কী বল তো মাইরি!
–ট্রাফিক সিগন্যাল বে, লাল দেখলে থেমে যাবি।
–আর নিরোধ! নিরোধটা কী যেন।
–রাজার টুপি…রাজার টুপি…
–খ্যা-অ্যা-অ্যা-খ্যা-অ্যা-অ্যা…
–খ্যা…
পরের স্টপে বাস আসতে তারা হেঁকে বলল–বেঁধে…লেডিজ…
নেমে গেল সবাই। বাসটাকে ফাঁকা নিস্তব্ধ মনে হল এবার। সবাই শরীর শ্লথ করে দিল। একজন চশমা-চোখে যুবা কন্ডাক্টরের দিকে চেয়ে বলল–লাথি দিয়ে নামিয়ে দিতে পারেন না এসব এলিমেন্টকে!
কন্ডাক্টর ম্লান মুখে হাসে
ঝুঁকে নীলু দেখছিল ছেলেগুলো রাস্তা থেকে বাসের উদ্দেশে টিটকিরি ছুঁড়ে দিচ্ছে। কান কেমন গরম হয়ে যায় তারা লাফিয়ে নেমে পড়তে ইচ্ছে করে। লাঠি ছোরা বোমা যা হোক অস্ত্র নিয়ে কয়েকটা খুন করে আসতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ পোগোর মুখখানা মনে পড়ে নীলুর। জামার আড়ালে ছোরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পোগো। স্বপ্ন দেখছে মার্ডারের তারা সবাই পোগোর পিছনে লাগে, মাঝে মধ্যে লাথি কষায়। তবু কেন যে পোগোর মতোই এক তীব্র মার্ডারের ইচ্ছে জেগে ওঠে নীলুর মধ্যেও মাঝে মাঝে এত তীব্র সেই ইচ্ছে যে আবেগ কমে গেলে শরীরে একটা অবসাদ আসে। তেতো হয়ে যায় মন।
শোভন বাথরুমে বল্লরী এসে দরজা খুলে চোখ কপালে তুলল–ওমা, আপনার কথাই ভাবছিলাম সকালবেলা অনেকদিন বাঁচবেন।।
শোভনের বৈঠকখানাটি খুব ছিমছাম, সাজানো। বেতের সোফা, কাচের বুককেস, গ্র&ন্ডিগের রেডিওগ্রাম, কাঠের টবে মানিপ্ল্যান্ট, দেয়ালে বিদেশি বারো-ছবিওলা ক্যালেন্ডার, মেঝেয় কয়ের কার্পেটা মাঝখানে নিচু টেবিলের ওপর মাখনের মতো রঙের ঝকঝকে অ্যাশ-ট্রে-টার সৌন্দর্যও দেখবার মতন। মেঝেয় ইংরিজি ছড়ার বই খুলে বসে ছিল শোভনের চার আর তিন বছর বয়সের মেয়ে মিলি আর জুলি। একটু ইংরিজি কায়দায় থাকতেই ভালবাসে শোভন। মিলিকে কিন্ডারগার্টেনের বাস এসে নিয়ে যায় রোজ। সে ইংরিজি ছড়া মুখস্থ বলে।
নীলুকে দেখেই মিলি জুলি টপাটপ উঠে দৌড়ে এল।
মিলি বলে–তুমি বলেছিলে ভাত খেলে হাত এঁটো হয়। এঁটো কী?
দুজনকে দু’কোলে তুলে নিয়ে ভারী একরকমের সুখবোধ করে নীলু ওদের গায়ে শৈশবের আশ্চর্য সুগন্ধা
মিলি জুলি তার চুল, জামার কলার লণ্ডভণ্ড করতে থাকে। তাদের শরীরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে নীলু বল্লরীকে বলে–তোমার হাঁড়ি চড়ে গেছে নাকি উনুনে।
–এইবার চড়বো বাজার এল এইমাত্র।
–হাঁড়ি ক্যানসেল করো আজ। বাপ গেছে বারুইপুরে। সকালেই বিশ চাক্কি ঝাঁক হয়ে গেল। সেটা পুষিয়ে নিতে হবে তো! তোমার এ দুটো পুঁটলি নিয়ে দুপুরের আগেই চলে যেও আমার গাজায়, খুমে লিও সবাই।
বল্লরী কেঁঝে ওঠে–কী যে সব অসভ্য কথা শিখেছেন বাজে লোকদের কাছ থেকে! নেমন্তন্নের ওই ভাষা!
বাথরুম থেকে শোভন চেঁচিয়ে বলে–চলে যাস না নীলু, কথা আছে।
–যেও কিন্তু। নীলু বল্লরীকে বলে–নইলে আমার প্রেস্টিজ থাকবে না।
–বাঃ, আমার যে ডালের জল চড়ানো হয়ে গেছে। এত বেলায় কি নেমন্তন্ন করে মানুষ!
নীলু সেসব কথায় কান দেয় না। মিলি জুলির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
শোভন সকালেই দাড়ি কামিয়েছে। নীল গাল। মেদবহুল শরীরে এঁটে বসেছে ফিনফিনে গেঞ্জি, পরনে পাটভাঙা পায়জামা। গত বছর যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে এল শোভনা বাসা খুঁজে দিয়েছিল নীলুই। চারদিনের নোটিশো এখন সুখে আছে শোভন। যৌথ পরিবারে থাকার সময়ে এত নিশ্চিন্ত আর তৃপ্ত আর সুখী দেখাত না তাকে।
পাছে হিংসা হয় সেই ভয়ে চোখ সরিয়ে নেয় নীলু।
নেমন্তন্নের ব্যাপার শুনে শোভন হাসে–আমিও যাব-যাব করছিলাম তোর কাছে। এর মধ্যেই চলে যেতাম ভালই হল।
এক কাপ চা আর প্লেটে বিস্কুট সাজিয়ে ঘরে আসে বল্লরী।
শোভন হতাশ গলায় বলে–বা মোটে এক কাপ করলে! ছুটির দিনে এ সময়ে আমারও তো এক কাপ পাওনা।
বল্লরী গম্ভীরভাবে বলে–বাথরুমে যাওয়ার আগেই তো এক কাপ খেয়েছ।
মিষ্টি ঝগড়া করে দুজন মিলি জুলির গায়ের অদ্ভুত সুগন্ধে ডুবে থেকে শোভন আর বল্লরীর আদর-করা গলার স্বর শোনে নীলু। সম্মোহিত হয়ে যেতে থাকে।
তারপরই হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে–চলি রে? তোরা ঠিক সময়ে চলে যাস।
–শুনুন শুনুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। বল্লরী তাকে থামায়।
–কী কথা?
–বলছিলুম না আজ সকালেই ভেবেছি আপনার কথা তার মানে নালিশ আছে একটা কারা বলুন তো আমাদের বাড়ির দেওয়ালে রাজনীতির কথা লিখে যায়? তারা কারা? আপনাদের তো এলাকা এটা, আপনার জানার কথা।
–কী লিখেছে?
–সে অনেক কথা ঢোকার সময়ে দেখেননি? বর্ষার পরেই নিজেদের খরচে বাইরেটা রং করালুম দেখুন গিয়ে, কালো রং দিয়ে ছবি এঁকে লিখে কী করে গেছে শ্রী! তা ছাড়া রাতভর লেখে, গোলমালে আমরা কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি।
নীলু উদাসভাবে বলে–বারণ করে দিলেই পারো।
–কে বারণ করবে? আপনার বন্ধু ঘুমোতে না পেরে উঠে সিগারেট ধরাল আর ইংরিজিতে আপনমনে গালাগাল দিতে লাগল–ভ্যাগাবন্ডস, মিসফিটস, প্যারাসাইটস… আরও কত কী! সাহস নেই যে উঠে ছেলেগুলোকে ধমকাবো
–তা তুমি ধমকালে না কেন? নীলু বলে উদাস ভাবটা বজায় রেখেই।
বল্লরী হাসল উজ্জ্বলভাবে। বলল–ধমকাইনি নাকি! শেষমেষ আমিই তো উঠলাম। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললাম–ভাই, আমরা কি রাতে একটু ঘুমোব না? আপনার বন্ধু তো আমার কাণ্ড দেখে অস্থির। পিছন থেকে আঁচল টেনে ফিসফিস করে বলছে–চলে এসো, ওরা ভীষণ ইতর, যা তা বলে দেবে। কিন্তু ছেলেগুলো খারাপ না। বেশ ভদ্রলোকের মতো চেহারা। ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছে, হাতে কিছু চটি চটি বই, প্যামফলেটা আমার দিকে হাতজোড় করে বলল–বৌদি, আমাদেরও তো ঘুম নেই। এখন তো ঘুমের সময় না এদেশো বললুম–আমার দেয়ালটা অমন নোংরা হয়ে গেল যে! একটা ছেলে বলল–কে বলল নোংরা! বরং আপনার দেয়ালটা অনেক ইস্পট্যান্ট হল আগের চেয়ে। লোক এখান দাঁড়াবে, দেখবে, জ্ঞানলাভ করবো আমি। বুঝলুম খামোখা কথা বলে লাভ নেই। জানালা বন্ধ করতে যাচ্ছি অমনি একটা মিষ্টি চেহারার ছেলে এগিয়ে এসে বলল–বৌদি, আমাদের একটু চা খাওয়াবেন? আমরা ছ’জন আছি!
নীলু চমকে উঠে বলে–খাওয়ালে না কি?
বল্লরী মাথা হেলিয়ে বলল–খাওয়াব না কেন?
–সে কী!
শোভন মাথা নেড়ে বলল–আর বলিস না, ভীষণ ডেয়ারিং এই মহিলাটি। একদিন বিপদে পড়বো
–আহা, ভয়ের কী! এইটুকু-টুকু সব ছেলে, আমার ভাই বাবলুর বয়সী মিষ্টি কথাবার্তা তাছাড়া এই শরতের হিমে সারা রাত জেগে বাইরে থাকছে–ওদের জন্য না হয় একটু কষ্ট করলাম!
শোভন হাসে, হাত তুলে বল্লরীকে থামিয়ে বলে–তার মানে তুমিও ওদের দলে।
–আহা, আমি কী জানি ওরা কোন দলের? আজকাল হাজারো দল দেয়ালে লেখো আমি কী করে বুঝব!
–তুমি ঠিকই বুঝেছ। তোমার ভাই বাবলু কোন দলে তা কি আমি জানি না! সেদিন খবরের কাগজে বাবলুর কলেজের ইলেকশনের রেজাল্ট তোমাকে দেখালুম না? তুমি ভাইয়ের দলের সিমপ্যাথাইজারা।
অসহায়ভাবে বল্লরী নীলুর দিকে তাকায়, কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে–না, বিশ্বাস করুন। আমি দেখিওনি ওরা কী লিখেছে।
নীলু হাসে–কিন্তু চা তো খাইয়েছ!
–হ্যাঁ। সে তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার গ্যাস জ্বেলে ছ পেয়ালা চা করতে কতক্ষণ লাগে! ওরা কী খুশী হল! বলল–বৌদি দরকার পড়লে আমাদের ডাকবেন। যাওয়ার সময়ে পেয়ালাগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দিয়ে গেল। ওরা ভাল না?
নীলু শান্তভাবে একটু মুচকি হাসে–কিন্তু তোমার নালিশ ছিল বলছিলে যে! এ তো নালিশ নয়। প্রশংসা।
–না নালিশই। কারণ, আজ সকালে হঠাৎ গোটা দুই বড় বড় ছেলে এসে হাজির। বলল–আপনাদের দেয়ালে ওসব লেখা কেন? আপনারা কেন এসব আলাউ করেন? আপনার বন্ধু। ঘটনাটা বুঝিয়ে বলতে ওরা থমথমে মুখ করে চলে গেল। আপনি ওই ছ’জনকে যদি চিনতে পারেন তবে বলবেন–ওরা যেন আর আমাদের দেয়ালে না লেখো লিখলে আমরা বড় বিপদে পড়ে যাই। দুদলের মাঝখানে থাকতে ভয় করে আমাদের বলবেন যদি চিনতে পারেন।
শোভন মাথা নেড়ে বলে–তার চেয়ে নীলু, তুই আমার জন্য আর একটা বাসা দেখা এই। দেয়ালের লেখা নিয়ে ব্যাপার কদূর গড়ায় কে জানে। এর পর বোমা কিংবা পেটো ছুড়ে দিয়ে যাবে জানালা দিয়ে, রাস্তায় পেলে আলু টপকাবো তার ওপর বল্লরী ওদের চা খাইয়েছে–যদি সে ঘটনার সাক্ষীসাবুদ কেউ থেকে থাকে তবে এখানে থাকাটা বেশ রিস্কি এখন।
বল্লরী নীলুর দিকে চেয়ে বলল–বুঝলেন তো! আমাদের কোনো দলের ওপর রাগ নেই। রাতজাগা ছটা ছেলেকে চা খাইয়েছি–সে তো আর দল বুঝে নয়! অন্য দলের হলেও খাওয়াতুম।
বেরিয়ে আসার সময়ে দেয়ালের লেখাটা নীলু একপলক দেখল। তেমন কিছু দেখার নেই। সারা কলকাতার দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিপ্লবের ডাক। নিঃশব্দে।
কয়েকদিন আগে এক সকালবেলায় হরলালের জ্যাঠামশাইকে নীলু দেখেছিল প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরার পথে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দেওয়ালের সামনে পড়লেন লেখা। নীলুকে দেখে ডাক দিলেন তিনি বললেন–এইসব লেখা দেখেছ নীলু। কী রকম স্বার্থপরতার কথা। আমাদের ছেলেবেলায় মানুষকে স্বার্থত্যাগের কথাই শেখানো হত। এখন এরা শেখাচ্ছে স্বার্থসচেতন হতে, হিংস্র হতে–দেখেছ কীরকম উল্টো শিক্ষা!
নীলু শুনে হেসেছিল।
উনি গম্ভীর হয়ে বললেন–হেসো না। রামকৃষ্ণদেব যে কামিনীকাঞ্চন সম্বন্ধে সাবধান হতে বলেছিলেন তার মানে বোঝো?
নীলু মাথা নেড়েছিল। না।
উনি বললেন–আমি এতদিনে সেটা বুঝেছি। রামকৃষ্ণদেব আমাদের দুটো অশুভ শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হতে বলেছিলেন একটা হচ্ছে ফ্রয়েডের প্রতীক কামিনী, অপরটা মার্ক্সের কাঞ্চনা ও দুই তত্ত্ব পৃথিবীকে ব্যভিচার আর স্বার্থপরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তোমার কী মনে হয়?
নীলু ভীষণ হেসে ফেলেছিল।
হরলালের জ্যাঠামশাই রেগে গিয়ে দেয়ালে লাঠি ঠুকে বললেন–তবে এর মানে কী? অ্যা! পড়ে দেখ, এ সব ভীষণ স্বার্থপরতার কথা কি না।
তারপর থেকে যতবার সেই কথা মনে পড়েছে ততবার হেসেছে নীলু একা একা বেলা বেড়ে গেছে। বাসায় খবর দেওয়া নেই যে শোভনরা খাবো খবরটা দেওয়া দরকার। ফুলবাগানের মোড় থেকে নীলু একটা শর্টকাট ধরল। বড় রাস্তায় যেখানে গলির মুখ এসে মিশেছে সেখানেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাধন–নীলুর চতুর্থ ভাই। কলেজের শেষ ইয়ারে পড়ে। নীলুকে দেখে সিগারেট লুকোল। পথচলতি অচেনা মানুষের মতো দুজনে দুজনকে চেয়ে দেখল একটু চোখ সরিয়ে নিলা। তাদের দেখে কেউ বুঝবে না যে তারা এক মায়ের পেটে জন্মেছে, একই ছাদের নীচে একই বিছানায় শোয়! নীলু শুধু জানে সাধন তার ভাই। সাধনের আর কিছুই জানে না সে কোন দল করছে সাধন, কোন পথে যাচ্ছে, কেমন তার চরিত্র–কিছুই জানা নেই নীলুর। কেবল মাঝে মাঝে ভোরবেলা উঠে সে দেখে সাধনের আঙুলে, হাতে কিংবা জামায় আলকাতরার দাগ। তখন মনে পড়ে, গভীর রাতে ঘুমোতে এসেছিল সাধনা।
এখন কেন জানে না, সাধনের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল নীলুর সাধন, তুই কেমন আছিস? তোর জামাপ্যান্ট নিয়েছিস তুই? অনার্স ছাড়িসনি তো! এরকম কত জিজ্ঞাসা করার আছে।
একটু এগিয়ে গিয়েছিল নীলু। ফিরে আসবে কিনা ভেবে ইতস্তত করছিল। মুখ ফিরিয়ে দেখল সাধন তার দিকেই চেয়ে আছে। একদৃষ্টো হয়তো জিজ্ঞেস করতে চায়–দাদা, ভাল আছিস তো? বড্ড রোগা হয়ে গেছিস, তোর ঘাড়ের নলী দেখা যাচ্ছে রে! কুসুমদির সঙ্গে তোর বিয়ে হল না শেষ পর্যন্ত, না? ওরা বড়লোক, তাই? তুই আলাদা বাসা করতে রাজি হলি না, তাই? না হোক কুসুমদির সঙ্গে তোর বিয়ে–কিন্তু আমরা–ভাইয়েরা তো জানি তোর মন কত বড়, বাবার পর তুই কেমন আগলে আছিস আমাদের! আহারে দাদা, রোদে ঘুরিস না, বাড়ি যা। আমার জন্য। ভাবিস না–আমি রাতচরা–কিন্তু নষ্ট হচ্ছি না রে, ভয় নেই!
কয়েক পলক নির্জন গলিপথে তারা দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে এরকম নিঃশব্দে কথা বলল। তারপর সামান্য লজ্জা পেয়ে নীলু বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে লাগল।
দুপুরে বাড়িতে কাণ্ড হয়ে গেল খুব নাড়মামী কলকল করে কথা বলে, সেই সঙ্গে মা আর ছোট বোনটা। শোভনের দুই মেয়ে কাণ্ড করল আরও বেশি বাইরের ঘরে শোভন আর নীলু শুয়েছিল–ঘুমোতে পারল না। সাধন ছাড়া ভাইয়েরা যে যার আগে খেয়ে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে কি আস্তানায় কেটে পড়েছিল, তবু যজ্ঞিবাড়ির ভিড়ের মতো হয়ে রইল রবিবারের দুপুর।
সবার শেষে খেতে এল সাধন। মিষ্টি মুখের ডৌলটুকু আর গায়ের ফর্সা রং রোদে পুড়ে তেতে কেমন টেনে গেছে। মেঝেতে ছক পেতে বাইরের ঘরেই লুডো খেলছিল বল্লরী, মামী, আর নীলুর দুই বোন সাধন ঘরে ঢুকতেই নীলু বল্লরীর মুখখানা লক্ষ করল।
যা ভেবেছিল তা হল না। বল্লরী চিনতেও পারল না সাধনকে। মুখ তুলে দেখল একটু, তারপর চালুনির ভিতর ছক্কাটাকে খটাখট পেড়ে দান ফেলল। সাধনও চিনল না।
একটু হতাশ হল নীলু। হয়তো রাতের সেই ছেলেটা সত্যিই সাধন ছিল না, নয়তো এখনকার মানুষ পরস্পরের মুখ বড় তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।
নীলু গলা উঁচু করে বলল–তোমার মেয়ে দুটো বড় কাণ্ড করছে বল্লরী, ওদের নিয়ে যাও।
–আঃ, একটু রাখুন না বাবা, আমি প্রায় ঘরে পৌঁছে গেছি।
রাত্রির শো-তে শোভন আর বল্লরী জোর করে টেনে নিয়ে গেল নীলুকে। অনেক দামি টিকিটে বাজে একটা বাংলা ছবি দেখল তারা। তারপর ট্যাক্সিতে ফিরল।
জ্যোৎস্না ফুটেছে খুব। ফুলবাগানের মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে জ্যোৎস্নায় ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল নীলু রাস্তা ফাঁকা। দুধের মতো জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের ডাকা নিরপেক্ষ মানুষেরা তারই আড়ালে শুয়ে আছে। দূরে দূরে কোথাও পেটো ফাটবার আওয়াজ ওঠো মাঝে-মধ্যে গলির মুখে মুখে যুদ্ধের ন্যূহ তৈরি করে লড়াই শুরু হয়। সাধন আছে ওই দলে কে জানে একদিন হয়তো তার নামে একটা শহীদ স্তম্ভ উইঢিবির মতো। গজিয়ে উঠবে গলির মুখো।
পাড়া আজ নিস্তব্ধ। তার মানে নীলুর ছোটলোক বন্ধুরা কেউ আজ মেজাজে নেই। হয়তো বৃটিশ আজ মাল খায়নি, জগু আর জাপান গেছে ঘুমোতো ভাবতে ভালই লাগে।
শোভন আর বল্লরীর ভালবাসার বিয়ে বড় সংসার ছেড়ে এসে সুখে আছে ওরা। কুসুমের বাবা শেষ পর্যন্ত মত করলেন না। এই বিশাল পরিবারে তাঁর আদরের মেয়ে এসে অথই জলে পড়বো বাসা ছেড়ে যেতে পারল না নীলু যেতে কষ্ট হয়েছিল কষ্ট হয়েছিল কুসুমের জন্যও। কোনটা ভাল হত তা সে বুঝলই না। একা হলে ঘুরে-ফিরে কুসুমের কথা বড় মনে পড়ে।
বাবা ফিরবে পরশু আরও দুদিন তার কিছু চাক্কি ঝাঁক যাবে। হাসি মুখেই মেনে নেবে নীলু। নয়তো রাগই করবো কিন্তু ঝাঁক হবেই। বাবা ফিরে নীলুর দিকে আড়ে আড়ে অপরাধীর মতো তাকাবে, হাসবে মিটিমিটি খেলটুকু ভালই লাগবে নীলুর। সে এই সংসারের জন্য প্রেমিকাকে ত্যাগ করেছে–কুসুমকে–এই চিন্তায় সে কি মাঝে মাঝে নিজেকে মহৎ ভাববে?
একা থাকলে অনেক চিন্তার টুকরো ঝরে-পড়া কুটোকাটার মতো মাথার ভিতরে চক্কর খায়।
বাড়ির ছায়া থেকে পোগো হঠাৎ নিঃশব্দে পিছু নেয়। মনে মনে হাসে নীলু। তারপর ফিরে বলে–পোগো, কী চাস?
পোগা দূর থেকে বলে–ঠালা, টোকে মার্ডার করব।
ক্লান্ত গলায় নীলু বলে–আয়, করে যা মার্ডার।
পোগো চুপ থাকে একটু সতর্ক গলায় বলে–মারবি না বল!
বড় কষ্ট হয় নীলুর। ধীরে ধীরে পোগোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে–মারব না। আয়, একটা সিগারেট খা।
পোগো খুশী হয়ে এগিয়ে আসে।
নিশুত রাতে এক ঘুমন্ত বাড়ির সিঁড়িতে বসে নীলু, পাশে পাগলা পোগো সিগারেট ধরিয়ে নেয় দুজনে। তারপর–নীলু কখনও কাউকে বলতে পারে না–সেই হৃদয়ের দুঃখের গল্প–কুসুমের গল্প–অনর্গল বলে যায় পোগোর কাছে।
পোগো নিবিষ্ট মনে বুঝবার চেষ্টা করে।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now