বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
সিরাজুল যেমন লম্বা, তেমনি ঢ্যাঙা। ক্লাস এইটের ছাত্র। দেখলে মনে হয় কলেজ-টলেজে পড়ে। তবে দেখতে হবে পেছন থেকে। মুখের দিকে তাকালে ভুল ভাঙবে। মুখটা আমাদের মতোই। অর্থাত্ ক্লাস এইটের ছাত্রের মতোই। কচি, মোলায়েম। শুধু আকৃতিটা ওই রকম।
এই বয়সে কেন যে সে এত লম্বা?
ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকেই আমরা ফুলপ্যান্ট পরি, পায়জামা পরি। সিরাজুল পরে হাফপ্যান্ট। একে এতটা লম্বা আর ঢ্যাঙা, তার ওপর পরে ঢলঢলা হাফপ্যান্ট, শার্টের অবস্থাও তেমন। ঢলঢলা। হঠাত্ করে দেখলে সিরাজুলকে কখনো কখনো কাকতাড়ুয়ার মতো লাগে। ক্লাসে বসে থাকলেও তার মাথা সব ছাত্রের মাথার অনেক ওপরে উঠে থাকে, দাঁড়ালেও একই অবস্থা। তবে সিরাজুলের গায়ের রং ফরসা। চেহারা ভালোই। নিরীহ, গোবেচারা-টাইপ।
আমাদের ইংরেজির টিচার বুলেট স্যার।
বুলেট স্যারের আসল নাম গোবিন্দচন্দ্র দাস। মাঝারি সাইজের মানুষ। একটু মোটার দিকে শরীর। গায়ের রং এতটাই ফরসা, রোদে হাঁটলে মুখটা সাহেবদের মতো লালচে হয়ে যায়। স্যারের আসল কৃতিত্ব কথা বলার ধরনে। কথা বলেন বুলেটের গতিতে। একটু উচ্চ স্বরে, অতি দ্রুত, হড়বড় হড়বড় করে। এ জন্য ওপর ক্লাসের কোনো রসিক ছাত্র তাঁর নাম দিয়েছিল ‘বুলেট’। সেই নাম এত পপুলার হলো, বুলেট নামের আড়ালে তাঁর আসল নাম চাপা পড়ে গেল। অন্য স্যাররাও তাঁকে আজকাল বুলেট স্যার বলেই ডাকেন। গুরুগম্ভীর হেডস্যার পর্যন্ত। যাঁর মুখের হাসি অতি দুর্লভ। কেউ কখনো দেখেছে, এমন ইতিহাস নেই। বেশির ভাগ সময় অফিস রুমে বসে থাকেন। জমিদার বংশের লোক। বেশ মোটা। অতিকায় ভুঁড়ি। টেবিলে তাঁর হাতের কাছে একটা সোডা ওয়াটারের বোতল। প্রায়ই ওই জিনিস গলাধঃকরণ করছেন। চিরকুমার। হাতে সব সময় একটা না একটা ডিকশনারি। সামনে সাদা কাগজ আর কালো মোটা ফাউনটেন পেন। মাঝে মাঝেই সেই কাগজে কী কী টুকছেন। পরে আমরা জেনেছি তিনি কয়েকটা ডিকশনারি লিখেছেন, গ্রামার বই লিখেছেন। ক্বচিত্ অফিস থেকে বেরোন। হাতে থাকে জোড়া বেত। সেটা টিফিন পিরিয়ডে। ছেলেরা যেদিন টিফিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার পরও ক্লাসে ঢোকে না, বেশি হইচই করে, সেদিন। বেরিয়েই দোতলার চওড়া বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা হাঁক দেন। অ্যাই...
সেই হাঁক মানে অ্যাটম বোম। মুহূর্তে পুরো স্কুল স্তব্ধ, গভীর রাতের মতো সুনসান। ছাত্ররা সুড়সুড় করে ক্লাসে ঢুকে যে যার বেঞ্চে সুবোধ বালক হয়ে বসে পড়েছে। স্যাররাও এসে ঢুকেছেন ক্লাসে। লেখাপড়া শুরু হয়ে গেছে।
ওই রকম একদিন হেডস্যার এসে আমাদের ক্লাসে ঢুকলেন। হাতে জোড়া বেত। আমাদের কলিজা কম্পমান। কাকে যে ধরেন আজ? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছি সবাই।
স্যার ধরলেন সিরাজুলকে। উঁচু মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে। অ্যাই, বল, সেনটেনস কাহাকে বলে?
বাক্য কাকে বলে এটা ক্লাস ফোর-ফাইভেই শিখে গেছি আমরা। সিরাজুলও নিশ্চয় জানে। কিন্তু হেডস্যারের ও রকম দেহ, ও রকম কণ্ঠস্বর শুনে এমন ভড়কানো ভড়কাল, দু-তিনবার ঢোক গিলে তোতলাতে লাগল। আ আ সেন টেনস, সেন টেনস...
স্যার সপাং করে বেত চালালেন। গরু কোথাকার। ক্লাস এইটের ছাত্র সেনটেনস কাকে বলে জানে না? বেরো ক্লাস থেকে।
বেত খাওয়া জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে বেরিয়ে গেল সিরাজুল।
স্যার ধরলেন হারুনকে। তুই বল।
হারুন ফার্স্টবয়। যেকোনো বিষয়ে ভালো জ্ঞান ধারণ করে আছে। সেনটেনস কাকে বলে এই জিনিস তার কাছে তুচ্ছ। খুবই স্মার্ট ভঙ্গিতে বলল, সেনটেনস মানে বাক্য। বাক্য হচ্ছে...
ইংরেজিতে বল।
হারুন বলল, A sentence is a group of words which makes a complete sense।
স্যার মুগ্ধ। তাঁর জলদগম্ভীর কণ্ঠ তরল হয়ে গেল। আরে এই ছেলেটা তো ভালো! গুড গুড, ভেরি গুড। ছুটির পর আমার রুমে এসে বিস্কুট খেয়ে যাবি। আমি তোকে বিস্কুট খাওয়াব। গুড গুড, ভেরি গুড।
স্যার আর কাউকে ধরলেন না। অফিস রুমে ফিরে গেলেন। হারুনের জন্য আমরা বেঁচে গেলাম। তবে আজ স্যার সহজ জিনিসই ধরেছিলেন। তাঁর মতলবের ঠিক নেই। হয়তো ক্লাস এইটের ছাত্রকে এমন ট্রানসেলেশন ধরলেন, ক্লাস টেনের ভালো ছাত্রের পক্ষেও সেটা ত্রাহি ডাক ছাড়ার মতো। আর ভুল হলেই জোড়া বেত। ওই জিনিস একবার খেলে ইহজনমে ভোলা যাবে না।
তবে হারুনের বিস্কুট খাওয়া...
ছুটির পর হারুন গেল স্যারের রুমে। আমরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি স্যারের দরজার বাইরে। স্বয়ং হেডস্যার হারুনকে বিস্কুট খাওয়াবেন, এর চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা এই স্কুলের ইতিহাসে নেই।
স্যারের হাতে অক্সফোর্ডের ডিকশনারি। সামনে সাদা কাগজ, মোটা কলম আর সোডা ওয়াটারের বোতল। কপালে তিন-চারটা ভাঁজ পড়ে আছে। নিবিষ্ট মনে তিনি কিছু ভাবছেন।
হারুন গিয়ে সামনে দাঁড়াল। আদাব স্যার।
কপালে আরও দু-তিনটা ভাঁজ পড়ল স্যারের। খ্যাঁকানো গলায় বললেন, কী?
হারুন তোতলাতে লাগল। বি বি...
কী বি বি?
বি বিস্কুট স্যার, বিস্কুট।
কিসের বিস্কুট?
আপনি বলেছিলেন, আমি স্যার ওই যে ইংলিশে সেনটেনস কাহাকে বলে...
ডিকশনারির চাপে স্যার সব ভুলে গেছেন। এমন ধমক দিলেন হারুনকে! যা ভাগ, আহাম্মক কোথাকার...
স্যারের ধমক শুনে দরজার বাইরে দাঁড়ানো আমরা জান-পরান নিয়ে দৌড় দিলাম। হারুনের কী হলো কে জানে। ভিরমি খেয়ে স্যারের রুমেই পড়ে গেছে কি না, বলতে পারব না।
এই ঘটনা রটতে দেরি হলো না। পরদিন থেকে আমাদের ক্লাসের ছেলেরা তো আছেই, ওপর-নিচ ক্লাসের ছেলেরাও হারুনকে দেখলেই ‘বিস্কুট বিস্কুট’ বলে খ্যাপায়। কেউ কেউ পুরো বাক্যটাই বলে, ‘আয়, বিস্কুট খেয়ে যা।’
হারুন এমনিতেই কালো, ওসব শুনে তার কালো মুখ আরও কালো হয়ে যায়।
বুলেট স্যার ছাত্রদের পক্ষের মানুষ। তিনিও একদিন হারুনকে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওই হারুন, আয় বিস্কুট খেয়ে যা।’
হারুন বেচারা আর যায় কোথায়? ছাত্ররা বলছে বলছে, স্যাররাও যদি বলতে থাকেন...
হারুনকে ছেড়ে বুলেট স্যার একদিন সিরাজুলকে নিয়ে পড়লেন। সেদিন তিনি বোধ হয় একটু বিরক্ত ছিলেন। বললেন, সিরাজুল, কাল থেকে তুই আর হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে আসবি না। বিচ্ছিরি লাগে। এত বড় ছেলে হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে আসে? ছি!
সিরাজুল কথা বলল না। কিন্তু পরদিনও হাফপ্যান্ট পরেই এল। বুলেট স্যার সেদিন খুব মুডে। ক্লাসে এসে সিরাজুলকে দেখে একবার মাত্র ভুরু কোঁচকালেন। ওকে বললেন না কিছুই, ধরলেন আমাকে।
তোর নাম যেন কী?
নাম বললাম।
রোল নম্বর?
বললাম।
এবার স্যারের অদ্ভুত প্রশ্ন। দা চিনিস?
চিনি স্যার। দা দিয়ে গাছের ডালপালা ঝোপ-জঙ্গল কাটা হয়। আরও অনেক কিছু কাটা হয়।
রাইট। রামদা চিনিস?
চিনি স্যার। বড় সাইজের দা। পুরোনো দিনের ডাকাতেরা রামদা দিয়ে লোকের গলা কাটত।
রাইট। ছাগল চিনিস?
ক্লাসের সবাই হেসে ফেলল। স্যার কঠিন চোখে তাকালেন। মুহূর্তে সবার হাসি বিলুপ্ত। আমার মুখে যে হাসিটা ফুটি ফুটি করছিল, সেটা আমি আর ফুটতে দিলাম না। গম্ভীর গলায় বললাম, চিনি স্যার।
ওই জিনিস সবারই চেনার কথা। রামছাগল চিনিস?
তাও চিনি স্যার। বড় সাইজের ছাগল।
খোকা চিনিস?
আমি একটু থতমত খেলাম। খোকা? মানে বাচ্চা ছেলে? ছেলেশিশু? চিনি স্যার, চিনি।
গুড। রামখোকা চিনিস?
আমি আবার থতমত খেলাম। রামখোকা, রামখোকা...
স্যার সিরাজুলের দিকে তাকালেন। স্ট্যান্ডআপ।
সিরাজুল দাঁড়াল। স্যার বললেন, চিনে রাখ চিনে রাখ, এটা হচ্ছে ‘রামখোকা’। বড় সাইজের খোকা। রাম মানেই বড়। যেমন রামদা, যেমন রামছাগল...
স্যারের সামনে তো আর গলা খুলে হাসতে পারি না, আমরা মুখ টিপে হাসতে লাগলাম। পরদিন থেকে যদিও হাফপ্যান্ট পরা ছেড়ে দিল সিরাজুল, পায়জামার সঙ্গে হাফহাতা শার্ট পরে স্কুলে আসে, তবু তার নাম পড়ে গেল ‘রামখোকা’। হারুন হলো ‘বিস্কুট’ আর সিরাজুল ‘রামখোকা’। এই দুই জিনিস নিয়ে আমাদের ক্লাস চলছে।
একদিন স্কুলে ম্যাজিশিয়ান এল।
আগের দিন নোটিশ দেওয়া হয়েছে, আজ টিফিন আওয়ারের পর আর ক্লাস হবে না। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাবে। ম্যাজিকের নামে আমরা অজ্ঞান। কখন চারটা ক্লাস শেষ হবে, কখন টিফিন আওয়ার হবে, টিফিন খেয়েই কখন আমরা দেখতে পাব ম্যাজিক, ওই নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা।
সব অপেক্ষা একসময় শেষ হলো।
আজ আমাদের টিফিনটা ভালো ছিল। বড় সাইজের মালপোয়া পিঠা। ওই জিনিস একটা খেলে বিকেল পর্যন্ত ক্ষুধা লাগার প্রশ্নই ওঠে না। মালপোয়া খেয়ে ঢেকুর তুলে আমরা ম্যাজিক দেখতে বেরোলাম।
আমাদের স্কুলগ্রাউন্ড বিশাল। রাস্তার দিকে, পশ্চিম পাশে লোহার গেট, তারপর লম্বা উঁচু দেয়াল, তারপর আরেকটা একই রকম গেট। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে দুটো গেটই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্কুলে ঢোকার পর বড় একটা বাগান, তারপর অতিকায় একটা তিনতলা বিল্ডিং। দেখতে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো। নিচতলায় প্রাইমারি সেকশন। দোতলা থেকে ওপরের ক্লাস। দুপাশে টানা লম্বা, বেশ চওড়া বারান্দা। সিঁড়িও চওড়া। কত যে রুম বিল্ডিংয়ে! এক শ সোয়া শ বছর আগে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার জমিদারেরা বানিয়েছিলেন। সেই জমিদার বংশেরই একজন এখনো আমাদের হেডমাস্টার। প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের লোক বলে হেডস্যারের সম্মান অন্য স্কুলের হেডস্যারদের চেয়ে অনেক বেশি। এলাকার লোক খুবই মান্য করে তাঁকে।
স্কুলের রুমগুলো বড় বড়। সিলিং অনেক ওপরে। আজকালকার দোতলার সমান হাইট একেক তলার। কালচে লাল ধরনের রং করা। বিল্ডিং ছাড়িয়ে পুব দিকে মাঝারি সাইজের একটা মাঠ। মাঠ বলা ঠিক হবে, নাকি চত্বর বলব? মাঠ বললে তো সবুজ ঘাসে ভরা খোলা একটা জায়গার ছবি ভেসে ওঠে। ওই জায়গায় ঘাসের বালাই নেই। একসময় হয়তো ছিল। হাজার দুয়েক ছাত্রের হুড়োহুড়ি-দৌড়াদৌড়ি, ফুটবল-ক্রিকেট খেলা, গোল্লাছুট খেলার চাপে ঘাস বিলুপ্ত। এখন শুধু সাদা মাটি। সেখানে আমাদের অ্যাসেম্বলি হয়।
উত্তর দিকে আরেকটা চত্বর। ‘ইউ’ অক্ষরের মাঝখানটা যেমন হয়, এই জায়গায়টা তেমনি। তবে বাঁধাই করা। কালচে লাল ধরনের মেঝে। ওই যে পুরোনো দিনের বিল্ডিংগুলোর ফ্লোর যেমন হতো, তেমনি।
ওই চত্বরের উত্তরে একতলা একটা বিল্ডিং। বড় বড় কয়েকটা রুম। পুব দিককার রুম মানে হলরুম। সেই রুমে বিভিন্ন সাইজের হাঁড়ি-পাতিল আর পাকা চুলা আছে কয়েকটি। লাকড়ি-খড়ির স্তূপ। আটা, ময়দা, চিনি, সুজির বস্তা, ঘি, তেলের টিন। এটা আসলে কিচেন। বাবুর্চিরা আমাদের টিফিন তৈরি করে। পাশের রুমগুলোতে দারোয়ান-দপ্তরিরা থাকে। একজন বাবুর্চিও পাকাপাকি থাকে তাদের সঙ্গে।
এই চত্বরে হবে ম্যাজিক শো।
পুব দিককার বারান্দায় ম্যাজিশিয়ানের টেবিল, চোঙা আর তিন মাপের তিনটা বিচিত্র ধরনের বাক্স রাখা হয়েছে। পশ্চিম দিককার বারান্দায় স্যারদের জন্য চেয়ার। ছাত্ররা বসেছে খোলা চত্বরে। প্রাইমারি সেকশনের ছাত্ররা নেই। ওদের জন্য আগামীকাল সকালে ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ শুধু ওপর ক্লাসের ছেলেদের জন্য। ক্লাস সিক্স থেকে টেন। হেডস্যারের সাজেশন অনুযায়ী রো সাজানো হয়েছে। ম্যাজিশিয়ানের একেবারে সামনের রোতে বসবে ক্লাস সিক্সের ছাত্ররা, তাদের পেছনে ক্লাস সেভেন, এভাবে।
ক্লাস এইট পড়েছে একেবারে মাঝখানে।
প্রতিটি ক্লাস থেকে পাঁচজন করে ভলান্টিয়ার নেওয়া হয়েছে। তারা যে যার ক্লাসের ছাত্রদের ম্যানেজ করবে। হইচই-দুষ্টুমি যেন কেউ না করে। ভলান্টিয়াররা বসতে পারবে না, তারা একপাশে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখবে আর নিজ নিজ ক্লাসের ছাত্রদের দিকে চোখ রাখবে।
আমাদের ক্লাসের পাঁচজনের মধ্যে আমিও চান্স পেয়েছি। বাকি চারজনের মধ্যে রামখোকা সিরাজুল আর বিস্কুট হারুন আছে। অন্য দুজন হলো মুকুল আর মানবেন্দ্র। আমরা আমাদের ক্লাস বরাবর কিচেনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।
ম্যাজিশিয়ান এল।
বছর তিরিশেক বয়সের একজন রোগাপটকা মানুষ। পরনে কালো আলখাল্লা। মাথায় চানাচুরঅলাদের মতো চোঙা-টাইপের ক্যাপ। অদ্ভুত এক সুরে কথা বলতে শুরু করল সে। ম্যাজিক যতটা না দেখায় কথা বলে তার চৌগুণ। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি।
খুবই সহজ সহজ ম্যাজিক দেখাতে লাগল সে। হাতে একটা কয়েন নিয়ে তালুতে ঘষতে ঘষতে উধাও করে দিল, তারপর সেই কয়েন বেরোল তার কান থেকে। আরেকবার কয়েন উধাও করে সামনের সারিতে বসা ক্লাস সিক্সের এক ছেলের শার্টের কলার থেকে বের করল। তারপর আলখাল্লার পকেট থেকে বের করতে লাগল জাদুর রুমাল। রুমালের একটা কোনা আগে থেকেই আলখাল্লার পকেটে কিছুটা বেরিয়ে ছিল। হঠাত্ সে বলল, ইশ্, খুব গরম পড়েছে। মুখটা একটু মুছে নিই...
বুকপকেট থেকে রুমাল বের করতে গেল, ওমা, রুমাল শুধু বেরোচ্ছেই। আর ফুরায় না। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ অবিরাম রুমাল বেরোতে লাগল। ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছে।
একটা বাক্স থেকে রুমালের মতো নানা রঙের কাগজের মালা বের করল। সেই মালা আর ফুরায় না। এইটুকু বাক্সে এত মালা ধরল কী করে? শেষ পর্যন্ত বাক্স থেকে বেরোল সাদা একটা কবুতর। আমরা বিস্মিত। আমার পাশে দাঁড়ানো সিরাজুল হাঁ করে ম্যাজিক দেখছে। তার চোখে বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা নেই। একটা করে ম্যাজিক শেষ হয় আর ছেলেরা সমানে করতালি দেয়। নিজের প্রতিভায় ম্যাজিশিয়ান মুগ্ধ। একটা করে ম্যাজিক শেষ হয়, ছাত্ররা হাততালি দেয় আর তার মুখে ফোটে বাঙ্গির ফালির মতো হাসি।
স্যাররাও মজা পাচ্ছেন ম্যাজিক দেখে, মুগ্ধ হচ্ছেন।
হেডস্যার গম্ভীর মুখে বসে আছেন স্যারদের মধ্যমণি হয়ে। হেডস্যারের কারণে অন্য স্যাররা কেউ মুগ্ধতা প্রকাশ করতে পারছেন না। চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে নিঃশব্দে মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন।
এই পর্যায়ে শুরু হলো শেষ দিককার একটা ম্যাজিক।
একদলা সুতা গিলে পেটের ডানপাশটা ব্লেড দিয়ে কেটে সেই ফুটো দিয়ে সুতাটা টেনে টেনে বের করবে ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিক শুরুর আগে সে ঘটনা বলল। কীভাবে সুতা গিলবে, কীভাবে বের করবে। শুনে গভীর উত্তেজনা নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। বলে কী? সুতা গিলে পেট কেটে সেই সুতা টেনে বের করবে? এ তো ভয়ংকর ম্যাজিক! শুনেই সিরাজুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। ওই চোখে পলক না ফেলে সে ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।
ম্যাজিশিয়ান আলখাল্লার পকেট থেকে সাদা একদলা সুতা বের করল। হাত তুলে সুতা সবাইকে দেখাল। সুতার দলা মুখে পুরে গিলে ফেলল। একদম চোখের সামনে সবকিছু। অবিশ্বাস করার কোনো উপায়ই নেই।
পিনপতন নীরবতা চলছে। ম্যাজিশিয়ান তার গলার স্বরে বেশ একটা আতঙ্কিত পরিবেশ তৈরি করেছে। সুতা গিলে আলখাল্লার অন্য পকেটে হাত দিয়ে মোড়কে জড়ানো নতুন একটা ব্লেড বের করল। আলখাল্লার ডান দিকটা তুলে পেটের ওদিকটা দেখাল সবাইকে। দাঁত দিয়ে আলখাল্লার কোনা কামড়ে ধরে পেটের চকচকে সাদা চামড়া ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। চামড়া কাটা লালচে রক্তাক্ত একটা ভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধীরে ধীরে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল জায়গাটা। ম্যাজিশিয়ান কোনো শব্দ করছে না। একসময় কাটা জায়গায় দুটো আঙুলের সামান্য একটু ঢুকিয়ে সুতার মাথা টেনে বের করল। ধীরে ধীরে সুতা বেরোচ্ছে। সুতাতেও একটু একটু রক্তাক্ত ভাব।
আমরা দম বন্ধ করে দেখছি। হঠাত্ পাশে ধপাস শব্দ। কী হলো, কী হলো?
সিরাজুল চোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে পপাত ধরণিতল। বেশ একটা হইচই লেগে গেল। ম্যাজিশিয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হেডস্যার অতি বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। স্যারকে দাঁড়াতে দেখে সব কোলাহল বন্ধ। আবার পিনপতন নীরবতা। সিরাজুলের দেহ পড়ে আছে আমাদের পায়ের কাছে। স্যার বললেন, ম্যাজিক হচ্ছে কারসাজি। ওই দেখে ক্লাস এইটের ছাত্র ফিট হয়ে যায়?
স্যার তাকালেন আমাদের দিকে। অ্যাই, ওটিকে চ্যাংদোলা করে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আয়।
আমাদের ক্লাসের ছাত্রের দায়িত্ব আমাদের। আমরা চারজন সিরাজুলের পা ধরলাম দুজনে, হাত দুজনে। সত্যি সত্যি চ্যাংদোলা করে নিয়ে এলাম সিকরুমে। স্যার বলেছেন ঠিকই, কিন্তু ভাগাড়ে তো আর ফেলতে পারি না!
সিকরুমে এনে মুখে পানির ছিটা-মিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো সিরাজুলের। সে উঠে বসল। চোখ-মুখে তখনো আতঙ্ক। বাবা রে বাবা, সুতা গিলে পেট কেটে বের করেছে...
আমরা তখন হাসছি।
মানবেন্দ্র বলল, সুতা গিলেওনি, পেটও কাটেনি।
সিরাজুল অবাক। যাহ্।
সত্যি।
কিন্তু সবাই যে দেখল সুতা গিলেছে, পেট কেটে টেনে টেনে বের করছে।
পুরোটাই চালাকি। সবাই দেখেছে সুতা গিলছে, কিন্তু গিলে নাই। কায়দা করে মুখের ভেতর রেখে দিয়েছে।
আর ওই যে ব্লেড দিয়ে পেটটা কাটল...
পেট কাটে নাই।
তাহলে কী কাটল?
পেটের ওখানটায় পেটের রঙের মতো করে ময়দার দলা পেস্ট করে রেখেছিল। ব্লেড দিয়ে ওই ময়দা কেটেছে।
তাহলে সুতা বেরোল কী করে?
ময়দার ভেতর কায়দা করে সুতা রেখে দিয়েছিল। ওটাই টেনে টেনে বের করেছে।
সুতায় যে রক্তমাখা ছিল? রক্ত এল কোত্থেকে?
এবার কথা বলল মুকুল। আরে গাধা, আমরা যাতে বিশ্বাস করি এ জন্য সুতায় হালকা করে লাল রং মাখিয়ে রেখেছিল। সবই কারসাজি।
মুকুলের কথা শুনে খুবই আরামের একটা শ্বাস ফেলল সিরাজুল। মুখে ফুটল কেলানো একখানা হাসি। তাই বল। তাহলে তো আমার ফিট হওয়া ঠিক হয় নাই।
হারুন বলল, না না, একদম ঠিক হয় নাই। হেডস্যার পেলে জোড়া বেত ভাঙবে তোর পিঠে।
সিরাজুল বানরের মতো মুখ খিঁচিয়ে বলল, আর তোকে বিস্কুট খাওয়াবে। বান্দর কোথাকার!
বিস্কুট আর রামখোকার কথা শুনে আমরা হাসতে লাগলাম।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
লাকি
User ৩ বছর, ৮ মাস পুর্বে