বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
অত্যন্ত যত্ন সহকারে নাকের লোম ছিঁড়ছিলাম। নিশ্চিত ছিলাম যে এই দৃশ্য কেউ দেখবে না- রেস্তোরাঁ পুরোই খালি। শৈল্পিক এই কাজে ডুবে যেতে যেতে টেরই পাইনি, মৌরি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ।
মৌরির গলা খাঁকারি আমায় বাস্তব জগতে ফেরালো। ঘাড় ঘুরিয়ে বিব্রত বোধ করলাম বেশ। চেয়ারের নীচে কোনমতে হাত মুছে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বললাম, ‘আরে মৌরি, এসেছ?’
মৌরি তিক্ত দৃষ্টিতে আমার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। লক্ষ্য করলাম, ডান হাতের তর্জনীতে কালোমতন শক্ত কিছু একটা এখনও লেগে আছে। বুড়ো আঙুলের টোকা দিয়ে সেটা উড়িয়ে দিতে হলো।
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন, বসো না।‘
মৌরি আমার মুখোমুখি এসে বসলো।
সদ্য বাইশে পা দেওয়া মৌরির সাথে আমার সম্পর্কের প্রায় এক বছরপূর্তি হতে চললো। উজ্জ্বল শ্যামলা, ছিপছিপে, কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল। ভারী মিষ্টি চেহারা, হাসলে গালে টোল পড়ে। এমনিতে সবসময় হাসিখুশী, কিন্তু আজ কেন যেন হাবভাব বন্ধুভাবাপন্ন মনে হচ্ছে না।
মৌরি বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বললো-
‘শিহাব, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো আমাকে।‘
কিছুটা উদ্বিগ্নভাবেই শুধালামঃ ‘কী প্রশ্ন?’
‘বিপাশা কে?’
এইরে, বাউন্সার ছেড়েছে! বিপাশার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল মৌরির ঠিক আগে। মৌরিকে মোটামুটি বাগে আনার পর ওকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু… ও বিপাশাকে চিনলো কী করে?
‘কথা বলছো না কেন?’
মিনমিনে কন্ঠে জানালাম যে বিপাশা আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড, বাবার বন্ধুর মেয়ে।
‘ও আচ্ছা, আংকেলের ফ্রেন্ড? তা কোন সূত্রে ফ্রেন্ড?’
‘বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলেন একসময়।‘
…মৌরি আমার চোখে চোখ রেখে অবজ্ঞার কাষ্ঠহাসি হাসলো, ঠোঁট একদিকে বাঁকা করে। আমি চোখ সরিয়ে ঈশানকোণের অয়েল পেইন্টিংটার দিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। স্প্যানিশ গিটার হাতে ফুটপাথে বসা এক বৃদ্ধের ছবি; শিল্পী ভাল এঁকেছেন।
‘শোনো শিহাব, বিপাশা আমার খালাতো বোনের ক্লাসমেট ছিল কলেজে। সেদিন বোনের বার্থডে পার্টিতে মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে। আমাকে তো বললো ওর বাবা কলেজের প্রফেসর- ভুল বলেছে বোধহয়, তাই না?’
ধুর ছাই! কতজনের সাথেই তো সম্পর্ক ছিলো! কার বাবা কী করে এত মনে রাখা সম্ভব নাকি! আমি কাঁচুমাঁচু হয়ে বললামঃ
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাইতো! মনে পড়েছে।‘
‘বিপাশার সাথে আমার পুরো পার্টি জুড়েই আলাপ হয়েছে‘… মৌরি ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে যোগ করলো, ‘সবকিছু নিয়েই।‘
‘ও ইয়ে… আচ্ছা।‘
‘তোমার কি আর কিছু বলার আছে?’
‘না মানে… দেখো, পাস্ট ইজ পাস্ট, তাই না?’
‘হ্যাঁ, পাস্ট ইজ পাস্ট। বিপাশার আগে তোমার যেসব পাস্ট ছিলো সেগুলোও শুনেছি। সত্যি বলতে, এগুলো জানতে পেরেই বিপাশা তোমার কাছ থেকে সরে এসেছিলো।’
… এতদিনে পরিষ্কার হলো, আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দেবার পরও বিপাশা কোন উচ্চবাচ্য করেনি কেন। বলদ ধরনের মেয়েটা আমার এত গোপন খবর কীভাবে জানলো কে জানে!
আমি ছলছল চোখে বললামঃ
‘দেখো জান, আমার চোখের দিকে তাকাও। তুমি আমায় বিশ্বাস না করে একটা বাজে মেয়ের কথা বিশ্বাস করছো? এই দিনও দেখতে হলো আমাকে!‘
‘স্টপ বুলশিটিং, শিহাব! ওর কাছে বেশ কিছু স্ক্রীনশট আছে, যেটা হয়তো তুমি জানো না। তোমার সাথে অন্য মেয়েদের চ্যাটের স্ক্রীনশট। ওগুলো আমি কপি করে নিয়েছি। দেখাবো?’
‘ইয়ে… আসলে এই যুগে ফটোশপে…’
বলতে বলতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এসব বিপাশা কোত্থেকে যোগাড় করলো?
মৌরি নাক-চোখ কুঁচকে বললো-
‘ছিঃ! ছিঃ! তোমার দিকে তাকাতেই তো আমার ঘেন্না করছে। এতদিন যে তোমাকে বিশ্বাস করে গিয়েছি, সেটাই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!‘
চুপ করে রইলাম। কিছু বলার নাই।
‘আর শোনো, যাবার আগে দু’একটা সত্যি কথা বলে যাই।‘ মৌরি চোয়াল শক্ত করে, একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলোঃ
‘একটু রেগুলার গোসল কোরো- গায়ের গন্ধে টেকা যায় না। মানুষের গা দিয়ে যে পেঁয়াজের গন্ধ আসতে পারে তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না; এতদিন ভাল ছেলে ভেবে বহু কষ্টে সহ্য করেছি এই জিনিস। আর এভাবে নাকের ময়লা বের করে যেখানে সেখানে মুছে ফেলা কী ধরনের স্বভাব? এই কাজটা তুমি প্রায়ই করো- তোমার কি ধারণা কেউ খেয়াল করে না? শুধু সুন্দর চেহারা আর মিষ্টি কথা দিয়ে সব হয় না। আল্লাহ বাঁচিয়েছে যে তোমার মতন একটা থার্ড ক্লাস খবিসের সাথে ব্রেক-আপ হচ্ছে। আই ফীল সো রিলিভ্ড নাউ।‘
এতক্ষণ আহত হইনি, এবার সত্যি আঘাত পেলাম- বিচ্ছেদের বিরহে নয়, পেঁয়াজের গন্ধের কালিমা লেপনে।
‘এসব কোন ধরনের কথা, মৌরি?’
মৌরি উত্তর না দিয়ে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল।
আমি একজন আশাবাদী মানুষ, সেই সাথে নিজেকে একজন রমণীমোহন পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করতেও ভালোবাসি। মোটেও বাড়িয়ে বলছি না, কেউ চাইলে আমি প্রমাণ দেখাতে পারি। এখন পর্যন্ত আমার স্কোর কত হবে? বিশ? পঁচিশ? ভাবতেই এক চিলতে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হাসি খেলে গেল আমার ঠোঁটে…
সুউচ্চ আশাবাদিতা আর তীব্র নারীবল্লভতা যোগ করে বলতে পারি- এক মৌরি গিয়েছে, হাজার মৌরি আসবে। লোকাল বাসের মত। সুতরাং হতাশ হবার কোন কারণই দেখি না। আমি নব উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে চ্যাংড়া ওয়েটারকে হাঁক মারলাম, ‘এই যে ছোট ভাই, ৩৮ নাম্বার আইটেম একটা। সাথে ফান্টা।‘
পিৎজা আর ফান্টা শেষ করতে করতে আমার নাকের অবশিষ্ট সকল লোম ছেঁড়া হয়ে গেল। মৌরির সাথে আজ আর রিকশায় ঘোরা হলো না। চিকন অথচ তুলতুলে কোমরটা কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখা যেত, সেটা থেকে বঞ্চিত হলাম… এটুকুই আফসোস।
কাল থেকে নতুন বাস ধরা দরকার। নিতু বেশ ক’দিন ধরে বের হতে চাচ্ছিলো, ওকে ফোন দিলেই নিশ্চিত সুড়সুড় করে চলে আসবে। সামান্য মোটা হলেও দেখতে মন্দ না। খরার মৌসুমে এক মুঠো চিড়েকেই বাসমতী চালের পোলাওরূপে গণ্য করতে হবে- বুদ্ধিমানেরা তাই করে।
এদিক-সেদিক একটু ঘুরলাম, একটা কফি শপে কিছুক্ষণ বসে নিজের পর্যবেক্ষণ শক্তি পরখ করে নিলাম। ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটার মত বেজে গেল। ফ্রেশ হয়েই ফোন দিলাম আমার গোলগাল বান্ধবী নিতুকে। বাসের টিকিট করে রাখা দরকার।
‘এই যে আমার ছোট্ট পাখি, কেমন আছো?’
‘হুঁম, ভালো।‘
‘কতদিন তোমার সাথে দেখা হয় না! অনেক মিস করছি তোমাকে। কাল দেখা করবে নাকি?’
‘ইয়ে, শিহাব, আমি নেক্সট কয়েকদিন একটু বিজি আছি।‘
‘ঠিক আছে ফ্রী হলে আমাকে জানিও। তারপর… কেমন যাচ্ছে দিনকাল? ফেসবুকে তোমার সিলেট ট্যুরের ছবি দেখলাম। অনেক শুকিয়ে গিয়েছো (একেবারেই বাজে কথা, প্রকৃতপক্ষে সে আরো মোটা হয়েছে)। তোমার একটা ছবিতে খেয়াল করলাম…’
‘… শিহাব, আমাকে মা ডাকছেন। এখন রাখি, কেমন? খোদা হাফেজ।‘
আমি উত্তরে কিছু বলার আগেই নিতু লাইন কেটে দিলো।
বেশ হতভম্ব হলাম। নিতু তো কখনো এভাবে এক মিনিটের মাথায় ফোন রাখে না! এমন অনাগ্রহের স্বরেও কথা বলে না।
নিতু জাহান্নামে যাক; খুব ভাব বেড়েছে ধুমসীর! এরচে’ চৈতীকে ফোন দিই।
রিং হচ্ছিলো। চৈতী ফোন কেটে দিলো। দিনটাই আসলে খারাপ!
আজ বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, টেম্পো ধরতে হবে। অর্পিতাকে ফোন দেবো নাকি ভাবছিলাম। এমন সময় বন্ধু ইমনের ফোন এলো।
‘দোস্ত, সেই কখন থেকে পাগলের মত ট্রাই করছি তোকে!‘
‘ফোনে চার্জ ছিল না, দশ মিনিট আগে অন করেছি। কী হয়েছে? ‘
‘তুই জানিস না কিছু?’
‘মানে?’
‘ফেসবুকে ঢুকেছিস আজকে?’
‘দুপুরে ঢুকেছিলাম লাস্ট। আরে ঘটনা কী বলবি তো!’… বলতে বলতে তলপেটে অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে ওঠার কারণ রেস্তোরাঁর বাসী খাবার নাকি অন্য কিছু, সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই।
‘দোস্ত, তোর একটা গার্লফেন্ড আছে না, মৌরি? একটু ওর প্রোফাইলে ঢোক। আমি রাখলাম, আল্লাহ হাফেজ।‘
হঠাৎ একটু কেঁপে উঠলাম। কনকনে শীতের রাতে ঘর থেকে বের হলে সহসা যেমন কেঁপে উঠি আমরা, সেভাবে।
দ্রুত ফেসবুকে লগিন করে আবিষ্কার করলাম, ইনবক্সে গোটা বিশেক নতুন মেসেজ। মৌরির প্রোফাইলে ঢুকতে হলো না, নোটিফিকেশনেই পেলাম- “Mouri Zahan tagged you in her note….”
বিশাল লেখা। লেখার শিরোনাম- ‘পেঁয়াজমানব হইতে সাবধান’।
এখন পর্যন্ত লাইক সংখ্যা ২,১০৭। শেয়ার হয়েছে ১,৬১৯ বার। এই অল্প ক’ ঘন্টাতেই!
পুরো লেখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়া সম্ভব হলো না, দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছিলো।
অনুচ্ছেদগুলোর ফাঁকে ফাঁকে, বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পেঁয়াজমানবের কথোপকথনের স্ক্রীনশট দেওয়া। লেখার শেষে পেঁয়াজমানবের হাস্যমুখী ছবি এবং ব্যক্তিগত প্রোফাইলের লিংক।
আমি ঘোলা চোখে পোস্ট আপলোড করার সময়টা খেয়াল করলাম। রাত ৭টা ৪০। রেস্তোরাঁ থেকে মৌরি বের হয়ে যাবার ঠিক ৪০ মিনিট পর।
অর্থাৎ, মৌরির এই বৈরী লেখা তৈরীই ছিল। বাসায় পৌঁছানো মাত্রই অনলাইন প্রকাশনার শুভকর্মটি সম্পন্ন হয়েছে।
রুমের ভেতরেই এক নারীমূর্তির আবছা অবয়ব দেখতে পেলাম। সেই নারীর সবকিছুই আমার সর্বশেষ প্রেমিকার মতন, কেবল মুখমণ্ডল সবুজ আর ডানহাতে বিশাল আকৃতির এক স্ক্রু ড্রাইভার। একেই কি মনোবিদরা হ্যালুসিনেশন বলে থাকেন?
মোবাইল ফোন বাজছে। পিটবুলের নতুন গানের রিংটোন- কী প্রচণ্ড অশুভ শোনাচ্ছে সেই গান!
জানি না কে কল করেছে, জানার ইচ্ছেও নেই। আমি ফোন না ধরে, দেহের একটি স্পর্শকাতর দ্বি-প্রতিসম অঙ্গ ইস্পাতের ন্যায় শক্ত করে শৌচাগারের পথে রওনা হলাম। তলপেটের মৃদু মোচড়খানি কোন ফাঁকে উত্তাল ঢেউতে রূপান্তরিত হয়ে জলোচ্ছ্বাসের পরিণতিতে এগুচ্ছে এতক্ষণ খেয়াল করিনি।
কোথা থেকে যেন পেঁয়াজের গন্ধও ভেসে আসছে, কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ…
লেখক: ফারাবী (২০০০-২০০৬)
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now