বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

বেশি দূরে নয় – ০৩

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X শেফালির হাবা ভাই সীতু ওই বসে আছে দাদুর কাছে। পুজোর ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে দাদু বসে আছে একটা হাঁটু বুকের কাছে জড়ো করে। সীতু হাফ প্যান্টের নীচে তার দুটো আদুর রোগা ঠ্যাং ঝুলিয়ে। পায়ের কাছে টাইগার কুকুর। এই ষোলো বছর বয়সেও বুদ্ধি খুলল না সীতুর। সারাক্ষণ কেবল বড় বড় দাঁত বের করে হাসে। একটা পচা স্কুলে সেই কবে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছিল, আজও সেই থ্রিতেই পড়ছে। সীতু কোনও দিন ফোরে উঠবে না, সবাই জানে। তবু মাসে মাসে বাবা ওর স্কুলের বেতন মিটিয়ে দেয়। তাই স্কুল থেকে ওকে তাড়ায় না। ওর যত ভাব দাদু আর টাইগারের সঙ্গে। এ বাড়িতে একমাত্র দাদুই যা ওকে কাছে ডেকে বসায়, কথাটথা কয়। আর টাইগার সারা দিন সীতুর পিছনে পিছনে ছায়ার মতো লেগে থাকে। বোকা বলে সীতুর তেমন বন্ধু নেই। খেলায়ও নেয় না কেউ ওকে। ও যে বোকা তা টাইগার বুঝতে পারে না, তাই ও টাইগারের সঙ্গেই ছোটাছুটি করে খেলে। আর তার দাদু খুব একাবোকা মানুষ। যেন একটা ফেলে দেওয়া ন্যাকড়ার মতো এক ধারে পড়ে থাকে। ঠাকুরঘরের পিছন দিকটায় একটা খুপরি মতো আছে। ভারী ছোট্টো ঘর। একটা চৌকি এঁটে আর এক চিলতে জায়গা। তেল, মাজন সব জানালার তাকে। ব্যস ওতেই দাদুর হয়ে যায়। ঠাকুমা মারা গিয়ে অবধি দাদু পিছু হটতে হটতে ওইখানে গিয়ে ঠেকেছে। তাকে কারও মনেই পড়ে না। শেফালির পড়ে। দিনে এক বার দু’বার সে গিয়ে দাদুকে দেখে আসে। কথা কয়। তবে শেফালিরও তো কাজ আছে। ক্লাসের পড়া, মায়ের ফরমাস, একটু আড্ডা, একটু মন-খারাপ করে বসে থাকা। এই মন-খারাপটা বড্ড ভাল জিনিস। রাজ্যের অভিমান উঠে আসে বুকে। নাক ফুলে ফুলে ওঠে। কান্না পায়। কার ওপর অভিমান তা বুঝতে পারে না। গোটা দুনিয়াটার ওপর, এই মানবী জন্মের ওপর, প্রীতমের ওপর। সব কিছুর ওপর অভিমান উথলে ওঠে যখন, তখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে যে কী ভালই লাগে। মেয়ে-জন্মের একটা বাধক হল, বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই কেউ না কেউ চোখ পাকিয়ে বলবে, অ্যাই কোথায় যাচ্ছিস? যেন নিজের ইচ্ছেয় কোথাও যাওয়ার নেই তার। এই যে কার্তিকের এই মায়াবী বিকেলে পশ্চিমের খুনখারাপি আকাশের তলায় এক মায়াজাল পাতা হয়েছে, এ কি তার জন্যই নয়? জন্ম থেকেই দেখে আসছে শেফালি, তাদের এই জায়গাটা ভারী দুঃখী জায়গা। জায়গাটার যেন সব সময়ে মুখভার। কখনও হাসি ফোটে না মুখে। ক’দিন আগে রানাঘাটে মাসির বাড়িতে গিয়েছিল শেফালি। কী হাসাখুশি জায়গাটা। সব সময়ে যেন আহ্লাদে গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে সাহস করে বোম্বে রোডের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে যখন যায় শেফালি, তখন মনে হয়, জায়গাটা যেন এক দুষ্টু-দুষ্টু পুরুষ মানুষ। লরির সার দাঁড়িয়ে আছে। ধাবায় কেমন ব্যস্তসমস্ত লোকজন। কেমন সাঁ করে অনেক দূর চলে যাচ্ছে চকচকে সব গাড়ি। বাবা যে কেন বাড়িটা ও দিকে করল না কে জানে। স্টেশনের এ-পাশটা বড্ড পান্তাভাত, ঝিমধরা। —মা একটু আসছি। —কোথায় যাচ্ছিস? —মণিমালাদের বাড়িতে। —দয়া করে তাড়াতাড়ি এসো। সবাই জানে, সে খুব বেশি দূর যাবে না। তারা, মেয়েরা সব অদৃশ্য দড়িতে শক্ত করে বাঁধা। তাদের কোনও দূর নেই। কোনও অনন্ত নেই। এক বাঁধা অবস্থা থেকে আর এক বাঁধা পড়ার জন্যই তারা জন্মায়। কী হল হেনার? তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট মাঠটায় এক শীতকালে বাহাত্তর ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছিল বিনোদ মাল। বাঁশের খুঁটিতে লাইট লাগানো, চব্বিশ ঘণ্টা মাইকে হিন্দি গান, চার দিকে ভিড়ের মধ্যে ঝালমুড়ি, ফুচকা, চানাচুর-বাদামের দোকান বসে গেল। বিনোদ সাইকেল চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। শেফালিও বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে যেত। কিন্তু মজা লাগত না তার। কষ্ট হত রোগাপানা ছেলেটার জন্য। কী কষ্ট ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল করে যাওয়ার মধ্যে! বিনোদের ওই কষ্ট আর পুরুষকার জানালার ফাঁক দিয়ে দিনরাত দেখত হেনা। তারও কষ্ট হত। আর হতে হতেই তার বুক উথলে উঠল। প্রাণ আকুল হল। হাউ হাউ করে কাঁদত। যে দিন বাহাত্তর ঘণ্টা শেষ হল সে দিন বিনোদকে কাঁধে নিয়ে পাড়া ঘোরাল ক্লাবের ছেলেরা। টাকার মালা পরানো হল। বিনোদের জয়ধ্বনিতে কান পাতা দায়। হেনা গিয়ে ছলছলে চোখে তার গলার সোনার চেনটা খুলে পরিয়ে দিয়েছিল বিনোদকে। প্রকাশ্যেই। তাতে একটা কানাকানি শুরু হয়েছিল। আর বাবার হাতে বিশ বছরের মেয়েটা খেয়েছিল বেদম মার। শেষে ওই বিনোদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল হেনা। গিয়ে দেখল বিনোদের আরও একটা বউ আছে, দুটো বাচ্চা এবং হাঁড়ির হাল! বিনোদের সংসারের জন্য সময় নেই। সে কেবল এখানে-সেখানে সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। ওটাই তার রুজি-রোজগার। শখ আহ্লাদ দু’দিনেই মরে গিয়েছিল হেনার। এই বছরখানেক আগে কোলে একটা খোকা নিয়ে বাপের বাড়িতে ফেরত এসেছে। মেয়েদের জীবনটাই ও-রকম। যতই ভালবাসুক না কেন, পুরুষ জাতটাই তো বিশ্বাসঘাতকের জাত। হেনা আজকাল দুঃখ করে বলে, কী বয়স আমার বল! লেখাপড়া করতে পারতাম, গান গাইতে পারতাম। জীবনটাই মাটি হয়ে গেল। কেন যে পোড়া চোখে ওই সাইকেল চালানো দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েদের জীবনটা এ-রকম। তা বোঝে শেফালি। সব বুঝেও ফের ফাঁদে পা দিতেও ইচ্ছে হয়। যত বার ঠকে যাক, ফের ঠকতে রাজি হয়ে যাবে হাসি-হাসি মুখ করে। তারা বড্ড বোকা। তার হাঁদা ভাই সীতুর সঙ্গে সত্যিই কি তার কোনও তফাত আছে? কথাটা ভাবতে ভাবতেই সীতুর ডাক কানে এল, দিদি! এই দিদি! ফিরে দাঁড়িয়ে শেফালি বিরক্ত গলায় বলল, কী হল? —কোথায় যাচ্ছিস? —তাতে তোর কী? —মা ডাকছে। —কেন? —মায়ের হাওয়াই চপ্পলটা ছিঁড়ে গেছে। এক জোড়া কিনে আনতে বলল। —আমার কাছে পয়সা নেই। দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আয়। আমি দাঁড়াচ্ছি। সীতু সত্যিই দৌড়োল। বুকটায় এক মুঠো আবির কে যেন ছড়িয়ে দিল হঠাৎ। ভিতরটা যেন রঙিন। এক জোড়া হাওয়াই চটি তাকে গঙ্গারামপুর অবধি নিয়ে যাবে। ওইখানে এক মানুষ-জন্তু, এক শ্রমিক-পুরুষ, এক উদাস উদ্যমী তাকে হেলাফেলা করবে বলে বসে আছে নিজের দোকানে। চেনেও না তাকে। না চিনল তো বয়েই গেল। তবু কি আমি তোমার চোখের বালি না হয়ে থাকতে পারি? অবহেলা কি আজকের? সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই তো আমরা তোমাদের হেলাফেলার জিনিস! কখনও কখনও আদর করে বুকে তুলে নাও বটে, তার পরই শোঁকা ফুলের মতো ফেলে দাও, আর ফিরেও তাকাও না। তবু আমরা তো বার বার অচ্ছেদ্দা সয়েও তোমাদের জন্যই ফুটে থাকি। ছুটতে ছুটতেই এল সীতু, তার পিছনে টাইগার। দিদি, আমাকে সঙ্গে নিবি? শেফালি ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখল। গায়ে একখানা হলুদ ডোরাকাটা জামা, পরনে হাফপ্যান্ট। রোগা ল্যাকপ্যাকে চেহারা। কী জানি একটু মায়া হল। বলল, চল। মাঝখানে দুটো ঝুড়ি আর ধার ঘেঁষে দু’জনে বসা, তার মধ্যেই ঠেলে ঘেঁষটে ভ্যানগাড়িতে উঠে পড়ল ভাইবোন। সীতু হাসছে, যেমন সব সময়ে হাসে। শেফালি ধমক দিয়ে বলল, দাঁত বন্ধ কর তো। সব সময় হাসি আসে কেন তোর? লোকে বোকা বলবে না? —চপ খাওয়াবি দিদি? টাইগার ভ্যানগাড়ির পিছনে ছুটছে। গঙ্গারামপুর অবধি যাবে। যাক। সীতু যে বোকা সেটা টাইগার বুঝতে পারে না। তাই সীতুর সঙ্গে থাকে সব সময়ে। —ইস্কুল থেকে ফিরে ভাত খাসনি? —খেয়েছি তো! —তবে আবার চপ কীসের? —খাওয়াবি না? —আচ্ছা খাস। —দিদি। —হুঁ। —আমাকে তোর স্কুলে ভর্তি করে নিবি? —আমার স্কুলে! পাগল নাকি? আমাদের তো মেয়েদের স্কুল। —মেয়েরাই ভাল। ছেলেগুলো বড় পিছনে লাগে। —তুই তো বোকা, সবাই বোকাদের পিছনে লাগে। —তোর স্কুলে আমাকে নেবে না? —তাই নেয় কখনও? চুপ কর তো! —ঠোক্কর মারে যে! এই দ্যাখ না, মাথা ফুলে গেছে। শেফালি গম্ভীর হয়ে রইল। সীতুটাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। ভারী লজ্জা করে। অপ্রস্তুত হতে হয়। —চুপচাপ বসে থাক। বকবক করতে হবে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সীতু ফের ডাকে, দিদি! —হুঁ। —তোর বিয়ে হবে না? —চুপ কর তো! —তোর কার সঙ্গে বিয়ে হবে জানিস? —কার সঙ্গে? —ফুটুদার সঙ্গে। —সে আবার কে? —আছে এক জন। —তোকে কে বলল? —আমি জানি। —ভ্যাট। কোথা থেকে এক ফুটুদা জুটিয়েছে। বোকা কোথাকার। অ্যাই ফুটুদাটা কে বল তো? —সে আছে। —মারব থাপ্পড়। কোন বদমাশের পাল্লায় পড়েছিস বল তো! খবরদার ও সব ফুটুদা মুটুদাকে একদম লাই দিবি না। —ফুটুদা তো খুব ভাল। —তোর আবার ভাল মন্দ। একটু যদি বুদ্ধি থাকে। গঙ্গারামপুরে নেমে পড়ল দু’জন। গঙ্গারামপুর এলেই বুকের ভিতরে কী যেন একটু চলকে ওঠে শেফালির। এ বড় দুষ্টু জায়গা। এ বড় পাগল জায়গা। এখানেই মরবে এক দিন শেফালি।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫২২ জন


এ জাতীয় গল্প

→ কিয়ামত বেশি দূরে নয়
→ বেশি দূরে নয় – ১০ (শেষ পর্ব)
→ বেশি দূরে নয় – ০৯
→ বেশি দূরে নয় – ০৮
→ বেশি দূরে নয় – ০৭
→ বেশি দূরে নয় – ০৬
→ বেশি দূরে নয় – ০৫
→ বেশি দূরে নয় – ০৪
→ বেশি দূরে নয় – ০২
→ বেশি দূরে নয় – ০১
→ বেশি দূরে নয় – ১০ (শেষ)
→ বেশি দূরে নয় – ০৯
→ বেশি দূরে নয় – ০৮
→ বেশি দূরে নয় – ০৭

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now