বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
সন্ধ্যার পর শহরের রিপোর্ট দিচ্ছিলেন আলী। সুলতানের সাথে রয়েছেন বাহাউদ্দীন শাদাদ এবং আরও ক’জন উপদেষ্টা। আলী বললেন, “এ ব্যাপারে কোথাও কোন কথা হয়নি। আমাদের গোয়েন্দারা নিজেরাই কয়েক জায়গায় বলেছে আজ খোত্ৰায় খলিফার নাম নেয়া হয়নি। কাজটা ভাল করেনি খতিব।
লোকজন আশ্চর্য হয়ে গেছে। খোৎবায় খলিফার নাম নেয়া হয়েছে কিনা একথাই তারা জানে না। কেউ কেউ বলেছে, খলিফাতো খোদা বা নবী না, খোৎবায় তার নাম বলা হয়নি তাতে এমন কি হয়েছে?
নিশ্চিন্ত হলেন সুলতান। জনগণের বিরোধিতার যে ভয় ছিল তা হচ্ছে না।
সেদিনই তিনি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে চিঠি লিখলেন। লিখলেন, “খোৎবা থেকে খলিফার নাম তুলে দিয়েছি। এতে জনগণের মাঝে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আপনিও খলিফার নাম খোৎবা থেকে তুলে দিন।’
প্রাসাদে গোয়েন্দাদের আরও সতর্ক করার নির্দেশ দিলেন আয়ুবী। আলীকে বললেন, সন্দেহজনক কিছু দেখলে সাথে সাথে যেন আমাকে। অবহিত করা হয়।
তিনি জানতেন রজবকে খলিফা তার নিজস্ব গার্ড রেজিমেন্টের . কমান্ডার করেছেন। এজন্য আলীকে বললেন, তার সাথে একজন লোক দাও, যে তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করবে।’
খলিফার রাতের মাহফিল জমজমাট। রজব নেই, সে চলে গেছে গুপ্তঘাতকদলের কাছে। যতশীঘ্র সম্ভব সালাহদীন আয়ুবীকে হত্যার ব্যবস্থা করতে সে ব্যস্ত খলিফা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর, উম্মে আমারার মাদকতাময় রূপের সাগরে ডুবে আছেন তিনি।
খোৎবা থেকে তার নাম তুলে দেয়া হয়েছে একথা কেউ তাকে বলেনি। আয়ুবীকে হত্যার ব্যবস্থা হচ্ছে এজন্য তিনি ভীষণ খুশী।
বুড়োর হাত থেকে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মেয়েটা তাকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। ঘুমিয়ে পড়লেন খলিফা।
আলো নিভিয়ে ও কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। এগিয়ে গেল নিজের বিশ্রামের জন্য আলাদা করে রাখা এক বিশেষ কক্ষের দিকে, যেখানে মাঝে মধ্যে রজব গোপনে এসে দেখা করে।।
কামরায় ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে কেউ তার ওপর কম্বল ছুড়ে মারল। কোন শব্দ করার আগেই আরেকজন তাকে কম্বল সহ জাপটে ধরল। চিৎকার করতে যাবে সে, কিন্তু ততক্ষণে কম্বলসহ আরেকটা কাপড় দিয়ে মেয়েটাকে বেঁধে কাধে তুলে নিয়েছে সে।
উম্মে আমারা তৃতীয় কোন লোকের অস্তিত্ব টের পেল না। বুঝল, ওরা মাত্র দু’জন।
তাকে নিয়ে চলতে শুরু করেছে ওরা।
ওরা এদিক ঘুরে, ওদিক ঘুরে যেভাবে দ্রুত ওকে নিয়ে এগুচ্ছিল তাতে তার মনে হল, প্রাসাদের পথঘাট অপহরণকারীদের চেনা।
অন্ধকারেই সিড়ি ভাঙতে লাগল অপহরণকারীরা। উঠে এল ছাদে। ছাদ থেকে নিচের দিকে রশি ঝুলে আছে। মেয়েটাকে সহ একজন রশি বেয়ে নেমে এল নিচে। পেছনে নামল দ্বিতীয় জন। তারপর দু’জনই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
একটু দূরে চারটে ঘোড়া বাধা ছিল। দ্রুত ওখানে চলে এল অপহরণকারীরা। ঘোড়ার পাশে বসে ছিল দু’জন লোক। সংগীদের আসতে দেখে ওরা ঘোড়াসহ এগিয়ে এল।
নিশ্চয়ই এ সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাজ।
‘গভর্নর ছাড়া আর কেউ এমন সাহস করবে না।’ ‘
এ কাজ সে ছাড়া আর কে করতে পারে!’
রাজপ্রাসাদে কানাঘুষা চলছে সালাউদ্দিন আয়ুবী উম্মে আমারাকে অপহরণ করিয়েছেন।
রজব ফিরে এসেছে। তল্লাশী নেয়া হয়েছে প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে। রক্ষীদের উপর মনের ঝাল মেটাচ্ছে কমান্ডার। যেনতেন অপরাধ নয়, খলিফার হারেমের হীরকখণ্ড অপহৃত।
দেখা গেল প্রাসাদের পেছনে একটা রশি ঝুলছে। পায়ের চিহ্ন খানিক দূর গিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্নের সাথে মিশে গেছে। সন্দেহ নেই, মেয়েটাকে দড়ি বেয়ে নামানো হয়েছে।
মেয়েটা স্বেচ্ছায় কারো সাথে পালিয়ে গেছে এমন সন্দেহও প্রকাশ করল কেউ কেউ।
খলিফা একথা বাতিল করে দিলেন। ‘মেয়েটা আমাকে জীবনের চাইতে বেশী ভালবাসে।”
“এ সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাজ। রজব খলিফাকে বলল, ‘প্রাসাদের সবাই বলছে সে ছাড়া এমন দুঃসাহস কারো নেই।’
প্রাসাদে এ কথা ছড়িয়েছে রজবই। মহল তল্লাশী নেয়ার সময় প্রতিটি লোককেই বলেছে, এ সুলতান আয়ুবীর কাজ। তার এ রটনা কাজ দিয়েছে। মহলের প্রতিটি লোকের মুখে এখন এক কথা, এ কাজ সুলতান আয়ুবী করেছে।’
খলিফা একবারও ভাবলেন না, এ অপবাদ মিথ্যেও হতে পারে। আগেই তাকে বলা হয়েছিল সুলতান হারেমের মেয়েদের নষ্ট করেছেন।
তিনি বিশেষ দূতকে ডেকে বললেন, ‘আয়ুবীকে গিয়ে বল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে, আমি তাকে কোন শাস্তি দেব না।’
দূত সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে পৌছল।
দূত যখন সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে খলিফার নির্দেশ শোনাচ্ছিল, কায়রোর দশ বার মাইল দূরে ঘটছিল অন্য ঘটনা।
তিনটি উট ধীরে ধীরে কায়রোর দিকে এগিয়ে আসছে। আরোহী তিনজন মিসরীয় সৈন্য। পেট্রোল ডিউটি থেকে ফিরছিল ওরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুশমনের গুপ্তচরবৃত্তি, দেশদ্রোহীদের তৎপরতা এবং সুদানীদের হামলার আশংকায় সালাহউদ্দীন আয়ুবী সৈন্যদের অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রাতের বেলা বিস্তীর্ণ মরু এবং পার্বত্য এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াত ওরা। ওদের বাহন ছিল উট এবং ঘোড়া। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ত্বরিত আয়ুবীর কাছে সংবাদ পৌছে দিত।
ডিউটি শেষে কায়রো ফিরে আসছিল তিন উস্ট্রারোহী। সামনে মাটি এবং পাথুরে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা।
উপত্যকা দিয়ে চলছিল ওরা, একটা মেয়ের কান্নার শব্দ ভেসে এল। সাথে পুরুষালী কণ্ঠ। মনে হয় কাউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
উট থেকে নেমে এল একজন সৈনিক। পায়ে পায়ে পাহাড়ে উঠে গেল। শব্দ আসছে ওপাশ থেকে। লুকিয়ে পড়ল সৈন্যটা।
ওপাশে চারটে ঘোড়া বাঁধা। ক্লাছেই চারজন সুদানী কাফ্রী। একটা সুন্দরী মেয়ে দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে ছুটছে এক কাফ্রী। কিছুদূর গিয়েই মেয়েটার নাগাল পেয়ে গেল সে। মেয়েটার বাহু ধরে সংগীদের কাছে নিয়ে এল।
একজন কাফ্রী তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলল, তুমি পবিত্র মেয়ে। নিজকে কষ্টের মধ্যে ফেলে আমাদের পাপী করো না। দেবতার অভিশাপে আমরা পুড়ে যাব। দেবতা আমাদের পাথরে পরিনত করবেন।
‘আমি মুসলমান!” চিৎকার করে বলল মেয়েটা। ‘আল্লাহর গজব পড়ুক তোমাদের দেবতাদের ওপর। আমাকে ছেড়ে দাও, নইলে খলিফার কুকুর দিয়ে তোমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলব।
তুমি এখন খলিফার মালিকানায় নেই, দেবতাদের মালিকানায় রয়েছ। দেবতাদের রয়েছে বজের শক্তি, নাগনাগিনীর বিষ আর সিংহের দাত। তোমাকে কেউ লুকানোর চেষ্টা করলে মরুভূমির উত্তপ্ত বালু তাকে ছাই ভস্ম করে দেবে।’
এক কাফ্রী বলল, “তোমাদেরকে থামতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। ওর হাত পা বাধা থাক। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পৌছে যেতে পারব।’ ‘
আমাদের ঘোড়াগুলোর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তুমি নিজেও জান, দ্রুত যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কারোরই আপত্তি নেই।
‘এখন কথা না বলে আবার ওকে বেধে ফেলো।
একজন মেয়েটাকে ধরল। একটা তীর এসে বিধল তার পিঠে। ঢ়িলে হয়ে গেল মেয়েটাকে ধরা হাত। তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার দৌড় দিল মেয়েটা।
একজন এসে আহত লোকটাকে ধরে ঘোড়ার আড়ালে নিয়ে গেল। আরেকটা তীর এসে বিধল অন্য কাফ্রীর ঘাড়ে।
একজন দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে আনল আবার। দ্বিতীয় লোকটা তীরবিদ্ধ হতেই যে লোকটা মেয়েটাকে ধরে রেখেছিল সে উটের লাগাম তুলে নিয়ে দ্রুত নীচের দিকে নেমে গেল। সাথে তার সংগীও ছুটলো।
তীর দুটো ছুড়েছিল যে সেন্ট্রি সে পরে বলেছে, ‘দেবতাদের নাম শুনে প্রথমটায় আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যখন বলল আমি মুসলমান, গজব পড়ুক দেবতাদের উপর, তখন জেগে উঠল আমার ঈমানী শক্তি। খলিফার নাম শুনে বুঝলাম ও হারেমের মেয়ে। পোশাক আশাকেও তাকে বড় ঘরেরই মনে হল। মেয়েটাকে অপহরণ করে সুদানীদের মেলার বিক্রি করা হতে পারে ভেবে আর স্থির থাকতে পারিনি, সাথে সাথে তীর ছুড়লাম।
সেনাবাহিনীর প্রতি সুলতানের নির্দেশ ছিল এক ডজন মানুষ হত্যা করতে হলেও একটা মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। এ জন্যই সৈন্যটি দু’জনকে হত্যা করেছে। দু’জনকে জীবিত ধরার জন্য নীচে এসেই ভুল করেছিল সে।
পাহাড় থেকে নেমে ও উটে সওয়ার হল। সংগীদের নিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে এসে দেখল দু’টো লাশ পড়ে আছে। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে বাকী দু’জন।
উট নিয়ে ঘোড়ার পিছু নেয়া সম্ভব নয়। তিন জনের একজনের কাছে তীর, দু’জনের কাছে তরবারী এবং বর্শা। কাফ্রীরা চারটে ঘোড়াই নিয়ে গেছে.
সেন্ট্রিরা পার্বত্য এলাকায় অনেক খোঁজাখুজি করল তাদের। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এলেও ওরা তাদের নাগাল পায়নি।
মেয়েটার মুখে খলিফার নাম শুনেছে বলে লাশ দু’টোকে তুলে নিল ওরা। অপহরণকারীদের চেনার জন্য ওরা লাশগুলো সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে নিয়ে গেল। *
ΟΟΟΟΟ
কক্ষে পায়চারী করছেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। চোখে মুখে ক্রোধ আর উৎকণ্ঠা। কয়েকজন উপদেষ্টা মাথা নুইয়ে বসে আছেন। এর আগে সুলতানকে তারা কখনো রাগান্বিত হতে দেখেননি।
আবেগ তাকে কাবু করতে পারেনি কোনদিন। রাগান্বিত হবার মত ঘটনা ঘটলেও সব সময় ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি। শত্রু বেষ্টিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন, কেল্লায় খাবার নেই, সাহস হারিয়ে ফেলেছে সৈন্যরা। সবাই অপেক্ষা করছে কমান্ডার আত্মসর্পণের নির্দেশ দেবেন, এ পরিস্থিতিতেও সুলতান সাহস হারাননি। ফৌজকে সাহসে উদ্দীপ্ত করে ঝাপিয়ে পড়েছেন শক্রর ওপর। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। কিন্তু আজ সুলতান নিজকে সংবরণ করতে পারছেন না। তার চেহারায় ক্রোধের সাথে ভয়। এ জন্য কক্ষের সবাই চুপ মেরে আছেন।
“এই প্রথম আমার মাথা কাজ করছে না।”
সুলতান, আপনি কি খলিফার,এ নির্দেশটাকে ভুলে যেতে পারেন না? সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান আল নাসের বললেন।
চেষ্টা করছি, কিন্তু অপবাদের ধরনটা দেখেছেন? আমি হারেমের একটা মেয়েকে চুরি করেছি! আস্তাগফিরুল্লা। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন। সে আমাকে চরমভাবে অপমানই করেনি, দূত পাঠিয়ে ধমক দিয়েছে। আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতা’।
এর পরও আমার পরাশর্ম হল আপনি শান্ত হোন।’ বললেন শাদাদ।
ভাবছি, সত্যিই কি হারেমের কোন মেয়ে অপহৃত হয়েছে? আমার মনে হয় না। খোৎবা থেকে তার নাম বাদ দিয়েছি, হয়ত কোনভাবে জেনে ফেলেছে। মেয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে সে তার জবাব দিয়েছে। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। মুফতি ঈশা, মিসরের প্রতিটি মসজিদে নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিন, আগামী জুম্মা থেকে থোৎবায় কোন মসজিদেই খলিফার নাম নেয়া হবে না।”
আপনি নিজে গিয়ে খলিফার সাথে কথা বলুন। আল নাসের বললেন। তাঁকে স্পষ্ট বলে দিন, খলিফা জাতির ইজ্জতের প্রতিভূ হলেও দেশে তার হুকুম কার্যকর করা এখন সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন দেশের মাতাল। খলিফার গার্ড বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে দিন। সুদানীদের পরিবর্তে মিসরী সৈন্য দিন। প্রাসাদের জন্য নির্ধারিত সম্মানীও কমিয়ে দিন। জানি, আমাদেরকে তার মোকাবিলা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের পুরোপুরি আল্লাহর উপর নির্ভর করা উচিৎ।
আমি সব সময় আল্লাহর উপরই নির্ভর করেছি। তিনি নিশ্চয়ই এ অপবাদ ও অপমান থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দেবেন।
প্রহরী ভেতরে ঢুকল। সবাই তাকাল তার দিকে। প্র
হরী বলল, ‘একজন কমান্ডার এসেছেন। সাথে পেট্রোল ডিউটি থেকে আসা তিনজন সিপাই এবং সুদানীদের দুটো লাশ।
প্রহরীর আগমনে কক্ষের সবাই বিরক্ত হলো। এ মূহুর্তে সুলতান এক জরুরী মিটিং করছেন। সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ‘ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
কমান্ডার ভেতরে এল। ধুলোমলিন চেহারা।
তাকে বসিয়ে সুলতান প্রহরীকে বললেন ওর খাবারের ব্যবস্থা কর।
কমান্ডার বলল, টহলরত সৈন্যরা চারজন কাফ্রীর হাত থেকে একটা অপহৃত মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তীর মেরে দু’জনকে মেরে ফেলেছে। বাকী দুই কাফ্রী মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওরা বলেছে মেয়েটা বেদুঈন নয়, মনে হয় কোন বড় ঘরের মেয়ে। ও নাকি বলেছিল ও খলিফার প্রাসাদে থাকে ৷
‘হয়ত’ সুলতান বললেন, “হয়ত আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।”
তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করল সবাই।
বাইরে মাটিতে দু’টো লাশ পড়ে আছে। একটা উপুড় হয়ে। তীর বিধে আছে পিঠে। দ্বিতীয় লাশের তীর ঘাড়ে। পাশে দাড়ানো তিনজন সৈনিক। ওরা গভর্নর এবং সেনাপতিকে এই প্রথম দেখেছে।
স্যালুট করে একপাশে সরে গেল ওরা।
সুলতান ওদের সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘এ শিকার কোথেকে নিয়ে এলে?”
তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যটি এগিয়ে এসে সুলতানকে পুরো ঘটনা শোনাল |
এ মেয়েটাই কি খলিফার রক্ষিতা!’ উপদেষ্টাদের দিকে তাকিয়ে সুলতান প্রশ্ন করলেন।
তাই মনে হয়। দুটাে খঞ্জর দেখিয়ে বললেন আলী।
সৈন্যটি যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল, আলী তখন লাশের তল্লাশী নিচ্ছিলেন। ওদের পরনে গোত্রীয় পোশাক। ভেতরে বেল্টের সাথে খঞ্জর আটকানো। খলিফার গার্ড বাহিনীর বিশেষ খঞ্জর। বাটে খেলাফতের মোহর অঙ্কিত।”
খঞ্জর দু’টো চুরি না করে থাকলে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। এরাই খলিফার রক্ষিতা মেয়েটাকে অপহরণ করেছে।
লাশ তুলে নাও, খলিফার কাছে যাব।
আগে নিশ্চিত হতে হবে এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য কি না।” বললেন আলী।
কিছুক্ষণ পর রক্ষীদের একজন কমান্ডার এল। লাশ দেখানো হল তাকে। কমান্ডার বলল, ‘এরা গার্ড বাহিনীর সদস্য। তিনদিন আগে ওরা এক হস্তার জন্য ছুটি নিয়েছে।
আর কেউ ছুটিতে আছে? প্রশ্ন করলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী।
‘এদের সাথে আরও দু’জন ছিল।’
‘এরা কি একত্রেই গেছে?”
হ্যা।’
কমান্ডার এমন তথ্য প্রকাশ করল, শুনে সবাই চমকে উঠলেন। সে বলল, ‘এরা সুদানের জংগী উপজাতির লোক। ফেরাউনের সময় থেকে ওদের মধ্যে কিছু রসম চলে আসছে। প্রতি তিন বছর পর ওদের একটা উৎসব হয়, মেলা বসে। চলে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত। চতুর্থ রাতে থাকে ভরা পূর্ণিমা।
এ গোত্রের লোক ছাড়া অন্যরাও মেলায় অংশ গ্রহণ করে। ওরা যায় ফুর্তি করার জন্য। ওখানে মেয়েদের বেচাকেনা হয়।
মেলা বসার একমাস আগে থেকেই কায়রো পর্যন্ত আশপাশের যুবতী মেয়েদের পিতামাতারা আতঙ্কে সময় কাটায়। যতটা সম্ভব সতর্ক থাকে ওরা। মেয়েদের একা বের হতে দেয়না। বেদুঈনরা মেয়ে চুরি করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। যুবতীদের ধরে এনে মেলায় বিক্রি করে।
এ চারজন সুদানীও মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য ছুটি নিয়েছে। তিন দিন পর মেলা শুরু হচ্ছে।’
হারেমের মেয়েটাকে এরাই চুরি করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।
নিশ্চিত করে বলা যায়না। তবে এ সময় জীবনবাজি রেখেও ওরা, মেয়ে চুরি করে। কোন অভিভাবক মেয়েকে আনতে গেলে তাকেও হত্যা করে। মিসরের আমীর-ওমরা, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও সরকারী কর্মকর্তারাই এসব মেয়েদের গ্রাহক। মেলায় অস্থায়ী পতিতালয়ের ব্যবস্থা থাকে। মদ আর জুয়া চলে রাতভর। শেষ রাতটি হয় রহস্যে ঘেরা।
গোপন স্থানে অনন্যা সুন্দরী এক যুবতীকে বলি দেয়া হয়। মেয়েটাকে কোথেকে আনা হয় বা কিভাবে বলি দেয়া হয় কেউ জানেনা। এ কাজ সম্পন্ন করে ধর্মীয় গুরু। জংলীরা তাকে ঈশ্বরের মত সম্মান করে।
বলি অনুষ্ঠানে ধমীয় গুরু ছাড়াও চার পাচজন যুবতী এবং ক’জন বিশিষ্ট লোক উপস্থিত থাকে। দর্শকদের দেখানো হয় মেয়েটার কাটা মাথা এবং রক্ত। জংলীরা তখন মদপান করে পাগলের মত নাচতে থাকে।
খলিফার গার্ড বাহিনীকে ষ্ট্যান্ডবাই করে রাখা হয়েছিল। সকাল থেকে রোদের মধ্যে দাড়িয়ে আছে ওরা। এখন সূর্য ডুবোডুবো। খাদ্য পানি কিছুই দেয়া হয়নি।
রজব বার বার ওদের সামনে এসে ঘোষণা করছিল, ‘তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া অপহরণ সম্ভব নয়। যে অপহরণকারীকে সাহায্য করেছ সামনে আস। না হয় সবাইকে না খাইয়ে মারা হবে। সে যদি স্বেচ্ছায় গিয়ে থাকে তবুও তোমরা দেখেছ।
কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছিল না। সবাই বলছে, তারা কিছুই জানেনা।
খলিফা রজবকে একদম বিশ্রাম দিচ্ছেন না | রজব! মেয়েটাকে অপহরণ করা হয়েছে এতে আমার দুঃখ নেই। ভাবছি এমন কঠোর প্রহরা থেকে যে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে সে আমাকেও হত্যা করতে পারে। সালাহউদ্দীন এ কাজ করেছে এর প্রমাণ হাজির কর।’
সুলতান আয়ুবীর উপর মেয়ে চুরির অপবাদ দেয়া সহজ, কিন্তু রজব তার প্রমাণ দেবে কিভাবে? সে মহা ফ্যাসাদে পড়ল।
রাগের চোটে সে একবার যাচ্ছে রক্ষীদের কাছে, আবার খলিফার ডাকে ছুটে যাচ্ছে তার কাছে।
রক্ষীদের ধমকাচ্ছিল রজব। প্রহরী ফটক খুলে ঘোষণা করল, মিসরের গভর্নর আসছেন।”
ভেতরে প্রবেশ করল আয়ুবীর ঘোড়া। সামনে দু’জন দেহরক্ষী। পেছনে আটজন ঘোড়সওয়ার। একজন ডানে, একজন বায়ে, উপদেষ্টারা পেছনে। এদের সাথে আলীও রয়েছেন।
রজব সুলতানের আগমনের সংবাদ দিল খলিফাকে। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকল। পেছনে একটি টাংগায় দুটি লাশ। একটা রয়েছে চিৎ হয়ে, অন্যটা উপুড় হয়ে। তীর বিধে আছে দু’টো লাশের শরীরে।
খলিফা এগিয়ে এলেন। সালাহউদ্দীন আয়ুবী নামলেন ঘোড়া থেকে। সাথে সাথে সংগীরাও নেমে পড়ল। সুলতান এগিয়ে খলিফাকে সালাম করে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
হারেমের চুরি যাওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ আমি পেয়েছি। আমি নিয়ে এসেছি আপনার দু’জন রক্ষীর লাশ। এরাই আমাকে নিরপরাধ প্রমাণ করবে। আপনাকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আয়ুবী আপনার সেনাবাহিনীর সৈন্য নয়। আপনি যে খেলাফতের প্রতিনিধি, আয়ুবীকে সেখান থেকেই পাঠানো হয়েছে।
আয়ুবীর মনের অবস্থা বুঝে ফেললেন খলিফা। পাপের ভারে পিষ্ট হচ্ছিল তার বিবেক। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর ব্যক্তিত্বের সামনে দাড়ানোর শক্তি তার ছিল না।
সুলতানের কাঁধে হাত রেখে খলিফা বললেন, ‘তোমাকে আমি নিজের সন্তানের চাইতে বেশী স্নেহ করি সালাহউদ্দীন ‘
আমি এখন আসামী। আমাকে এখন নিজের সাফাই পেশ করতে হবে। আল্লাহ আমার সাহায্যে এ দু’টো লাশ পাঠিয়েছেন। ওদের নীরবতা এবং ওদের দেহের বিদ্ধ তীর বলবে, আয়ুবী অপরাধী নয়। নিজকে নিরপরাধ প্রমাণ না করা পর্যন্ত আমি ভেতরে যাব না।”
তিনি লাশের দিকে হাটা দিলেন। খলিফা কাঁচুমাচু হয়ে তার পেছনে চললেন। সুলতান গার্ডদের সামনে লাশ দুটি রেখে বললেন, ‘প্রথমে কমান্ডার ও পরে আটজন করে এক সাথে এগিয়ে এসে বল কার এ লাশ।
এগিয়ে এল কমান্ডার। লাশ দেখে ওদের নাম বলল। এরা আমাদের গার্ডবাহিনীর সদস্য। আটজন করে এসে লাশ দু’টো গার্ড বাহিনীর বলে শনাক্ত করল।
সালাহউদ্দীন, বুঝলাম এ দু’টো গার্ড বাহিনীর সদস্যের লাশ। তার আগে বল এদের কে হত্যা করেছে?
সালাহউদ্দীন আয়ুবী পেট্রোল ডিউটির সৈন্য তিনজনকে ডাকলেন। ওরা খলিফাকে রাতের কাহিনী শোনাল। ওদের বলা শেষ হলে সুলতান সুদানী কাফ্রীদের মেলায় বিক্রি করার জন্য।’
খলিফা সুলতানকে ভেতরে যেতে বললেন। তিনি ভেতরে যেতে অস্বীকার করে বললেন, আমি মেয়েটাকে এনে আপনার সামনে হাজির হব। শুধু বলব, উপহার হিসেবে পাওয়া এ মেয়েটা আপনার স্ত্রী নয় রক্ষিতা। আমার কাছে এ মেয়ে মূল্যহীন। আল্লাহ আমাকে এরচে অনেক গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন।
একটা মেয়ে চুরি হয়েছে বলে আমি শঙ্কিত নই। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে এভাবে মেয়েরা অপহৃত হতে থাকলে দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির কি হবে?
আর আমার দুঃশ্চিন্তা হল মুসলিম বিশ্ব অপহৃত হচ্ছে, এর থেকে জাতিকে কিভাবে রক্ষা করা যায়। আপনি ভাববেন না, আমার গোয়েন্দারা মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে।
সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে খলিফা বললেন, সালাহউদ্দীন, কিছুদিন থেকে দেখছি তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ। আমি তোমার পিতা নাজমুদ্দীনকে ভীষণ সম্মান করতাম। কিন্তু তুমি আমাকে মোটেও সম্মান করনা। আজই শুনলাম জামে মসজিদের খতিব আমিরুল আলেম নাকি থোৎবা থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে। তার এ অপরাধের শাস্তি আমি দিতে পারি। কিন্তু ভাবছি, সে তো তোমার আশকারা পেয়ে এমনটি করেনি?’ ‘
আমার আশকার পেয়ে নয় আমার নির্দেশে খতিব এ কাজ করেছেন। শুধু আপনার নাম নয়, এখন থেকে আপনার পরে যত খলিফা আসবেন থোৎবায় কারও নামই থাকবে না।”
এ পদক্ষেপ ফাতেমী খেলাফতকে দুর্বল করার জন্য নেয়া হয়েছে। মনে হয় এখানে আব্বাসী খেলাফত নিয়ে আসার পরিকল্পনা হচ্ছে।
হুজুরের অনেক বয়স হয়েছে। মাথাটাও ঠিকমত কাজ করে না। কোরানে মদ হারাম করেছে কারণ মদ মানুষের মস্তিষ্ক দুর্বল করে দেয়। আমি ভাবছি আপনার গার্ডবাহিনী পরিবর্তন করব। রজবের স্থানে অন্য কমান্ডার দেব |
কিন্তু রজবকে তো আমি রাখতে চাই।
সামরিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য হুজুরের কাছে অনুরোধ করব |”
আলীর দিকে তাকালেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। পাঁচজন কাফ্রী সেপাই নিয়ে এগিয়ে আসছেন তিনি।
এ পাঁচজন সেই গোত্রের। কমান্ডার বলেছে, এরা আগামী পরশু ছুটিতে যাচ্ছে। আমি এদেরকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। অপহরণে ওদের হাত থাকতে পারে।’
সালাহউদ্দীন আয়ুবী রজবকে ডেকে বললেন, কাল থেকে এখানে অন্য কমান্ডার আসবে। তুমি যাবে আমার কাছে। তোমাকে মেনজানিক কামানের দায়িত্ব দেব। রজবের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কাফ্রী দু’জন মেয়েটাকে নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল। এখন আর ধরা পড়ার ভয় নেই। থামল ওরা। আরেকবার পালাতে চাইল মেয়েটা।
কাফ্রী বলল, ‘পালানোর বৃথা চেষ্টা করছ। পালাতে পারলেও এ বিজন মরু থেকে যেতে পারবে না। আমরা তোমার ইজ্জত নষ্ট করতে চাই না।’
অবশ্য এখন পর্যন্ত ওরা সে চেষ্টা করেনি। আশ্চর্য হল উম্মে আমারা।
তার মাদকতাময় দেহ ওদের আকর্ষণ করেনি। যে দু’জন মারা গেছে তাদের একজন তার সামনে হাটু গেড়ে বসে নিজকে কষ্টে না ফেলার জন্য আবদার করেছিল। ও জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
ওরা বলল, তুমি হবে আকাশের দেবতার রাণী।
ওরা আমারার চোখ বেঁধে ঘোড়ায় তুলে নিল। পালানোর চেষ্টা করা বৃথা। ও আর মুক্ত হবার চেষ্টা করল না, ঘোড়ায় বসে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল।
এক জায়গায় থেমে ওকে পানি পান করান হল। অনেকক্ষণ পর বাতাসের শীতল স্পর্শ অনুভব করল ও। রাত হয়েছে, ভাবল ও। দীর্ঘ পথশ্রমে ও ক্লান্ত শ্ৰান্ত। ব্যথায় শরীর ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ে আতংকে চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলছে।
ঘোড়া থামল। ভেসে এল চার পাঁচজন নারী পুরুষের কণ্ঠ। পথে কাষ্ট্রীরা ওর সাথে আরবীতে কথা বলেছে। এখন ওদের ভাষা বোঝা যাচ্ছে না। ওরা ওর চোখের বাধন খুলল না।
বোবা হয়ে গেছে উন্মে আমারা। এক ব্যক্তি ওকে পাল্কীতে তুলে দিল। শুরু হল দ্বিতীয় যাত্রা।
দফের শব্দের সাথে ভেসে এল নারী কষ্ঠের গান। গানের ভাষা ও বুঝতে পারল না। সুরে এক মোহময় আবেশ।
আতংক বেড়ে গেল ওর। রাতের নিঃশব্দ প্রকৃতিতে এক মাতাল করা আবহ সৃষ্টি হল। উম্মে আমারা পালকি থেকে লাফিয়ে পালাতে চাইছিল, চাইছিল এরা ওকে মেরে ফেলুক। কিন্তু সাহস হলনা।
ওর মনে হল এরা মানুষ নয়, ভিন গ্রহের অন্য কোন শক্তি। নিজের ইচ্ছায় সে এখন কিছুই করতে পারবে না।
বেহারারা সিড়ি ভাঙছে। প্রায় ত্ৰিশটা সিড়ি অতিক্রম করে সমতল ভূমিতে চলতে লাগল ওরা। থামল বেহারারা। কাধ থেকে পান্ধী নামাল।
চোখের বাধন খুলে একজন চোখের ওপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে ফাক হল আঙ্গুল। ঝাপিয়ে পড়ল আলো। হাত সরে গেল। ও দাড়িয়ে আছে হাজার বছরের এক পুরনো বাড়িতে।
বাড়িটি পুরোনো হলেও আলোয় ঝলমল করছে বিরাট হলঘর। প্রাচীরের সাথে আটকানো লাঠির মাথায় মশাল জুলছে। দফ বাজছে। ভেসে আসছে নারী কষ্ঠের গান। কক্ষের বাতাসে অনাঘ্ৰাত সুবাস। এ যেন এক স্বপ্নপুরী।
সামনে তাকাল ও। উচু বেদী। আট দশটি সিড়ি রয়েছে। বেদীর ওপর অবাক করা এক পাথরের মূর্তি।
মাথা এবং মুখ বিশাল। থুতনির ঈষৎ নিচে গলা, ঘাড়। থুতনি থেকে মাথা পর্যন্ত উচ্চতা দু’জন মানুষের সমান। দাতের মাড়ি দেখলে মনে হয় মুর্তিটি হাসছে। হা করা মুখ। একজন মানুষের মাথা সে পথে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে।
মূর্তির দু’কানে গোঁজা লাঠির মাথায় মশাল। দু’হাত লম্বা চোখ। এক সময় চোখ দুটি জ্বলে উঠল। স্বচ্ছ নীল আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল কক্ষে। বদলে গেল গানের সূর।
মূর্তির মুখের ভেতর আলোকিত হয়ে উঠল। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দু’জন লোক। পরনে আজানুলম্বিত জুব্বা। লোক দুটাে কাল। মাথায় রং বেরঙের পালকের মুকুট।
চত্বর থেকে নীচে নামার তিনটে সিড়ি। লোক দুটাে সিড়ির দুপাশে দাড়িয়ে পড়ল।
মুর্তির মুখ থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। বয়স্ক মানুষ, পরনে লাল জুব্বা। মাথায় মুকুট। দু’কাঁধে ফনা ধরে কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে দু’টো কাল সাপ।
বৃদ্ধ এ গোত্রের পুরোহিত। মোহাবিষ্টের মত দাঁড়িয়ে আছে উম্মে আমারা।
বৃদ্ধ সিড়ি ভেঙে নেমে এল। হাটু গেড়ে বসল মেয়েটার কাছে। ওর দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমো খেল। অনুচ্চ কষ্ঠে বলল, তুমি ভাগ্যবতী। আমাদের দেবতা তোমাকে পসন্দ করেছেন। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উম্মে আমারা কেঁদে বলল, আমি দেবতা বিশ্বাস করি না। তোমরা যে দেবতাকে মানো তার দোহাই, আমায় ছেড়ে দাও। আমাকে এখানে কেন এনেছ?
এখানে যে আসে প্রথম প্রথম সে এ কথাই বলে। যখন এ পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানতে পারে আর যেতে চায় না।
তুমি মুসলমানদের খলিফার প্রেমিকা, কিন্তু পৃথিবীর রাজা বাদশা এবং দেবদূতরা যার সামনে মাথা নোয়ায় তিনি তোমায় পসন্দ করেছেন। তুমি স্বর্গে এসেছ।
জুব্বার ভেতর থেকে একটা ফুল নিয়ে পুরোহিত মেয়েটার নাকের সামনে তুলে ধরল। উম্মে আমার হারেমের রাজকুমারী। বিভিন্ন আতর গোলাপের গন্ধের সাথে পরিচিত। এ ফুলের ঘ্ৰাণ তার কাছে নতুন মনে হল। হৃদয়ের গভীরে পৌছে গেল ফুলের সুবাস। তার দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটল। বদলে গেল অভিব্যক্তি।
ফুলটা সরিয়ে নিয়ে পুরোহিত বলল, “দেবতার দেয়া উপহার।
হাত প্রসারিত করল উম্মে আমারা। পুরোহিতের ফুল ধরা হাত টেনে আবার নাকের কাছে নিয়ে এল। জড়ানো কষ্ঠে বলল, চমৎকার উপহার। আমায় দেবেন না?”
তুমি এ উপহার খুশি মনে গ্রহণ করছ? পুরোহিতের ঠোঁটে মৃদু হাসি।
হ্যাঁ, আমি এ উপহার আনন্দের সাথেই গ্রহণ করছি।”
ও আবার ফুল শুকল। আবেশে বন্ধ হল ওর চোখ দু’টো।
‘তুমি দেবতার ফুল গ্রহণ করেছো, দেবতাও তোমায় গ্রহণ করেছেন!’ পুরোহিত বলল, এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?
পুরোহিতের দিকে তাকাল মেয়েটা। স্মরণ করার চেষ্টা করছে। মাথা ঝুকিয়ে বলল, এখানেইতো ছিলাম, নাকি অন্য এক কোথাও ছিলাম, কি জানি, কোথায় ছিলাম মনে করতে পারছি না।’
‘কে তোমাকে এখানে এনেছে?’
কেউ না, আমি নিজেই এসেছি।
‘তুমি ঘোড়ায় চড়ে আসনি?’
‘না, আমি উড়ে এসেছি।’
‘আসার পথে বিজন মরু, পাহাড় আর বন জংগল পড়েনি?’
না তো! চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ।
“তোমার চোখ বেঁধে দেয়া হয়েছিল?”
না, না, আমার চোখ খোলাই ছিল? পথে কত রংবেরঙের সুন্দর সুন্দর পাখী, ফুল, প্রজাপতি দেখেছি।”
পুরোহিত তারপর কি যেন বলল, উম্মে আমারা বুঝতে পারল না। উন্মে আমারা দেখল তার চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে চারটি মেয়ে।
ওরা তার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর হাত দিল উম্মে। আমারার গায়ে। মেয়েগুলো তার দেহের সব কাপড় খুলে নিল। উম্মে। আমারা বিবস্ত্র হয়ে পড়ল।
মৃদু হেসে উন্মে আমারা বলল, দেবতা এভাবে আমাকে পসন্দ করবেন?’
না, তোমাকে দেবতাদের কাপড় পরানো হবে।
মেয়েরা তার কাধের উপর চাদর বিছিয়ে দিল। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে গেল সে চাদরে।
চাদরের মাথায় বেঁধে দেয়া হল রংগীন ফিতা। উম্মে আমারার সোনালী চুল আঁচড়ে কাধে ছড়িয়ে দিল একটা মেয়ে।
পুরোহিত মুচকি হেসে ঘুরে মুর্তির দিকে হাঁটা দিল। মেয়েরা উন্মে আমারার হাত ধরে পুরোহিতের পিছু নিল।
রাজকুমারীর মত এগিয়ে চলল ও। কোন দিকে তাকাচ্ছে না।
গানের সুর আরও আকর্ষণীয় মনে হল তার কাছে। সিঁড়িতে পা রাখল ও। মূর্তির মুখে প্রবেশ করল পুরোহিত। সিড়ি পেরিয়ে ঢুকে গেল মুর্তির ভেতরে।
মুর্তির কাছে এসে থেমে গেল মেয়েরা। মুর্তির গলা থেকে সিড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। ও সিড়ি ভেংগে একটা অপ্রশস্ত কক্ষে এল।
সুবাসিত কক্ষে আলো জুলছে। দেয়াল এবং ছাদ গাছের পাতা ফুলে ঢাকা। একপাশে সুন্দর সোরাহী এবং গ্লাস।
পুরোহিত সোরাহী থেকে দু’টো গ্লাস ভরল। উম্মে আমারাকে একটা দিয়ে নিজে অন্যটা ঠোঁটে ছোয়াল।
দেবতা কখন আসবেন? প্রশ্ন করল ও।
‘তুমি এখনো তাকে চিনতে পারনি? তোমার সামনে কে দাড়িয়ে . আছেন?’
তার পায়ের কাছে বসে ও বলল, হ্যা, চিনতে পেরেছি। তুমি উপরের সে লোক নও। তুমি দেবতা। তুমি কি আমায় গ্রহণ করেছ?”
হ্যাঁ, আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী। –
বাবার কাছে শুনেছি, পুরোহিত মেয়েটাকে ফুল শুকতে দেয়। সে তখন নিজের পরিচয় ভুলে যায়। কোথেকে এসেছে, কিভাবে আনা হয়েছে কিছুই মনে থাকে না। পুরোহিত যা বলে তাই করে। নিকৃষ্ট জিনিসও তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। পুরোহিতের সাথে মাটির নীচের কক্ষে থাকতে হয় তিন দিন। এর বেশী আমি আপনাকে বলতে পারবনা।” পাঁচজন কাফ্রীর একজন বলল আলী বিন সুফিয়ানকে।
উম্মে আমারা অপহরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনি খলিফার পাঁচজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এসেছিলেন। এরা ছিল সে জংলী গোত্রের লোক।
গোয়েন্দা প্রধান ওদেরকে মেয়েটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। অজ্ঞতা.প্রকাশ করল ওরা।
তিনি ওদের লোভ দেখালেন। বললেন, তোমাদেরকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। কিন্তু মুখ খুললনা ওরা।
ওদের গোত্র ছিল জংলী এবং হিংস্র প্রকৃতির। শাস্তির ভয়ে ভীত নয়। পাঁচজনই অনড়। কেউ মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানে না।
আলী ওদের পাঠিয়ে দিলেন শাস্তি সেলে। সেখানে মুর্তির মুখ থেকেও কথা বের হয়। পাঁচজন সুদানী ছিল অত্যন্ত কঠোর প্রাণ। রাতভর ওদেরকে শাস্তি দেয়া হল। ওদের সাথে জেগে রইলেন আলী।
অবশেষে শেষ চেষ্টা করা হল। উপুর করে শুইয়ে হাত পা রশি দিয়ে বেধে ফেলা হল। পা আটকানো হল আংটার সাথে। হাতের রশির প্রান্ত বাধা হল একটা চাকার সাথে।
এ শাস্তিতে চাকা ঘুরলেই বাহু কাধ থেকে এবং পাউরুর গোড়া থেকে ছিড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। হঠাৎ চাকা থামিয়ে দেয়া হয়। ঘুরানো হয় আবার। অজ্ঞান হয়ে যায় অপরাধী। ওদের উপর এ শাস্তি চলল।
শেষ রাতে মাঝ বয়েসী এক কাফ্রী বলল, আমি সব জানি, কিন্তু দেবতার ভয়ে কিছুই বলব না। দেবতা আমায় নিকৃষ্ট মৃত্যু দেবেন।
যে ভাবে তোমাদের মারা হচ্ছে এরচে’ ভয়ংকর মৃত্যুও কি হতে পারে? আলী বললেন, ‘তোমাদের দেবতা সত্যি হলে এ শাস্তি থেকে তোমাদের সে অবশ্যই রক্ষা করতো। তোমরা যদি সত্যি কথা বলো, তাহলে আমাদের কাছে এমন দেবতা আছে যে তোমাদেরকে তোমাদেরদের দেবতার আক্রোশ থেকে রক্ষা করবেন।
বন্দীর চোখে দেবতার পরিবর্তে ভেসে উঠছিল মৃত্যুর বিভীষিকা। মুখ খুলতে রাজি হল কাফ্রী। তার বাঁধন খুলে দেয়া হল। তাকে খাবার ও পানি দেয়া হল। খাওয়ার পর শুইয়ে দেয়া হল আলাদা এক ঘরে।
লম্বা ঘুম দিল লোকটা। ঘুম থেকে জেগে সে স্বীকার করল, তার গোত্রের লোকেরাই উম্মে আমারাকে অপহরণ করেছে। চারজন ছুটিতে যাওয়ার সময় অপহরণের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিল। সে রাতে এ পাঁচজনের ডিউটি ছিল। চারজনের দু’জন ভেতরে এসেছিল। অপহরণে এরা পুরো সহযোগিতা করেছে।
প্রতি তিন বছর পর মেলা হয়। বলি দিতে হয় একটা মেয়ে। তবে শর্ত হচ্ছে, মেয়ে সে গোত্রের হতে পারবেনা। সে হবে বিদেশী কোন উচু বংশের। ফর্সা এবং সুন্দরী। এমন সুন্দরী যার দিকে দর্শকরা হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে।
তার মানে প্রতি তিন বছর পর তোমাদের গোত্র একটা মেয়েকে বলি দেয়, আর তোমরা একটা সুন্দরী যুবতী অপহরণ কর!’
তা ঠিক নয়। তিন বছর পর মেলা বসে। প্রতি পাঁচ মেলার পর একটা মেয়ে বলি দেয়া হয়। যারা জানে না প্রতি মেলায় বলি দেয়া হয় এ কুথা কেবল তারাই বলে।
বলিটা কোথায় দেয়া হয়?’
বলির স্থানের বর্ণনা করল কাফ্রী। পুরোহিতকে মনে করা হয় দেবতার সন্তান। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে মাইল দেড়েক দূরে পার্বত্য এলাকা। সে পার্বত্য এলাকার এক দূর্গম জংগলে দেবতা থাকেন। দেবতার সেবার জন্য আছে অন্সরী।
ধুধু মরুভূমির মাঝে দ্বীপের মত এক জায়গায় দেখা যাবে সবুজের সমারোহ। মনে হবে প্রকৃতির লীলা।
ওখানে রয়েছে ফেরাউনের সময়কার পুরাকীর্তি। ঝিলে রয়েছে ছোট। ছোট কুমীর। গোত্রের কেউ মারাত্মক অপরাধ করলে পুরোহিতের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। পুরোহিত তাকে নিক্ষেপ করে ঝিলে।
তিনি ওই প্রাচীন বাড়ীতেই থাকেন। প্রতি পনর বছরের শেষ দিন বাইরে থেকে একটা মেয়ে চুরি করে বলি দেয়া হয়। মেয়েটা তার সাথে থাকে কয়েকদিন। এছাড়া থাকে চারজন পুরুষ এবং চারজন সুন্দরী তরুণী।
অন্য কেউ ওখানে যেতে পারেনা। বেদিতে নেয়ার সময় মেয়েটা বুঝতেই পারেনা তাকে হত্যা করার জন্য নেয়া হচ্ছে। তার চেহারায় থাকে আনন্দ এবং গর্ব। দেহ থেকে মাথা কেটে দেহটা ফেলে দেয়া হয় ঝিলে। চুলগুলো গোত্রের লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। এ চুল ওদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র।
এরপর কাটা মাথা শুকিয়ে একটা গুহায় রেখে দেয়া হয়। পনর বছর পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এখন মেয়ে বলি দেয়া হবে। আমরা একই গোত্রের নয়জন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। সাহসী এবং জংলী বলে আমাদেরকে গার্ড বাহিনীতে নেয়া হয়েছে। দু’মাস আগে মেয়েটাকে দেখে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। এত রূপসী মেয়ে আমরা আর কখনও দেখিনি।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে বলি দেয়ার জন্য চুরি করব। আমাদের একজন গোত্রের সর্দারকে বলেছে বলি দেয়ার জন্য এবার আমরা মেয়ে দেব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা উম্মে আমারাকে অপহরণ করেছি।’
এসব কথা সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে শোনান হল। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ান তার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। এলাকার ম্যাপ খুলে সুলতান বললেন, “এ স্থান আমাদের সীমানার বাইরে। আলী! তোমার দেয়া তথ্য শুনে মনে হয় ফেরাউন মরে গেলেও এখনও ফেরাউনের প্রেতাত্মা বেঁচে আছে। মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য সর্বপ্রকার শিরক এবং কুফরের মূলোৎপাটন করা, আজ পর্যন্ত কত নিষ্পাপ মেয়ে বলি দেয়া হয়েছে, মেলায় বিক্রির জন্য অপহৃত হয়েছে কত যুবতী তার হিসেব নেই। মানুষের মন থেকে দেবতার ভয় দূর করতে হবে। এদের ধর্মীয় গুরুরা মেয়েদের অপহরণ করিয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে।
আমাদের কিছু ফৌজি অফিসার এবং শহরের বিত্তশালীরা মেয়েদের কিনে নিয়ে আসে। আলী বললেন, সমাজের চরিত্র নষ্ট হওয়া ছাড়াও আমাদের সাবেক সুদানী ফৌজের সাথে বর্তমান সেনা সদস্যরা মেলামেশা করছে। এর পরিণতি শুভ নয় |
এরপর খানিকটা সংকোচের সাথে আলী বললেন, ‘মেয়েটাকে জীবিত এনে খলিফার হাতে তুলে দেয়া জরুরী। তাহলে খলিফা বুঝবেন আপনাকে দেয়া অপবাদ ভিত্তিহীন।
‘খলিফা কি বলল না বলল তার পরোয়া করিনা | আমি নিজকে নিয়ে ভাবিনা। ইসলামের কাজ করতে গিয়ে আমাকে যে যত নিকৃষ্টই বলুক তাতে কিছু যায় আসে না।
আলী, নিজের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাও। নিবদ্ধ কর দেশের কল্যাণের দিকে। ইসলাম এবং দেশ রক্ষার দায়িত্ব খলিফার। কিন্তু এখন আমাদের খলিফারা আত্মপূজায় হারিয়ে গেছে। ওরাই এখন ইসলামের সবচে; দুর্বল দিক। এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে খ্রিষ্টান শক্তি। সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করতে চাইলে নিজের কথা ভুলে যাও।
খলিফার দেয়া অপবাদ আমি অনেক কষ্টে বরদাশত করেছি। এর জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু এতে রাজনীতি ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার হতে থাকবে। আমার আশংকা ছিল, মুসলিম বিশ্ব কোন এক সময় ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিপূজা, আত্মম্ভরিতা, স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিন্সার ক্রীড়নকে পরিণত হবে।’
অপরাধ ক্ষমা করুন সম্মানিত আমীর। মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইলে আমাদের হাতে সময় খুব কম। আগামী পরশু মেলা শুরু হবে।’
কোন সেনা সদস্য মেলায় শরীক হতে পারবে না, আমার এ নির্দেশ এখনি ছাউনিতে পৌছে দাও। নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি পঞ্চাশ বেত্ৰাঘাত। এ জন্য কারও পদমর্যাদা দেখা হবে না।’
নির্দেশ পৌছে দেয়া হল। সেনা অফিসারদের ডেকে সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, “ওদের কুসংস্কার ভেঙে দিতে হবে। মনে হচ্ছে এটিই ফেরাউনের শেষ চিহ্ন ‘
প্রথমেই সেনা অভিযানের প্রস্তাব এল। কিন্তু এতে গোত্রের লোকেরা সামরিক আক্রমণ ভেবে বেঁকে যেতে পারে। ফলে মারা পড়বে অনেক দর্শক এবং নিরপরাধ নারী ও শিশু।
কাফ্রী পাঁচজনকে সাথে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করল কেউ। সুলতান এ প্রস্তাবও নাকচ করলেন। কাফ্রীরা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করতে পারে ‘
উপ সামরিক প্রধান আল নাসের এবং আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘পার্বত্য এলাকায় যাবে বারজন কমান্ডো সদস্য। কাফ্রীদের দেয়া তথ্যে মনে হয় মেলা হয় জাঁকজমকের সাথে। অথচ মেয়েটাকে কোথায় বলি দেয়া হয় দর্শকদের কেউ তা জানে না।
তাই সাধারণ পোশাকে পাচশত সশস্ত্র সৈনিক দর্শকদের সাথে মিশে যাবে। বলির স্থান খুঁজে বের করবে এরা।
ওদের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কমান্ডোরা অভিযান চালাবে। কমান্ডোরা কাপড়ে আগুন লাগিয়ে উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেই কেবল পাঁচশত সৈনিক সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করবে।
কমান্ডো বাহিনীর সদস্যদের বলা হল, মেয়েটাকে যখন বেদীতে চড়ানো হবে তখনই কেবল হামলা করবে। এর আগে পাহারাদারদের মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ আগে হলে ওরা হয়ত মেয়েটাকে বন্ধ কক্ষেই হত্যা করবে অথবা লুকিয়ে ফেলবে।
মেয়েটাকে বলি দেয়া হবে মাঝ রাতে। কমান্ডো বাহিনীকে তার পূর্বেই পৌছতে হবে পার্বত্য এলাকায়। ধরা পড়লে সমগ্র পরিকল্পনাই পন্ড।
নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো বাহিনী থেকে অভিযানের জন্য সদস্য নির্বাচন করা হল। এরা ছিল আরব। সুদানের নোংরা রাজনীতি এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত। ইসলাম ছিল ওদের একমাত্র লক্ষ্য। ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী প্রতিটি কাজের বিরুদ্ধে এরা ছিল সোচ্চার।
ওদেরকে অভিযানের গুরুত্ব এবং কর্মপদ্ধতি বুঝিয়ে দেয়া হল। এ অভিযানে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে ঠিকই, আবার এমনও হতে পারে, হয়ত কোন সংঘর্ষই হবে না।
বলি দানের আর মাত্র ছ’দিন বাকী। তিনদিন তিন রাত ওদের ট্রেনিং দেয়া হল। চতুর্থ দিন কমান্ডো বাহিনীকে পাঠানো হল উটে চড়িয়ে।
দেড় দিনের সফর। উটের চালককে নির্দেশ দেয়া হল ওদেরকে পাহাড় থেকে খানিক দূরে নামিয়ে ফিরে আসতে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পাঁচশ সৈন্য রওয়ানা হল উট ও ঘোড়ায় চড়ে। বাহন এবং অস্ত্রশস্ত্র ওদেরকে সাথে রাখতে হবে। ছদ্মবেশে সৈন্যদের সংগী হলেন কমান্ডার।
মেলার শেষ রাত। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হাসছে মরুর বালুকারাশি। মেলায় উপচে পড়া ভিড়। কোথাও নাচছে অর্ধ ংগ মেয়েরা। গানের আসর জমেছে কোথাও।
সবচে বেশী ভিড় মেয়ে বিক্রির হাটে। একটা মেয়ে তুলে আনা হয় চত্বরে। গ্রাহকরা দেখে।
কেউ দেখে দাঁত, কেউ চুল। দেহের বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গ দেখার পর হয়।
জুয়ার আডডা এবং মদের আসরও জমে উঠেছে। এসব ব্যাপারে এখানে আইনের কোন কড়াকড়ি নেই।
মেলার চারপাশে দর্শকদের জন্য টানানো তাবু। নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম এবং সামাজিকতার বাধন থেকে মুক্ত এরা। এরা এসেছে অবাধ স্ফুর্তি ও আনন্দের জন্য। পাশের পাহাড়ে কি হচ্ছে তা জানার কোন আগ্রহ নেই তাদের।
ওরা জানত, পাহাড় ঘেরা স্থানটি দেবতাদের আবাস। দেবতাদের পাহারা দেয় জীন এবং ভূতের দল। কোন মানুষ ওখানে গেলে জীবন নিয়ে ফিরতে পারে না। ওরা জানেনা খানিক দূরের সেই পাহাড়ের কোলে এক সুন্দরী যুবতীকে বলি দেয়ার জন্য তৈরী করা হচ্ছে। দেবতা হচ্ছেন একজন মানুষ।
ওরা এও জানত না, দর্শক বেশে মেলায় রয়েছে পাঁচশ খোদার সৈনিক। বারজন কমান্ডো সদস্য পৌছে গেছে দেবতাদের পাহাড় ঘেরা আস্তানায়।
কমান্ডো বাহিনীকে বলা হয়েছিল পাহাড়ের আশপাশে দৃশ্যতঃ কোন পাহারা থাকবে না। ওখানে পাহারা দেয় অদৃশ্য জীন ও ভুত। কিন্তু দেখা গেল কাফ্রীর বক্তব্য ঠিক নয়। আস্তানার চার পাশে সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে।
পার্বত্য এ এলাকাটা মাইলখানেক দীর্ঘ এবং প্রশস্ত। কমান্ডো সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগিয়ে চলল আস্তানার দিকে।
হঠাৎ একজন দেখল গাছের কাছে একটা ছায়া নড়ছে। হামাগুড়ি দিয়ে ছায়ার পেছনে চলে গেল সে ঝাপিয়ে পড়ল ছায়াটার ওপর। এক হাতে পেচিয়ে ধরল গলা। অন্য হাতের খঞ্জর তার বুকে ছুইয়ে বলল, “এখানে কি করছ? কিভাবে পাহারা দিচ্ছ তোমরা?”
আরবী বুঝল না কাফ্রীটা ততোক্ষণে আরেকজন কমান্ডো চলে এসেছে। এবার তাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করা হল, কিন্তু কিছু বলল না সে।
আরও পাহারাদার আছে বলে সন্দেহ হল ওদের। কাফ্রটাকে নিকেশ। করে ওরা সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল। কিছুদূর গিয়েই আবার দেখা পেল পাহারাদারের। এভাবে বেশ কয়েকটা বাধা ডিঙিয়ে ওরা জংগলের প্রান্তে এসে পৌছল।
সামনে জংগল, তারপর পাহাড়। চাঁদ উঠে আসছে উপরে। ওরা গাছের ছায়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে জংগল পেরিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল।
আস্তানার ভেতরে ওরা দেখতে পেল পাথরের মূর্তি। সামনের চত্বরে কাপেট বিছানো। সে কাপেটের ওপরে ফুল ছড়ানো। ফুলের ওপর পাশাপশি রাখা আছে চওড়া তরবার ও পেতলের থালা।
চত্বরের চারপাশে মশাল জুলছে। চারজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে চার কোণায়। ওদের সারা দেহ অনাবৃত। গাছের দুটি পাতা দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকা। এক জায়গায় শরীরে শাদা চাদর জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে চারজন কাফ্রী।
উম্মে আমারা তখনও নীচের অন্ধকার কামরায়। পুরোহিত তার চুল নিয়ে খেলা করছিল। নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ, জড়ানো কষ্ঠে ও বলে যাচ্ছে, ‘আমি আংগুকের মা। তুমি আংগুকের পিতা। আমাদের সন্তান হবে মিসর এবং সুদানের সম্রাট। ওদেরকে আমার রক্ত পান করতে দাও।
প্রতিটি ঘরে বিলিয়ে দাও আমার সোনালী চুল। তুমি দূরে কেন? কাছে এস।”
আংগুক’ গোত্রের দেবতা। নেশার ঘোরে এক আরব মেয়ে হয়েছে জংলী গোত্রের মা এবং পুরোহিতের স্ত্রী। দেবতার নামে বলি দেয়ার জন্য পুরোহিত নানা রকম রসম রেওয়াজ পালন করছিল।
বারজন কমান্ডো সদস্য পাহাড় বেয়ে এগিয়ে আসছিল। কাঁটা ঝোপে ভরা এবড়ো থেবড়ো পাহাড় পেরুতে কষ্ট হচ্ছিল ওদের। চাঁদ মাথার উপর উঠে এসেছে। গাছের ছায়ার কারণে ওদের দেখা যাচ্ছে না।
ওরা দেখল, পাহাড়ের ওপর চাদের আলোয় দাড়িয়ে আছে এক কাফ্রী। এক হাতে বর্শা, অন্য হাতে ঢাল।
মনে হচ্ছে প্রহরী। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, পেছন থেকে তাকে আক্রমণ করা সম্ভব নয়। আবার সামনাসামনি সংঘর্ষে যাওয়াও ঠিক হবে না। কিন্তু তাকে হত্যা করা জরুরী।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now